গাজীপুরে বিএনপির হরতালে ১৪৪ ধারা ভাঙলো ছাত্রলীগ by নিয়াজ মাহমুদ ও ইকবাল আহমেদ সরকার
১৪৪ ধারা ভাঙলো ছাত্রলীগ। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মহাসমাবেশস্থল ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজের কয়েক শ’ গজের মধ্যেই গাজীপুর চৌরাস্তায় দিনভর মহড়া দিয়েছে তারা। মিছিল করেছে দফায় দফায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য সেখানে উপস্থিত থাকলেও বাধা দেয়নি ছাত্রলীগকর্মীদের। অন্যদিকে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে থেকে শহর আওয়ামী লীগ সভাপতি এডভোকেট ওয়াজউদ্দিন মিয়া ও জেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক দেলোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে হরতালবিরোধী মিছিল বের করা হয়। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগ খ- খ- মিছিল বের করে হরতালের বিপক্ষে। দুপুরে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউল্লাহ ম-লসহ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা চৌরঙ্গী মোড়ে অবস্থান নেন। হরতালের সময় গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় গাজীপুর সিটি মেয়র অধ্যাপক এম এ মান্নান ও জেলা বিএনপির সভাপতি ফজলুল হক মিলনসহ ৩০ নেতাকর্মীর নামে জয়দেবপুর থানায় মামলা হয়েছে। ২০ দলীয় জোটের হরতাল ঠেকাতে ছাত্রলীগের পাশাপাশি মাঠে নামে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও মহিলা লীগ। উল্লেখ্য, অনির্দিষ্টকালের জন্য নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ১৪৪ ধারা জারির প্রতিবাদে গতকাল গাজীপুর জেলায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছিল বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দল। একই ঘটনার প্রতিবাদে সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল কর্মসূচিও দিয়েছে বিরোধী জোট। ওদিকে হরতালের সমর্থনে সকালে শ্রীপুরের সিঅ্যান্ডবি এলাকায় একটি মিছিল বের করে বিএনপি নেতা-কর্মীরা। পরে সকাল ৯টার দিকে বড় বাড়ি এলাকায় ১টি সিএনজি ভাঙচুর করে বিক্ষুব্ধ হরতালকারীরা। পুলিশ তাদের ধাওয়া দিলে হরতালকারীরা আরও কয়েকটি যানবাহন ভাঙচুর করে। সকালে জেলা শহরের ছায়াবীথি এলাকায় হরতালের পক্ষে বিক্ষোভ মিছিল করেছে শ্রমিক দল ও ছাত্রদল। এছাড়া কালিগঞ্জ উপজেলায় হরতালকারীরা মিছিল বের করার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের ধাওয়া দিয়ে সরিয়ে দেয়। বেলা ১২টার দিকে টঙ্গী থানা বিএনপি হরতালের পক্ষে ও থানা আওয়ামী লীগ হরতালের বিপক্ষে মিছিল বের করে। কালিয়াকৈর উপজেলা ও পৌর বিএনপির উদ্যোগে পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন কবীর খানের নেতৃত্বে হরতালের সমর্থনে একটি বিশাল মিছিল সাহেব বাজার থেকে শুরু হয়ে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে পুনরায় সাহেব বাজার গিয়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। কালিয়াকৈর পৌরসভার মেয়র মজিবুর রহমানের নেতৃত্ব্বে কালিয়াকৈর বাজার হতে নেতাকর্মী নিয়ে একটি মিছিল ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে উঠতে চাইলে পুলিশের বাধার মুখে শেষ হয়। পুলিশ ও বিজিবির কড়া নজরদারির কারণে অনেকটা নিরুত্তাপভাবেই পালিত হয়েছে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল। কয়েকটি জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে পিকেটিং ও কয়েকটি যানবাহন ভাঙচুর করা হলেও হরতালকারীদের বড় কোন তৎপরতা দেখা যায়নি। হরতালের সমর্থনে রাজপথে দেখা যায়নি বিএনপিসহ জোটের কোন সিনিয়র নেতাকে। তবে বিএনপি নেতা হুমায়ুন কবির খান অভিযোগ করেন, ছাত্রলীগ পুলিশের সামনেই ১৪৪ উপেক্ষা করে অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিয়েছে। কিন্তু বিএনপি নেতাকর্মীদের শান্তিপূর্ণ মিছিলও করতে দেয়া হচ্ছে না। জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক ডা. মাজহারুল আলম, সদর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সুরুজ আহম্মেদ ও সিটি কাউন্সিলর হাসান আজমল ভুঁইয়া জানান, ১৪৪ ধারা জারির কারণে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে তারা ভাওয়াল কলেজ এলাকায় মিটিং-মিছিল করেননি। তবে সাধারণ জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে সারা জেলায় হরতাল পালন করেছে। ২০ দলীয় নেতাকর্মীদের পিকেটিংয়ে দেখা না গেলেও হরতালবিরোধী কর্মসূচি নিয়ে মাঠে ছিল আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও বিভিন্ন সহযোগী সংগঠন। ওদিক, কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে ২০ দলের ডাকা সকাল-সন্ধ্যা হরতালে দূরপাল্লার কোন পরিবহন চলাচল করেনি। তবে হালকা কিছু যানচলাচল করতে দেখা গেছে দিনভর। নগরীর সড়কে রিকশা ছাড়া ভারি যানবাহন চলাচল করতে দেখা যায়নি। বেশির ভাগ দোকানপাট বন্ধ ছিল। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু দোকানপাট ও কলকারখানা খুলতে দেখা যায়। এদিকে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে শুক্রবার রাতেই চার প্লাটুন বিজিবি সদস্য মোতায়েন করা হয়। সভাস্থল ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ মাঠ ছাড়াও আশপাশের এলাকা, গাজীপুর চান্দনা, চৌরাস্তা, কালিয়াকৈরের চন্দ্রা শ্রীপুরের মাওনাসহ বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন ছিল অতিরিক্ত পুলিশ। হরতাল চলাকালে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা তারা বিভিন্ন সড়কে টহল দেন। এদিকে গাজীপুরে সমাবেশকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা সৃষ্টির পর থেকেই বিএনপি কার্যালয় ছিল পুলিশের নিয়ন্ত্রণে। গতকালও সকাল থেকে শহরের জয়দেবপুরস্থ জেলা বিএনপি কার্যালয়ের সামনে দেখা গেছে পুলিশি পাহারা। দলটির কাউকেই ভিড়তে দেয়া হয়নি সেখানে। তবে দুপুর ৩টায় দলীয় কার্যালয়ে আসেন জেলা বিএনপির উপদেষ্টা এডভোকেট ড. মো. সহিদুজ্জামান। হরতালের সময় নগরের বড় বাড়ি এলাকার ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে গাজীপুর রিপোর্টাস ক্লাবের সভাপতি রোমান শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক এম এ ফরিদ হোসেনসহ সাংবাদিকদের বহনকারী একটি মাইক্রোবাসসহ কয়েকটি যানবাহন ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় সেখান থেকে তুলা মিয়া, জুয়েল ও জয়নাল নামে তিনজনকে আটক করে পুলিশ। এ ঘটনায় রিপোর্টার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এমএ ফরিদ বাদী হয়ে জয়দেবপুর থানায় একটি মামলা করেছেন। মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও গাজীপুর সিটি মেয়র অধ্যাপক এমএ মান্নান ও জেলা বিএনপির সভাপতি ফজলুল হক মিলনসহ ৩০ নেতাকর্মীর নামোল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরও ১৫-২০ জনকে আসামি করা হয়। সিনিয়র দুই নেতাকে করা হয়েছে হুকুমের আসামি। হরতাল শেষে গাজীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন মানবজমিনকে বলেন, আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে ১৪৪ জারি করে। এটা গণতন্ত্রের ভাষা নয়। তাই গাজীপুরবাসী ১৪৪ ধারা ভেঙে শত বাধা উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছে। হরতাল সফল হয়েছে দাবি করে গাজীপুরবাসীকে ধন্যবাদ জানান তিনি। এ সময় টঙ্গী থানা বিএনপি কার্যালয়ে হামলা ও আগুন দেয়ার সঙ্গে জড়িত আওয়ামী দুর্বৃত্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও গ্রেপ্তার এবং গ্রেপ্তারকৃত বিএনপি নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবি জানিয়েছেন জেলা বিএনপির সভাপতি। ফজলুল হক মিলন বলেন, কালীগঞ্জ উপজেলা থেকে তাদের ৪-৫ জন নেতা-কর্মীকে হরতাল চলাকালে আটক করে পুলিশ। ২০ দলের হরতাল প্রসঙ্গে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. নুরুল ইসলাম জানান, হরতালে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে চার প্লাটুন বিজিবি সদস্য মোতায়েন করা হয়। সকাল থেকে তারা বিভিন্ন এলাকায় টহল দিতে থাকে। গাজীপুরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ ভাওয়াল কলেজ এলাকা ঘুরে সাংবাদিকদের বলেছেন, ১৪৪ ধারা জারির পর দুই পক্ষই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েছে। কোন পক্ষ এই এলাকায় মিছিল-মিটিং করেনি। আর হরতালেরও তেমন প্রভাব পড়েনি। দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল করছে। এদিকে শুক্রবার রাতে টঙ্গী থানা বিএনপি কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। এতে অফিসের দরজা ও আসবাব পুড়ে যায়। পরে টঙ্গী ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা রাত ১২টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এছাড়া শুক্রবার রাতে দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হাসান উদ্দিন সরকার ও শ্রমিক দলের গাজীপুর জেলা সভাপতি সালাউদ্দিন সরকারের টঙ্গীর বাসাসহ সিনিয়র নেতাদের বাসায় তল্লাশি চালিয়েছে পুলিশ। এ সময় তাদের আটক করতে না পারলেও তাদের বাসা থেকে খালেদা জিয়ার সমাবেশের বিপুল পরিমাণ ব্যানার পোস্টার ও লিফলেট উদ্ধার করা হয়।
No comments