ক্রীতদাস-মনোদাস-রাজা নয় মানুষ হতে হবে by মোঃ মাহমুদুর রহমান
দেশের মানুষ কেমন আছে, এ বিষয়ে জানতে
চাওয়া হলে আমাদের ভাগ্যবিধাতারা উত্তর দেবেন, যার যেভাবে সুবিধা বা প্রয়োজন
সেভাবে। অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে দেশের মানুষ ভালো আছে বলে এক পক্ষ দাবি
করে। তাদের মতে আর্থিক সচ্ছলতা, প্রযুক্তির ব্যবহার, সামাজিক শান্তি ও
আইনশৃংখলা পরিস্থিতি বিচারে দেশ এখন সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আছে। এদের কথা
শুনলে মনে হবে মধ্যযুগের কবি ভারতচন্দ্রের প্রার্থনা ‘আমার সন্তান যেন থাকে
দুধে ভাতে’ অনুযায়ী সেই পরম কাক্সিক্ষত অবস্থা বিরাজ করছে এখন দেশে। অপর
পক্ষের সঙ্গে কথা বললে মনে হবে, স্বাধীনতার পর থেকে সবচেয়ে নিকৃষ্ট সময় পার
করছে দেশের মানুষ। শৃংখলিত রাজনীতি, মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিপন্ন,
বিনিয়োগে স্থবিরতা ও আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতিতে দেশের মানুষ
শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় দিনাতিপাত করছে। রাজনৈতিক বলয়ের বাইরে কোনো এনজিও
কর্মকর্তার উত্তর হবে- শিক্ষা, দারিদ্র্য, মা-শিশুমৃত্যুর হার, স্যানিটেশন
সুবিধাসহ অন্যান্য সামাজিক সূচকের বিবেচনায় এখনও অনেক কাজ করতে হবে।
আসলে এদের সবার কথাই অনেকটা সত্য। অবস্থানগত কারণে যার যেভাবে প্রয়োজন সেভাবেই বর্ণনা দেয়া হয়ে থাকে। নিজ স্বার্থের বিপক্ষে যায় এমন কোনো তথ্য এরা কেউই উল্লেখ করতে চান না। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে জরিপের ফল প্রকাশিত হয়ে থাকে। এগুলোও পুরো দৃশ্যপট সামনে তুলে ধরতে পারে না বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে। সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্ব ক্রীতদাস সূচকে বাংলাদেশ ১৬৭টি দেশের মধ্যে ৫৯তম অবস্থানে থাকলেও মোট দাসের সংখ্যা ৬ লাখ ৮০ হাজার ৯০০। এ হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান নবম এবং আমাদের প্রতিবেশী ভারত প্রথম, যেখানে বিশ্বের আধুনিক ক্রীতদাসদের প্রায় অর্ধেক বসবাস করছে। অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক সংগঠন ‘ওয়াক ফ্রি ফাউন্ডেশন’ জরিপটি ২০১৩ সাল থেকে পরিচালনা করছে। বিশ্বে ক্রীতদাস প্রথার অবসান হলেও নতুন আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় কিছু কিছু মানুষের জীবন এমন পর্যায়ে আছে যাকে স্বাভাবিক জীবন না বলে তারা আধুনিক ক্রীতদাসের জীবন বলছে। বাংলাদেশেও বিভিন্ন পেশায় এরকম প্রায় ৭ লাখ মানুষ রয়েছে বলে তাদের জরিপে ধরা পড়েছে। চিংড়ি খাত, গার্মেন্ট খাত, ইটভাটা, নির্মাণ খাত, ঋণের জালে আটকানো, জোরপূর্বক যৌনতায় বাধ্যকরাসহ বিভিন্ন খাতের অনেক শ্রমিকের জীবনকে আধুনিক ক্রীতদাসের জীবন বলা হয়েছে। বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়া এবং তাদের জীবনও জরিপে স্থান পেয়েছে। জরিপের হিসাবে উল্লিখিত সংখ্যার সঙ্গে যে কারও দ্বিমতের সুযোগ থাকলেও বিষয়টির গুরুত্বের বিষয়ে দ্বিমতের সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।
জরিপের আওতার বাইরে আমাদের দেশে আরও একটি গ্রুপ রয়েছে যারা বেঁচে থাকার জন্য নয়, লাইফ স্ট্যাটাসকে ধরে রাখার জন্য দাসের মতো জীবনযাপন করছে। এদের বাইরের অবয়ব দেখলে দাস নয়, মনিবই মনে হয়। জীবন ধারণের প্রয়োজনে ন্যূনতম অর্থের জন্য এরা দাস নয়। মূলত ব্যক্তিত্ব, সততা ও দৃঢ় মনোবলের অভাব এবং অতিরিক্ত লোভ এবং অস্বাভাবিক চাহিদার কারণে নিজের অজান্তেই নিজেকে দাস হিসেবে উপস্থাপন করে থাকেন তারা। এ শ্রেণীর মধ্যে রয়েছেন রাজনীতিক, আমলা, বেসরকারি খাতের চাকরিজীবী ও বড় বড় ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা। যখন কোনো রাজনীতিক দলীয় পদ-পদবি বা সরকারি সুবিধা ধরে রাখার জন্য দল বা দলের নেতা-নেত্রীদের অন্যায্য কোনো সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেন না বা ভিন্নভাবে বললে অনুগত দাসের মতো মেনে নেন, তখন তাকে স্বাধীন মানুষ বিবেচনা করা কঠিন। পুলিশ, আমলাসহ সরকারি কর্মকর্তারা যখন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বেআইনি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেন লোভনীয় পোস্টিং ও প্রমোশনের জন্য, তখন তারা নিজেরাই নিজেদের নাম স্বাধীন মানুষের তালিকা থেকে সরিয়ে নেন। এভাবে অন্যান্য পেশার মানুষরাও আমাদের দেশে নিজের অজান্তেই দাসত্বের জীবন বেছে নেন। অবশ্য এ শ্রেণীকে ক্রীতদাস বলা যাবে না। কারণ এরা জীবিকার জন্য দাসত্বকে বরণ করেনি। চাকরি, ব্যবসা বা রাজনৈতিক পদ ছেড়ে দিলেও এদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুযোগ রয়েছে। হয়তো বর্তমান স্ট্যাটাস ধরে রাখতে পারবে না। তাই এদের ক্রীতদাস না বলে ‘মনোদাস’ বলাই ভালো। অনেকেই আবার নিজের অভ্যাসের তাঁবেদারি করে থাকেন। এরাও মনোদাসের অন্তর্ভুক্ত। তাই ভালোভাবে তাকালে ‘মনোদাস’ আর ক্রীতদাসের বাইরে দেশে মুক্ত কোনো মানুষের সন্ধান পাওয়া কঠিন। ‘Man is born free and everywhere he is in chains’ দার্শনিক রুশোর এ বক্তব্যটি সব সমাজেই কোনো না কোনোভাবে মিলে যায়।
স্বেচ্ছায় যারা গলায় গোলামির রশি লাগায় তাদের মুক্ত করা কঠিন। কিন্তু যারা শুধু বেঁচে থাকার জন্য ক্রীতদাসের জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে, তাদের রক্ষা করা সবারই দায়িত্ব। এ দায়িত্ববোধকে জাগ্রত করাই হয়তো ‘ওয়াক ফ্রি ফাউন্ডেশন’ পরিচালিত জরিপের উদ্দেশ্য। সংগঠনটি কিছু পরামর্শও দিয়েছে সরকারকে। আইনি কাঠামো পরিবর্তন, কাজের পরিবেশ ও শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় তদারকিসহ বিভিন্ন সুপারিশ করা হয়েছে। সরকার এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করলে কর্মরত শ্রমিকদের দাসত্বের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে। তবে সমস্যার পুরোপুরি সমাধান হবে না।
কারণ আমাদের দেশে বেকার সমস্যার সমাধানে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান ব্যতীত মানুষের জীবনমান উন্নত করা সম্ভব নয়। শিক্ষিত বেকার তরুণদের মিছিল যে কত দীর্ঘ তা বিসিএসসহ যে কোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় একটি পদের বিপরীতে শত শত আবেদনের দিকে তাকালেই সহজে অনুমান করা যায়। বেসরকারি খাতে ব্যাংক ও কিছু এনজিও ছাড়া কাজের খুব একটা সুযোগ নেই। চাকরির আশা বাদ দিয়ে নিজে উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যবসা বা উৎপাদনমূলক কাজ শুরু করাও কঠিন। পুঁজির অভাব, সীমিত অবকাঠামো সুবিধা, আইনি সমস্যা ও আইনশৃংখলা পরিস্থিতি যে কোনো উদ্যোক্তাকে ঝুঁকি নিতে নিরুৎসাহিত করে। ফলে লাখ লাখ বেকার তরুণের সামনে একটি পথই খোলা থাকে, তা হচ্ছে বিদেশ গমন। বহির্বিশ্বের চাকরির বাজার নির্ভর করে শ্রমিকদের দক্ষতা ও চাকরিদাতা দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের দেশের সম্পর্কের ওপর। মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়াই আমাদের প্রধান শ্রমবাজার। দীর্ঘদিন থেকে শ্রমবাজারগুলো বাংলাদেশী শ্রমিকদের ব্যাপারে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দেখাচ্ছে। ফলে দেশে কর্মহীন মানুষের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে মানুষকে ক্রীতদাসে পরিণত করা খুব কঠিন কাজ নয়।
এরকম একটি অবস্থায় দেশের মানুষ সরকারের কোনো সহযোগিতা ছাড়াই নিজে নিজের কর্মসংস্থানের জন্য ভয়ংকর ঝুঁকি নিচ্ছে। কিছুদিন আগে মিডিয়ায় খবর এলো কিভাবে টেকনাফ থেকে নৌকা ও ট্রলারে চেপে বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ে জীবন সঁপে দিচ্ছে শ্রমিকরা থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য। এরও কিছুদিন আগে খবর এসেছে এসব হতভাগ্য যাত্রীর একটি অংশ থাইল্যান্ডের জঙ্গলে ক্রীতদাস হিসেবে মানবেতর জীবনযাপন করছে। যারা সমুদ্রের প্রকৃতি ও ভয়ংকর সব প্রাণী এবং থাইল্যান্ডের আদম পাচারকারী চক্রের হাত থেকে রেহাই পেয়ে মালয়েশিয়ার ভূ-ভাগে পা রাখতে সমর্থ হয়, তারাও অবৈধভাবে অনেকটা ক্রীতদাসের জীবনযাপন করে। এভাবে আমরা ঘরে-বাইরে আধুনিক ক্রীতদাস হচ্ছি শুধু ‘মনোদাস’দের সঠিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে আন্তরিকতার অভাবে।
আমাদের দুর্ভাগ্য এ দেশের রাজনীতি মুক্তভাবে তার গতিপথ ঠিক করতে পারেনি। পারলে হয়তো জনগণের দিকে সঠিকভাবে খেয়াল করার সুযোগ পেতেন রাজনীতিকরা। এখন তাদের প্রতিনিয়ত ক্ষমতায় থাকা বা যাওয়ার জন্য শক্তিশালী দেশগুলোর তাঁবেদারির চিন্তা মাথায় রাখতে হয়। জনগণের তাঁবেদারি করার সময় একদম তাদের হাতে নেই। আগে মাঝে মাঝে জনগণকে খুশি করার জন্য অনেক চটকদার কথা বলতেন তারা। এখন আর এগুলো বলাও লাগবে না হয়তো। কারণ ভোটের অবস্থা ভবিষ্যতেও ৫ জানুয়ারির মতো হলে দৃশ্যপট থেকে জনগণ পুরোপুরি মাইনাস হয়ে যাবে। তখন দেশে তাঁবেদারি বা দাসত্বের দুষ্টচক্রই অবশিষ্ট থাকবে। রাজনীতিকরা পরাশক্তি ও প্রতিবেশী দেশগুলোর তাঁবেদারি করবে। দেশের পুলিশ ও প্রশাসন বিদ্যমান আইনের নয় রাজনীতিকদের তাঁবেদারি করবে। দুর্ভাগা জনগণ সামনে যাকে পাবে তারই দাসত্ব মেনে নেবে। মজার বিষয় হচ্ছে, আমরা সবাই নিজেদের গণ্ডির মধ্যে নিজেকে মনিব বা রাজা ভাবতে পছন্দ করি। হয়তো দাসত্বের কারণে সৃষ্ট মনোবৈকল্য বা যন্ত্রণা উপশমের জন্য। তাইতো আমরা গাইতে পছন্দ করি কবিগুরুর গান, ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে’।
মনোদাস, ক্রীতদাস কিংবা রাজা না হয়ে প্রকৃত মানুষ হতে আমাদের আর কতদিন লাগবে তা ভবিষ্যতই বলে দেবে।
মোঃ মাহমুদুর রহমান : ব্যাংকার
আসলে এদের সবার কথাই অনেকটা সত্য। অবস্থানগত কারণে যার যেভাবে প্রয়োজন সেভাবেই বর্ণনা দেয়া হয়ে থাকে। নিজ স্বার্থের বিপক্ষে যায় এমন কোনো তথ্য এরা কেউই উল্লেখ করতে চান না। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে জরিপের ফল প্রকাশিত হয়ে থাকে। এগুলোও পুরো দৃশ্যপট সামনে তুলে ধরতে পারে না বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে। সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্ব ক্রীতদাস সূচকে বাংলাদেশ ১৬৭টি দেশের মধ্যে ৫৯তম অবস্থানে থাকলেও মোট দাসের সংখ্যা ৬ লাখ ৮০ হাজার ৯০০। এ হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান নবম এবং আমাদের প্রতিবেশী ভারত প্রথম, যেখানে বিশ্বের আধুনিক ক্রীতদাসদের প্রায় অর্ধেক বসবাস করছে। অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক সংগঠন ‘ওয়াক ফ্রি ফাউন্ডেশন’ জরিপটি ২০১৩ সাল থেকে পরিচালনা করছে। বিশ্বে ক্রীতদাস প্রথার অবসান হলেও নতুন আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় কিছু কিছু মানুষের জীবন এমন পর্যায়ে আছে যাকে স্বাভাবিক জীবন না বলে তারা আধুনিক ক্রীতদাসের জীবন বলছে। বাংলাদেশেও বিভিন্ন পেশায় এরকম প্রায় ৭ লাখ মানুষ রয়েছে বলে তাদের জরিপে ধরা পড়েছে। চিংড়ি খাত, গার্মেন্ট খাত, ইটভাটা, নির্মাণ খাত, ঋণের জালে আটকানো, জোরপূর্বক যৌনতায় বাধ্যকরাসহ বিভিন্ন খাতের অনেক শ্রমিকের জীবনকে আধুনিক ক্রীতদাসের জীবন বলা হয়েছে। বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়া এবং তাদের জীবনও জরিপে স্থান পেয়েছে। জরিপের হিসাবে উল্লিখিত সংখ্যার সঙ্গে যে কারও দ্বিমতের সুযোগ থাকলেও বিষয়টির গুরুত্বের বিষয়ে দ্বিমতের সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।
জরিপের আওতার বাইরে আমাদের দেশে আরও একটি গ্রুপ রয়েছে যারা বেঁচে থাকার জন্য নয়, লাইফ স্ট্যাটাসকে ধরে রাখার জন্য দাসের মতো জীবনযাপন করছে। এদের বাইরের অবয়ব দেখলে দাস নয়, মনিবই মনে হয়। জীবন ধারণের প্রয়োজনে ন্যূনতম অর্থের জন্য এরা দাস নয়। মূলত ব্যক্তিত্ব, সততা ও দৃঢ় মনোবলের অভাব এবং অতিরিক্ত লোভ এবং অস্বাভাবিক চাহিদার কারণে নিজের অজান্তেই নিজেকে দাস হিসেবে উপস্থাপন করে থাকেন তারা। এ শ্রেণীর মধ্যে রয়েছেন রাজনীতিক, আমলা, বেসরকারি খাতের চাকরিজীবী ও বড় বড় ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা। যখন কোনো রাজনীতিক দলীয় পদ-পদবি বা সরকারি সুবিধা ধরে রাখার জন্য দল বা দলের নেতা-নেত্রীদের অন্যায্য কোনো সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেন না বা ভিন্নভাবে বললে অনুগত দাসের মতো মেনে নেন, তখন তাকে স্বাধীন মানুষ বিবেচনা করা কঠিন। পুলিশ, আমলাসহ সরকারি কর্মকর্তারা যখন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বেআইনি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেন লোভনীয় পোস্টিং ও প্রমোশনের জন্য, তখন তারা নিজেরাই নিজেদের নাম স্বাধীন মানুষের তালিকা থেকে সরিয়ে নেন। এভাবে অন্যান্য পেশার মানুষরাও আমাদের দেশে নিজের অজান্তেই দাসত্বের জীবন বেছে নেন। অবশ্য এ শ্রেণীকে ক্রীতদাস বলা যাবে না। কারণ এরা জীবিকার জন্য দাসত্বকে বরণ করেনি। চাকরি, ব্যবসা বা রাজনৈতিক পদ ছেড়ে দিলেও এদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুযোগ রয়েছে। হয়তো বর্তমান স্ট্যাটাস ধরে রাখতে পারবে না। তাই এদের ক্রীতদাস না বলে ‘মনোদাস’ বলাই ভালো। অনেকেই আবার নিজের অভ্যাসের তাঁবেদারি করে থাকেন। এরাও মনোদাসের অন্তর্ভুক্ত। তাই ভালোভাবে তাকালে ‘মনোদাস’ আর ক্রীতদাসের বাইরে দেশে মুক্ত কোনো মানুষের সন্ধান পাওয়া কঠিন। ‘Man is born free and everywhere he is in chains’ দার্শনিক রুশোর এ বক্তব্যটি সব সমাজেই কোনো না কোনোভাবে মিলে যায়।
স্বেচ্ছায় যারা গলায় গোলামির রশি লাগায় তাদের মুক্ত করা কঠিন। কিন্তু যারা শুধু বেঁচে থাকার জন্য ক্রীতদাসের জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে, তাদের রক্ষা করা সবারই দায়িত্ব। এ দায়িত্ববোধকে জাগ্রত করাই হয়তো ‘ওয়াক ফ্রি ফাউন্ডেশন’ পরিচালিত জরিপের উদ্দেশ্য। সংগঠনটি কিছু পরামর্শও দিয়েছে সরকারকে। আইনি কাঠামো পরিবর্তন, কাজের পরিবেশ ও শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় তদারকিসহ বিভিন্ন সুপারিশ করা হয়েছে। সরকার এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করলে কর্মরত শ্রমিকদের দাসত্বের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে। তবে সমস্যার পুরোপুরি সমাধান হবে না।
কারণ আমাদের দেশে বেকার সমস্যার সমাধানে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান ব্যতীত মানুষের জীবনমান উন্নত করা সম্ভব নয়। শিক্ষিত বেকার তরুণদের মিছিল যে কত দীর্ঘ তা বিসিএসসহ যে কোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় একটি পদের বিপরীতে শত শত আবেদনের দিকে তাকালেই সহজে অনুমান করা যায়। বেসরকারি খাতে ব্যাংক ও কিছু এনজিও ছাড়া কাজের খুব একটা সুযোগ নেই। চাকরির আশা বাদ দিয়ে নিজে উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যবসা বা উৎপাদনমূলক কাজ শুরু করাও কঠিন। পুঁজির অভাব, সীমিত অবকাঠামো সুবিধা, আইনি সমস্যা ও আইনশৃংখলা পরিস্থিতি যে কোনো উদ্যোক্তাকে ঝুঁকি নিতে নিরুৎসাহিত করে। ফলে লাখ লাখ বেকার তরুণের সামনে একটি পথই খোলা থাকে, তা হচ্ছে বিদেশ গমন। বহির্বিশ্বের চাকরির বাজার নির্ভর করে শ্রমিকদের দক্ষতা ও চাকরিদাতা দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের দেশের সম্পর্কের ওপর। মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়াই আমাদের প্রধান শ্রমবাজার। দীর্ঘদিন থেকে শ্রমবাজারগুলো বাংলাদেশী শ্রমিকদের ব্যাপারে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দেখাচ্ছে। ফলে দেশে কর্মহীন মানুষের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে মানুষকে ক্রীতদাসে পরিণত করা খুব কঠিন কাজ নয়।
এরকম একটি অবস্থায় দেশের মানুষ সরকারের কোনো সহযোগিতা ছাড়াই নিজে নিজের কর্মসংস্থানের জন্য ভয়ংকর ঝুঁকি নিচ্ছে। কিছুদিন আগে মিডিয়ায় খবর এলো কিভাবে টেকনাফ থেকে নৌকা ও ট্রলারে চেপে বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ে জীবন সঁপে দিচ্ছে শ্রমিকরা থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য। এরও কিছুদিন আগে খবর এসেছে এসব হতভাগ্য যাত্রীর একটি অংশ থাইল্যান্ডের জঙ্গলে ক্রীতদাস হিসেবে মানবেতর জীবনযাপন করছে। যারা সমুদ্রের প্রকৃতি ও ভয়ংকর সব প্রাণী এবং থাইল্যান্ডের আদম পাচারকারী চক্রের হাত থেকে রেহাই পেয়ে মালয়েশিয়ার ভূ-ভাগে পা রাখতে সমর্থ হয়, তারাও অবৈধভাবে অনেকটা ক্রীতদাসের জীবনযাপন করে। এভাবে আমরা ঘরে-বাইরে আধুনিক ক্রীতদাস হচ্ছি শুধু ‘মনোদাস’দের সঠিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে আন্তরিকতার অভাবে।
আমাদের দুর্ভাগ্য এ দেশের রাজনীতি মুক্তভাবে তার গতিপথ ঠিক করতে পারেনি। পারলে হয়তো জনগণের দিকে সঠিকভাবে খেয়াল করার সুযোগ পেতেন রাজনীতিকরা। এখন তাদের প্রতিনিয়ত ক্ষমতায় থাকা বা যাওয়ার জন্য শক্তিশালী দেশগুলোর তাঁবেদারির চিন্তা মাথায় রাখতে হয়। জনগণের তাঁবেদারি করার সময় একদম তাদের হাতে নেই। আগে মাঝে মাঝে জনগণকে খুশি করার জন্য অনেক চটকদার কথা বলতেন তারা। এখন আর এগুলো বলাও লাগবে না হয়তো। কারণ ভোটের অবস্থা ভবিষ্যতেও ৫ জানুয়ারির মতো হলে দৃশ্যপট থেকে জনগণ পুরোপুরি মাইনাস হয়ে যাবে। তখন দেশে তাঁবেদারি বা দাসত্বের দুষ্টচক্রই অবশিষ্ট থাকবে। রাজনীতিকরা পরাশক্তি ও প্রতিবেশী দেশগুলোর তাঁবেদারি করবে। দেশের পুলিশ ও প্রশাসন বিদ্যমান আইনের নয় রাজনীতিকদের তাঁবেদারি করবে। দুর্ভাগা জনগণ সামনে যাকে পাবে তারই দাসত্ব মেনে নেবে। মজার বিষয় হচ্ছে, আমরা সবাই নিজেদের গণ্ডির মধ্যে নিজেকে মনিব বা রাজা ভাবতে পছন্দ করি। হয়তো দাসত্বের কারণে সৃষ্ট মনোবৈকল্য বা যন্ত্রণা উপশমের জন্য। তাইতো আমরা গাইতে পছন্দ করি কবিগুরুর গান, ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে’।
মনোদাস, ক্রীতদাস কিংবা রাজা না হয়ে প্রকৃত মানুষ হতে আমাদের আর কতদিন লাগবে তা ভবিষ্যতই বলে দেবে।
মোঃ মাহমুদুর রহমান : ব্যাংকার
No comments