দেশে গণতন্ত্রের জন্য আকুতি চলছে
তত্ত্বাবধায়ক
সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেছেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের
জন্য যে বিষয়গুলো থাকা উচিত সেগুলো ক্রমশ দুরূহ হয়ে যাচ্ছে। আমরা গণতন্ত্র
থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছি। এ কারণে দেশে গণতন্ত্রের জন্য আকুতি চলছে।
গতকাল রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের মাল্টিপারপাস হলরুমে
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর পঞ্চম জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে
প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। ড. আকবর আলি খান আরও বলেন,
বাংলাদেশে বর্তমানে একটি অনুদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিরাজ করছে। অনুদার
গণতন্ত্রের লক্ষণ হচ্ছে ক্রমান্বয়ে গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো আস্তে আস্তে
ক্ষয় পেতে থাকে। বাংলাদেশে আজকে একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচিত হয়েছে। যেখানে
১৫৩টি আসনে কোন ভোটার ভোট দেয়ার সুযোগ পায়নি। এধরনের গণতন্ত্র এবং তার
সঙ্গে যে সমস্ত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেখানেও বিভিন্ন ধরনের
বিচ্যুতি এবং অবক্ষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা
সংস্কারের প্রয়োজন তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলন যে
তিন/ চার দশক ধরে চলছে, গণতন্ত্র হচ্ছে, নির্বাচন হচ্ছে, সরকার বদল হচ্ছে
কিন্তু গণতন্ত্র দুর্বল হচ্ছে। এর কারণ হলো শুধু লোক বদল করে কিংবা দল বদল
করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না। বাংলাদেশের বর্তমান যে ব্যবস্থা সে
ব্যবস্থার মধ্যে অনেক বিচ্যুতি রয়েছে। এখানে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে,
এখানে সংসদের ক্ষমতা কমে গেছে। এখানে আপনার নির্বাচনী ব্যবস্থায় আপনি কম
ভোট পেয়েও সামগ্রিকভাবে জাতীয়ভাবে অনেক আসন পেতে পারেন। সমস্যা সমাধানে
গণভোটের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, কোন সরকার ক্ষমতায় যায় তখন সে মনে করে
নির্বাচনী মেয়াদের জন্য সে দায়িত্ব পেয়েছে। এবং যা খুশি তা করতে পারে।
এখানে গণভোটের কোন ব্যবস্থা নেই। গণভোটের ব্যবস্থা থাকলে হরতালের কোন
প্রয়োজন হতো না। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ভোটাররাই নির্ধারণ করতো।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাংলাদেশের প্রয়োজন আছে কি নাই এটা তো রাজনৈতিক দলের
বিষয় না- এটা তো ভোটারদেরও বিষয়। ভোটারদের হাতে যদি দিয়ে দেয়া হতো। ভোটাররা
যদি বলে আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাই, আমরা সেটা মেনে নেবো। ভোটাররা যদি
বলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাই না আমরা সেটা মেনে নেবো। কিন্তু এই ধরনের
ক্ষমতাগুলো রাজনৈতিক দলগুলো কুক্ষিগত করে রেখেছে।
দেশে গণতন্ত্রের জন্য যে আকুতি ও আন্দোলন চলছে সেখানে সুজনকে ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, গণতন্ত্র আর উন্নয়নের মধ্যে কোন বৈপরীত্য নাই। গণতন্ত্র ছাড়া কোন উন্নয়ন হয় না। গণতন্ত্র অবশ্যই উন্নয়নের অংশ। গণতন্ত্র ছাড়া মাথাপিছু আয় বাড়িয়ে সেটা যদি ধনীলোকের আয় বাড়ায় সেটাকে আমরা উন্নয়ন বলবো না। উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্র অবশ্যই থাকতে হবে। এটা নিয়ে বিতর্কের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।
সুজন সভাপতি এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, দেশে আইন আছে, শাসন আছে। কিন্তু আইনের শাসন নাই। আমরা সুশাসন থেকে দিন দিন দূরে সরে যাচ্ছি। আমাদের দেশের গণতন্ত্রের জন্য মানুষের উৎসাহ-উদ্দীপনা আছে। তাদের একান্ত কাম্য দেশে গণতন্ত্র হবে, সুশাসন হবে, আইনের শাসন হবে।
আমরা একদিনের গণতন্ত্র দেখতে পাই নির্বাচনে। সেটাও শেষ হয়ে গেছে। এটা থেকে উত্তরণ করতে পারবো বলে মনে হচ্ছে না। একমাত্র হতে পারে যদি আমরা আমাদের সক্রিয়তা জোরালো করতে পারি। আমাদের অনাস্থা ও গণভোটের বিষয়ে আন্দোলন করতে হবে।
সম্প্রতি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, দেশে গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই। দেশে দলীয়করণ চলছে। পরমতসহিষ্ণুতা একেবারে নেই। যা আমরা গাজীপুরে দেখতে পেলাম। বকশীবাজারে যে ঘটনা দেখেছি এবং সরকারের পক্ষ থেকে কথা এসেছে সেটা শুনলে মর্মাহত হতে হয়। বিরোধীদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অবশ্যই দিতে হবে। গণতন্ত্রের জন্য এটা পূর্বশর্ত।
সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবু হেনা বলেন, বাংলাদেশের মানুষ চায় একটি সুস্থ সমাজ, যে সমাজে মানুষ নিজেদের অধিকার পাবে। সেই সমাজ মানুষ চায়, সে সমাজে দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি থাকবে না। মানুষ বলবে- ‘আমার ভোট আমি দেবো, যাকে খুশি তাকে দেবো।’ আজকে জনপ্রশাসনে অবক্ষয়ের কথা শুনি। আজকে দুর্নীতি বেড়েছে। আমরা তো এ রকম সমাজ ভাবিনি। এ থেকে মুক্তি দরকার।
সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা বলেন, গণতন্ত্র এবং সুশাসন আংশিকভাবে ব্যাখ্যায়িত হওয়ার ফলে সমস্যা হচ্ছে। যেমন গণতন্ত্র বলতে বোঝানো হয় নির্বাচনী গণতন্ত্র। তা কিন্তু নয়। এখানে গণতন্ত্রের নামে নির্বাচিত স্বৈরশাসনের মতো ব্যবস্থা হচ্ছে। যেখানে একটা সংসদে সুসংগঠিত বিরোধী দল থাকা দরকার, যারা বিতর্কে অংশগ্রহণ করবে। জনগণের কথাবার্তা বলবে। সে জিনিসটা বাংলাদেশে হয় না। এটাও আমাদের দুর্ভাগ্য যে, যে দল ক্ষমতায় আসে আরেক দলকে সহযোগিতা করে না। সংসদ কার্যকরী হয় না।
বিএনপি নির্বাচনে না যাওয়ায় দেশের গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে আরেক দলকে ফাঁকা মাঠে গোল দেয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে। নির্বাচন বয়কট করে কোনকালে কেউ লাভবান হয়নি। নির্বাচনের পরে নির্বাচনের প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে আলোচনা হওয়া উচিত। যেটা কখনও হয়নি। কমিশনের লোকজনের ব্যাকগ্রাউন্ড আলোচনা হওয়া উচিত ছিল। বড় একটা বিষয়ের মধ্যে আমরা আবদ্ধ থাকলাম, তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তারপরে নির্বাচন বয়কট করলাম। এবং যার ফলে একতরফাভাবে একটা নির্বাচন করলো।
দুর্নীতি বাংলাদেশকে গ্রাস করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সুশাসনের বিষয়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি ধূম্রজালের সৃষ্টি হয় যখন তখন এখানে কিছু অর্থনৈতিক নির্দেশক দেয়া হয়। এটা সত্যি আমাদের অনেক নির্দেশকে অবস্থান ভালো। কিন্তু প্রতিনিয়ত বাংলাদেশে প্রতিটি কাজে দুর্নীতি ছাড়া, ঘুষ ছাড়া কিছু হয় না। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি পয়সা দিয়ে করতে হয়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের জন্য যে সার্ভিসগুলো দরকার সেটা সুন্দরভাবে হচ্ছে না। জনগণের কষ্ট হচ্ছে। সে জন্য আমরা দুর্নীতিতে নিচে পড়ি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)-এর প্রতিবেদনে দুর্নীতির যে মাত্রা আছে সেটা অনেক কম। প্রকৃত অবস্থা আরও খারাপ।
গণতান্ত্রিক পরিবেশ না হলে দেশে স্থিতিশীলতা আশা করা যায় না উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. এমাজউদ্দীন আহমেদ বলেন, বর্তমানে আমরা খুব খারাপ সময় অতিবাহিত করছি। উন্নয়ন বলতে শুধু আর্থিক অগ্রগতি নয়, মানুষের মানবিক মর্যাদা বোঝায়। শিক্ষাক্ষেত্রসহ বিভিন্ন পর্যায়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সাহসিকতা বোঝায়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হয়েছে জনস্বার্থ ও জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য। উন্নয়ন ছাড়া গণতন্ত্র চিন্তা করা কঠিন। গণতন্ত্র ছাড়া উন্নয়ন অবাস্তব।
সাংবাদিক আশরাফ কায়সার বলেন, বাংলাদেশ আজকে দলনিরপেক্ষ মানুষের ভূমিকা প্রবলভাবে অনুভব করছে। এখন গণতন্ত্রের প্রতিশব্দ হিসেবে দলতন্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। দলের অন্যায় কাজ সমর্থন না করলে দল আশাহত করছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, আমাদের দেশের বেশির ভাগ সুশীল মওসুমি বিবেকবান। অনেক সংগঠনই তাদের কার্যক্রম চালান অবস্থা বুঝে। কিন্তু সুজন এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। অর্থাৎ যারাই ক্ষমতায় থাকুন না কেন, যেখানেই কুশাসন, সেখানেই সোচ্চার সুজন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, পরিসংখ্যান দিয়ে আজ উন্নয়নকে মাপা হচ্ছে। উন্নয়ন মানে শুধুমাত্র আর্থিক উন্নয়ন নয়, বরং উন্নয়ন মানে নারীর ক্ষমতায়ন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, আইনের শাসন তথা সুশাসন। গণতন্ত্র মানে শুধু নির্বাচন নয়, প্রতিদিনের কার্যক্রমে সুশাসন নিশ্চিত করাই উন্নয়ন। তাই গণতন্ত্র ও উন্নয়ন একটি আরেকটির পরিপূরক।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইনাম আহমেদ চৌধুরী বলেন, দেশে আইন আছে, শাসন আছে, কিন্তু সুশাসন নেই। বৈরী রাজনৈতিক আবহাওয়ার মধ্যেও সুজন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
সম্মেলনে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার রাজনৈতিক সঙ্কটের টেকসই সমাধানের লক্ষ্যে জাতীয় সনদ উপস্থাপন করেন। সনদে তিনি বিরাজমান সঙ্কটের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন এবং এ সঙ্কট নিরসনে তিনটি ক্ষেত্রে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি হওয়া প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, দেশে বর্তমানে বৈরী পরিবেশ বিরাজ করছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল চরম বিতর্কিত। এখানে অনেকের হিসেবে দশ শতাংশ ভোটও পড়েনি। বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে তিনি ঐকমত্যের আহ্বান জানিয়ে বলেন, পরবর্তী নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে একটি ঐকমত্য প্রয়োজন, যা নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন নিশ্চিত করবে। দ্বিতীয়ত প্রয়োজন, নির্বাচনকালীন ব্যবস্থা নিয়ে ঐকমত্য, যাতে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য হয়। ঐকমত্যের অন্য ক্ষেত্রটি হতে হবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত পরবর্তী সরকারের জন্য করণীয় সম্পর্কে। সম্মেলনে সাংগঠনিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সুজন সম্পাদক। অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সুজন সহ-সভাপতি এএসএম শাহজাহান, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সুজন নির্বাহী সদস্য আলী ইমাম মজুমদার, সুজন নির্বাহী সদস্য সৈয়দ আবুল মকসুদ, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী, প্রকৌশলী মুসবাহ আলীম, অধ্যাপক নাজমা হাসিন ও ড. জালাল উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন।
দেশে গণতন্ত্রের জন্য যে আকুতি ও আন্দোলন চলছে সেখানে সুজনকে ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, গণতন্ত্র আর উন্নয়নের মধ্যে কোন বৈপরীত্য নাই। গণতন্ত্র ছাড়া কোন উন্নয়ন হয় না। গণতন্ত্র অবশ্যই উন্নয়নের অংশ। গণতন্ত্র ছাড়া মাথাপিছু আয় বাড়িয়ে সেটা যদি ধনীলোকের আয় বাড়ায় সেটাকে আমরা উন্নয়ন বলবো না। উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্র অবশ্যই থাকতে হবে। এটা নিয়ে বিতর্কের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।
সুজন সভাপতি এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, দেশে আইন আছে, শাসন আছে। কিন্তু আইনের শাসন নাই। আমরা সুশাসন থেকে দিন দিন দূরে সরে যাচ্ছি। আমাদের দেশের গণতন্ত্রের জন্য মানুষের উৎসাহ-উদ্দীপনা আছে। তাদের একান্ত কাম্য দেশে গণতন্ত্র হবে, সুশাসন হবে, আইনের শাসন হবে।
আমরা একদিনের গণতন্ত্র দেখতে পাই নির্বাচনে। সেটাও শেষ হয়ে গেছে। এটা থেকে উত্তরণ করতে পারবো বলে মনে হচ্ছে না। একমাত্র হতে পারে যদি আমরা আমাদের সক্রিয়তা জোরালো করতে পারি। আমাদের অনাস্থা ও গণভোটের বিষয়ে আন্দোলন করতে হবে।
সম্প্রতি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, দেশে গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই। দেশে দলীয়করণ চলছে। পরমতসহিষ্ণুতা একেবারে নেই। যা আমরা গাজীপুরে দেখতে পেলাম। বকশীবাজারে যে ঘটনা দেখেছি এবং সরকারের পক্ষ থেকে কথা এসেছে সেটা শুনলে মর্মাহত হতে হয়। বিরোধীদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অবশ্যই দিতে হবে। গণতন্ত্রের জন্য এটা পূর্বশর্ত।
সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবু হেনা বলেন, বাংলাদেশের মানুষ চায় একটি সুস্থ সমাজ, যে সমাজে মানুষ নিজেদের অধিকার পাবে। সেই সমাজ মানুষ চায়, সে সমাজে দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি থাকবে না। মানুষ বলবে- ‘আমার ভোট আমি দেবো, যাকে খুশি তাকে দেবো।’ আজকে জনপ্রশাসনে অবক্ষয়ের কথা শুনি। আজকে দুর্নীতি বেড়েছে। আমরা তো এ রকম সমাজ ভাবিনি। এ থেকে মুক্তি দরকার।
সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা বলেন, গণতন্ত্র এবং সুশাসন আংশিকভাবে ব্যাখ্যায়িত হওয়ার ফলে সমস্যা হচ্ছে। যেমন গণতন্ত্র বলতে বোঝানো হয় নির্বাচনী গণতন্ত্র। তা কিন্তু নয়। এখানে গণতন্ত্রের নামে নির্বাচিত স্বৈরশাসনের মতো ব্যবস্থা হচ্ছে। যেখানে একটা সংসদে সুসংগঠিত বিরোধী দল থাকা দরকার, যারা বিতর্কে অংশগ্রহণ করবে। জনগণের কথাবার্তা বলবে। সে জিনিসটা বাংলাদেশে হয় না। এটাও আমাদের দুর্ভাগ্য যে, যে দল ক্ষমতায় আসে আরেক দলকে সহযোগিতা করে না। সংসদ কার্যকরী হয় না।
বিএনপি নির্বাচনে না যাওয়ায় দেশের গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে আরেক দলকে ফাঁকা মাঠে গোল দেয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে। নির্বাচন বয়কট করে কোনকালে কেউ লাভবান হয়নি। নির্বাচনের পরে নির্বাচনের প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে আলোচনা হওয়া উচিত। যেটা কখনও হয়নি। কমিশনের লোকজনের ব্যাকগ্রাউন্ড আলোচনা হওয়া উচিত ছিল। বড় একটা বিষয়ের মধ্যে আমরা আবদ্ধ থাকলাম, তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তারপরে নির্বাচন বয়কট করলাম। এবং যার ফলে একতরফাভাবে একটা নির্বাচন করলো।
দুর্নীতি বাংলাদেশকে গ্রাস করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সুশাসনের বিষয়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি ধূম্রজালের সৃষ্টি হয় যখন তখন এখানে কিছু অর্থনৈতিক নির্দেশক দেয়া হয়। এটা সত্যি আমাদের অনেক নির্দেশকে অবস্থান ভালো। কিন্তু প্রতিনিয়ত বাংলাদেশে প্রতিটি কাজে দুর্নীতি ছাড়া, ঘুষ ছাড়া কিছু হয় না। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি পয়সা দিয়ে করতে হয়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের জন্য যে সার্ভিসগুলো দরকার সেটা সুন্দরভাবে হচ্ছে না। জনগণের কষ্ট হচ্ছে। সে জন্য আমরা দুর্নীতিতে নিচে পড়ি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)-এর প্রতিবেদনে দুর্নীতির যে মাত্রা আছে সেটা অনেক কম। প্রকৃত অবস্থা আরও খারাপ।
গণতান্ত্রিক পরিবেশ না হলে দেশে স্থিতিশীলতা আশা করা যায় না উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. এমাজউদ্দীন আহমেদ বলেন, বর্তমানে আমরা খুব খারাপ সময় অতিবাহিত করছি। উন্নয়ন বলতে শুধু আর্থিক অগ্রগতি নয়, মানুষের মানবিক মর্যাদা বোঝায়। শিক্ষাক্ষেত্রসহ বিভিন্ন পর্যায়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সাহসিকতা বোঝায়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হয়েছে জনস্বার্থ ও জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য। উন্নয়ন ছাড়া গণতন্ত্র চিন্তা করা কঠিন। গণতন্ত্র ছাড়া উন্নয়ন অবাস্তব।
সাংবাদিক আশরাফ কায়সার বলেন, বাংলাদেশ আজকে দলনিরপেক্ষ মানুষের ভূমিকা প্রবলভাবে অনুভব করছে। এখন গণতন্ত্রের প্রতিশব্দ হিসেবে দলতন্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। দলের অন্যায় কাজ সমর্থন না করলে দল আশাহত করছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, আমাদের দেশের বেশির ভাগ সুশীল মওসুমি বিবেকবান। অনেক সংগঠনই তাদের কার্যক্রম চালান অবস্থা বুঝে। কিন্তু সুজন এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। অর্থাৎ যারাই ক্ষমতায় থাকুন না কেন, যেখানেই কুশাসন, সেখানেই সোচ্চার সুজন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, পরিসংখ্যান দিয়ে আজ উন্নয়নকে মাপা হচ্ছে। উন্নয়ন মানে শুধুমাত্র আর্থিক উন্নয়ন নয়, বরং উন্নয়ন মানে নারীর ক্ষমতায়ন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, আইনের শাসন তথা সুশাসন। গণতন্ত্র মানে শুধু নির্বাচন নয়, প্রতিদিনের কার্যক্রমে সুশাসন নিশ্চিত করাই উন্নয়ন। তাই গণতন্ত্র ও উন্নয়ন একটি আরেকটির পরিপূরক।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইনাম আহমেদ চৌধুরী বলেন, দেশে আইন আছে, শাসন আছে, কিন্তু সুশাসন নেই। বৈরী রাজনৈতিক আবহাওয়ার মধ্যেও সুজন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
সম্মেলনে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার রাজনৈতিক সঙ্কটের টেকসই সমাধানের লক্ষ্যে জাতীয় সনদ উপস্থাপন করেন। সনদে তিনি বিরাজমান সঙ্কটের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন এবং এ সঙ্কট নিরসনে তিনটি ক্ষেত্রে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি হওয়া প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, দেশে বর্তমানে বৈরী পরিবেশ বিরাজ করছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল চরম বিতর্কিত। এখানে অনেকের হিসেবে দশ শতাংশ ভোটও পড়েনি। বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে তিনি ঐকমত্যের আহ্বান জানিয়ে বলেন, পরবর্তী নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে একটি ঐকমত্য প্রয়োজন, যা নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন নিশ্চিত করবে। দ্বিতীয়ত প্রয়োজন, নির্বাচনকালীন ব্যবস্থা নিয়ে ঐকমত্য, যাতে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য হয়। ঐকমত্যের অন্য ক্ষেত্রটি হতে হবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত পরবর্তী সরকারের জন্য করণীয় সম্পর্কে। সম্মেলনে সাংগঠনিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সুজন সম্পাদক। অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সুজন সহ-সভাপতি এএসএম শাহজাহান, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সুজন নির্বাহী সদস্য আলী ইমাম মজুমদার, সুজন নির্বাহী সদস্য সৈয়দ আবুল মকসুদ, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী, প্রকৌশলী মুসবাহ আলীম, অধ্যাপক নাজমা হাসিন ও ড. জালাল উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন।
No comments