চলে গেলেন রং-তুলির কারিগর
দেশবরেণ্য
চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী আর নেই। রোববার রাত ৯টা ৫৭ মিনিটে সম্মিলিত
সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি...
রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। এর আগে রাত ৮টা ৪০ মিনিটে রাজধানীর আর্মি
স্টেডিয়ামে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের উচ্চাঙ্গসঙ্গীত সম্মেলনে বক্তৃতার
একপর্যায়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ে যান। প্রথমে বক্তৃতা দিয়ে মঞ্চের নির্দিষ্ট
চেয়ারে গিয়ে বসেন। এরপর অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বক্তৃতা দিতে দাঁড়ালে তিনি
ফিরে এসে বলেন, আমার একটি কথা বলার আছে। এরপর মাইকের দিকে এগিয়ে গিয়ে কথা
বলার আগেই ঢলে পড়েন তিনি। এ সময় তার পাশে থাকা অধ্যাপক আনিসুজ্জামান,
স্কয়ার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী ও বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান আবুল খায়ের লিটুসহ অন্যরা সঙ্গে সঙ্গে তাকে অচেতন
অবস্থায় সিএমএইচে নিলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। চিত্রক’র শিল্পী মনির
যুগান্তরকে জানান, সিএমএইচ থেকে তার মরদেহ নিয়ে রাতেই স্কয়ার হাসপাতালের
হিমঘরে রাখা হবে। জন্ম ও কৃতকর্ম : ১৯৩৪ সালে ৯ মার্চ ফেনীতে জন্মগ্রহণ
করেন রং-তুলির এই কারিগর। জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসানের পর বাংলাদেশের
প্রথম প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় নাম কাইয়ুম চৌধুরী।
প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে তার বিপুল খ্যাতি রয়েছে। সাধনায় তিনি শুধু
চিত্রশিল্পের জগৎকেই উৎকর্ষমণ্ডিত করেননি, দেশের সমগ্র সাংস্কৃতিক
পরিমণ্ডলকেই অগ্রসর চিন্তার আলোকে জাগ্রত রেখেছেন। তিনি সাংস্কৃতিক ভুবনে
যৌবনকালের মতোই সক্রিয় এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। ছয় দশক ধরে এই শিল্পী দেশের
প্রকাশনার জগৎকে তার বিপুল সৃষ্টির মাধ্যমে যেভাবে সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছেন,
তার কোনো তুলনা হয় না। শিল্প ও সাংস্কৃতিক জগৎকে তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে
সুরুচির আলোয় আলোকিত করেছেন। আর এভাবেই তিনি পরিণত হয়েছেন বাংলাদেশের এক
সার্থক শিল্পী-ব্যক্তিত্বে। এই সার্থকতার পেছনে ছিল সৃজনশীল প্রতিভা,
নিষ্ঠা এবং একাগ্রতা।
শিক্ষাজীবন : মক্তবে তার শিক্ষার হাতেখড়ি। এরপর ভর্তি হন চট্টগ্রামের নর্মাল স্কুলে। ১৯৪৯ সালে ময়মনসিংহের সিটি কলেজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করেন। একই বছর ঢাকার শিল্প শিক্ষালয়ে জয়নুল আবেদিনসহ শিক্ষকদের সাহচর্যে শিক্ষা নেন। এভাবেই তিনি বেড়ে ওঠেন। এরপর বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে নতুনভাবে উজ্জীবিত হয়েছিলেন। সেই তারুণ্য থেকে শুরু। এরপর দেশ ও মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করেছেন সব চিন্তা, কর্ম ও সৃষ্টি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত স্বাধীনতাকেন্দ্রিক এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সব সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞে তিনি সক্রিয় থেকেছেন। ষাটের দশকের নানা প্রতিবাদী প্রকাশনা সমৃদ্ধ হয়েছে তার শিল্পের ছোঁয়ায়।
১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব অসহযোগ আন্দোলনের সময় দেশের চারু ও কারুশিল্পীদের যে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়, তার যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। তারপর মুক্তিযুদ্ধকালীন অনুভূতি নিয়ে অনেক ছবি এঁকেছেন তিনি। রাজশাহীর বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনে করেছেন মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক মোজাইক ম্যুরাল। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে স্বৈরতন্ত্র, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সব আন্দোলনের সঙ্গে তিনি নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন।
কাজের স্বীকৃতি : শিল্প ও সংস্কৃতির সব ধারা থেকে রস নিয়ে কাইয়ুম চৌধুরী নিরন্তর পরিপুষ্ট করে চলেন নিজ সৃজনশক্তিকে। আর এর স্বীকৃতিও পেয়েছেন রাষ্ট্র, জনগণ ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা পদক লাভ করেন। এর আগে ১৯৭৭ সালে তিনি পেয়েছেন শিল্পকলা একাডেমি প্রদত্ত শিল্পকলার জাতীয় পুরস্কার, মনোনীত হয়েছেন বাংলা একাডেমির সম্মানিত ফেলো, ১৯৮৬ সালে লাভ করেছেন রাষ্ট্রীয় একুশে পদক। ১৯৫৯ এবং ১৯৬১ সালে তিনি রেলওয়ের টাইমটেবলের প্রচ্ছদের জন্য সেরা পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৬১-৬২ সালে শিল্পকলায় পাকিস্তানের জাতীয় পুরস্কার, ১৯৬৬ সালে পঞ্চম তেহরান বিয়েনাল থেকে রাজকীয় দরবার পুরস্কার, ১৯৬৪-১৯৭৬ সালে বাংলাদেশের প্রচ্ছদশিল্পের জন্য গ্রন্থকেন্দ্র পুরস্কার এবং ১৯৭৫ সালে স্বর্ণপদক লাভ করেন। প্রিয় বিষয় : তার প্রিয় বিষয়ের মধ্যে ছিল নদী, আকাশ আর মাটি। দেশের নানা সংকটে তার বিপর্যস্ত মন গ্রামবাংলার জীবনচিত্রের মধ্যে স্বস্তি খুঁজে পেত। গ্রাম্যজীবন তার অন্তর্গত সত্তায় এমন এক ধরনের অনুভূতির জন্ম দেয়, যা তার সৃষ্টিশীল উদ্যমকে ওই জীবননির্ভর চিত্রাঙ্কনে প্রাণিত করে। ওইরূপ অনুভূতি তার দেশাত্মবোধেরও উৎস। কাইয়ুম চৌধুরীর প্রতিটি ছবির কম্পোজিশনই এক প্রকার ডিজাইন। এই নকশাধর্মিতা লোকজশিল্পেরও অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই বাস্তবতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও নিজের কর্মধারা চিত্রশিল্পী ও ডিজাইনার হিসেবে তার দুই সত্তাকে পরস্পরের পরিপূরক করে তুলেছে। তার ছবিতে কর্কশতা বা নির্মমতা নেই। তার ছবি সব সময় লালিত্যময়। গঠনবিন্যাসের সৌন্দর্যই এই লালিত্যের কারণ। সমকালকে অতিক্রম করে নিজ চিত্রকর্মকে এক চিরকালীন আবেদনে ব্যঞ্জিত করার দিকেই শিল্পীর আগ্রহ। বাংলাদেশের শিল্প ও সাংস্কৃতিক ভুবনকে তিনি আলোকিত করে রেখে গেছেন, তা আরও বহু-বহুকাল ধরে অব্যাহত থাকবে।
শোক : বরেণ্য এই শিল্পীর মৃত্যুতে দেশের শিল্প সাংস্কৃতিক জগতে শোকের ছায়া নেমে আসে। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, ডেপুটি স্পিকার মো. ফজলে রাব্বী মিয়া, বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ, চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, বিএনপির চেয়ারপাসন খালেদা জিয়া এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আআমস আরেফিন সিদ্দিক শোক প্রকাশ করেছেন। রাষ্ট্রপতি তার শোক বার্তায় বলেন, কাইয়ুম চৌধুরীর মৃত্যুতে জাতি এক বরেণ্য সন্তানকে হারাল। রাষ্ট্রপতি তার আত্মার মাগফিরাত কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান।
শিক্ষাজীবন : মক্তবে তার শিক্ষার হাতেখড়ি। এরপর ভর্তি হন চট্টগ্রামের নর্মাল স্কুলে। ১৯৪৯ সালে ময়মনসিংহের সিটি কলেজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করেন। একই বছর ঢাকার শিল্প শিক্ষালয়ে জয়নুল আবেদিনসহ শিক্ষকদের সাহচর্যে শিক্ষা নেন। এভাবেই তিনি বেড়ে ওঠেন। এরপর বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে নতুনভাবে উজ্জীবিত হয়েছিলেন। সেই তারুণ্য থেকে শুরু। এরপর দেশ ও মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করেছেন সব চিন্তা, কর্ম ও সৃষ্টি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত স্বাধীনতাকেন্দ্রিক এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সব সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞে তিনি সক্রিয় থেকেছেন। ষাটের দশকের নানা প্রতিবাদী প্রকাশনা সমৃদ্ধ হয়েছে তার শিল্পের ছোঁয়ায়।
১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব অসহযোগ আন্দোলনের সময় দেশের চারু ও কারুশিল্পীদের যে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়, তার যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। তারপর মুক্তিযুদ্ধকালীন অনুভূতি নিয়ে অনেক ছবি এঁকেছেন তিনি। রাজশাহীর বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনে করেছেন মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক মোজাইক ম্যুরাল। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে স্বৈরতন্ত্র, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সব আন্দোলনের সঙ্গে তিনি নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন।
কাজের স্বীকৃতি : শিল্প ও সংস্কৃতির সব ধারা থেকে রস নিয়ে কাইয়ুম চৌধুরী নিরন্তর পরিপুষ্ট করে চলেন নিজ সৃজনশক্তিকে। আর এর স্বীকৃতিও পেয়েছেন রাষ্ট্র, জনগণ ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা পদক লাভ করেন। এর আগে ১৯৭৭ সালে তিনি পেয়েছেন শিল্পকলা একাডেমি প্রদত্ত শিল্পকলার জাতীয় পুরস্কার, মনোনীত হয়েছেন বাংলা একাডেমির সম্মানিত ফেলো, ১৯৮৬ সালে লাভ করেছেন রাষ্ট্রীয় একুশে পদক। ১৯৫৯ এবং ১৯৬১ সালে তিনি রেলওয়ের টাইমটেবলের প্রচ্ছদের জন্য সেরা পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৬১-৬২ সালে শিল্পকলায় পাকিস্তানের জাতীয় পুরস্কার, ১৯৬৬ সালে পঞ্চম তেহরান বিয়েনাল থেকে রাজকীয় দরবার পুরস্কার, ১৯৬৪-১৯৭৬ সালে বাংলাদেশের প্রচ্ছদশিল্পের জন্য গ্রন্থকেন্দ্র পুরস্কার এবং ১৯৭৫ সালে স্বর্ণপদক লাভ করেন। প্রিয় বিষয় : তার প্রিয় বিষয়ের মধ্যে ছিল নদী, আকাশ আর মাটি। দেশের নানা সংকটে তার বিপর্যস্ত মন গ্রামবাংলার জীবনচিত্রের মধ্যে স্বস্তি খুঁজে পেত। গ্রাম্যজীবন তার অন্তর্গত সত্তায় এমন এক ধরনের অনুভূতির জন্ম দেয়, যা তার সৃষ্টিশীল উদ্যমকে ওই জীবননির্ভর চিত্রাঙ্কনে প্রাণিত করে। ওইরূপ অনুভূতি তার দেশাত্মবোধেরও উৎস। কাইয়ুম চৌধুরীর প্রতিটি ছবির কম্পোজিশনই এক প্রকার ডিজাইন। এই নকশাধর্মিতা লোকজশিল্পেরও অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই বাস্তবতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও নিজের কর্মধারা চিত্রশিল্পী ও ডিজাইনার হিসেবে তার দুই সত্তাকে পরস্পরের পরিপূরক করে তুলেছে। তার ছবিতে কর্কশতা বা নির্মমতা নেই। তার ছবি সব সময় লালিত্যময়। গঠনবিন্যাসের সৌন্দর্যই এই লালিত্যের কারণ। সমকালকে অতিক্রম করে নিজ চিত্রকর্মকে এক চিরকালীন আবেদনে ব্যঞ্জিত করার দিকেই শিল্পীর আগ্রহ। বাংলাদেশের শিল্প ও সাংস্কৃতিক ভুবনকে তিনি আলোকিত করে রেখে গেছেন, তা আরও বহু-বহুকাল ধরে অব্যাহত থাকবে।
শোক : বরেণ্য এই শিল্পীর মৃত্যুতে দেশের শিল্প সাংস্কৃতিক জগতে শোকের ছায়া নেমে আসে। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, ডেপুটি স্পিকার মো. ফজলে রাব্বী মিয়া, বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ, চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, বিএনপির চেয়ারপাসন খালেদা জিয়া এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আআমস আরেফিন সিদ্দিক শোক প্রকাশ করেছেন। রাষ্ট্রপতি তার শোক বার্তায় বলেন, কাইয়ুম চৌধুরীর মৃত্যুতে জাতি এক বরেণ্য সন্তানকে হারাল। রাষ্ট্রপতি তার আত্মার মাগফিরাত কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান।
No comments