ব্রহ্মপুত্র জটিলতা - ডিএনএ’র সম্পাদকীয়
চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুনইং ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, তিব্বতের ইয়ারলুং জাংবো নদীতে নির্মাণাধীন পানি-বিদ্যুৎ বাঁধের ভাটিতে কোন সমস্যা সৃষ্টি করবে না। নদীটি ভারত ও বাংলাদেশে এসে হয়েছে ব্রহ্মপুত্র নদ। হুয়া আরও বলেছেন, ভারতের সঙ্গে চীন বন্যা মওসুমের হাইড্রোলোজিক্যাল তথ্য আদান প্রদান করবে। চীনের এ ব্যাখ্যা ভারতের সব ধরনের সংশয় প্রশমন করার সম্ভাবনা কম। হুয়ার কাছ থেকে পাওয়া তথ্য নিশ্চিত বা অস্বীকার করে ভারতের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোন বিবৃতি এলে ভাল হতো। ভারতের একাধিক পরিবেশ কর্মী কয়েক বছর ধরে তিব্বতের ইয়ারলুং জাংবো নদীতে পানি-বিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণের ফলে আসাম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য এলাকায় নেতিবাচক প্রভাবের হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছেন। দুখঃজনক হলো, ভারতের উৎকণ্ঠা সাধারণভাবেই প্রকাশ করা হচ্ছে। এ সব দাবি সমর্থন করার মতো কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। গুরুত্বপূর্ণ এ ইস্যুতে তথ্যের অভাব থাকাটা বোধগম্য। কেননা, সরকারগুলো তথ্য প্রকাশে হিসাবি। এগুলোর কিছু অংশ সংবেদনশীল নিরাপত্তা সংক্রান্ত হতে পারে। কিন্তু উভয় দেশের কর্তৃপক্ষের চেষ্টা করা উচিত এ সব তথ্যের যতটা সম্ভব ততটা প্রকাশ করা। এটা ধোঁয়াশা পরিষ্কার করতে বড় উপকারে আসবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত ও চীনের মধ্যে কোন পানিবণ্টন চুক্তি নেই। যেমনটা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে রয়েছে। সিন্ধু পানি চুক্তি। এর পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। সিন্ধু আর এর শাখা নদীগুলো বৈধভাবে চিহ্নিতকৃত ভারত ও পাকিস্তান ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। জম্মু-কাশ্মীর ছাড়া পাকিস্তানের সঙ্গে কোন সীমান্ত বিরোধ নেই। আর চীনের ক্ষেত্রে ভারত স্বীকার করেছে যে তিব্বত চীনের অংশ। সমস্যা দাঁড়িয়েছে উভয় দেশের সীমানা নির্ধারণে। এখনও এর কোন সমাধান হয়নি। প্রতিনিধি পর্যায়ে উভয়পক্ষ আলোচনায় বসেছে। ইতিমধ্যে ১৭ দফা আলোচনা সম্পন্ন হয়েছে। স্পষ্টত নিরাপত্তা ইস্যু বিজড়িত এ সীমান্ত বিরোধ চীনের ওই বাঁধ নির্মাণ নিয়ে সংশয় সৃষ্টি করছে। সিন্ধু পানি চুক্তির আদলে একটি ব্রহ্মপুত্র চুক্তি সার্বিক বিষয়গুলো অনেক সহজ করে দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কাশ্মীরে ভারতের কিষেণগঙ্গা পানি-বিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণে পাকিস্তানের পরিবেশগত কারণে আপত্তি ছিল। বিষয়টি দ্য হেগ-এর আন্তর্জাতিক নিষ্পত্তি আদালতে পাঠানো হয়। আদালত সিদ্ধান্ত দেয় যে, বাঁধ নির্মাণ ও পানির গতিপথ পাল্টানোর অধিকার ভারতের রয়েছে। কিন্তু আদালত তথ্য আদান প্রদান নিয়ে শর্ত নিরূপণ করে দিয়েছে। ভারত ও চীন তথ্য আদান প্রদান সংক্রান্ত অনানুষ্ঠানিক একটি সমঝোতায় আসার প্রক্রিয়ায় রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। যে জিনিসটার ঘাটতি রয়েছে তা হলো আস্থা। উভয় দেশের বেসরকারি এবং সুপরিচিত স্বতন্ত্র বিশেষজ্ঞরা দ্বিপাক্ষিক নিরাপত্তাজনিত সম্পর্কে নানা বৈয়ী পরিস্থিতির তথ্য উপস্থাপন করেছেন। ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা চীনের কাছ থেকে স্পষ্ট নিরাপত্তা হুমকি উপলব্ধি করে। পক্ষান্তরে চীনা বিশেষজ্ঞরা ভারতকে দেখে চীনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এশিয়া প্যাসিফিক জোটের অংশ হিসেবে। মজার বিষয় হলো, ভারত ও চীনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক এখন অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী। আর তা ক্রমবিকাশের দিকে এগোচ্ছে। জাপানের সঙ্গে চীনের একই রকম দ্বন্দ্বমুখর সম্পর্ক বিদ্যমান। অর্থনৈতিক সম্পর্কগুলো সক্রিয় ও ইতিবাচক কিন্তু কূটনৈতিক উত্তাপ আগের যে কোন সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। এটাকে এশিয়ার ঐতিহাসিক রীতি হিসেবেই দেখতে হবে। হয়তো এ মডেল আরও কিছু সময়ের জন্য থাকবে। উত্তম হবে যদি ভারত ও চীনের ইতিবাচক অর্থনৈতিক অগ্রগতি পর্দার আড়ালে রাখার সুযোগ দেয়া না হয়।
No comments