যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় ভীত হওয়ার কিছু নেই by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
আজ এমন একটি বিষয় নিয়ে লিখতে বসেছি যা
পড়তে বসে আমার প্রবীণ বয়সী পাঠকরা হয়তো ভ্রু কুঁচকাবেন। ভাববেন, লেখকের
হয়তো বুড়ো বয়সে ভীমরতিতে পেয়েছে। নইলে এমন বিষয় নিয়েও এই বয়সে কেউ লিখতে
বসে! আমার বয়োকনিষ্ঠ যুগান্তর সম্পাদকও হয়তো বিব্রত হয়ে ভাবতে পারেন, তার
বয়োজ্যেষ্ঠ কলামিস্টকে এ কোন ছেলেমি রোগে ধরেছে! কিন্তু যে যা-ই ভাবুন,
সমস্যাটি সামাজিক এবং সমাজ-প্রগতির। যদি আমরা সমাজ-প্রগতি রুখতে চাই, তাহলে
সমস্যাটির দিকে চোখ বন্ধ করে থাকতে পারি। আর রুখতে না চাইলে (যা আমাদের
সাধ্যে নেই) তার ভালো-মন্দ দিক নিয়ে আলোচনা করতেই হবে।
এই সমস্যা সম্পর্কিত খবরটি দিয়েছেন কলকাতার দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকা (১৮ নভেম্বর মঙ্গলবার ২০১৪)। খবরটি হল, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ৫ নভেম্বর এক বিরাট মিছিল বের করেছিল। তাদের দাবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ও চত্বরে ছাত্রছাত্রীদের প্রকাশ্যে চুম্বন বিনিময়ের অধিকার দিতে হবে। এই অধিকার আদায়ের দাবিতে এক যুগল ছাত্রছাত্রী প্রকাশ্যে চুম্বন বিনিময় করেছে এবং সেই ছবিও কাগজে ছাপা হয়েছে।
এই ছাত্রছাত্রীরা দাবি করেছে, তারা মরাল পুলিশিং এবং গৈরিক সন্ত্রাসের বিরোধী। মিছিলের কয়েকশ ছাত্রছাত্রী যাদবপুর থানার সামনে জড়ো হয়ে সোগান দিয়েছে, চুমু চুমু চুমু চাই- চুমু খেয়ে বাঁচতে চাই। আরেকটি সোগান আমার দেহ আমার মন, দূর হটো রাজ্যশাসন। ছাত্রছাত্রীদের গলায় ঝোলানো পোস্টারে লেখা ছিল, পেয়ার কি আজাদি চাই, লাভ কি ফ্রিডম চাই এবং চুমু খাওয়া আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার।
একেবারে ঘরের কাছে কলকাতার এ খবর পাঠ করে শঙ্কিত হইনি, বরং মজা পেয়েছি। বহু দশক আগে নারীবাদী আন্দোলনের নামে পশ্চিমা বিশ্বে শিক্ষিত নারীরা যা করেছেন, তার বিলম্বিত অনুকরণ শুরু হয়েছে এতদিনে ভারতীয় উপমহাদেশে। মৌলবাদী রক্ষণশীলতার যখন ঝড় বইছে উপমহাদেশের সবগুলো দেশে, তখন ভারতের হিন্দুত্ববাদী ও বাংলাদেশে পাকিস্তানের ইসলামী জঙ্গিদের নাকের ওপরে এই চুমু খাওয়ার অধিকারের আন্দোলন প্রকাশ্য রূপ ধারণ করল কিভাবে? তাহলে কি কবির কথাই সঠিক, এ যৌবন জলতরঙ্গ রোধিবি কী দিয়া বালির বাঁধ?
বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রেমিক-প্রেমিকাদের মধ্যে প্রকাশ্যে চুমু বিনিময়ের অধিকার স্বীকৃতি পেলে তারপরই দাবি উঠতে পারে প্রকাশ্যে আলিঙ্গন করার অধিকার নিয়ে। আলিঙ্গনের অধিকার স্বীকৃতি পেলে তার পরের দাবিটা কী হতে পারে? তা ভেবে হয়তো যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ অস্থির। তাদের একদিকে রক্ষণশীল সমাজ ও সমাজপতিদের রক্তচক্ষুর শাসন এবং অন্যদিকে শাসন ও নিয়মভাঙার উদ্যমতায় অধীর তরুণ সমাজ। এই দুয়ের সংঘর্ষের মধ্য দিয়েই সমাজ ও সভ্যতা সব সময় আগায়। আবার কোনো কোনো সংঘর্ষ সমাজের অগ্রগতি নয়, অধোগতির সূচনা করে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন কি সমাজ-প্রগতির জন্ম দেবে, না সমাজের জন্য ডেকে আনবে আরও অধোগতি?
প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া বা চুমু বিনিময় পশ্চিমা দেশগুলোতে কোনো সমস্যাই নয়। এককালে ছিল। এখন নেই। তাতে সমাজের অধোগতি নয়, অগ্রগতি হয়েছে। প্রকাশ্যে চুম্বন বিনিময় দেশগুলোতে সেক্সক্রাইম বাড়ায়নি। বরং কমিয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলোর রাস্তাঘাটে, ট্রেনে-বাসে, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রেমিক-প্রেমিকারা অবাধে চুমু বিনিময় করছে। বিয়ের পর বর-বধূ পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজনের সামনে পরস্পর চুমু বিনিময় করে। তা এখন সমাজে স্বীকৃত ও আচরিত। তাতে পাশ্চাত্য সমাজে কোনো অরাজকতা সৃষ্টি হয়নি।
আমাদের দেশেও প্রেমিক-প্রেমিকারা চুমু খান। এটা কোনো পাপ নয়। সহজাত, স্বাভাবিক ক্রিয়া। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরেও এটি ঘটে। তবে প্রকাশ্যে নয়, সংগোপনে। আমাদের উপমহাদেশীয় সব ধর্মের সমাজেই প্রকাশ্য চুম্বন সমাজ-স্বীকৃত প্রথা নয়। এমনকি স্বীমা-স্ত্রীর মধ্যেও নয়। একমাত্র শিশুদের দেয়া আদরের চুমু এবং আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে গালে গাল ঠেকিয়ে চুমু খাওয়া সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত প্রথা। তার বাইরে আর সবকিছুই গোপনীয়তায় ঢাকা।
উপমহাদেশে শুধু মুসলমান সমাজে নয়, অন্যান্য ধর্মীয় সমাজেও প্রকাশ্যে চুম্বন বিনিময় বৈধ নয়। মুসলিম সমাজে নর-নারীর প্রকাশ্য মেলামেশাও নিষিদ্ধ। উপমহাদেশে নাটকাভিনয়ে বা চলচ্চিত্রে নায়ক-নায়িকার প্রেমের দৃশ্যেও চুম্বন বর্জিত ছিল। পশ্চিমা প্রভাবে মুম্বাইয়া হিন্দি ছবিতে চুমু খাওয়ার দৃশ্য এখন ক্রমেই স্থান করে নিচ্ছে। তবে মুম্বাইয়া অধিকাংশ ছবিতে শরীর প্রদর্শন ও অশ্লীল যেসব অঙ্গভঙ্গি থাকে, তার বদলে চুম্বন যোগ হলে বরং ছায়াছবিতে অশ্লীলতা কমবে। হলিউডি ছবিতে চুমুর দৃশ্য অত্যন্ত ন্যাচারাল। তাতে অশ্লীলতা থাকে না; যতটা থাকে হিন্দি ছবির চুম্বনবর্জিত অশ্লীল দেহভঙ্গিসর্বস্ব ছবিগুলোতে। এদিক থেকে উপমহাদেশের চলচ্চিত্রে অশ্লীল শরীর প্রদর্শনী বন্ধ করে প্রেমের দৃশ্যে নায়ক-নায়িকার স্বাভাবিক চুমু খাওয়ার দৃশ্য যোগ হলে মুম্বাইয়া চলচ্চিত্র শিল্পে যে ভালগারিটি, তা অনেকটাই দূর হবে।
পশ্চিমা দেশগুলোতে প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া সমাজে স্বীকৃত রীতি হওয়ায় তাদের সমাজজীবনে যেমন কোনো অধঃপতন ঘটেনি, তেমনি আমাদের উপমহাদেশে প্রধান সম্প্রদায়গুলোতে প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া নিষিদ্ধ থাকাতেও সমাজ তার তথাকথিত পবিত্রতা রক্ষা করতে পারেনি। বরং যৌন অপরাধের সংখ্যা আমাদের দেশগুলোতেই বেশি। হলিউডের এক সময়ের কিংবদন্তির নায়ক মিসরীয় ওমর শরিফ বলেছেন, চুমু খাওয়াকে সেক্স অ্যাক্ট হিসেবে গণ্য করা উচিত নয়। সেক্স এবং লাভের মধ্যে পার্থক্য আছে। চুম্বন মূলত প্রেম ও ভালোবাসার প্রকাশ। ছায়াছবিতে এই চুম্বনের দৃশ্য বর্জন করার অর্থ প্রেমের দৃশ্যের স্বাভাবিকতাকে বর্জন করা।
মানব সমাজে চুমু খাওয়ার ইতিহাস খুঁজতে গেলে দেখা যায়, একেবারে আদিম যুগ থেকে এই ক্রিয়াটি প্রচলিত। চুম্বনের কয়েকটি শ্রেণী বিভাগ আছে। শিশুদের মুখে আমরা চুমু খাই আদর ও স্নেহ প্রকাশের জন্য। বন্ধুদের মুখে চুমু খাই শুভেচ্ছা ও সম্প্রীতি জানানোর জন্য। পবিত্র গ্রন্থে আমরা চুমু খাই আনুগত্য প্রকাশের জন্য। শুধু বয়োপ্রাপ্ত নর-নারী পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হলে চুমু বিনিময় করে প্রেম ও ভালোবাসা প্রকাশের জন্য। আমাদের সমাজব্যবস্থায় এই শেষোক্ত চুম্বন প্রকাশ্যে বিনিময় নিষিদ্ধ। অপর চুম্বনগুলো নয়।
কিন্তু ধর্ম, সমাজ ও সব ধরনের রক্ষণশীলতার হাজারো বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও নর-নারীর প্রকাশ্য মেলামেশা ও মিলন যেমন বন্ধ রাখা যায়নি; তেমনি ঘরের বাইরেও (এমনকি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেও) প্রেমে আবদ্ধ নর-নারী বা ছাত্রছাত্রীর মধ্যে গোপন চুমু বিনিময় বন্ধ করা যায়নি। উপমহাদেশের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে গোপনে চুম্বন বিনিময়ে রত প্রেমিক ছাত্রছাত্রী ধরা পড়ায় শাস্তি ভোগ করেছেন এবং এখনও করছেন, তার উদাহরণ আছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা এই শাস্তিদানের নিয়ম বাতিল এবং প্রকাশ্যে চুমু বিনিময়ের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলনে নেমেছেন। এটা ভালো কী মন্দ, সেই রায় দেয়ার এখতিয়ার আমার নেই।
একটা মজার ব্যাপার এই যে, আমাদের এশিয়া-আফ্রিকার বহু দেশে প্রকাশ্যে চুমু খাওয়াকে শুধু অশালীনতা নয়, অপরাধ বলে গণ্য করা হয়। লন্ডনের রাস্তায় কোনো নর-নারী প্রকাশ্যে চুমু খেলে বা আলিঙ্গনাবদ্ধ হলে সেদিকে কেউ নজরই দেবে না। কিন্তু ঢাকার রাস্তায় এই ঘটনাটি ঘটলে পুলিশ হয়তো চুমু খাওয়ারত দুজনকেই গ্রেফতার করবে। কিন্তু এই নিষিদ্ধ বস্তুটি ছাড়া আমাদের শিল্প, সাহিত্য, কাব্য, সঙ্গীত সব কিছুই অচল। সেই প্রাচীন যুগের আরব ও পারস্যের সাহিত্যেও চুমুর ছড়াছড়ি। উদাহরণ হিসেবে আলেফ লায়লা বা আরব্য রজনীয় একটি কাহিনীর কথা উল্লেখ করা যায়।
বাগদাদের খলিফার সুন্দরী পত্নী গেছেন সখীদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে দোকানে কাপড় কিনতে। একটি মহামূল্যবান সিল্কের কাপড় তিনি পছন্দ করলেন। দোকানিকে তার দাম জিজ্ঞাসা করলেন। দোকানি বেগমের রূপ দর্শনে তখন মুগ্ধ এবং অভিভূত। সে বলল, বেগম যদি তাকে গালে একটি চুমু খেতে দেন, তাহলেই হবে। ওই কাপড়ের জন্য দাম দিতে হবে না। বেগমের খুবই পছন্দ কাপড়টি। কিন্তু দোকানি চুমু ছাড়া সেটা বেচতে রাজি নয়।
অনেক ভেবেচিন্তে বেগম বললেন, তিনি তার অনাবৃত গালে দোকানিকে চুমু খেতে দেবেন না। তবে তিনি তার গাল পুরু সাত পাল্লার কাপড় দ্বারা আবৃত করবেন। দোকানি তার ওপর চুমু খেতে পারে। দোকানি তাতেই রাজি। অতঃপর কাপড় আবৃত বেগমের গালে চুমু খেয়ে দোকানি মূল্যবান বস্ত্রটি তাকে দিল। বেগম খুশি মনে প্রাসাদে ফিরলেন। কিন্তু রাতে শয়নকক্ষে এসে খলিফা তার পতœীর দিকে একবার তাকিয়েই বললেন, তোমার বাঁ গালে লালচে আভা দেখছি। কেউ চুমু খেয়েছে নাকি? শংকিত বেগম ভেবে পেলেন না সাত স্তবক কাপড় দ্বারা আবৃত তার গালে দোকানির চুমু খাওয়ার দাগ কেমন করে লাগল?
আরব্য রজনীর অনেক কাহিনীতেই আছে এ চুমু খাওয়ার কথা। এ যুগের ইংরেজি, ফরাসি এমনকি বাংলা সাহিত্যেও রয়েছে চুম্বনের ছড়াছড়ি। রবীন্দ্রনাথ চুম্বন নামে একটি কবিতাই লিখেছেন। তার এই চুম্বনের শ্লীলতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেননি। কারণ তা রয়েছে ভাষাশৈলীর সৌন্দর্য দ্বারা আবৃত। ত্রিশের বাঙালি কবি বুদ্ধদেব বসু অসাধারণ শক্তিশালী কবি হওয়া সত্ত্বেও এই শ্লীলতা রক্ষা করেননি। তার কবিতায় চুম্বন কেবল প্রেমের নয়, যৌনাকাক্সক্ষার প্রতীক। রবীন্দ্রনাথের চুম্বনের সঙ্গে এখানে চুম্বনের পার্থক্য।
চুম্বনের ছড়াছড়ি সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ফরাসি সাহিত্যে। ফ্রান্সে এক সময় পুরুষদের ঘন গোঁফ রাখা ফ্যাশন ছিল। প্রথম মহাযুদ্ধের কিছু আগে থেকে ফরাসি পুরুষরা তাদের গোঁফ কামাতে শুরু করে। তখনকার এই অবস্থায় বর্ণনা রয়েছে ফ্রাসোয়া সাঁগার একটি বিখ্যাত উপন্যাসে। উপন্যাসের প্রায় মধ্যবয়সী নায়িকা বলছেন, আমাদের পুরুষরা গোঁফ কামাতে শুরু করেছেন। ওদের ঠোঁটে চুমু খাওয়ার মজাটাই নষ্ট হয়ে গেছে।
চুম্বন মাহত্ম্যের কথা আর কত লিখব? সেই আদি যুগ থেকে বিশ্বের শিল্পে, সাহিত্যে, কাব্যে, নাটকে রয়েছে চুম্বনের ছড়াছড়ি। কিন্তু প্রাচ্যে বহুকাল ধরে এই স্বাভাবিক আনন্দটি সমাজ জীবনে গোপন বিষয়ে ঠেলে রাখা হয়েছে। তার স্বাভাবিক প্রকাশকে ধর্ম ও সামাজিক শাসন দ্বারা রুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। কিন্তু সময় ও কালের রথের চাকায় এই বাধা মানেনি। ইউরোপ-আমেরিকায় বেশ কয়েক বছর আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা জেন্ডার ডিসক্রিমিনেশন বা লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছে। সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা বার্ন দ্য ব্রা সোগান তুলে ব্রেসিয়ার পুড়িয়েছিল। আমেরিকায় ছাত্রীদের ফ্রি দ্য নিপ্পল আন্দোলনও এক সময় সমাজ শাসকদের চোখ লাল করেছিল।
প্রাচ্যদেশীয় ছাত্রীরা এখন পর্যন্ত অতটা আগায়নি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে মাত্র প্রকাশ্যে চুমু খাওয়ার দাবি তুলেছে। কিন্তু প্রশ্ন হল উপমহাদেশের প্রায় সব কটি দেশে যখন আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় ধর্মীয় মৌলবাদের রক্ষণশীলতার উত্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তখন পশ্চিমবঙ্গের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে হঠাৎ নারীবাদের প্লাবন বইল কেন? এ সম্পর্কে দৈনিক স্টেটসম্যানেই বন্দনা রায় নামে এক ভদ্রমহিলা লিখেছেন, কী হল নতুন প্রজন্মের? আসলে ভারতে ইন্দ্রিয় সুখভোগের জোয়ার এসেছে। রক্ষণশীল সমাজে ভারতীয়দের যৌনক্ষুধা অতৃপ্ত ছিল। বিশ্বায়নের ফলে ঐতিহ্যের দেয়াল ভাঙছে। ভাঙছে নতুন প্রজন্ম। বরাবর তাই হয়ে এসেছে। (দৈনিক স্টেটসম্যান, ১৮ নভেম্বর মঙ্গলবার, ২০১৪)
আমি এই মন্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করি না। অতৃপ্ত যৌনক্ষুধা থেকে অন্তত নারীমুক্তি আন্দোলনের জন্ম নয়। এই আন্দোলনের জন্ম মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার উদগ্রীব আকাক্সক্ষা থেকে। সময় সময় এই আন্দোলনে বা নারীর (এবং পুরুষেরও) এই মুক্তি কামনায় আতিশয্য ঘটে থাকতে পারে। কিন্তু তা আসল লক্ষ্য থেকে ভ্রষ্ট হয়নি। সেই লক্ষ্য হল মানবিক জীবনের স্বাভাবিক চাহিদাগুলো পূরণ- যা ধর্ম, সমাজের অতীতমুখী নানা বিধিবিধানে বেঁধে রাখা হয়েছে।
আমাদের দেশের সমাজচেতনা এখনই এতটা সচেতন ও স্বনিয়ন্ত্রিত নয় যে, এই মুহূর্তে যাবদপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের দাবি পূরণ করা যেতে পারে। কিন্তু বর্তমান কাল সে দাবি পূর্ণ করতে না পারলেও ভাবীকাল হয়তো করবে। যেমন ঘটেছে পশ্চিমা দেশগুলোতে। সবার অলক্ষ্যে পরিবর্তনটি ঘটেছে সময়ের জোয়ারে। ধর্ম ও সমাজপতিদের অনুমতি নিয়ে এই পরিবর্তন ঘটেনি।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনে বাংলাদেশে আমাদের আপাতত ভীত হওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশে নারীমুক্তি আন্দোলনের পাশাপাশি নারী নির্যাতনও বাড়ছে। কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজাব পরা ছাত্রীর সংখ্যা বেড়ে চলা সত্ত্বেও ক্যাম্পাসে যৌন অপরাধ অব্যাহত রয়েছে। কখনও কখনও একশ্রেণীর শিক্ষকও তাতে জড়িত। তাতেই বোঝা যায়, হিজাব যৌন অপরাধের তেমন কোনো প্রতিষেধক নয়। তা সত্ত্বেও এই হিজাব পরা পশ্চিমের দেশগুলোতেও মুসলিম কমিউনিটির নারীদের একটা বড় অংশের এখন ফ্যাশন।
এই ফ্যাশনের জোয়ার যতদিন অব্যাহত আছে, ততদিন যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীদের প্রকাশ্যে চুমু খাওয়ার অধিকার দাবির আন্দোলন সম্পর্কে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। সমাজ ও সংস্কৃতির অগ্রগতি কখনও সমন্বয়মূলক, কখনও সংঘর্ষমূলক। বর্তমানে উপমহাদেশে যে অগ্রগতি ঘটছে দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে, তাতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের হাওয়া ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর বা সাভার বিশ্ববিদ্যালয়ে সহসা প্রবাহিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে আমার ধারণা ভুলও প্রমাণ হতে পারে।
লন্ডন ৩০ নভেম্বর রোববার, ২০১৪
এই সমস্যা সম্পর্কিত খবরটি দিয়েছেন কলকাতার দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকা (১৮ নভেম্বর মঙ্গলবার ২০১৪)। খবরটি হল, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ৫ নভেম্বর এক বিরাট মিছিল বের করেছিল। তাদের দাবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ও চত্বরে ছাত্রছাত্রীদের প্রকাশ্যে চুম্বন বিনিময়ের অধিকার দিতে হবে। এই অধিকার আদায়ের দাবিতে এক যুগল ছাত্রছাত্রী প্রকাশ্যে চুম্বন বিনিময় করেছে এবং সেই ছবিও কাগজে ছাপা হয়েছে।
এই ছাত্রছাত্রীরা দাবি করেছে, তারা মরাল পুলিশিং এবং গৈরিক সন্ত্রাসের বিরোধী। মিছিলের কয়েকশ ছাত্রছাত্রী যাদবপুর থানার সামনে জড়ো হয়ে সোগান দিয়েছে, চুমু চুমু চুমু চাই- চুমু খেয়ে বাঁচতে চাই। আরেকটি সোগান আমার দেহ আমার মন, দূর হটো রাজ্যশাসন। ছাত্রছাত্রীদের গলায় ঝোলানো পোস্টারে লেখা ছিল, পেয়ার কি আজাদি চাই, লাভ কি ফ্রিডম চাই এবং চুমু খাওয়া আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার।
একেবারে ঘরের কাছে কলকাতার এ খবর পাঠ করে শঙ্কিত হইনি, বরং মজা পেয়েছি। বহু দশক আগে নারীবাদী আন্দোলনের নামে পশ্চিমা বিশ্বে শিক্ষিত নারীরা যা করেছেন, তার বিলম্বিত অনুকরণ শুরু হয়েছে এতদিনে ভারতীয় উপমহাদেশে। মৌলবাদী রক্ষণশীলতার যখন ঝড় বইছে উপমহাদেশের সবগুলো দেশে, তখন ভারতের হিন্দুত্ববাদী ও বাংলাদেশে পাকিস্তানের ইসলামী জঙ্গিদের নাকের ওপরে এই চুমু খাওয়ার অধিকারের আন্দোলন প্রকাশ্য রূপ ধারণ করল কিভাবে? তাহলে কি কবির কথাই সঠিক, এ যৌবন জলতরঙ্গ রোধিবি কী দিয়া বালির বাঁধ?
বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রেমিক-প্রেমিকাদের মধ্যে প্রকাশ্যে চুমু বিনিময়ের অধিকার স্বীকৃতি পেলে তারপরই দাবি উঠতে পারে প্রকাশ্যে আলিঙ্গন করার অধিকার নিয়ে। আলিঙ্গনের অধিকার স্বীকৃতি পেলে তার পরের দাবিটা কী হতে পারে? তা ভেবে হয়তো যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ অস্থির। তাদের একদিকে রক্ষণশীল সমাজ ও সমাজপতিদের রক্তচক্ষুর শাসন এবং অন্যদিকে শাসন ও নিয়মভাঙার উদ্যমতায় অধীর তরুণ সমাজ। এই দুয়ের সংঘর্ষের মধ্য দিয়েই সমাজ ও সভ্যতা সব সময় আগায়। আবার কোনো কোনো সংঘর্ষ সমাজের অগ্রগতি নয়, অধোগতির সূচনা করে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন কি সমাজ-প্রগতির জন্ম দেবে, না সমাজের জন্য ডেকে আনবে আরও অধোগতি?
প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া বা চুমু বিনিময় পশ্চিমা দেশগুলোতে কোনো সমস্যাই নয়। এককালে ছিল। এখন নেই। তাতে সমাজের অধোগতি নয়, অগ্রগতি হয়েছে। প্রকাশ্যে চুম্বন বিনিময় দেশগুলোতে সেক্সক্রাইম বাড়ায়নি। বরং কমিয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলোর রাস্তাঘাটে, ট্রেনে-বাসে, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রেমিক-প্রেমিকারা অবাধে চুমু বিনিময় করছে। বিয়ের পর বর-বধূ পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজনের সামনে পরস্পর চুমু বিনিময় করে। তা এখন সমাজে স্বীকৃত ও আচরিত। তাতে পাশ্চাত্য সমাজে কোনো অরাজকতা সৃষ্টি হয়নি।
আমাদের দেশেও প্রেমিক-প্রেমিকারা চুমু খান। এটা কোনো পাপ নয়। সহজাত, স্বাভাবিক ক্রিয়া। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরেও এটি ঘটে। তবে প্রকাশ্যে নয়, সংগোপনে। আমাদের উপমহাদেশীয় সব ধর্মের সমাজেই প্রকাশ্য চুম্বন সমাজ-স্বীকৃত প্রথা নয়। এমনকি স্বীমা-স্ত্রীর মধ্যেও নয়। একমাত্র শিশুদের দেয়া আদরের চুমু এবং আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে গালে গাল ঠেকিয়ে চুমু খাওয়া সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত প্রথা। তার বাইরে আর সবকিছুই গোপনীয়তায় ঢাকা।
উপমহাদেশে শুধু মুসলমান সমাজে নয়, অন্যান্য ধর্মীয় সমাজেও প্রকাশ্যে চুম্বন বিনিময় বৈধ নয়। মুসলিম সমাজে নর-নারীর প্রকাশ্য মেলামেশাও নিষিদ্ধ। উপমহাদেশে নাটকাভিনয়ে বা চলচ্চিত্রে নায়ক-নায়িকার প্রেমের দৃশ্যেও চুম্বন বর্জিত ছিল। পশ্চিমা প্রভাবে মুম্বাইয়া হিন্দি ছবিতে চুমু খাওয়ার দৃশ্য এখন ক্রমেই স্থান করে নিচ্ছে। তবে মুম্বাইয়া অধিকাংশ ছবিতে শরীর প্রদর্শন ও অশ্লীল যেসব অঙ্গভঙ্গি থাকে, তার বদলে চুম্বন যোগ হলে বরং ছায়াছবিতে অশ্লীলতা কমবে। হলিউডি ছবিতে চুমুর দৃশ্য অত্যন্ত ন্যাচারাল। তাতে অশ্লীলতা থাকে না; যতটা থাকে হিন্দি ছবির চুম্বনবর্জিত অশ্লীল দেহভঙ্গিসর্বস্ব ছবিগুলোতে। এদিক থেকে উপমহাদেশের চলচ্চিত্রে অশ্লীল শরীর প্রদর্শনী বন্ধ করে প্রেমের দৃশ্যে নায়ক-নায়িকার স্বাভাবিক চুমু খাওয়ার দৃশ্য যোগ হলে মুম্বাইয়া চলচ্চিত্র শিল্পে যে ভালগারিটি, তা অনেকটাই দূর হবে।
পশ্চিমা দেশগুলোতে প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া সমাজে স্বীকৃত রীতি হওয়ায় তাদের সমাজজীবনে যেমন কোনো অধঃপতন ঘটেনি, তেমনি আমাদের উপমহাদেশে প্রধান সম্প্রদায়গুলোতে প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া নিষিদ্ধ থাকাতেও সমাজ তার তথাকথিত পবিত্রতা রক্ষা করতে পারেনি। বরং যৌন অপরাধের সংখ্যা আমাদের দেশগুলোতেই বেশি। হলিউডের এক সময়ের কিংবদন্তির নায়ক মিসরীয় ওমর শরিফ বলেছেন, চুমু খাওয়াকে সেক্স অ্যাক্ট হিসেবে গণ্য করা উচিত নয়। সেক্স এবং লাভের মধ্যে পার্থক্য আছে। চুম্বন মূলত প্রেম ও ভালোবাসার প্রকাশ। ছায়াছবিতে এই চুম্বনের দৃশ্য বর্জন করার অর্থ প্রেমের দৃশ্যের স্বাভাবিকতাকে বর্জন করা।
মানব সমাজে চুমু খাওয়ার ইতিহাস খুঁজতে গেলে দেখা যায়, একেবারে আদিম যুগ থেকে এই ক্রিয়াটি প্রচলিত। চুম্বনের কয়েকটি শ্রেণী বিভাগ আছে। শিশুদের মুখে আমরা চুমু খাই আদর ও স্নেহ প্রকাশের জন্য। বন্ধুদের মুখে চুমু খাই শুভেচ্ছা ও সম্প্রীতি জানানোর জন্য। পবিত্র গ্রন্থে আমরা চুমু খাই আনুগত্য প্রকাশের জন্য। শুধু বয়োপ্রাপ্ত নর-নারী পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হলে চুমু বিনিময় করে প্রেম ও ভালোবাসা প্রকাশের জন্য। আমাদের সমাজব্যবস্থায় এই শেষোক্ত চুম্বন প্রকাশ্যে বিনিময় নিষিদ্ধ। অপর চুম্বনগুলো নয়।
কিন্তু ধর্ম, সমাজ ও সব ধরনের রক্ষণশীলতার হাজারো বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও নর-নারীর প্রকাশ্য মেলামেশা ও মিলন যেমন বন্ধ রাখা যায়নি; তেমনি ঘরের বাইরেও (এমনকি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেও) প্রেমে আবদ্ধ নর-নারী বা ছাত্রছাত্রীর মধ্যে গোপন চুমু বিনিময় বন্ধ করা যায়নি। উপমহাদেশের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে গোপনে চুম্বন বিনিময়ে রত প্রেমিক ছাত্রছাত্রী ধরা পড়ায় শাস্তি ভোগ করেছেন এবং এখনও করছেন, তার উদাহরণ আছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা এই শাস্তিদানের নিয়ম বাতিল এবং প্রকাশ্যে চুমু বিনিময়ের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলনে নেমেছেন। এটা ভালো কী মন্দ, সেই রায় দেয়ার এখতিয়ার আমার নেই।
একটা মজার ব্যাপার এই যে, আমাদের এশিয়া-আফ্রিকার বহু দেশে প্রকাশ্যে চুমু খাওয়াকে শুধু অশালীনতা নয়, অপরাধ বলে গণ্য করা হয়। লন্ডনের রাস্তায় কোনো নর-নারী প্রকাশ্যে চুমু খেলে বা আলিঙ্গনাবদ্ধ হলে সেদিকে কেউ নজরই দেবে না। কিন্তু ঢাকার রাস্তায় এই ঘটনাটি ঘটলে পুলিশ হয়তো চুমু খাওয়ারত দুজনকেই গ্রেফতার করবে। কিন্তু এই নিষিদ্ধ বস্তুটি ছাড়া আমাদের শিল্প, সাহিত্য, কাব্য, সঙ্গীত সব কিছুই অচল। সেই প্রাচীন যুগের আরব ও পারস্যের সাহিত্যেও চুমুর ছড়াছড়ি। উদাহরণ হিসেবে আলেফ লায়লা বা আরব্য রজনীয় একটি কাহিনীর কথা উল্লেখ করা যায়।
বাগদাদের খলিফার সুন্দরী পত্নী গেছেন সখীদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে দোকানে কাপড় কিনতে। একটি মহামূল্যবান সিল্কের কাপড় তিনি পছন্দ করলেন। দোকানিকে তার দাম জিজ্ঞাসা করলেন। দোকানি বেগমের রূপ দর্শনে তখন মুগ্ধ এবং অভিভূত। সে বলল, বেগম যদি তাকে গালে একটি চুমু খেতে দেন, তাহলেই হবে। ওই কাপড়ের জন্য দাম দিতে হবে না। বেগমের খুবই পছন্দ কাপড়টি। কিন্তু দোকানি চুমু ছাড়া সেটা বেচতে রাজি নয়।
অনেক ভেবেচিন্তে বেগম বললেন, তিনি তার অনাবৃত গালে দোকানিকে চুমু খেতে দেবেন না। তবে তিনি তার গাল পুরু সাত পাল্লার কাপড় দ্বারা আবৃত করবেন। দোকানি তার ওপর চুমু খেতে পারে। দোকানি তাতেই রাজি। অতঃপর কাপড় আবৃত বেগমের গালে চুমু খেয়ে দোকানি মূল্যবান বস্ত্রটি তাকে দিল। বেগম খুশি মনে প্রাসাদে ফিরলেন। কিন্তু রাতে শয়নকক্ষে এসে খলিফা তার পতœীর দিকে একবার তাকিয়েই বললেন, তোমার বাঁ গালে লালচে আভা দেখছি। কেউ চুমু খেয়েছে নাকি? শংকিত বেগম ভেবে পেলেন না সাত স্তবক কাপড় দ্বারা আবৃত তার গালে দোকানির চুমু খাওয়ার দাগ কেমন করে লাগল?
আরব্য রজনীর অনেক কাহিনীতেই আছে এ চুমু খাওয়ার কথা। এ যুগের ইংরেজি, ফরাসি এমনকি বাংলা সাহিত্যেও রয়েছে চুম্বনের ছড়াছড়ি। রবীন্দ্রনাথ চুম্বন নামে একটি কবিতাই লিখেছেন। তার এই চুম্বনের শ্লীলতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেননি। কারণ তা রয়েছে ভাষাশৈলীর সৌন্দর্য দ্বারা আবৃত। ত্রিশের বাঙালি কবি বুদ্ধদেব বসু অসাধারণ শক্তিশালী কবি হওয়া সত্ত্বেও এই শ্লীলতা রক্ষা করেননি। তার কবিতায় চুম্বন কেবল প্রেমের নয়, যৌনাকাক্সক্ষার প্রতীক। রবীন্দ্রনাথের চুম্বনের সঙ্গে এখানে চুম্বনের পার্থক্য।
চুম্বনের ছড়াছড়ি সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ফরাসি সাহিত্যে। ফ্রান্সে এক সময় পুরুষদের ঘন গোঁফ রাখা ফ্যাশন ছিল। প্রথম মহাযুদ্ধের কিছু আগে থেকে ফরাসি পুরুষরা তাদের গোঁফ কামাতে শুরু করে। তখনকার এই অবস্থায় বর্ণনা রয়েছে ফ্রাসোয়া সাঁগার একটি বিখ্যাত উপন্যাসে। উপন্যাসের প্রায় মধ্যবয়সী নায়িকা বলছেন, আমাদের পুরুষরা গোঁফ কামাতে শুরু করেছেন। ওদের ঠোঁটে চুমু খাওয়ার মজাটাই নষ্ট হয়ে গেছে।
চুম্বন মাহত্ম্যের কথা আর কত লিখব? সেই আদি যুগ থেকে বিশ্বের শিল্পে, সাহিত্যে, কাব্যে, নাটকে রয়েছে চুম্বনের ছড়াছড়ি। কিন্তু প্রাচ্যে বহুকাল ধরে এই স্বাভাবিক আনন্দটি সমাজ জীবনে গোপন বিষয়ে ঠেলে রাখা হয়েছে। তার স্বাভাবিক প্রকাশকে ধর্ম ও সামাজিক শাসন দ্বারা রুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। কিন্তু সময় ও কালের রথের চাকায় এই বাধা মানেনি। ইউরোপ-আমেরিকায় বেশ কয়েক বছর আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা জেন্ডার ডিসক্রিমিনেশন বা লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছে। সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা বার্ন দ্য ব্রা সোগান তুলে ব্রেসিয়ার পুড়িয়েছিল। আমেরিকায় ছাত্রীদের ফ্রি দ্য নিপ্পল আন্দোলনও এক সময় সমাজ শাসকদের চোখ লাল করেছিল।
প্রাচ্যদেশীয় ছাত্রীরা এখন পর্যন্ত অতটা আগায়নি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে মাত্র প্রকাশ্যে চুমু খাওয়ার দাবি তুলেছে। কিন্তু প্রশ্ন হল উপমহাদেশের প্রায় সব কটি দেশে যখন আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় ধর্মীয় মৌলবাদের রক্ষণশীলতার উত্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তখন পশ্চিমবঙ্গের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে হঠাৎ নারীবাদের প্লাবন বইল কেন? এ সম্পর্কে দৈনিক স্টেটসম্যানেই বন্দনা রায় নামে এক ভদ্রমহিলা লিখেছেন, কী হল নতুন প্রজন্মের? আসলে ভারতে ইন্দ্রিয় সুখভোগের জোয়ার এসেছে। রক্ষণশীল সমাজে ভারতীয়দের যৌনক্ষুধা অতৃপ্ত ছিল। বিশ্বায়নের ফলে ঐতিহ্যের দেয়াল ভাঙছে। ভাঙছে নতুন প্রজন্ম। বরাবর তাই হয়ে এসেছে। (দৈনিক স্টেটসম্যান, ১৮ নভেম্বর মঙ্গলবার, ২০১৪)
আমি এই মন্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করি না। অতৃপ্ত যৌনক্ষুধা থেকে অন্তত নারীমুক্তি আন্দোলনের জন্ম নয়। এই আন্দোলনের জন্ম মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার উদগ্রীব আকাক্সক্ষা থেকে। সময় সময় এই আন্দোলনে বা নারীর (এবং পুরুষেরও) এই মুক্তি কামনায় আতিশয্য ঘটে থাকতে পারে। কিন্তু তা আসল লক্ষ্য থেকে ভ্রষ্ট হয়নি। সেই লক্ষ্য হল মানবিক জীবনের স্বাভাবিক চাহিদাগুলো পূরণ- যা ধর্ম, সমাজের অতীতমুখী নানা বিধিবিধানে বেঁধে রাখা হয়েছে।
আমাদের দেশের সমাজচেতনা এখনই এতটা সচেতন ও স্বনিয়ন্ত্রিত নয় যে, এই মুহূর্তে যাবদপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের দাবি পূরণ করা যেতে পারে। কিন্তু বর্তমান কাল সে দাবি পূর্ণ করতে না পারলেও ভাবীকাল হয়তো করবে। যেমন ঘটেছে পশ্চিমা দেশগুলোতে। সবার অলক্ষ্যে পরিবর্তনটি ঘটেছে সময়ের জোয়ারে। ধর্ম ও সমাজপতিদের অনুমতি নিয়ে এই পরিবর্তন ঘটেনি।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনে বাংলাদেশে আমাদের আপাতত ভীত হওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশে নারীমুক্তি আন্দোলনের পাশাপাশি নারী নির্যাতনও বাড়ছে। কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজাব পরা ছাত্রীর সংখ্যা বেড়ে চলা সত্ত্বেও ক্যাম্পাসে যৌন অপরাধ অব্যাহত রয়েছে। কখনও কখনও একশ্রেণীর শিক্ষকও তাতে জড়িত। তাতেই বোঝা যায়, হিজাব যৌন অপরাধের তেমন কোনো প্রতিষেধক নয়। তা সত্ত্বেও এই হিজাব পরা পশ্চিমের দেশগুলোতেও মুসলিম কমিউনিটির নারীদের একটা বড় অংশের এখন ফ্যাশন।
এই ফ্যাশনের জোয়ার যতদিন অব্যাহত আছে, ততদিন যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীদের প্রকাশ্যে চুমু খাওয়ার অধিকার দাবির আন্দোলন সম্পর্কে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। সমাজ ও সংস্কৃতির অগ্রগতি কখনও সমন্বয়মূলক, কখনও সংঘর্ষমূলক। বর্তমানে উপমহাদেশে যে অগ্রগতি ঘটছে দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে, তাতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের হাওয়া ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর বা সাভার বিশ্ববিদ্যালয়ে সহসা প্রবাহিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে আমার ধারণা ভুলও প্রমাণ হতে পারে।
লন্ডন ৩০ নভেম্বর রোববার, ২০১৪
No comments