ইন্টারভিউ বোর্ডে যখন শিক্ষামন্ত্রী
সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে পদায়নের জন্য শিক্ষকদের যোগ্যতা যাচাইয়ে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও দলবাজি বন্ধ করতেই এই সাক্ষাৎকার বলে দাবি করেছেন শিক্ষামন্ত্রী। তবে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পেতে ইচ্ছুক শিক্ষকরা বলেছেন, মন্ত্রী নিজে এ সাক্ষাৎকার নিয়ে অনিয়ম বন্ধ করতে পারবেন না। কারণ, তদবিরবাজরা মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে তদবিরের কাজ সেরে ফেলেছেন। তবে শিক্ষামন্ত্রী বলছেন, অনিয়ম বন্ধ করতে আমাদের এ উদ্যোগ। এটা কোন পরীক্ষা না। কেবল অধ্যক্ষ পদায়নের জন্য তাদের সাক্ষাৎকার নেয়া। মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত ১৫ই অক্টোবর অধ্যক্ষ পদে সাক্ষাৎকারের জন্য ১৬৫ জন কর্মকর্তার একটি তালিকা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। আবেদনকৃত কর্মকর্তাগণকে নমুনা ছকে তথ্য ও উত্তরসহ সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার কথা বলা হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় তথ্যমতে, দেশের ৬৬টি সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ পদ বর্তমানে শূন্য রয়েছে। এসব পদে আসীন হতে ইচ্ছুক শিক্ষকদের রোববার সাক্ষাৎকার নেন শিক্ষামন্ত্রী। সকাল ৮টা থেকে শুরু হয়ে এ সাক্ষাৎকার চলে রাত ৮টা পর্যন্ত। নমুনা সাক্ষাৎকারের আবেদনপত্রে নাম, পদবি, জন্ম তারিখ ও বর্তমান কর্মস্থল ছাড়া তিনটি প্রশ্ন জুড়ে দেয়া হয়। সেখানে একজন অধ্যক্ষকে বলা হয়, আপনি প্রিন্সিপাল হলে আগামী এক বছর কলেজের কি কি ইনোভেটিভ (সৃষ্টিশীল) কাজ করবেন? দুই নম্বরে লেখা ছিল আপনার কলেজের শিখন-শেখানোর উন্নয়নের আগামী এক বছরে কি কি পদক্ষেপ নেবেন এবং তৃতীয় প্রশ্নে জানতে চাওয়া হয়, শিক্ষায় আইটি ব্যবহারে আপনি কি কি পদক্ষেপ নেবেন? সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি কলেজে অধ্যক্ষ পদায়নের বিষয়টি একটি রুটিন কাজ। এ ধরনের প্রক্রিয়ায় একজন মন্ত্রীর একটি দিন ব্যয় করার কোন মানে নেই। এ বিষয়টি অনেকটা ‘মশা মারতে কামান দাগানোর মতো’। কেননা, যে কাজটি ফাইল নোটের মাধ্যমে সচরাচর দাপ্তরিক পর্যায়ে হয়ে থাকে, সেটা নিয়ে রাষ্ট্রের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মূল্যবান সময় ব্যয় শুধু অনর্থক নয়, অপ্রয়োজনীয় বটে। এ ধরনের পদক্ষেপকে প্রশাসনিক ব্যর্থতার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত বলে আখ্যায়িত করে শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশাসন যদি এ বিষয়টি করতে ব্যর্থ হতো, তবেই শিক্ষাক্ষেত্রে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় এই ব্যক্তি হস্তক্ষেপ করতে পারেন। মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, এর আগে ৬৭টি কলেজে অধ্যক্ষ ও ৯টি কলেজে উপাধ্যক্ষ নিয়োগের ক্ষেত্রে সাক্ষাৎকার নেন শিক্ষামন্ত্রী। এতে কোন ভাল ফল বয়ে আনতে পারেনি তিনি। রোববার সাক্ষাৎকারের পর কক্সবাজার সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যাপক মোহাম্মদ নূর নবী বলেন, সাক্ষাৎকার তেমন কিছু না। শুধু নাম, পরিচয়, কেমন আছেন ইত্যাদি বিষয়। তিনি বলেন, চাকরির শেষ জীবনে এসে এ ধরনের সাক্ষাৎকারে আমাদের শুধু অসম্মানই করা হয়নি, রীতিমতো অপমান করা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, অধ্যক্ষ নিয়োগের ব্যাপারে ২০১২ সালের ২৬শে এপ্রিল মন্ত্রী নাহিদেরই? তত্ত্বাবধানে একটি নীতিমালা তৈরি হয়। সেখানে বলা হয়, এ কাজটি সম্পন্ন করতে সর্বোচ্চ একজন অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে মনোনীত করা হয়েছে। অর্থাৎ এটি সচিবেরও কাজ নয়। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের মহাপরিচালক এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিবের সমন্বয়ে তিন সদস্যের কমিটি একটি ফিটলিস্ট (উপযুক্ত ব্যক্তি নির্বাচন) তৈরি করবেন। অথচ সেই কাজে মন্ত্রী নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করতে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ বিসিএস শিক্ষক সমিতির এক নেতা বলেন, বিভিন্ন সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ নিয়োগে যে নীতিমালা করা হয়েছে তাতে পরিষ্কার ভাষায় কর্মকর্তা (অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ) নির্বাচনের কথা বলা আছে। এরপরও এ ধরনের সাক্ষাৎকার শুধু স্বজনপ্রীতি, দলপ্রীতি এবং অনিয়ম-দুর্নীতির লক্ষ্য হতে পারে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ জানান, এটা কোন পরীক্ষা না। তাদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করা মাত্র। এটিকে নেগেটিভভাবে দেখার কিছু নেই।
তিনি বলেন, আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলে তাদের আইডিয়াগুলো জানার চেষ্টা করছি। এ বিষয়ে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. ওসমান ফারুক বলেন, কলেজের অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ পদায়নের মতো বিষয়ে সাক্ষাৎকার খোদ শিক্ষামন্ত্রীর নেয়ার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। একজন মন্ত্রী কেন এ কাজটি করবেন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, মন্ত্রীকে যদি এ কাজ করতে হয় তবে নীতিনির্ধারণী কাজ করবেন কে? তিনি বলেন, প্রশাসন যদি এ কাজটি করতে ব্যর্থ হয় তবেই সংশ্লিষ্ট সর্বোচ্চ ব্যক্তি এখানে হাত দিতে পারেন। তিনি মন্ত্রী থাকার সময় এ ধরনের কোন সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে ওসমান ফারুক জানান, আমি মন্ত্রী থাকাকালে কোন দিন এ ধরনের সাক্ষাৎকার নেইনি। বর্তমানে সারাদেশে সরকারি কলেজ ও সমমানের প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৩০৫টি। এর মধ্যে কলেজ ২৭১টি, শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ (টিটিসি) ১৪টি, সরকারি কমার্শিয়াল কলেজ ১৬টি এবং সরকারি মাদরাসা ৪টি।
No comments