বছরে সড়কে মৃত্যুর মিছিলে ১২০০০ মানুষ
দেশে প্রতি বছর সড়ক পথে দুর্ঘটনায় গড়ে ১২ হাজার মানুষ নিহত ও ৩৫ হাজার আহত হন। চালকদের বেপরোয়া যান চালানোর কারণে প্রায় প্রতিদিনই দেশে ঘটছে এ প্রাণহানি। রাজধানী ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সড়ক-মহাসড়কগুলোর বেহালও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। পাশপাশি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুয়ায়ী বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে ৫৫ জনের মৃত্যু হয়। আর বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে মৃত্যুর হার ৮৫ দশমিক ৬। বেসরকারি এক হিসাবে চলতি বছর প্রথম সাত মাসেই সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ২ হাজার মানুষ। সড়ক দুর্ঘটনায় যে কেবল একটি প্রাণের মৃত্যু হচ্ছে তা নয়, এর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জিডিপির শতকরা ২ ভাগ। গবেষণায় বলা হয়, দুর্ঘটনায় মোট মৃত্যুর শতকরা ৬০ ভাগ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর, যাদের বয়স ১৫ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে। দুর্ঘটনায় যিনি মারা যাচ্ছেন তার সঙ্গে তার পুরো পরিবারেও নেমে আসছে অনিশ্চয়তা। সামপ্রতিক বছরগুলোতে ঈদের সময় মহাসড়কে দুর্ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। এবারের ঈদের ছুটিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় ২৬ জন মারা যান। আর এর আগে ঈদুল ফিতরের সময় মারা যান ৯৬ জন। সম্প্রতি সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সড়ক দুর্ঘটনার দিক দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশ এখন দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব সড়ক দুর্ঘটনার ওপর পরিচালিত জরিপ ও গবেষণাপত্র ব্যবহার করে কার্যকর পদক্ষেপ নিলে মৃত্যুর এ মিছিল কমিয়ে আনা সম্ভব। তবে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে যে আইন রয়েছে তা যুগোপযোগী নয়। পুরনো মোটরযান আইনে কোন পরিবর্তন আনা হয়নি। এছাড়া সড়ক দুর্ঘটনার জন্য করা মামলাগুলোও সাক্ষীর অভাবে বছরের পর বছর ঝুলে থাকে। আসামিরা আইনের ফাঁকফোঁকর গলিয়ে সহজেই জামিনে বেরিয়ে যান। এক জরিপে বলা হয়, সড়ক দুর্ঘটনায় অভিযুক্ত ৮৩ ভাগ আসামি থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এর ফলে চালকদের মধ্যে এক ধরনের বেপরোয়া ভাব দেখা যায়। এছাড়া আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের অবহেলা ও উদাসীনতাতো রয়েছেই। এদিকে, সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর এবং বিআরটিএর প্রতিরোধ সেলগুলোর নজরদারি আরও বাড়ানো প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকরা বলছেন, মহাসড়কের চার ভাগএলাকায় শতকরা ৩৫ ভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে। আর দুর্ঘটনার কারণে বছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায়৭ হাজার কোটি টাকা। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাকের যৌথ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে শতকরা ৬৯ ভাগ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বাস ও ট্রাক। নিহতদের মধ্যে বাস ও কারের আরোহী শতকরা ১৯ ভাগ। তিন চাকার গাড়ির আরোহী ১৬ ভাগ এবং সাইকেল চালক ৩ ভাগ। চালকদের ৮১ শতাংশ গাড়ি চালনা শিখছেন অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায়। আর অদক্ষ চালকের কারণে ২০০০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ৩ হাজার ১৩৭ জন দুর্ঘটনাস্থলেই মারা যান। গবেষকরা দুর্ঘটনার নয়টি কারণ চিহ্নিত করেন। এগুলো হলো বেপরোয়া যান চালানো, চালকের প্রশিক্ষণের অভাব, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, মোটরচালিত যান ও ধীরগতির যানের একই সঙ্গে চলাচল, সড়কের কাছে ঝুঁকিপূর্ণ কর্মকাণ্ড, সড়কের নকশায় ত্রুটি, ট্রাফিক আইনের দুর্বল প্রয়োগ, সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতার অভাব, পথচারীর ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ ও আইনি দুর্বলতা। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, জরুরি বিভাগে ভর্তি হওয়া মোট রোগর শতকরা ৫৬ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনার শিকার। আর হাসপাতালের বেডগুলোর ২৫ থেকে ৩০ ভাগ দুর্ঘটনাকবলিত রোগীতে পূর্ণ। এছাড়া দেশের ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ সড়ক দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনার শিকার শতকরা ২০ ভাগের বয়স ১৬ বছরের নিচে। আর ২৬ থেকে ৩৫ বছরের চালকরাই দুর্ঘটনায় বেশি সম্পৃক্ত। ভারি যান চালকদের ৯০ ভাগেরই কোন প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেই।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ সেন্টারের (এআরসি) গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে ১২ হাজার মানুষ নিহত ও ৩৫ হাজার আহত হন। অপরদিকে, বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের মতে, মহাসড়কের দুর্ঘটনা রোধে ২০০৫ সালে ৭২টি পুলিশ ফাঁড়ি নিয়ে হাইওয়ে পুলিশের যাত্রা শুরু হয়। তবে এটি তেমন একটা কাজে আসছে না। সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠকও নিয়মিত হচ্ছে না। কাউন্সিলের সদস্য, ‘নিরাপদ সড়ক চাই’-এর চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, দেশে যে হারে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে তা মহামারী পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এ বিষয়ে সরকারিভাবে তেমন একটা পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। এ কারণে দুর্ঘটনার মিছিল বাড়ছে। নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়ন করতে সকলের ঐক্য প্রয়োজন। জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস ও জাহানারা কাঞ্চনের ২১তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে গতকাল আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) দীর্ঘ ২১ বছর ধরে সড়ককে নিরাপদ করার লক্ষ্যে আন্দোলন করে আসছে। সড়ককে নিরাপদ করার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় প্রতি বছর ২২শে অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস পালিত হয়। ২২শে অক্টোবর ২০১৪ বুধবার জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস এবং মরহুমা জাহানারা কাঞ্চনের ২১তম মৃত্যুবার্ষিকী। যার অকাল মৃত্যুতে সড়ককে নিরাপদ করার এ সামাজিক আন্দোলনের শুরু। দিবসটি উপলক্ষে নিসচা বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।‘সবাই মিলে ঐক্য করি, সড়ক দুর্ঘটনামুক্ত বাংলাদেশ গড়ি’- এই স্লোগানকে সামনে রেখে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) প্রতি বছরের মতো এ বছরও নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
No comments