অপেক্ষার তেতাল্লিশ বছর by কাজল ঘোষ
আজ এমন ক’জন মানুষের কথা বলবো যারা নিজেদের সম্ভ্রম বিলিয়ে দিয়েছিলেন স্বাধীনতার জন্য। যাপিত জীবনের অসংখ্য ঘটনায় এই সমাজ তাদের খোঁজ নিতে পারেনি যুগের পর যুগ। দেশ এগিয়েছে। রাজনীতির খোলনলচে বদলে গেছে বহুভাবে। দেশে যে হারে ধনীর তালিকা দীর্ঘ হয়েছে। একইভাবে খেলাপি ঋণ গ্রহীতার তালিকাও দীর্ঘ হয়েছে। কিন্তু উন্নয়ন সমীকরণ আর মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা, রাজাকার-আলবদরদের লড়াইয়ে যাদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ কেড়ে নিয়েছিল পাক হানাদার বাহিনী সেই সব নির্যাতিত মায়েদের খোঁজ কি রেখেছে এই রাষ্ট্র?
এসনু বেগম। সিলেটের সীমান্ত এলাকা জকিগঞ্জের। একাত্তরে ১৩-১৪ বছরের কিশোরী। এখন আটান্নতে পা দিয়েছেন। পাকিস্তানি নরপিসাচদের লালসার শিকার হয়েছিলেন এদেশীয় দালালদের বেঈমানির জন্য। নতুন দেশ। চারদিকে আনন্দ। কিন্তু এসনু বেগম লুকালেন। নানা মানুষের নানা কথা। সামাজিকভাবে হেয় আর অপদস্ত হওয়াই যেন নিয়তি। দরিদ্র পরিবার। অনেকদিন পর্যন্ত বিয়েও দিতে পারেনি। কেউ এগিয়ে আসেনি এই মানুষটির জন্য। পরে এক বিপত্নীকের সঙ্গে সংসার। বিয়ের পনের বছরের মাথায় আশ্রয় বলতে স্বামীও মারা যান। নানা রোগ কুরে কুরে খাচ্ছে এসনু বেগমকে। এই তেতাল্লিশ বছরে কেউ তার খোঁজ নেয়নি। একবার কারা যেন এসে এসনু বেগমের নাম লিখে নিয়েছে। এইটুকুনই। বছরের পর বছর পেয়েছে শুধু গঞ্জনা।
লাইলি বেগম। মাগুরার মদনপুরের বাসিন্দা। রঙিন স্বপ্ন নিয়ে ঘর বেঁধেছিলেন। এক বুক আশা দিয়ে। যুদ্ধ শুরু হলে যোগ দেয় স্বপ্নের মানুষ। যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফেরে স্বামী মুক্তিযোদ্ধা মনোয়ার হোসেন। নয় মাসের যুদ্ধ চলাকালে লাইলি বেগমের স্বপ্ন কেড়ে নেয় পাক হানাদার বাহিনী। তার সকল স্বপ্নকে দুমড়ে মুচড়ে জীবনকে চির অন্ধকারে ঠেলে দেয়। যুদ্ধ শেষে নতুন জীবনের তাড়নার বদলে অসীম লাঞ্ছনা নিয়ে অপেক্ষায় থাকে। নতুন আশায় বুক বাঁধে লাইলি-মনোয়ার। স্বামী মনোয়ার কখনও রিকশা কখনও ভ্যান চালিয়ে যা আয় করতেন তাতেই সংসার চলতো। তার ওপর সমাজের নানা মানুষের কটূক্তি। স্বামী মনোয়ার-লাইলির এই আত্মত্যাগ নিয়ে গৌরব করলেও রাষ্ট্র তাদের পাশে দাঁড়ায়নি। দেয়নি সম্মান। দেশের জন্য এত বড় আত্মত্যাগ করে লাইলি খেয়েছে কচু ঘেচু; রোগে চিকিৎসা না পেয়ে কষ্ট ভোগে জীবন কাটাবার অধিকার।
লাইলির ক্ষেত্রে যা হয়েছিল সিরাজগঞ্জের রাহেলার তা হয়নি। জেলার বেলগাতি গ্রামে স্বামীর সামনেই নির্যাতনের শিকার হন রাহেলা। দেশমাতৃকার জন্য সম্ভ্রম হারানো এই মানুষটি প্রত্যাখ্যাত হন স্বামীর কাছ থেকেও। একদিকে সামাজিক লাঞ্ছনা আর অন্যদিকে তালাকনামা। দ্বিমুখী বিপর্যয়ে রাহেলা সমাজের নিচুতলার মানুষ হিসেবে বাঁচার অধিকারটুকুও হারাতে বসেন। স্বাধীনতার পাঁচ বছর পরে বিয়ে করে বাঁচার নতুন লড়াইয়ে নামলেও সে সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। অকালে দ্বিতীয় স্বামীকেও হারান। ছেলেপুলে নিয়ে চরম দরিদ্র অবস্থায় কাল কাটাতে হয়। সঙ্কট শেষ হয়নি রাহেলার। ২০১৩ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি শাহবাগের জাগরণ মঞ্চে নিজের দুঃসহ জীবনযন্ত্রণা তুলে ধরে শাস্তি দাবি করেন যুদ্ধাপরাধীদের। কিন্তু নিজের এলাকায় যারা স্বাধীনতার সুফল ভোগ করছেন- তারা সমাজের খারাপ মেয়ে বলে আখ্যায়িত করে সামাজিকভাবে তাকে একঘরে করে দেন। নিজের মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন যে পরিবারে সেখান থেকেও তাকে তালাকনামা নিয়ে ফিরতে হয়। মায়ের যন্ত্রণা বংশপরম্পরায় মেয়েকেও বইতে হচ্ছে। এ যেন ধারাবাহিক আত্মত্যাগ। কিন্তু এ ত্যাগের বিনিময়ে এই রাষ্ট্র কি দিয়েছে রাহেলাকে?
পাক বাহিনীর চোখে অপরাধ করেছে স্বামী। আর তার সাজা ভোগ করছেন রওশন আরা। স্বামী আইনুদ্দিন হাওলাদার মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা পারাপারের কাজ করতেন। পাক বাহিনীর কাছে সে খবর পৌঁছলে তারা চড়াও হয় রওশন আরার ওপর। তারা রওশন আরাকে কোলের সন্তানসহ ধরে নিয়ে যায়। তিন দিন আটকে ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করে। বাড়ি ফিরলে আশেপাশের কেউ কথা বলে না। শ্বশুর-শাশুড়ি, আত্মীয়স্বজন তাকে পরিবারে রাখতে রাজি নয়। স্বামী নির্বিকার। হাতে পায়ে ধরে আশ্রয় মিলে পরিবারে। এ যেন নিজগৃহে পরবাসী। অযত্ন আর অবহেলায় কোলের সন্তানটি রোগে ভুগে বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করে জীবন কাটাচ্ছেন রওশন আরা। বার্ধক্যের আঘাতে এখন তাও পারছেন না।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার আব্দুল্লাপুরের জোহরা বেগম। এক শীতের সকালে জোহরার জীবনে নেমে আসে কালো ছায়া। বাড়ির আঙিনায় আগুনে তাপ নিচ্ছিলেন দাদি আর নাতি। সেখানেই ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকসেনারা। নিয়ে যায় ক্যাম্পে। বর্ণনাতীত এক নির্যাতনের পর ফিরিয়ে দেয়। দেশ স্বাধীন হয়। চলে ভাঙাগড়ার খেলা। জোহরা পায় শুধু অপমান আর লাঞ্ছনা। বিয়ে নিয়ে পোহাতে হয় অসহনীয় যন্ত্রণা। তেতাল্লিশ বছর চলে যায় জোহরা জানেন না এই রাষ্ট্র তাকে কি বলে সম্মান দেবে?
একই রকমের বঞ্চনার শিকার ঝরনা রানী মণ্ডল, আসমা বেগম, হালিমা বেগম, সাজেদা বেগম, তীর্থবালা পাল, জামেলা বেওয়া, নূরজাহান বেগম, টেপরি রানীসহ আরও নাম না জানা অনেকেই। যারা ছড়িয়ে আছেন এই ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের লাল-সবুজের জমিনে। যারা জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ দিয়েও সামান্য সম্মানটুকু পেতে অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে তেতাল্লিশ বছর। কখনও কখনও মনে হয় বাংলাদেশে আজকের যে পরিস্থিতি তা কি অল্প সময়ের স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে। সাত কোটি মানুষ কি হঠাৎ করেই এই বিজয় অর্জন করেছে। হয়তো তা নয়। একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়েই আমাদের এই মহান স্বাধীনতা। কিন্তু এই অভূতপূর্ব এই অর্জনে আমাদের বীরকন্যাদের এতো দুঃখ ভোগ কেন? এত লাঞ্ছনা কেন? অর্থ-বিত্ত নয়। গাড়ি-বাড়ি বা ফ্ল্যাগ নয়। হাজার কোটি টাকা নয়। একজন মুক্তিযোদ্ধার সামান্য মর্যাদাটুকুও পেতে এত কার্পণ্য এই রাষ্ট্রের। এর চেয়ে দুঃখজনক অধ্যায় আর কি হতে পারে?
অনেক অপেক্ষা। এই মানুষগুলো লাঞ্ছনা নিয়েই কাটিয়ে দিয়েছে যুগের পর যুগ। অবশেষে সুখবর আসে আদালত থেকে। বীরাঙ্গনাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও প্রাপ্য সুবিধা দিতে রুল জারি করে হাইকোর্ট। সিরাজগঞ্জের সালেহা ইসহাক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী সংগঠন ও বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি এই লড়াইয়ে একের পর এক পদক্ষেপ নেয়। বিশেষত সিরাজগঞ্জের সালেহা ইসহাক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রীরা সত্যিকার অর্থেই একটি অনুকরণীয় কাজ করেছে। যা আমাদের ভবিষ্যতে প্রাক্তন যেকোন সংগঠনের জন্যই ভাল কাজের প্রেরণা যোগাবে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে বীরকন্যাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু কথা থাকে, এর একটি নীতিমালা রয়েছে। ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের জনপদে অসংখ্য নারী মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন যারা অল্পশিক্ষিত। ডিসি অফিসের বারান্দায় তারা ধরনা দেয়ার শক্তি ও সাহস ইতিমধ্যেই খুইয়েছেন। অনেকেরই বয়স হয়ে গেছে ষাটের কোঠায়। রাষ্ট্র নিজ তাগিদে এই বীরকন্যাদের খুঁজে বের করার মহতী উদ্যোগ নিলে হয়তো আরও একটি বড় কাজ হবে। কারণ ব্যক্তিগতভাবে এই কাজ কোন একক মানুষ বা সংগঠনের পক্ষে সফল করা খুবই কঠিন। শেষ করতে চাই বীরকন্যাদের গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে। অবনত মস্তকে এ কথাই বলতে চাই, এদেশের সবকিছুই হয়তো বদলে যাবে। দেশ একদিন উন্নতির শিখরে আরোহণ করবে। আমরা হয়তো তখন কেউই থাকবো না। কিন্তু ইতিহাসের সত্য প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বয়ে বেড়াবে। যারা নিজেদের সম্ভ্রম বিলিয়ে দিয়েছেন স্বাধীনতার জন্য, প্রত্যাশা রইলো- ইতিহাস তাদের প্রতি অবিচার করবে না।
এসনু বেগম। সিলেটের সীমান্ত এলাকা জকিগঞ্জের। একাত্তরে ১৩-১৪ বছরের কিশোরী। এখন আটান্নতে পা দিয়েছেন। পাকিস্তানি নরপিসাচদের লালসার শিকার হয়েছিলেন এদেশীয় দালালদের বেঈমানির জন্য। নতুন দেশ। চারদিকে আনন্দ। কিন্তু এসনু বেগম লুকালেন। নানা মানুষের নানা কথা। সামাজিকভাবে হেয় আর অপদস্ত হওয়াই যেন নিয়তি। দরিদ্র পরিবার। অনেকদিন পর্যন্ত বিয়েও দিতে পারেনি। কেউ এগিয়ে আসেনি এই মানুষটির জন্য। পরে এক বিপত্নীকের সঙ্গে সংসার। বিয়ের পনের বছরের মাথায় আশ্রয় বলতে স্বামীও মারা যান। নানা রোগ কুরে কুরে খাচ্ছে এসনু বেগমকে। এই তেতাল্লিশ বছরে কেউ তার খোঁজ নেয়নি। একবার কারা যেন এসে এসনু বেগমের নাম লিখে নিয়েছে। এইটুকুনই। বছরের পর বছর পেয়েছে শুধু গঞ্জনা।
লাইলি বেগম। মাগুরার মদনপুরের বাসিন্দা। রঙিন স্বপ্ন নিয়ে ঘর বেঁধেছিলেন। এক বুক আশা দিয়ে। যুদ্ধ শুরু হলে যোগ দেয় স্বপ্নের মানুষ। যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফেরে স্বামী মুক্তিযোদ্ধা মনোয়ার হোসেন। নয় মাসের যুদ্ধ চলাকালে লাইলি বেগমের স্বপ্ন কেড়ে নেয় পাক হানাদার বাহিনী। তার সকল স্বপ্নকে দুমড়ে মুচড়ে জীবনকে চির অন্ধকারে ঠেলে দেয়। যুদ্ধ শেষে নতুন জীবনের তাড়নার বদলে অসীম লাঞ্ছনা নিয়ে অপেক্ষায় থাকে। নতুন আশায় বুক বাঁধে লাইলি-মনোয়ার। স্বামী মনোয়ার কখনও রিকশা কখনও ভ্যান চালিয়ে যা আয় করতেন তাতেই সংসার চলতো। তার ওপর সমাজের নানা মানুষের কটূক্তি। স্বামী মনোয়ার-লাইলির এই আত্মত্যাগ নিয়ে গৌরব করলেও রাষ্ট্র তাদের পাশে দাঁড়ায়নি। দেয়নি সম্মান। দেশের জন্য এত বড় আত্মত্যাগ করে লাইলি খেয়েছে কচু ঘেচু; রোগে চিকিৎসা না পেয়ে কষ্ট ভোগে জীবন কাটাবার অধিকার।
লাইলির ক্ষেত্রে যা হয়েছিল সিরাজগঞ্জের রাহেলার তা হয়নি। জেলার বেলগাতি গ্রামে স্বামীর সামনেই নির্যাতনের শিকার হন রাহেলা। দেশমাতৃকার জন্য সম্ভ্রম হারানো এই মানুষটি প্রত্যাখ্যাত হন স্বামীর কাছ থেকেও। একদিকে সামাজিক লাঞ্ছনা আর অন্যদিকে তালাকনামা। দ্বিমুখী বিপর্যয়ে রাহেলা সমাজের নিচুতলার মানুষ হিসেবে বাঁচার অধিকারটুকুও হারাতে বসেন। স্বাধীনতার পাঁচ বছর পরে বিয়ে করে বাঁচার নতুন লড়াইয়ে নামলেও সে সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। অকালে দ্বিতীয় স্বামীকেও হারান। ছেলেপুলে নিয়ে চরম দরিদ্র অবস্থায় কাল কাটাতে হয়। সঙ্কট শেষ হয়নি রাহেলার। ২০১৩ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি শাহবাগের জাগরণ মঞ্চে নিজের দুঃসহ জীবনযন্ত্রণা তুলে ধরে শাস্তি দাবি করেন যুদ্ধাপরাধীদের। কিন্তু নিজের এলাকায় যারা স্বাধীনতার সুফল ভোগ করছেন- তারা সমাজের খারাপ মেয়ে বলে আখ্যায়িত করে সামাজিকভাবে তাকে একঘরে করে দেন। নিজের মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন যে পরিবারে সেখান থেকেও তাকে তালাকনামা নিয়ে ফিরতে হয়। মায়ের যন্ত্রণা বংশপরম্পরায় মেয়েকেও বইতে হচ্ছে। এ যেন ধারাবাহিক আত্মত্যাগ। কিন্তু এ ত্যাগের বিনিময়ে এই রাষ্ট্র কি দিয়েছে রাহেলাকে?
পাক বাহিনীর চোখে অপরাধ করেছে স্বামী। আর তার সাজা ভোগ করছেন রওশন আরা। স্বামী আইনুদ্দিন হাওলাদার মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা পারাপারের কাজ করতেন। পাক বাহিনীর কাছে সে খবর পৌঁছলে তারা চড়াও হয় রওশন আরার ওপর। তারা রওশন আরাকে কোলের সন্তানসহ ধরে নিয়ে যায়। তিন দিন আটকে ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করে। বাড়ি ফিরলে আশেপাশের কেউ কথা বলে না। শ্বশুর-শাশুড়ি, আত্মীয়স্বজন তাকে পরিবারে রাখতে রাজি নয়। স্বামী নির্বিকার। হাতে পায়ে ধরে আশ্রয় মিলে পরিবারে। এ যেন নিজগৃহে পরবাসী। অযত্ন আর অবহেলায় কোলের সন্তানটি রোগে ভুগে বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করে জীবন কাটাচ্ছেন রওশন আরা। বার্ধক্যের আঘাতে এখন তাও পারছেন না।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার আব্দুল্লাপুরের জোহরা বেগম। এক শীতের সকালে জোহরার জীবনে নেমে আসে কালো ছায়া। বাড়ির আঙিনায় আগুনে তাপ নিচ্ছিলেন দাদি আর নাতি। সেখানেই ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকসেনারা। নিয়ে যায় ক্যাম্পে। বর্ণনাতীত এক নির্যাতনের পর ফিরিয়ে দেয়। দেশ স্বাধীন হয়। চলে ভাঙাগড়ার খেলা। জোহরা পায় শুধু অপমান আর লাঞ্ছনা। বিয়ে নিয়ে পোহাতে হয় অসহনীয় যন্ত্রণা। তেতাল্লিশ বছর চলে যায় জোহরা জানেন না এই রাষ্ট্র তাকে কি বলে সম্মান দেবে?
একই রকমের বঞ্চনার শিকার ঝরনা রানী মণ্ডল, আসমা বেগম, হালিমা বেগম, সাজেদা বেগম, তীর্থবালা পাল, জামেলা বেওয়া, নূরজাহান বেগম, টেপরি রানীসহ আরও নাম না জানা অনেকেই। যারা ছড়িয়ে আছেন এই ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের লাল-সবুজের জমিনে। যারা জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ দিয়েও সামান্য সম্মানটুকু পেতে অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে তেতাল্লিশ বছর। কখনও কখনও মনে হয় বাংলাদেশে আজকের যে পরিস্থিতি তা কি অল্প সময়ের স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে। সাত কোটি মানুষ কি হঠাৎ করেই এই বিজয় অর্জন করেছে। হয়তো তা নয়। একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়েই আমাদের এই মহান স্বাধীনতা। কিন্তু এই অভূতপূর্ব এই অর্জনে আমাদের বীরকন্যাদের এতো দুঃখ ভোগ কেন? এত লাঞ্ছনা কেন? অর্থ-বিত্ত নয়। গাড়ি-বাড়ি বা ফ্ল্যাগ নয়। হাজার কোটি টাকা নয়। একজন মুক্তিযোদ্ধার সামান্য মর্যাদাটুকুও পেতে এত কার্পণ্য এই রাষ্ট্রের। এর চেয়ে দুঃখজনক অধ্যায় আর কি হতে পারে?
অনেক অপেক্ষা। এই মানুষগুলো লাঞ্ছনা নিয়েই কাটিয়ে দিয়েছে যুগের পর যুগ। অবশেষে সুখবর আসে আদালত থেকে। বীরাঙ্গনাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও প্রাপ্য সুবিধা দিতে রুল জারি করে হাইকোর্ট। সিরাজগঞ্জের সালেহা ইসহাক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী সংগঠন ও বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি এই লড়াইয়ে একের পর এক পদক্ষেপ নেয়। বিশেষত সিরাজগঞ্জের সালেহা ইসহাক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রীরা সত্যিকার অর্থেই একটি অনুকরণীয় কাজ করেছে। যা আমাদের ভবিষ্যতে প্রাক্তন যেকোন সংগঠনের জন্যই ভাল কাজের প্রেরণা যোগাবে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে বীরকন্যাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু কথা থাকে, এর একটি নীতিমালা রয়েছে। ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের জনপদে অসংখ্য নারী মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন যারা অল্পশিক্ষিত। ডিসি অফিসের বারান্দায় তারা ধরনা দেয়ার শক্তি ও সাহস ইতিমধ্যেই খুইয়েছেন। অনেকেরই বয়স হয়ে গেছে ষাটের কোঠায়। রাষ্ট্র নিজ তাগিদে এই বীরকন্যাদের খুঁজে বের করার মহতী উদ্যোগ নিলে হয়তো আরও একটি বড় কাজ হবে। কারণ ব্যক্তিগতভাবে এই কাজ কোন একক মানুষ বা সংগঠনের পক্ষে সফল করা খুবই কঠিন। শেষ করতে চাই বীরকন্যাদের গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে। অবনত মস্তকে এ কথাই বলতে চাই, এদেশের সবকিছুই হয়তো বদলে যাবে। দেশ একদিন উন্নতির শিখরে আরোহণ করবে। আমরা হয়তো তখন কেউই থাকবো না। কিন্তু ইতিহাসের সত্য প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বয়ে বেড়াবে। যারা নিজেদের সম্ভ্রম বিলিয়ে দিয়েছেন স্বাধীনতার জন্য, প্রত্যাশা রইলো- ইতিহাস তাদের প্রতি অবিচার করবে না।
No comments