রাজনীতিক অলি আহাদ by সাইফুদ্দিন আহমেদ মনি
গতকাল ২০ অক্টোবর ছিল বিশিষ্ট রাজনীতিক অলি আহাদের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। এ দেশে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে যে চারজন নেতা সোচ্চার হয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ইতিহাস সৃষ্টি করেন, অলি আহাদ তাদের অন্যতম। মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানের জন্য সরকার ২০০৪ সালে স্বাধীনতা পদক প্রদান করে। সামরিক-বেসামরিক স্বৈরাচার-দুঃশাসকের বিরুদ্ধে তার বজ্রকণ্ঠ সদা উচ্চকিত ছিল। সুবিধাবাদ ও আপসকামিতা তার চরিত্রকে স্পর্শ করতে পারেনি। দীর্ঘ দিন রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে থেকেও নীতিহীন ক্ষমতার রাজনীতি তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। দেশের স্বার্থকে উপেক্ষা করে অসৎ ও ক্ষমতালোভীদের সাথে আপস করেননি।
অলি আহাদের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৭৩ সালে ফরওয়ার্ড স্টুডেন্ট ব্লকের সক্রিয় কর্মী হিসেবে মিছিল শেষে বিজয় নগর বাংলা জাতীয় লীগ কার্যালয়ে। সে দিনই আমাকে বললেন, ‘ছাত্রদের প্রথম কাজ লেখাপড়া করা। লেখাপড়ার ফাঁকে ছাত্র রাজনীতি করতে চাইলে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে রাজনীতির বই, প্রতিদিনের একাধিক দৈনিক পত্রিকা মনোযোগের সাথে পড়তে হবে। লেখাপড়া বাদ দিয়ে ছাত্ররাজনীতির আমি ঘোর বিরোধী। দেশকে যদি ভালোবাস, তবে তোমাকে সময় বের করে কাজ করতে হবে। জ্ঞান আর ত্যাগ না থাকলে দেশকে কিছু দেয়া যায় না, সমাজও কিছু পায় না।’ ছাত্রজীবন শেষ করে এ নেতার মৃত্যুর দিন পর্যন্ত তার সাথে ছিলাম। পত্রিকার প্রয়োজনীয় অংশ মার্ক করে তা আমাদের পাঠাতেন। বিদেশী ম্যাগাজিন, বিশেষত টাইমস ও নিউজ উইক সাময়িকীর তিনি নিয়মিত পাঠক ছিলেন। পত্রিকা পড়ার পর আমরা তার সাথে বসতাম। রাজনীতির গতিবিধি, পত্রিকার খবরের পর্যালোচনা এবং দলীয় কর্মকাণ্ড ছিল আলোচ্যসূচি। রাজনীতির আলোচিত সব বই তার সংগ্রহে ছিল এবং উল্লেখযোগ্য বইগুলো নিয়ে পর্যালোচনা হতো। হরতালের দিন অলি আহাদ হেঁটে চলতেন, হরতাল শেষ হওয়ার এক মিনিট আগেও রিকশায় চড়তেন না। কোনো নেতা নিজেদের হরতালে যানবাহনে এলে ভর্ৎসনা করতেন। তার জীবন ছিল খুবই সাদামাটা। হরতালের দিন আমরা অফিসে একসাথে সাধারণ মানের খিচুড়ি এবং মাঝে মধ্যে লবণ দিয়ে শুধু আলু সিদ্ধ খেয়েছি অনেক দিন।
মেধাবী ছাত্র অলি আহাদ ১৯৪৪ সালে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৬ সালে আইএসসি পরীক্ষা দেয়া সম্ভব হয়নি। কারণ, তিনি তখন পাকিস্তান আন্দোলনে মুসলিম ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে ব্যস্ত ছিলেন। ১৯৪৭ সালে প্রথম বিভাগে আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিকম কাসে ভর্তি হন। আইএসসিতে ভালো রেজাল্ট করার জন্য তিনি হাজী মুহম্মদ মুহসীন ট্রাস্টের মাসিক ২০ টাকা হারে বৃত্তি লাভের জন্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনে প্রথম কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন তিনি। দফায় দফায় বিভিন্ন সরকারের আমলে তিনি প্রায় এক যুগ কারাবরণ করেছেন। আত্মগোপন করে থেকেছেন আরো কয়েক বছর। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল প্রর্যন্ত অলি আহাদ অন্যায়ের বিরুদ্ধে, জনতার অধিকার আদায়ের সংগ্রামে কারারুদ্ধ হন বারবার। এরশাদের আমলে ছয়বার গ্রেফতার হয়ে ৩৫৭ দিন জেলে ছিলেন। ১৯৪৮ সালে তাকে দুইবার আটক করা হয়। ’৪৯ সালের ২০ এপ্রিল আবার গ্রেফতার হন। ’৫০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি, ’৫২ সালের ৭ মার্চ, ’৬৯-এর ৩১ জানুয়ারি, ’৭৪-এর ৩০ জুন এবং তৎপরবর্তী প্রতিটি আমলেই কারাগারে আটক ছিলেন তিনি।
অলি আহাদের বই জাতীয় ‘রাজনীতি ৪৫ থেকে ৭৫’ আমাদের রাজনীতির ইতিহাসে এক নির্ভেজাল দলিল। তিনি ‘ইত্তেহাদ’ নামে সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন অনেক দিন।
অলি আহাদ ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক, ১৯৫০ সালের গণতান্ত্রিক যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক, ১৯৫৩ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রচার সম্পাদক, ১৯৫৫-৫৬ সালে সাংগঠনিক সম্পাদক। ১৯৫৭ সালের আওয়ামী লীগের কাগমারী সম্মেলনের প্রাক্কালে মওলানা ভাসানীর নির্দেশে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করায় অলি আহাদের সদস্য পদ স্থগিত করা হয়। এর প্রতিবাদে আটজন আইন পরিষদ সদস্য পদত্যাগ করেছিলেন। দল থেকে বেরিয়ে এলেন মওলানা ভাসানী। প্রতিষ্ঠিত হলো ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি। অলি আহাদ হলেন এ সংগঠনের যুগ্ম সম্পাদক। পরে অলি আহাদ জাতীয় লীগের ও বাংলা জাতীয় লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং শেষে ডেমোক্রেটিক লীগের সভাপতি ছিলেন। আপসহীন সংগ্রামী এই নেতা আমাদের রাজনীতির ইতিহাসে ধ্রুবতারা হয়ে জ্বলবেন চিরকাল।
লেখক : ডেমোক্রেটিক লীগের সাধারণ সম্পাদক
অলি আহাদের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৭৩ সালে ফরওয়ার্ড স্টুডেন্ট ব্লকের সক্রিয় কর্মী হিসেবে মিছিল শেষে বিজয় নগর বাংলা জাতীয় লীগ কার্যালয়ে। সে দিনই আমাকে বললেন, ‘ছাত্রদের প্রথম কাজ লেখাপড়া করা। লেখাপড়ার ফাঁকে ছাত্র রাজনীতি করতে চাইলে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে রাজনীতির বই, প্রতিদিনের একাধিক দৈনিক পত্রিকা মনোযোগের সাথে পড়তে হবে। লেখাপড়া বাদ দিয়ে ছাত্ররাজনীতির আমি ঘোর বিরোধী। দেশকে যদি ভালোবাস, তবে তোমাকে সময় বের করে কাজ করতে হবে। জ্ঞান আর ত্যাগ না থাকলে দেশকে কিছু দেয়া যায় না, সমাজও কিছু পায় না।’ ছাত্রজীবন শেষ করে এ নেতার মৃত্যুর দিন পর্যন্ত তার সাথে ছিলাম। পত্রিকার প্রয়োজনীয় অংশ মার্ক করে তা আমাদের পাঠাতেন। বিদেশী ম্যাগাজিন, বিশেষত টাইমস ও নিউজ উইক সাময়িকীর তিনি নিয়মিত পাঠক ছিলেন। পত্রিকা পড়ার পর আমরা তার সাথে বসতাম। রাজনীতির গতিবিধি, পত্রিকার খবরের পর্যালোচনা এবং দলীয় কর্মকাণ্ড ছিল আলোচ্যসূচি। রাজনীতির আলোচিত সব বই তার সংগ্রহে ছিল এবং উল্লেখযোগ্য বইগুলো নিয়ে পর্যালোচনা হতো। হরতালের দিন অলি আহাদ হেঁটে চলতেন, হরতাল শেষ হওয়ার এক মিনিট আগেও রিকশায় চড়তেন না। কোনো নেতা নিজেদের হরতালে যানবাহনে এলে ভর্ৎসনা করতেন। তার জীবন ছিল খুবই সাদামাটা। হরতালের দিন আমরা অফিসে একসাথে সাধারণ মানের খিচুড়ি এবং মাঝে মধ্যে লবণ দিয়ে শুধু আলু সিদ্ধ খেয়েছি অনেক দিন।
মেধাবী ছাত্র অলি আহাদ ১৯৪৪ সালে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৬ সালে আইএসসি পরীক্ষা দেয়া সম্ভব হয়নি। কারণ, তিনি তখন পাকিস্তান আন্দোলনে মুসলিম ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে ব্যস্ত ছিলেন। ১৯৪৭ সালে প্রথম বিভাগে আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিকম কাসে ভর্তি হন। আইএসসিতে ভালো রেজাল্ট করার জন্য তিনি হাজী মুহম্মদ মুহসীন ট্রাস্টের মাসিক ২০ টাকা হারে বৃত্তি লাভের জন্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনে প্রথম কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন তিনি। দফায় দফায় বিভিন্ন সরকারের আমলে তিনি প্রায় এক যুগ কারাবরণ করেছেন। আত্মগোপন করে থেকেছেন আরো কয়েক বছর। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল প্রর্যন্ত অলি আহাদ অন্যায়ের বিরুদ্ধে, জনতার অধিকার আদায়ের সংগ্রামে কারারুদ্ধ হন বারবার। এরশাদের আমলে ছয়বার গ্রেফতার হয়ে ৩৫৭ দিন জেলে ছিলেন। ১৯৪৮ সালে তাকে দুইবার আটক করা হয়। ’৪৯ সালের ২০ এপ্রিল আবার গ্রেফতার হন। ’৫০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি, ’৫২ সালের ৭ মার্চ, ’৬৯-এর ৩১ জানুয়ারি, ’৭৪-এর ৩০ জুন এবং তৎপরবর্তী প্রতিটি আমলেই কারাগারে আটক ছিলেন তিনি।
অলি আহাদের বই জাতীয় ‘রাজনীতি ৪৫ থেকে ৭৫’ আমাদের রাজনীতির ইতিহাসে এক নির্ভেজাল দলিল। তিনি ‘ইত্তেহাদ’ নামে সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন অনেক দিন।
অলি আহাদ ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক, ১৯৫০ সালের গণতান্ত্রিক যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক, ১৯৫৩ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রচার সম্পাদক, ১৯৫৫-৫৬ সালে সাংগঠনিক সম্পাদক। ১৯৫৭ সালের আওয়ামী লীগের কাগমারী সম্মেলনের প্রাক্কালে মওলানা ভাসানীর নির্দেশে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করায় অলি আহাদের সদস্য পদ স্থগিত করা হয়। এর প্রতিবাদে আটজন আইন পরিষদ সদস্য পদত্যাগ করেছিলেন। দল থেকে বেরিয়ে এলেন মওলানা ভাসানী। প্রতিষ্ঠিত হলো ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি। অলি আহাদ হলেন এ সংগঠনের যুগ্ম সম্পাদক। পরে অলি আহাদ জাতীয় লীগের ও বাংলা জাতীয় লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং শেষে ডেমোক্রেটিক লীগের সভাপতি ছিলেন। আপসহীন সংগ্রামী এই নেতা আমাদের রাজনীতির ইতিহাসে ধ্রুবতারা হয়ে জ্বলবেন চিরকাল।
লেখক : ডেমোক্রেটিক লীগের সাধারণ সম্পাদক
No comments