তালপট্টি হারাল, না জাতীয় নিরাপত্তা অরক্ষিত by প্রকৌশলী এস এম ফজলে আলী
ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা নিয়ে নেদারল্যান্ডসের স্থায়ী সালিসি আদালতের রায়ে বাংলাদেশ ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার সমুদ্রাঞ্চল পেয়েছে। তবে দক্ষিণ তালপট্টি থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হয়েছে। ভারতের সাথে বাংলাদেশের বিরোধপূর্ণ সমুদ্রাঞ্চল ছিল ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটার। মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তি হওয়ার পর এ রায়ের ফলে ৯ লাখ ২৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার আঞ্চলিক সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৮ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহিসোপানে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণীজ ও অপ্রাণীজ সম্পদের ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
স্থায়ী সালিসি আদালতের রায়ে বঙ্গোপসাগরের ওপর টানা রেখায় দক্ষিণ তালপট্টি ভারতের অংশে পড়েছে। আদালতের রায়ে বঙ্গোপসাগরের ৫০ বর্গকিলোমিটারের একটি ‘গ্রে জোন’ রয়েছে, যার মৎস্যসম্পদ ভারতের এবং সমুদ্র তলদেশের সম্পদ বাংলাদেশের অধিকারে থাকবে। এটা একটি ‘গোঁজামিলের রায়’ বলে প্রতীয়মান হয়। কারণ ওই এলাকায় তলদেশে তেমন খনিজসম্পদ নেই। আর ওপরে তো মাছ সারা বছরই থাকবে। সে মাছ ধরা নিয়ে বাংলাদেশের সাথে যেকোনো সময় বিরোধের সৃষ্টি হতে পারে। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ নেই। এই রায়ের মাধ্যমে ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক আদালতে দায়ের করা, ভারত ও মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমাসংক্রান্ত বাংলাদেশের মামলার নিষ্পত্তি হলো।
এ রায় ঠেকানোর জন্য ভারত বহু চেষ্টা-তদবির করেছে; কিন্তু এ নিয়ে আর বেশি আগায়নি, যেহেতু তারা দক্ষিণ তালপট্টি পেয়ে গেছে। এটা ভারতের বড় অর্জন। ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে তালপট্টি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। ভারত এখানে তার নৌবাহিনী মোতায়েন করে পুরো বঙ্গোপসাগরে আধিপত্য খাটাবে। এই অঞ্চল চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের শ্যেন দৃষ্টিতে আছে। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে ভারতের যে নৌবহর আছে, দক্ষিণ তালপট্টির সাথে এর সংযোগ করে ভারত এ অঞ্চলে এর আধিপত্য মজবুত করতে পারবে।
অপর দিকে বাংলাদেশের উপকূল ভাগ অরক্ষিত হয়ে যাবে। ভারতের নৌবহর বা যুদ্ধযানের ওপর বাংলাদেশের নজরদারির সুযোগ থাকবে না। অধিকন্তু চীন, ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বঙ্গোপসাগরে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার যে লড়াই শুরু হবে, তখন বাংলাদেশের নিরাপত্তা অবশ্যই বিঘ্নিত হবে।
ভারতীয় উপমহাদেশ বিভাগের সময় স্যার র্যাডকিফ হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মধ্যবর্তী যে সীমারেখা টেনে ছিলেন, তা বঙ্গোপসাগরে প্রলম্বিত করার পর তালপট্টি হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মধ্যস্রোতের পুব পাশে ছিল, অর্থাৎ এটি বাংলাদেশের অংশেই ছিল। ইদানীং আকাশ থেকে ল্যান্ডস্যাটের যে চিত্রের কথা বলা হয়, তা সঠিক বলে বিবেচনায় আনা যায় না। বলা হচ্ছে, দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপটির কোনো অস্তিত্ব নেই। যদি তাই হয়, তাহলে আশির দশকে ভারত তার সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সে দ্বীপটি দখল করেছিল কিভাবে? ভারতের চৌকি তো সেখানে এখনো আছে বলে জানা যায়।
২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবর হেগের আদালতের বিচারকেরা সরেজমিন বাংলাদেশ ও ভারতের দাবি অনুযায়ী বেইজ পয়েন্ট দেখে গেছেন। সমুদ্রসীমা নির্ধারণে আদালত ভারতের সমদূরত্ব ও বাংলাদেশের সমতা পদ্ধতি বিবেচনায় নিয়ে রায় দিয়েছেন। বাংলাদেশ ১৮০ ডিগ্রিতে বঙ্গোপসাগরে সমুদ্র সীমারেখা টানার দাবি করেছিল। ভারতের দাবি ছিল ১৬২ ডিগ্রিতে। আদালত ১৭৭ দশমিক ৫ ডিগ্রিতে সমুদ্র সীমারেখা টেনেছেন।
বাংলাদেশের সাথে সমুদ্রসীমার রায় আটকাতে ভারত সব ধরনের চেষ্টা করেছে। সর্বশেষ, নেদারল্যান্ডসে অবস্থিত স্থায়ী সালিসি আদালতের (পিসিএ) ব্যয়ের অর্থ পরিশোধে গড়িমসি করে তারা রায় প্রকাশ ২০ দিন ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। এর আগে বাংলাদেশের অনুরোধ সত্ত্বেও দেশটি পিসিএ’র বদলে জার্মানির হামবুর্গে অবস্থিত সমুদ্র আইনবিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে (ইটলস) মামলা স্থানান্তর করতে রাজি হয়নি। পিসিএ’র বিচারক নিয়োগেও ভারত যতটা সম্ভব বিলম্ব করার চেষ্টা চালায়।
হেগে অবস্থিত পিসিএতে বাংলাদেশ ও ভারত গত বছর ৯ থেকে ১৮ ডিসেম্বর সমুদ্রসীমা নির্ধারণে যার যার অবস্থানের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেছিল। শুনানি শেষে আদালতের পক্ষ থেকে বলা হয়, কার্যবিধির ১৫ ধারা অনুযায়ী ছয় মাস পর সমুদ্রসীমা নির্ধারণের রায় দেয়া হবে। সে হিসেবে ১৮ জুনের মধ্যে এ রায় হওয়ার কথা; কিন্তু ভারত পিসিএতে বিচারপ্রক্রিয়া চালাতে তার অংশের অর্থ পরিশোধ না করায় রায় দিতে বিলম্ব হয়। পিসিএতে বিচারক নিয়োগসহ বিচারকার্যের আনুষঙ্গিক খরচ বিবদমান পক্ষগুলোকে সমান ভাগে দিতে হয়; কিন্তু আর্থিক সক্ষমতাসহ সমুদ্রসীমার কারিগরি তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ এবং সমুদ্র আইনসংক্রান্ত বিশেষজ্ঞের ক্ষেত্রের বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে থাকার কারণে ভারত পিসিএতে দ্বিপক্ষীয় সালিসির মাধ্যমে বিষয়টির নিষ্পত্তি চেয়েছে। ভারত এর আগে বেশ কিছু দেশের সাথে তার সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করেছে। তাই এ ক্ষেত্রে ভারতীয়দের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল।
বঙ্গোসাগরে ভারত ও মিয়ানমারের পাল্টাপাল্টি দাবির মুখে সমুদ্রে বাংলাদেশের জন্য প্রায় কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের ২৮টি ব্লকের মধ্যে ১০টিতে ভারত ও ১৭টিতে মিয়ানমার আপত্তি দিয়ে রেখেছিল। তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য ২০০৮ সালে তিনটি ব্লক (৫, ১০ ও ১১) বাংলাদেশ বিদেশী কোম্পানির কাছে দেয়ার উদ্যোগ নিলেও এই প্রতিবেশীদের কাছ থেকে আপত্তি আসে। বাংলাদেশ এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারত ও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আরবিট্রেশনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তির পর ১৭টি ব্লকের মধ্যে ১২টি পুনর্গঠন করতে হয়েছে বাংলাদেশের। আর ভারতের সাথে সমুদ্রসীমার নিষ্পত্তির পর পাঁচটি ব্লক পুনর্গঠন করতে হবে। এগুলো হলো ৫, ৯, ১৪, ১৯ ও ২৪। এই ব্লকগুলো পুনর্গঠন করে শিগগিরই বাংলাদেশ তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের উদ্যোগ নিচ্ছে। এর আগে বঙ্গোপসাগরের অধিকার নিয়ে আমাদের প্রতিবেশী দেশের বিরোধ থাকায় কোনো আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি বাংলাদেশের আহ্বানে সাড়া দেয়নি। সমুদ্রসীমার নিষ্পত্তি হওয়ায় এখন তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী কোম্পানিগুলো আগ্রহ দেখাচ্ছে। বর্তমানে উৎপাদন বণ্টন চুক্তির আওতায় (PSC) কনকো ফিলিপস ১০ ও ১১ নম্বর ব্লকে অনুসন্ধান চালাচ্ছে। মার্কিন কোম্পানিটির সিসমিক সার্ভে অনুযায়ী ব্লক দুটোতে পাঁচ থেকে সাত টিসিএফ (ট্রিলিয়ন ঘনফুট) গ্যাসের মজুদ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। অবশ্য সমুদ্রে বাংলাদেশের একমাত্র গ্যাসক্ষেত্র সাংগু দুই বছর আগেই পরিত্যক্ত হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে গ্যাস ঘাটতির পরিমাণ দৈনিক ৬০ কোটি ঘনফুট, যা মোট চাহিদার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। ১৯৯৮ সালে হবিগঞ্জে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের পর এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো সাফল্য পায়নি। গ্যাসের অভাবে বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দিকে ঝুঁকছে আর অন্তর্বর্তী চাহিদা মেটানোর জন্য সরকার অত্যন্ত ব্যয়বহুল তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে যাচ্ছে। এর ফলে গ্রাহকপর্যায়ে বিদ্যুতের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।
২০০৮ ও ২০১০ সালের পর ব্লক পুনর্গঠন শেষে বাংলাদেশ আগামী বছর বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য তৃতীয় দফা আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানে যাবে বলে জানা গেছে। দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমানা ঠিক হওয়ায় বাংলাদেশ নিজ এলাকায় তেল-গ্যাসের অনুসন্ধান চালাতে পারবে ঠিকই; কিন্তু আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতি ও ভৌগোলিক অবস্থানের দরুন বঙ্গোপসাগর অস্থিতিশীল হতে পারে। সে ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের নীতি হতে হবে ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়।’
লেখক : পরিবেশবিদ
স্থায়ী সালিসি আদালতের রায়ে বঙ্গোপসাগরের ওপর টানা রেখায় দক্ষিণ তালপট্টি ভারতের অংশে পড়েছে। আদালতের রায়ে বঙ্গোপসাগরের ৫০ বর্গকিলোমিটারের একটি ‘গ্রে জোন’ রয়েছে, যার মৎস্যসম্পদ ভারতের এবং সমুদ্র তলদেশের সম্পদ বাংলাদেশের অধিকারে থাকবে। এটা একটি ‘গোঁজামিলের রায়’ বলে প্রতীয়মান হয়। কারণ ওই এলাকায় তলদেশে তেমন খনিজসম্পদ নেই। আর ওপরে তো মাছ সারা বছরই থাকবে। সে মাছ ধরা নিয়ে বাংলাদেশের সাথে যেকোনো সময় বিরোধের সৃষ্টি হতে পারে। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ নেই। এই রায়ের মাধ্যমে ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক আদালতে দায়ের করা, ভারত ও মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমাসংক্রান্ত বাংলাদেশের মামলার নিষ্পত্তি হলো।
এ রায় ঠেকানোর জন্য ভারত বহু চেষ্টা-তদবির করেছে; কিন্তু এ নিয়ে আর বেশি আগায়নি, যেহেতু তারা দক্ষিণ তালপট্টি পেয়ে গেছে। এটা ভারতের বড় অর্জন। ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে তালপট্টি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। ভারত এখানে তার নৌবাহিনী মোতায়েন করে পুরো বঙ্গোপসাগরে আধিপত্য খাটাবে। এই অঞ্চল চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের শ্যেন দৃষ্টিতে আছে। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে ভারতের যে নৌবহর আছে, দক্ষিণ তালপট্টির সাথে এর সংযোগ করে ভারত এ অঞ্চলে এর আধিপত্য মজবুত করতে পারবে।
অপর দিকে বাংলাদেশের উপকূল ভাগ অরক্ষিত হয়ে যাবে। ভারতের নৌবহর বা যুদ্ধযানের ওপর বাংলাদেশের নজরদারির সুযোগ থাকবে না। অধিকন্তু চীন, ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বঙ্গোপসাগরে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার যে লড়াই শুরু হবে, তখন বাংলাদেশের নিরাপত্তা অবশ্যই বিঘ্নিত হবে।
ভারতীয় উপমহাদেশ বিভাগের সময় স্যার র্যাডকিফ হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মধ্যবর্তী যে সীমারেখা টেনে ছিলেন, তা বঙ্গোপসাগরে প্রলম্বিত করার পর তালপট্টি হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মধ্যস্রোতের পুব পাশে ছিল, অর্থাৎ এটি বাংলাদেশের অংশেই ছিল। ইদানীং আকাশ থেকে ল্যান্ডস্যাটের যে চিত্রের কথা বলা হয়, তা সঠিক বলে বিবেচনায় আনা যায় না। বলা হচ্ছে, দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপটির কোনো অস্তিত্ব নেই। যদি তাই হয়, তাহলে আশির দশকে ভারত তার সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সে দ্বীপটি দখল করেছিল কিভাবে? ভারতের চৌকি তো সেখানে এখনো আছে বলে জানা যায়।
২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবর হেগের আদালতের বিচারকেরা সরেজমিন বাংলাদেশ ও ভারতের দাবি অনুযায়ী বেইজ পয়েন্ট দেখে গেছেন। সমুদ্রসীমা নির্ধারণে আদালত ভারতের সমদূরত্ব ও বাংলাদেশের সমতা পদ্ধতি বিবেচনায় নিয়ে রায় দিয়েছেন। বাংলাদেশ ১৮০ ডিগ্রিতে বঙ্গোপসাগরে সমুদ্র সীমারেখা টানার দাবি করেছিল। ভারতের দাবি ছিল ১৬২ ডিগ্রিতে। আদালত ১৭৭ দশমিক ৫ ডিগ্রিতে সমুদ্র সীমারেখা টেনেছেন।
বাংলাদেশের সাথে সমুদ্রসীমার রায় আটকাতে ভারত সব ধরনের চেষ্টা করেছে। সর্বশেষ, নেদারল্যান্ডসে অবস্থিত স্থায়ী সালিসি আদালতের (পিসিএ) ব্যয়ের অর্থ পরিশোধে গড়িমসি করে তারা রায় প্রকাশ ২০ দিন ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। এর আগে বাংলাদেশের অনুরোধ সত্ত্বেও দেশটি পিসিএ’র বদলে জার্মানির হামবুর্গে অবস্থিত সমুদ্র আইনবিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে (ইটলস) মামলা স্থানান্তর করতে রাজি হয়নি। পিসিএ’র বিচারক নিয়োগেও ভারত যতটা সম্ভব বিলম্ব করার চেষ্টা চালায়।
হেগে অবস্থিত পিসিএতে বাংলাদেশ ও ভারত গত বছর ৯ থেকে ১৮ ডিসেম্বর সমুদ্রসীমা নির্ধারণে যার যার অবস্থানের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেছিল। শুনানি শেষে আদালতের পক্ষ থেকে বলা হয়, কার্যবিধির ১৫ ধারা অনুযায়ী ছয় মাস পর সমুদ্রসীমা নির্ধারণের রায় দেয়া হবে। সে হিসেবে ১৮ জুনের মধ্যে এ রায় হওয়ার কথা; কিন্তু ভারত পিসিএতে বিচারপ্রক্রিয়া চালাতে তার অংশের অর্থ পরিশোধ না করায় রায় দিতে বিলম্ব হয়। পিসিএতে বিচারক নিয়োগসহ বিচারকার্যের আনুষঙ্গিক খরচ বিবদমান পক্ষগুলোকে সমান ভাগে দিতে হয়; কিন্তু আর্থিক সক্ষমতাসহ সমুদ্রসীমার কারিগরি তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ এবং সমুদ্র আইনসংক্রান্ত বিশেষজ্ঞের ক্ষেত্রের বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে থাকার কারণে ভারত পিসিএতে দ্বিপক্ষীয় সালিসির মাধ্যমে বিষয়টির নিষ্পত্তি চেয়েছে। ভারত এর আগে বেশ কিছু দেশের সাথে তার সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করেছে। তাই এ ক্ষেত্রে ভারতীয়দের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল।
বঙ্গোসাগরে ভারত ও মিয়ানমারের পাল্টাপাল্টি দাবির মুখে সমুদ্রে বাংলাদেশের জন্য প্রায় কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের ২৮টি ব্লকের মধ্যে ১০টিতে ভারত ও ১৭টিতে মিয়ানমার আপত্তি দিয়ে রেখেছিল। তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য ২০০৮ সালে তিনটি ব্লক (৫, ১০ ও ১১) বাংলাদেশ বিদেশী কোম্পানির কাছে দেয়ার উদ্যোগ নিলেও এই প্রতিবেশীদের কাছ থেকে আপত্তি আসে। বাংলাদেশ এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারত ও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আরবিট্রেশনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তির পর ১৭টি ব্লকের মধ্যে ১২টি পুনর্গঠন করতে হয়েছে বাংলাদেশের। আর ভারতের সাথে সমুদ্রসীমার নিষ্পত্তির পর পাঁচটি ব্লক পুনর্গঠন করতে হবে। এগুলো হলো ৫, ৯, ১৪, ১৯ ও ২৪। এই ব্লকগুলো পুনর্গঠন করে শিগগিরই বাংলাদেশ তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের উদ্যোগ নিচ্ছে। এর আগে বঙ্গোপসাগরের অধিকার নিয়ে আমাদের প্রতিবেশী দেশের বিরোধ থাকায় কোনো আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি বাংলাদেশের আহ্বানে সাড়া দেয়নি। সমুদ্রসীমার নিষ্পত্তি হওয়ায় এখন তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী কোম্পানিগুলো আগ্রহ দেখাচ্ছে। বর্তমানে উৎপাদন বণ্টন চুক্তির আওতায় (PSC) কনকো ফিলিপস ১০ ও ১১ নম্বর ব্লকে অনুসন্ধান চালাচ্ছে। মার্কিন কোম্পানিটির সিসমিক সার্ভে অনুযায়ী ব্লক দুটোতে পাঁচ থেকে সাত টিসিএফ (ট্রিলিয়ন ঘনফুট) গ্যাসের মজুদ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। অবশ্য সমুদ্রে বাংলাদেশের একমাত্র গ্যাসক্ষেত্র সাংগু দুই বছর আগেই পরিত্যক্ত হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে গ্যাস ঘাটতির পরিমাণ দৈনিক ৬০ কোটি ঘনফুট, যা মোট চাহিদার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। ১৯৯৮ সালে হবিগঞ্জে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের পর এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো সাফল্য পায়নি। গ্যাসের অভাবে বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দিকে ঝুঁকছে আর অন্তর্বর্তী চাহিদা মেটানোর জন্য সরকার অত্যন্ত ব্যয়বহুল তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে যাচ্ছে। এর ফলে গ্রাহকপর্যায়ে বিদ্যুতের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।
২০০৮ ও ২০১০ সালের পর ব্লক পুনর্গঠন শেষে বাংলাদেশ আগামী বছর বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য তৃতীয় দফা আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানে যাবে বলে জানা গেছে। দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমানা ঠিক হওয়ায় বাংলাদেশ নিজ এলাকায় তেল-গ্যাসের অনুসন্ধান চালাতে পারবে ঠিকই; কিন্তু আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতি ও ভৌগোলিক অবস্থানের দরুন বঙ্গোপসাগর অস্থিতিশীল হতে পারে। সে ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের নীতি হতে হবে ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়।’
লেখক : পরিবেশবিদ
No comments