চমেক মর্গ যেন দালালের স্বর্গরাজ্য লাশ নিয়ে চলে অমানবিক বাণিজ্য- টাকা দিলে পাল্টে যায় পোস্টমর্টেম রিপোর্টও! by রতন বড়ুয়া
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) মর্গ যেন দালালের স্বর্গরাজ্য। লাশ ও লাশের পোস্টমর্টেম (সুরতহাল) রিপোর্ট নিয়ে এখানে বাণিজ্যের শেষ নেই। ভুক্তভোগী ও সংশ্লিষ্টদের মতে এ অমানবিক বাণিজ্যের সাথে জড়িত রয়েছে দালালসহ এক শ্রেণির চিকিৎসক-কর্মচারী ও পুলিশের একটি চক্র। একে-অপরের যোগসাজসে দিনের পর দিন নির্বিঘ্নে এ বাণিজ্য চালিয়ে আসছে চক্রটি। পুলিশের পাশাপাশি দালাল চক্রের এ বাণিজ্যের বিষয়টি স্বীকার করেছে চমেক কর্তৃপক্ষও।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, হাসপাতালের লাশ ঘরে কোন লাশ আসার পর ওয়ার্ড মাস্টারের একটি চিঠি নিকটবর্তী থানার (পাঁচলাইশ) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয়। পরে থানার একজন দারোগা ও একজন কনস্টেবল গিয়ে চালান ফরমের মাধ্যমে সিসি সংযুক্তপূর্বক লাশটি মর্গে প্রেরণ করা হয়।
ভুক্তভোগী ও সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, এ প্রক্রিয়ায় পুলিশের কাছ থেকে লাশ চালান ফরম নিয়ে লাশের অভিভাবকদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হয়ে থাকে। টাকা না দিলে লাশও নড়ে না। বহিরাগত দালালরা এ টাকা নিলেও এর সাথে পুলিশও যে জড়িত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্যদিকে মর্গে আনা লাশ নিয়ে শুরু হয় রমরমা বাণিজ্য। পোস্টমর্টেমের পর লাশ হস্তান্তর, পোস্টমর্টেম ছাড়াই লাশ ফিরিয়ে দেয়া এবং পোস্টমর্টেম রিপোর্ট নিজেদের পক্ষে আনা বা রিপোর্ট পাল্টে দেয়ার প্রলোভন দেয়া হয় লাশের পরিবারের সদস্যদের কাছে। আর এ কাজে নেয়া হয় তিন থেকে দশ হাজার টাকা পর্যন্ত। আবার যার কাছ থেকে যা নেয়া যায়, চালু রয়েছে এ প্রক্রিয়াও। বিশেষ করে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট নিয়ে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে টাকার অংকটা একটু মোটা হয়। কারণ এক্ষেত্রে টাকার অংকটি বেশ কয়েকভাগে ভাগ হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
অন্যদিকে লাশ নিয়ে এ অমানবিক বাণিজ্যের কারণে হয়রানির সম্মুখীন হন লাশের পরিবারের সদস্যরা। কারণ সব কিছু নিয়ম মাফিক হলেও এসব দালালের হাতে টাকা না দিলে লাশও মেলে না। নড়ে না লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সও।
চমেক হাসপাতালের প্রাক্তন ওয়ার্ড সর্দার আবু তাহের বলেন, দালালদের ইশারা ছাড়া মর্গ থেকে কেউ কোন লাশবাহী গাড়ি নিতে পারে না। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত লাশ নিতে তিন থেকে ৫ হাজার টাকা দাবি করা হয়ে থাকে। দালালদের এ টাকা না দিলে লাশ পাওয়া যায় না। অথচ এরা হাসপাতালের কর্মচারী না। হাসপাতালের সাথে এদের কোন সম্পৃক্ততা নেই।
গত ২৩ জুলাই ফটিকছড়ি এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত সাইফুদ্দিনের পরিবারের এক সদস্য বলেন, লাশ নিতে গেলে দালালরা তিন হাজার টাকা দাবি করে। টাকা দিয়েই শেষ পর্যন্ত লাশ নিতে হয়েছে। এদিকে ১৮ জুন নিহত আবদুস সবুরের লাশ নিয়েও একই ঘটনা ঘটে বলে জানা যায়। প্রাক্তন ওয়ার্ড সর্দার আবু তাহেরের অভিযোগ, সাগর নামের একজনসহ বেশ কয়েক জন বহিরাগত এ ধরনের কাজে জড়িত। কারখানা, শিপব্রেকিং, নির্মাণ শ্রমিকরা দুর্ঘটনায় মৃত্যুর শিকার হলে তাদের ব্যবসা জমে উঠে। এই দালাল চক্রে বহিরাগতদের পাশাপাশি অ্যাম্বুলেন্স চালক-সহকারী এবং মর্গে দায়িত্বরত এক শ্রেণির চিকিৎসক-পুলিশ ও কর্মচারীরা জড়িত বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। হাসপাতালে কর্মরত একাধিক কর্মচারীও একই অভিযোগ করেছেন।
এদিকে এ ধরনের বিভিন্ন অভিযোগে নাসির খান সাগর (৩২) নামে এক দালালকে গতকাল গ্রেফতার করেছে পাঁচলাইশ থানা পুলিশ। তার বিরুদ্ধে ৩৮৫/৫০৬ ধারায় একটি মামলা দায়েরের (মামলা নং-১৯) পাশাপাশি তাকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পাঁচলাইশ থানার পুলিশ পরিদর্শক মো. গিয়াস উদ্দিন চমেক মর্গে দালালদের দৌরাত্ম্যের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, লাশ নিয়ে বিভিন্নভাবে লাশের পরিবারের কাছে টাকা দাবির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এর প্রেক্ষিতে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মর্গে লাশ নিয়ে এ ধরনের বিভিন্ন চাঁদাবাজির ঘটনা হরদম ঘটছে বলেও স্বীকার করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, বিগত তিন/চার বছর ধরে মর্গে এ ধরনের কাজ চালিয়ে আসছেন সাগর। পাশাপাশি তিনি পাঁচলাইশ থানায় সুইপারের কাজও করতেন। তবে দুই বছর আগে থানায় তার স্থলে অন্য আরেকজনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ফলে গত দুই বছর ধরে সাগর শুধু এ কাজেই যুক্ত। কিন্তু চমেক ও হাসপাতালের সাথে কোন সম্পৃক্ততা নেই সাগরের। সাগরের মতো আরো বেশ কয়েকজন বহিরাগত এ কাজে যুক্ত রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খোন্দকার শহিদুল গণির সাথে যোগাযোগ করা হলে আজাদীকে তিনি বলেন, ‘মর্গটি হাসপাতালের নয়, কলেজের অধীন। হাসপাতালের লাশ ঘর থেকে মর্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের (হাসপাতালের) মাত্র দুজন কর্মচারী কাজ করে। এদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ পাওয়া গেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে লাশ ঘর থেকে লাশের দায়িত্ব পুলিশকে বুঝিয়ে দেয়া হয় বলেও জানান তিনি।
যোগাযোগ করা হলে দালালের উৎপাতের বিষয়টি স্বীকার করেন চমেক অধ্যক্ষ ডা. সেলিম মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর। তিনি বলেন, এই দালালদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে আমরা প্রশাসনকে অনুরোধ জানিয়েছি। তবে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট নিয়ে বাণিজ্যের বিষয়টি সঠিক নয় বলে দাবি করেন চমেক অধ্যক্ষ। কয়েক সদস্য বিশিষ্ট একটি বোর্ডের মাধ্যমে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট চূড়ান্ত করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, রিপোর্ট নিয়ে সন্দেহ থাকলে যে কেউ আদালতে আবেদন করতে পারেন। এর প্রেক্ষিতে আদালত পুনরায় রিপোর্ট প্রদানে আদেশ দিতে পারেন।
No comments