শতবর্ষের জয়নুল by শুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়
বাংলাদেশের
শিল্পজগতের দুয়ার খুলতেই জ্বলজ্বল করে ওঠে যার নাম, তিনি জয়নুল আবেদীন।
তিনিই আমাদের চিত্রকলা ও লোকশিল্পের বর্ণাঢ্য ইতিহাসের রূপকার। আমাদের
শিল্পাচার্য। গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর দিনটি ছিল তাঁর শততম জন্মদিন।
শিল্পাচার্যের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে সারাদেশেই নানা রকম আয়োজন চলছে। তার
মধ্যে সম্প্রতি শিল্পাচার্যের জন্মশতবর্ষ উদযাপনে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের
বছরব্যাপী অনুষ্ঠানের শুরু হলো। এর অংশ হিসেবে গত শনিবার ধানমণ্ডির বেঙ্গল
গ্যালারিতে জয়নুল আবেদিন ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের আঁকা ছবি নিয়ে
'শিল্পাচার্যের প্রসারিত শিল্পাঙ্গন' শিরোনামে পক্ষকালব্যাপী শুরু হয়েছে
বিশেষ চিত্রকলা প্রদর্শনী।
জয়নুল আবেদিনের বিখ্যাত কিছু চিত্রকর্মের সঙ্গে গ্যালারিতে স্থান পেয়েছে শফিকুল আমিন, জুনাবুল ইসলাম, আবদুুর রাজ্জাক, নজরুল ইসলাম, মিজানুর রহিম, ময়নুল আবেদীন, সামিনা নাফিস, মোহাম্মদ আফজালুর রহিম, আরিফ আহমেদ তনু, মাসুদ মিজান এবং মানিজে আবেদিনের কাজ। তারা সবাই কোনো না কোনোভাবে জয়নুল আবেদিনের আত্মীয়। শিল্পাচার্যের সঙ্গে পারিবারিকভাবে সম্পর্কিত দেশের এই শিল্পীদের কাজ তাঁর কাজের সঙ্গে এক গ্যালারিতে উপস্থাপনের এ আয়োজন যেন এই মহান শিল্পীর পারিবারিক শিল্প-চেতনাকে উন্মোচিত করেছে। বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পকলা আন্দোলনের পথিকৃৎ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। শিল্পকলায় অবদানের জন্য তাঁর জীবদ্দশায় তিনি পেয়েছেন 'শিল্পাচার্য' খেতাব। মাত্র ১৬ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে তিনি বন্ধুদের সঙ্গে কলকাতায় গিয়েছিলেন শুধু কলকাতা গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস দেখার জন্য। এ আর্ট স্কুল দেখে আসার পর সাধারণ পড়াশোনায় জয়নুল আবেদিনের মন বসছিল না। তাই ১৯৩৩ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষার আগেই স্কুলের পড়ালেখা বাদ দিয়ে কলকাতায় চলে যান এবং মায়ের অনুপ্রেরণায় তিনি গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসে ভর্তি হন। জয়নুল আবেদিনের আগ্রহ দেখে তাঁর মা নিজের গলার হার বিক্রি করে ছেলেকে আর্ট স্কুলে ভর্তি করান। পরে ছেলে জয়নুল আবেদিন মায়ের সেই ভালোবাসার ঋণ শোধ করেছেন দেশের স্বনামধন্য শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে।
জয়নুল আবেদিন ছিলেন এদেশের চিত্রশিল্প আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি শুধু দুর্ভিক্ষের ছবি নয়, গ্রামবাংলার প্রাকৃতিক দৃশ্য, মা-মাটি এবং মানুষের জীবনের নানান বাস্তবতা তুলে ধরেছেন তাঁর ছবির মাধ্যমে। তাঁর আঁকা জলচিত্রগুলোও পেয়েছে এক অসাধারণ ভিন্নমাত্রা। তাঁর প্রচেষ্টায়ই বাংলাদেশে শিল্প আন্দোলনের জয়যাত্রা শুরু।
'৪৭-এ উপমহাদেশে দুটো স্বাধীন রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম হলে তিনি পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকায় চলে আসেন। কলকাতা আর্ট স্কুলে তাঁর চাকরিটি ছেড়ে ঢাকার আরমানিটোলায় একটি স্কুলে আর্ট শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। তাঁর শিল্পী খ্যাতি, অসাধারণ সাংগঠনিক মেধা; তৎকালীন শিল্পী, সহকর্মী ও বন্ধুদের সহযোগিতা এবং শিল্পাগ্রহী কিছু বাঙালি সরকারি কর্মকর্তার সহযোগিতা_ সব মিলিয়ে তিনি ১৯৪৮ সালে এদেশের প্রথম আর্ট স্কুল 'গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস' প্রতিষ্ঠা করেন। ৮ বছরের মাথায় মাত্র দুই কক্ষের সেই প্রতিষ্ঠানটিকে ১৯৫৬ সালে তিনি একটি আধুনিক শিল্পকলা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করেন। পরে এটি পূর্ব পাকিস্তান 'চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ 'চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়'-এ রূপান্তরিত হয়। তারপর মহাবিদ্যালয়টি সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হস্তান্তরিত হয় এবং বর্তমানে এটি 'চারুকলা অনুষদ' নামে পরিচিতি লাভ করে।
তাঁর আঁকা দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা পৃথিবীবিখ্যাত চিত্রকর্মের সিরিজ। সেই দুর্ভিক্ষ বা মন্ব্বন্তর ঘটেছিল ১৯৪৩ সালে অবিভক্ত বাংলায়। বর্তমান বাংলাদেশ ও ভারতের বেঙ্গল প্রদেশে যা 'তেতালি্লশের মন্বন্তর' নামেও পরিচিত। শিল্পাচার্যের দুর্ভিক্ষ সিরিজের সেই কালজয়ী চিত্রকর্ম বেঙ্গল গ্যালারির আয়োজনে স্থান পেয়েছে, যা দর্শকদের জয়নুল আবেদিনের অসামান্য শিল্প-সাধনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় আরেকবার।
সেই তেতালি্লশের মন্বন্তর সম্পর্কে জয়নুল আবেদিন একবার বলেছিলেন, '১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ ছিলো মনুষ্যসৃষ্ট। একটি পরাধীন দেশে একটি বিদেশি শক্তির চক্রান্ত। তার একটা স্বতন্ত্র আবেদন ছিলো; তাই অন্তর থেকে ছবি আঁকার দুর্বার প্রেরণা ছিলো। সত্তরের ঘূর্ণিঝড় ও ধ্বংসলীলা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এতে কারো হাত নেই তেমন। এতে দুঃখ হয় কিন্তু আবেদন ক্ষণস্থায়ী, তাই অধিকসংখ্যক উল্লেখযোগ্য ছবি হয়নি। আর এখন? এখন তো চারিদিকে রুচির দুর্ভিক্ষ! একটি স্বাধীন দেশে সুচিন্তা আর সুরুচির দুর্ভিক্ষ! এই দুর্ভিক্ষের ছবি হয় না!'
জয়নুল আবেদিন ছিলেন আমাদের সেই প্রকৃত আলোকবর্তিকা, যিনি শুধু পথ প্রদর্শনই নয়, পথকে নিজ হাতে গড়ে দিয়ে গেছেন আমাদের জন্য; এই বাংলাদেশের জন্য। তিনি দিলি্ল বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত ডিলিট প্রাপ্তির ভাষণে বলেছিলেন, 'আমার সমস্ত জীবন ও কর্ম নিবেদিত ছিলো একজন সম্পূর্ণ মানুষ হওয়ার পথে।'
শিল্প ও চেতনার স্ফুরণে জয়নুল আবেদিন আমাদের মননজগৎকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন অনবরত। তিনি আমাদের সেই বাতিঘর, যেখান থেকে আমরা দেখি গণমানুষের হাজার বছরের আর্তিকে। অফুরান সেই আলো।
জয়নুল আবেদিনের বিখ্যাত কিছু চিত্রকর্মের সঙ্গে গ্যালারিতে স্থান পেয়েছে শফিকুল আমিন, জুনাবুল ইসলাম, আবদুুর রাজ্জাক, নজরুল ইসলাম, মিজানুর রহিম, ময়নুল আবেদীন, সামিনা নাফিস, মোহাম্মদ আফজালুর রহিম, আরিফ আহমেদ তনু, মাসুদ মিজান এবং মানিজে আবেদিনের কাজ। তারা সবাই কোনো না কোনোভাবে জয়নুল আবেদিনের আত্মীয়। শিল্পাচার্যের সঙ্গে পারিবারিকভাবে সম্পর্কিত দেশের এই শিল্পীদের কাজ তাঁর কাজের সঙ্গে এক গ্যালারিতে উপস্থাপনের এ আয়োজন যেন এই মহান শিল্পীর পারিবারিক শিল্প-চেতনাকে উন্মোচিত করেছে। বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পকলা আন্দোলনের পথিকৃৎ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। শিল্পকলায় অবদানের জন্য তাঁর জীবদ্দশায় তিনি পেয়েছেন 'শিল্পাচার্য' খেতাব। মাত্র ১৬ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে তিনি বন্ধুদের সঙ্গে কলকাতায় গিয়েছিলেন শুধু কলকাতা গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস দেখার জন্য। এ আর্ট স্কুল দেখে আসার পর সাধারণ পড়াশোনায় জয়নুল আবেদিনের মন বসছিল না। তাই ১৯৩৩ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষার আগেই স্কুলের পড়ালেখা বাদ দিয়ে কলকাতায় চলে যান এবং মায়ের অনুপ্রেরণায় তিনি গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসে ভর্তি হন। জয়নুল আবেদিনের আগ্রহ দেখে তাঁর মা নিজের গলার হার বিক্রি করে ছেলেকে আর্ট স্কুলে ভর্তি করান। পরে ছেলে জয়নুল আবেদিন মায়ের সেই ভালোবাসার ঋণ শোধ করেছেন দেশের স্বনামধন্য শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে।
জয়নুল আবেদিন ছিলেন এদেশের চিত্রশিল্প আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি শুধু দুর্ভিক্ষের ছবি নয়, গ্রামবাংলার প্রাকৃতিক দৃশ্য, মা-মাটি এবং মানুষের জীবনের নানান বাস্তবতা তুলে ধরেছেন তাঁর ছবির মাধ্যমে। তাঁর আঁকা জলচিত্রগুলোও পেয়েছে এক অসাধারণ ভিন্নমাত্রা। তাঁর প্রচেষ্টায়ই বাংলাদেশে শিল্প আন্দোলনের জয়যাত্রা শুরু।
'৪৭-এ উপমহাদেশে দুটো স্বাধীন রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম হলে তিনি পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকায় চলে আসেন। কলকাতা আর্ট স্কুলে তাঁর চাকরিটি ছেড়ে ঢাকার আরমানিটোলায় একটি স্কুলে আর্ট শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। তাঁর শিল্পী খ্যাতি, অসাধারণ সাংগঠনিক মেধা; তৎকালীন শিল্পী, সহকর্মী ও বন্ধুদের সহযোগিতা এবং শিল্পাগ্রহী কিছু বাঙালি সরকারি কর্মকর্তার সহযোগিতা_ সব মিলিয়ে তিনি ১৯৪৮ সালে এদেশের প্রথম আর্ট স্কুল 'গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস' প্রতিষ্ঠা করেন। ৮ বছরের মাথায় মাত্র দুই কক্ষের সেই প্রতিষ্ঠানটিকে ১৯৫৬ সালে তিনি একটি আধুনিক শিল্পকলা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করেন। পরে এটি পূর্ব পাকিস্তান 'চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ 'চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়'-এ রূপান্তরিত হয়। তারপর মহাবিদ্যালয়টি সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হস্তান্তরিত হয় এবং বর্তমানে এটি 'চারুকলা অনুষদ' নামে পরিচিতি লাভ করে।
তাঁর আঁকা দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা পৃথিবীবিখ্যাত চিত্রকর্মের সিরিজ। সেই দুর্ভিক্ষ বা মন্ব্বন্তর ঘটেছিল ১৯৪৩ সালে অবিভক্ত বাংলায়। বর্তমান বাংলাদেশ ও ভারতের বেঙ্গল প্রদেশে যা 'তেতালি্লশের মন্বন্তর' নামেও পরিচিত। শিল্পাচার্যের দুর্ভিক্ষ সিরিজের সেই কালজয়ী চিত্রকর্ম বেঙ্গল গ্যালারির আয়োজনে স্থান পেয়েছে, যা দর্শকদের জয়নুল আবেদিনের অসামান্য শিল্প-সাধনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় আরেকবার।
সেই তেতালি্লশের মন্বন্তর সম্পর্কে জয়নুল আবেদিন একবার বলেছিলেন, '১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ ছিলো মনুষ্যসৃষ্ট। একটি পরাধীন দেশে একটি বিদেশি শক্তির চক্রান্ত। তার একটা স্বতন্ত্র আবেদন ছিলো; তাই অন্তর থেকে ছবি আঁকার দুর্বার প্রেরণা ছিলো। সত্তরের ঘূর্ণিঝড় ও ধ্বংসলীলা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এতে কারো হাত নেই তেমন। এতে দুঃখ হয় কিন্তু আবেদন ক্ষণস্থায়ী, তাই অধিকসংখ্যক উল্লেখযোগ্য ছবি হয়নি। আর এখন? এখন তো চারিদিকে রুচির দুর্ভিক্ষ! একটি স্বাধীন দেশে সুচিন্তা আর সুরুচির দুর্ভিক্ষ! এই দুর্ভিক্ষের ছবি হয় না!'
জয়নুল আবেদিন ছিলেন আমাদের সেই প্রকৃত আলোকবর্তিকা, যিনি শুধু পথ প্রদর্শনই নয়, পথকে নিজ হাতে গড়ে দিয়ে গেছেন আমাদের জন্য; এই বাংলাদেশের জন্য। তিনি দিলি্ল বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত ডিলিট প্রাপ্তির ভাষণে বলেছিলেন, 'আমার সমস্ত জীবন ও কর্ম নিবেদিত ছিলো একজন সম্পূর্ণ মানুষ হওয়ার পথে।'
শিল্প ও চেতনার স্ফুরণে জয়নুল আবেদিন আমাদের মননজগৎকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন অনবরত। তিনি আমাদের সেই বাতিঘর, যেখান থেকে আমরা দেখি গণমানুষের হাজার বছরের আর্তিকে। অফুরান সেই আলো।
No comments