গ্রামীণজীবনের ভাষ্যকার by ফজলুল হক সৈকত
বাংলার
গ্রামীণজীবনের ভাষ্যকার। গ্রাম-সমাজ ও গ্রামজীবন তার কবিতার ক্যানভাসে
চিত্রিত হয়েছে ভাষ্যকারের বিবৃতিতে। গ্রামজীবনের প্রতিচিত্র নির্মাণের
পাশাপাশি তিনি বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও মানববোধকে লালন এবং সমৃদ্ধ
করেছেন। স্বমহিমায় প্রোজ্জ্বল কবিতা-নির্মাতা জসীমউদ্দীনের কাব্য-পরিসরের
মূল্যায়ন আজও যথার্থভাবে হয়ে ওঠেনি। মানবপ্রীতি আর জীবন-সংকটের সঙ্গে
একাত্ম যে জসীমউদ্দীন, তাকে আমরা আবিষ্কার করতে পারছি না নিবিড় পাঠ ও
অনুপুঙ্খ-বিশেষণের অভাবে। সাধারণভাবে বা আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশের (তৎকালীন
ভারতবর্ষ ও পরবর্তীকালের পাকিস্তানের একটি বিশেষ ভূখণ্ডও বটে) অনগ্রসর
অঞ্চলের মানুষের যাপিত জীবন এবং প্রকৃতি-সুষমা জসীমের কাব্যকথার প্রধান
উপজীব্য হলেও, বিশেষ-বিবেচনায় তিনি সব কালের সব মানুষের কবি। তার
ভাবনার-ব্যাপকতা সমকাল পেরিয়ে উত্তরকাল এবং আপন-বিবর ছাড়িয়ে বিশ্ব-পরিসরে
প্রসারিত। ‘পল্লীকবি’ বা ‘গ্রামীণ কবি’ প্রভৃতি খণ্ডিত বিবেচনার মধ্যেও
তেমন কোনো মাহাত্ম্য নেই। কেননা, তার চিন্তাভুবনে কেবল গ্রাম নয়, আধুনিক
শিল্প-ভাবনার বিচিত্র বিষয় জায়গা করে নিয়েছে- কালের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে।
প্রকৃতপক্ষে, তিনি ছিলেন শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুখপাত্র। গ্রামের কবি
হিসেবে চিহ্নিত করতে গিয়ে ‘দগ্ধগ্রামে’র ভাষ্যকার জসীমকে আমরা চিনতে ভুল
করি। আর তার প্রতিবাদী প্রবল কণ্ঠস্বরটি তাই আমাদের দৃষ্টি-সীমানার বাইরেই
পড়ে থাকে পরম অবহেলায়। আর এই প্রতিবাদী চেতনাটি তিনি লাভ করেছেন সমকালের
সামাজিক অশিক্ষা-অজ্ঞতা-অনাচার-অবহেলা আর মানুষের জীবন-বাস্তবতার ভেতরে
লুকিয়ে থাকা না-বলা সব যন্ত্রণার প্রত্যক্ষ অনুভব থেকে। তার কবিতায় বাঙালি
জাতিসত্তার যে বীজ রোপিত, তা বাংলা কাব্যসভায় অনন্যসাধারণ। জসীমউদ্দীন
বাংলা ভাষার একমাত্র কবি, যিনি ছিলেন একাধারে লোকায়তিক, আধুনিক, গ্রামীণ,
স্বাদেশিক ও আন্তর্জাতিক।
শিল্পের সাধক কিংবা কবি-সাহিত্যিকরা সমাজ-সংসার-সংগ্রামের কথা লিখবেন। এসব কথা লিখতে গিয়ে শব্দ চাতুরীর আশ্রয় নিলে, বিশেষ কোনো কথন-ভঙ্গির আশ্রয় নিলে দোষ নেই। কিন্তু কবিতা যদি রসকথা-সর্বস্ব হয়ে দাঁড়ায়, তখন তাতে আনন্দের উপাদান পাওয়া গেলেও জীবনের প্রবহমানতা থেকে তার অবস্থান থাকে অনেক দূরে। বস্তুত, জীবন সম্পর্কে নীরবতা যদি কবির আরাধ্য হয়, তখন তার সৃষ্ট পঙ্ক্তি ও যাবতীয় কথামালা শো-কেসের দর্শনীয় বস্তুতে পরিণত হতে পারে- অন্য কিছু নয়। প্রকৃতির মমতাঘেরা সমাজ-কাঠামোর গীতলতা এবং তার নির্মলতার চারপাশে বিরাজমান জীবনের কথকতা কবিতার বিষয় হবে- এটা স্বাভাবিক। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে কবিদের বিবেচনায় ও বিবরণে এসব চিত্র ফুটে উঠতে দেখেছি আমরা। ওয়ার্ডসওয়ার্থ, ম্যাকিয়ভ্যালি থেকে শুরু করে আমাদের রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ এবং ইরানের সাম্প্রতিকতম কবি ফখরুদ্দিন ইরাকির কবিতা পর্যন্ত প্রসারিত ওই চেতনার বীজ, বীজতলা এবং শস্যভূমি। যাপিত জীবনের যে বৃহত্তর পর্যায়ক্রম, তার প্রতিভাস কবিতাজমিনে অঙ্কিত না হলে কবিতা হয়ে পড়ে জীবনবিমুখ। পরিপ্রেক্ষিত ও প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠতে পারেন না অনেক কবিই। জসীমউদ্দীন তার কবিতাকে এই ‘খাঁটি জীবনে’র প্রতিচ্ছায়া করতে গিয়ে সংকটকালীন মানব মনের বলিষ্ঠ বিবেকের মতো সোচ্চার কণ্ঠে প্রতিবাদ করেছিলেন। তার কবিতায় বিবৃত সমাজ ও জীবনকে বুঝতে হলে কবির এই বিশেষ প্রবণতাটিকে মনে রাখতে হবে। জসীমউদ্দীন ছিলেন প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী এবং এ ধরনের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। এরূপ মানসিকতার কারণেই ষাটের দশকে পাকিস্তান সরকার রেডিও এবং টেলিভিশন থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধের উদ্যোগ নিলে অনেকের মতো তিনিও এর তীব্র প্রতিবাদ জানান। তিনি বাঙালির জাতিসত্তা বিকাশের একজন দৃঢ় সমর্থক ছিলেন। কবিতা যে ফ্যাশন-শিল্প নয় কিংবা নেহাত সৌন্দর্য-ভাবনার প্রতিফলন নয়- সে কথা জসীমউদ্দীনের চেতনার গভীরে প্রোথিত ছিল। তিনি জীবন-সংগ্রামকে কবিতা-কাঁথায় আঁকতে চেয়েছেন বিভিন্নভাবে, বিচিত্র পরিসরে।
জসীমউদ্দীন ছিলেন অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারী। তার কবিতায় ব্যক্তিগত জীবনাভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তাই অনায়াসে চিহ্নিত হতে পেরেছে মানববৃত্তি আর সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতিচেতনা। শিল্পী যতই নিঃসঙ্গ হন না কেন, তার ব্যক্তি-মানসের সূত্রগুলো সমাজ সংগঠনের ভেতরেই নিহিত থাকে। হিন্দু মধ্যবিত্তের সম্প্রসারণের কাল যখন ফুরিয়ে এসেছে, বিশ শতকের সেই প্রথম দিকেই মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজের উন্মেষ। স্বভাবতই মুসলিম মধ্যবিত্ত তখন অপেক্ষাকৃত আশাবাদী। সুতরাং জসীমউদ্দীনের কবি-মানসে লোকজ জীবন ও ঐতিহ্যের প্রাধান্য কোনো প্রতিক্রিয়া-সজ্ঞাত নয়। বরং বলা চলে বৃহত্তর বাংলার কৃষক সমাজ ও তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে জসীমউদ্দীনের পরিচয় ঐতিহাসিক কারণেই প্রত্যক্ষ ও নিবিড়। গ্রামবাংলা ও সাংস্কৃতিক ঐশ্বর্য তার কবিতার শুধু উপকরণই নয়; প্রেরণাও বটে। গ্রামীণ গাথা ও পুুঁথি সাহিত্যের আবহাওয়ায় পুষ্ট জসীমউদ্দীনের কাব্য-সাধনায় যে আবহমান বাংলার পরিচয় উদ্ভাসিত তা কোনো সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিতে অসম্পূর্ণ অথবা খণ্ডিত নয়। জসীমউদ্দীনের কবিতায় শুধু গ্রাম আর গ্রামীণ জীবনচিত্র অন্বেষণ এখন নিরর্থক; তার প্রকৃত মূল্যায়ন আজ অত্যন্ত জরুরি। কারণ, ঐতিহ্যবাহী বাংলা কবিতার মূল ধারাটিকে নগরসভায় নিয়ে আসার কৃতিত্ব জসীমউদ্দীনের। জসীমউদ্দীন তার কাব্যাদর্শে আজীবন অটল ছিলেন এবং গ্রাম্যতা পরিহার করে গ্রামীণ ভাবাবহে তিনি প্লাবিত করে রেখে গেছেন নগরাক্রান্ত চিত্ত। প্রকৃত অর্থে, গীতলতার অন্তরালে জসীমউদ্দীনের কবিতায় দ্রোহ আছে। আছে প্রতিবাদের অগ্নিশিখা। তিনি নিজস্ব ভাষাভঙ্গিতেই অবলীলায় নির্মাণ করেছেন সে প্রতিবাদের প্রতিভাস। জসীমের বিদ্রোহী-সত্তাটিকে চিনে নিতে হলে পাঠককে একটু সাবধানী হতে হয় বৈ-কি!
আমরা দেখেছি জসীমউদ্দীনের পূর্বগামী বাংলার কবিরা গ্রামীণ সমাজ ও জীবনের ছবি এঁকেছেন। এই ঐতিহ্য সূচিত হয়েছে চর্যার কবিদের সময় থেকেই। চর্যাপদকর্তারা পর্বতের কথা বলেছেন, শবর বালিকার কথা বলেছেন- সে বালিকার মাথায় ময়ূরপুচ্ছ পরিয়ে গলায় পুঞ্জার মালা দিয়েছেন। শবরীর রূপমুগ্ধ শবরের প্রমত্ত আবেগের সৌন্দর্যও প্রকাশ করেছেন। নদী অতিক্রমের চিত্র, নৌকা বাওয়ার চিত্র কিংবা ডোম-ডোমনা আর হরিণ-হরিণীর প্রণয় কথা বর্ণনা করেছেন। গ্রাম-নদী-উপবন-রাখাল আর বাঁশির পুনরাবৃত্তি পাই বৈষ্ণব পদাবলিতে। মধ্যযুগের অপরাপর কাব্যেও গ্রামজীবনের ছবি পরিবেশিত হয়েছে দারুণ মমতায়। শুধু মধ্যযুগের কথাই বা বলি কেন, আধুনিক যুগেও মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শহুরে জীবনের অভিজ্ঞতার পরিপুষ্ট হওয়া সত্ত্বেও গ্রামের প্রকৃতি আর মানুষের কথা লিখেছেন। তাদের বর্ণনা ও পরিবেশনা গভীর, আন্তরিক এবং প্রাতিস্বিক। বিশ শতকের প্রথমপাদে কবি বন্দে আলী মিয়ার কবিতায়ও ভিড় করেছে গ্রাম-সমাজ ও জীবনের যাবতীয় আনন্দ এবং যন্ত্রণা। জসীমউদ্দীন এদের উত্তরাধিকারী। তবে তার বিবেচনা, পর্যবেক্ষণ ও উপস্থাপন পূর্বসূরিদের তুলনায় অনেক নিবিড়। গ্রামের সমাজ-পরিপ্রেক্ষিতে জীবন ও গ্রামের প্রকৃতি, স্মৃতিকাতরতা, জীবনের প্রতি মমতা-আসক্তি এবং অনুষঙ্গ তার কবিতায় ফুটে উঠেছে আপন আপন চারিত্র্যে।
জসীমউদ্দীন তার কবিতা-পরিসরে সমকালীন সমাজ-পরিপ্রেক্ষিত, মানব জীবনের পরিসর এবং বিচিত্র প্রবণতা প্রকাশ করে ওই স্বাভাবিকতাকে সমর্থন করেছেন। প্রতিবেশ ও সমাজ-পরিসরের চিরচেনা পরিজনকে তিনি দেখেছেন খুব কাছ থেকে। তাদের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব সম্বন্ধে তিনি সাবধানী শিল্পী। জসীমউদ্দীনের অনুসন্ধানী পর্যবেক্ষণ তার কবিতায় সমাজ ও মানুষকে দান করেছে বিশেষ মর্যাদা।
শিল্পের সাধক কিংবা কবি-সাহিত্যিকরা সমাজ-সংসার-সংগ্রামের কথা লিখবেন। এসব কথা লিখতে গিয়ে শব্দ চাতুরীর আশ্রয় নিলে, বিশেষ কোনো কথন-ভঙ্গির আশ্রয় নিলে দোষ নেই। কিন্তু কবিতা যদি রসকথা-সর্বস্ব হয়ে দাঁড়ায়, তখন তাতে আনন্দের উপাদান পাওয়া গেলেও জীবনের প্রবহমানতা থেকে তার অবস্থান থাকে অনেক দূরে। বস্তুত, জীবন সম্পর্কে নীরবতা যদি কবির আরাধ্য হয়, তখন তার সৃষ্ট পঙ্ক্তি ও যাবতীয় কথামালা শো-কেসের দর্শনীয় বস্তুতে পরিণত হতে পারে- অন্য কিছু নয়। প্রকৃতির মমতাঘেরা সমাজ-কাঠামোর গীতলতা এবং তার নির্মলতার চারপাশে বিরাজমান জীবনের কথকতা কবিতার বিষয় হবে- এটা স্বাভাবিক। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে কবিদের বিবেচনায় ও বিবরণে এসব চিত্র ফুটে উঠতে দেখেছি আমরা। ওয়ার্ডসওয়ার্থ, ম্যাকিয়ভ্যালি থেকে শুরু করে আমাদের রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ এবং ইরানের সাম্প্রতিকতম কবি ফখরুদ্দিন ইরাকির কবিতা পর্যন্ত প্রসারিত ওই চেতনার বীজ, বীজতলা এবং শস্যভূমি। যাপিত জীবনের যে বৃহত্তর পর্যায়ক্রম, তার প্রতিভাস কবিতাজমিনে অঙ্কিত না হলে কবিতা হয়ে পড়ে জীবনবিমুখ। পরিপ্রেক্ষিত ও প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠতে পারেন না অনেক কবিই। জসীমউদ্দীন তার কবিতাকে এই ‘খাঁটি জীবনে’র প্রতিচ্ছায়া করতে গিয়ে সংকটকালীন মানব মনের বলিষ্ঠ বিবেকের মতো সোচ্চার কণ্ঠে প্রতিবাদ করেছিলেন। তার কবিতায় বিবৃত সমাজ ও জীবনকে বুঝতে হলে কবির এই বিশেষ প্রবণতাটিকে মনে রাখতে হবে। জসীমউদ্দীন ছিলেন প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী এবং এ ধরনের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। এরূপ মানসিকতার কারণেই ষাটের দশকে পাকিস্তান সরকার রেডিও এবং টেলিভিশন থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধের উদ্যোগ নিলে অনেকের মতো তিনিও এর তীব্র প্রতিবাদ জানান। তিনি বাঙালির জাতিসত্তা বিকাশের একজন দৃঢ় সমর্থক ছিলেন। কবিতা যে ফ্যাশন-শিল্প নয় কিংবা নেহাত সৌন্দর্য-ভাবনার প্রতিফলন নয়- সে কথা জসীমউদ্দীনের চেতনার গভীরে প্রোথিত ছিল। তিনি জীবন-সংগ্রামকে কবিতা-কাঁথায় আঁকতে চেয়েছেন বিভিন্নভাবে, বিচিত্র পরিসরে।
জসীমউদ্দীন ছিলেন অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারী। তার কবিতায় ব্যক্তিগত জীবনাভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তাই অনায়াসে চিহ্নিত হতে পেরেছে মানববৃত্তি আর সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতিচেতনা। শিল্পী যতই নিঃসঙ্গ হন না কেন, তার ব্যক্তি-মানসের সূত্রগুলো সমাজ সংগঠনের ভেতরেই নিহিত থাকে। হিন্দু মধ্যবিত্তের সম্প্রসারণের কাল যখন ফুরিয়ে এসেছে, বিশ শতকের সেই প্রথম দিকেই মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজের উন্মেষ। স্বভাবতই মুসলিম মধ্যবিত্ত তখন অপেক্ষাকৃত আশাবাদী। সুতরাং জসীমউদ্দীনের কবি-মানসে লোকজ জীবন ও ঐতিহ্যের প্রাধান্য কোনো প্রতিক্রিয়া-সজ্ঞাত নয়। বরং বলা চলে বৃহত্তর বাংলার কৃষক সমাজ ও তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে জসীমউদ্দীনের পরিচয় ঐতিহাসিক কারণেই প্রত্যক্ষ ও নিবিড়। গ্রামবাংলা ও সাংস্কৃতিক ঐশ্বর্য তার কবিতার শুধু উপকরণই নয়; প্রেরণাও বটে। গ্রামীণ গাথা ও পুুঁথি সাহিত্যের আবহাওয়ায় পুষ্ট জসীমউদ্দীনের কাব্য-সাধনায় যে আবহমান বাংলার পরিচয় উদ্ভাসিত তা কোনো সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিতে অসম্পূর্ণ অথবা খণ্ডিত নয়। জসীমউদ্দীনের কবিতায় শুধু গ্রাম আর গ্রামীণ জীবনচিত্র অন্বেষণ এখন নিরর্থক; তার প্রকৃত মূল্যায়ন আজ অত্যন্ত জরুরি। কারণ, ঐতিহ্যবাহী বাংলা কবিতার মূল ধারাটিকে নগরসভায় নিয়ে আসার কৃতিত্ব জসীমউদ্দীনের। জসীমউদ্দীন তার কাব্যাদর্শে আজীবন অটল ছিলেন এবং গ্রাম্যতা পরিহার করে গ্রামীণ ভাবাবহে তিনি প্লাবিত করে রেখে গেছেন নগরাক্রান্ত চিত্ত। প্রকৃত অর্থে, গীতলতার অন্তরালে জসীমউদ্দীনের কবিতায় দ্রোহ আছে। আছে প্রতিবাদের অগ্নিশিখা। তিনি নিজস্ব ভাষাভঙ্গিতেই অবলীলায় নির্মাণ করেছেন সে প্রতিবাদের প্রতিভাস। জসীমের বিদ্রোহী-সত্তাটিকে চিনে নিতে হলে পাঠককে একটু সাবধানী হতে হয় বৈ-কি!
আমরা দেখেছি জসীমউদ্দীনের পূর্বগামী বাংলার কবিরা গ্রামীণ সমাজ ও জীবনের ছবি এঁকেছেন। এই ঐতিহ্য সূচিত হয়েছে চর্যার কবিদের সময় থেকেই। চর্যাপদকর্তারা পর্বতের কথা বলেছেন, শবর বালিকার কথা বলেছেন- সে বালিকার মাথায় ময়ূরপুচ্ছ পরিয়ে গলায় পুঞ্জার মালা দিয়েছেন। শবরীর রূপমুগ্ধ শবরের প্রমত্ত আবেগের সৌন্দর্যও প্রকাশ করেছেন। নদী অতিক্রমের চিত্র, নৌকা বাওয়ার চিত্র কিংবা ডোম-ডোমনা আর হরিণ-হরিণীর প্রণয় কথা বর্ণনা করেছেন। গ্রাম-নদী-উপবন-রাখাল আর বাঁশির পুনরাবৃত্তি পাই বৈষ্ণব পদাবলিতে। মধ্যযুগের অপরাপর কাব্যেও গ্রামজীবনের ছবি পরিবেশিত হয়েছে দারুণ মমতায়। শুধু মধ্যযুগের কথাই বা বলি কেন, আধুনিক যুগেও মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শহুরে জীবনের অভিজ্ঞতার পরিপুষ্ট হওয়া সত্ত্বেও গ্রামের প্রকৃতি আর মানুষের কথা লিখেছেন। তাদের বর্ণনা ও পরিবেশনা গভীর, আন্তরিক এবং প্রাতিস্বিক। বিশ শতকের প্রথমপাদে কবি বন্দে আলী মিয়ার কবিতায়ও ভিড় করেছে গ্রাম-সমাজ ও জীবনের যাবতীয় আনন্দ এবং যন্ত্রণা। জসীমউদ্দীন এদের উত্তরাধিকারী। তবে তার বিবেচনা, পর্যবেক্ষণ ও উপস্থাপন পূর্বসূরিদের তুলনায় অনেক নিবিড়। গ্রামের সমাজ-পরিপ্রেক্ষিতে জীবন ও গ্রামের প্রকৃতি, স্মৃতিকাতরতা, জীবনের প্রতি মমতা-আসক্তি এবং অনুষঙ্গ তার কবিতায় ফুটে উঠেছে আপন আপন চারিত্র্যে।
জসীমউদ্দীন তার কবিতা-পরিসরে সমকালীন সমাজ-পরিপ্রেক্ষিত, মানব জীবনের পরিসর এবং বিচিত্র প্রবণতা প্রকাশ করে ওই স্বাভাবিকতাকে সমর্থন করেছেন। প্রতিবেশ ও সমাজ-পরিসরের চিরচেনা পরিজনকে তিনি দেখেছেন খুব কাছ থেকে। তাদের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব সম্বন্ধে তিনি সাবধানী শিল্পী। জসীমউদ্দীনের অনুসন্ধানী পর্যবেক্ষণ তার কবিতায় সমাজ ও মানুষকে দান করেছে বিশেষ মর্যাদা।
No comments