আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষা

 ২৮ ডিসেম্বর প্রথম আলোয় অধ্যাপক সৌমিত্র শেখরের ‘মাতৃভাষায় শিক্ষা: বাস্তবায়নভিত্তিক পরিকল্পনা চাই’ শিরোনামে প্রকাশিত লেখা সম্পর্কে দুটি কারণে কিছু বলা আবশ্যক মনে করছি। প্রথমত, লেখাটিতে বেশ কিছু তথ্য উপস্থাপিত হয়েছে, যা যথার্থ নয়। দ্বিতীয়ত, আদিবাসীদের জন্য মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের পরিপ্রেক্ষিত এবং বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা বাস্তবায়নে যৌক্তিকতা ও সাম্প্রতিক অগ্রগতির বিষয়ে পাঠককে জানানো প্রয়োজন। প্রথমেই সৌমিত্র শেখরকে ধন্যবাদ জানাই যে তিনি বাংলাদেশের আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষার বিষয় নিয়ে একটি সময়োপযোগী লেখা উপস্থাপন করেছেন। শুরুতেই বলে রাখা ভালো, ২০১০ সালে যে যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছিল, সেখানে এ দেশের আদিবাসী তথা সরকারি ভাষায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। আর এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের শুরুতেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় উদ্যোগী হয় প্রাক্-প্রাথমিক পর্যায়ে আদিবাসীদের জন্য মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির। এ বিষয়ে শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে গঠিত হয় একটি জাতীয় কমিটি। সেই কমিটির সুপারিশে প্রাথমিকভাবে ছয়টি (চাকমা, মারমা, ককবোরক, মান্দি, সাঁওতালি ও সাদরি) ভাষায় পাঠ্যপুস্তক তৈরি, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া চলছে। কাজেই অধ্যাপক সৌমিত্র শেখরের ‘প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে কাজ করেছে প্রথাগত এনজিওগুলো, এই তথ্য যথার্থ নয়। তবে এনজিওগুলো এ ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে, তা অস্বীকার করার অবকাশ নেই।
তিনি চাকমাদের জনসংখ্যা উল্লেখ করেছেন ‘তিন লাখের মতো’ কিন্তু ২০১১ সালের জনগণনার হিসাবে চার লাখ ৪৪ হাজার। তিনি আরও লিখেছেন, ‘জনগোষ্ঠীর দু-একটির মাত্র সম্পূর্ণ লিপি বা হরফ আছে’ এই তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা জানাতে চাই যে বাংলাদেশের আদিবাসীদের মধ্যে চাকমা, মারমা, মণিপুরি ও ম্রোদের নিজস্ব লিপি আছে, যা দ্বারা পাঠ্যপুস্তক তৈরি করে উন্নয়ন সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন ধরে মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষিক শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। উল্লেখ্য, সাঁওতালেরা তাদের ভাষায় রোমানলিপি ব্যবহার করে আসছে ১০০ বছরেরও অধিক। এ ছাড়া বাংলাদেশে তারা বাংলা লিপিও ব্যবহার করে থাকে। মন্ত্রণালয়ে গঠিত আদিবাসীদের মাতৃভাষা বাস্তবায়ন জাতীয় কমিটি লিপির প্রশ্নে সাঁওতালিদের মধ্যে বিভক্তি থাকায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সাঁওতাল সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের দায়িত্ব দিয়েছিল। কিন্তু তারা অদ্যাবধি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় সাঁওতালি ভাষায় পাঠ্যপুস্তক তৈরির বিষয়টি আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে। লিপির বিষয়ে কিছু তথ্য জানানো প্রয়োজন যে মন্ত্রণালয় বা বাস্তবায়ন কমিটি কোন জনগোষ্ঠী কোন লিপি ব্যবহার করবে, তা সম্পূর্ণ তাদের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে নিজ নিজ ভাষার ওপর তাদের যে মমতা ও আবেগ রয়েছে, তা যেন বিদ্যমান থাকে একুশে ফেব্রুয়ারির গৌরবময় ঐতিহ্যের এই দেশে, তা রক্ষা করার চেষ্টা করেছে কমিটি। যাদের নিজস্ব লিপি নেই, তারা রোমান অথবা বাংলা—যে হরফেই হোক না কেন, এটি নির্ধারণ করবে নিজ নিজ ভাষাভাষীর জনগোষ্ঠী। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ত্রিপুরাদের ককবোরক ভাষা লিখিত হয় বাংলা হরফে কিন্তু বাংলাদেশের ত্রিপুরাদের দাবি অনুযায়ী তারা রোমান হরফ গ্রহণ করেছে। লেখক সৌমিত্র শেখর আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, দু-চার বছর পর এই বিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাবে।
আশঙ্কাটি অমূলক। কেননা এটি কোনো এনজিওর প্রকল্পভিত্তিক বিদ্যালয় নয়। দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০১৪ সাল থেকে যে প্রাক্-প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষাদান কর্মসূচি চালু হতে যাচ্ছে, সেখানে বিভিন্ন ভাষার আদিবাসীরা শুধু তাদের ভাষায় (পর্যায়ক্রমিকভাবে) প্রাক্-প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষা লাভের সুযোগ পাবে। যেহেতু সরকারিভাবে এবং সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষাদান করা হবে, সে কারণে এটি বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা নেই। এবার আসি আদিবাসীদের মধ্যে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু প্রসঙ্গে। লেখক প্রস্তাব করেছেন, সবার আগে অপেক্ষাকৃত কম আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষার আওতায় আনতে হবে। ভাষা ও শিক্ষা নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন, আমরা সবাই এ বিষয়ে একমত। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতার কথা বিবেচনা করে এ মুহূর্তে এটি করা সম্ভব নয়। কেননা খুমি, খেয়াং, পাংখোয়া প্রভৃতি সংখ্যায় স্বল্প হলেও এই আদিবাসীরা যে দুর্গম এলাকায় থাকে, সেখানে কোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই বললেই চলে, এমনকি তাদের মধ্যে মাতৃভাষায় শিক্ষাদান উপযোগী শিক্ষক তৈরি করতেও সময়ের প্রয়োজন। এই প্রধান দুই বাস্তবতা সামনে রেখে বাংলাদেশের আদিবাসীদের মধ্যে পর্যায়ক্রমিকভাবে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়কেই বেছে নেওয়া হয়েছে। সূচনাবর্ষে (২০১৪ বা ২০১৫) পাঁচটি আদিবাসী ভাষা এবং পরবর্তী বর্ষে আরও কিছু ভাষা এভাবে ক্রমান্বয়ে সম্ভাব্য সব আদিবাসীর মাতৃভাষায় প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত সম্পন্ন করা হবে। প্রাথমিক সমাপনী বা পঞ্চম শ্রেণীতে যাওয়ার আগেই ভাষিক সমন্বয় (ব্রিজিং) অর্থাৎ মাতৃভাষা থেকে পর্যায়ক্রমে বাংলা ও ইংরেজি ভাষা শেখা এবং বাংলা মাধ্যমে শিক্ষালাভের যোগ্যতা অর্জন করার প্রক্রিয়াটি আধুনিক এমএলই (মাল্টি লিঙ্গুয়াল এডুকেশন) ব্রিজিং-প্রক্রিয়া মেনেই করা হয়েছে। শিক্ষানীতির প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সরকার আদিবাসীদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। এটি বাস্তবায়নে প্রয়োজন সময় ও আন্তরিকতার। ইতিমধ্যে অনেকটা সময়ক্ষেপণ হলেও আশা করি, সরকার তার আন্তরিকতা দিয়ে আমলাতান্ত্রিক ও প্রশাসনিক জটিলতা কাটিয়ে দ্রুত বাস্তবায়ন করবে।
 সৌরভ সিকদার: অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
jeweel1965@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.