গাছ নয়, শ্বাসনালি কাটছে ওরা by শেখ রোকন
যে কারণেই হোক, রাজনৈতিকভাবে যে পক্ষেরই
হোক; 'আশরাফুল মাখলুকাত' মানুষের জানমালেরই যখন তোয়াক্কা করা হচ্ছে না, তখন
গাছ নিয়ে উদ্বেগ কতটা সঙ্গত_ অন্ধ বিভাজনের শিকার এই সমাজে এমন প্রশ্ন
তোলার লোকের অভাব নেই, বলা বাহুল্য। পাল্টা প্রশ্ন হচ্ছে, রাজনৈতিক যে সংকট
সৃস্টি হয়েছে গাছ বলি দিয়ে কি তার সুরাহা মিলেছে? মহাসড়কে মহাসড়কে
নির্বিচারে গাছ কেটে যে 'অবরোধ' সৃষ্টি করতে চেয়েছিল একটি গোষ্ঠী, তাও কি
টিকিয়ে রাখতে পেরেছে?
স্বীকার করতে হবে, ক্রমবর্ধমান হারে বিসবুজায়নের এই দেশে কেবল রাজনৈতিক জিঘাংসাবশত গাছ কাটা হলো, এমন নয়। আমরা বেদনার সঙ্গে দেখে এসেছি, গাছ কাটতে ছলের অভাব হয় না। রাস্তাঘাট সম্প্রসারণ থেকে শুরু করে 'উন্নয়ন' কর্মকাণ্ড বা নগরের 'সৌন্দর্য' বর্ধন, শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি ছলে করাত উঁচিয়ে প্রস্তুত থাকে কিছু লোক। ইটভাটার খোরাক জোগাতে কিংবা পাহাড় কাটতে গিয়েও নির্বিচারে বন ধ্বংস হচ্ছে। সংরক্ষিত বনাঞ্চলগুলো তো রক্ষক ও ভক্ষকদের যোগসাজশে বাইরে থেকে নিবিড় বনানী দেখা গেলেও ভেতরে ফোকলা হয়ে গেছে। এর মধ্যে মহাসড়ক ধরে গড়ে ওঠা সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির গাছগুলোই তুলনামূলক অক্ষত ছিল। এর একটি কারণ হচ্ছে, এসব বৃক্ষের টিকে থাকার সঙ্গে বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবিকার প্রশ্নটি জড়িত। তারাই দিন-রাত পাহারা দিয়ে কুড়ালের কোপ থেকে মহাসড়কের গাছগুলো টিকিয়ে রেখেছিল। আওয়ামী লীগ বা বিএনপি যে আমলেই হোক, মহাসড়কের গাছের প্রতি ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় প্রভাবশালীদের লোলুপ দৃষ্টির ছাপও বিভিন্ন সময় দেখা গেছে। দেখা গেছে, রাতের আঁধারে, এমনকি দিনের আলোতেও ঝপাঝপ কোপ দিয়ে গাছ নিয়ে উধাও তারা। ছায়াঘন সড়ক হঠাৎই ন্যাড়া, মুখব্যাদান করে পড়ে থাকে কাটা গাছের গুঁড়ি। বন বিভাগ, সড়ক ও জনপথ কিংবা স্থানীয় সরকার প্রকৌশলের ছোট ও মাঝারি কর্তাদের 'বিধিমতো ব্যবস্থা' নেওয়ার আশ্বাসই সার। না মেলে গাছের হদিস, না পায় কেউ শাস্তি। কিন্তু এবার বিরোধীদলীয় জোটের হরতাল, অবরোধ এবং স্থানীয় পর্যায়ে ডাকা হরতাল-ধর্মঘট 'সফল' করতে গিয়ে যেভাবে নির্বিচারে মহাসড়কের গাছ কাটা হয়েছে, তা অতীতে কখনও দেখা গেছে কি?
এ বিষয়ে সমকালের ১৫ ডিসেম্বরের সম্পাদকীয় থেকে উদ্ধৃতি_ "বিরোধীদলীয় জোটের গত কিছু দিনের 'কর্মসূচি' যেন হয়ে উঠেছে বৃক্ষ নিধনের মচ্ছব। দিনের আলোতে বা রাতের অন্ধকারে উন্মত্ত কিছু গোষ্ঠী বহু যত্নে লালিত চারা থেকে বৃক্ষ হয়ে ওঠা গাছগুলো কয়েক মিনিটেই কেটে রাস্তায় ফেলছে। আমরা দেখেছি, উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো যখন রাজধানীতে তাদের জমায়েত করেছিল, তখন এখানকার সড়কদ্বীপের লাবণ্যময় গাছগুলোও তাদের কঠোর করাত থেকে রেহাই পায়নি। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কারসাজিতে মহাসড়কের বৃক্ষবন ফোকলা হওয়ার অঘটন এ দেশে বিরল নয়; কিন্তু এমন কদমছাঁট কে কবে দেখেছে! সরেজমিন না দেখেও আশঙ্কা করা কঠিন নয় যে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের দীর্ঘ পরিশ্রমের ফলে সবুজ নদীর আকার ধারণ করা আমাদের মহাসড়কগুলো এখন ন্যাড়া হয়েছে। সড়কের পাশে সামাজিক বনায়ন করে বাংলাদেশ বিশ্বে যে নজির সৃষ্টি করতে পেরেছিল, তা এখন বোধহয় অতীত।"
ঠিক কত গাছ কাটা হয়েছে বিরোধীদলীয় জোটের দেশব্যাপী প্রায় টানা অবরোধ ও খুচরা হরতালের দিনগুলোতে? সড়কে-মহাসড়কে বন বিভাগ ছাড়াও সড়ক ও জনপথ বিভাগ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ, স্থানীয় সরকার, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রকল্পের গাছ রয়েছে। বলা বাহুল্য, গাছ-ঘাতকরা এসব বিচার করেনি। সামনে যা পড়েছে উন্মত্তের মতো কেটেছে। বন বিভাগের একটি হিসাবে জানা যাচ্ছে কমবেশি ১৫ হাজার। আমার ধারণা, সংখ্যাটা আরও বেশি। কতটা ব্যাপক তা গুগলের ইঞ্জিনে গিয়ে 'মহাসড়ক+অবরোধ+গাছ' লিখে সার্চ দিলেই বোঝা যায়। দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর প্রভৃতি 'বৃক্ষ বধ্যভূমি' তো আছেই; অন্তত ৩২টি জেলার নাম পাওয়া যাবে যেখানে মহাসড়কের গাছ নির্বিচারে কাটা হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর করতে গিয়ে যে চিত্র পেয়েছি, তাতে বিকট শঙ্কা ছাড়া আর কিছু জাগে না। দেখা যাচ্ছে, ৬৪টি জেলার মধ্যে মাত্র ১২টি জেলার গাছ দৃশ্যত অক্ষত থেকেছে। বাকি ৫২টি জেলার মহাসড়কজুড়ে গড়ে ওঠা বনাঞ্চল কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
খতিয়ে দেখলাম, রংপুর বিভাগের আটটি জেলাতেই_ পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী, রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধায় মহাসড়কের গাছ কাটা হয়েছে। রাজশাহী বিভাগের দশাও তথৈবচ। রাজশাহী, চাঁপাইনবানগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, বগুড়া, জয়পুরহাট, পাবনা, সিরাজগঞ্জ_ প্রত্যেকটি জেলার গাছ অবরোধকারীদের কোপানলে পড়েছে। ঢাকা বিভাগের পরিস্থিতি অপেক্ষাকৃত ভালো ছিল। মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, রাজবাড়ী এবং ঢাকা সদরের সাভার, দোহার প্রভৃতি এলকায় কিছু গাছ কাটা হয়েছে। বিস্ময়করভাবে এই বিভাগের ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর জেলায় গাছ কাটা পড়েনি। অন্তত সংবাদপত্রে খবর হওয়ার মতো মাত্রায় পেঁৗছেনি। খুলনা বিভাগেই রয়েছে চলতি অবরোধে মানুষ ও বৃক্ষ হত্যায় কুখ্যাতি পাওয়া সাতক্ষীরা অঞ্চল। তবে এর বাইরে খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, নড়াইল, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুরেও কম গাছ কাটা পড়েনি। সেদিক থেকে এই বিভাগের মাগুরা জেলার গাছগুলো সৌভাগ্যক্রমে নিরাপদে ছিল। সিলেট বিভাগেরও সব ক'টি জেলার_ সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ_ গাছপালা কুড়াল-করাতের জিঘাংসা দেখেছে। বরিশাল বিভাগে বরগুনা ছাড়া বরিশাল, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, ভোলা, পিরোজপুরের গাছগুলোতে কোপ পড়েছে। বরিশাল বিভাগে বিরোধীদলীয় জোটের কর্মসূচি অপেক্ষাকৃত দুর্বল ছিল বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু যতটুকু হয়েছে, তাতে গাছ যে ছাড় পায়নি তা স্পষ্ট। চট্টগ্রাম বিভাগের কুমিল্লা, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এমনকি বান্দরবানেও গাছ কেটে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধের ঘটনা ঘটেছে। অক্ষত ছিল রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি। তিন পার্বত্য জেলার গাছ কাটা পরিসংখ্যান থেকে পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে কর্মরত গবেষকরা এই অনুসিদ্ধান্তেও আসতে পারেন যে আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসতি পরিবেশ ও সবুজের জন্য সহায়ক। যে কারণে সমতল থেকে যাওয়া সেটেলারের সংখ্যা যেখানে বেশি সেই বান্দরবানে গাছ নিরাপদ থাকেনি।
এভাবে নির্বিচারে গাছ কেটে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের যে কিছু করতে পারেনি, তা খুব সম্ভবত ইতিমধ্যে প্রমাণ হয়েছে। কিন্তু এর হোতারা দেশের পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থার যে ক্ষতি করলেন, তা অপূরণীয়। দেখা যাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় আমাদের যখন বেশি করে গাছ লাগানোর কথা, তখন আমরা রাতারাতি শত শত গাছ কেটে ফেললাম! অনেকে আশা করতেন, পরিবর্তিত জলবায়ুর যুগে বনাঞ্চলের পরিমাণ দেখিয়ে 'কার্বন-ট্রেড' ব্যবস্থায় বাংলাদেশ সুবিধা করতে পারবে। কিন্তু গাছই যদি না থাকে, তাহলে সেই আশায় গুড়ে বালি! গাছ কাটার অঘটনগুলোর পর অনেকে যথার্থই সামাজিক বনায়নের সঙ্গে যুক্ত দেশের হাজার হাজার দরিদ্র পরিবারগুলোর জীবন-জীবিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু অবরোধের চিত্রগুলো দেখলে, সংবাদ পড়লে বোঝা যায় বিভিন্ন স্থানের করাতকল থেকেও গাছের গুঁড়ি ছিনিয়ে বা চুরি করে সড়কে ফেলা হয়েছে, আগুন লাগানো হয়েছে। আহা কতজনের পুঁজি এভাবে অবরোধের উন্মাদনায় ফৌত হয়ে গেছে! নির্মম পরিহাস হচ্ছে, হাজার হাজার গাছ কেটে শেষ রক্ষা তো হয়ইনি_ বিরোধীদলীয় জোটকে ভবিষ্যতে যদি আবার অবরোধে নামতে হয়, 'প্রয়োজনীয়' গাছও আর পাবে না!
নির্মমতা ও নির্বুদ্ধিতার খতিয়ান দেখতে দেখতে প্রশ্ন জেগেছিল_ আর কিছু না হোক, মানুষের শ্বাস নেওয়ার প্রয়োজনেও যে গাছ প্রয়োজন, করাতধারী মূর্খরা তা কি জানে? এরা কি জানে যে মানুষের জীবনধারণের প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহের সঙ্গে গাছের রয়েছে সরাসরি সম্পর্ক। আমরা যে কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন করি, তা গাছ শোষণ করে অক্সিজেন ছাড়ে_ প্রাথমিক পর্যায়ের এই তথ্যটুকু কি তাদের কাছে আছে? এরা কি জানে যে গাছে নয়, তারা আসলে নিজ নিজ শ্বাসনালিতে করাত চালাচ্ছে?
আচ্ছা, গাছের অনুভূতি আবিষ্কারকারী বিশ্ববরেণ্য বঙ্গসন্তান জগদীশচন্দ্র বসুর নামও কি এরা জানে? অবশ্য যারা সাধারণ নাগরিকের বিড়ম্বনা বিবেচনা না করে দিনের পর দিন ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে; যারা যাত্রীবাহী বাস, লেগুনা এমনকি অটোরিকশার নারী-শিশুর আর্তি উপেক্ষা করে পেট্রোল বোমা মারছে বা অগি্নসংযোগ করছে; তাদের কাছে গাছের প্রাণ-অনুভূতির মূল্য কী? যারা অন্ধ ও সংকীর্ণ গোষ্ঠীস্বার্থে মত্ত, তাদের কাছে পরিবেশ-প্রতিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ, সবুজের প্রয়োজনীয়তার কথা আক্ষরিক অর্থেই অরণ্য রোদন ছাড়া কী? আমরা কেবল বলতে পারি_ এদের জ্ঞান দাও প্রভু, এদের ক্ষমা কর!
শেখ রোকন : গবেষক ও সাংবাদিক
skrokon@gmail.com
স্বীকার করতে হবে, ক্রমবর্ধমান হারে বিসবুজায়নের এই দেশে কেবল রাজনৈতিক জিঘাংসাবশত গাছ কাটা হলো, এমন নয়। আমরা বেদনার সঙ্গে দেখে এসেছি, গাছ কাটতে ছলের অভাব হয় না। রাস্তাঘাট সম্প্রসারণ থেকে শুরু করে 'উন্নয়ন' কর্মকাণ্ড বা নগরের 'সৌন্দর্য' বর্ধন, শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি ছলে করাত উঁচিয়ে প্রস্তুত থাকে কিছু লোক। ইটভাটার খোরাক জোগাতে কিংবা পাহাড় কাটতে গিয়েও নির্বিচারে বন ধ্বংস হচ্ছে। সংরক্ষিত বনাঞ্চলগুলো তো রক্ষক ও ভক্ষকদের যোগসাজশে বাইরে থেকে নিবিড় বনানী দেখা গেলেও ভেতরে ফোকলা হয়ে গেছে। এর মধ্যে মহাসড়ক ধরে গড়ে ওঠা সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির গাছগুলোই তুলনামূলক অক্ষত ছিল। এর একটি কারণ হচ্ছে, এসব বৃক্ষের টিকে থাকার সঙ্গে বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবিকার প্রশ্নটি জড়িত। তারাই দিন-রাত পাহারা দিয়ে কুড়ালের কোপ থেকে মহাসড়কের গাছগুলো টিকিয়ে রেখেছিল। আওয়ামী লীগ বা বিএনপি যে আমলেই হোক, মহাসড়কের গাছের প্রতি ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় প্রভাবশালীদের লোলুপ দৃষ্টির ছাপও বিভিন্ন সময় দেখা গেছে। দেখা গেছে, রাতের আঁধারে, এমনকি দিনের আলোতেও ঝপাঝপ কোপ দিয়ে গাছ নিয়ে উধাও তারা। ছায়াঘন সড়ক হঠাৎই ন্যাড়া, মুখব্যাদান করে পড়ে থাকে কাটা গাছের গুঁড়ি। বন বিভাগ, সড়ক ও জনপথ কিংবা স্থানীয় সরকার প্রকৌশলের ছোট ও মাঝারি কর্তাদের 'বিধিমতো ব্যবস্থা' নেওয়ার আশ্বাসই সার। না মেলে গাছের হদিস, না পায় কেউ শাস্তি। কিন্তু এবার বিরোধীদলীয় জোটের হরতাল, অবরোধ এবং স্থানীয় পর্যায়ে ডাকা হরতাল-ধর্মঘট 'সফল' করতে গিয়ে যেভাবে নির্বিচারে মহাসড়কের গাছ কাটা হয়েছে, তা অতীতে কখনও দেখা গেছে কি?
এ বিষয়ে সমকালের ১৫ ডিসেম্বরের সম্পাদকীয় থেকে উদ্ধৃতি_ "বিরোধীদলীয় জোটের গত কিছু দিনের 'কর্মসূচি' যেন হয়ে উঠেছে বৃক্ষ নিধনের মচ্ছব। দিনের আলোতে বা রাতের অন্ধকারে উন্মত্ত কিছু গোষ্ঠী বহু যত্নে লালিত চারা থেকে বৃক্ষ হয়ে ওঠা গাছগুলো কয়েক মিনিটেই কেটে রাস্তায় ফেলছে। আমরা দেখেছি, উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো যখন রাজধানীতে তাদের জমায়েত করেছিল, তখন এখানকার সড়কদ্বীপের লাবণ্যময় গাছগুলোও তাদের কঠোর করাত থেকে রেহাই পায়নি। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কারসাজিতে মহাসড়কের বৃক্ষবন ফোকলা হওয়ার অঘটন এ দেশে বিরল নয়; কিন্তু এমন কদমছাঁট কে কবে দেখেছে! সরেজমিন না দেখেও আশঙ্কা করা কঠিন নয় যে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের দীর্ঘ পরিশ্রমের ফলে সবুজ নদীর আকার ধারণ করা আমাদের মহাসড়কগুলো এখন ন্যাড়া হয়েছে। সড়কের পাশে সামাজিক বনায়ন করে বাংলাদেশ বিশ্বে যে নজির সৃষ্টি করতে পেরেছিল, তা এখন বোধহয় অতীত।"
ঠিক কত গাছ কাটা হয়েছে বিরোধীদলীয় জোটের দেশব্যাপী প্রায় টানা অবরোধ ও খুচরা হরতালের দিনগুলোতে? সড়কে-মহাসড়কে বন বিভাগ ছাড়াও সড়ক ও জনপথ বিভাগ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ, স্থানীয় সরকার, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রকল্পের গাছ রয়েছে। বলা বাহুল্য, গাছ-ঘাতকরা এসব বিচার করেনি। সামনে যা পড়েছে উন্মত্তের মতো কেটেছে। বন বিভাগের একটি হিসাবে জানা যাচ্ছে কমবেশি ১৫ হাজার। আমার ধারণা, সংখ্যাটা আরও বেশি। কতটা ব্যাপক তা গুগলের ইঞ্জিনে গিয়ে 'মহাসড়ক+অবরোধ+গাছ' লিখে সার্চ দিলেই বোঝা যায়। দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর প্রভৃতি 'বৃক্ষ বধ্যভূমি' তো আছেই; অন্তত ৩২টি জেলার নাম পাওয়া যাবে যেখানে মহাসড়কের গাছ নির্বিচারে কাটা হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর করতে গিয়ে যে চিত্র পেয়েছি, তাতে বিকট শঙ্কা ছাড়া আর কিছু জাগে না। দেখা যাচ্ছে, ৬৪টি জেলার মধ্যে মাত্র ১২টি জেলার গাছ দৃশ্যত অক্ষত থেকেছে। বাকি ৫২টি জেলার মহাসড়কজুড়ে গড়ে ওঠা বনাঞ্চল কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
খতিয়ে দেখলাম, রংপুর বিভাগের আটটি জেলাতেই_ পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী, রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধায় মহাসড়কের গাছ কাটা হয়েছে। রাজশাহী বিভাগের দশাও তথৈবচ। রাজশাহী, চাঁপাইনবানগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, বগুড়া, জয়পুরহাট, পাবনা, সিরাজগঞ্জ_ প্রত্যেকটি জেলার গাছ অবরোধকারীদের কোপানলে পড়েছে। ঢাকা বিভাগের পরিস্থিতি অপেক্ষাকৃত ভালো ছিল। মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, রাজবাড়ী এবং ঢাকা সদরের সাভার, দোহার প্রভৃতি এলকায় কিছু গাছ কাটা হয়েছে। বিস্ময়করভাবে এই বিভাগের ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর জেলায় গাছ কাটা পড়েনি। অন্তত সংবাদপত্রে খবর হওয়ার মতো মাত্রায় পেঁৗছেনি। খুলনা বিভাগেই রয়েছে চলতি অবরোধে মানুষ ও বৃক্ষ হত্যায় কুখ্যাতি পাওয়া সাতক্ষীরা অঞ্চল। তবে এর বাইরে খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, নড়াইল, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুরেও কম গাছ কাটা পড়েনি। সেদিক থেকে এই বিভাগের মাগুরা জেলার গাছগুলো সৌভাগ্যক্রমে নিরাপদে ছিল। সিলেট বিভাগেরও সব ক'টি জেলার_ সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ_ গাছপালা কুড়াল-করাতের জিঘাংসা দেখেছে। বরিশাল বিভাগে বরগুনা ছাড়া বরিশাল, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, ভোলা, পিরোজপুরের গাছগুলোতে কোপ পড়েছে। বরিশাল বিভাগে বিরোধীদলীয় জোটের কর্মসূচি অপেক্ষাকৃত দুর্বল ছিল বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু যতটুকু হয়েছে, তাতে গাছ যে ছাড় পায়নি তা স্পষ্ট। চট্টগ্রাম বিভাগের কুমিল্লা, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এমনকি বান্দরবানেও গাছ কেটে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধের ঘটনা ঘটেছে। অক্ষত ছিল রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি। তিন পার্বত্য জেলার গাছ কাটা পরিসংখ্যান থেকে পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে কর্মরত গবেষকরা এই অনুসিদ্ধান্তেও আসতে পারেন যে আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসতি পরিবেশ ও সবুজের জন্য সহায়ক। যে কারণে সমতল থেকে যাওয়া সেটেলারের সংখ্যা যেখানে বেশি সেই বান্দরবানে গাছ নিরাপদ থাকেনি।
এভাবে নির্বিচারে গাছ কেটে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের যে কিছু করতে পারেনি, তা খুব সম্ভবত ইতিমধ্যে প্রমাণ হয়েছে। কিন্তু এর হোতারা দেশের পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থার যে ক্ষতি করলেন, তা অপূরণীয়। দেখা যাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় আমাদের যখন বেশি করে গাছ লাগানোর কথা, তখন আমরা রাতারাতি শত শত গাছ কেটে ফেললাম! অনেকে আশা করতেন, পরিবর্তিত জলবায়ুর যুগে বনাঞ্চলের পরিমাণ দেখিয়ে 'কার্বন-ট্রেড' ব্যবস্থায় বাংলাদেশ সুবিধা করতে পারবে। কিন্তু গাছই যদি না থাকে, তাহলে সেই আশায় গুড়ে বালি! গাছ কাটার অঘটনগুলোর পর অনেকে যথার্থই সামাজিক বনায়নের সঙ্গে যুক্ত দেশের হাজার হাজার দরিদ্র পরিবারগুলোর জীবন-জীবিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু অবরোধের চিত্রগুলো দেখলে, সংবাদ পড়লে বোঝা যায় বিভিন্ন স্থানের করাতকল থেকেও গাছের গুঁড়ি ছিনিয়ে বা চুরি করে সড়কে ফেলা হয়েছে, আগুন লাগানো হয়েছে। আহা কতজনের পুঁজি এভাবে অবরোধের উন্মাদনায় ফৌত হয়ে গেছে! নির্মম পরিহাস হচ্ছে, হাজার হাজার গাছ কেটে শেষ রক্ষা তো হয়ইনি_ বিরোধীদলীয় জোটকে ভবিষ্যতে যদি আবার অবরোধে নামতে হয়, 'প্রয়োজনীয়' গাছও আর পাবে না!
নির্মমতা ও নির্বুদ্ধিতার খতিয়ান দেখতে দেখতে প্রশ্ন জেগেছিল_ আর কিছু না হোক, মানুষের শ্বাস নেওয়ার প্রয়োজনেও যে গাছ প্রয়োজন, করাতধারী মূর্খরা তা কি জানে? এরা কি জানে যে মানুষের জীবনধারণের প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহের সঙ্গে গাছের রয়েছে সরাসরি সম্পর্ক। আমরা যে কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন করি, তা গাছ শোষণ করে অক্সিজেন ছাড়ে_ প্রাথমিক পর্যায়ের এই তথ্যটুকু কি তাদের কাছে আছে? এরা কি জানে যে গাছে নয়, তারা আসলে নিজ নিজ শ্বাসনালিতে করাত চালাচ্ছে?
আচ্ছা, গাছের অনুভূতি আবিষ্কারকারী বিশ্ববরেণ্য বঙ্গসন্তান জগদীশচন্দ্র বসুর নামও কি এরা জানে? অবশ্য যারা সাধারণ নাগরিকের বিড়ম্বনা বিবেচনা না করে দিনের পর দিন ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে; যারা যাত্রীবাহী বাস, লেগুনা এমনকি অটোরিকশার নারী-শিশুর আর্তি উপেক্ষা করে পেট্রোল বোমা মারছে বা অগি্নসংযোগ করছে; তাদের কাছে গাছের প্রাণ-অনুভূতির মূল্য কী? যারা অন্ধ ও সংকীর্ণ গোষ্ঠীস্বার্থে মত্ত, তাদের কাছে পরিবেশ-প্রতিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ, সবুজের প্রয়োজনীয়তার কথা আক্ষরিক অর্থেই অরণ্য রোদন ছাড়া কী? আমরা কেবল বলতে পারি_ এদের জ্ঞান দাও প্রভু, এদের ক্ষমা কর!
শেখ রোকন : গবেষক ও সাংবাদিক
skrokon@gmail.com
No comments