আয়না-পড়া by ময়ুখ চৌধুরী
১. সামনে
দাঁড়াতেই আয়নাটা হাঁটতে আরম্ভ করলো। ভয়ে পিছুতে গিয়ে ঠোক্কর খেল খাটে।
ওখানেই বসে পড়লো নির্মল আচার্য। না, নেশা করেনি। করলেও বা কতো দিন নেশা করে
ফিরেছে; কিন্তু এই অদ্ভুত ঘটনা আজই প্রথম।
বেশ কয়েকদিন ধরে চাই-পি-এসটা কাজ করছে না। অফিস ছুটির পর ডিলারের দোকানে গিয়েছিল। ওখানে রতনের দেখা। দেখেই বোঝা যায় বেশ ফুর্তিতে আছে। কিন্তু রতন তো এমনটা ছিল না! রাশভারি না হলেও, কখনো তার মধ্যে আবেগ-উচ্ছ্বাস দেখা যায়নি। নির্মল যেন এই প্রথম অন্য এক রতনকে দেখছে। রতনও তা বুঝতে পারছে।
_'নে।' সিগারেট বাড়িয়ে দিল নির্মলের দিকে। _'ডিউটি ফ্রি। মামির কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছি।'
_'তোকে বেশ খুশি খুশি লাগছে।'
মাথা দোলাতে দোলাতে লম্বা একটা টান লাগালো রতন। _'আহ্, স্বাধীনতা সত্যিই কী আনন্দের।' এরপর ফুকফুক করে কয়েকটা টান, মাথা দোলানো চালিয়ে যাচ্ছে। নির্মল তাকিয়েই আছে। রতন খপ করে তার কব্জি চেপে ধরে বললো_
'বুঝলি, খেদিটা বিদায় হয়েছে।'
_'মানে'!
_'মানে আবার কী, যার বেসুরো গান শুনেও তোরা তালি দিতি_ জুলি, জুলি। জুরি না ঠুলি, মাথামুণ্ডু। আপদ গেছে।'
_'বলিস কী, ভালোবেসেই তো বিয়ে করেছি ছিল!'
_'রাখ বিয়ে ভালোবাসা।_ সে তো একবার। রোজকার প্যান প্যান ঘ্যান ঘ্যান কে সহ্য করবে!'
অথচ এই রতনই সব সময় আগলে রাখতো বউকে। টেবিলে ট্রে নামিয়ে রাখতে গেলে উপুড় হতে হয় বলে বউয়ের হাত থেকে ট্রে নিয়ে নিত।
_'তারপর, তোর কেমন চলছে? বউবাচ্চা ভালো?'
_'ভালো।' সংক্ষেপেই উত্তর দিল_ ডিটেলসে গেল না। আটদিন হয়েছে। বাপের বাড়িতে গেছে শান্তা। বিকেলে অফিস থেকে ফোন করেছিল, ধরেছে তিনি্ন।
_নির্মলের মেয়ে।
_'মা কোথায়?'
_'ড্রইংরুমে। গানের মাস্টার বেড়াতে এসেছে।' কী ভেবে ফোনটা রেখে দিয়েছে নির্মল।
রতনের সঙ্গে হোটেলে খেয়ে নিল নির্মল। একই খাবার, দু'রকমের বাধ্যবাধকতা। রতন যেটাকে স্বাধীনতার আনন্দ বলেছে, সেটা কি সত্যি তার ভেতরের কথা? নির্মল ভাবছে আর হাঁটছে। ঢাকায় বাসের আগে হেঁটে যাওয়া যায়। সাড়ে দশটাও হয়নি। এখন সে বাসায়। সারাপথেই সে ব্যস্ত ছিল রতন, রতনের বউ, গানের মাস্টার, শান্তা_ এইসব নিয়ে।
কিন্তু আয়নার অদ্ভুত আচরণের পর, হতভম্ব হয়ে বসে আছে খাটের ওপর। এমন সময় কারেন্ট চলে গেল। মোবাইল অন করে মোমবাতি বের করলো নির্মল। পায়ে পায়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই আয়নাটা আবার সরে যেতে লাগলো।
_'আরে যাচ্ছ কোথায়, দাঁড়াবে তো!'
_'কেন দাঁড়াবো?'
_'এ কী! তুমি কথা বলতে পারো!'
_'পারি তোমরা শুনতে পাও না। প্রাচীনকালে আমাদের পূর্বপুরুষরা আয়না-সুন্দরীকে দেখাতে পারতো। এখন আমরা আরও অনেক কিছু পারি।... আমাকে যেতে দাও, এখানে ভালো লাগছে না।'
_'দাঁড়াও। সকালে দাড়ি কামাতে গিয়ে কোন জায়গাটা কেটেছিল,_ দেখি।' কাটা দাগ দেখতে গিয়ে নির্মল নিজেকেও দেখলো না। আয়না দেখতে গিয়ে আয়নাকেই দেখছে। বেশ কিছুক্ষণ।
_'কী দেখলে? ... কিছুই দ্যাখেনি।' আয়না আবার কথা বলতে লাগলো_ 'এতদিন আমার সামনে দাঁড়িয়ে যাকে দেখতে চেয়েছ, সে তুমি নও। তুমি দেখেছো তোমার প্রচ্ছদ, তোমার খোলস, তোমার মুখোশ মাত্র। তুমি পারফিউম মাখো_ তোমার প্রচ্ছদে, তুমি সাবান মাখো_ তোমার খোলসে, তুমি ক্রিম মাখো_ তোমার মুখেশ দাড়ি কাটতে গিয়ে সামান্য আঁচড় লেগেছে_ তাও মুখোশে।'
_'চুপ করো। চুপ করো। এই_ এই আমি, এই রকম। হুবহু ফেসবুকের মতো। আইডি কার্ডও আছে।' নির্মলের কথাগুলো নিজের কাছেই প্রলাপের মতো লাগছে। ঘোরের মধ্যেই সে শুনতে পাচ্ছে_ আয়না বলছে_ 'তুমি আসলে এই রকম নও, অন্য রকম। নর্দমার থিকথিকে কালো দইয়ের মতো, যার ওপর দিয়ে সাবানের ফেনা গড়িয়ে যায় দাঁড়ায় না; তলায় নানা রকম পোকা।'
নির্মল ক্ষেপে যাচ্ছে_ 'দ্যাখো, আর একটা কথা বললে, তোমাকে এক্ষুনি টুকরো টুকরো করে ফেলবো।'
_'কতো টুকরো করবে শুনি? আমরা প্রত্যেকটা টুকরোতে তুমি ধরা আছো।... ফুলদানিটা ওখানেই রেখে দাও।'
_'তুমি যাও, যাও। আমি দেখতে চাই না তোমাকে।'
_'কিন্তু, আমি তো চোখ সরাতে পারবো না,_সরে যাবো। দৃশ্য আমার খাদ্য।'
২.
নির্মল শেলফের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে আছে। বইগুলোও তেমনি, খুব ভোরে চলন্ত ট্রেনের জানলা দিয়ে যে-রকমটা দেখা। বলতে গেলে পড়াই হয় না। এক সময় পড়তো, হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াতো বই। স্কুল জীবনের কিরীটি রায়ের খুব ভক্ত ছিল। মনে আছে, নীহাররঞ্জনের 'চক্র' নামে একটা বই কিনেছিল ফুটপাত থেকে। অনেকদূর পড়া হয়ে গেছে, কৃষ্ণা-সুব্রত দূরে থাক, খোদ কিরীটি রায়েরই দেখা নেই! চক্রের সমাধান মিলল একদিন বাদে, পাড়াতো দাদা সুধাকান্তের কাছ থেকে। বইটা নীহাররঞ্জনের 'চক্র' নয়, _সুবোধ ঘোষের 'বাসবদত্তা'। বাজারে যাচ্ছিল না বলে, বাঁধাই না করা বইগুলোর ওপরে নীহাররঞ্জনের লেবেল মুড়ে দেওয়া হয়েছে। সুধাকান্তদা বইটা ফেরত দিয়ে বললো_ 'দু'নম্বরী কিনতে গিয়ে এক নম্বরী কিনে ফেলেছ।'
এতো বছর পরে পুরনো একটা প্রশ্ন মোচড় দিয়ে উঠলো_ এক নম্বরী জিনিস চালাতে গিয়ে দু'নম্বরী মলাট কেন লাগাতে হয়েছে?
৩.
_'কী ভাবছো?' আয়না আবার কথা বলে উঠলো।
নির্মলের রাগ তখনও পড়েনি। গোঁ গোঁ করে বললো_ 'ফুলদানি কিন্তু বেশি দূরে নয়।'
_'শোনো জেন্টেলম্যান, বেশি মেজাজ দেখিও না। আমি সব দেখেছি। সব দৃশ্য জমা আছে ভেতরে_ সব। আমি তোমার ল্যাপটপ নই যে, রিসাইকেল বিন থেকে ওগুলো গায়ের করে দেবে।'
নির্মল ঘামতে শুরু করেছে। অল্প অল্প হাঁপাচ্ছে।
_'সারাদিন অফিসে মুনুমুনু পুষুপুষু। রাত হলে জন্তুর মতো হামাগুড়ি দিয়ে বউয়ের ওপার হামলে পড়ো। একঘেয়ে দৃশ্যগুলো সব জমা আছে। জানো, মাঝে মধ্যে না আমার বমি বমি লাগে। নাড়িভুড়ি মোচড় দেয়। মনে হয় সব উগড়ে আসবে। নীল বমি দেখে, তোমার ছেলেমেয়েরা তাদের বাবাকে চিনতে পারবে না। ভাববে_ অপরিচিত একটা জন্তু তাদের মায়ের ওপর হামলে পড়েছে। ওরা চিৎকার করে উঠবে_ বাবা, বাবা, মাকে বাঁচাও_ রাক্ষসটা খেয়ে ফেলবে মাকে। আপাতত রাক্ষসটাকে আমি লুকিয়ে রেখেছি। আমি ভেঙে গেলে ওটাকে বের করে দেবো।'
_ 'না, তুমি তা করতে পারো না।' নির্মল ভয় পেয়ে গেছে_ 'আমি তোমাকে বাসায় এনেছি। তোমাকে ঝকঝকে তকতকে করে রাখা হয় ...।'
_ 'ধুলো জমলেই ভালো ছিল; ঝাপসা দেখতাম। এই যে তুমি, ঘরে তুমি ছাড়া যখন কেউ থাকে না, ন্যাংটো হয়ে এ ঘরে ও ঘরে হাঁটাহাঁটি করো, আমার সামনে দাঁড়িয়ে আদিমকালের মানুষ সাজো, গুহা খোঁজ_ কয়েকরকম গুহা গেলবার বউবাচ্চা যখন ছিল না_ তুমি একা; তখন দরজা খুলে কাকে ঘরে ঢুকিয়েছিলে_ যার নাম পর্যন্ত জানো না! তোমার বউয়ের সামনে ওই দৃশ্যটা যদি বমি করে দিই!'
নির্মল একটা চিৎকার দিয়েছিল, তারপর আর কিছু মনে নেই। সকালে দেখলো আয়নার একটা কেন্দ্র থেকে কয়েকা ফাটল নানা দিকে চলে যাচ্ছে। যে কোনো মুহূর্তে খসে পড়তে পারে। সেখানে সেঁটে আছে একাধিক নির্মল আচার্য। ভাঙা ভাঙা নির্মল আচার্য। অথচ, ছোটবেলায় সেলুনের মুখোমুখি আয়নায় অনেকগুলো নির্মল ছিল, কিন্তু এ রকম ছিল না।
৪.
পাউরুটি খেলে বমি বমি লাগে। অফিসের বেসিনে একবার চেষ্টাও করেছে, কিন্তু হয়নি। ডিমের সাদা তুলতুলে মাংস_ মানে তৃতীয় মুখোশ_ থিকথিকে কালো দইয়ের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে আছে। থাক। ওসব বেরিয়ে না আসাই ভালো। বারবার আয়নার কথা মনে পড়ছে। অফিসের কাজে মন বসাতে পারছে না। আয়নায় ফাটল দিয়েছে, জন্তুটা বেরিয়ে আসতে পারে। কিন্তু আয়নাটা ফাটলো কী করে, নির্মল এখনও বুঝে উঠতে পারছে না।
এরই মধ্যে, অন্যমনস্কভাবে, একটা ইনভাইটেশন কার্ডের উল্টো পিঠে অনেকগুলো মুখ এঁকে ফেলেছে। লাইন অ্যান্ড সেড নিয়ে খেললো কিছুক্ষণ। বাথরুম হয়ে এসে আবার যখন দেখল, ততক্ষণে সব মুখোশ হেয় গেছে। ঠিক আফ্রিকার আদিম নৃ-গোষ্ঠীর মুখোশের মতো।
ঠিক তাও হয়নি। আদিমকালের মুখোশে এক ধরনের খাঁটিত্ব ছিল, গোষ্ঠীগত ঐক্য ছিল, তাৎপর্যবাহী বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল। সবচেয়ে বড় কথা_ সরল অভিপ্রায় ছিল। তাদের ভেতরে যে বিশ্বাস ছিল, সেই বিশ্বাসকে ফুটিয়ে তোলার জন্যেই তারা মুখোশ পরত। অথচ, ধুলো থেকে চোখকে বাঁচাবার জন্যে আমরা যে সানগ্গ্নাস পরি, সেটা অন্যের চোখে ধুলো দেওয়ার কাজেই বেশি আসে। একটা মুখের ওপর একই সঙ্গে অনেক চেহারা আমরা সাজিয়ে রাখতে পারি।
নির্মাল আচার্যও পেরেছে। সিঁড়ি ডিঙানোর ইতিহাসটুকু কার্পেট দিয়ে ঢেকে রাখতে। তা না হলে কি আর এতো অল্প সময়ের মধ্যে এতো বড় অ্যাড-ফার্মের চিফ ডিজাইনার! বড় হতে গিয়ে পদে পদে ছোটমনের কতো পরিচয় সে পেছনে ফেলে এসেছে! শুধু, বড় সাহেবের শ্যালকের সঙ্গে কৃত্রিম ঘনিষ্ঠতার রশিটুকু কিছুতেই খুলতে পারছে না। নির্মলের সব দুর্বলতা তার জানা। এই জন্যেই, তার মেয়েকে বিশ্রীভাবে আদর করার পরও এমন ভাব করেছে, যেন দ্যাখেনি।
৫.
ফাইল হাতে ঢুকলো টুম্পা_ নির্মলের জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট। বসের কথামতো টেবিলের কোণা ঘেঁষে দাঁড়াবে। নির্মলের হাতের মুঠো অভ্যাসবশত চলে যাবে ঐ স্পর্শকাতর জায়গায়। টুম্পা টেবিলে উপুড় হয়ে ফাইল খুলবে। বালুচরের মতো উপচে উঠবে অনাবৃত অংশ,_ চোখ দিয়ে চেটে খাওয়ার জন্যে। কেউ ঢোকা মাত্র আঁচলে ঢাকা পড়বে প্রাত্যহিক উপচার। অনাবশ্যকভাবে টুম্পার মুখে ধ্বনিত হবে_ 'আঙ্কেল'।
'আঙ্কেল' হয়েও নির্মল ছুটির পরে আটকে রাখে টুম্পাকে। সুযোগ বুঝে বড় সাহেবের রুমে পাঠায়। মেয়েটাও বুঝে না বোঝার ভান করে। যে মেয়ে মামুলি একটা চাকরির জন্যে বাবার বন্ধুর সঙ্গে বান্দরবানে রাত কাটাতে পারে, তার জন্যে বড় সাহেবের রুম তো দার্জিলিং, আর সে নিজে কাঞ্চনজঙ্ঘা।
বড় সাহেবের টেবিলের ওপর ফ্রেমেবন্দি সুখী পরিবার। ঘরের সেই পাগলা আয়নাটা বলেছিল_ 'ব্যস, নির্মল আচার্য, তোমার দৌড় এই পর্যন্ত। তুমি দ্যাখোনি, পেছনের লাগোয়া রেস্টরুমে প্রমাণ সাইজের আয়না_ আমার আত্মীয়। তার মুখে শুনেছি বুড়োর অক্ষম আগ্রাসনের কথা। বুড়োর ব্যর্থতায় মেয়েটার করুণা জাগে। বেচারা। 'ব্যস্ততা'র অজুহাতে স্ত্রী না ঘুমানো পর্যন্ত বাড়িতে ফেরে না। তোমাদের মুখ ও মুখোশের খেলা এভাবেই চলে আসছে, চলবে।
৬.
তোমার একার দোষ দিয়ে লাভ কী! এই ধরো, তুমি যখন ছোট, খুব ছোট, কাঁথার পর কাঁথা মুতে ভাসিয়ে দিচ্ছ, তখন সারাদেশ ভেসে যাচ্ছিল বন্যায়।_ তোমার জানার কথা নয়। প্রলয়ঙ্করী বন্যা বলতে যা বোঝায়, ঐ মাপের সতেরটা বন্যা হয়েছিল এ দেশে। পর পর তিন বছরে তিনটা বন্যা হলো_ ৫৪.৫৫.৫৬-তে। মজলুম জননেতা ভাসানী কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পঞ্চাশ কোটি টাকা সাহায্য দানের দাবিতে অনশন শুরু করেছিলেন।
মজার ব্যাপার কী জানো? ঠিক ঐ সময়ে বাঙালি মধ্যবিত্তের বিনোদনের জন্য কলকাতা-বোম্বাই-মাদ্রাজ-লাহোরের দেখাদেখি ঢাকাতেও সিনেমা-বানানোর পুঁজি নিশপিশ করছিল। ৫৪-এর বন্যাবর্ষে (৬ আগস্ট) ছবির শুভমহরত অনুষ্ঠান হলো। মুক্তি পেল ৩ আগস্ট ১৯৫৬_ তাও বন্যাবর্ষ। সিনেমার নাম 'মুখ ও মুখোশ'। কাকতালীয় ব্যাপার_ তাই না?
আমাদের সারা দেহজুড়ে চোখ, আমরা দেখেছি_ ঐ বছরটা শুধু বন্যার বছর নয়, দুর্ভিক্ষেরও বটে। দেশে যখন দুর্ভিক্ষ চলছে, তখন ঢাকা-চট্টগ্রাম-নারায়ণগঞ্জে 'একযোগে চলিতেছে' 'মুখ ও মুখোশ'! একদিকে মানুষ মরছে, অন্যদিকে সিনেমা হলে হাততালি।
তোমাদের বিনোদনশিল্প আর পুঁজির বিকাশ এভাবেই শুরু হয়েছিল। এটাই ঐতিহাসিক সত্য। এ রকম এক বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়ে আজ তুমি, তোমাদের সভ্যতা, তোমাদের সংস্কৃতি, তোমাদের অন্তর্জগৎ।
তোমরা সভ্যতার জনক, সেহেতু বাস্তবতারও জনক। তোমরা অনেক কিছু বানাতে পরো, বিক্রি করতে পারো। তোমরা সত্যকেও বিক্রি করতে পারো, কিনতে পারো। তোমাদের যা যা আছে সবই পণ্য, যা কিছু নেই তাও।
এই যে, বিজ্ঞাপনের জন্যে যখন মডেল খোঁজ, তখন কী কী দ্যাখো? কার শরীরের কোন কোন অংশে চুম্বক আছে_ সেগুলোই তো? ভিন্ন চাকরির জন্যে ইন্টারভিউ দিতে আসা বন্ধুর মেয়েটি যখন তোমাকে পায়ে ছুঁয়ে প্রণাম করছিল, তোমার পঁয়তালি্লশ ডিগ্রি দৃষ্টিভঙ্গির গন্তব্য কী ছিল? শুনতে হয়তো তোমার খারাপ লাগছে, কিন্তু করার বেলার তোমাদের খারাপ লাগে না।
সত্যিই তোমরা সভ্য। কী সুন্দরভাবে পোশাক-আসাকের গুহায় নিজেদের পশুত্বকে লুকিয়ে রাখতে পেরেছ!
তুমিই বা কী করতে পারো। চাকরি করতে হয়, গোলামি করতে হয়, চোখকান বন্ধ রাখতে হয়। আরও যা যা আছে। এস্টাবলিস্টমেন্টের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার সাহস তোমার নেই। যে গাছের ডালে চড়ে বসেছ, তার গোড়ায় করাত চালাবার মতো বোকা তুমি নও। তাই, সমাজের মধ্যে থেকেও ঘুণপোকার মতো কাজ করে যাচ্ছ তুমি। সমাজের দোহাই পেড়ে বাদবাকি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বড় করে তুলেছ। এইসব ধাপ্পাবাজি তোমরা ঠিকই বোঝ। তোমাদের ভয়_ কর্পোরেট সিস্টেম থেকে ছিটকে পড়া মানেই উল্কার ছাই।
অথচ দ্যাখো, একটা সময় ছিল যখন সমাজের পাল্লা ছিল ভারী। নিত্যনতুন প্রতিষ্ঠান এসে সমাজকে গিলে ফেলেছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই কমবেশি সমাজের মুখোশ মাত্র। এমনকি রাষ্ট্রও। সমাজের মুখ কিন্তু অন্য রকম। তোমাদের মতো মাল ডেলিভারি দেওয়া আর্টিস্টের পক্ষে তা আঁকা সম্ভব নয়।
৮.
বড় সাহেব নেই, টুম্পা নেই, কাজও তেমন নেই। অফিস পাহারা দেওয়ার কোনো মানে হয় না। ঝোলাটা কাঁধে নিয়ে আস্তে আস্তে রাস্তায় নেমে পড়লো নির্মল আচার্য। উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটছে, আর এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে। নানা রকম বিলবোর্ড। দেশপ্রেমিকের পোস্টারের পাশেই এক হাজার গুণ বড় বিদেশী নায়িকা। তাকে উন্মোচিত করলেই গোলাপি রঙের পেলব সাবান। সাবানও মুখোশ পরে! কেউ বলে মোড়ক।
পান্থপথে ভালোই জ্যাম। উঁকি দেওয়ার জন্যে জানলা খুলতেই দৌড়ে গেল ফুলওয়ালি। অমনি কাচটা বন্ধ হয়ে গেল। গাড়িতে বসা ভদ্রমহিলা হয়তো নারী উন্নয়ন সংস্থার কিছু একটা হবেন। পেছনের গাড়ির জানলার কাচ নেমে গেল। টাকমাথাওয়ালা ভদ্রলোক প্রয়োজনের বেশি কথা বললেন এবং প্রয়োজনহীনভাবে দুটো মালা মেয়েটার কাছ থেকে কিনলেন। কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে একটা বাস মস্তানের মতো বেলাইনে ঢুকে পড়লো। মুখোশপরা ট্রাফিক পুলিশ ওটাকেই আগে ছাড় দিল। জনগণের সেবায় নিবেদিতপ্রাণ নেতার গাড়ি ক্রস করে যাবার পর, জ্যাম ছুটলো। রিকশা থেকে হাত নাড়লো ছাত্রনেতা হাসিল, পাশে ম্যাডাম।
বাঁ দিকে মোড় কাটলেই পার্লার। ওখান থেকে বেরিয়ে আসছে ডিসটেম্পার করা কয়েকটা মুখ। আর একটু সামনে অন্ধ লাইটপোস্ট। তিন চারজন মহিলা। দু'জনের মুখে নেকাব। একজনের হাতে ধরা একটা বাচ্চা। গৃহিণী গৃহিণী ভাব ফুটিয়ে তোলার উপকরণ।
মুখোশের পর মুখোশ দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে নির্মল। অথচ বাসাতেও ফিরতে ইচ্ছে করছে না। ভয়ে। পাগলা আয়না আবার না কী শুরু করে। বাসায় ফিরে সম্পূর্ণ ন্যাংটো হয়ে সে জামাকাপড় পাল্টাবে। কিন্তু ড্রইংরুমে।
বাসায় ফিরে সে রীতিমতো তাজ্জব। আয়নার ফাটল-টাটল সব গায়েব। দুই হাতে হালকা একটা ঝাঁকুনি দিল। _ 'কী? এবার কোন মতলব এঁটেছ?' কোনো জবাব না পেয়ে নির্মলের সাহস বেড়ে গেল। কর্কশকণ্ঠে বললো_ 'মজা আমিও দেখাতে পারি। কালকেই বিক্রি করে দেব তোকে। বউ জিগ্যেস করলে বলবো ফেটে গেছে। তারপর যা হবার হবে। দৃশ্যগুলো দিয়ে বায়োস্কোপ বানা, এক্সিবিশন কর, জাহান্নামে যা।'
আয়না নিশ্চুপ। নির্মল উঠে গিয়ে, পা দিয়ে আয়নার বুকে ঠেলা মারলো। সাড়া নেই। সম্ভবত মরে গেছে। মরে গেলেই ভালো। নির্মলের বেঁচে থাকতে অসুবিধা হবে না।
বেশ কয়েকদিন ধরে চাই-পি-এসটা কাজ করছে না। অফিস ছুটির পর ডিলারের দোকানে গিয়েছিল। ওখানে রতনের দেখা। দেখেই বোঝা যায় বেশ ফুর্তিতে আছে। কিন্তু রতন তো এমনটা ছিল না! রাশভারি না হলেও, কখনো তার মধ্যে আবেগ-উচ্ছ্বাস দেখা যায়নি। নির্মল যেন এই প্রথম অন্য এক রতনকে দেখছে। রতনও তা বুঝতে পারছে।
_'নে।' সিগারেট বাড়িয়ে দিল নির্মলের দিকে। _'ডিউটি ফ্রি। মামির কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছি।'
_'তোকে বেশ খুশি খুশি লাগছে।'
মাথা দোলাতে দোলাতে লম্বা একটা টান লাগালো রতন। _'আহ্, স্বাধীনতা সত্যিই কী আনন্দের।' এরপর ফুকফুক করে কয়েকটা টান, মাথা দোলানো চালিয়ে যাচ্ছে। নির্মল তাকিয়েই আছে। রতন খপ করে তার কব্জি চেপে ধরে বললো_
'বুঝলি, খেদিটা বিদায় হয়েছে।'
_'মানে'!
_'মানে আবার কী, যার বেসুরো গান শুনেও তোরা তালি দিতি_ জুলি, জুলি। জুরি না ঠুলি, মাথামুণ্ডু। আপদ গেছে।'
_'বলিস কী, ভালোবেসেই তো বিয়ে করেছি ছিল!'
_'রাখ বিয়ে ভালোবাসা।_ সে তো একবার। রোজকার প্যান প্যান ঘ্যান ঘ্যান কে সহ্য করবে!'
অথচ এই রতনই সব সময় আগলে রাখতো বউকে। টেবিলে ট্রে নামিয়ে রাখতে গেলে উপুড় হতে হয় বলে বউয়ের হাত থেকে ট্রে নিয়ে নিত।
_'তারপর, তোর কেমন চলছে? বউবাচ্চা ভালো?'
_'ভালো।' সংক্ষেপেই উত্তর দিল_ ডিটেলসে গেল না। আটদিন হয়েছে। বাপের বাড়িতে গেছে শান্তা। বিকেলে অফিস থেকে ফোন করেছিল, ধরেছে তিনি্ন।
_নির্মলের মেয়ে।
_'মা কোথায়?'
_'ড্রইংরুমে। গানের মাস্টার বেড়াতে এসেছে।' কী ভেবে ফোনটা রেখে দিয়েছে নির্মল।
রতনের সঙ্গে হোটেলে খেয়ে নিল নির্মল। একই খাবার, দু'রকমের বাধ্যবাধকতা। রতন যেটাকে স্বাধীনতার আনন্দ বলেছে, সেটা কি সত্যি তার ভেতরের কথা? নির্মল ভাবছে আর হাঁটছে। ঢাকায় বাসের আগে হেঁটে যাওয়া যায়। সাড়ে দশটাও হয়নি। এখন সে বাসায়। সারাপথেই সে ব্যস্ত ছিল রতন, রতনের বউ, গানের মাস্টার, শান্তা_ এইসব নিয়ে।
কিন্তু আয়নার অদ্ভুত আচরণের পর, হতভম্ব হয়ে বসে আছে খাটের ওপর। এমন সময় কারেন্ট চলে গেল। মোবাইল অন করে মোমবাতি বের করলো নির্মল। পায়ে পায়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই আয়নাটা আবার সরে যেতে লাগলো।
_'আরে যাচ্ছ কোথায়, দাঁড়াবে তো!'
_'কেন দাঁড়াবো?'
_'এ কী! তুমি কথা বলতে পারো!'
_'পারি তোমরা শুনতে পাও না। প্রাচীনকালে আমাদের পূর্বপুরুষরা আয়না-সুন্দরীকে দেখাতে পারতো। এখন আমরা আরও অনেক কিছু পারি।... আমাকে যেতে দাও, এখানে ভালো লাগছে না।'
_'দাঁড়াও। সকালে দাড়ি কামাতে গিয়ে কোন জায়গাটা কেটেছিল,_ দেখি।' কাটা দাগ দেখতে গিয়ে নির্মল নিজেকেও দেখলো না। আয়না দেখতে গিয়ে আয়নাকেই দেখছে। বেশ কিছুক্ষণ।
_'কী দেখলে? ... কিছুই দ্যাখেনি।' আয়না আবার কথা বলতে লাগলো_ 'এতদিন আমার সামনে দাঁড়িয়ে যাকে দেখতে চেয়েছ, সে তুমি নও। তুমি দেখেছো তোমার প্রচ্ছদ, তোমার খোলস, তোমার মুখোশ মাত্র। তুমি পারফিউম মাখো_ তোমার প্রচ্ছদে, তুমি সাবান মাখো_ তোমার খোলসে, তুমি ক্রিম মাখো_ তোমার মুখেশ দাড়ি কাটতে গিয়ে সামান্য আঁচড় লেগেছে_ তাও মুখোশে।'
_'চুপ করো। চুপ করো। এই_ এই আমি, এই রকম। হুবহু ফেসবুকের মতো। আইডি কার্ডও আছে।' নির্মলের কথাগুলো নিজের কাছেই প্রলাপের মতো লাগছে। ঘোরের মধ্যেই সে শুনতে পাচ্ছে_ আয়না বলছে_ 'তুমি আসলে এই রকম নও, অন্য রকম। নর্দমার থিকথিকে কালো দইয়ের মতো, যার ওপর দিয়ে সাবানের ফেনা গড়িয়ে যায় দাঁড়ায় না; তলায় নানা রকম পোকা।'
নির্মল ক্ষেপে যাচ্ছে_ 'দ্যাখো, আর একটা কথা বললে, তোমাকে এক্ষুনি টুকরো টুকরো করে ফেলবো।'
_'কতো টুকরো করবে শুনি? আমরা প্রত্যেকটা টুকরোতে তুমি ধরা আছো।... ফুলদানিটা ওখানেই রেখে দাও।'
_'তুমি যাও, যাও। আমি দেখতে চাই না তোমাকে।'
_'কিন্তু, আমি তো চোখ সরাতে পারবো না,_সরে যাবো। দৃশ্য আমার খাদ্য।'
২.
নির্মল শেলফের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে আছে। বইগুলোও তেমনি, খুব ভোরে চলন্ত ট্রেনের জানলা দিয়ে যে-রকমটা দেখা। বলতে গেলে পড়াই হয় না। এক সময় পড়তো, হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াতো বই। স্কুল জীবনের কিরীটি রায়ের খুব ভক্ত ছিল। মনে আছে, নীহাররঞ্জনের 'চক্র' নামে একটা বই কিনেছিল ফুটপাত থেকে। অনেকদূর পড়া হয়ে গেছে, কৃষ্ণা-সুব্রত দূরে থাক, খোদ কিরীটি রায়েরই দেখা নেই! চক্রের সমাধান মিলল একদিন বাদে, পাড়াতো দাদা সুধাকান্তের কাছ থেকে। বইটা নীহাররঞ্জনের 'চক্র' নয়, _সুবোধ ঘোষের 'বাসবদত্তা'। বাজারে যাচ্ছিল না বলে, বাঁধাই না করা বইগুলোর ওপরে নীহাররঞ্জনের লেবেল মুড়ে দেওয়া হয়েছে। সুধাকান্তদা বইটা ফেরত দিয়ে বললো_ 'দু'নম্বরী কিনতে গিয়ে এক নম্বরী কিনে ফেলেছ।'
এতো বছর পরে পুরনো একটা প্রশ্ন মোচড় দিয়ে উঠলো_ এক নম্বরী জিনিস চালাতে গিয়ে দু'নম্বরী মলাট কেন লাগাতে হয়েছে?
৩.
_'কী ভাবছো?' আয়না আবার কথা বলে উঠলো।
নির্মলের রাগ তখনও পড়েনি। গোঁ গোঁ করে বললো_ 'ফুলদানি কিন্তু বেশি দূরে নয়।'
_'শোনো জেন্টেলম্যান, বেশি মেজাজ দেখিও না। আমি সব দেখেছি। সব দৃশ্য জমা আছে ভেতরে_ সব। আমি তোমার ল্যাপটপ নই যে, রিসাইকেল বিন থেকে ওগুলো গায়ের করে দেবে।'
নির্মল ঘামতে শুরু করেছে। অল্প অল্প হাঁপাচ্ছে।
_'সারাদিন অফিসে মুনুমুনু পুষুপুষু। রাত হলে জন্তুর মতো হামাগুড়ি দিয়ে বউয়ের ওপার হামলে পড়ো। একঘেয়ে দৃশ্যগুলো সব জমা আছে। জানো, মাঝে মধ্যে না আমার বমি বমি লাগে। নাড়িভুড়ি মোচড় দেয়। মনে হয় সব উগড়ে আসবে। নীল বমি দেখে, তোমার ছেলেমেয়েরা তাদের বাবাকে চিনতে পারবে না। ভাববে_ অপরিচিত একটা জন্তু তাদের মায়ের ওপর হামলে পড়েছে। ওরা চিৎকার করে উঠবে_ বাবা, বাবা, মাকে বাঁচাও_ রাক্ষসটা খেয়ে ফেলবে মাকে। আপাতত রাক্ষসটাকে আমি লুকিয়ে রেখেছি। আমি ভেঙে গেলে ওটাকে বের করে দেবো।'
_ 'না, তুমি তা করতে পারো না।' নির্মল ভয় পেয়ে গেছে_ 'আমি তোমাকে বাসায় এনেছি। তোমাকে ঝকঝকে তকতকে করে রাখা হয় ...।'
_ 'ধুলো জমলেই ভালো ছিল; ঝাপসা দেখতাম। এই যে তুমি, ঘরে তুমি ছাড়া যখন কেউ থাকে না, ন্যাংটো হয়ে এ ঘরে ও ঘরে হাঁটাহাঁটি করো, আমার সামনে দাঁড়িয়ে আদিমকালের মানুষ সাজো, গুহা খোঁজ_ কয়েকরকম গুহা গেলবার বউবাচ্চা যখন ছিল না_ তুমি একা; তখন দরজা খুলে কাকে ঘরে ঢুকিয়েছিলে_ যার নাম পর্যন্ত জানো না! তোমার বউয়ের সামনে ওই দৃশ্যটা যদি বমি করে দিই!'
নির্মল একটা চিৎকার দিয়েছিল, তারপর আর কিছু মনে নেই। সকালে দেখলো আয়নার একটা কেন্দ্র থেকে কয়েকা ফাটল নানা দিকে চলে যাচ্ছে। যে কোনো মুহূর্তে খসে পড়তে পারে। সেখানে সেঁটে আছে একাধিক নির্মল আচার্য। ভাঙা ভাঙা নির্মল আচার্য। অথচ, ছোটবেলায় সেলুনের মুখোমুখি আয়নায় অনেকগুলো নির্মল ছিল, কিন্তু এ রকম ছিল না।
৪.
পাউরুটি খেলে বমি বমি লাগে। অফিসের বেসিনে একবার চেষ্টাও করেছে, কিন্তু হয়নি। ডিমের সাদা তুলতুলে মাংস_ মানে তৃতীয় মুখোশ_ থিকথিকে কালো দইয়ের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে আছে। থাক। ওসব বেরিয়ে না আসাই ভালো। বারবার আয়নার কথা মনে পড়ছে। অফিসের কাজে মন বসাতে পারছে না। আয়নায় ফাটল দিয়েছে, জন্তুটা বেরিয়ে আসতে পারে। কিন্তু আয়নাটা ফাটলো কী করে, নির্মল এখনও বুঝে উঠতে পারছে না।
এরই মধ্যে, অন্যমনস্কভাবে, একটা ইনভাইটেশন কার্ডের উল্টো পিঠে অনেকগুলো মুখ এঁকে ফেলেছে। লাইন অ্যান্ড সেড নিয়ে খেললো কিছুক্ষণ। বাথরুম হয়ে এসে আবার যখন দেখল, ততক্ষণে সব মুখোশ হেয় গেছে। ঠিক আফ্রিকার আদিম নৃ-গোষ্ঠীর মুখোশের মতো।
ঠিক তাও হয়নি। আদিমকালের মুখোশে এক ধরনের খাঁটিত্ব ছিল, গোষ্ঠীগত ঐক্য ছিল, তাৎপর্যবাহী বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল। সবচেয়ে বড় কথা_ সরল অভিপ্রায় ছিল। তাদের ভেতরে যে বিশ্বাস ছিল, সেই বিশ্বাসকে ফুটিয়ে তোলার জন্যেই তারা মুখোশ পরত। অথচ, ধুলো থেকে চোখকে বাঁচাবার জন্যে আমরা যে সানগ্গ্নাস পরি, সেটা অন্যের চোখে ধুলো দেওয়ার কাজেই বেশি আসে। একটা মুখের ওপর একই সঙ্গে অনেক চেহারা আমরা সাজিয়ে রাখতে পারি।
নির্মাল আচার্যও পেরেছে। সিঁড়ি ডিঙানোর ইতিহাসটুকু কার্পেট দিয়ে ঢেকে রাখতে। তা না হলে কি আর এতো অল্প সময়ের মধ্যে এতো বড় অ্যাড-ফার্মের চিফ ডিজাইনার! বড় হতে গিয়ে পদে পদে ছোটমনের কতো পরিচয় সে পেছনে ফেলে এসেছে! শুধু, বড় সাহেবের শ্যালকের সঙ্গে কৃত্রিম ঘনিষ্ঠতার রশিটুকু কিছুতেই খুলতে পারছে না। নির্মলের সব দুর্বলতা তার জানা। এই জন্যেই, তার মেয়েকে বিশ্রীভাবে আদর করার পরও এমন ভাব করেছে, যেন দ্যাখেনি।
৫.
ফাইল হাতে ঢুকলো টুম্পা_ নির্মলের জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট। বসের কথামতো টেবিলের কোণা ঘেঁষে দাঁড়াবে। নির্মলের হাতের মুঠো অভ্যাসবশত চলে যাবে ঐ স্পর্শকাতর জায়গায়। টুম্পা টেবিলে উপুড় হয়ে ফাইল খুলবে। বালুচরের মতো উপচে উঠবে অনাবৃত অংশ,_ চোখ দিয়ে চেটে খাওয়ার জন্যে। কেউ ঢোকা মাত্র আঁচলে ঢাকা পড়বে প্রাত্যহিক উপচার। অনাবশ্যকভাবে টুম্পার মুখে ধ্বনিত হবে_ 'আঙ্কেল'।
'আঙ্কেল' হয়েও নির্মল ছুটির পরে আটকে রাখে টুম্পাকে। সুযোগ বুঝে বড় সাহেবের রুমে পাঠায়। মেয়েটাও বুঝে না বোঝার ভান করে। যে মেয়ে মামুলি একটা চাকরির জন্যে বাবার বন্ধুর সঙ্গে বান্দরবানে রাত কাটাতে পারে, তার জন্যে বড় সাহেবের রুম তো দার্জিলিং, আর সে নিজে কাঞ্চনজঙ্ঘা।
বড় সাহেবের টেবিলের ওপর ফ্রেমেবন্দি সুখী পরিবার। ঘরের সেই পাগলা আয়নাটা বলেছিল_ 'ব্যস, নির্মল আচার্য, তোমার দৌড় এই পর্যন্ত। তুমি দ্যাখোনি, পেছনের লাগোয়া রেস্টরুমে প্রমাণ সাইজের আয়না_ আমার আত্মীয়। তার মুখে শুনেছি বুড়োর অক্ষম আগ্রাসনের কথা। বুড়োর ব্যর্থতায় মেয়েটার করুণা জাগে। বেচারা। 'ব্যস্ততা'র অজুহাতে স্ত্রী না ঘুমানো পর্যন্ত বাড়িতে ফেরে না। তোমাদের মুখ ও মুখোশের খেলা এভাবেই চলে আসছে, চলবে।
৬.
তোমার একার দোষ দিয়ে লাভ কী! এই ধরো, তুমি যখন ছোট, খুব ছোট, কাঁথার পর কাঁথা মুতে ভাসিয়ে দিচ্ছ, তখন সারাদেশ ভেসে যাচ্ছিল বন্যায়।_ তোমার জানার কথা নয়। প্রলয়ঙ্করী বন্যা বলতে যা বোঝায়, ঐ মাপের সতেরটা বন্যা হয়েছিল এ দেশে। পর পর তিন বছরে তিনটা বন্যা হলো_ ৫৪.৫৫.৫৬-তে। মজলুম জননেতা ভাসানী কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পঞ্চাশ কোটি টাকা সাহায্য দানের দাবিতে অনশন শুরু করেছিলেন।
মজার ব্যাপার কী জানো? ঠিক ঐ সময়ে বাঙালি মধ্যবিত্তের বিনোদনের জন্য কলকাতা-বোম্বাই-মাদ্রাজ-লাহোরের দেখাদেখি ঢাকাতেও সিনেমা-বানানোর পুঁজি নিশপিশ করছিল। ৫৪-এর বন্যাবর্ষে (৬ আগস্ট) ছবির শুভমহরত অনুষ্ঠান হলো। মুক্তি পেল ৩ আগস্ট ১৯৫৬_ তাও বন্যাবর্ষ। সিনেমার নাম 'মুখ ও মুখোশ'। কাকতালীয় ব্যাপার_ তাই না?
আমাদের সারা দেহজুড়ে চোখ, আমরা দেখেছি_ ঐ বছরটা শুধু বন্যার বছর নয়, দুর্ভিক্ষেরও বটে। দেশে যখন দুর্ভিক্ষ চলছে, তখন ঢাকা-চট্টগ্রাম-নারায়ণগঞ্জে 'একযোগে চলিতেছে' 'মুখ ও মুখোশ'! একদিকে মানুষ মরছে, অন্যদিকে সিনেমা হলে হাততালি।
তোমাদের বিনোদনশিল্প আর পুঁজির বিকাশ এভাবেই শুরু হয়েছিল। এটাই ঐতিহাসিক সত্য। এ রকম এক বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়ে আজ তুমি, তোমাদের সভ্যতা, তোমাদের সংস্কৃতি, তোমাদের অন্তর্জগৎ।
তোমরা সভ্যতার জনক, সেহেতু বাস্তবতারও জনক। তোমরা অনেক কিছু বানাতে পরো, বিক্রি করতে পারো। তোমরা সত্যকেও বিক্রি করতে পারো, কিনতে পারো। তোমাদের যা যা আছে সবই পণ্য, যা কিছু নেই তাও।
এই যে, বিজ্ঞাপনের জন্যে যখন মডেল খোঁজ, তখন কী কী দ্যাখো? কার শরীরের কোন কোন অংশে চুম্বক আছে_ সেগুলোই তো? ভিন্ন চাকরির জন্যে ইন্টারভিউ দিতে আসা বন্ধুর মেয়েটি যখন তোমাকে পায়ে ছুঁয়ে প্রণাম করছিল, তোমার পঁয়তালি্লশ ডিগ্রি দৃষ্টিভঙ্গির গন্তব্য কী ছিল? শুনতে হয়তো তোমার খারাপ লাগছে, কিন্তু করার বেলার তোমাদের খারাপ লাগে না।
সত্যিই তোমরা সভ্য। কী সুন্দরভাবে পোশাক-আসাকের গুহায় নিজেদের পশুত্বকে লুকিয়ে রাখতে পেরেছ!
তুমিই বা কী করতে পারো। চাকরি করতে হয়, গোলামি করতে হয়, চোখকান বন্ধ রাখতে হয়। আরও যা যা আছে। এস্টাবলিস্টমেন্টের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার সাহস তোমার নেই। যে গাছের ডালে চড়ে বসেছ, তার গোড়ায় করাত চালাবার মতো বোকা তুমি নও। তাই, সমাজের মধ্যে থেকেও ঘুণপোকার মতো কাজ করে যাচ্ছ তুমি। সমাজের দোহাই পেড়ে বাদবাকি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বড় করে তুলেছ। এইসব ধাপ্পাবাজি তোমরা ঠিকই বোঝ। তোমাদের ভয়_ কর্পোরেট সিস্টেম থেকে ছিটকে পড়া মানেই উল্কার ছাই।
অথচ দ্যাখো, একটা সময় ছিল যখন সমাজের পাল্লা ছিল ভারী। নিত্যনতুন প্রতিষ্ঠান এসে সমাজকে গিলে ফেলেছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই কমবেশি সমাজের মুখোশ মাত্র। এমনকি রাষ্ট্রও। সমাজের মুখ কিন্তু অন্য রকম। তোমাদের মতো মাল ডেলিভারি দেওয়া আর্টিস্টের পক্ষে তা আঁকা সম্ভব নয়।
৮.
বড় সাহেব নেই, টুম্পা নেই, কাজও তেমন নেই। অফিস পাহারা দেওয়ার কোনো মানে হয় না। ঝোলাটা কাঁধে নিয়ে আস্তে আস্তে রাস্তায় নেমে পড়লো নির্মল আচার্য। উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটছে, আর এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে। নানা রকম বিলবোর্ড। দেশপ্রেমিকের পোস্টারের পাশেই এক হাজার গুণ বড় বিদেশী নায়িকা। তাকে উন্মোচিত করলেই গোলাপি রঙের পেলব সাবান। সাবানও মুখোশ পরে! কেউ বলে মোড়ক।
পান্থপথে ভালোই জ্যাম। উঁকি দেওয়ার জন্যে জানলা খুলতেই দৌড়ে গেল ফুলওয়ালি। অমনি কাচটা বন্ধ হয়ে গেল। গাড়িতে বসা ভদ্রমহিলা হয়তো নারী উন্নয়ন সংস্থার কিছু একটা হবেন। পেছনের গাড়ির জানলার কাচ নেমে গেল। টাকমাথাওয়ালা ভদ্রলোক প্রয়োজনের বেশি কথা বললেন এবং প্রয়োজনহীনভাবে দুটো মালা মেয়েটার কাছ থেকে কিনলেন। কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে একটা বাস মস্তানের মতো বেলাইনে ঢুকে পড়লো। মুখোশপরা ট্রাফিক পুলিশ ওটাকেই আগে ছাড় দিল। জনগণের সেবায় নিবেদিতপ্রাণ নেতার গাড়ি ক্রস করে যাবার পর, জ্যাম ছুটলো। রিকশা থেকে হাত নাড়লো ছাত্রনেতা হাসিল, পাশে ম্যাডাম।
বাঁ দিকে মোড় কাটলেই পার্লার। ওখান থেকে বেরিয়ে আসছে ডিসটেম্পার করা কয়েকটা মুখ। আর একটু সামনে অন্ধ লাইটপোস্ট। তিন চারজন মহিলা। দু'জনের মুখে নেকাব। একজনের হাতে ধরা একটা বাচ্চা। গৃহিণী গৃহিণী ভাব ফুটিয়ে তোলার উপকরণ।
মুখোশের পর মুখোশ দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে নির্মল। অথচ বাসাতেও ফিরতে ইচ্ছে করছে না। ভয়ে। পাগলা আয়না আবার না কী শুরু করে। বাসায় ফিরে সম্পূর্ণ ন্যাংটো হয়ে সে জামাকাপড় পাল্টাবে। কিন্তু ড্রইংরুমে।
বাসায় ফিরে সে রীতিমতো তাজ্জব। আয়নার ফাটল-টাটল সব গায়েব। দুই হাতে হালকা একটা ঝাঁকুনি দিল। _ 'কী? এবার কোন মতলব এঁটেছ?' কোনো জবাব না পেয়ে নির্মলের সাহস বেড়ে গেল। কর্কশকণ্ঠে বললো_ 'মজা আমিও দেখাতে পারি। কালকেই বিক্রি করে দেব তোকে। বউ জিগ্যেস করলে বলবো ফেটে গেছে। তারপর যা হবার হবে। দৃশ্যগুলো দিয়ে বায়োস্কোপ বানা, এক্সিবিশন কর, জাহান্নামে যা।'
আয়না নিশ্চুপ। নির্মল উঠে গিয়ে, পা দিয়ে আয়নার বুকে ঠেলা মারলো। সাড়া নেই। সম্ভবত মরে গেছে। মরে গেলেই ভালো। নির্মলের বেঁচে থাকতে অসুবিধা হবে না।
No comments