১৯৭১ : মুক্তিযুদ্ধে শওকত ওসমান by বুলবন ওসমান
মুক্তিযুদ্ধ
এদেশে মহাভারতের ঘটনার মতো একটি বিষয়। ওই সময় যারা এদেশে বসবাস করেছেন
সবাই তা উপলব্ধি করেছেন। শওকত ওসমান ছিলেন দেশের অন্যতম বরেণ্য নাগরিক।
সাহিত্যে পেয়েছেন আদমজি পুরস্কার,বাংলা একাডেমি পুরস্কার। ১৯৬৮ সালে
পেয়েছেন ‘প্রেসিডেন্ট প্রাইড অব পারফরমেন্স’ পুরস্কার। সুতরাং শত্র“দের
ছিলেন এক নম্বর টার্গেট। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ সকাল থেকেই বাবাকে খুব
চিন্তান্বিত লাগছিল। ১০টার দিকে তিনি বাড়ির বাইরে যাবেন বলে কাপড় পরলেন। মা
জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাচ্ছ? তিনি বললেন, একটু খোঁজখবর নিয়ে আসি। মা বললেন, তাড়াতাড়ি চলে এসো। ঠিক আছে।
বাবা বেরিয়ে গেলেন। ফিরলেন বেলা ২টার দিকে। মুখ খুব গম্ভীর। কারও সঙ্গে
কোনো কথা না বলে শোবার ঘরে ঢুকে কাপড়-চোপড় ছাড়লেন। খাবার সময় পার হয়ে
যাচ্ছে তা-ও খেতে বসছেন না। আমাদের বাড়িটি রাজারবাগ পুলিশ লাইনের উত্তর গেটের প্রায় বিপরীতে একটা গলির মধ্যে। তাই বড় রাস্তা থেকে চোখে পড়ে না।
মা খেতে ডাকলে বাবা টেবিলে নীরবে বসলেন। খাবার খেলেন, কোনো কথা বললেন না। যে মানুষ কথা না বলে থাকতে পারেন না তার এমন মৌনিরূপ আমরা আগে দেখিনি। খাওয়া শেষে তিনি আমাদের ডাকলেন। বললেন, তোমরা কেউ বাড়ির বাইরে যাবে না। অবস্থা খুব খারাপ। টক ফেল করেছে। কোনো সমঝোতা হয়নি। আমরা চার ভাই সবাই তরুণ। ইয়াফেস থাকে বুয়েটের হলে। বাকি আমরা তিন ভাই। আমি, আসফাক আর জাঁ-নেসার।
খানিক পরে সব জানা গেল। তিনি ন্যাপ-নেতা ওয়ালি খানের সঙ্গে হোটেলে দেখা করেছেন। এই রাজনীতিবিদ বাবার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। পূর্ব ও পশ্চিম দুই অংশের ন্যাপের মধ্যে ছিল সহমর্মিতা। দুই দলেরই আদর্শ ছিল দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম করা। বাবা জানালেন, ওয়ালি খান শেখ সাহেবকে বলেন একটা সমঝোতা করতে। তার আশংকা, অন্যথায় এই ন্যাপ ও দেশ পড়বে নেকড়ের মুখে। আর সে নেকড়ে হল জুলফিকার আলী ভুট্টো। তিনি এও জানান, অন্যান্য বাম-মনোভাবের সবাই কেন্দ্রে শেখ সাহেকে সহযোগিতা দেবেন, কিন্তু শেখ সাহেব ছয় দফার নীতিতে অনড়। ফলে আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। ভয়াবহ কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে আঁচ করছেন বাবা।
থেকে থেকে আমরা রেডিও ধরি। নতুন কোনো খবর নেই। একই খবর : দুইপক্ষে আলোচনা চলছে। সন্ধ্যারাতেই জানা গেল পাকিস্তানের সব নেতারা একে একে চলে যাচ্ছেন। রাত ৮টার দিকে মোমেনবাগের পাড়াজুড়ে ফিসফিস আলোচনা, সব নেতা চলে যাচ্ছেন, অথচ রেডিও বলছে টক চলছে... এ কেমন কথা! আরও খানিক পরে একজন জানালেন খুব কনফিডেনসিয়াল রিপোর্ট... আর্মি হেড কোয়ার্টার্স থেকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানও চলে গেছেন। তা হলে কি হতে যাচ্ছে?
কেউ জানে না। সবাই ধরে নিয়েছে যে কোনো মুহূর্তে আর্মি ঢাকা শহরের ক্ষমতা দখল করবে। কি হবে তখন? মানুষের যে মুড, তাতে কোনো বাধা কেউ মানবে বলে মনে হয় না। কিন্তু মানুষ তো নিরস্ত্র? রাত ১০টা সাড়ে ১০টার দিকে পাড়ায় এক যুবক চিৎকার করে বলে যেতে লাগল, ক্যান্টনমেন্ট থেকে আর্মিরা বেরিয়ে পড়েছে! আপনারা সাবধান! সাবধান!
বাবা তখনই মা আর বোনকে নিয়ে পেছনে এক বাড়িতে চলে গেলেন। আমরা যুবকরা সবাই তখন পরিকল্পনা করছি কীভাবে আর্মিদের ঠেকানো যায়। এর মধ্যে রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে সশস্ত্র পুলিশরা পাড়ায় ঢুকতে শুরু করেছে। আমরা পুলিশদের সব ছাদে ওঠার ব্যবস্থা করছি। পুলিশরা আসায় আমরা খুব আশান্বিত। আমাদের ঘরের ছাদ ঢালু বলে পুলিশের ওখানে ওঠা হল না। অন্যান্য পাকা বাড়ির ছাদে পুলিশরা পজিশন নিতে থাকে। তাদের একমাত্র অস্ত্র রাইফেল।
রাত পৌনে ১২টার দিকে মালিবাগে গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল। রাইফেলের গুলির শব্দে আমরা বুঝতে পারি পুলিশরা শত্র“র ওপর আঘাত হানছে। মিনিট পনেরও যায়নি। এরপর শুরু হল চারদিক থেকে মেশিনগানের অনবরত গুলি। রাতের অন্ধকার নিমেষে উধাও। এই আলোতে শক্ররা আমাদের অবস্থান জেনে নিতে থাকে। বাধ্য হয়ে আমরা পেছনে এক বাড়িতে প্রায় ৪০-৫০ জন আশ্রয় নিই। রাত আড়াইটার দিকে ঘর থেকে সামান্য দরজা খুলে দেখি পুরো পুলিশ লাইন দাউদাউ করে জ্বলছে। দিনের আলোর মতো রাজারবাগ আলোকিত। এ অবস্থায় পুলিশ অসহায়। ভোরের দিকে তারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রস্থান করতে থাকে। আমরা তাদের লুঙ্গি-জামা দিই, সিভিল পোশাক ধারণের জন্য। ২৬ তারিখ সারা দিন বন্দি। ২৭ তারিখ দুই ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল। পরদিন ২৮ তারিখ বাবা আমাদের ঢাকার বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে বললেন। আমি চলে গেলাম বিক্রমপুর শ্রীনগরের দামলা গ্রামে। দিন দশেক পরে ফিরে দেখি বাবা বাসায় নেই। তিনি ঘনিষ্ঠ বন্ধু নোয়াখালীর এম এন এ মোহাইমেন সাহেবের সঙ্গে গোপন স্থানে আছেন।
ক’দিন পর তিনি ফিরে এলেন। মোহাইমেন সাহেব ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন। বাবার চেহারা খুব খারাপ। পাশের বাড়িতে ছিলেন সঙ্গীতশিল্পী আলতাফ মাহমুদ। আমাদের সঙ্গে তিনিও বাবাকে সাহস জোগান। ভাবতে থাকি বাবাকে নিয়ে কি করা যায়। সব শেষে আমরা সিদ্ধান্ত নিই তাকে ভারতবর্ষে পাঠিয়ে দেয়ার। মেজভাই আশফাক ওসমান তখন সব ব্যবস্থা করেন। তার চাকরি স্থল সায়েন্স ল্যাবরেটরি। এখানকার পিওন ইদরিশ মিয়ার বাড়ি আগরতলার কাছে কোনাবন বর্ডারে। বাবা খুব দোটানায় পড়ে যান। পরিবারকে হায়েনার মুখে ফেলে... আমরা তাকে সাহস জোগাই, অবস্থা বুঝে আমরাও আগরতলা রওনা দেব। বন্ধুশিল্পী রফিকুন নবীর বাবা রশীদুন নবী গোয়েন্দা বিভাগে ছিলেন, তার মারফত খবর পাই বিপদ আসন্ন। তাই বাবা যাওয়ার ১০-১২ দিন পর মে মাসের শেষ সপ্তাহে আমি মা ও বোন আনফিসাকে নিয়ে আগরতলা পৌঁছাই। ওখানে বাবা ছোটভাই জাঁনেসারকে নিয়ে আমাদের অপেক্ষায় ছিলেন।
এখন যেতে হবে কলকাতা। রাস্তাপথে কলকাতা প্রায় তিন দিনের ধাক্কা। বাবা চট্টগ্রামের নেতা এম আর সিদ্দিকীকে ধরে একটি আর্মি কার্গো প্লেনে কলকাতা যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। আগরতলা এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছি... আমরা পুরো পরিবার ও চট্টগ্রামের ন্যাপ নেতা চৌধুরী হারুন। আমরা দু’জন পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করছি। একটু হয়তো জোরে জোরে... বাবা এগিয়ে এসে আমাদের ধমকের সুরে বললেন, মনে রাখবে এটা বিদেশ, রাজনৈতিক আলোচনা নয়... আমার মনে তখন বেশ মিশ্র প্রতিক্রিয়া, এই দেশে বাবা জন্মেছেন এবং ৩২ বছর কাটিয়ে গেছেন, আজ তা বিদেশ... আমিও জন্মেছি এদেশে, কাটিয়েছি শৈশবের ১০টি বছর, সত্যি আজ এটা আমাদের জন্য বিদেশ। বাবার কথার বাস্তবতাটা আমরা উপলব্ধি করি।
দমদম পৌঁছতে আমাদের বিকাল হয়ে গেল। আমরা উঠলাম পার্ক সার্কাসে জাস্টিস মাসুদের ১৫ নাসিরুদ্দীন রোডের বাড়িতে। জাস্টিস মাসুদ সম্পর্কে আমাদের মামা হন। থাকেন চারতলা বাড়ির তিনতলায়। তিনতলার একটি কামরা আমাদের জন্য বরাদ্দ হয়। আমি ছোটভাই জাঁনেসার, মা ও আনফিসা এই কামরায়। খাটে আমরা দুই ভাই, মেঝে মা-বোন। বাবার জন্য বরাদ্দ চারতলার চিলেঘরের একটি কামরা, যেখানে পুরো সংসারের পরিত্যক্ত জিনিস ভরা, তার এক কোণে একটা পুরনো খাটে চাদর চাপিয়ে বিছানা হল। একটা পুরনো স্ট্যান্ড ফ্যান ছিল সেটা সচল করা গেলে রক্ষা।
আমি কলকাতা রেডিও আর খবরের কাগজে ঘুরচ্ছি লেখার ফরমাশ পাওয়ার জন্য। বাবা এ সময় ‘দেশ’ সম্পাদক সাগরময় ঘোষের কাছ থেকে শারদীয় সংখ্যার উপন্যাস লেখার হুকুম পেলেন। বাবা সেই গ্রীষ্মের মধ্যে লেখা শুরু করেন, তার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম উপন্যাস ‘জাহান্নাম হইতে বিদায়’। দুই পাতা লেখেন আর ‘দেশ’ পত্রিকার পিওন এসে তাড়া দেয়। বাবা কখনো কখনো পিওনকে বসিয়ে রেখে কয়েক স্লিপ লেখা তৈরি করে দিতেন। এটা কম্পোজ চলে... এভাবে জোড়া দিয়ে দিয়ে ছাপা চলতে থাকে।
মাস দু’য়ের মাথায় আমাদের কিছুটা ভালো জায়গায় থাকার ব্যবস্থা হল। এটি কাজী আবদুল ওদুদ সাহেবের বাড়ি, ৮-বি তারকা দত্ত রোডে। দোতলায় একটি রুম পেলেন বাবা। তখন তার লেখার বেশ সুবিধে হল। এদিকে ইয়াফেস তখন তার মুক্তিবাহিনী প্লাটুন নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ। বাবার কাছে সব খবর আসে। তিনি ও মা প্রতি মুহূর্তে ছেলের চিন্তায় উদ্বিগ্ন থাকেন। ফ্রন্টে ও পশ্চাতে সর্বত্র তখন যুদ্ধ। জীবন-যুদ্ধ কী কম বড় যুদ্ধ? জীবনের রসদ জোগান মানুষের চিরকালের যুদ্ধ। কৃচ্ছ তা তখন আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে। দুটি প্যান্ট আর একটি শার্ট নিয়ে কলকাতায়। আর পকেটে ছিল ৫০০ টাকার একটা নোট।
এ সময় কলকাতায় নকশাল আন্দোলন চলছে। তার মধ্যে বাবা একটা বড় ধরনের ঝুঁকি নিয়ে চীনের প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখলেন-এই চিঠিতে তিনি চীনা সরকারকে বাংলার পীড়িত মানুষের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে অংশ নিতে অনুরোধ জানান। বলা দরকার যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন তখন চীনের সঙ্গে সম্পর্ক-স্থাপনের জন্য পিং পং রাজনীতি শুরু করেছেন। এই চিঠি প্রকাশিত হওয়ায় কলকাতায় বাবার জীবন ঝুঁকিতে পড়ে গেল। কেননা চীনাপন্থি কমিউনিস্টরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সাপোর্ট করেনি। অবশ্য অন্যান্য বুদ্ধিজীবী বাবার পক্ষ নেন।
লেখা ছাড়াও বাবা রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করতেন এবং বুদ্ধি দিতেন। বিশেষ করে তিনি বলতেন, ডাক্তার ছেলেদের যেন ফ্রন্টাল যুদ্ধে না পাঠানো হয়। কারণ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ডাক্তারদের বিশাল ভূমিকা নিতে হবে। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সারিয়ে তোলা, শরণার্থী শিবিরে দুস্থ মানুষকে সেবা... তাদের কাজ থাকবে সবচেয়ে বেশি। এভাবে গোটা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় তিনি নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন।
মা খেতে ডাকলে বাবা টেবিলে নীরবে বসলেন। খাবার খেলেন, কোনো কথা বললেন না। যে মানুষ কথা না বলে থাকতে পারেন না তার এমন মৌনিরূপ আমরা আগে দেখিনি। খাওয়া শেষে তিনি আমাদের ডাকলেন। বললেন, তোমরা কেউ বাড়ির বাইরে যাবে না। অবস্থা খুব খারাপ। টক ফেল করেছে। কোনো সমঝোতা হয়নি। আমরা চার ভাই সবাই তরুণ। ইয়াফেস থাকে বুয়েটের হলে। বাকি আমরা তিন ভাই। আমি, আসফাক আর জাঁ-নেসার।
খানিক পরে সব জানা গেল। তিনি ন্যাপ-নেতা ওয়ালি খানের সঙ্গে হোটেলে দেখা করেছেন। এই রাজনীতিবিদ বাবার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। পূর্ব ও পশ্চিম দুই অংশের ন্যাপের মধ্যে ছিল সহমর্মিতা। দুই দলেরই আদর্শ ছিল দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম করা। বাবা জানালেন, ওয়ালি খান শেখ সাহেবকে বলেন একটা সমঝোতা করতে। তার আশংকা, অন্যথায় এই ন্যাপ ও দেশ পড়বে নেকড়ের মুখে। আর সে নেকড়ে হল জুলফিকার আলী ভুট্টো। তিনি এও জানান, অন্যান্য বাম-মনোভাবের সবাই কেন্দ্রে শেখ সাহেকে সহযোগিতা দেবেন, কিন্তু শেখ সাহেব ছয় দফার নীতিতে অনড়। ফলে আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। ভয়াবহ কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে আঁচ করছেন বাবা।
থেকে থেকে আমরা রেডিও ধরি। নতুন কোনো খবর নেই। একই খবর : দুইপক্ষে আলোচনা চলছে। সন্ধ্যারাতেই জানা গেল পাকিস্তানের সব নেতারা একে একে চলে যাচ্ছেন। রাত ৮টার দিকে মোমেনবাগের পাড়াজুড়ে ফিসফিস আলোচনা, সব নেতা চলে যাচ্ছেন, অথচ রেডিও বলছে টক চলছে... এ কেমন কথা! আরও খানিক পরে একজন জানালেন খুব কনফিডেনসিয়াল রিপোর্ট... আর্মি হেড কোয়ার্টার্স থেকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানও চলে গেছেন। তা হলে কি হতে যাচ্ছে?
কেউ জানে না। সবাই ধরে নিয়েছে যে কোনো মুহূর্তে আর্মি ঢাকা শহরের ক্ষমতা দখল করবে। কি হবে তখন? মানুষের যে মুড, তাতে কোনো বাধা কেউ মানবে বলে মনে হয় না। কিন্তু মানুষ তো নিরস্ত্র? রাত ১০টা সাড়ে ১০টার দিকে পাড়ায় এক যুবক চিৎকার করে বলে যেতে লাগল, ক্যান্টনমেন্ট থেকে আর্মিরা বেরিয়ে পড়েছে! আপনারা সাবধান! সাবধান!
বাবা তখনই মা আর বোনকে নিয়ে পেছনে এক বাড়িতে চলে গেলেন। আমরা যুবকরা সবাই তখন পরিকল্পনা করছি কীভাবে আর্মিদের ঠেকানো যায়। এর মধ্যে রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে সশস্ত্র পুলিশরা পাড়ায় ঢুকতে শুরু করেছে। আমরা পুলিশদের সব ছাদে ওঠার ব্যবস্থা করছি। পুলিশরা আসায় আমরা খুব আশান্বিত। আমাদের ঘরের ছাদ ঢালু বলে পুলিশের ওখানে ওঠা হল না। অন্যান্য পাকা বাড়ির ছাদে পুলিশরা পজিশন নিতে থাকে। তাদের একমাত্র অস্ত্র রাইফেল।
রাত পৌনে ১২টার দিকে মালিবাগে গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল। রাইফেলের গুলির শব্দে আমরা বুঝতে পারি পুলিশরা শত্র“র ওপর আঘাত হানছে। মিনিট পনেরও যায়নি। এরপর শুরু হল চারদিক থেকে মেশিনগানের অনবরত গুলি। রাতের অন্ধকার নিমেষে উধাও। এই আলোতে শক্ররা আমাদের অবস্থান জেনে নিতে থাকে। বাধ্য হয়ে আমরা পেছনে এক বাড়িতে প্রায় ৪০-৫০ জন আশ্রয় নিই। রাত আড়াইটার দিকে ঘর থেকে সামান্য দরজা খুলে দেখি পুরো পুলিশ লাইন দাউদাউ করে জ্বলছে। দিনের আলোর মতো রাজারবাগ আলোকিত। এ অবস্থায় পুলিশ অসহায়। ভোরের দিকে তারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রস্থান করতে থাকে। আমরা তাদের লুঙ্গি-জামা দিই, সিভিল পোশাক ধারণের জন্য। ২৬ তারিখ সারা দিন বন্দি। ২৭ তারিখ দুই ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল। পরদিন ২৮ তারিখ বাবা আমাদের ঢাকার বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে বললেন। আমি চলে গেলাম বিক্রমপুর শ্রীনগরের দামলা গ্রামে। দিন দশেক পরে ফিরে দেখি বাবা বাসায় নেই। তিনি ঘনিষ্ঠ বন্ধু নোয়াখালীর এম এন এ মোহাইমেন সাহেবের সঙ্গে গোপন স্থানে আছেন।
ক’দিন পর তিনি ফিরে এলেন। মোহাইমেন সাহেব ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন। বাবার চেহারা খুব খারাপ। পাশের বাড়িতে ছিলেন সঙ্গীতশিল্পী আলতাফ মাহমুদ। আমাদের সঙ্গে তিনিও বাবাকে সাহস জোগান। ভাবতে থাকি বাবাকে নিয়ে কি করা যায়। সব শেষে আমরা সিদ্ধান্ত নিই তাকে ভারতবর্ষে পাঠিয়ে দেয়ার। মেজভাই আশফাক ওসমান তখন সব ব্যবস্থা করেন। তার চাকরি স্থল সায়েন্স ল্যাবরেটরি। এখানকার পিওন ইদরিশ মিয়ার বাড়ি আগরতলার কাছে কোনাবন বর্ডারে। বাবা খুব দোটানায় পড়ে যান। পরিবারকে হায়েনার মুখে ফেলে... আমরা তাকে সাহস জোগাই, অবস্থা বুঝে আমরাও আগরতলা রওনা দেব। বন্ধুশিল্পী রফিকুন নবীর বাবা রশীদুন নবী গোয়েন্দা বিভাগে ছিলেন, তার মারফত খবর পাই বিপদ আসন্ন। তাই বাবা যাওয়ার ১০-১২ দিন পর মে মাসের শেষ সপ্তাহে আমি মা ও বোন আনফিসাকে নিয়ে আগরতলা পৌঁছাই। ওখানে বাবা ছোটভাই জাঁনেসারকে নিয়ে আমাদের অপেক্ষায় ছিলেন।
এখন যেতে হবে কলকাতা। রাস্তাপথে কলকাতা প্রায় তিন দিনের ধাক্কা। বাবা চট্টগ্রামের নেতা এম আর সিদ্দিকীকে ধরে একটি আর্মি কার্গো প্লেনে কলকাতা যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। আগরতলা এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছি... আমরা পুরো পরিবার ও চট্টগ্রামের ন্যাপ নেতা চৌধুরী হারুন। আমরা দু’জন পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করছি। একটু হয়তো জোরে জোরে... বাবা এগিয়ে এসে আমাদের ধমকের সুরে বললেন, মনে রাখবে এটা বিদেশ, রাজনৈতিক আলোচনা নয়... আমার মনে তখন বেশ মিশ্র প্রতিক্রিয়া, এই দেশে বাবা জন্মেছেন এবং ৩২ বছর কাটিয়ে গেছেন, আজ তা বিদেশ... আমিও জন্মেছি এদেশে, কাটিয়েছি শৈশবের ১০টি বছর, সত্যি আজ এটা আমাদের জন্য বিদেশ। বাবার কথার বাস্তবতাটা আমরা উপলব্ধি করি।
দমদম পৌঁছতে আমাদের বিকাল হয়ে গেল। আমরা উঠলাম পার্ক সার্কাসে জাস্টিস মাসুদের ১৫ নাসিরুদ্দীন রোডের বাড়িতে। জাস্টিস মাসুদ সম্পর্কে আমাদের মামা হন। থাকেন চারতলা বাড়ির তিনতলায়। তিনতলার একটি কামরা আমাদের জন্য বরাদ্দ হয়। আমি ছোটভাই জাঁনেসার, মা ও আনফিসা এই কামরায়। খাটে আমরা দুই ভাই, মেঝে মা-বোন। বাবার জন্য বরাদ্দ চারতলার চিলেঘরের একটি কামরা, যেখানে পুরো সংসারের পরিত্যক্ত জিনিস ভরা, তার এক কোণে একটা পুরনো খাটে চাদর চাপিয়ে বিছানা হল। একটা পুরনো স্ট্যান্ড ফ্যান ছিল সেটা সচল করা গেলে রক্ষা।
আমি কলকাতা রেডিও আর খবরের কাগজে ঘুরচ্ছি লেখার ফরমাশ পাওয়ার জন্য। বাবা এ সময় ‘দেশ’ সম্পাদক সাগরময় ঘোষের কাছ থেকে শারদীয় সংখ্যার উপন্যাস লেখার হুকুম পেলেন। বাবা সেই গ্রীষ্মের মধ্যে লেখা শুরু করেন, তার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম উপন্যাস ‘জাহান্নাম হইতে বিদায়’। দুই পাতা লেখেন আর ‘দেশ’ পত্রিকার পিওন এসে তাড়া দেয়। বাবা কখনো কখনো পিওনকে বসিয়ে রেখে কয়েক স্লিপ লেখা তৈরি করে দিতেন। এটা কম্পোজ চলে... এভাবে জোড়া দিয়ে দিয়ে ছাপা চলতে থাকে।
মাস দু’য়ের মাথায় আমাদের কিছুটা ভালো জায়গায় থাকার ব্যবস্থা হল। এটি কাজী আবদুল ওদুদ সাহেবের বাড়ি, ৮-বি তারকা দত্ত রোডে। দোতলায় একটি রুম পেলেন বাবা। তখন তার লেখার বেশ সুবিধে হল। এদিকে ইয়াফেস তখন তার মুক্তিবাহিনী প্লাটুন নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ। বাবার কাছে সব খবর আসে। তিনি ও মা প্রতি মুহূর্তে ছেলের চিন্তায় উদ্বিগ্ন থাকেন। ফ্রন্টে ও পশ্চাতে সর্বত্র তখন যুদ্ধ। জীবন-যুদ্ধ কী কম বড় যুদ্ধ? জীবনের রসদ জোগান মানুষের চিরকালের যুদ্ধ। কৃচ্ছ তা তখন আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে। দুটি প্যান্ট আর একটি শার্ট নিয়ে কলকাতায়। আর পকেটে ছিল ৫০০ টাকার একটা নোট।
এ সময় কলকাতায় নকশাল আন্দোলন চলছে। তার মধ্যে বাবা একটা বড় ধরনের ঝুঁকি নিয়ে চীনের প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখলেন-এই চিঠিতে তিনি চীনা সরকারকে বাংলার পীড়িত মানুষের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে অংশ নিতে অনুরোধ জানান। বলা দরকার যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন তখন চীনের সঙ্গে সম্পর্ক-স্থাপনের জন্য পিং পং রাজনীতি শুরু করেছেন। এই চিঠি প্রকাশিত হওয়ায় কলকাতায় বাবার জীবন ঝুঁকিতে পড়ে গেল। কেননা চীনাপন্থি কমিউনিস্টরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সাপোর্ট করেনি। অবশ্য অন্যান্য বুদ্ধিজীবী বাবার পক্ষ নেন।
লেখা ছাড়াও বাবা রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করতেন এবং বুদ্ধি দিতেন। বিশেষ করে তিনি বলতেন, ডাক্তার ছেলেদের যেন ফ্রন্টাল যুদ্ধে না পাঠানো হয়। কারণ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ডাক্তারদের বিশাল ভূমিকা নিতে হবে। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সারিয়ে তোলা, শরণার্থী শিবিরে দুস্থ মানুষকে সেবা... তাদের কাজ থাকবে সবচেয়ে বেশি। এভাবে গোটা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় তিনি নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন।
No comments