সংবিধান রক্ষার নির্বাচন
৫ জানুয়ারি যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, সেই নির্বাচন নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের সমালোচনার মূল কথা হলো, প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে ছাড়া এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। কিন্তু সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য এর কোনো বিকল্প ছিল বলে আমি মনে করি না। নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশে যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাকে ব্যাহত হতে দেওয়া যায় না। আমি এও মনে করি, সময়ের প্রয়োজনেই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থাটি এসেছিল। সেটি কোনোভাবেই স্থায়ী ব্যবস্থা হতে পারে না। তদুপরি পঞ্চম সংশোধনীকে চ্যালেঞ্জ করে যে মামলা হয়েছিল, ২০০৪ সালে বিএনপির আমলেই হাইকোর্ট তাঁকে অবৈধ বলে রায় দেন। সরকার সেই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে এবং সুপ্রিম কোর্ট ২০১০ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী বলে ঘোষণা দেন। সেই রায়ে বলা হয়েছিল, জাতীয় সংসদ চাইলে দুই মেয়াদের জন্য এই ব্যবস্থা বহাল রাখতে পারে। জাতীয় সংসদ চায়নি।
এখন তো জোর করে সেই ব্যবস্থা চলতে পারে না। যদি কেউ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আবার সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করেও, আইনের চোখে সেটি টিকবে না। পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক দেশে যে পদ্ধতিতে নির্বাচন, বাংলাদেশেও সেই পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে। পূর্ব তিমুর বা সুদানের মতো দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন হয়েছে। বাংলাদেশের মতো পুরোনো গণতান্ত্রিক দেশে সেটি কাম্য হতে পারে না। আরেকটি কথা, ১৯৯৬ সালে যে রাজনৈতিক বাস্তবতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল, সেই বাস্তবতা এখন আর নেই। গত পাঁচ বছরে অনেকগুলো স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন হয়েছে, যাতে বিএনপি অংশ নিয়েছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে জয়লাভও করেছে। বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্র তথা ভোটের অধিকার রক্ষার ব্যাপারে খুবই সজাগ। যোগাযোগব্যবস্থাও আগের চেয়ে অনেক সহজতর হয়েছে, ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা তৈরি হয়েছে, সর্বোপরি গণমাধ্যমের সজাগ দৃষ্টি রয়েছে। এ কারণে নির্বাচনে কারচুপি করা এখন আর সহজ নয়। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হওয়াটাই বাঞ্ছনীয় ছিল। বিশেষ করে বিএনপির মতো একটি রাজনৈতিক দল, যাদের ৩০ শতাংশেরও বেশি জনসমর্থন আছে, তাদের বাইরে রেখে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তা যেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে না, তেমনি উৎসবময় পরিবেশও আশা করা যায় না। সেই সঙ্গে এ কথাও স্বীকার করতে হবে,
সংবিধান মানলে নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে নির্বাচনটি হতেই হবে। ১৯৭০ সালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) বড় একটি রাজনৈতিক দল ছিল। কিন্তু তারা নির্বাচনে অংশ নেয়নি, বরং সামরিক আইনের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমালোচনাও করেছিল। পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়েছে যে মওলানা ভাসানীর নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি নির্বাচন বর্জনের পক্ষে যৌক্তিক কারণ দেখাতে পারেনি। তাঁর দলের পক্ষে জাতীয় সংসদে অন্তর্বর্তী সরকারের যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, সেটি যেমন অবাস্তব তেমনি জগাখিচুড়ি ধরনের। পরবর্তী সময়ে তারা দাবি করল, প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে শেখ হাসিনাকে চলে যেতে হবে। আমি মনে করি, এই দাবি সংবিধানবিরোধী। আগামী লোকসভা নির্বাচন সামনে রেখে সম্প্রতি ভারতেও প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের পদত্যাগের দাবি উঠলে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, মেয়াদ শেষ হওয়ার এক দিন আগেও পদত্যাগ করবেন না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথেষ্ট সচেষ্ট ছিলেন। সংবিধানে না থাকা সত্ত্বেও তিনি সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দেন। এমনকি বিরোধী দল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ কোন কোন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় নিতে চায়, সেটিও জানতে চান। কিন্তু বিরোধী দল তাতে সাড়া দেয়নি। আমি মনে করি, এর ফলে বিএনপি দশম সংসদ নির্বাচনের ট্রেনটি মিস করেছে। এটি তাদের রাজনৈতিক ভুল বলেই মনে করি। অনেকে বলেন, জামায়াত নির্বাচনে যেতে পারছে না বলেই বিএনপি এই নির্বাচন বর্জন করেছে। এতে বিএনপির জনসমর্থন বাড়েনি। জনগণ তাদের আন্দোলনে সাড়া দিয়েছে,
এ কথাও জোর দিয়ে বলা যাবে না। তদুপরি দুই মাস ধরে আন্দোলনের নামে সারা দেশে যে সহিংস তাণ্ডব চলেছে, মানুষ হত্যা ও সরকারি সম্পদ ধ্বংস করার ঘটনা ঘটেছে, তা জামায়াতেরই কাজ। কিন্তু এর দায় বিএনপিও কোনোভাবে এড়াতে পারে না। কেননা, তাদের আহূত কর্মসূচির সুযোগেই জামায়াতে ইসলামী এসব অপকর্ম করতে পেরেছে। দ্বিতীয়ত, আমার ধারণা, এ মুহূর্তে সাংগঠনিকভাবে সংগঠিত নয় বলে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়নি। যেকোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একাধিক গণতান্ত্রিক দল থাকা প্রয়োজন। সে কারণে একটি শক্তিশালী দল হিসেবে বিএনপি গণতন্ত্র চর্চায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে, সেটাই সবার প্রত্যাশা। কেননা, একক গণতান্ত্রিক দল থাকলে সেটি গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গলজনক নয়। আরেকটি কথা, বিএনপি জনগণকে আন্দোলনে শরিক হতে বললেও দলের নেতাদেরও আন্দোলনে নামাতে পারেনি। এটি তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা। তবে দশম নির্বাচনের ট্রেন মিস করলেও বিএনপিকে আগামী দিনে নির্বাচনী রাজনীতির জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী ও অন্য মন্ত্রীরা বলেছেন, সমঝোতার ভিত্তিতে একাদশ সংসদ নির্বাচন হতে পারে। তবে সেই সমঝোতা হতে হবে অবশ্যই সংবিধানের আলোকে এবং মৌলবাদী জামায়াতে ইসলামী রাজনীতিকে না বলার মধ্য দিয়ে। বিএনপির জামায়াতকে ছাড়তে হবে। গণতন্ত্র ও জামায়াতের রাজনীতি একসঙ্গে চলতে পারে না। অনেকেই ১৫৪টি আসনে বিনা নির্বাচনে প্রার্থীদের জয়ী হওয়ার কথা বলেছেন। ওই সব আসনে নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই জনপ্রতিনিধি বাছাই করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ ইচ্ছা করলে ওই সব আসনে ডামি ক্যান্ডিডেট দিয়ে ভোটের মহড়া দেখাতে পারত। কিন্তু তারা সেটি দেখায়নি রাজনৈতিক সততার কারণেই। তারা শেষ পর্যন্ত ভেবেছিল, বিএনপি নির্বাচনে আসবে এবং একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হবে।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments