মুখোশের স্বীকারোক্তি by ফরিদ কবির
একটা
কুকুর কুকুর হিসেবেই জন্ম নেয়। মারাও যায় কুকুর হিসেবেই। একটা বাঘ বা একটা
বেড়ালের বেলায়ও তাই। এমনকি কোনো সাপও জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি সাপই। অন্য
কিছু নয়। একটা সাপ 'সাপ' ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। কিন্তু জন্ম নেবার পর
মানুষ 'মানুষ' থাকবে কি না তা বলা মুশকিল! মৃত্যুর সময়েও সে মানুষ হিসেবেই
মৃত্যুবরণ করবে কি-না তা কেউ বলতে পারে না! আমি যখন বেশ ছোট তখন গুরুজনরা বলতেন_ বাবা, মানুষ হও। শুনে আমি অবাক হতাম! তাহলে কি আমি মানুষ নই? আমি তাহলে কী?
অনেকে হয়তো আরও অনেক আগেই বুঝতে পারেন, কিন্তু মানুষ হবার বিষয়টি বুঝতে আমার অনেক সময় লেগেছে! কাজেই মানুষ হয়ে উঠবার প্রক্রিয়াটিও আমার মধ্যে শুরু হয়েছে কিছুটা দেরিতেই! মানুষের আসলে সুবিধা অনেক। সে ইচ্ছে করলেই অন্য কিছু একটা হয়ে উঠতে পারে! একটা কুকুর বা বেড়ালের সে সুযোগ বা ক্ষমতা নেই! একটা কুকুর ইচ্ছে করলেই হাতি হতে পারে না! একটা বেড়াল চাইলেই বাঘ হতে পারে না। মানুষ তার মুখের আদল অবিকৃত রেখেও তার স্বভাববশে হয়ে উঠতে পারে অন্য কিছু! এর জন্য তার মুখোশ পরার দরকার পড়ে না। মুখোশ পরার প্রয়োজন তার নেই বলেই মানুষকে ঠিক চেনা যায় না। ভয়টা সেখানেই।
মুখোশের উৎপত্তি কীভাবে হয়েছিলো আমার জানা নেই। তবে উইকিপিডিয়া বলছে, আদিকালে মানুষ বিভিন্ন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মুখোশ পরতো। এ ছাড়া, কোনো কারণে নিজেকে রক্ষার জন্য বা পরিচয় গোপন করতে মানুষ মুখোশ পরতো বা ছদ্মবেশ ধারণ করতো।
আদিকালের মানুষ এক অর্থে বোকাই ছিলো! ছদ্মবেশ ধরতে বা পরিচয় গোপন করতে তার মুখোশের দরকার হতো। বর্তমানকালের মানুষ যথেষ্ট বুদ্ধিমান। ছদ্মবেশ ধরতে বা পরিচয় গোপন করতে তার মুখোশের দরকার হয় না।
দেশপ্রেমিকের পোশাকে অনেক দেশদ্রোহী, অনেক রাজাকার আমরা দেখেছি। প্রেমিক বা প্রেমিকার পরিচয়ে প্রতারণার ঘটনা কার জীবনে ঘটেনি! যাকে বন্ধু হিসেবে জানি, সে বন্ধুর ছদ্মবেশে প্রতারক বা ঘাতক কি-না তা জানার উপায় নেই। বাঘ বা সাপ থেকে বাঁচার জন্য মানুষ নানা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু ভাই বা বন্ধুর ছদ্মাবরণে যে শত্রু বা ঘাতক মানুষের পাশেই ছোবল মারার জন্য ওঁৎ পেতে আছে, তার থেকে নিজেকে মানুষ বাঁচাবে কীভাবে?
একটা-দুটো ঘটনা বলি। এতে মুখ ও মুখোশের তফাত হয়তো কিছুটা স্পষ্ট হতে পারে।
১৯৮৩ সালের ঘটনা। শ্রীলংকা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি সেখানে একটা ইউথ কনফারেন্সে যোগ দিতে। শুনে আমার এক বন্ধু বললো, 'আমিও ইনভাইটেশন পেয়েছি। কী পরিমাণ টাকা লাগবে বল তো? '
আমি বললাম, 'পনেরো-কুড়ি হাজার হলেই চলবে।'
বন্ধু বললো, 'তুই এতো টাকা কোত্থেকে জোগাড় করলি?'
বললাম, 'টুকটাক ব্যবসা করার জন্য আমার মার কাছ থেকে আমি হাজার ত্রিশেক টাকা নিয়েছি। আপাতত সেখান থেকেই খরচ করবো।'
আসলে টাকাটা আমি জোগাড় করেছি অন্যভাবে। আমার বাবা সামান্য চাকরি করেন। তার আয় খুবই সীমিত। বিদেশ ঘোরার জন্য আমাকে পনেরো হাজার টাকা দেয়ার সঙ্গতি তার নেই।
আমি গোপনে আলমারি থেকে আমার মায়ের কিছু গহনা সরালাম! সেগুলি তাঁতিবাজারে নিয়ে বিক্রি করে ২৭ হাজার টাকা পেলাম। সে সময়ে আমি শ্রীলংকা যাওয়ার জন্য এমনই অন্ধ হয়ে পড়েছিলাম, আমি যে মারাত্মক অন্যায় করছি_ তা বুঝতে পারছিলাম না।
এ গয়নাগুলো আমার মা সারাজীবন ধরে তিল তিল করে তৈরি করেছেন। তিনি যখন এটা জানতে পারবেন তখন কতোটা দুঃখ পাবেন তা আমি আন্দাজ করতে পারিনি।
কিন্তু তখন এসব কিছুই মাথায় আসেনি।
বন্ধুকে বললাম, 'আপাতত ব্যবসার টাকা থেকে হাজার বিশেক টাকা নিয়ে রওনা দেবো।'
'তাহলে তো তোর প্রবেল্গম সলভ্ড। আমার কিছু জমানো টাকা আছে। দশ-বারো হাজার হবে। দেখি বাকি টাকা জোগাড় করতে পারি কি-না। পারলে তোকে জানাবো।'
'ঠিক আছে। তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমার পরিচিত আরও কেউ কেউ যাবে শুনেছি। তুই গেলে দু'জনে আগেই চলে যাবো। দু'একদিন এদিক সেদিক বেড়ানো যাবে।'
কয়েক দিন পর বন্ধু আমার বাড়িতে হাজির। 'দোস্ত, টাকা জোগাড় হয়ে গেছে। পাসপোর্টও করে ফেলেছি। তুই ভিসার জন্য কবে যাবি?'
'আজকালের মধ্যেই চল। সময় তো বেশি নেই।'
আমরা কম খরচে যাওয়ার জন্য কলকাতা-মাদ্রাজ হয়ে শ্রীলংকা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সে অনুযায়ী ভারতের ট্রানজিট ভিসা নিলাম। কলকাতা যাবো বিমানে। সেখান থেকে ট্রেনে মাদ্রাজ (বর্তমান চেন্নাই)। মাদ্রাজ থেকে ট্রেনে রামেস্বরম। রামেস্বরম থেকে জাহাজে শ্রীলংকা।
একদিন বন্ধুর টেলিফোন, 'দোস্ত, তুই যখন বিমানের টিকিট কাটবি, আমার জন্যও একটা নিয়ে নিস। আমি তোকে টাকা দিয়ে দেবো। তুই ভাবিস না। আমি বিশ হাজার টাকা জোগাড় করেছি। পুরো টাকাটাই তোর হাতে দিয়ে দেবো। তুই খরচ করিস। যা খরচ হবে, পরে আমরা আধাআধি ভাগ করে নেবো।'
কলকাতা রওনা হবার আগ পর্যন্ত বন্ধুটি টেলিফোনেই যোগাযোগ রাখছিলো। বললো, 'এয়ারপোর্টে তো দেখা হচ্ছেই। এয়ারপোর্টেই টাকাটা আমি দিয়ে দেবো।'
এয়ারপোর্টে দেখা হলো। কিন্তু তখন কাস্টমস-ইমেগ্রেশন নিয়ে আমরা ব্যস্ত। আমি ভাবলাম, অসুবিধার তো কিছু নেই। কলকাতা গিয়েই ডলার আর বিমান ভাড়ার টাকাটা নিয়ে নেবো। আমরা লাউঞ্জে বসে আছি। কী মনে করে আমি বন্ধুটিকে বললাম, 'দোস্ত টাকাটা এবার দিয়ে দে।'
বন্ধু ইতিউতি তাকিয়ে বললো, 'এখনি দিতে হবে?'
'এখন দিতে সমস্যা কী? ২০০ ডলার আর বিমানের টিকিট বাবদ ১২ হাজার ৩০০ টাকা দিবি।'
বন্ধুটি ইতস্তত করতে লাগলো, 'কলকাতা গিয়ে দেই?'
'কেন, এখন কী সমস্যা?' আমি বললাম।
'না, মানে...।' বন্ধুটি তোতলাতে শুরু করলো। 'মানে, টাকাটা ঠিক জোগাড় হয়নি। কলকাতা গিয়ে দিতে পারবো।'
আমি তখন রেগে গেলাম, 'কলকাতা তোর কে আছে? কে ওখানে টাকা নিয়ে বসে আছে, বল?'
বন্ধু মোচড়াতে শুরু করলো, 'আসলে আমি আমার বড় ভাইয়ের কাছে ১৫ হাজার টাকা চেয়েছিলাম। উনি তো ব্যবসা করেন। কলকাতার এক লোকের কাছে উনি অনেক টাকা পান। তো তার সঙ্গে উনি কথা বলে রেখেছেন। ওখানে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করলে উনি ১৫ হাজার টাকা আমাকে দেবেন।'
আমি বিশ্বাস করলাম।
কলকাতা গিয়ে আমি কলকাতা-মাদ্রাজের দুটো টিকিট কিনলাম। আমি হোটেলে ফিরলাম। আমার বন্ধু টাকার খোঁজে গেলো! অন্তত আমাকে সে রকমই বলে গেলো।
ফিরলো দুখী একটা চেহারা নিয়ে।
'কী হলো? টাকা পাসনি?'
বন্ধু বললো, 'না। উনি বললেন, সাত-আটদিন পর টাকা দিতে পারবেন। আমরা তো কলকাতা হয়েই ফিরবো। তখন তোকে আমি টাকাটা দিতে পারবো।'
আমি বিশ্বাস করলাম।
শ্রীলংকা থেকে কলকাতা এবং কলকাতা থেকে ঢাকায় আমরা ফিরে এসেছিলাম। কিন্তু সেই টাকা আমি পাইনি। আজও পাইনি।
তিনি একজন তরুণ কবি। কোনো এক অনুষ্ঠানেই আরেক তরুণ কবির মাধ্যমে আলাপ। বয়সে আমার বছর দু'তিনেকের বড়। অল্প ক'দিনের আলাপেই আমার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা বেড়ে গেলো। তরুণ কবির থাকার জায়গা নেই। আজ এখানে তো কাল সেখানে তার দিন কাটছে। হলে জায়গা পাচ্ছেন না। শুনে আমার মন খারাপ হয়ে গেলো।
আমি একদিন বললাম, 'আপনার খুব অসুবিধা হলে আমার বাসায় থাকতে পারেন। যদিও এক বিছানায় তিনজনকে কষ্ট করে থাকতে হবে।'
তিনি আবেগে প্রায় কেঁদে ফেললেন। জড়িয়ে ধরলেন আমাকে।
বললেন, 'ফরিদ, ঢাকায় প্রকৃত মানুষ খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন। তুমি একজন খাঁটি মানুষ! আমার সত্যিকারের বন্ধু।'
তিনি আমাদের বাসায় উঠলেন। আমি আর আমার অনুজ তখন এক বিছানায় ঘুমোতাম। তিনিও সেখানে যুক্ত হলেন। অবসর সময়ে আমরা একসঙ্গেই ঘুরতাম। একে অপরের কবিতারও ছিলাম প্রায় প্রথম পাঠক! বছর দেড়েক পরে তিনি সরকারি ডরমিটরিতে উঠে গেলেন। কিন্তু আমাদের বন্ধুত্ব অটুট থাকলো।
১৯৮৫ সালে আমি নিজের একটা কবিতার বই বের করার উদ্যোগ নিলাম। তখন আমি পড়াশোনার পাশাপাশি একটা ছোট অ্যাড ফার্ম দিয়েছি। ছোটখাট প্রিন্টিংয়ের কাজও করি। ভালোই আয় হয়। আমার বই বেরোচ্ছে শুনে কবিবন্ধু বললেন, ' চার ফর্মার একটা বই করতে কী রকম টাকা লাগবে?'
আমি বললাম, টাকার অংকটা একটু বেশিই। কারণ আমার প্রথম বইয়ে থাকছে চার রঙা প্রচ্ছদ। ছাপতে দিয়েছি ঢাকা ফাইন আর্ট প্রেসের মতো অভিজাত প্রেসে। আমার বইয়ের প্রচ্ছদ করে দিয়েছেন পূর্ণেন্দু পত্রী।
সে সময় ঢাকায় চার রঙা অফসেটে প্রচ্ছদ ছাপার কথা কেউ কল্পনাও করতে পারতেন না। আমি কল্পনা করলাম। এবং সে অনুযায়ী বই ছাপার উদ্যোগও নিলাম।
কবিবন্ধু আমার পেছনে সেঁটে রইলেন।
দ্রুত স্ক্রিপ্ট তৈরি করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, 'তোমার বই বেরোবে, আর আমার বেরোবে না_ তা কী করে হয়! তুমি ব্যবস্থা করো। টাকা যা লাগবে আমি দেবো।'
আমি তার বইও ছাপার জন্য প্রেসে দিলাম।
আমাদের বই যথাসময়ে বের হলো। বই বের করতে গিয়ে আমার ব্যবসার সমস্ত নগদ টাকা লগি্ন করতে হয়েছিলো। কবিবন্ধুকে বললাম, 'এবার আপনার বইয়ের টাকাটা দিলে ভালো হয়।' বন্ধু বললেন, 'দেশের বাড়িতে আমাদের কিছু জমি বিক্রির চেষ্টা চলছে। বিক্রি হয়ে গেলেই আমার হাতে টাকা এসে যাবে। তখন দিতে পারবো। এখন তো অতো টাকা আমি দিতে পারবো না।'
শুনে ঘাবড়ে গেলাম!
তিনি বললেন, 'ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আগামী মাস নাগাদ হয়ে যাবে।'
আমি প্রতি মাসে তার কাছে ধরনা দেই। তিনি জানান, 'জমি এখনো বিক্রি হয়নি।'
আমি প্রচণ্ড বিপদে পড়লাম। নগদ টাকার অভাবে অ্যাড ফার্মে কোনো কাজ করতে পারছিলাম না। আমি ভাবলাম, ঠিক আছে, একটা মাসই তো। আগামী মাসে টাকা পেলে পুরোদমে কাজ শুরু করবো।
কবিবন্ধুর কাছে প্রতি মাসেই একবার যাই।
তিনি বলেন, 'আগামী মাসে দেখা করো। একটা কিছু এবার হবেই।'
মাসের পর মাস যেতে থাকে। আমার ফার্মে কাজকর্ম বন্ধ। আমি ঘর ভাড়া দিতে পারি না। কর্মচারীদের বেতন দিতে পারি না। টেলিফোন বিল দিতে পারি না। এগুলো জমতে জমতে পাহাড় হয়ে গেলো। আমি কয়েকজন বন্ধুর কাছ থেকে ধার করে কিছু ভাড়া বাবদ দিলাম। কিছু কর্মচারীদের দিলাম। কিছু নিজে খরচ করলাম। মাস যায় আর আমার ঋণ বাড়তে থাকে। আমি এক অবিশ্বাস্য খারাপ পরিস্থিতিতে পড়লাম। ঋণে আমি আমুণ্ডু ডুবে গেলাম।
যাদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছি তাদের টাকাও ফেরত দিতে পারছি না। একদিন তাদেরই একজন আমার বাড়িতে এসে হাজির। 'টাকা দে। আজ রক্ত বিক্রি করে হলেও টাকা দিতে হবে।'
আমি বললাম, 'ভাই রে, আমার বিষ কেনারও টাকা নেই।'
তিনি বললেন, 'এসব বলে লাভ নেই। আমাকে আজ এক্ষুণি টাকা দিতে হবে। টাকা না নিয়ে আমি যাচ্ছি না। আমার সঙ্গে চল, রক্ত বিক্রি করে হলেও টাকা আমাকে আজ দিতে হবে।'
আমি ওর সঙ্গে বেরোলাম। শাহবাগ এসে ঋণদাতা আমাকে বললো, 'ঠিক আছে, আমি আজ গেলাম। কিন্তু আগামী রোববার আমি আবার আসবো। টাকা রেডি রাখিস।'
অপমানে আমার শরীর কাঁপছিলো। আমি বুঝলাম, আমি এমন এক কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছি, যেখান থেকে মৃত্যুই হতে পারে উদ্ধার পাওয়ার একমাত্র উপায়। শাহবাগের দুই ফার্মেসি থেকে দুই পাতা ঘুমে বড়ি কিনলাম এবং একটা হোটেলে ঢুকে তার সবটা খেয়ে ফেললাম।
সেখানে কবিবন্ধুদের অনেকেই আড্ডা দিতে আসতেন। সেদিনও অনেকেই ছিলেন। ছিলেন সেই কবিবন্ধুটিও, যিনি আমার বাসায় কাটিয়েছেন এক বছরেরও বেশি সময়। যার বইয়ের পেছনে লগি্ন করা টাকা আমি ফেরত তখনো পাইনি। আড্ডা দিতে আসা দু'একজন কবির সঙ্গে আমার শুভেচ্ছা বিনিময়ও হয়েছিলো। তারা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি কী ঘটতে যাচ্ছে! আমিও তো মানুষই। মুখ দেখে মানুষকে বোঝার সাধ্য কার আছে!
এক সময় আমি ঢলে পড়লাম।
মুখোশের ভিড়ে কিছু মুখও হয়তো থাকে। সেদিন সত্তরের দশকের অপর এক কবিবন্ধু আমাকে আরেকজনের সহায়তায় হাসপাতালে নিয়ে যান। সে যাত্রায় আমি মরতে গিয়েও বেঁচে যাই।
গয়না চুরির ঘটনায় আমার মা নিদারুণ দুঃখ পেয়েছিলেন। তার ছেলে হয়ে আমি এ রকম একটা কাজ করতে পারি_ সেটা তার জন্য ছিলো অবিশ্বাস্য।
আমাদের চারপাশে কারটা মুখ আর, কারটা মুখের আদলে আসলে মুখোশ, তা বোঝা বেশ শক্ত। চারপাশে সত্যিকারের কোনো মুখ কস্ফচিৎ চোখে পড়ে। ডাক্তার, ডাক্তার কি-না, সাংবাদিক সাংবাদিক কি-না, মুক্তিযোদ্ধা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা কি-না_ কে বলতে পারে! মানুষ এখন প্রকৃতই মানুষ আছে কিনা তাই বা কে বলতে পারে! মানুষ হয়ে উঠেছে হিংস্র যে কোনো প্রাণীর চাইতেও ভয়ঙ্কর!
লেখালেখি, সাংবাদিকতা আর কর্মসূত্রে কতো লোকের সঙ্গেই না মিশেছি। কিন্তু সব জায়গাতেই মুখোশের ভিড়। সেই ভিড়ে আমার নিজের মুখও আসলে দেখা যাচ্ছে না। আবছা যে মুখটা আমার দেখা যাচ্ছে, সেটাও হয়তো কোনো মুখোশই, যদিও দেখতে হুবহু মুখের মতোই!
অনেকে হয়তো আরও অনেক আগেই বুঝতে পারেন, কিন্তু মানুষ হবার বিষয়টি বুঝতে আমার অনেক সময় লেগেছে! কাজেই মানুষ হয়ে উঠবার প্রক্রিয়াটিও আমার মধ্যে শুরু হয়েছে কিছুটা দেরিতেই! মানুষের আসলে সুবিধা অনেক। সে ইচ্ছে করলেই অন্য কিছু একটা হয়ে উঠতে পারে! একটা কুকুর বা বেড়ালের সে সুযোগ বা ক্ষমতা নেই! একটা কুকুর ইচ্ছে করলেই হাতি হতে পারে না! একটা বেড়াল চাইলেই বাঘ হতে পারে না। মানুষ তার মুখের আদল অবিকৃত রেখেও তার স্বভাববশে হয়ে উঠতে পারে অন্য কিছু! এর জন্য তার মুখোশ পরার দরকার পড়ে না। মুখোশ পরার প্রয়োজন তার নেই বলেই মানুষকে ঠিক চেনা যায় না। ভয়টা সেখানেই।
মুখোশের উৎপত্তি কীভাবে হয়েছিলো আমার জানা নেই। তবে উইকিপিডিয়া বলছে, আদিকালে মানুষ বিভিন্ন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মুখোশ পরতো। এ ছাড়া, কোনো কারণে নিজেকে রক্ষার জন্য বা পরিচয় গোপন করতে মানুষ মুখোশ পরতো বা ছদ্মবেশ ধারণ করতো।
আদিকালের মানুষ এক অর্থে বোকাই ছিলো! ছদ্মবেশ ধরতে বা পরিচয় গোপন করতে তার মুখোশের দরকার হতো। বর্তমানকালের মানুষ যথেষ্ট বুদ্ধিমান। ছদ্মবেশ ধরতে বা পরিচয় গোপন করতে তার মুখোশের দরকার হয় না।
দেশপ্রেমিকের পোশাকে অনেক দেশদ্রোহী, অনেক রাজাকার আমরা দেখেছি। প্রেমিক বা প্রেমিকার পরিচয়ে প্রতারণার ঘটনা কার জীবনে ঘটেনি! যাকে বন্ধু হিসেবে জানি, সে বন্ধুর ছদ্মবেশে প্রতারক বা ঘাতক কি-না তা জানার উপায় নেই। বাঘ বা সাপ থেকে বাঁচার জন্য মানুষ নানা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু ভাই বা বন্ধুর ছদ্মাবরণে যে শত্রু বা ঘাতক মানুষের পাশেই ছোবল মারার জন্য ওঁৎ পেতে আছে, তার থেকে নিজেকে মানুষ বাঁচাবে কীভাবে?
একটা-দুটো ঘটনা বলি। এতে মুখ ও মুখোশের তফাত হয়তো কিছুটা স্পষ্ট হতে পারে।
১৯৮৩ সালের ঘটনা। শ্রীলংকা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি সেখানে একটা ইউথ কনফারেন্সে যোগ দিতে। শুনে আমার এক বন্ধু বললো, 'আমিও ইনভাইটেশন পেয়েছি। কী পরিমাণ টাকা লাগবে বল তো? '
আমি বললাম, 'পনেরো-কুড়ি হাজার হলেই চলবে।'
বন্ধু বললো, 'তুই এতো টাকা কোত্থেকে জোগাড় করলি?'
বললাম, 'টুকটাক ব্যবসা করার জন্য আমার মার কাছ থেকে আমি হাজার ত্রিশেক টাকা নিয়েছি। আপাতত সেখান থেকেই খরচ করবো।'
আসলে টাকাটা আমি জোগাড় করেছি অন্যভাবে। আমার বাবা সামান্য চাকরি করেন। তার আয় খুবই সীমিত। বিদেশ ঘোরার জন্য আমাকে পনেরো হাজার টাকা দেয়ার সঙ্গতি তার নেই।
আমি গোপনে আলমারি থেকে আমার মায়ের কিছু গহনা সরালাম! সেগুলি তাঁতিবাজারে নিয়ে বিক্রি করে ২৭ হাজার টাকা পেলাম। সে সময়ে আমি শ্রীলংকা যাওয়ার জন্য এমনই অন্ধ হয়ে পড়েছিলাম, আমি যে মারাত্মক অন্যায় করছি_ তা বুঝতে পারছিলাম না।
এ গয়নাগুলো আমার মা সারাজীবন ধরে তিল তিল করে তৈরি করেছেন। তিনি যখন এটা জানতে পারবেন তখন কতোটা দুঃখ পাবেন তা আমি আন্দাজ করতে পারিনি।
কিন্তু তখন এসব কিছুই মাথায় আসেনি।
বন্ধুকে বললাম, 'আপাতত ব্যবসার টাকা থেকে হাজার বিশেক টাকা নিয়ে রওনা দেবো।'
'তাহলে তো তোর প্রবেল্গম সলভ্ড। আমার কিছু জমানো টাকা আছে। দশ-বারো হাজার হবে। দেখি বাকি টাকা জোগাড় করতে পারি কি-না। পারলে তোকে জানাবো।'
'ঠিক আছে। তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমার পরিচিত আরও কেউ কেউ যাবে শুনেছি। তুই গেলে দু'জনে আগেই চলে যাবো। দু'একদিন এদিক সেদিক বেড়ানো যাবে।'
কয়েক দিন পর বন্ধু আমার বাড়িতে হাজির। 'দোস্ত, টাকা জোগাড় হয়ে গেছে। পাসপোর্টও করে ফেলেছি। তুই ভিসার জন্য কবে যাবি?'
'আজকালের মধ্যেই চল। সময় তো বেশি নেই।'
আমরা কম খরচে যাওয়ার জন্য কলকাতা-মাদ্রাজ হয়ে শ্রীলংকা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সে অনুযায়ী ভারতের ট্রানজিট ভিসা নিলাম। কলকাতা যাবো বিমানে। সেখান থেকে ট্রেনে মাদ্রাজ (বর্তমান চেন্নাই)। মাদ্রাজ থেকে ট্রেনে রামেস্বরম। রামেস্বরম থেকে জাহাজে শ্রীলংকা।
একদিন বন্ধুর টেলিফোন, 'দোস্ত, তুই যখন বিমানের টিকিট কাটবি, আমার জন্যও একটা নিয়ে নিস। আমি তোকে টাকা দিয়ে দেবো। তুই ভাবিস না। আমি বিশ হাজার টাকা জোগাড় করেছি। পুরো টাকাটাই তোর হাতে দিয়ে দেবো। তুই খরচ করিস। যা খরচ হবে, পরে আমরা আধাআধি ভাগ করে নেবো।'
কলকাতা রওনা হবার আগ পর্যন্ত বন্ধুটি টেলিফোনেই যোগাযোগ রাখছিলো। বললো, 'এয়ারপোর্টে তো দেখা হচ্ছেই। এয়ারপোর্টেই টাকাটা আমি দিয়ে দেবো।'
এয়ারপোর্টে দেখা হলো। কিন্তু তখন কাস্টমস-ইমেগ্রেশন নিয়ে আমরা ব্যস্ত। আমি ভাবলাম, অসুবিধার তো কিছু নেই। কলকাতা গিয়েই ডলার আর বিমান ভাড়ার টাকাটা নিয়ে নেবো। আমরা লাউঞ্জে বসে আছি। কী মনে করে আমি বন্ধুটিকে বললাম, 'দোস্ত টাকাটা এবার দিয়ে দে।'
বন্ধু ইতিউতি তাকিয়ে বললো, 'এখনি দিতে হবে?'
'এখন দিতে সমস্যা কী? ২০০ ডলার আর বিমানের টিকিট বাবদ ১২ হাজার ৩০০ টাকা দিবি।'
বন্ধুটি ইতস্তত করতে লাগলো, 'কলকাতা গিয়ে দেই?'
'কেন, এখন কী সমস্যা?' আমি বললাম।
'না, মানে...।' বন্ধুটি তোতলাতে শুরু করলো। 'মানে, টাকাটা ঠিক জোগাড় হয়নি। কলকাতা গিয়ে দিতে পারবো।'
আমি তখন রেগে গেলাম, 'কলকাতা তোর কে আছে? কে ওখানে টাকা নিয়ে বসে আছে, বল?'
বন্ধু মোচড়াতে শুরু করলো, 'আসলে আমি আমার বড় ভাইয়ের কাছে ১৫ হাজার টাকা চেয়েছিলাম। উনি তো ব্যবসা করেন। কলকাতার এক লোকের কাছে উনি অনেক টাকা পান। তো তার সঙ্গে উনি কথা বলে রেখেছেন। ওখানে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করলে উনি ১৫ হাজার টাকা আমাকে দেবেন।'
আমি বিশ্বাস করলাম।
কলকাতা গিয়ে আমি কলকাতা-মাদ্রাজের দুটো টিকিট কিনলাম। আমি হোটেলে ফিরলাম। আমার বন্ধু টাকার খোঁজে গেলো! অন্তত আমাকে সে রকমই বলে গেলো।
ফিরলো দুখী একটা চেহারা নিয়ে।
'কী হলো? টাকা পাসনি?'
বন্ধু বললো, 'না। উনি বললেন, সাত-আটদিন পর টাকা দিতে পারবেন। আমরা তো কলকাতা হয়েই ফিরবো। তখন তোকে আমি টাকাটা দিতে পারবো।'
আমি বিশ্বাস করলাম।
শ্রীলংকা থেকে কলকাতা এবং কলকাতা থেকে ঢাকায় আমরা ফিরে এসেছিলাম। কিন্তু সেই টাকা আমি পাইনি। আজও পাইনি।
তিনি একজন তরুণ কবি। কোনো এক অনুষ্ঠানেই আরেক তরুণ কবির মাধ্যমে আলাপ। বয়সে আমার বছর দু'তিনেকের বড়। অল্প ক'দিনের আলাপেই আমার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা বেড়ে গেলো। তরুণ কবির থাকার জায়গা নেই। আজ এখানে তো কাল সেখানে তার দিন কাটছে। হলে জায়গা পাচ্ছেন না। শুনে আমার মন খারাপ হয়ে গেলো।
আমি একদিন বললাম, 'আপনার খুব অসুবিধা হলে আমার বাসায় থাকতে পারেন। যদিও এক বিছানায় তিনজনকে কষ্ট করে থাকতে হবে।'
তিনি আবেগে প্রায় কেঁদে ফেললেন। জড়িয়ে ধরলেন আমাকে।
বললেন, 'ফরিদ, ঢাকায় প্রকৃত মানুষ খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন। তুমি একজন খাঁটি মানুষ! আমার সত্যিকারের বন্ধু।'
তিনি আমাদের বাসায় উঠলেন। আমি আর আমার অনুজ তখন এক বিছানায় ঘুমোতাম। তিনিও সেখানে যুক্ত হলেন। অবসর সময়ে আমরা একসঙ্গেই ঘুরতাম। একে অপরের কবিতারও ছিলাম প্রায় প্রথম পাঠক! বছর দেড়েক পরে তিনি সরকারি ডরমিটরিতে উঠে গেলেন। কিন্তু আমাদের বন্ধুত্ব অটুট থাকলো।
১৯৮৫ সালে আমি নিজের একটা কবিতার বই বের করার উদ্যোগ নিলাম। তখন আমি পড়াশোনার পাশাপাশি একটা ছোট অ্যাড ফার্ম দিয়েছি। ছোটখাট প্রিন্টিংয়ের কাজও করি। ভালোই আয় হয়। আমার বই বেরোচ্ছে শুনে কবিবন্ধু বললেন, ' চার ফর্মার একটা বই করতে কী রকম টাকা লাগবে?'
আমি বললাম, টাকার অংকটা একটু বেশিই। কারণ আমার প্রথম বইয়ে থাকছে চার রঙা প্রচ্ছদ। ছাপতে দিয়েছি ঢাকা ফাইন আর্ট প্রেসের মতো অভিজাত প্রেসে। আমার বইয়ের প্রচ্ছদ করে দিয়েছেন পূর্ণেন্দু পত্রী।
সে সময় ঢাকায় চার রঙা অফসেটে প্রচ্ছদ ছাপার কথা কেউ কল্পনাও করতে পারতেন না। আমি কল্পনা করলাম। এবং সে অনুযায়ী বই ছাপার উদ্যোগও নিলাম।
কবিবন্ধু আমার পেছনে সেঁটে রইলেন।
দ্রুত স্ক্রিপ্ট তৈরি করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, 'তোমার বই বেরোবে, আর আমার বেরোবে না_ তা কী করে হয়! তুমি ব্যবস্থা করো। টাকা যা লাগবে আমি দেবো।'
আমি তার বইও ছাপার জন্য প্রেসে দিলাম।
আমাদের বই যথাসময়ে বের হলো। বই বের করতে গিয়ে আমার ব্যবসার সমস্ত নগদ টাকা লগি্ন করতে হয়েছিলো। কবিবন্ধুকে বললাম, 'এবার আপনার বইয়ের টাকাটা দিলে ভালো হয়।' বন্ধু বললেন, 'দেশের বাড়িতে আমাদের কিছু জমি বিক্রির চেষ্টা চলছে। বিক্রি হয়ে গেলেই আমার হাতে টাকা এসে যাবে। তখন দিতে পারবো। এখন তো অতো টাকা আমি দিতে পারবো না।'
শুনে ঘাবড়ে গেলাম!
তিনি বললেন, 'ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আগামী মাস নাগাদ হয়ে যাবে।'
আমি প্রতি মাসে তার কাছে ধরনা দেই। তিনি জানান, 'জমি এখনো বিক্রি হয়নি।'
আমি প্রচণ্ড বিপদে পড়লাম। নগদ টাকার অভাবে অ্যাড ফার্মে কোনো কাজ করতে পারছিলাম না। আমি ভাবলাম, ঠিক আছে, একটা মাসই তো। আগামী মাসে টাকা পেলে পুরোদমে কাজ শুরু করবো।
কবিবন্ধুর কাছে প্রতি মাসেই একবার যাই।
তিনি বলেন, 'আগামী মাসে দেখা করো। একটা কিছু এবার হবেই।'
মাসের পর মাস যেতে থাকে। আমার ফার্মে কাজকর্ম বন্ধ। আমি ঘর ভাড়া দিতে পারি না। কর্মচারীদের বেতন দিতে পারি না। টেলিফোন বিল দিতে পারি না। এগুলো জমতে জমতে পাহাড় হয়ে গেলো। আমি কয়েকজন বন্ধুর কাছ থেকে ধার করে কিছু ভাড়া বাবদ দিলাম। কিছু কর্মচারীদের দিলাম। কিছু নিজে খরচ করলাম। মাস যায় আর আমার ঋণ বাড়তে থাকে। আমি এক অবিশ্বাস্য খারাপ পরিস্থিতিতে পড়লাম। ঋণে আমি আমুণ্ডু ডুবে গেলাম।
যাদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছি তাদের টাকাও ফেরত দিতে পারছি না। একদিন তাদেরই একজন আমার বাড়িতে এসে হাজির। 'টাকা দে। আজ রক্ত বিক্রি করে হলেও টাকা দিতে হবে।'
আমি বললাম, 'ভাই রে, আমার বিষ কেনারও টাকা নেই।'
তিনি বললেন, 'এসব বলে লাভ নেই। আমাকে আজ এক্ষুণি টাকা দিতে হবে। টাকা না নিয়ে আমি যাচ্ছি না। আমার সঙ্গে চল, রক্ত বিক্রি করে হলেও টাকা আমাকে আজ দিতে হবে।'
আমি ওর সঙ্গে বেরোলাম। শাহবাগ এসে ঋণদাতা আমাকে বললো, 'ঠিক আছে, আমি আজ গেলাম। কিন্তু আগামী রোববার আমি আবার আসবো। টাকা রেডি রাখিস।'
অপমানে আমার শরীর কাঁপছিলো। আমি বুঝলাম, আমি এমন এক কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছি, যেখান থেকে মৃত্যুই হতে পারে উদ্ধার পাওয়ার একমাত্র উপায়। শাহবাগের দুই ফার্মেসি থেকে দুই পাতা ঘুমে বড়ি কিনলাম এবং একটা হোটেলে ঢুকে তার সবটা খেয়ে ফেললাম।
সেখানে কবিবন্ধুদের অনেকেই আড্ডা দিতে আসতেন। সেদিনও অনেকেই ছিলেন। ছিলেন সেই কবিবন্ধুটিও, যিনি আমার বাসায় কাটিয়েছেন এক বছরেরও বেশি সময়। যার বইয়ের পেছনে লগি্ন করা টাকা আমি ফেরত তখনো পাইনি। আড্ডা দিতে আসা দু'একজন কবির সঙ্গে আমার শুভেচ্ছা বিনিময়ও হয়েছিলো। তারা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি কী ঘটতে যাচ্ছে! আমিও তো মানুষই। মুখ দেখে মানুষকে বোঝার সাধ্য কার আছে!
এক সময় আমি ঢলে পড়লাম।
মুখোশের ভিড়ে কিছু মুখও হয়তো থাকে। সেদিন সত্তরের দশকের অপর এক কবিবন্ধু আমাকে আরেকজনের সহায়তায় হাসপাতালে নিয়ে যান। সে যাত্রায় আমি মরতে গিয়েও বেঁচে যাই।
গয়না চুরির ঘটনায় আমার মা নিদারুণ দুঃখ পেয়েছিলেন। তার ছেলে হয়ে আমি এ রকম একটা কাজ করতে পারি_ সেটা তার জন্য ছিলো অবিশ্বাস্য।
আমাদের চারপাশে কারটা মুখ আর, কারটা মুখের আদলে আসলে মুখোশ, তা বোঝা বেশ শক্ত। চারপাশে সত্যিকারের কোনো মুখ কস্ফচিৎ চোখে পড়ে। ডাক্তার, ডাক্তার কি-না, সাংবাদিক সাংবাদিক কি-না, মুক্তিযোদ্ধা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা কি-না_ কে বলতে পারে! মানুষ এখন প্রকৃতই মানুষ আছে কিনা তাই বা কে বলতে পারে! মানুষ হয়ে উঠেছে হিংস্র যে কোনো প্রাণীর চাইতেও ভয়ঙ্কর!
লেখালেখি, সাংবাদিকতা আর কর্মসূত্রে কতো লোকের সঙ্গেই না মিশেছি। কিন্তু সব জায়গাতেই মুখোশের ভিড়। সেই ভিড়ে আমার নিজের মুখও আসলে দেখা যাচ্ছে না। আবছা যে মুখটা আমার দেখা যাচ্ছে, সেটাও হয়তো কোনো মুখোশই, যদিও দেখতে হুবহু মুখের মতোই!
No comments