মুখোশমুখর by শুভাশিস সিনহা
বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ/খুঁজিতে যাই না আর... _জীবনানন্দ দাশ
ভাবনা ছিল মুখোশ নিয়ে, কথায় আগে আগে চলে এলো 'মুখ'। এর মানে দাঁড়াল মুখোশের আগে মুখই আসে, যদিও বাহ্যত মুখোশের নিচেই থাকে মুখ। কেমন জানি ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাপার হয়ে গেল। মুখ আগে না মুখোশ আগে, তার ফয়সালা হওয়ার আগে এটুকু নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, মুখ আর মুখোশ পরস্পর যুক্ত। মুখোশটা তো মুখের ওপরই পরতে হয়। সুতরাং মুখ না থাকলে মুখোশও থাকতে পারে না। কিন্তু অনেকদিন ধরে মুখোশ লাগানো থাকলে মুখ যে আছে, তা-ই হয়তো একসময় ভুলে যাওয়ার শঙ্কা থাকে। বাংলার মুখ দেখে দেখে জীবনানন্দ তৃপ্ত না-কি ক্লান্ত-আজ সেটা ভাবার বিষয়। লাইন দুটির মধ্যে একটা ডিকশনাল কন্ট্রোভার্সি আছে। প্রথমবার 'মুখ' বলে দ্বিতীয়বার বলেছেন 'রূপ'। কেন 'পৃথিবীর মুখ' হলো না বা কেন 'বাংলার রূপ' হলো না। যদি হতো 'বাংলার রূপ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর', তাহলে কোনো ধাঁধা থাকত না। এখানে মুখের সঙ্গে রূপের সমার্থকতা বোঝাচ্ছেন। অর্থাৎ বিষয়টা এভাবে ভাবা যায়, বাংলার মুখ এত ব্যাপ্ত, এত বিচিত্র, পৃথিবীর মহা মহাব্যাপার ধারণ করা বিশাল রূপটা আর না দেখলেও ক্ষতি নেই। আর জীবনানন্দ বাংলার প্রকৃতির, লোকজীবনের ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে খুঁজে পেয়েছিলেন অনন্য সৌন্দর্য, বৈচিত্র্য, রূপমাধুরী। আজ এ কবিতা আমাদের কাছে বোধহয় স্বতই প্যারোডি হয়ে এসেছে। আজকের বাংলাদেশ তার যে অবিশ্বাস্য নিয়ত করুণ নিষ্ঠুর বীভৎস মুখ নিয়ে হাজির হচ্ছে তাতে পৃথিবীর অন্য দেশগুলোর বিষয়ে আর নজর না দিলেও ক্ষতি নেই; দেশ আর রাষ্ট্রের বিস্ময়কর রূপ চিনে নিতে সমস্যা হবে না।
সেজন্যই মুখোশের লেখায় মুখের কথার কোট করলাম। এটা ধরে নিতে চেয়েছি যে, বাংলার ওই মুখের মধ্যে মুখোশের কথা আপনা-আপনিই ছিল, হয়তো বা ভবিষ্যপাঠে শ্লেষ হিসেবে বোঝার সম্ভাবনায়।
অর্থাৎ বাংলা যে মুখ নিয়ে আছে, তার ওপর এত এত অবিশ্বাস্য (কু) রূপ খেলা করে, পৃথিবীর রূপ আর বিশেষ কিছুই নয় তার কাছে! এই বাংলা তো আমাদেরই দেশ, বিমূর্ত কোনো জিনিস নয়। আমাদেরই নির্মাণ করা রাষ্ট্র। জীবনানন্দ আজকের বাংলাদেশে বেঁচে থাকলে হয়তো কবিতাটিকে শ্লেষাত্মক করেই হাজির করতেন। ঐতিহ্য ও গ্রামীণতার সৌন্দর্য খুঁজে ফেরা সেই অন্তর্মুখী কবি আজ নিশ্চয় দারুণভাবে প্রকাশবাদী হয়ে উঠতেন। মুখ নয়, বাংলা-ভরে কেবল মুখোশ দেখে ফিরতেন।
ভিনগাঁয়ের কবি অস্কারওয়াইল্ড তো লক্ষ কদম আগে বাড়লেন। শাদা দেশের কবি বলছেন, 'অ সধংশ ঃবষষং ঁং সড়ৎব ঃযধহ ধ ভধপব' সোজা কথায়, মুখের চেয়ে মুখোশ বড়। সেজন্যই বোধহয় ওনাদের দুনিয়ায় মুখোশের কায়কারবার শুরু হয়েছিল অনেক আগে। পালা, অপেরা, থিয়েটারে কারণে-অকারণে মুখোশ নিয়ে ঢোকার অভ্যাস তো দেখতেই পাই। উদ্ভট কিছু বোঝাতে হলে কিংবা মানুষের ভেতরকার স্বভাব-চরিত্র একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে এই কাজগুলো করতেন তারা, এখনও করেন। তাদের চেহারা-সুরত খুব ফর্সা, বাইরে দেখলে বোঝার উপায় খুব কম_ এত সুন্দর বর্ণে-গাত্রে লোকগুলো পিশাচ হতে পারে ক্যামনে? সাদা দিলে তাদের এত কাদা! সুযোগ পেলেই অভাগার গাই-বাছুর পর্যন্ত তুলে নিয়ে যেতে ফিরে ফিরে হানা দিয়েছে আমাদের দেশে। তাই তাদের জন্য মনে হয় মুখোশ না পরে ভেতরকার স্বভাব বোঝানো শিল্পকলার ছলাকলাতেও একটু কঠিন।
আমাদের তা লাগে না। আমরা মুখ দেখেই বুঝতে পারি তার ভেতরটা কেমন। আমাদের নাটকে তাই মুখোশ নেই। রবীন্দ্রনাথ গাইছেন, 'এসেছিলে তবু আস নাই জানায়ে গেলে ...' একেবারে ক্রিয়ার বিপ্রতীপ প্রতিক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন। মুখের ভাব-ভঙ্গির প্রশ্নের আরও ওপরে। যে আসে সে কি এসেছে_ এটাই সন্দেহ। সে কি আসলেই সে? আবার পরক্ষণে প্রশ্ন তুলছেন 'তোমার সে উদাসীনতা সত্য কিনা ...' উদাসীন হয়েও লাভ নেই। সেই উদাসীনতার ভেতর একেবারে চরম কৌতূহলের চোখ পিটপিট করছে কি-না, রহস্য।
তারপরও মুখোশ বললে আমরা সেই হৃদয়ের উল্টার্থক বিষয়-আশয় বুঝি না। খারাপ কিছুই ভাবি। এখন আমাদের অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, আমরা রাস্তাঘাটে মুখের চাইতে মুখোশই বেশি দেখি। দ্যাশ দ্যাশ বলে গলা ফাটাই বিয়ালি্লশ বছর ধরে। সেই দ্যাশের ভেতর দ্যাশ-বিরোধী মুখগুলো কী আনন্দে বেঁচে-বর্তে ছিল, টের পেয়েও পাইনি। সুতরাং মুখোশ না পরলেও আমাদের প্রাচ্যে মুখ খুব সহজে আড়াল করে রাখা যায়। এমনই আড়াল যে খোদ কোটি কোটি লোক, রাষ্ট্র, সমাজ কিচ্ছু তাকে ধরতে পারে না। তাই আমাদের দেশে আজ প্রকৃতিও মুখ বদলিয়ে রাখতে পারে। শীতকালেও অঝোরে নেমে পড়ে বৃষ্টি। বর্ষাকালে বৃষ্টি থাকে না, শরতে প্রায়ই নেমে আসে সাইক্লোন।
শোনা যায়, নয় হাজার বছর আগে প্রথম জেরুজালেমের ইসরায়েল মিউজিয়ামে মুখোশ পাওয়া গিয়েছিল। আদিকালের বুনো মানুষ জন্তু-জানোয়ারকে ফাঁদে ফেলার জন্য তাদেরই বেশ ধরত; জন্তুরা স্বজাতি মনে করে কাছে ভিড়লে চড়াও হতো দা-বল্লম নিয়ে। মুখোশের ধারণাটা এভাবেই নাকি সমাজে এসেছিল। আজকেও সে ধারণার বদল হয়নি, বরং প্রগাঢ়তর হয়েছে। শিকারকে ফাঁদে ফেলার জন্য মুখোশ কিংবা ছদ্মবেশের ব্যবহার আজ আরও ব্যাপক। তফাৎ একটাই, এখন মানুষের উদ্দিষ্ট শিকার আর সেই জন্তু-জানোয়ার নয়, খোদ মানুষই।
ইংরেজি মাস্ক শব্দটা নাকি ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম প্রচলন হয়। অর্থাৎ ষোড়শ শতকের শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে শব্দটার জন্মের একটা সম্পর্ক পাওয়া যাচ্ছে। শিল্প আর পণ্যসভ্যতাই মানুষের ভেতর ঠগবাজি, জোচ্চুরি, 'বাইরে এক ভিতরে আরেক' নিয়ে চলার সামাজিক শর্ত তৈরি করে দিয়েছিল। মহাত্মা রবীন্দ্রনাথও ইংরেজদের মুখোশকে মুখ বলে ভেবে নিয়েছিলেন। একটা কাল পর্যন্ত সেই মুখশ্রীতে মুগ্ধ থাকলেও জীবন-অন্তিমে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, সেই মুখ আসলে একটা মুখোশ। সে মুখোশের আড়ালে বের হয়ে পড়ে ইংরেজের আসল কদর্য, সাম্রাজ্যবাদী মুখ। তিনি আবিষ্কার করলেন, 'সমস্ত য়ূরোপে বর্বরতা কীরকম নখদন্ত বিকাশ করে বিভীষিকা বিস্তার করতে উদ্যত। এই মানবপীড়নের মহামারী পাশ্চাত্য সভ্যতার মজ্জার ভেতর থেকে জাগ্রত হয়ে উঠে আজ মানবাত্মার সামনে দিগন্ত থেকে দিগন্ত পর্যন্ত বাতাস কলুষিত করে দিয়েছে।'
বাহ্যত প্রায়শ রূপবাদী সেজে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর সব সাহিত্যে রূপসর্বস্বতাবিরোধী। কবিতাকে অনেকেই বলে থাকেন 'কবির মুখোশ'। কবি নিজেকে আড়াল করেন কবিতা দিয়ে। কিন্তু গদ্যকার বা কথাশিল্পী নিজেকে উন্মোচিত করেন তার গদ্য দিয়েই। রবীন্দ্রনাথের কাছে তা হয়তো সত্য নয়। তিনি পৌত্তলিকতাকে কবিতা বলতে নারাজ। যে পৌত্তলিকতা দূরার্থে মুখোশেরই নামান্তর। তিনি বলেছেন, 'কেহ কেহ পৌত্তলিকতাকে কবিতা হিসেবে দেখেন। তাঁহারা বলেন, কবিতাই পৌত্তলিকতা, পৌত্তলিকতাই কবিতা। আমাদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি অনুসারে আমরা ভাবমাত্রাকে আকার দিতে চাই। ভাবের সেই সাকার বাহ্যস্ফূর্তিকে কবিতা বলিতে পার বা পৌত্তলিকতা বলিতে পার। এইরূপ ভাবের বাহ্য প্রকাশ চেষ্টাকেই ভাবাভিনয়ন বলে।' তিনি জোরগলায় আপত্তি করছেন, 'কবিতা পৌত্তলিকতা নহে।'
এরপর নানান-বিনান যুক্তি-পরামর্শ দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন কবিতা অলঙ্কারশাস্ত্রের শাসনে গড়া কোনো আঙ্গিক নয়। কট্টর রূপবাদীরা সেটাকে অস্বীকার করেন। তারা কবিতাকে কবির মুখোশ প্রমাণ করেই ছাড়বেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ একাই লড়েছেন তার 'গীতাঞ্জলি'তে। জীবনের সহজ দার্শনিক ভাবনাকে অকপটে প্রকাশ করেছেন। ফল্গুধারার মতো ঝরে পড়েছে সেই বাণীনিচয়। রবীন্দ্রনাথের সব সাহিত্যই মানুষের মুখ খুঁজে বেড়িয়েছে। 'রাজা ও রানী'তে রানী যে যোদ্ধা-সৈনিকের ছদ্মবেশ নিয়ে রাজার সামনে দাঁড়ান, তা কিন্তু নিজের প্রকৃত মুখটি রাজার কাছে উন্মোচনের আকাঙ্ক্ষাতেই। 'চিত্রাঙ্গদা'র পুরুষরূপের ভেতরকার নারীসুলভ আকাঙ্ক্ষা আর তার উন্মোচন রবীন্দ্রনাথ লিঙ্গীয় মুক্তির মধ্য দিয়ে খোঁজেননি। খুঁজেছেন আরও গভীরে। সব জৈবিক পরিচয়ের ঊধর্ে্ব মানবিক সত্যতার সন্ধান করেছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ মুখোশ কিংবা ছদ্মবেশ, সোজা কথায় ছলনাকে অস্বীকার করতে চেয়েছেন সবসময়। 'গীতাঞ্জলি' যা কি-না সেই আইরনিক পাশ্চাত্যের কাছে পরম আদরের জিনিস হয়ে উঠল, তার মর্মে নিজের ভেতরের সত্যকে উন্মোচন করে পরম সত্তার সঙ্গে সহজে মিশে যাওয়ার আনন্দের কথাই বলা হয়েছে। এমনই সহজ, নিরাভরণ, প্রকৃত অন্তঃসত্তার খঁূজে বেড়িয়েছিলেন তিনি; মুখোশ তো দূরের কথা নিজের নামটাকে, শব্দের বর্মটাকেই তার প্রধান প্রতিবন্ধক ভাবতে শুরু করেছিলেন। নামটাই যেন তাঁর কাছে হয়ে উঠল মুখোশ। লিখলেন_
'আমার/নামটা দিয়ে ঢেকে রাখি যারে/মরছে সে এই নামের কারাগারে।/সকল ভুলে যতই দিবারাতি/নামটারে ওই আকাশ-পানে গাঁথি/ততই আমার নামের অন্ধকারে/হারাই আমার সত্য আপনারে।'
আমাদের নিশ্চয় চমকে উঠতে হয়। বিংশ শতকের এক কবি, যার চারপাশে শব্দ কিংবা ভাষাই হয়ে উঠছিল জনগণকে ঠুলি-পরাবার একটা উপচার (ষরঃবৎধৎু ফরংমঁরংব) এবং বিশ্বব্যাপী যখন সাহিত্যিক, বৌদ্ধিক অপরাধও ঘটতে শুরু করেছিল, তিনি তখন ব্যক্তি-মানুষের আপন স্বত্বকে ভুলে রিক্ত হয়ে নিজের আবিষ্কারের কথা বলেছেন। এই স্বত্বের জন্যই আগ্রাসন, সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতা। অথচ কত সহজেই তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন সবকিছুর বিরুদ্ধে; খুলে ফেলতে চাইলেন খোদ-নামের মুখোশ। একেবারে স্বত্বহীন হয়ে গিয়ে মিলতে চাইলেন সেই 'সর্বস্বত্বময়'-এর সঙ্গে। বললেন,
'নামটা যেদিন ঘুচাবে নাথ/বাঁচব সেদিন মুক্ত হয়ে/আপন-গড়া স্বপন হতে/তোমার মধ্যে জনম লয়ে।'
'বিনা নামের পরিচয়ে'ই তিনি বিশ্বমিলনে ধাইলেন। তিনি 'রূপ-সাগরে' ডুব দেন 'অরূপ-রতন' আশা করে। অর্থাৎ রূপের ভেতর থেকে প্রকৃত সত্যটির সন্ধান পাওয়ার জন্য। কিন্তু আমরা সেই সন্ধানের দিকে যাইনি। সেই সত্যের মুখ দেখা আজ যেন হয়ে উঠছে যোজন যোজন দূরযাত্রা। আমরা বারবার মুখোশকেই মুখ বলে ভুল করি। আর আমরা নিজেরাও এক একটা মুখোশ পরে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। কখনও চরম ক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে নির্লিপ্ততার মুখোশ, শোষিতের যন্ত্রণার পাশে নিখাদ ভদ্রলোকের নির্বিকার মুখোশ, ভেতরে অন্ধকারের আখড়া বানিয়ে রেখে মুখে আলোকিত মুখোশ, মনে অধর্মের নরক পুষে চরম ধার্মিকের মুখোশ। আমাদের কহতব্যও তাই নিজের স্বর ভুলে শ্রুতি আর বাখানের বাজারে অন্য কোনো আকর্ষক স্বর কিনে তার ভেতর দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করে।
রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার অমিত বলেছিল, 'ফ্যাশানটা হলো মুখোশ, স্টাইলটা হলো মুখশ্রী।' ওর মতে, 'যারা সাহিত্যের ওমরাও-দলের, যারা নিজের মন রেখে চলে, স্টাইল তাদেরই। আর যারা আমলা-দলের, দশের মন রাখা যাদের ব্যবসা, ফ্যাশান তাদেরই।' এখন মুখশ্রী নয়, মুখোশেরই জয়জয়কার। তাই স্টাইল নয়, ফ্যাশন নিয়ে প্রতিযোগিতা হয়, ফ্যাশন-হাউসে ভরে যায় আমাদের পণ্যশহর, কিন্তু স্টাইল কেউ চর্চা করে না। এখন ব্যক্তিত্বের সেই দীপ্তি আর সহজে কারও চোখে অনুপম অনুভূতি সৃষ্টি করে না। আমাদের সাহিত্যের অনেকাংশে যে হাল, আমাদের জীবনেও ঠিক তা-ই।
আমরা আধুনিকেরা কবিতাকে তৈরি করেছি মুখোশের মতো। আমাদের প্রকৃত মুখ থেকে নানা রঙে-রূপে-রেখায় সে ভিন্ন হয়। কবির নিজের মুখ, তার প্রকৃত দেশ, ভূমি, তার অনুভূতি, অভিব্যক্তি বোঝার নিজস্ব ধরনকে আমাদের ঔপনিবেশিক মন সবসময় ঠকাতে চেষ্টা করেছে। আমরা ভেবেছি এভাবে বললে হবে না। কবির আপন-মুখের ওপর চেপে বসেছে কবিতার পর-মুখোশ। কিন্তু এই ভাবের ছদ্মবেশ পরা মুখোশ পরাকেও পাশ্চাত্য অন্যভাবে দেখেছে। তার জীবনের বিপর্যাস তাকে ভাবতে বাধ্য করেছে অন্যভাবে। যেমন উইলিয়াম কনগ্রিভ তার কবিতাতেই বলছেন, 'মুখোশ কোনো সত্যকেই প্রকাশ করতে পারে না, পারে না কোনো মিথ্যাকে আড়াল করতে, বরং নগ্নতাই হচ্ছে আসল মুখোশ, প্রকৃত আড়াল।'
রবীন্দ্রনাথে যে অবগুণ্ঠন সরানোর কথা বারবার এসেছে, পাশ্চাত্যের কবিরা সেই অবগুণ্ঠনের মধ্যেই মুক্তির পথ খুঁজেছেন। এমনকি নগ্নতাও সেখানে প্রধান অবগুণ্ঠন!
ইয়েটস বললেন, 'শয়তান আমাদের কল্পনায় আসে, সকল ধর্মের মুখোশ পরে।' আমাদের চারপাশের যে ধর্মোন্মাদ মানুষের রূপ দেখছি, তাতে করে এ কথাকে কে ফেলে দিতে পারবে। মনে পড়ে কাফ্কার 'দ্য ট্রায়াল' উপন্যাসের কথা, যার নায়কের কাছে পুরো রাষ্ট্রটাকেই মনে হয়েছিল আইনের মুখোশ পরা একটা কয়েদখানা। সে আর সেখান থেকে বেরোবার কোনো পথ খুঁজে পায় না। ঠিক তেমনই 'স্যাটানিক ভার্সেস'-এ সালমান রুশদি আমাদের এই সভ্যতার ভয়ঙ্কর সংকটকে এভাবে পেশ করতে চেয়েছিলেন, 'আমাদের প্রত্যেকের মুখোশের নিচে একটা মুখোশ, তার নিচে আরও একটা মুখোশ, তারও নিচে আরেকটা... এভাবেই একটার পর একটা মুখোশ নিয়ে আমরা আবৃত থাকি, যতক্ষণ পর্যন্ত না হঠাৎ সেই রক্তহীন নগ্ন করোটি প্রকাশ পায়।' অর্থাৎ এতসব মুখোশের নিচে আর সেই মুখের চিহ্ন নেই। সেই অচল, জড় করোটিই রয়েছে। এমন এক ভয়াবহ অস্তিত্বের-সংকট, পরিচয়ের-ডিলেমা তৈরি করে রেখেছি আমরা দুনিয়ায়।
সিসেরোর সেই কথামৃত_ 'মুখ হচ্ছে আমাদের মনের প্রতিচ্ছবি, আর চোখ তার ব্যাখ্যাকারী'_ আজ একেবারে যেন ব্যর্থ, অসার বচন। কারও মুখ দেখে মনের কথা আজ আর কেউ বুঝতে পারে না, আর চোখ বাখান করতে পারে না সত্য কোনো কিছু। মনে পড়ে ঈশপের সেই কথা, 'একজন সন্দেহজনক বন্ধুর চাইতে একজন নিশ্চিত শত্রুই শ্রেয়। মানুষকে যে কোনো একটা রূপে চিনতে দাও। তারপর আমরা তার সাক্ষাৎ করব।' কিন্তু কই! চোখের সামনেই কত খুনি ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের সঙ্গেই তো রাস্তাঘাটে প্রতিদিন আমার দেখা হচ্ছে। তাদের অনেকেই কি 'বন্ধু' ছিল না আমার? আমাদের? কই, আমি তো চিনতে পারিনি। এত খুনি লুকানোর অন্ধকার আমাদের এই দেশে থাকার কথা নয়। নিশ্চয় তাদের মুখের ওপর রয়েছে নিজেকে লুকানোর এক একটা ম্যাজিক-মুখোশ।
অ-দৃশ্যতার মুখোশ পরে থাকা স্বতঃদৃশ্যমান 'রাজা'কে আলোয় পাওয়ার জন্য আর আমাদের রানী (সুদর্শনা)-সুলভ কোনো আকুতি নেই। কারণ, আলোর মুখোশপরা অন্ধকার-রাজার শাসনেই পৃথিবী চলছে আজ।
মানুষ আজকে তাই মুখ নয়, মুখোশমুখর।
ভাবনা ছিল মুখোশ নিয়ে, কথায় আগে আগে চলে এলো 'মুখ'। এর মানে দাঁড়াল মুখোশের আগে মুখই আসে, যদিও বাহ্যত মুখোশের নিচেই থাকে মুখ। কেমন জানি ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাপার হয়ে গেল। মুখ আগে না মুখোশ আগে, তার ফয়সালা হওয়ার আগে এটুকু নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, মুখ আর মুখোশ পরস্পর যুক্ত। মুখোশটা তো মুখের ওপরই পরতে হয়। সুতরাং মুখ না থাকলে মুখোশও থাকতে পারে না। কিন্তু অনেকদিন ধরে মুখোশ লাগানো থাকলে মুখ যে আছে, তা-ই হয়তো একসময় ভুলে যাওয়ার শঙ্কা থাকে। বাংলার মুখ দেখে দেখে জীবনানন্দ তৃপ্ত না-কি ক্লান্ত-আজ সেটা ভাবার বিষয়। লাইন দুটির মধ্যে একটা ডিকশনাল কন্ট্রোভার্সি আছে। প্রথমবার 'মুখ' বলে দ্বিতীয়বার বলেছেন 'রূপ'। কেন 'পৃথিবীর মুখ' হলো না বা কেন 'বাংলার রূপ' হলো না। যদি হতো 'বাংলার রূপ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর', তাহলে কোনো ধাঁধা থাকত না। এখানে মুখের সঙ্গে রূপের সমার্থকতা বোঝাচ্ছেন। অর্থাৎ বিষয়টা এভাবে ভাবা যায়, বাংলার মুখ এত ব্যাপ্ত, এত বিচিত্র, পৃথিবীর মহা মহাব্যাপার ধারণ করা বিশাল রূপটা আর না দেখলেও ক্ষতি নেই। আর জীবনানন্দ বাংলার প্রকৃতির, লোকজীবনের ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে খুঁজে পেয়েছিলেন অনন্য সৌন্দর্য, বৈচিত্র্য, রূপমাধুরী। আজ এ কবিতা আমাদের কাছে বোধহয় স্বতই প্যারোডি হয়ে এসেছে। আজকের বাংলাদেশ তার যে অবিশ্বাস্য নিয়ত করুণ নিষ্ঠুর বীভৎস মুখ নিয়ে হাজির হচ্ছে তাতে পৃথিবীর অন্য দেশগুলোর বিষয়ে আর নজর না দিলেও ক্ষতি নেই; দেশ আর রাষ্ট্রের বিস্ময়কর রূপ চিনে নিতে সমস্যা হবে না।
সেজন্যই মুখোশের লেখায় মুখের কথার কোট করলাম। এটা ধরে নিতে চেয়েছি যে, বাংলার ওই মুখের মধ্যে মুখোশের কথা আপনা-আপনিই ছিল, হয়তো বা ভবিষ্যপাঠে শ্লেষ হিসেবে বোঝার সম্ভাবনায়।
অর্থাৎ বাংলা যে মুখ নিয়ে আছে, তার ওপর এত এত অবিশ্বাস্য (কু) রূপ খেলা করে, পৃথিবীর রূপ আর বিশেষ কিছুই নয় তার কাছে! এই বাংলা তো আমাদেরই দেশ, বিমূর্ত কোনো জিনিস নয়। আমাদেরই নির্মাণ করা রাষ্ট্র। জীবনানন্দ আজকের বাংলাদেশে বেঁচে থাকলে হয়তো কবিতাটিকে শ্লেষাত্মক করেই হাজির করতেন। ঐতিহ্য ও গ্রামীণতার সৌন্দর্য খুঁজে ফেরা সেই অন্তর্মুখী কবি আজ নিশ্চয় দারুণভাবে প্রকাশবাদী হয়ে উঠতেন। মুখ নয়, বাংলা-ভরে কেবল মুখোশ দেখে ফিরতেন।
ভিনগাঁয়ের কবি অস্কারওয়াইল্ড তো লক্ষ কদম আগে বাড়লেন। শাদা দেশের কবি বলছেন, 'অ সধংশ ঃবষষং ঁং সড়ৎব ঃযধহ ধ ভধপব' সোজা কথায়, মুখের চেয়ে মুখোশ বড়। সেজন্যই বোধহয় ওনাদের দুনিয়ায় মুখোশের কায়কারবার শুরু হয়েছিল অনেক আগে। পালা, অপেরা, থিয়েটারে কারণে-অকারণে মুখোশ নিয়ে ঢোকার অভ্যাস তো দেখতেই পাই। উদ্ভট কিছু বোঝাতে হলে কিংবা মানুষের ভেতরকার স্বভাব-চরিত্র একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে এই কাজগুলো করতেন তারা, এখনও করেন। তাদের চেহারা-সুরত খুব ফর্সা, বাইরে দেখলে বোঝার উপায় খুব কম_ এত সুন্দর বর্ণে-গাত্রে লোকগুলো পিশাচ হতে পারে ক্যামনে? সাদা দিলে তাদের এত কাদা! সুযোগ পেলেই অভাগার গাই-বাছুর পর্যন্ত তুলে নিয়ে যেতে ফিরে ফিরে হানা দিয়েছে আমাদের দেশে। তাই তাদের জন্য মনে হয় মুখোশ না পরে ভেতরকার স্বভাব বোঝানো শিল্পকলার ছলাকলাতেও একটু কঠিন।
আমাদের তা লাগে না। আমরা মুখ দেখেই বুঝতে পারি তার ভেতরটা কেমন। আমাদের নাটকে তাই মুখোশ নেই। রবীন্দ্রনাথ গাইছেন, 'এসেছিলে তবু আস নাই জানায়ে গেলে ...' একেবারে ক্রিয়ার বিপ্রতীপ প্রতিক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন। মুখের ভাব-ভঙ্গির প্রশ্নের আরও ওপরে। যে আসে সে কি এসেছে_ এটাই সন্দেহ। সে কি আসলেই সে? আবার পরক্ষণে প্রশ্ন তুলছেন 'তোমার সে উদাসীনতা সত্য কিনা ...' উদাসীন হয়েও লাভ নেই। সেই উদাসীনতার ভেতর একেবারে চরম কৌতূহলের চোখ পিটপিট করছে কি-না, রহস্য।
তারপরও মুখোশ বললে আমরা সেই হৃদয়ের উল্টার্থক বিষয়-আশয় বুঝি না। খারাপ কিছুই ভাবি। এখন আমাদের অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, আমরা রাস্তাঘাটে মুখের চাইতে মুখোশই বেশি দেখি। দ্যাশ দ্যাশ বলে গলা ফাটাই বিয়ালি্লশ বছর ধরে। সেই দ্যাশের ভেতর দ্যাশ-বিরোধী মুখগুলো কী আনন্দে বেঁচে-বর্তে ছিল, টের পেয়েও পাইনি। সুতরাং মুখোশ না পরলেও আমাদের প্রাচ্যে মুখ খুব সহজে আড়াল করে রাখা যায়। এমনই আড়াল যে খোদ কোটি কোটি লোক, রাষ্ট্র, সমাজ কিচ্ছু তাকে ধরতে পারে না। তাই আমাদের দেশে আজ প্রকৃতিও মুখ বদলিয়ে রাখতে পারে। শীতকালেও অঝোরে নেমে পড়ে বৃষ্টি। বর্ষাকালে বৃষ্টি থাকে না, শরতে প্রায়ই নেমে আসে সাইক্লোন।
শোনা যায়, নয় হাজার বছর আগে প্রথম জেরুজালেমের ইসরায়েল মিউজিয়ামে মুখোশ পাওয়া গিয়েছিল। আদিকালের বুনো মানুষ জন্তু-জানোয়ারকে ফাঁদে ফেলার জন্য তাদেরই বেশ ধরত; জন্তুরা স্বজাতি মনে করে কাছে ভিড়লে চড়াও হতো দা-বল্লম নিয়ে। মুখোশের ধারণাটা এভাবেই নাকি সমাজে এসেছিল। আজকেও সে ধারণার বদল হয়নি, বরং প্রগাঢ়তর হয়েছে। শিকারকে ফাঁদে ফেলার জন্য মুখোশ কিংবা ছদ্মবেশের ব্যবহার আজ আরও ব্যাপক। তফাৎ একটাই, এখন মানুষের উদ্দিষ্ট শিকার আর সেই জন্তু-জানোয়ার নয়, খোদ মানুষই।
ইংরেজি মাস্ক শব্দটা নাকি ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম প্রচলন হয়। অর্থাৎ ষোড়শ শতকের শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে শব্দটার জন্মের একটা সম্পর্ক পাওয়া যাচ্ছে। শিল্প আর পণ্যসভ্যতাই মানুষের ভেতর ঠগবাজি, জোচ্চুরি, 'বাইরে এক ভিতরে আরেক' নিয়ে চলার সামাজিক শর্ত তৈরি করে দিয়েছিল। মহাত্মা রবীন্দ্রনাথও ইংরেজদের মুখোশকে মুখ বলে ভেবে নিয়েছিলেন। একটা কাল পর্যন্ত সেই মুখশ্রীতে মুগ্ধ থাকলেও জীবন-অন্তিমে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, সেই মুখ আসলে একটা মুখোশ। সে মুখোশের আড়ালে বের হয়ে পড়ে ইংরেজের আসল কদর্য, সাম্রাজ্যবাদী মুখ। তিনি আবিষ্কার করলেন, 'সমস্ত য়ূরোপে বর্বরতা কীরকম নখদন্ত বিকাশ করে বিভীষিকা বিস্তার করতে উদ্যত। এই মানবপীড়নের মহামারী পাশ্চাত্য সভ্যতার মজ্জার ভেতর থেকে জাগ্রত হয়ে উঠে আজ মানবাত্মার সামনে দিগন্ত থেকে দিগন্ত পর্যন্ত বাতাস কলুষিত করে দিয়েছে।'
বাহ্যত প্রায়শ রূপবাদী সেজে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর সব সাহিত্যে রূপসর্বস্বতাবিরোধী। কবিতাকে অনেকেই বলে থাকেন 'কবির মুখোশ'। কবি নিজেকে আড়াল করেন কবিতা দিয়ে। কিন্তু গদ্যকার বা কথাশিল্পী নিজেকে উন্মোচিত করেন তার গদ্য দিয়েই। রবীন্দ্রনাথের কাছে তা হয়তো সত্য নয়। তিনি পৌত্তলিকতাকে কবিতা বলতে নারাজ। যে পৌত্তলিকতা দূরার্থে মুখোশেরই নামান্তর। তিনি বলেছেন, 'কেহ কেহ পৌত্তলিকতাকে কবিতা হিসেবে দেখেন। তাঁহারা বলেন, কবিতাই পৌত্তলিকতা, পৌত্তলিকতাই কবিতা। আমাদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি অনুসারে আমরা ভাবমাত্রাকে আকার দিতে চাই। ভাবের সেই সাকার বাহ্যস্ফূর্তিকে কবিতা বলিতে পার বা পৌত্তলিকতা বলিতে পার। এইরূপ ভাবের বাহ্য প্রকাশ চেষ্টাকেই ভাবাভিনয়ন বলে।' তিনি জোরগলায় আপত্তি করছেন, 'কবিতা পৌত্তলিকতা নহে।'
এরপর নানান-বিনান যুক্তি-পরামর্শ দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন কবিতা অলঙ্কারশাস্ত্রের শাসনে গড়া কোনো আঙ্গিক নয়। কট্টর রূপবাদীরা সেটাকে অস্বীকার করেন। তারা কবিতাকে কবির মুখোশ প্রমাণ করেই ছাড়বেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ একাই লড়েছেন তার 'গীতাঞ্জলি'তে। জীবনের সহজ দার্শনিক ভাবনাকে অকপটে প্রকাশ করেছেন। ফল্গুধারার মতো ঝরে পড়েছে সেই বাণীনিচয়। রবীন্দ্রনাথের সব সাহিত্যই মানুষের মুখ খুঁজে বেড়িয়েছে। 'রাজা ও রানী'তে রানী যে যোদ্ধা-সৈনিকের ছদ্মবেশ নিয়ে রাজার সামনে দাঁড়ান, তা কিন্তু নিজের প্রকৃত মুখটি রাজার কাছে উন্মোচনের আকাঙ্ক্ষাতেই। 'চিত্রাঙ্গদা'র পুরুষরূপের ভেতরকার নারীসুলভ আকাঙ্ক্ষা আর তার উন্মোচন রবীন্দ্রনাথ লিঙ্গীয় মুক্তির মধ্য দিয়ে খোঁজেননি। খুঁজেছেন আরও গভীরে। সব জৈবিক পরিচয়ের ঊধর্ে্ব মানবিক সত্যতার সন্ধান করেছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ মুখোশ কিংবা ছদ্মবেশ, সোজা কথায় ছলনাকে অস্বীকার করতে চেয়েছেন সবসময়। 'গীতাঞ্জলি' যা কি-না সেই আইরনিক পাশ্চাত্যের কাছে পরম আদরের জিনিস হয়ে উঠল, তার মর্মে নিজের ভেতরের সত্যকে উন্মোচন করে পরম সত্তার সঙ্গে সহজে মিশে যাওয়ার আনন্দের কথাই বলা হয়েছে। এমনই সহজ, নিরাভরণ, প্রকৃত অন্তঃসত্তার খঁূজে বেড়িয়েছিলেন তিনি; মুখোশ তো দূরের কথা নিজের নামটাকে, শব্দের বর্মটাকেই তার প্রধান প্রতিবন্ধক ভাবতে শুরু করেছিলেন। নামটাই যেন তাঁর কাছে হয়ে উঠল মুখোশ। লিখলেন_
'আমার/নামটা দিয়ে ঢেকে রাখি যারে/মরছে সে এই নামের কারাগারে।/সকল ভুলে যতই দিবারাতি/নামটারে ওই আকাশ-পানে গাঁথি/ততই আমার নামের অন্ধকারে/হারাই আমার সত্য আপনারে।'
আমাদের নিশ্চয় চমকে উঠতে হয়। বিংশ শতকের এক কবি, যার চারপাশে শব্দ কিংবা ভাষাই হয়ে উঠছিল জনগণকে ঠুলি-পরাবার একটা উপচার (ষরঃবৎধৎু ফরংমঁরংব) এবং বিশ্বব্যাপী যখন সাহিত্যিক, বৌদ্ধিক অপরাধও ঘটতে শুরু করেছিল, তিনি তখন ব্যক্তি-মানুষের আপন স্বত্বকে ভুলে রিক্ত হয়ে নিজের আবিষ্কারের কথা বলেছেন। এই স্বত্বের জন্যই আগ্রাসন, সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতা। অথচ কত সহজেই তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন সবকিছুর বিরুদ্ধে; খুলে ফেলতে চাইলেন খোদ-নামের মুখোশ। একেবারে স্বত্বহীন হয়ে গিয়ে মিলতে চাইলেন সেই 'সর্বস্বত্বময়'-এর সঙ্গে। বললেন,
'নামটা যেদিন ঘুচাবে নাথ/বাঁচব সেদিন মুক্ত হয়ে/আপন-গড়া স্বপন হতে/তোমার মধ্যে জনম লয়ে।'
'বিনা নামের পরিচয়ে'ই তিনি বিশ্বমিলনে ধাইলেন। তিনি 'রূপ-সাগরে' ডুব দেন 'অরূপ-রতন' আশা করে। অর্থাৎ রূপের ভেতর থেকে প্রকৃত সত্যটির সন্ধান পাওয়ার জন্য। কিন্তু আমরা সেই সন্ধানের দিকে যাইনি। সেই সত্যের মুখ দেখা আজ যেন হয়ে উঠছে যোজন যোজন দূরযাত্রা। আমরা বারবার মুখোশকেই মুখ বলে ভুল করি। আর আমরা নিজেরাও এক একটা মুখোশ পরে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। কখনও চরম ক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে নির্লিপ্ততার মুখোশ, শোষিতের যন্ত্রণার পাশে নিখাদ ভদ্রলোকের নির্বিকার মুখোশ, ভেতরে অন্ধকারের আখড়া বানিয়ে রেখে মুখে আলোকিত মুখোশ, মনে অধর্মের নরক পুষে চরম ধার্মিকের মুখোশ। আমাদের কহতব্যও তাই নিজের স্বর ভুলে শ্রুতি আর বাখানের বাজারে অন্য কোনো আকর্ষক স্বর কিনে তার ভেতর দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করে।
রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার অমিত বলেছিল, 'ফ্যাশানটা হলো মুখোশ, স্টাইলটা হলো মুখশ্রী।' ওর মতে, 'যারা সাহিত্যের ওমরাও-দলের, যারা নিজের মন রেখে চলে, স্টাইল তাদেরই। আর যারা আমলা-দলের, দশের মন রাখা যাদের ব্যবসা, ফ্যাশান তাদেরই।' এখন মুখশ্রী নয়, মুখোশেরই জয়জয়কার। তাই স্টাইল নয়, ফ্যাশন নিয়ে প্রতিযোগিতা হয়, ফ্যাশন-হাউসে ভরে যায় আমাদের পণ্যশহর, কিন্তু স্টাইল কেউ চর্চা করে না। এখন ব্যক্তিত্বের সেই দীপ্তি আর সহজে কারও চোখে অনুপম অনুভূতি সৃষ্টি করে না। আমাদের সাহিত্যের অনেকাংশে যে হাল, আমাদের জীবনেও ঠিক তা-ই।
আমরা আধুনিকেরা কবিতাকে তৈরি করেছি মুখোশের মতো। আমাদের প্রকৃত মুখ থেকে নানা রঙে-রূপে-রেখায় সে ভিন্ন হয়। কবির নিজের মুখ, তার প্রকৃত দেশ, ভূমি, তার অনুভূতি, অভিব্যক্তি বোঝার নিজস্ব ধরনকে আমাদের ঔপনিবেশিক মন সবসময় ঠকাতে চেষ্টা করেছে। আমরা ভেবেছি এভাবে বললে হবে না। কবির আপন-মুখের ওপর চেপে বসেছে কবিতার পর-মুখোশ। কিন্তু এই ভাবের ছদ্মবেশ পরা মুখোশ পরাকেও পাশ্চাত্য অন্যভাবে দেখেছে। তার জীবনের বিপর্যাস তাকে ভাবতে বাধ্য করেছে অন্যভাবে। যেমন উইলিয়াম কনগ্রিভ তার কবিতাতেই বলছেন, 'মুখোশ কোনো সত্যকেই প্রকাশ করতে পারে না, পারে না কোনো মিথ্যাকে আড়াল করতে, বরং নগ্নতাই হচ্ছে আসল মুখোশ, প্রকৃত আড়াল।'
রবীন্দ্রনাথে যে অবগুণ্ঠন সরানোর কথা বারবার এসেছে, পাশ্চাত্যের কবিরা সেই অবগুণ্ঠনের মধ্যেই মুক্তির পথ খুঁজেছেন। এমনকি নগ্নতাও সেখানে প্রধান অবগুণ্ঠন!
ইয়েটস বললেন, 'শয়তান আমাদের কল্পনায় আসে, সকল ধর্মের মুখোশ পরে।' আমাদের চারপাশের যে ধর্মোন্মাদ মানুষের রূপ দেখছি, তাতে করে এ কথাকে কে ফেলে দিতে পারবে। মনে পড়ে কাফ্কার 'দ্য ট্রায়াল' উপন্যাসের কথা, যার নায়কের কাছে পুরো রাষ্ট্রটাকেই মনে হয়েছিল আইনের মুখোশ পরা একটা কয়েদখানা। সে আর সেখান থেকে বেরোবার কোনো পথ খুঁজে পায় না। ঠিক তেমনই 'স্যাটানিক ভার্সেস'-এ সালমান রুশদি আমাদের এই সভ্যতার ভয়ঙ্কর সংকটকে এভাবে পেশ করতে চেয়েছিলেন, 'আমাদের প্রত্যেকের মুখোশের নিচে একটা মুখোশ, তার নিচে আরও একটা মুখোশ, তারও নিচে আরেকটা... এভাবেই একটার পর একটা মুখোশ নিয়ে আমরা আবৃত থাকি, যতক্ষণ পর্যন্ত না হঠাৎ সেই রক্তহীন নগ্ন করোটি প্রকাশ পায়।' অর্থাৎ এতসব মুখোশের নিচে আর সেই মুখের চিহ্ন নেই। সেই অচল, জড় করোটিই রয়েছে। এমন এক ভয়াবহ অস্তিত্বের-সংকট, পরিচয়ের-ডিলেমা তৈরি করে রেখেছি আমরা দুনিয়ায়।
সিসেরোর সেই কথামৃত_ 'মুখ হচ্ছে আমাদের মনের প্রতিচ্ছবি, আর চোখ তার ব্যাখ্যাকারী'_ আজ একেবারে যেন ব্যর্থ, অসার বচন। কারও মুখ দেখে মনের কথা আজ আর কেউ বুঝতে পারে না, আর চোখ বাখান করতে পারে না সত্য কোনো কিছু। মনে পড়ে ঈশপের সেই কথা, 'একজন সন্দেহজনক বন্ধুর চাইতে একজন নিশ্চিত শত্রুই শ্রেয়। মানুষকে যে কোনো একটা রূপে চিনতে দাও। তারপর আমরা তার সাক্ষাৎ করব।' কিন্তু কই! চোখের সামনেই কত খুনি ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের সঙ্গেই তো রাস্তাঘাটে প্রতিদিন আমার দেখা হচ্ছে। তাদের অনেকেই কি 'বন্ধু' ছিল না আমার? আমাদের? কই, আমি তো চিনতে পারিনি। এত খুনি লুকানোর অন্ধকার আমাদের এই দেশে থাকার কথা নয়। নিশ্চয় তাদের মুখের ওপর রয়েছে নিজেকে লুকানোর এক একটা ম্যাজিক-মুখোশ।
অ-দৃশ্যতার মুখোশ পরে থাকা স্বতঃদৃশ্যমান 'রাজা'কে আলোয় পাওয়ার জন্য আর আমাদের রানী (সুদর্শনা)-সুলভ কোনো আকুতি নেই। কারণ, আলোর মুখোশপরা অন্ধকার-রাজার শাসনেই পৃথিবী চলছে আজ।
মানুষ আজকে তাই মুখ নয়, মুখোশমুখর।
No comments