জাতির মেরুদণ্ড কি ভেঙে যাবে? by ড. ইশা মোহাম্মদ
শিক্ষা ব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি সাধন
করেছে বর্তমান সরকার। তৃণমূল পর্যায়ে শিক্ষার শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে। প্রাথমিক
শিক্ষা স্তরে বইপুস্তক সরবরাহের রেকর্ড অভূতপূর্ব। উচ্চমার্গীয় ফলের ব্যাপক
সমাহার ঘটেছে এ সরকারের আমলে। মেয়েদের শিক্ষাব্যয় শূন্য পর্যায়ে নামিয়ে
আনার চেষ্টাও সম্ভবত ফলপ্রসূ হবে। এসবই ভালো খবর। এর উপরে আরও একটি সুন্দর
খবর আছে। এ যাবতকাল যা শোনা যায়নি, তাই শোনা গেছে এবার। বর্তমান
শিক্ষামন্ত্রী অবৈধ অর্থ সংগ্রহ করেন না। বাংলাদেশের জন্য এটি বিরল ঘটনা।
তবে এত ভালো খবর ছাপিয়ে একটি ছোটখাটো খারাপ খবরে মনটা খারাপ হয়ে গেল। খবরটি হচ্ছে, খুলনায় কয়েকটি স্কুলে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ছাপিয়েছে প্রেস এবং বিক্রি করেছে স্কুলে। এটি অভাবনীয় নয়। কিন্তু যেটি বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় সেটি হচ্ছে, প্রশ্নটি ওই স্কুলের কোনো শিক্ষক তৈরি করেনি। প্রশ্ন তৈরি করেছে ওই প্রেসেরই লোকজন। কিন্তু পরীক্ষা নিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি নিয়ে কোনো আলোচনাই হতো না, যদি নির্বাচনের সঙ্গে এটি সম্পর্কিত না হতো। মেয়র নির্বাচনের একজন প্রার্থীকে একজন বিখ্যাত খলিফার সঙ্গে তুলনা করে প্রশ্ন করা হয়েছে, যা ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করেছে। তাতে যথেষ্ট হইচই হয়েছে এবং কর্তৃপক্ষ তদন্ত ও ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছে। বিষয়টি এখানেই শেষ হলে ভালো হতো। কিন্তু শংকা হচ্ছে, যন্ত্রণার নিবৃত্ত এভাবে হবে না। বরং অবহেলার কারণে ক্ষত আরও গভীর হবে।
যেসব শিক্ষক নিজে প্রশ্ন করে না, কিন্তু যাদের তারা পড়িয়েছে, তাদের অন্য লোকের তৈরি করা প্রশ্নে পরীক্ষা নেয়, তারা অবশ্যই অপরাধী। তাদের শাস্তিযোগ্য অপরাধে শাস্তি দেয়া যেতেই পারে। সম্ভবত তাদের চিরতরে শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বহিষ্কার করলে সেটি অন্যদের জন্য একটি উদাহরণ হিসেবে কাজ করবে। দু-চারজন শাস্তি পাওয়ার কারণে দুষ্টমতির শিক্ষকরা সাবধান হয়ে যাবেন। তারা এ ধরনের ভুল করা থেকে নিজেদের বিরত রাখবেন। কিন্তু বিষয়টির মনে হয় এভাবে নিষ্পত্তি হবে না। কারণ এখানে ব্যবসার সম্পর্ক রয়েছে।
যতদূর জানা যায়, পৃথিবীতে মাত্র একজন লোক বলেছিলেন, শিক্ষা বিতরণ করে পয়সা নেয়া অবৈধ। যে ব্যক্তি শিক্ষা দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে টাকা নেয় সে প্রকৃত শিক্ষক নয়, তার কাছ থেকে বিদ্যা শিক্ষা নেয়াই উচিত নয়। তিনি পৃথিবী বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিস। কিন্তু তার নিয়ম মেনে চললে সমাজ ও রাষ্ট্রে শিক্ষক বিরল হয়ে যায়। তাই তার সময়েই সফিস্টরা শিক্ষার বিনিময়ে অর্থ সংগ্রহ বৈধ ঘোষণা করে সমাজে শিক্ষকের সংখ্যা বাড়িয়ে ফেলে। একপর্যায়ে তার সুফলও পাওয়া যায়। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, শিক্ষাকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই দুটি বিশেষ সেবা খাত ছিল- শিক্ষা ও চিকিৎসা। এখন এ দুটি খাতই বড় মুনাফার ব্যবসা খাত হয়ে গেছে। বাজার অর্থনীতির কুফল এটি। এ সমস্যা থেকে মুক্তি সম্ভবত অসম্ভব। তবে সরকার উদ্যোগ নিয়ে এটাকে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পারে।
বলছি না বিনা পয়সায় শিক্ষা দিতে হবে। বিনা বেতনের শিক্ষক এখন আর পাওয়া যাবে না। কিন্তু সরকার তো বেতন দিচ্ছেই কোনো কোনো স্তর পর্যন্ত। তাহলে কেন শিক্ষাকে ব্যবসায়ীর হাত থেকে মুক্ত করা যাবে না? প্রশ্নটা নৈতিকতার। শিক্ষাকে ব্যবসায়ীর হাত থেকে মুক্ত করতে না পারলে মুনাফা ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। প্রজন্ম শিক্ষিত হবে না। তারা কেবল সনদধারী ব্যক্তি হয়ে যাবে। ব্যবসা ও শিক্ষার এই সম্পর্ক আলোচ্য হয়েছে এ কারণে যে, একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যবসা ঢুকে পড়েছে। যে প্রেসে প্রশ্নপত্র ছাপা হয়েছে, সে প্রেসের মালিক একজন ব্যবসায়ী। তিনি নিছক মুনাফার কথা চিন্তা করে প্রশ্নপত্র ছাপিয়েছেন এবং বিক্রি করেছেন স্কুলের কাছে। কয়েকটি স্কুল কিনেছে। সম্ভবত এটাই চল ওই এলাকায়। কী খারাপ অবস্থা, ভাবা যায়? যারা পড়ায়, তারা কেন প্রশ্ন করে না? শিক্ষা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যারা সম্পর্কিত, তারা এ যাবতকাল এ কুকর্মটি সম্পর্কে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কেন? রাজনৈতিক হৈচৈ না হলে তো বিষয়টি নিভৃতেই থেকে যেত। এখন শাস্তির কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু জানাজানি না হলে শাস্তির প্রশ্নই উঠত না।
শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের অনুপ্রবেশ বন্ধ করতেই হবে। নইলে ব্যবসায়ীরাই একদিন গ্রাস করবে শিক্ষাকে এবং ওই একই ধারায় সমগ্র জাতিকে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে দেখা যায়, সরকার নিজেদের সেবা প্রতিষ্ঠান চাহিদা মোতাবেক বাড়াতে পারে না। অতি মেধাবীরাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। বাকিরা যাবে কোথায়? সুযোগ পেয়ে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠে অসংখ্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে কী পড়ানো হচ্ছে? খোঁজ নিলে দেখা যাবে, কেবল নোটবই পড়ে তারা। সস্তা লেখকের সস্তা বই ছাপানো হয় বিভিন্ন প্রেসে। এগুলোর নাম গাইড বই। কিছু টেক্সট বই আছে, যা গাইড বইয়ের চেয়েও নিুমানের। এসব বইয়ের প্রকৃত মালিক লেখকরা নন, মালিক প্রেসের মালিক নিজেই। তারা কসরত করে কলেজ ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব বই পাঠ্য করে। ছেলেমেয়েরা এসবই পড়ছে ও অশিক্ষিত হচ্ছে। সবচেয়ে ভয়ংকর খবর হচ্ছে, এসব সস্তা লেখকের অধিকাংশই মৌলবাদী ঘরানার। তারা অতিকৌশলে আধুনিক চিন্তাচেতনার সঙ্গে মৌলবাদ মিশ্রণ করে বইপুস্তক লেখে। এরা নিজেরাও বিভিন্ন কলেজ ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে উমেদারি করে শিক্ষকদের মোটিভেট করে তাদের লেখা বইপুস্তক পড়ানোর ব্যবস্থা করে। শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের অনুপ্রবেশের প্রথম সুযোগ তৈরি হয় বড় বড় কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট বিতাড়নের পর পরই। আগে অনেক সরকারি কলেজে খুব ভালোভাবে ইন্টারমিডিয়েট পড়ানো হতো। হঠাৎ সরকারের একটা ভুল সিদ্ধান্তের ফলে এসব সরকারি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট বহিষ্কৃত হয়। ফল হয় খুবই খারাপ। রাতারাতি ওইসব কলেজের আশপাশে প্রাইভেট কলেজ গজিয়ে ওঠে এবং সেখানে খুবই নিম্ন মেধার শিক্ষকরা পড়িয়ে থাকে। অনেক ব্যবসায়ী ওইসব ইন্টারমিডিয়েট কলেজের সঙ্গে লগ্নী পুঁজির কারণে সম্পৃক্ত হয়। মৌলবাদীরাও পুজি সমেত এসব কলেজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় এবং ওই একই ধারায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা প্রথম দিকে ওইসব কলেজ থেকেই আসত। কেননা, এসব কলেজের ছেলেমেয়েরা দুর্বল জ্ঞানের কারণে কোনো ভালো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারত না। পাস করার পর তারা যাবে কোথায়? বাধ্য হয়ে তারা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শরণাপন্ন হতো। এই একই অবস্থা পরিদৃষ্টে অনেক ডিগ্রি কলেজে অনার্স মাস্টার্স চালু করা হয়। এর ফল হয় খুবই খারাপ। সরকারি কলেজগুলো থেকে ইন্টারমিডিয়েট তাড়ানোর ফলে ওই পর্যায়ের ছেলেমেয়েরা মৌলবাদ ও ব্যবসায়ীর খপ্পরে পড়ে। এ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে রক্ষা পাওয়ার জন্য পুরনো সরকারি কলেজগুলোতে আবার ইন্টারমিডিয়েট চালু করতে হবে। যদি বড় কলেজগুলো চাপ অনুভব করে, তবে সেখান থেকে মাস্টার্স অপসারণ করা যেতে পারে। মাস্টার্সের চাপে ইন্টারমিডিয়েট বিতাড়ন করে শিক্ষার মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া ঠিক নয়। মাস্টার্সের চাপ কমানোর জন্য স্থানীয় পর্যায়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস তৈরি করে শুধু একজন প্রোভিসি নিয়োগ দিয়েই মাস্টার্সের চাহিদা মোকাবেলা করা সম্ভব। মাস্টার্স পর্যায়ে কয়েকটি ভালো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থাকতে পারে। তবে ব্যাঙের ছাতার মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ করতেই হবে। ব্যাঙের ছাতা বিশ্ববিদ্যালয় মূলত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষাকে ব্যবসায়ীদের হাতে বন্ধক দেয়া ঠিক নয়। এতে শিক্ষার মেরুদণ্ড ভেঙে পড়ে। এখন যেমন অসংখ্য সনদধারী স্বল্পশিক্ষিত সামাজিক-অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড করে বেড়াচ্ছে, তেমন ধারা চলতে থাকলে অচিরেই পুরো সমাজটি অনৈতিক হয়ে যাবে। আশা করি, সরকার সর্বনাশ সামাল দিতে পারবে এবং ইন্টারমিডিয়েটসহ সব ধরনের শিক্ষাকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসবে।
ড. ইশা মোহাম্মদ : জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
তবে এত ভালো খবর ছাপিয়ে একটি ছোটখাটো খারাপ খবরে মনটা খারাপ হয়ে গেল। খবরটি হচ্ছে, খুলনায় কয়েকটি স্কুলে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ছাপিয়েছে প্রেস এবং বিক্রি করেছে স্কুলে। এটি অভাবনীয় নয়। কিন্তু যেটি বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় সেটি হচ্ছে, প্রশ্নটি ওই স্কুলের কোনো শিক্ষক তৈরি করেনি। প্রশ্ন তৈরি করেছে ওই প্রেসেরই লোকজন। কিন্তু পরীক্ষা নিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি নিয়ে কোনো আলোচনাই হতো না, যদি নির্বাচনের সঙ্গে এটি সম্পর্কিত না হতো। মেয়র নির্বাচনের একজন প্রার্থীকে একজন বিখ্যাত খলিফার সঙ্গে তুলনা করে প্রশ্ন করা হয়েছে, যা ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করেছে। তাতে যথেষ্ট হইচই হয়েছে এবং কর্তৃপক্ষ তদন্ত ও ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছে। বিষয়টি এখানেই শেষ হলে ভালো হতো। কিন্তু শংকা হচ্ছে, যন্ত্রণার নিবৃত্ত এভাবে হবে না। বরং অবহেলার কারণে ক্ষত আরও গভীর হবে।
যেসব শিক্ষক নিজে প্রশ্ন করে না, কিন্তু যাদের তারা পড়িয়েছে, তাদের অন্য লোকের তৈরি করা প্রশ্নে পরীক্ষা নেয়, তারা অবশ্যই অপরাধী। তাদের শাস্তিযোগ্য অপরাধে শাস্তি দেয়া যেতেই পারে। সম্ভবত তাদের চিরতরে শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বহিষ্কার করলে সেটি অন্যদের জন্য একটি উদাহরণ হিসেবে কাজ করবে। দু-চারজন শাস্তি পাওয়ার কারণে দুষ্টমতির শিক্ষকরা সাবধান হয়ে যাবেন। তারা এ ধরনের ভুল করা থেকে নিজেদের বিরত রাখবেন। কিন্তু বিষয়টির মনে হয় এভাবে নিষ্পত্তি হবে না। কারণ এখানে ব্যবসার সম্পর্ক রয়েছে।
যতদূর জানা যায়, পৃথিবীতে মাত্র একজন লোক বলেছিলেন, শিক্ষা বিতরণ করে পয়সা নেয়া অবৈধ। যে ব্যক্তি শিক্ষা দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে টাকা নেয় সে প্রকৃত শিক্ষক নয়, তার কাছ থেকে বিদ্যা শিক্ষা নেয়াই উচিত নয়। তিনি পৃথিবী বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিস। কিন্তু তার নিয়ম মেনে চললে সমাজ ও রাষ্ট্রে শিক্ষক বিরল হয়ে যায়। তাই তার সময়েই সফিস্টরা শিক্ষার বিনিময়ে অর্থ সংগ্রহ বৈধ ঘোষণা করে সমাজে শিক্ষকের সংখ্যা বাড়িয়ে ফেলে। একপর্যায়ে তার সুফলও পাওয়া যায়। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, শিক্ষাকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই দুটি বিশেষ সেবা খাত ছিল- শিক্ষা ও চিকিৎসা। এখন এ দুটি খাতই বড় মুনাফার ব্যবসা খাত হয়ে গেছে। বাজার অর্থনীতির কুফল এটি। এ সমস্যা থেকে মুক্তি সম্ভবত অসম্ভব। তবে সরকার উদ্যোগ নিয়ে এটাকে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পারে।
বলছি না বিনা পয়সায় শিক্ষা দিতে হবে। বিনা বেতনের শিক্ষক এখন আর পাওয়া যাবে না। কিন্তু সরকার তো বেতন দিচ্ছেই কোনো কোনো স্তর পর্যন্ত। তাহলে কেন শিক্ষাকে ব্যবসায়ীর হাত থেকে মুক্ত করা যাবে না? প্রশ্নটা নৈতিকতার। শিক্ষাকে ব্যবসায়ীর হাত থেকে মুক্ত করতে না পারলে মুনাফা ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। প্রজন্ম শিক্ষিত হবে না। তারা কেবল সনদধারী ব্যক্তি হয়ে যাবে। ব্যবসা ও শিক্ষার এই সম্পর্ক আলোচ্য হয়েছে এ কারণে যে, একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যবসা ঢুকে পড়েছে। যে প্রেসে প্রশ্নপত্র ছাপা হয়েছে, সে প্রেসের মালিক একজন ব্যবসায়ী। তিনি নিছক মুনাফার কথা চিন্তা করে প্রশ্নপত্র ছাপিয়েছেন এবং বিক্রি করেছেন স্কুলের কাছে। কয়েকটি স্কুল কিনেছে। সম্ভবত এটাই চল ওই এলাকায়। কী খারাপ অবস্থা, ভাবা যায়? যারা পড়ায়, তারা কেন প্রশ্ন করে না? শিক্ষা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যারা সম্পর্কিত, তারা এ যাবতকাল এ কুকর্মটি সম্পর্কে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কেন? রাজনৈতিক হৈচৈ না হলে তো বিষয়টি নিভৃতেই থেকে যেত। এখন শাস্তির কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু জানাজানি না হলে শাস্তির প্রশ্নই উঠত না।
শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের অনুপ্রবেশ বন্ধ করতেই হবে। নইলে ব্যবসায়ীরাই একদিন গ্রাস করবে শিক্ষাকে এবং ওই একই ধারায় সমগ্র জাতিকে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে দেখা যায়, সরকার নিজেদের সেবা প্রতিষ্ঠান চাহিদা মোতাবেক বাড়াতে পারে না। অতি মেধাবীরাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। বাকিরা যাবে কোথায়? সুযোগ পেয়ে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠে অসংখ্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে কী পড়ানো হচ্ছে? খোঁজ নিলে দেখা যাবে, কেবল নোটবই পড়ে তারা। সস্তা লেখকের সস্তা বই ছাপানো হয় বিভিন্ন প্রেসে। এগুলোর নাম গাইড বই। কিছু টেক্সট বই আছে, যা গাইড বইয়ের চেয়েও নিুমানের। এসব বইয়ের প্রকৃত মালিক লেখকরা নন, মালিক প্রেসের মালিক নিজেই। তারা কসরত করে কলেজ ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব বই পাঠ্য করে। ছেলেমেয়েরা এসবই পড়ছে ও অশিক্ষিত হচ্ছে। সবচেয়ে ভয়ংকর খবর হচ্ছে, এসব সস্তা লেখকের অধিকাংশই মৌলবাদী ঘরানার। তারা অতিকৌশলে আধুনিক চিন্তাচেতনার সঙ্গে মৌলবাদ মিশ্রণ করে বইপুস্তক লেখে। এরা নিজেরাও বিভিন্ন কলেজ ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে উমেদারি করে শিক্ষকদের মোটিভেট করে তাদের লেখা বইপুস্তক পড়ানোর ব্যবস্থা করে। শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের অনুপ্রবেশের প্রথম সুযোগ তৈরি হয় বড় বড় কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট বিতাড়নের পর পরই। আগে অনেক সরকারি কলেজে খুব ভালোভাবে ইন্টারমিডিয়েট পড়ানো হতো। হঠাৎ সরকারের একটা ভুল সিদ্ধান্তের ফলে এসব সরকারি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট বহিষ্কৃত হয়। ফল হয় খুবই খারাপ। রাতারাতি ওইসব কলেজের আশপাশে প্রাইভেট কলেজ গজিয়ে ওঠে এবং সেখানে খুবই নিম্ন মেধার শিক্ষকরা পড়িয়ে থাকে। অনেক ব্যবসায়ী ওইসব ইন্টারমিডিয়েট কলেজের সঙ্গে লগ্নী পুঁজির কারণে সম্পৃক্ত হয়। মৌলবাদীরাও পুজি সমেত এসব কলেজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় এবং ওই একই ধারায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা প্রথম দিকে ওইসব কলেজ থেকেই আসত। কেননা, এসব কলেজের ছেলেমেয়েরা দুর্বল জ্ঞানের কারণে কোনো ভালো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারত না। পাস করার পর তারা যাবে কোথায়? বাধ্য হয়ে তারা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শরণাপন্ন হতো। এই একই অবস্থা পরিদৃষ্টে অনেক ডিগ্রি কলেজে অনার্স মাস্টার্স চালু করা হয়। এর ফল হয় খুবই খারাপ। সরকারি কলেজগুলো থেকে ইন্টারমিডিয়েট তাড়ানোর ফলে ওই পর্যায়ের ছেলেমেয়েরা মৌলবাদ ও ব্যবসায়ীর খপ্পরে পড়ে। এ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে রক্ষা পাওয়ার জন্য পুরনো সরকারি কলেজগুলোতে আবার ইন্টারমিডিয়েট চালু করতে হবে। যদি বড় কলেজগুলো চাপ অনুভব করে, তবে সেখান থেকে মাস্টার্স অপসারণ করা যেতে পারে। মাস্টার্সের চাপে ইন্টারমিডিয়েট বিতাড়ন করে শিক্ষার মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া ঠিক নয়। মাস্টার্সের চাপ কমানোর জন্য স্থানীয় পর্যায়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস তৈরি করে শুধু একজন প্রোভিসি নিয়োগ দিয়েই মাস্টার্সের চাহিদা মোকাবেলা করা সম্ভব। মাস্টার্স পর্যায়ে কয়েকটি ভালো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থাকতে পারে। তবে ব্যাঙের ছাতার মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ করতেই হবে। ব্যাঙের ছাতা বিশ্ববিদ্যালয় মূলত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষাকে ব্যবসায়ীদের হাতে বন্ধক দেয়া ঠিক নয়। এতে শিক্ষার মেরুদণ্ড ভেঙে পড়ে। এখন যেমন অসংখ্য সনদধারী স্বল্পশিক্ষিত সামাজিক-অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড করে বেড়াচ্ছে, তেমন ধারা চলতে থাকলে অচিরেই পুরো সমাজটি অনৈতিক হয়ে যাবে। আশা করি, সরকার সর্বনাশ সামাল দিতে পারবে এবং ইন্টারমিডিয়েটসহ সব ধরনের শিক্ষাকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসবে।
ড. ইশা মোহাম্মদ : জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
No comments