কালের আয়নায়-জাতীয় নিরাপত্তা এবং দায়িত্বহীন সাংবাদিকতা by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
বৃহস্পতিবার বিকেলে (লন্ডন সময়) লন্ডনে এসে পেঁৗছেছেন। এটা তার বেসরকারি
সফর। ছোট বোন রেহানার বড় মেয়ে কাউন্সিলর টিউলিপের (ব্রিটিশ লেবার দলীয়
কাউন্সিলর) বিবাহোত্তর সংবর্ধনা উপলক্ষে পরিবারের অনেক সদস্যসহ তিনি লন্ডনে
এসেছেন।
যদিও এটি তার বেসরকারি সফর, তথাপি বাংলাদেশের
বর্তমান বিস্ফোরক পরিস্থিতি বিবেচনা করে ব্রিটিশ সরকার তার বিশেষ
নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে।
শেখ হাসিনার এবারের লন্ডন সফর নিয়ে ব্রিটেনের বাংলাদেশি কমিউনিটির একটা সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মধ্যে উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছিল। কারণ, এ সফরের কথা ঘোষিত হতেই লন্ডনে বিএনপি-জামায়াতের নেতা, সমর্থক ও কর্মী মহলে দারুণ তৎপরতা শুরু হয়। পূর্ব লন্ডনের অধিকাংশ মসজিদ ও মাদ্রাসা এখন জামায়াতিদের শক্ত ঘাঁটি। গত ফেব্রুয়ারি মাসে শহীদ আলতাব আলী পার্কে ভাষা শহীদ মিনারে জুতো পায়ে উঠে জামায়াত কর্মীরা অসম্মান দেখায় এবং ইস্ট লন্ডন মসজিদে শুক্রবার জুমার নামাজের খুতবার পর মসজিদের ইমাম অধিকাংশ সময় শেখ হাসিনার নামোল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে উত্তেজনা ছড়ান। তার ধ্বংস কামনা করেন।
বাংলাদেশের চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পর ব্রিটেনে বিএনপি-জামায়াতের ঘাঁটিতে হিংস্র উল্লাস আরও বেড়ে যায় এবং আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে কীভাবে শায়েস্তা করা যাবে সে সম্পর্কে প্রকাশ্যে হুমকি দিতে তারা শুরু করেন। গুজব রটে যায়, লন্ডনে শেখ হাসিনাকে নাজেহাল করার জন্য তারেক রহমান তার দলীয় কর্মীদের সর্বশক্তি নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছেন। গোটা ইউরোপ থেকে কয়েক হাজার বিএনপি, জামায়াত কর্মী ও সমর্থককে লন্ডনে আনা হবে। তারা শুধু শেখ হাসিনাকে কালো পতাকাই দেখাবে না, সুযোগ পেলে তাকে লাঞ্ছিত করবে। এমনকি তার জীবন বিপন্ন হতে পারে। এই আশঙ্কা বিলাতের বাংলাদেশি কমিউনিটির সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে।
ব্রিটিশ সরকার সাধারণত সরকারিভাবে আমন্ত্রিত তাদের কোনো মেহমান ছাড়া ব্যক্তিগত সফরে আসা রাষ্ট্রনায়কদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা করে না। বাংলাদেশের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান যখন লন্ডন সফরে আসেন, তখনও তার সঙ্গে প্রেসিডেন্সিয়াল সিকিউরিটি ফোর্সের লোকজন ছিল। ব্রিটিশ সরকার কোনো বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেয়নি। শেখ হাসিনার বর্তমান সফরও যেহেতু বেসরকারি এবং ব্যক্তিগত সফর, সেহেতু ব্রিটিশ সরকার লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশনে জানিয়ে দিয়েছিল যে, শেখ হাসিনার জন্য মেট্রোপলিটন পুলিশ নিয়মমাফিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে; কিন্তু তার জন্য বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবে না। এই নিয়মটি সব বিদেশি রাষ্ট্রনায়ক বা সরকারপ্রধানদের (দু'একটি ব্যতিক্রম ছাড়া) জন্য প্রযোজ্য। সুতরাং রুটিনমাফিক এই চিঠি শেখ হাসিনার সফর সম্পর্কেও পাঠানো হয়েছিল।
সঙ্গে সঙ্গে লন্ডনে নবনিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মিজারুল কায়েস সতর্ক হন এবং ব্রিটিশ সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ধরা পড়ে, গ্যাপ অব ইনফরমেশনের জন্য এই অবস্থাটি ঘটেছে। বাংলাদেশের বর্তমান বিস্ফোরক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে হাত দিয়ে শেখ হাসিনা তার জীবনের ওপর যে বিশাল ঝুঁকি তৈরি করেছেন, অতীতে তার জীবনের ওপর অসংখ্য হামলা, ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা এবং এই হামলার পেছনে বিএনপির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের যোগাযোগের অভিযোগ সম্পর্কে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বহু সদস্য অবহিত। তাদের মধ্যে রয়েছেন কিথ জর্জ, ফ্রাঙ্ক ডবসন প্রমুখ প্রভাবশালী এমপি ও সাবেক মন্ত্রী। তারা বিষয়টি জানতেই সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে উদ্যোগী হন।
দেখা গেল, ক্যামেরন সরকার কোনো ভুল সিদ্ধান্ত বা ইচ্ছাকৃত সিদ্ধান্ত নেয়নি। এটা প্রথামাফিক সিদ্ধান্ত। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ দ্রুত এই সিদ্ধান্ত পাল্টায় এবং শেখ হাসিনাকে তার আগেরবারের সফরের চেয়েও অধিক নিরাপত্তাদানের ব্যবস্থা করে। ফলে আগে সিদ্ধান্ত ছিল, শেখ হাসিনা লন্ডনের যে হোটেলে অবস্থান করবেন, সেখানেই শুধু তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু পরে তার জন্য হিথরো বিমানবন্দর থেকে পার্ক স্ট্রিটে হিলটন হোটেল পর্যন্ত নিরাপত্তাদানেরও ব্যবস্থা করা হয়।
ব্রিটেন গণতান্ত্রিক দেশ। প্রতিবারের মতো এবারও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কালো পতাকাসহ বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্য লন্ডনের বিএনপি ও জামায়াতকে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তারা বৃহস্পতিবার বিকেলে হিলটন হোটেলের সামনে জড়ো হয়েছিল। দেখা গেল, যত গর্জায় তত বর্ষায় না। সারা ইউরোপ থেকে বিএনপি-জামায়াত যে ঝটিকা বাহিনী এনেছে তাদের সংখ্যা দেড়শ', দুইশ'। তার তুলনায় ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা জানাতে যত আওয়ামী সমর্থক ও বাংলাদেশি এসেছেন, তাদের সংখ্যা অনেক বেশি। তিনশ'-চারশ'র মতো। ব্রিটিশ পুলিশ এই দু'পক্ষকে বড় ধরনের সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত রেখেছে। সংঘর্ষ হলে ঝটিকা বাহিনীর কপালে কী ঘটত তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না।
মনে হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লন্ডনে অবস্থানের বাকি দিনগুলো ভালোভাবেই কেটে যাবে। তারেক রহমানের ঝটিকা বাহিনী পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে উপদ্রব সৃষ্টির চেষ্টা অবশ্যই চালিয়ে যাবে। কিন্তু তা মোকাবেলা করার জন্য ব্রিটিশ সরকারের বর্তমান নিরাপত্তা ব্যবস্থাই যথেষ্ট। শেখ হাসিনার নিরাপত্তা সম্পর্কে এবার (যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলার পরিপ্রেক্ষিতে) ব্রিটেনের বাঙালি কমিউনিটির মধ্যে যথেষ্ট উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা দেখা গেছে। বহু কমিউনিটি নেতা, বিশেষ করে লন্ডনের বিখ্যাত রেস্টুরেন্ট রেড ফোর্ডের মালিক আমিন আলী (যার জীবন নিয়ে উইল টু উইন নামে একটি ফিল্ম তৈরি হয়েছে) প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা দৃঢ় করার জন্য বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।
ব্রিটেনে বা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরকালীন নিরাপত্তার সঙ্গে (সরকারি বা বেসরকারি যে সফরই হোক) আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নটি জড়িত। এটাকে দলীয় বা ব্যক্তিগত স্বার্থে অবহেলা বা উপেক্ষা করা হলে তা হবে গুরুতর অপরাধ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল একবার সাইপ্রাসে গোপন সফরে যাচ্ছিলেন। তার যাত্রাপথটি ছিল বিপজ্জনক। জার্মান যুদ্ধবিমান যে কোনো সময় তার বিমানে হামলা চালাতে পারে। চার্চিলের এই গোপন সফরের খবরটি জানতে পেরেছিলেন তার রাজনীতির ঘোর বিরোধী এক সাংবাদিক। তিনি খবরটি হাতে পেয়েও প্রকাশ করতে চাননি। বলেছেন, 'আমি চার্চিলের রাজনীতির সমালোচনা করি; কিন্তু তার জীবন বিপন্ন হোক এমন কোনো খবর ফাঁস করতে পারি না। তাতে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারে।'
শেখ হাসিনার এবারের লন্ডন সফর উপলক্ষ করে বাংলাদেশের এক শ্রেণীর সংবাদপত্রে, বিশেষ করে একটি ইংরেজি দৈনিকে যে সাংবাদিকতা লক্ষ্য করেছি, তাতে মনে প্রশ্ন জেগেছে, আমাদের মধ্যে প্রজ্ঞাবান বলে পরিচিত এক শ্রেণীর সম্পাদকও কি নিজেদের দায়িত্বজ্ঞান হারিয়ে হেট ক্যাম্পেইনকে একজন প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা বলে চালাতে পারেন এবং এমন খবর ছাপতে পারেন, যা অসত্য ও অর্ধসত্যে পূর্ণ এবং যে খবর ছাপা হলে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন হতে পারে? এবং যে নিরাপত্তা বিপন্ন হওয়া মানে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা বিপন্ন হওয়া।
প্রধানমন্ত্রী বিশাল (৪৫ জন) অতিথি বহর নিয়ে সরকারি খরচে লন্ডনে এসেছেন, তার অবশ্যই সমালোচনা হতে পারে। কিন্তু সেই খবরের সত্যতা অর্থাৎ সরকারি খরচেই সবাই গিয়েছেন কিনা তা আগে যাচাই করা দরকার। এর আগেও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো হয়েছে যে, তিনি ৬০-৭০ জনের বিরাট বহর নিয়ে বিদেশে যাচ্ছেন। পরে দেখা গেছে তার বহরের অধিকাংশই, বিশেষ করে ব্যবসায়ী সঙ্গীরা নিজ খরচে তার সঙ্গে গেছেন_ উদ্দেশ্য বিদেশের সঙ্গে দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদার করা। বর্তমানেও তার লন্ডন সফরে যারা গেছেন, সবাই সরকারি খরচে গেছেন কিনা তা যাচাই করে সংবাদ ছাপা দায়িত্বশীল সংবাদপত্রের কর্তব্য। যদি দেখা যায় প্রধানমন্ত্রীর সব সঙ্গীই সরকারি খরচে গেছেন, অবশ্যই এই ব্যয়বাহুল্যের সমালোচনা চলে।
কিন্তু ঢাকার ইংরেজি দৈনিকে ৪ জুলাই প্রকাশিত প্রধানমন্ত্রীর লন্ডন সফর সম্পর্কিত খবরটি যারা পড়েছেন তারাই জানেন, খবরটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের বিষয়টি বাহুল্যমাত্র। আসল কথা, ব্রিটিশ সরকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সম্মান দেয়নি, তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেনি_ এই কথাটি প্রচার করা। লক্ষ্য করার বিষয়, শেখ হাসিনা ৪ জুলাই বিকেলে (লন্ডন সময়) লন্ডনে এসেছেন। ওইদিন সকালেই ইংরেজি কাগজটির খবর বিএনপি-জামায়াত মহল ফলাও করে লন্ডনে প্রচার করে এবং প্রধানমন্ত্রী সিকিউরিটিবিহীনভাবে লন্ডনে আসছেন_ এই খবর বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্য লন্ডনে সমবেত বিএনপি-জামায়াত শিবিরে উল্লাস সৃষ্টি করে। যদি খবরটি সত্য হতো এবং শেখ হাসিনার জন্য ব্রিটিশ সিকিউরিটির ব্যবস্থা না থাকত, তাহলে কোনো ধরনের অঘটন ঘটানোর জন্য বিক্ষোভকারীরা চেষ্টা করলে তা কি বিস্ময়কর হতো? দায়িত্বহীন এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ সাংবাদিকতা একটা দেশ ও জাতির কত ক্ষতি করতে পারে, প্রথম মহাযুদ্ধের আগে সার্বিয়ার যুবরাজের হত্যাকাণ্ড এবং বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়া থেকেও কি তার প্রমাণ পাওয়া যায় না?
শেখ হাসিনা যে দলেরই প্রধানমন্ত্রী হন, তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। বিদেশে তাকে অসম্মান করা হলে তা যে তার ব্যক্তিগত নয়, দেশের অসম্মান_ এই কথাটা বোঝার মতো জ্ঞানবুদ্ধিও কি আমরা ব্যক্তিগত বিদ্বেষে হারিয়ে ফেলেছি? ভারতে বিজেপি নেতা নরেন্দ্রনাথ মোদি কংগ্রেস সরকারের ঘোর শত্রু। তার ওপর সংখ্যালঘু নিধনকারী সাম্প্রদায়িক নেতা হিসেবে তিনি পরিচিত। তার এই পরিচিতির জন্য মার্কিন সরকার যখন তাকে আমেরিকায় যাওয়ার ভিসা দেয়নি, তখন কংগ্রেস নেতারা মোদির এই অসম্মানে হি হি করে হাসেননি। তারা মোদির এই অবমাননাকে জাতীয় অবমাননা বলে গণ্য করেছেন এবং মার্কিন সরকারের কাছে তীব্র প্রতিবাদ করেছেন।
সুতরাং বিদেশে শেখ হাসিনা যদি কোথাও অসম্মানিত হন, তাহলে সেটা হবে বাংলাদেশের জন্য অসম্মান। তখন দলমত-নির্বিশেষে সবাই তার প্রতিবাদ করবেন। এটাই আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন একটা দেশ ও জাতি করে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশেই একটি ইংরেজি কাগজের আচরণে তার অন্যথা দেখা গেল।
আমাদের সৌভাগ্যের কথা, লন্ডনে শেখ হাসিনার এবারের সফরটি ব্যক্তিগত এবং বেসরকারি সফর হওয়া সত্ত্বেও ব্রিটিশ সরকার তাকে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা দিয়েছে, সম্মান দেখিয়েছে এবং প্রমাণ হয়েছে, তড়িঘড়ি করে হাসিনার লন্ডন সফরের দিনই ভুয়া এবং বানোয়াট সূত্র উল্লেখ করে ইংরেজি দৈনিকটি যে খবর ছেপেছে, তা অসত্য এবং উদ্দেশ্যপূর্ণ। এটা এক ধরনের হেট ক্যাম্পেইন। আমার বলতে দ্বিধা নেই, সম্প্রতি চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হওয়ার পর প্যাথলজিক্যাল আওয়ামী লীগ-বিদ্বেষীরা তাদের নিরপেক্ষতার মুখোশ ছিঁড়ে আবার স্বরূপে আবির্ভূত হতে শুরু করেছেন। এই ইংরেজি দৈনিকটির অতি সাম্প্রতিক ভূমিকা তার প্রমাণ।
লন্ডন, ৫ জুলাই শুক্রবার, ২০১৩
শেখ হাসিনার এবারের লন্ডন সফর নিয়ে ব্রিটেনের বাংলাদেশি কমিউনিটির একটা সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মধ্যে উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছিল। কারণ, এ সফরের কথা ঘোষিত হতেই লন্ডনে বিএনপি-জামায়াতের নেতা, সমর্থক ও কর্মী মহলে দারুণ তৎপরতা শুরু হয়। পূর্ব লন্ডনের অধিকাংশ মসজিদ ও মাদ্রাসা এখন জামায়াতিদের শক্ত ঘাঁটি। গত ফেব্রুয়ারি মাসে শহীদ আলতাব আলী পার্কে ভাষা শহীদ মিনারে জুতো পায়ে উঠে জামায়াত কর্মীরা অসম্মান দেখায় এবং ইস্ট লন্ডন মসজিদে শুক্রবার জুমার নামাজের খুতবার পর মসজিদের ইমাম অধিকাংশ সময় শেখ হাসিনার নামোল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে উত্তেজনা ছড়ান। তার ধ্বংস কামনা করেন।
বাংলাদেশের চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পর ব্রিটেনে বিএনপি-জামায়াতের ঘাঁটিতে হিংস্র উল্লাস আরও বেড়ে যায় এবং আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে কীভাবে শায়েস্তা করা যাবে সে সম্পর্কে প্রকাশ্যে হুমকি দিতে তারা শুরু করেন। গুজব রটে যায়, লন্ডনে শেখ হাসিনাকে নাজেহাল করার জন্য তারেক রহমান তার দলীয় কর্মীদের সর্বশক্তি নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছেন। গোটা ইউরোপ থেকে কয়েক হাজার বিএনপি, জামায়াত কর্মী ও সমর্থককে লন্ডনে আনা হবে। তারা শুধু শেখ হাসিনাকে কালো পতাকাই দেখাবে না, সুযোগ পেলে তাকে লাঞ্ছিত করবে। এমনকি তার জীবন বিপন্ন হতে পারে। এই আশঙ্কা বিলাতের বাংলাদেশি কমিউনিটির সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে।
ব্রিটিশ সরকার সাধারণত সরকারিভাবে আমন্ত্রিত তাদের কোনো মেহমান ছাড়া ব্যক্তিগত সফরে আসা রাষ্ট্রনায়কদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা করে না। বাংলাদেশের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান যখন লন্ডন সফরে আসেন, তখনও তার সঙ্গে প্রেসিডেন্সিয়াল সিকিউরিটি ফোর্সের লোকজন ছিল। ব্রিটিশ সরকার কোনো বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেয়নি। শেখ হাসিনার বর্তমান সফরও যেহেতু বেসরকারি এবং ব্যক্তিগত সফর, সেহেতু ব্রিটিশ সরকার লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশনে জানিয়ে দিয়েছিল যে, শেখ হাসিনার জন্য মেট্রোপলিটন পুলিশ নিয়মমাফিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে; কিন্তু তার জন্য বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবে না। এই নিয়মটি সব বিদেশি রাষ্ট্রনায়ক বা সরকারপ্রধানদের (দু'একটি ব্যতিক্রম ছাড়া) জন্য প্রযোজ্য। সুতরাং রুটিনমাফিক এই চিঠি শেখ হাসিনার সফর সম্পর্কেও পাঠানো হয়েছিল।
সঙ্গে সঙ্গে লন্ডনে নবনিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মিজারুল কায়েস সতর্ক হন এবং ব্রিটিশ সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ধরা পড়ে, গ্যাপ অব ইনফরমেশনের জন্য এই অবস্থাটি ঘটেছে। বাংলাদেশের বর্তমান বিস্ফোরক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে হাত দিয়ে শেখ হাসিনা তার জীবনের ওপর যে বিশাল ঝুঁকি তৈরি করেছেন, অতীতে তার জীবনের ওপর অসংখ্য হামলা, ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা এবং এই হামলার পেছনে বিএনপির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের যোগাযোগের অভিযোগ সম্পর্কে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বহু সদস্য অবহিত। তাদের মধ্যে রয়েছেন কিথ জর্জ, ফ্রাঙ্ক ডবসন প্রমুখ প্রভাবশালী এমপি ও সাবেক মন্ত্রী। তারা বিষয়টি জানতেই সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে উদ্যোগী হন।
দেখা গেল, ক্যামেরন সরকার কোনো ভুল সিদ্ধান্ত বা ইচ্ছাকৃত সিদ্ধান্ত নেয়নি। এটা প্রথামাফিক সিদ্ধান্ত। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ দ্রুত এই সিদ্ধান্ত পাল্টায় এবং শেখ হাসিনাকে তার আগেরবারের সফরের চেয়েও অধিক নিরাপত্তাদানের ব্যবস্থা করে। ফলে আগে সিদ্ধান্ত ছিল, শেখ হাসিনা লন্ডনের যে হোটেলে অবস্থান করবেন, সেখানেই শুধু তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু পরে তার জন্য হিথরো বিমানবন্দর থেকে পার্ক স্ট্রিটে হিলটন হোটেল পর্যন্ত নিরাপত্তাদানেরও ব্যবস্থা করা হয়।
ব্রিটেন গণতান্ত্রিক দেশ। প্রতিবারের মতো এবারও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কালো পতাকাসহ বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্য লন্ডনের বিএনপি ও জামায়াতকে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তারা বৃহস্পতিবার বিকেলে হিলটন হোটেলের সামনে জড়ো হয়েছিল। দেখা গেল, যত গর্জায় তত বর্ষায় না। সারা ইউরোপ থেকে বিএনপি-জামায়াত যে ঝটিকা বাহিনী এনেছে তাদের সংখ্যা দেড়শ', দুইশ'। তার তুলনায় ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা জানাতে যত আওয়ামী সমর্থক ও বাংলাদেশি এসেছেন, তাদের সংখ্যা অনেক বেশি। তিনশ'-চারশ'র মতো। ব্রিটিশ পুলিশ এই দু'পক্ষকে বড় ধরনের সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত রেখেছে। সংঘর্ষ হলে ঝটিকা বাহিনীর কপালে কী ঘটত তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না।
মনে হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লন্ডনে অবস্থানের বাকি দিনগুলো ভালোভাবেই কেটে যাবে। তারেক রহমানের ঝটিকা বাহিনী পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে উপদ্রব সৃষ্টির চেষ্টা অবশ্যই চালিয়ে যাবে। কিন্তু তা মোকাবেলা করার জন্য ব্রিটিশ সরকারের বর্তমান নিরাপত্তা ব্যবস্থাই যথেষ্ট। শেখ হাসিনার নিরাপত্তা সম্পর্কে এবার (যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলার পরিপ্রেক্ষিতে) ব্রিটেনের বাঙালি কমিউনিটির মধ্যে যথেষ্ট উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা দেখা গেছে। বহু কমিউনিটি নেতা, বিশেষ করে লন্ডনের বিখ্যাত রেস্টুরেন্ট রেড ফোর্ডের মালিক আমিন আলী (যার জীবন নিয়ে উইল টু উইন নামে একটি ফিল্ম তৈরি হয়েছে) প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা দৃঢ় করার জন্য বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।
ব্রিটেনে বা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরকালীন নিরাপত্তার সঙ্গে (সরকারি বা বেসরকারি যে সফরই হোক) আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নটি জড়িত। এটাকে দলীয় বা ব্যক্তিগত স্বার্থে অবহেলা বা উপেক্ষা করা হলে তা হবে গুরুতর অপরাধ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল একবার সাইপ্রাসে গোপন সফরে যাচ্ছিলেন। তার যাত্রাপথটি ছিল বিপজ্জনক। জার্মান যুদ্ধবিমান যে কোনো সময় তার বিমানে হামলা চালাতে পারে। চার্চিলের এই গোপন সফরের খবরটি জানতে পেরেছিলেন তার রাজনীতির ঘোর বিরোধী এক সাংবাদিক। তিনি খবরটি হাতে পেয়েও প্রকাশ করতে চাননি। বলেছেন, 'আমি চার্চিলের রাজনীতির সমালোচনা করি; কিন্তু তার জীবন বিপন্ন হোক এমন কোনো খবর ফাঁস করতে পারি না। তাতে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারে।'
শেখ হাসিনার এবারের লন্ডন সফর উপলক্ষ করে বাংলাদেশের এক শ্রেণীর সংবাদপত্রে, বিশেষ করে একটি ইংরেজি দৈনিকে যে সাংবাদিকতা লক্ষ্য করেছি, তাতে মনে প্রশ্ন জেগেছে, আমাদের মধ্যে প্রজ্ঞাবান বলে পরিচিত এক শ্রেণীর সম্পাদকও কি নিজেদের দায়িত্বজ্ঞান হারিয়ে হেট ক্যাম্পেইনকে একজন প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা বলে চালাতে পারেন এবং এমন খবর ছাপতে পারেন, যা অসত্য ও অর্ধসত্যে পূর্ণ এবং যে খবর ছাপা হলে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন হতে পারে? এবং যে নিরাপত্তা বিপন্ন হওয়া মানে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা বিপন্ন হওয়া।
প্রধানমন্ত্রী বিশাল (৪৫ জন) অতিথি বহর নিয়ে সরকারি খরচে লন্ডনে এসেছেন, তার অবশ্যই সমালোচনা হতে পারে। কিন্তু সেই খবরের সত্যতা অর্থাৎ সরকারি খরচেই সবাই গিয়েছেন কিনা তা আগে যাচাই করা দরকার। এর আগেও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো হয়েছে যে, তিনি ৬০-৭০ জনের বিরাট বহর নিয়ে বিদেশে যাচ্ছেন। পরে দেখা গেছে তার বহরের অধিকাংশই, বিশেষ করে ব্যবসায়ী সঙ্গীরা নিজ খরচে তার সঙ্গে গেছেন_ উদ্দেশ্য বিদেশের সঙ্গে দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদার করা। বর্তমানেও তার লন্ডন সফরে যারা গেছেন, সবাই সরকারি খরচে গেছেন কিনা তা যাচাই করে সংবাদ ছাপা দায়িত্বশীল সংবাদপত্রের কর্তব্য। যদি দেখা যায় প্রধানমন্ত্রীর সব সঙ্গীই সরকারি খরচে গেছেন, অবশ্যই এই ব্যয়বাহুল্যের সমালোচনা চলে।
কিন্তু ঢাকার ইংরেজি দৈনিকে ৪ জুলাই প্রকাশিত প্রধানমন্ত্রীর লন্ডন সফর সম্পর্কিত খবরটি যারা পড়েছেন তারাই জানেন, খবরটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের বিষয়টি বাহুল্যমাত্র। আসল কথা, ব্রিটিশ সরকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সম্মান দেয়নি, তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেনি_ এই কথাটি প্রচার করা। লক্ষ্য করার বিষয়, শেখ হাসিনা ৪ জুলাই বিকেলে (লন্ডন সময়) লন্ডনে এসেছেন। ওইদিন সকালেই ইংরেজি কাগজটির খবর বিএনপি-জামায়াত মহল ফলাও করে লন্ডনে প্রচার করে এবং প্রধানমন্ত্রী সিকিউরিটিবিহীনভাবে লন্ডনে আসছেন_ এই খবর বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্য লন্ডনে সমবেত বিএনপি-জামায়াত শিবিরে উল্লাস সৃষ্টি করে। যদি খবরটি সত্য হতো এবং শেখ হাসিনার জন্য ব্রিটিশ সিকিউরিটির ব্যবস্থা না থাকত, তাহলে কোনো ধরনের অঘটন ঘটানোর জন্য বিক্ষোভকারীরা চেষ্টা করলে তা কি বিস্ময়কর হতো? দায়িত্বহীন এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ সাংবাদিকতা একটা দেশ ও জাতির কত ক্ষতি করতে পারে, প্রথম মহাযুদ্ধের আগে সার্বিয়ার যুবরাজের হত্যাকাণ্ড এবং বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়া থেকেও কি তার প্রমাণ পাওয়া যায় না?
শেখ হাসিনা যে দলেরই প্রধানমন্ত্রী হন, তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। বিদেশে তাকে অসম্মান করা হলে তা যে তার ব্যক্তিগত নয়, দেশের অসম্মান_ এই কথাটা বোঝার মতো জ্ঞানবুদ্ধিও কি আমরা ব্যক্তিগত বিদ্বেষে হারিয়ে ফেলেছি? ভারতে বিজেপি নেতা নরেন্দ্রনাথ মোদি কংগ্রেস সরকারের ঘোর শত্রু। তার ওপর সংখ্যালঘু নিধনকারী সাম্প্রদায়িক নেতা হিসেবে তিনি পরিচিত। তার এই পরিচিতির জন্য মার্কিন সরকার যখন তাকে আমেরিকায় যাওয়ার ভিসা দেয়নি, তখন কংগ্রেস নেতারা মোদির এই অসম্মানে হি হি করে হাসেননি। তারা মোদির এই অবমাননাকে জাতীয় অবমাননা বলে গণ্য করেছেন এবং মার্কিন সরকারের কাছে তীব্র প্রতিবাদ করেছেন।
সুতরাং বিদেশে শেখ হাসিনা যদি কোথাও অসম্মানিত হন, তাহলে সেটা হবে বাংলাদেশের জন্য অসম্মান। তখন দলমত-নির্বিশেষে সবাই তার প্রতিবাদ করবেন। এটাই আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন একটা দেশ ও জাতি করে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশেই একটি ইংরেজি কাগজের আচরণে তার অন্যথা দেখা গেল।
আমাদের সৌভাগ্যের কথা, লন্ডনে শেখ হাসিনার এবারের সফরটি ব্যক্তিগত এবং বেসরকারি সফর হওয়া সত্ত্বেও ব্রিটিশ সরকার তাকে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা দিয়েছে, সম্মান দেখিয়েছে এবং প্রমাণ হয়েছে, তড়িঘড়ি করে হাসিনার লন্ডন সফরের দিনই ভুয়া এবং বানোয়াট সূত্র উল্লেখ করে ইংরেজি দৈনিকটি যে খবর ছেপেছে, তা অসত্য এবং উদ্দেশ্যপূর্ণ। এটা এক ধরনের হেট ক্যাম্পেইন। আমার বলতে দ্বিধা নেই, সম্প্রতি চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হওয়ার পর প্যাথলজিক্যাল আওয়ামী লীগ-বিদ্বেষীরা তাদের নিরপেক্ষতার মুখোশ ছিঁড়ে আবার স্বরূপে আবির্ভূত হতে শুরু করেছেন। এই ইংরেজি দৈনিকটির অতি সাম্প্রতিক ভূমিকা তার প্রমাণ।
লন্ডন, ৫ জুলাই শুক্রবার, ২০১৩
No comments