সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-সংসদে অসংসদীয় ভাষা কে থামাবেন? by আফতাব উদ্দিন ছিদ্দিকী
সংসদে অশালীন ও অসংসদীয় ভাষার চর্চাটা
এতকাল বিচ্ছিন্ন ঘটনা হলেও হালে তা নিরবচ্ছিন্ন ঘটনায় পরিণত হয়েছে। অশালীন ও
অসংসদীয় ভাষা পরিহার করে স্পিকার প্রাসঙ্গিক বিষয়ে বক্তব্য দিতে অনুরোধ
করেন।
মাইক বন্ধ করলে আবার বিএনপি সংসদ সদস্য সৈয়দা আসিফা
আশরাফী ও শাম্মী আক্তার স্পিকারের দিকে আঙুল উঁচিয়ে চিৎকার করেন :'মাইক
দে, মাইক দে।' মহান সংসদে বসে আইন তৈরির চেয়ে আমাদের সংসদ সদস্যরা এমনতর
পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ি ও চরিত্র হননের খেলায় এখন বেশি বুঁদ। সংসদ চললে
প্রতি মিনিটে ৩০ হাজার টাকা খরচ, যা কররূপে জনগণই জোগান দেয়। তাছাড়া ১৬
কোটি মানুষের আশা-ভরসার স্থলও জাতীয় সংসদ। সেই মহান ও ব্যয়বহুল সংসদের এরূপ
অরুচিকর, নীতি-নৈতিকতাবিরুদ্ধ লাগাতার অপব্যবহার দেখে দেশবাসী যারপরনাই
হতবাক। একই সঙ্গে লজ্জিত, আতঙ্কিত ও ক্ষুব্ধ। তাদের মনে উদ্ধারহীন প্রশ্ন,
কী হচ্ছে এসব? সংসদীয় দায়মুক্তির অজুহাতে আইন তৈরির কারখানায় এ কেমন বেআইনি
কার্যকলাপ? এ রুচি বিকৃত, অশালীন ও ব্যক্তিগত বিষোদ্গারের প্রতিযোগিতা
থামানোর কি কেউ নেই? সংসদের অভিভাবক স্পিকার কি এখানে শুধু সাক্ষী গোপাল?
আইনের চোখে এ সমস্যার সমাধান খোঁজা যাক।
এটা সত্য, সংবিধানের ৭৮(৩) অনুচ্ছেদমতে, সংসদে প্রদত্ত বক্তব্য বিষয়ে সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে আদালতে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু এই দায়মুক্তি কোনো অর্থেই লাগামহীন, বেপরোয়া ও অশালীন বক্তব্য দেওয়ার লাইসেন্স নয়।
শালীনতা ও নৈতিকতাসাপেক্ষে বাক ও ভাবপ্রকাশের সীমারেখার ঊধর্ে্ব নয়। তাছাড়া এই দায়মুক্তির উপভোগ জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালিবিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ওই বিধির ২৬৭ ধারায় সংসদে সংসদ সদস্যদের অবশ্য পালনীয় আচরণবিধির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো :
১. কোন সাংসদের বক্তৃতাকালে তাকে উচ্ছৃঙ্খল উক্তি বা গোলমাল সৃষ্টি বা টীকা-টিপ্পনী-শিস বা অন্য কোনরূপ বিশৃঙ্খল আচরণ দ্বারা বাধা প্রদান করা যাবে না। ২. অপ্রাসঙ্গিক কোন বই, সংবাদপত্র বা চিঠিপত্র পাঠ করা যাবে না। ৩. স্পিকারের ভাষণদানকালে সংসদকক্ষ ত্যাগ চলবে না। ৪. সংসদের বক্তৃতা ব্যতিরেকে নীরবতা পালন করতে হবে। ৫. সংসদের কাজে বাধা প্রদান বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি নিষিদ্ধ। ৬. কোন সাধারণ গ্যালারি বা বিশেষ গ্যালারিতে কোন আগন্তুকের প্রবেশকালে কোনরূপ হর্ষধ্বনি বা বক্তৃতাকালে তার উদ্দেশে কোন উক্তি করা যাবে না।
২৭০ ধারাতে আছে বক্তৃতাকালে পালনীয় নিয়মনীতির বর্ণনা। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো :১. সংসদে বক্তৃতাকালে আদালতে বিচারাধীন বিষয়ে কথা বলা যাবে না। ২. প্রাসঙ্গিকভাবে একান্ত অপরিহার্য না হলে মন্ত্রী বা সরকারি পদে অধিষ্ঠিত কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত অভিযোগ চলবে না। ৩. সংসদের পরিচালনা বা কার্যপ্রবাহ সম্পর্কে অপ্রীতিকর ভাষা ব্যবহার করা যাবে না। ৪. রহিত করার প্রস্তাব ব্যতীত সংসদের কোন সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কটাক্ষ করা যাবে না। ৫. বক্তৃতায় কোন আক্রমণাত্মক, কটু বা অশ্লীল ভাষা কিংবা দেশদ্রোহিতামূলক, রাষ্ট্রবিরোধী বা মানহানিকর উক্তি নিষিদ্ধ। ৬. কোন বিতর্কে অসৌজন্যমূলকভাবে কোন সংসদ সদস্যের নাম উল্লেখ চলবে না।
সংসদীয় কার্যপ্রণালিতে প্রচলিত কাদা ছোড়াছুড়ি বা ব্যক্তিগত আক্রমণ দূরে থাক, সংসদে কারও বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ পেশের সুযোগ পর্যন্ত নেই। সে ক্ষেত্রে স্পিকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে আগে তা জানাতে হয়, যাতে তারা তদন্তপূর্বক উত্তরদানের জন্য প্রস্তুত হতে পারেন। স্পিকার অনুমতি দিলেই পরে অভিযোগ সংসদে পেশ করা যাবে (ধারা-২৭১)। এমনকি কোনো সাংসদের কাছে সরাসরি কোনো প্রশ্ন উত্থাপনের নিয়মও নেই। করতে হয় স্পিকারের মাধ্যমে (ধারা-২৭২)। অথচ সংসদে ধান ভানতে শীবের গীত শোনাতেই আমাদের সাংসদদের তৃপ্তি।
ওই কার্যপ্রণালিতে বর্ণিত আচরণবিধি বা নিয়মনীতি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে স্পিকারকে বিবিধ ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে। যেমন_ সংসদ চলাকালে কোনো সংসদ সদস্য গুরুতর বিশৃঙ্খল আচরণ করলে (স্পিকারের বিবেচনায়) স্পিকার তাকে অবিলম্বে সংসদ ত্যাগ ও নির্ধারিত সময়ের জন্য ওই দিনের বৈঠকে অনুপস্থিত থাকতে নির্দেশ দিতে পারেন (ধারা-১৫)। কোনো সংসদ সদস্য স্পিকারের কর্তৃত্ব অমান্য করলে এবং বারবার ও ইচ্ছাকৃতভাবে সংসদের কাজে বাধাদানের জন্য বিধিগুলোর অপব্যবহার করলে স্পিকার তাকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করতে পারেন (ধারা-১৬)। বিশৃঙ্খলা গুরুতর হলে স্পিকার প্রয়োজনবোধে নির্ধারিত সময়ের জন্য বৈঠক স্থগিত করতে পারেন (ধারা-১৭)। এমনকি বিতর্কে ব্যবহৃত অবমাননাকর বা অশোভন বা সংসদ রীতিবিরোধী বা অমর্যাদাকর শব্দাবলি সংসদের কার্যবাহ হতে বাতিল করতে পারেন (ধারা-৩০৭)। অন্যদিকে কোনো সংসদ সদস্য অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য দিলে বা বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করলে স্পিকার সতর্কতাপূর্বক তাকে বক্তৃতা বন্ধের নির্দেশ দিতে পারেন। তখন ওই সংসদ সদস্য তার আসনে বসে পড়বেন (ধারা-২৭৩)।
প্রকৃতপক্ষে সংসদে শৃঙ্খলা রক্ষার সম্পূর্ণ দায়িত্ব এবং তা পালনে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের সমস্ত ক্ষমতা স্পিকারের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। (ধারা-৩০৩)। শৃঙ্খলা রক্ষা ছাড়াও সংসদের কার্যপ্রণালি নিয়ন্ত্রণ বা কার্যপরিচালনার প্রয়োজনে গৃহীত যে কোনো সিদ্ধান্ত কার্যকরের ক্ষমতা স্পিকারের আছে (ধারা-১৪(৫)। এমনকি সংসদ এবং সংসদের কমিটিগুলোর কার্যাবলি সম্পর্কিত যে বিষয়ে বিদ্যমান সংসদীয় কার্যপ্রণালিতে কিছু বলা নেই, সে ব্যাপারেও স্পিকারকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে (ধারা-৩১৬)। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৭৮(২) মতে, স্পিকারের ওইরূপ সিদ্ধান্তগুলোকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করার আইনগত সুযোগও নেই।
অর্থাৎ সংসদের কার্যপ্রণালি নিয়ন্ত্রণ, কার্যপরিচালনা বা শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে স্পিকারই সর্বেসর্বা এবং সে ক্ষেত্রে গৃহীত যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য তিনি আইনানুগভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত। একই সঙ্গে তজ্জন্য দায়মুক্ত।
সংসদে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে স্পিকার সাধারণত সাময়িকভাবে মাইক বন্ধ বা কার্যবাহ হতে আপত্তিকর শব্দ বাতিলেই সীমাবদ্ধ থাকেন। জানি, নিরপেক্ষতা অর্জন বা ধরে রাখার জন্য ভারসাম্যমূলক ব্যবস্থা হিসেবে এতটুকুতেই তাকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। কিন্তু অশালীন, মানহানিকর কুৎসাপূর্ণ ও অসংসদীয় ভাষায় লাগাতার চর্চায় সংসদ সদস্য ও সংসদের ভাবমূর্তি যে তলানিতে ঠেকেছে, তা থেকে ফিরিয়ে আনতে অভিযুক্ত সংসদ সদস্যকে বহিষ্কার, সাময়িক অপসারণসহ কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। গত ২৪ জুন সংসদ অধিবেশনে সরকারি দলের সংসদ সদস্য জুনাইদ আহমেদ পলক সংসদের অশালীন বক্তব্য বন্ধে প্রতিটি অশালীন শব্দের জন্য ৩০ হাজার টাকা জরিমানা আরোপের প্রস্তাব দেন। পরদিন বিএনপির সিনিয়র নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদও তাতে সমর্থন ব্যক্ত করেন। স্পিকার চাইলে এ প্রস্তাব কার্যকর করতে পারেন। ভারতে ৯০০ পৃষ্ঠাব্যাপী অসংসদীয় শব্দের শব্দকোষ তৈরি হয়েছে। গত ৬৬ বছরের বিতর্কে স্পিকারের রোলিংয়ের ভিত্তিতে ওই শব্দকোষ তৈরি হয়। স্পিকারের উদ্যোগে আমাদের দেশেও এরূপ একটা শব্দকোষ প্রণয়ন করা যেতে পারে। আমাদের সংসদীয় ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিবেচনায় এরূপ আরও বহুবিধ নিবারণমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, সংসদীয় সংস্কৃতিতে অবক্ষয়ের যে পাগলা ঘোড়া এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তাকে থামানোর এটাই চূড়ান্ত সময়। স্পিকার চাইলে এ ক্ষেত্রে আইনগতভাবে কাণ্ডারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন।
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
aftabragib@yahoo.com
এটা সত্য, সংবিধানের ৭৮(৩) অনুচ্ছেদমতে, সংসদে প্রদত্ত বক্তব্য বিষয়ে সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে আদালতে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু এই দায়মুক্তি কোনো অর্থেই লাগামহীন, বেপরোয়া ও অশালীন বক্তব্য দেওয়ার লাইসেন্স নয়।
শালীনতা ও নৈতিকতাসাপেক্ষে বাক ও ভাবপ্রকাশের সীমারেখার ঊধর্ে্ব নয়। তাছাড়া এই দায়মুক্তির উপভোগ জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালিবিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ওই বিধির ২৬৭ ধারায় সংসদে সংসদ সদস্যদের অবশ্য পালনীয় আচরণবিধির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো :
১. কোন সাংসদের বক্তৃতাকালে তাকে উচ্ছৃঙ্খল উক্তি বা গোলমাল সৃষ্টি বা টীকা-টিপ্পনী-শিস বা অন্য কোনরূপ বিশৃঙ্খল আচরণ দ্বারা বাধা প্রদান করা যাবে না। ২. অপ্রাসঙ্গিক কোন বই, সংবাদপত্র বা চিঠিপত্র পাঠ করা যাবে না। ৩. স্পিকারের ভাষণদানকালে সংসদকক্ষ ত্যাগ চলবে না। ৪. সংসদের বক্তৃতা ব্যতিরেকে নীরবতা পালন করতে হবে। ৫. সংসদের কাজে বাধা প্রদান বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি নিষিদ্ধ। ৬. কোন সাধারণ গ্যালারি বা বিশেষ গ্যালারিতে কোন আগন্তুকের প্রবেশকালে কোনরূপ হর্ষধ্বনি বা বক্তৃতাকালে তার উদ্দেশে কোন উক্তি করা যাবে না।
২৭০ ধারাতে আছে বক্তৃতাকালে পালনীয় নিয়মনীতির বর্ণনা। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো :১. সংসদে বক্তৃতাকালে আদালতে বিচারাধীন বিষয়ে কথা বলা যাবে না। ২. প্রাসঙ্গিকভাবে একান্ত অপরিহার্য না হলে মন্ত্রী বা সরকারি পদে অধিষ্ঠিত কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত অভিযোগ চলবে না। ৩. সংসদের পরিচালনা বা কার্যপ্রবাহ সম্পর্কে অপ্রীতিকর ভাষা ব্যবহার করা যাবে না। ৪. রহিত করার প্রস্তাব ব্যতীত সংসদের কোন সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কটাক্ষ করা যাবে না। ৫. বক্তৃতায় কোন আক্রমণাত্মক, কটু বা অশ্লীল ভাষা কিংবা দেশদ্রোহিতামূলক, রাষ্ট্রবিরোধী বা মানহানিকর উক্তি নিষিদ্ধ। ৬. কোন বিতর্কে অসৌজন্যমূলকভাবে কোন সংসদ সদস্যের নাম উল্লেখ চলবে না।
সংসদীয় কার্যপ্রণালিতে প্রচলিত কাদা ছোড়াছুড়ি বা ব্যক্তিগত আক্রমণ দূরে থাক, সংসদে কারও বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ পেশের সুযোগ পর্যন্ত নেই। সে ক্ষেত্রে স্পিকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে আগে তা জানাতে হয়, যাতে তারা তদন্তপূর্বক উত্তরদানের জন্য প্রস্তুত হতে পারেন। স্পিকার অনুমতি দিলেই পরে অভিযোগ সংসদে পেশ করা যাবে (ধারা-২৭১)। এমনকি কোনো সাংসদের কাছে সরাসরি কোনো প্রশ্ন উত্থাপনের নিয়মও নেই। করতে হয় স্পিকারের মাধ্যমে (ধারা-২৭২)। অথচ সংসদে ধান ভানতে শীবের গীত শোনাতেই আমাদের সাংসদদের তৃপ্তি।
ওই কার্যপ্রণালিতে বর্ণিত আচরণবিধি বা নিয়মনীতি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে স্পিকারকে বিবিধ ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে। যেমন_ সংসদ চলাকালে কোনো সংসদ সদস্য গুরুতর বিশৃঙ্খল আচরণ করলে (স্পিকারের বিবেচনায়) স্পিকার তাকে অবিলম্বে সংসদ ত্যাগ ও নির্ধারিত সময়ের জন্য ওই দিনের বৈঠকে অনুপস্থিত থাকতে নির্দেশ দিতে পারেন (ধারা-১৫)। কোনো সংসদ সদস্য স্পিকারের কর্তৃত্ব অমান্য করলে এবং বারবার ও ইচ্ছাকৃতভাবে সংসদের কাজে বাধাদানের জন্য বিধিগুলোর অপব্যবহার করলে স্পিকার তাকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করতে পারেন (ধারা-১৬)। বিশৃঙ্খলা গুরুতর হলে স্পিকার প্রয়োজনবোধে নির্ধারিত সময়ের জন্য বৈঠক স্থগিত করতে পারেন (ধারা-১৭)। এমনকি বিতর্কে ব্যবহৃত অবমাননাকর বা অশোভন বা সংসদ রীতিবিরোধী বা অমর্যাদাকর শব্দাবলি সংসদের কার্যবাহ হতে বাতিল করতে পারেন (ধারা-৩০৭)। অন্যদিকে কোনো সংসদ সদস্য অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য দিলে বা বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করলে স্পিকার সতর্কতাপূর্বক তাকে বক্তৃতা বন্ধের নির্দেশ দিতে পারেন। তখন ওই সংসদ সদস্য তার আসনে বসে পড়বেন (ধারা-২৭৩)।
প্রকৃতপক্ষে সংসদে শৃঙ্খলা রক্ষার সম্পূর্ণ দায়িত্ব এবং তা পালনে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের সমস্ত ক্ষমতা স্পিকারের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। (ধারা-৩০৩)। শৃঙ্খলা রক্ষা ছাড়াও সংসদের কার্যপ্রণালি নিয়ন্ত্রণ বা কার্যপরিচালনার প্রয়োজনে গৃহীত যে কোনো সিদ্ধান্ত কার্যকরের ক্ষমতা স্পিকারের আছে (ধারা-১৪(৫)। এমনকি সংসদ এবং সংসদের কমিটিগুলোর কার্যাবলি সম্পর্কিত যে বিষয়ে বিদ্যমান সংসদীয় কার্যপ্রণালিতে কিছু বলা নেই, সে ব্যাপারেও স্পিকারকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে (ধারা-৩১৬)। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৭৮(২) মতে, স্পিকারের ওইরূপ সিদ্ধান্তগুলোকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করার আইনগত সুযোগও নেই।
অর্থাৎ সংসদের কার্যপ্রণালি নিয়ন্ত্রণ, কার্যপরিচালনা বা শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে স্পিকারই সর্বেসর্বা এবং সে ক্ষেত্রে গৃহীত যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য তিনি আইনানুগভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত। একই সঙ্গে তজ্জন্য দায়মুক্ত।
সংসদে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে স্পিকার সাধারণত সাময়িকভাবে মাইক বন্ধ বা কার্যবাহ হতে আপত্তিকর শব্দ বাতিলেই সীমাবদ্ধ থাকেন। জানি, নিরপেক্ষতা অর্জন বা ধরে রাখার জন্য ভারসাম্যমূলক ব্যবস্থা হিসেবে এতটুকুতেই তাকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। কিন্তু অশালীন, মানহানিকর কুৎসাপূর্ণ ও অসংসদীয় ভাষায় লাগাতার চর্চায় সংসদ সদস্য ও সংসদের ভাবমূর্তি যে তলানিতে ঠেকেছে, তা থেকে ফিরিয়ে আনতে অভিযুক্ত সংসদ সদস্যকে বহিষ্কার, সাময়িক অপসারণসহ কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। গত ২৪ জুন সংসদ অধিবেশনে সরকারি দলের সংসদ সদস্য জুনাইদ আহমেদ পলক সংসদের অশালীন বক্তব্য বন্ধে প্রতিটি অশালীন শব্দের জন্য ৩০ হাজার টাকা জরিমানা আরোপের প্রস্তাব দেন। পরদিন বিএনপির সিনিয়র নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদও তাতে সমর্থন ব্যক্ত করেন। স্পিকার চাইলে এ প্রস্তাব কার্যকর করতে পারেন। ভারতে ৯০০ পৃষ্ঠাব্যাপী অসংসদীয় শব্দের শব্দকোষ তৈরি হয়েছে। গত ৬৬ বছরের বিতর্কে স্পিকারের রোলিংয়ের ভিত্তিতে ওই শব্দকোষ তৈরি হয়। স্পিকারের উদ্যোগে আমাদের দেশেও এরূপ একটা শব্দকোষ প্রণয়ন করা যেতে পারে। আমাদের সংসদীয় ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিবেচনায় এরূপ আরও বহুবিধ নিবারণমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, সংসদীয় সংস্কৃতিতে অবক্ষয়ের যে পাগলা ঘোড়া এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তাকে থামানোর এটাই চূড়ান্ত সময়। স্পিকার চাইলে এ ক্ষেত্রে আইনগতভাবে কাণ্ডারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন।
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
aftabragib@yahoo.com
No comments