মিসর ও নির্বাচনবাদী ইসলামপন্থার সংকট by ফরহাদ মজহার
মিসরের
সেনাবাহিনী সংবিধান স্থগিত ও নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। যুক্তি
দিয়েছে বিরোধী দলের সঙ্গে সেনাবাহিনীর বেঁধে দেয়া ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সমঝোতা
করতে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি ব্যর্থ হয়েছেন। সমঝোতার একটা
প্রস্তাব শেষ মুহূর্তে মুরসি দিয়েছিলেন, কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
মোহাম্মদ মুরসির পতনে ইসলামপন্থী মুসলিম ব্রাদারহুড বিরোধী সেক্যুলারিস্ট
এবং উদারপন্থীরা দারুণ উল্লসিত। উল্লসিত ব্রাদারহুডবিরোধী ভিন্নধারার
ইসলামপন্থীরাও। তারা তাহরির ময়দানে মুরসি সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ
জানাচ্ছিল। সেই বিক্ষোভ জানানোর যথেষ্ট কারণ মোহাম্মদ মুরসির স্বল্পস্থায়ী
দুই বছরের শাসনামলের ভুলভ্রান্তি, সন্দেহ নেই। কিন্তু গত দুই বছরের
অচলাবস্থার সব দোষ শুধু নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া
ব্রাদারহুডের বা মোহাম্মদ মুরসির একার নয়। সবারই। সেনাবাহিনী মুরসিকে
ক্ষমতা থেকে উৎখাত করায় তাহরির ময়দানে আনন্দ আর উল্লাস দেখা গেছে। তাহরিরে
একবার আমরা দেখেছিলাম হোসনি মোবারকের দীর্ঘ সেনা সমর্থিত স্বৈরশাসনের
অবসানে বিজয়ের আনন্দ, আর এবার দেখছি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একটি
সরকারকে সেনাবাহিনী উৎখাত করেছে বলে উল্লাস। এ ঘটনা থেকে এ সিদ্ধান্ত টানা
কতটুকু সঠিক যে সেক্যুলারিস্ট ও উদারবাদীরা ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়াই
করতে গিয়ে নিজের কান কিংবা নাক কেটে ফেলতে রাজি। অর্থাৎ মিসরের জনগণের
দীর্ঘ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে অর্জিত নির্বাচনী ব্যবস্থাকে রক্ষা করা তারা
গুরুত্বপূর্ণ মনে করেনি, তার চেয়ে মুরসিকে ক্ষমতা থেকে তাড়ানো তাদের কাছে
গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। সেনাবাহিনী পাশ্চাত্য শক্তির সমর্থন ছাড়া এই কাজ
করেছে মনে হয় না। তবে লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, একটি নির্বাচিত সরকারকে
সশস্ত্র শক্তির জোরে উৎখাত করার বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের জন্য কাতর পাশ্চাত্য
কোনো দেশ বিচলিত বোধ করে আপত্তি জানায়নি। তাদের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা হচ্ছে, এর
ফলে মিসরে যেন সন্ত্রাস ও সহিংসতা ব্যাপক ও বিস্তৃতি লাভ না করে ।
বিশ্লেষণ বিবর্জিত কায়দায় কিছুই না বোঝার আলস্য প্রমাণ করে, মিসরের ঘটনাকে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দিয়ে বোঝার চেষ্টা অনেকে করবেন। ষড়যন্ত্র থাকতেই পারে। থাকেও। বিভিন্ন শ্রেণী ও শক্তি পরস্পরের বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্র’ করে, লড়াই সংগ্রামের নানা মোড় বা বাঁক থাকে, কিন্তু রাজনীতি ষড়যন্ত্র মাত্র নয়। কোনো একটি ‘ষড়যন্ত্র’ কেন সফল বা বিফল হল তার ব্যাখ্যার জন্য সমাজ ও রাজনীতির গতিপ্রক্রিয়ার হদিস নেয়া জরুরি হয়ে পড়ে। যারা বলছেন মার্কিন, ইসরাইলি ও পাশ্চাত্য শক্তির ষড়যন্ত্রে একটি নির্বাচিত ইসলামপন্থী সরকারের পতন ঘটেছে, তারা পুরোটা সঠিক বলছেন না। সেনাবাহিনী মার্কিন ও ইসরাইলি স্বার্থরক্ষা করবে, এটা নতুন কোনো তথ্য নয়। সেনাবাহিনীর প্রতি মার্কিন-ইসরাইলি সমর্থন ছাড়া সাধারণভাবে পাশ্চাত্যের সমর্থন থাকাটা অসম্ভব কিছু নয়। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মিসরের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির নিজস্ব টানাপোড়েন আছে। তাকে উহ্য রেখে কিংবা হিসাবে না নিলে মিসরের রাজনীতির কিছুই আমরা বুঝব না। মিসরে একটি উদার নির্বাচনমুখী লিবারেল রাজনৈতিক পরিস্থিতি বহাল থাকুক এটা পাশ্চাত্য দেশগুলো একদমই চায়নি বা চায় না সেটা বলা যাবে না। মিসরের ঘটনাবলী সম্পর্কে জুলাইয়ের তিন তারিখে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্র“প যে মন্তব্য করেছে, তার মূল সুরটা পাশ্চাত্যের স্বার্থে মিসরে একটি উদার গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি বজায় রাখার পক্ষে ওকালতি বলা যায়। ফলে রাষ্ট্রভেদে ভিন্নতা সত্ত্বেও মিসরের ঘটনাবলীর প্রতি পাশ্চাত্যের সাধারণ মনোভাব বোঝা কঠিন নয়। সে মনোভাব হচ্ছে, পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে যে রাজনৈতিক ধারাগুলো নিরাপস লড়ছে তাদের বাদ দিয়ে উদার ও নির্বাচনবাদী ইসলামপন্থীদের সঙ্গে পাশ্চাত্য দেশগুলো রাজনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে রাজি। ‘ভালো মুসলমানদের’ সঙ্গে কৌশলগত মৈত্রী এবং ‘খারাপ মুসলমানদের’ বিরুদ্ধে যুদ্ধ- এই নীতি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্য দেশগুলো সরে আসেনি। সে কারণে মিসরে সেক্যুলারিস্ট বা লিবারেলদের তিরস্কার করতে তাদের বাধা নাই। সময় ও সুযোগ পেলে এই নীতি নিয়ে আমরা আগামী কোনো এক নিবন্ধে আলোচনা করব। এখানে মিসরের ঘটনাবলী থেকে বাংলাদেশে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় কিছু আছে কি-না সে কথা মনে রেখে দুই-একটি কথা বলব।
২
ঠিক যে, মুরসি কিছুকাল আগে সব ক্ষমতা নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু প্রতিবাদের মুখে সরেও এসেছিলেন। বিরোধীদের প্রতি কড়া কথা কম বলেননি, কিন্তু আপসের চেষ্টাও করেছেন। তিনি বিরোধীদের জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠন করার প্রস্তাব এবং নতুন পার্লামেন্টের নির্বাচন ত্বরান্বিত করার প্রতিশ্র“তিও দিয়েছিলেন। কিন্তু বিরোধী পক্ষ তার সরকারে যোগদানের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ হোসনি মোবারকের বিরুদ্ধে পরিচালিত গণআন্দোলনের অর্জন ধরে রাখার জন্য গণঐক্যের চেষ্টা করেছেন মুরসি। নির্বাচিত হয়ে শুধু ব্রাদারহুডের সরকার গঠন করা তিনি জাতীয় ঐক্য ধরে রাখার জন্য যথেষ্ট মনে করেননি। যদিও এই উপলব্ধি একটু দেরিতে হয়েছিল। কিন্তু এটা পরিষ্কার, একটি জাতীয় সরকার গঠনের সম্ভাবনা নস্যাৎ হওয়ার পেছনে মোহাম্মদ মুরসিকে একা দায়ী করা যায় না। তাছাড়া গণপরিষদ মুরসি বিলুপ্ত করেননি, করেছে সর্বোচ্চ প্রশাসনিক আদালত। মিসরের অর্থনৈতিক দুর্দশার জন্য শুধু মুরসির অর্থনৈতিক নীতি দায়ী নয়, বরং আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানের অধীনে থেকে মিসরীয় জনগণের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করা মোটেও সহজ কাজ ছিল না। এখনও নয়।
জেনারেল আবদেল ফাতাহ আল সিসি মোহাম্মদ মুরসিকে অপসারণের ঘোষণা যখন টেলিভিশনে দিচ্ছিলেন, মুরসিবিরোধী রাজনৈতিক দলের অনেক প্রভাবশালী নেতা তার পাশে ছিলেন। যেমন বিরোধীদলীয় নেতা মোহামেদ আল-বারাদেই, আল আজহার মসজিদের শেখ, ইসলামপন্থী নূর পার্টির এবং কপটিক খ্রিস্টীয় সম্প্রদায়ের প্রধান।
সেনাবাহিনী ১৯৫২ সাল থেকে যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছিল, মুরসি তা বহাল রেখেছিলেন। সংবিধান সভায় ব্রাদারহুড সদস্যরাই নির্বাচিত হয়ে এসেছিলেন, সংবিধান প্রণয়নের সভায় তাদেরই প্রাধান্য ছিল, তারাই নতুন সংবিধানের খসড়া করেছিলেন এবং মুরসি তাকে সমর্থনও করেছিলেন। কিন্তু সেই সংবিধানে সেনাবাহিনীকে গণতন্ত্রবহির্ভূত ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। যেমন মিলিটারি ট্রাইব্যুনালে বেসামরিক নাগরিকদের বিচার করার সাংবিধানিক ক্ষমতা। বাজেট বরাদ্দ অনুযায়ী রাষ্ট্র থেকে পাওয়া অর্থ কোথায় কিভাবে খরচ করবে, তার জন্য পার্লামেন্ট বা জনগণের কাছে জবাবদিহি করার দায় থেকে সেনাবাহিনী মুক্ত ছিল। একটি জাতীয় প্রতিরক্ষা কাউন্সিল এমনভাবে গঠনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল, যেখানে সেনাবাহিনীরই প্রতিনিধিত্ব বা আধিপত্য বহাল থাকে। সেই জাতীয় প্রতিরক্ষা কাউন্সিলকে যে কোনো খসড়া আইনের বিরুদ্ধে ভেটো দেয়ার ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল। সংবিধানের ভূমিকায় (preamble) ২০১১ সালের গণবিক্ষোভে সেনাবাহিনীর ‘অবদান’ আছে স্বীকার করা হয়েছিল।
এই পরিস্থিতি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার জন্য হুমকি হয়ে উঠেছিল। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে নতুন সংবিধান সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। অর্থাৎ গণআন্দোলন ও গণবিক্ষোভের পরে একটি গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র প্রণয়ন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের যে ইচ্ছা, আকাক্সক্ষা ও সংকল্প মিসরীয় জনগণের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল, মোহাম্মদ মুরসি তার বিপরীত দিকে অবস্থান নিয়েছিলেন। মুরসির সরকারের বিরুদ্ধে যারা বিক্ষোভ করছিলেন, তারা পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সন্ত্রাসী ও সহিংস কার্যকলাপের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন।
প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের মুখে ব্রাদারহুড নিজের পক্ষে যে যুক্তি খাড়া করছিল তার মূল কথা ছিল, বৈধতা। যেহেতু ব্রাদারহুড জনগণের ভোটে নির্বাচিত, অতএব তাদের সব সিদ্ধান্ত ‘বৈধ’। নির্বাচনে জিতে আসাটাই যা কিছু করার ‘বৈধতা’ অর্জনের মানদণ্ড। নির্বাচনবাদী ইসলামপন্থীরা গণতন্ত্র সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করে, তার সঙ্গে মোহাম্মদ মুরসির কার্যকলাপ ভিন্ন কিছু নয়। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হতে পারাটাই আসল কথা। এই নির্বাচনী বিজয়ই ক্ষমতাসীনদের যে কোনো আইন বা বিধান প্রণয়নের ক্ষমতা দেয়। ফলে নির্বাচিত হয়ে এসে একটি ইসলামী সংবিধান প্রণয়ন ও ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমও তা হলে ‘বৈধ’। ব্রাদারহুডের যুক্তি হচ্ছে, মুরসি তো অবৈধ কিছু করেননি, তিনি যা করেছেন তা বৈধভাবেই করেছেন। অতএব তা গণতন্ত্রবিরোধী হলেও অন্যদের তা মানতে হবে। বলাবাহুল্য, ব্রাদারহুড ও তাদের সমর্থকরা ছাড়া বাকি মিসরীয় জনগণ এই ‘বৈধতার’ যুক্তি মানেননি। কারণ লড়াইটা গণতন্ত্রের জন্য, নির্বাচন সেই লড়াইয়ের ধারাবাহিকতার একটি স্তর মাত্র। মোহাম্মদ মুরসি ও ব্রাদারহুডের নির্বাচনে জয়ী হওয়া চলমান লড়াইয়েরই অংশ। নির্বাচিত হয়েছে বলেই ব্রাদারহুড এমন কোনো সংবিধান দিতে পারে না, যা জনগণের গণতান্ত্রিক আশা-আকাক্সক্ষার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।
মিসরের ঘটনাবলীকে আমি এভাবে হাজির করার কারণ হচ্ছে, এখান থেকে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় দিকগুলো চিহ্নিত করা। বাংলাদেশেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অর্থ একই সঙ্গে সংবিধান সভার নির্বাচনও বটে। কারণ জাতীয় সংসদ সংবিধান পরিবর্তনের ক্ষমতা রাখে। এখানেও আমরা দেখি নির্বাচিত হয়ে গণতন্ত্রের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ সংশোধনী আনা ও আইন প্রণয়ন করা স্বাভাবিক ঘটনা। যেহেতু জাতীয় সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে সেই সংশোধনী বা আইন পাস হয়, অতএব এসব সংশোধনী ও আইন ‘বৈধ’। সব সরকারের আমলেই এই কুকর্ম হয়েছে। তবে শেখ হাসিনার বর্তমান আমল অন্তত এই দিক থেকে বাংলাদেশের ইতিহাসে অসাধারণ বলেই বিবেচিত হবে। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের পুরো ৭ মার্চের বক্তৃতাই সংবিধানে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এই নজির তৈরি হওয়ায় বাংলাদেশের ইসলামপন্থীদের আগামীতে বেশ সুবিধাই হবে। তারা চাইলে আখেরি নবীর বিদায় হজের ভাষণ, কিংবা সম্ভব হলে সহি বোখারি পুরোটাই সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে পারবেন। যদি ইসলামপন্থীরা কোনোদিন ক্ষমতায় এসে পুরো কোরআন শরিফ সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করতে চান, তাহলে সেটাও বৈধ হবে। এর পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সমর্থন থাকবে। শেখ হাসিনা যদি শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা সংবিধানে যুক্ত করতে পারেন, তো কোরআন শরিফ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না কেন? তিনি যদি পেরে থাকেন, তাহলে ইসলামপন্থীরা পারবেন না কেন? এখন যেভাবে আমরা পঞ্চদশ সংশোধনীসহ বাংলাদেশের সংবিধানকে মানছি, তখনও তেমনি মেনে নিতে হবে। শেখ হাসিনার রাজনীতি আর ব্রাদারহুডের রাজনীতি এই দিক থেকে আলাদা কিছু নয়। বৈধতার রাজনীতি আর গণতান্ত্রিক রাজনীতি সমার্থক নয়। আমরা এখনও তার ফারাক করতে শিখিনি।
৩
যে কোনো নির্বাচনবাদী অগণতান্ত্রিক শক্তির মতো নির্বাচনবাদী ইসলামপন্থীদেরও সাধারণ রাজনৈতিক কৌশল হচ্ছে নির্বাচনের সুবিধা নিয়ে সরকার গঠন করার সুযোগ অর্জন করা এবং সরকারে থেকে রাষ্ট্রের চরিত্র বদলে দেয়া। অর্থাৎ গণতন্ত্র কায়েম না করে রাষ্ট্রকে ইসলামী চরিত্র দান করার চেষ্টা করা। ইসলামবিরোধীরা যাকে মধ্যযুগীয় শাসন ব্যবস্থা বলে গণ্য করে এবং অনায়াসে প্রমাণ করতে পারে, পাশ্চাত্যে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মানবেতিহাসের অর্জনগুলোর সঙ্গে এ ধরনের শাসন ব্যবস্থার মৌলিক বিরোধ রয়েছে। এটাও তারা অনায়াসে প্রমাণ করতে পারে যে, গণতন্ত্রের সুবিধা নিয়ে নির্বাচনবাদী ইসলামপন্থীরা গণতন্ত্র ধ্বংস করার কপট কৌশল গ্রহণ করে। গণতন্ত্রের জন্য যা বিপজ্জনক। নির্বাচনবাদী ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে, এই ধারা আসলে গণতন্ত্রেই বিশ্বাস করে না। কিন্তু গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে গণতন্ত্র নস্যাৎ করার চেষ্টা চালায়। রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক হোক বা না হোক, নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করার ব্যবস্থায় ইসলামপন্থী রাজনীতি নিষিদ্ধ করার যে দাবি তোলা হয়, তাকে সে কারণে শুধু ইসলাম বা ধর্মের বিরোধিতা বলে গণ্য করা ভুল হবে। সেটা এই কপটতারও বিরোধিতা বটে। যে কোনো অগণতান্ত্রিক, বর্ণবাদী ও গণবিরোধী শক্তি জাতিবাদ, সমাজতন্ত্র কিংবা ধর্মনিরপেক্ষতার স্লোগান দিয়ে নির্বাচিত হয়ে সংবিধান বদলিয়ে রাষ্ট্রকে ফ্যাসিস্ট রূপ দান করলে তারাও একই যুক্তিতে কপটই বটে। এই রাজনীতির বিরোধিতা করার অর্থও একই যুক্তিতে ভাষা, সংস্কৃতি, সমাজতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা কিংবা ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধিতা নয়, ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা করা।
নির্বাচনবাদী ইসলামপন্থীরা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের আজ অবধি কোনো যুক্তিসঙ্গত উত্তর দিতে পারেনি। তারা নিজেদের যতই পাশ্চাত্যের উদার গণতন্ত্রের (ষরনবৎধষরংস) অনুরাগী ও সমর্থক বলে প্রমাণ করতে চেষ্টা করে, ততই তাদের রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা আরও করুণভাবে ফুটে ওঠে। তারা নিজেদের সাতিশয় উদার প্রমাণ করার জন্য নিজেদের ধর্মভিত্তিক সংগঠন ও দল থাকার পরও নতুন ‘অসাম্প্রদায়িক’ দল গঠন করে। কিংবা স্বেচ্ছায় বা রাষ্ট্রের হুকুমে তাদের গঠনতন্ত্র বদলাতে বাধ্য হয়। আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আনুগত্যের পরিবর্তে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে। আধুনিক রাষ্ট্র গঠন, সেটা পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রের আদলে হোক কী ইসলামী হোক, ইসলামপন্থী রাজনীতির আদৌ লক্ষ্য হতে পারে কি-না, সেই গোড়ার নীতিগত প্রশ্ন তারা তোলে না বা এড়িয়ে যায়। ফলে সবই শেষাবধি কৌশল অবলম্বন ছাড়া ভিন্ন কোনো অর্থ বহন করে না। অথচ মূল লড়াই কৌশলে নয়, নৈতিক বা আদর্শগত জায়গায়। মানবেতিহাসের ভবিষ্যৎ নির্মাণে ইসলামের সম্ভাব্য ভূমিকা পরিচ্ছন্ন করার চিন্তা ও তৎপরতা নির্ণয়ের প্রশ্নে।
প্রশ্ন হচ্ছে, ইসলামী রাজনীতি জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বিশ্ববাসীকে কী দিতে পারে, যা প্রচলিত নানা আদর্শ বা রাজনীতি দিতে অক্ষম। শুধু মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার যে রাজনীতি, তাকে মুসলমানদের রাজনীতি বলা যেতে পারে। সবার নয়। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় সেই রাজনীতি গড়ে ওঠা ও সাময়িক শক্তিশালী হয়ে ওঠার বাস্তবতা পূর্ণ মাত্রায় আছে এবং বেশ কিছুকাল থাকবে। অসম বিশ্বব্যবস্থায় মুসলিম দেশ ও জনগণ নানাভাবে নির্যাতিত। ফলে নিপীড়িতের সংগ্রামে ‘ইসলাম’ ভূমিকা রাখবে। রাখছেও। কিন্তু মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার রাজনীতিই কি ইসলামী রাজনীতি? ব্যস। আর কিছু না? তাহলে ইসলামী রাজনীতি কি সাম্প্রদায়িক বৃত্তের বাইরে আসতে আদৌ সক্ষম নয়? এর উত্তর তখনই দেয়া সম্ভব, যখন ইসলাম নিজেকে বিশেষ একটি সম্প্রদায়ের বিশ্বাস ও চর্চা কিংবা ঈমান-আকিদার ব্যাপার হিসেবে সীমাবদ্ধ না রেখে তার অন্তর্নিহিত দর্শন, আদর্শ বা নীতি সবার জন্য সবার বোধগম্য প্রকাশভঙ্গি ও সর্বজনগ্রাহ্য যুক্তির ভাষায় (চঁনষরপ জবধংড়হ) হাজির করতে সক্ষম হবে। যখন নিজেদের বক্তব্যের যথার্থতার জন্য মুসলমানদের নিজেদের বিশ্বাস ও ধর্ম চর্চার বরাত দিতে হবে না। এভাবে হাজির করাকে ভুলভাবে ‘সার্বজনীন’ গণ্য করা হয়। এভাবেই গ্রিক দর্শন আশ্রয় করে খ্রিস্টধর্ম নিজেকে সর্বজনগ্রাহ্য দর্শন ও সভ্যতা হিসেবে হাজির করে। কিন্তু দাবি করে, এই সভ্যতাই সবার মান্য, ইউরোপীয় সভ্যতাই একমাত্র ‘সার্বজনীন’ বিশ্বসভ্যতা। অথচ ‘আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতা’ মানবেতিহাসের শেষ ও একমাত্র পরিণতি নয়। ইউরোপের সভ্যতা ও ইতিহাসের অবদান মেনে নিলেও ইউরোপই বিশ্ব নয়, অতএব ইউরোপের ইতিহাসই বিশ্ব ইতিহাস নয়, ইউরোপ বিশ্বসভ্যতার একমাত্র আদর্শ হতে পারে না। অন্য জনগোষ্ঠীরও নিজ নিজ ধর্ম, সংস্কৃতি ও জীবনের লড়াই-সংগ্রামের নিজস্ব ইতিহাস রয়েছে, যা বিশ্ব ইতিহাসের বাইরের কোনো বিষয় নয়, মানবেতিহাসের ভেতরের জিনিস। তাকে উপেক্ষা করা গোলকায়নের এই যুগে কঠিন।
ইসলাম যখনই নিজেকে গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রামের প্রেরণা, অনুঘটক বা মতাদর্শ হিসেবে হাজির করেছে, তখনই জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে তার গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। তার সার্বজনীনতার বৈশিষ্ট্য কেমন হতে পারে তার উদাহরণ তৈরি হয়েছে। রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র, উপনিবেশবাদ, জাতপাতবিরোধী সংগ্রামসহ সাধারণভাবে জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াইকে ইসলাম যখনই তার নীতি ও আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করেছে ও লড়েছে, নিপীড়িত জনগণ তার লড়াইয়ের সাড়া দিতে দ্বিধা করেনি। কিন্তু যখনই ইসলাম নিজেকে অমুসলমানদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের লড়াই হিসেবে হাজির করেছে, তখনই সে লড়াই পর্যবসিত হয়েছে সাম্প্রদায়িকতা ও সংকীর্ণ স্বার্থবুদ্ধির অন্ধ চোরাবালিতে। ইসলামের ইতিহাসে এই রক্তাক্ত টানাপোড়েনের ইতিহাস অনেক তিক্ত ও দীর্ঘ। কমিউনিস্টদের নতুন সমাজ ও নতুন ধরনের মানুষ তৈরি করার ঐতিহাসিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা দৃশ্যত ব্যর্থ হওয়ার পর ঐতিহাসিক বাস্তবতার কারণেই বিদ্যমান রাষ্ট্র ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার সংস্কার, আমূল পরিবর্তন ও পরিগঠনের আকাক্সক্ষা নিয়ে বিশ্বব্যাপী জনগণের বিশাল একটি অংশ ইসলামপন্থী রাজনীতির প্রতি আগ্রহী এবং অনেকে সমর্থক হয়ে উঠছে। কিন্তু সে রাজনীতি যদি শুধু মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার বৃত্তে আটকা পড়ে থাকে, তবে সেই বৃত্তেই তাকে হোঁচট খেয়ে পড়ে থাকতে হবে। মিসরে ইখওয়ানুলের রাজনীতির বর্তমান দৃশ্যমান পরিণতি এই দিক থেকেই বিচার করতে হবে। জালিম বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে নিরাপস লড়াই না করে পাশ্চাত্যের উদার গণতন্ত্রের জন্য ইসলাম বিপজ্জনক নয়, সেটা প্রমাণের কৌশলের ওপর নির্বাচনবাদী ইসলামপন্থা রাজনীতিতে টিকে থাকতে চায়। ফলে তার ক্ষমতায় আসতে পারা না পারা বা ক্ষমতায় টিকে থাকা না থাকা নির্ভর করে পাশ্চাত্য বা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ওপর। বিদ্যমান রাষ্ট্র ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার সংস্কার, আমূল পরিবর্তন ও পরিগঠনের যে আকাক্সক্ষা নিয়ে জনগণের বিশাল অংশ ইসলামপন্থী রাজনীতির পক্ষাবলম্বী হয়ে ওঠে, তাদের প্রত্যাশা মেটাতে ইসলামী রাজনীতি ব্যর্থ হয়।
মিসরের রাজনীতি এখন ঠিক কোন দিকে মোড় নেবে, এখনও স্পষ্ট নয়। তবে মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থক ছাড়া মিসরীয় জনগণের প্রায় সবারই সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির সরকারের বিরুদ্ধে চলে যাওয়াকে ইসলামবিরোধীদের ষড়যন্ত্র হিসেবে না দেখে নির্বাচনবাদী রাজনীতির সীমাবদ্ধতা হিসেবে দেখাই শ্রেয়। গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রামের প্রতি ইসলামপন্থী রাজনীতির নীতি ও কৌশলের ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতাও এ ক্ষেত্রে দায়ী। এই দিকগুলো থেকে দেখলে মিসরের ঘটনাবলী থেকে বাংলাদেশে ইসলামপন্থী ও ইসলামবিরোধী রাজনৈতিক ধারার দুই পক্ষই কিছুটা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে, এই আশা করি।
বিশ্লেষণ বিবর্জিত কায়দায় কিছুই না বোঝার আলস্য প্রমাণ করে, মিসরের ঘটনাকে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দিয়ে বোঝার চেষ্টা অনেকে করবেন। ষড়যন্ত্র থাকতেই পারে। থাকেও। বিভিন্ন শ্রেণী ও শক্তি পরস্পরের বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্র’ করে, লড়াই সংগ্রামের নানা মোড় বা বাঁক থাকে, কিন্তু রাজনীতি ষড়যন্ত্র মাত্র নয়। কোনো একটি ‘ষড়যন্ত্র’ কেন সফল বা বিফল হল তার ব্যাখ্যার জন্য সমাজ ও রাজনীতির গতিপ্রক্রিয়ার হদিস নেয়া জরুরি হয়ে পড়ে। যারা বলছেন মার্কিন, ইসরাইলি ও পাশ্চাত্য শক্তির ষড়যন্ত্রে একটি নির্বাচিত ইসলামপন্থী সরকারের পতন ঘটেছে, তারা পুরোটা সঠিক বলছেন না। সেনাবাহিনী মার্কিন ও ইসরাইলি স্বার্থরক্ষা করবে, এটা নতুন কোনো তথ্য নয়। সেনাবাহিনীর প্রতি মার্কিন-ইসরাইলি সমর্থন ছাড়া সাধারণভাবে পাশ্চাত্যের সমর্থন থাকাটা অসম্ভব কিছু নয়। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মিসরের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির নিজস্ব টানাপোড়েন আছে। তাকে উহ্য রেখে কিংবা হিসাবে না নিলে মিসরের রাজনীতির কিছুই আমরা বুঝব না। মিসরে একটি উদার নির্বাচনমুখী লিবারেল রাজনৈতিক পরিস্থিতি বহাল থাকুক এটা পাশ্চাত্য দেশগুলো একদমই চায়নি বা চায় না সেটা বলা যাবে না। মিসরের ঘটনাবলী সম্পর্কে জুলাইয়ের তিন তারিখে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্র“প যে মন্তব্য করেছে, তার মূল সুরটা পাশ্চাত্যের স্বার্থে মিসরে একটি উদার গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি বজায় রাখার পক্ষে ওকালতি বলা যায়। ফলে রাষ্ট্রভেদে ভিন্নতা সত্ত্বেও মিসরের ঘটনাবলীর প্রতি পাশ্চাত্যের সাধারণ মনোভাব বোঝা কঠিন নয়। সে মনোভাব হচ্ছে, পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে যে রাজনৈতিক ধারাগুলো নিরাপস লড়ছে তাদের বাদ দিয়ে উদার ও নির্বাচনবাদী ইসলামপন্থীদের সঙ্গে পাশ্চাত্য দেশগুলো রাজনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে রাজি। ‘ভালো মুসলমানদের’ সঙ্গে কৌশলগত মৈত্রী এবং ‘খারাপ মুসলমানদের’ বিরুদ্ধে যুদ্ধ- এই নীতি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্য দেশগুলো সরে আসেনি। সে কারণে মিসরে সেক্যুলারিস্ট বা লিবারেলদের তিরস্কার করতে তাদের বাধা নাই। সময় ও সুযোগ পেলে এই নীতি নিয়ে আমরা আগামী কোনো এক নিবন্ধে আলোচনা করব। এখানে মিসরের ঘটনাবলী থেকে বাংলাদেশে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় কিছু আছে কি-না সে কথা মনে রেখে দুই-একটি কথা বলব।
২
ঠিক যে, মুরসি কিছুকাল আগে সব ক্ষমতা নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু প্রতিবাদের মুখে সরেও এসেছিলেন। বিরোধীদের প্রতি কড়া কথা কম বলেননি, কিন্তু আপসের চেষ্টাও করেছেন। তিনি বিরোধীদের জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠন করার প্রস্তাব এবং নতুন পার্লামেন্টের নির্বাচন ত্বরান্বিত করার প্রতিশ্র“তিও দিয়েছিলেন। কিন্তু বিরোধী পক্ষ তার সরকারে যোগদানের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ হোসনি মোবারকের বিরুদ্ধে পরিচালিত গণআন্দোলনের অর্জন ধরে রাখার জন্য গণঐক্যের চেষ্টা করেছেন মুরসি। নির্বাচিত হয়ে শুধু ব্রাদারহুডের সরকার গঠন করা তিনি জাতীয় ঐক্য ধরে রাখার জন্য যথেষ্ট মনে করেননি। যদিও এই উপলব্ধি একটু দেরিতে হয়েছিল। কিন্তু এটা পরিষ্কার, একটি জাতীয় সরকার গঠনের সম্ভাবনা নস্যাৎ হওয়ার পেছনে মোহাম্মদ মুরসিকে একা দায়ী করা যায় না। তাছাড়া গণপরিষদ মুরসি বিলুপ্ত করেননি, করেছে সর্বোচ্চ প্রশাসনিক আদালত। মিসরের অর্থনৈতিক দুর্দশার জন্য শুধু মুরসির অর্থনৈতিক নীতি দায়ী নয়, বরং আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানের অধীনে থেকে মিসরীয় জনগণের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করা মোটেও সহজ কাজ ছিল না। এখনও নয়।
জেনারেল আবদেল ফাতাহ আল সিসি মোহাম্মদ মুরসিকে অপসারণের ঘোষণা যখন টেলিভিশনে দিচ্ছিলেন, মুরসিবিরোধী রাজনৈতিক দলের অনেক প্রভাবশালী নেতা তার পাশে ছিলেন। যেমন বিরোধীদলীয় নেতা মোহামেদ আল-বারাদেই, আল আজহার মসজিদের শেখ, ইসলামপন্থী নূর পার্টির এবং কপটিক খ্রিস্টীয় সম্প্রদায়ের প্রধান।
সেনাবাহিনী ১৯৫২ সাল থেকে যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছিল, মুরসি তা বহাল রেখেছিলেন। সংবিধান সভায় ব্রাদারহুড সদস্যরাই নির্বাচিত হয়ে এসেছিলেন, সংবিধান প্রণয়নের সভায় তাদেরই প্রাধান্য ছিল, তারাই নতুন সংবিধানের খসড়া করেছিলেন এবং মুরসি তাকে সমর্থনও করেছিলেন। কিন্তু সেই সংবিধানে সেনাবাহিনীকে গণতন্ত্রবহির্ভূত ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। যেমন মিলিটারি ট্রাইব্যুনালে বেসামরিক নাগরিকদের বিচার করার সাংবিধানিক ক্ষমতা। বাজেট বরাদ্দ অনুযায়ী রাষ্ট্র থেকে পাওয়া অর্থ কোথায় কিভাবে খরচ করবে, তার জন্য পার্লামেন্ট বা জনগণের কাছে জবাবদিহি করার দায় থেকে সেনাবাহিনী মুক্ত ছিল। একটি জাতীয় প্রতিরক্ষা কাউন্সিল এমনভাবে গঠনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল, যেখানে সেনাবাহিনীরই প্রতিনিধিত্ব বা আধিপত্য বহাল থাকে। সেই জাতীয় প্রতিরক্ষা কাউন্সিলকে যে কোনো খসড়া আইনের বিরুদ্ধে ভেটো দেয়ার ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল। সংবিধানের ভূমিকায় (preamble) ২০১১ সালের গণবিক্ষোভে সেনাবাহিনীর ‘অবদান’ আছে স্বীকার করা হয়েছিল।
এই পরিস্থিতি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার জন্য হুমকি হয়ে উঠেছিল। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে নতুন সংবিধান সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। অর্থাৎ গণআন্দোলন ও গণবিক্ষোভের পরে একটি গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র প্রণয়ন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের যে ইচ্ছা, আকাক্সক্ষা ও সংকল্প মিসরীয় জনগণের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল, মোহাম্মদ মুরসি তার বিপরীত দিকে অবস্থান নিয়েছিলেন। মুরসির সরকারের বিরুদ্ধে যারা বিক্ষোভ করছিলেন, তারা পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সন্ত্রাসী ও সহিংস কার্যকলাপের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন।
প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের মুখে ব্রাদারহুড নিজের পক্ষে যে যুক্তি খাড়া করছিল তার মূল কথা ছিল, বৈধতা। যেহেতু ব্রাদারহুড জনগণের ভোটে নির্বাচিত, অতএব তাদের সব সিদ্ধান্ত ‘বৈধ’। নির্বাচনে জিতে আসাটাই যা কিছু করার ‘বৈধতা’ অর্জনের মানদণ্ড। নির্বাচনবাদী ইসলামপন্থীরা গণতন্ত্র সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করে, তার সঙ্গে মোহাম্মদ মুরসির কার্যকলাপ ভিন্ন কিছু নয়। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হতে পারাটাই আসল কথা। এই নির্বাচনী বিজয়ই ক্ষমতাসীনদের যে কোনো আইন বা বিধান প্রণয়নের ক্ষমতা দেয়। ফলে নির্বাচিত হয়ে এসে একটি ইসলামী সংবিধান প্রণয়ন ও ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমও তা হলে ‘বৈধ’। ব্রাদারহুডের যুক্তি হচ্ছে, মুরসি তো অবৈধ কিছু করেননি, তিনি যা করেছেন তা বৈধভাবেই করেছেন। অতএব তা গণতন্ত্রবিরোধী হলেও অন্যদের তা মানতে হবে। বলাবাহুল্য, ব্রাদারহুড ও তাদের সমর্থকরা ছাড়া বাকি মিসরীয় জনগণ এই ‘বৈধতার’ যুক্তি মানেননি। কারণ লড়াইটা গণতন্ত্রের জন্য, নির্বাচন সেই লড়াইয়ের ধারাবাহিকতার একটি স্তর মাত্র। মোহাম্মদ মুরসি ও ব্রাদারহুডের নির্বাচনে জয়ী হওয়া চলমান লড়াইয়েরই অংশ। নির্বাচিত হয়েছে বলেই ব্রাদারহুড এমন কোনো সংবিধান দিতে পারে না, যা জনগণের গণতান্ত্রিক আশা-আকাক্সক্ষার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।
মিসরের ঘটনাবলীকে আমি এভাবে হাজির করার কারণ হচ্ছে, এখান থেকে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় দিকগুলো চিহ্নিত করা। বাংলাদেশেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অর্থ একই সঙ্গে সংবিধান সভার নির্বাচনও বটে। কারণ জাতীয় সংসদ সংবিধান পরিবর্তনের ক্ষমতা রাখে। এখানেও আমরা দেখি নির্বাচিত হয়ে গণতন্ত্রের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ সংশোধনী আনা ও আইন প্রণয়ন করা স্বাভাবিক ঘটনা। যেহেতু জাতীয় সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে সেই সংশোধনী বা আইন পাস হয়, অতএব এসব সংশোধনী ও আইন ‘বৈধ’। সব সরকারের আমলেই এই কুকর্ম হয়েছে। তবে শেখ হাসিনার বর্তমান আমল অন্তত এই দিক থেকে বাংলাদেশের ইতিহাসে অসাধারণ বলেই বিবেচিত হবে। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের পুরো ৭ মার্চের বক্তৃতাই সংবিধানে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এই নজির তৈরি হওয়ায় বাংলাদেশের ইসলামপন্থীদের আগামীতে বেশ সুবিধাই হবে। তারা চাইলে আখেরি নবীর বিদায় হজের ভাষণ, কিংবা সম্ভব হলে সহি বোখারি পুরোটাই সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে পারবেন। যদি ইসলামপন্থীরা কোনোদিন ক্ষমতায় এসে পুরো কোরআন শরিফ সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করতে চান, তাহলে সেটাও বৈধ হবে। এর পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সমর্থন থাকবে। শেখ হাসিনা যদি শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা সংবিধানে যুক্ত করতে পারেন, তো কোরআন শরিফ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না কেন? তিনি যদি পেরে থাকেন, তাহলে ইসলামপন্থীরা পারবেন না কেন? এখন যেভাবে আমরা পঞ্চদশ সংশোধনীসহ বাংলাদেশের সংবিধানকে মানছি, তখনও তেমনি মেনে নিতে হবে। শেখ হাসিনার রাজনীতি আর ব্রাদারহুডের রাজনীতি এই দিক থেকে আলাদা কিছু নয়। বৈধতার রাজনীতি আর গণতান্ত্রিক রাজনীতি সমার্থক নয়। আমরা এখনও তার ফারাক করতে শিখিনি।
৩
যে কোনো নির্বাচনবাদী অগণতান্ত্রিক শক্তির মতো নির্বাচনবাদী ইসলামপন্থীদেরও সাধারণ রাজনৈতিক কৌশল হচ্ছে নির্বাচনের সুবিধা নিয়ে সরকার গঠন করার সুযোগ অর্জন করা এবং সরকারে থেকে রাষ্ট্রের চরিত্র বদলে দেয়া। অর্থাৎ গণতন্ত্র কায়েম না করে রাষ্ট্রকে ইসলামী চরিত্র দান করার চেষ্টা করা। ইসলামবিরোধীরা যাকে মধ্যযুগীয় শাসন ব্যবস্থা বলে গণ্য করে এবং অনায়াসে প্রমাণ করতে পারে, পাশ্চাত্যে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মানবেতিহাসের অর্জনগুলোর সঙ্গে এ ধরনের শাসন ব্যবস্থার মৌলিক বিরোধ রয়েছে। এটাও তারা অনায়াসে প্রমাণ করতে পারে যে, গণতন্ত্রের সুবিধা নিয়ে নির্বাচনবাদী ইসলামপন্থীরা গণতন্ত্র ধ্বংস করার কপট কৌশল গ্রহণ করে। গণতন্ত্রের জন্য যা বিপজ্জনক। নির্বাচনবাদী ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে, এই ধারা আসলে গণতন্ত্রেই বিশ্বাস করে না। কিন্তু গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে গণতন্ত্র নস্যাৎ করার চেষ্টা চালায়। রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক হোক বা না হোক, নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করার ব্যবস্থায় ইসলামপন্থী রাজনীতি নিষিদ্ধ করার যে দাবি তোলা হয়, তাকে সে কারণে শুধু ইসলাম বা ধর্মের বিরোধিতা বলে গণ্য করা ভুল হবে। সেটা এই কপটতারও বিরোধিতা বটে। যে কোনো অগণতান্ত্রিক, বর্ণবাদী ও গণবিরোধী শক্তি জাতিবাদ, সমাজতন্ত্র কিংবা ধর্মনিরপেক্ষতার স্লোগান দিয়ে নির্বাচিত হয়ে সংবিধান বদলিয়ে রাষ্ট্রকে ফ্যাসিস্ট রূপ দান করলে তারাও একই যুক্তিতে কপটই বটে। এই রাজনীতির বিরোধিতা করার অর্থও একই যুক্তিতে ভাষা, সংস্কৃতি, সমাজতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা কিংবা ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধিতা নয়, ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা করা।
নির্বাচনবাদী ইসলামপন্থীরা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের আজ অবধি কোনো যুক্তিসঙ্গত উত্তর দিতে পারেনি। তারা নিজেদের যতই পাশ্চাত্যের উদার গণতন্ত্রের (ষরনবৎধষরংস) অনুরাগী ও সমর্থক বলে প্রমাণ করতে চেষ্টা করে, ততই তাদের রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা আরও করুণভাবে ফুটে ওঠে। তারা নিজেদের সাতিশয় উদার প্রমাণ করার জন্য নিজেদের ধর্মভিত্তিক সংগঠন ও দল থাকার পরও নতুন ‘অসাম্প্রদায়িক’ দল গঠন করে। কিংবা স্বেচ্ছায় বা রাষ্ট্রের হুকুমে তাদের গঠনতন্ত্র বদলাতে বাধ্য হয়। আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আনুগত্যের পরিবর্তে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে। আধুনিক রাষ্ট্র গঠন, সেটা পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রের আদলে হোক কী ইসলামী হোক, ইসলামপন্থী রাজনীতির আদৌ লক্ষ্য হতে পারে কি-না, সেই গোড়ার নীতিগত প্রশ্ন তারা তোলে না বা এড়িয়ে যায়। ফলে সবই শেষাবধি কৌশল অবলম্বন ছাড়া ভিন্ন কোনো অর্থ বহন করে না। অথচ মূল লড়াই কৌশলে নয়, নৈতিক বা আদর্শগত জায়গায়। মানবেতিহাসের ভবিষ্যৎ নির্মাণে ইসলামের সম্ভাব্য ভূমিকা পরিচ্ছন্ন করার চিন্তা ও তৎপরতা নির্ণয়ের প্রশ্নে।
প্রশ্ন হচ্ছে, ইসলামী রাজনীতি জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বিশ্ববাসীকে কী দিতে পারে, যা প্রচলিত নানা আদর্শ বা রাজনীতি দিতে অক্ষম। শুধু মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার যে রাজনীতি, তাকে মুসলমানদের রাজনীতি বলা যেতে পারে। সবার নয়। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় সেই রাজনীতি গড়ে ওঠা ও সাময়িক শক্তিশালী হয়ে ওঠার বাস্তবতা পূর্ণ মাত্রায় আছে এবং বেশ কিছুকাল থাকবে। অসম বিশ্বব্যবস্থায় মুসলিম দেশ ও জনগণ নানাভাবে নির্যাতিত। ফলে নিপীড়িতের সংগ্রামে ‘ইসলাম’ ভূমিকা রাখবে। রাখছেও। কিন্তু মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার রাজনীতিই কি ইসলামী রাজনীতি? ব্যস। আর কিছু না? তাহলে ইসলামী রাজনীতি কি সাম্প্রদায়িক বৃত্তের বাইরে আসতে আদৌ সক্ষম নয়? এর উত্তর তখনই দেয়া সম্ভব, যখন ইসলাম নিজেকে বিশেষ একটি সম্প্রদায়ের বিশ্বাস ও চর্চা কিংবা ঈমান-আকিদার ব্যাপার হিসেবে সীমাবদ্ধ না রেখে তার অন্তর্নিহিত দর্শন, আদর্শ বা নীতি সবার জন্য সবার বোধগম্য প্রকাশভঙ্গি ও সর্বজনগ্রাহ্য যুক্তির ভাষায় (চঁনষরপ জবধংড়হ) হাজির করতে সক্ষম হবে। যখন নিজেদের বক্তব্যের যথার্থতার জন্য মুসলমানদের নিজেদের বিশ্বাস ও ধর্ম চর্চার বরাত দিতে হবে না। এভাবে হাজির করাকে ভুলভাবে ‘সার্বজনীন’ গণ্য করা হয়। এভাবেই গ্রিক দর্শন আশ্রয় করে খ্রিস্টধর্ম নিজেকে সর্বজনগ্রাহ্য দর্শন ও সভ্যতা হিসেবে হাজির করে। কিন্তু দাবি করে, এই সভ্যতাই সবার মান্য, ইউরোপীয় সভ্যতাই একমাত্র ‘সার্বজনীন’ বিশ্বসভ্যতা। অথচ ‘আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতা’ মানবেতিহাসের শেষ ও একমাত্র পরিণতি নয়। ইউরোপের সভ্যতা ও ইতিহাসের অবদান মেনে নিলেও ইউরোপই বিশ্ব নয়, অতএব ইউরোপের ইতিহাসই বিশ্ব ইতিহাস নয়, ইউরোপ বিশ্বসভ্যতার একমাত্র আদর্শ হতে পারে না। অন্য জনগোষ্ঠীরও নিজ নিজ ধর্ম, সংস্কৃতি ও জীবনের লড়াই-সংগ্রামের নিজস্ব ইতিহাস রয়েছে, যা বিশ্ব ইতিহাসের বাইরের কোনো বিষয় নয়, মানবেতিহাসের ভেতরের জিনিস। তাকে উপেক্ষা করা গোলকায়নের এই যুগে কঠিন।
ইসলাম যখনই নিজেকে গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রামের প্রেরণা, অনুঘটক বা মতাদর্শ হিসেবে হাজির করেছে, তখনই জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে তার গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। তার সার্বজনীনতার বৈশিষ্ট্য কেমন হতে পারে তার উদাহরণ তৈরি হয়েছে। রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র, উপনিবেশবাদ, জাতপাতবিরোধী সংগ্রামসহ সাধারণভাবে জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াইকে ইসলাম যখনই তার নীতি ও আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করেছে ও লড়েছে, নিপীড়িত জনগণ তার লড়াইয়ের সাড়া দিতে দ্বিধা করেনি। কিন্তু যখনই ইসলাম নিজেকে অমুসলমানদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের লড়াই হিসেবে হাজির করেছে, তখনই সে লড়াই পর্যবসিত হয়েছে সাম্প্রদায়িকতা ও সংকীর্ণ স্বার্থবুদ্ধির অন্ধ চোরাবালিতে। ইসলামের ইতিহাসে এই রক্তাক্ত টানাপোড়েনের ইতিহাস অনেক তিক্ত ও দীর্ঘ। কমিউনিস্টদের নতুন সমাজ ও নতুন ধরনের মানুষ তৈরি করার ঐতিহাসিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা দৃশ্যত ব্যর্থ হওয়ার পর ঐতিহাসিক বাস্তবতার কারণেই বিদ্যমান রাষ্ট্র ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার সংস্কার, আমূল পরিবর্তন ও পরিগঠনের আকাক্সক্ষা নিয়ে বিশ্বব্যাপী জনগণের বিশাল একটি অংশ ইসলামপন্থী রাজনীতির প্রতি আগ্রহী এবং অনেকে সমর্থক হয়ে উঠছে। কিন্তু সে রাজনীতি যদি শুধু মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার বৃত্তে আটকা পড়ে থাকে, তবে সেই বৃত্তেই তাকে হোঁচট খেয়ে পড়ে থাকতে হবে। মিসরে ইখওয়ানুলের রাজনীতির বর্তমান দৃশ্যমান পরিণতি এই দিক থেকেই বিচার করতে হবে। জালিম বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে নিরাপস লড়াই না করে পাশ্চাত্যের উদার গণতন্ত্রের জন্য ইসলাম বিপজ্জনক নয়, সেটা প্রমাণের কৌশলের ওপর নির্বাচনবাদী ইসলামপন্থা রাজনীতিতে টিকে থাকতে চায়। ফলে তার ক্ষমতায় আসতে পারা না পারা বা ক্ষমতায় টিকে থাকা না থাকা নির্ভর করে পাশ্চাত্য বা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ওপর। বিদ্যমান রাষ্ট্র ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার সংস্কার, আমূল পরিবর্তন ও পরিগঠনের যে আকাক্সক্ষা নিয়ে জনগণের বিশাল অংশ ইসলামপন্থী রাজনীতির পক্ষাবলম্বী হয়ে ওঠে, তাদের প্রত্যাশা মেটাতে ইসলামী রাজনীতি ব্যর্থ হয়।
মিসরের রাজনীতি এখন ঠিক কোন দিকে মোড় নেবে, এখনও স্পষ্ট নয়। তবে মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থক ছাড়া মিসরীয় জনগণের প্রায় সবারই সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির সরকারের বিরুদ্ধে চলে যাওয়াকে ইসলামবিরোধীদের ষড়যন্ত্র হিসেবে না দেখে নির্বাচনবাদী রাজনীতির সীমাবদ্ধতা হিসেবে দেখাই শ্রেয়। গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রামের প্রতি ইসলামপন্থী রাজনীতির নীতি ও কৌশলের ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতাও এ ক্ষেত্রে দায়ী। এই দিকগুলো থেকে দেখলে মিসরের ঘটনাবলী থেকে বাংলাদেশে ইসলামপন্থী ও ইসলামবিরোধী রাজনৈতিক ধারার দুই পক্ষই কিছুটা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে, এই আশা করি।
No comments