মিসরে সামরিক অভ্যুত্থান by তারেক শামসুর রেহমান

শেষ পর্যন্ত সামরিক বাহিনী মিসরের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করল। এর মধ্য দিয়ে পতন ঘটল গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মুরসি সরকারের। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, 'সামরিক বাহিনী মোহাম্মদ মুরসিকে উৎখাত করে দেশকে রক্ষায় তাদের ওপর অর্পিত ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছে।'
সেনাবাহিনী দেশ পরিচালনার জন্য তিন সদস্যের একটি প্রেসিডেনশিয়াল কাউন্সিল গঠন করেছে। এর প্রধান হয়েছেন সর্বোচ্চ সাংবিধানিক আদালতের প্রধান আদলি মনসুর। নিঃসন্দেহে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের এই ঘটনা 'আরব বসন্ত' পরবর্তী মিসরের জন্য একটি বড় ধরনের ঘটনা। এই সেনা অভ্যুত্থান প্রত্যাশিত না হলেও যাঁরা গত এক সপ্তাহের মিসরের ঘটনাবলি অনুসরণ করেছেন, তাঁরা দেখেছেন কিভাবে কায়রোর তাহরির স্কয়ার আবার উত্তাল হয়ে উঠেছিল। লাখ লাখ মানুষ আবার জমায়েত হতে শুরু করেছিল তাহরির স্কয়ারে, তাদের দাবি ছিল একটাই মুরসির পদত্যাগ। 'তামরুদ মুভমেন্ট' (যার অর্থ বিদ্রোহ) নামে একটি সংগঠন প্রায় এক সপ্তাহ ধরে মিসরের জনগণকে সংগঠিত করেছিল। তাহরির স্কয়ারের জনগণ গত ৩০ জুন মুরসিকে পদত্যাগের জন্য সময় নির্ধারণ করে দিয়েছিল। এই সংকটকালে সেনাবাহিনী প্রেসিডেন্টের পাশে এসে দাঁড়ায়নি। বরং সেনাবাহিনীও ৪৮ ঘণ্টার একটি চূড়ান্ত সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছিল একটি সমঝোতার জন্য। কিন্তু মুরসি এই চূড়ান্ত সময়সীমা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি একটি জাতীয় সরকার গঠনেরও প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু সেনাবাহিনীর কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয়নি। চূড়ান্ত সময়সীমা পার হয়ে যাওয়ার পরই সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করল। এর মধ্য দিয়ে 'আরব বসন্ত' পরবর্তী মিসরে সেনাপ্রধান ও দেশরক্ষা মন্ত্রী জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ এল সিসি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তিত্বে পরিণত হলেন। ২০১১ সালে তাহরির স্কয়ারের ১৭ দিনের 'বিপ্লব' নতুন এক ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিল মিসরে। মূলত তরুণরাই এই বিপ্লবের নায়ক। এরা সবাই যে ইসলামিক আদর্শকে পছন্দ করে, তা নয়। তারা মুবারকের অপশাসন (১৯৮১ সাল থেকে ক্ষমতায় ছিলেন) থেকে মিসরকে 'মুক্ত' করতে চেয়েছিল। ওই তরুণরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করে বিপ্লবকে তার লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছিল। এই তরুণ প্রজন্মের কেউ কেউ মুরসিকে সমর্থন করেছে, এটা সত্য। কিন্তু মিসর ধর্মভিত্তিক একটি রাষ্ট্র হোক, এটি তারা চায়নি। মিসর 'বিপ্লব'-এ নারীরা একটা বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। কিন্তু তাঁরা নিশ্চয়ই চাননি মিসরে নারীদের অধিকার সংকুচিত হোক, বাধ্যতামূলক পর্দাপ্রথা আরোপ করা হোক। মিসরের নারীরা যথেষ্ট স্বাধীন, আধুনিকমনস্ক। পূর্ণ পর্দাপ্রথা তাঁরা অনুসরণ না করলেও শালীনতা বজায় রেখে চলেন। মিসরের সংখ্যালঘু 'কপটিক খ্রিস্টান'রা বরাবরই আতঙ্কগ্রস্ত। তাঁরা আশঙ্কা করেছিলেন তাঁরা ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হতে পারেন। সম্ভবত এটা উপলব্ধি করেই প্রেসিডেন্ট অঙ্গীকার করেছিলেন নতুন সরকারে 'কপটিক খ্রিস্টান'দের প্রতিনিধিত্ব থাকবে এবং নয়া প্রধানমন্ত্রী হবেন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ। কিন্তু গত এক বছরের আচরণে তা প্রমাণিত হয়নি। তিনি আধুনিকমনস্ক একজন মানুষ হলেও কট্টরপন্থীদের চাপের কাছে তিনি আত্মসমর্পণ করেছিলেন।
মিসরকে একটি ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাইলেন মুরসি। আর বিপত্তিটা তিনি সেখানেই বাঁধিয়েছেন। স্পষ্টতই সেনাবাহিনী আলাদা একটা অবস্থান গ্রহণ করেছে।
আসলে মিসরের সমস্যা শুধু মুবারককে উৎখাত কিংবা একটি ইসলামিক রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। অর্থনীতি একটা বড় ফ্যাক্টর মিসরের জন্য। অঙ্ফোর্ডের মিসরীয় বংশোদ্ভূত শিক্ষক তারিক রামাদান একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন We are making a mistake, a very big mistake if we look at what we calls the Arab Awakening only by looking at the whole dynamics in political and not in economic terms। দরিদ্রতা ২০০৯ সালে যেখানে ছিল ২১ শতাংশ, ২০১২ সালে তা বেড়েছে ২৫ শতাংশে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০১১ সালে ছিল ৩৬ মিলিয়ন ডলার, আর তখন তা কমে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৩ মিলিয়নে। মিসরে সেনাবাহিনী একটি শক্তি। ৬১ বছর ধরেই তারা ক্ষমতায়। মাঝখানে সীমিত পরিসরে ২০১১ সালের বিপ্লবের পর, কিছুদিন পর্যন্ত তারা পর্দার অন্তরালে থেকে ক্ষমতা পরিচালনা করেছে। এখন আবার তারা প্রকাশ্যে এলো। ১৯৫২ সালে রাজতন্ত্র উৎখাতের মধ্য দিয়ে মিসরের সেনাবাহিনী সেখানে একটি 'রাজনৈতিক' শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। কর্নেল জামাল আবদুল নাসের ওই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে শুধু মিসরেই নয়, বরং সমগ্র আরব বিশ্বে আরব জাতীয়তাবাদী রাজনীতির জন্ম দিয়েছিলেন। পুরো আরব বিশ্ব এবং সেই সঙ্গে তৃতীয় বিশ্বে এক অবিসংবাদিত নেতায় তিনি পরিণত হয়েছিলেন। তাঁর সেই আদর্শকে সামনে রেখেই আনোয়ার সাদাত আর হোসনি মুবারক ক্ষমতা পরিচালনা করে গেছেন। সেনাবাহিনী নিজের উদ্যোগে একাধিক দল গঠন করলেও সেগুলোর কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। যে কারণে সেনা নিয়ন্ত্রিত মিসরে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকশিত হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব চেয়েছিল হোসনি মুবারকের পতন। মাঝখানে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য মুরসি এসেছিলেন। মুরসির ব্যর্থতা প্রধানত দুটি। এক. তিনি আধুনিকমনস্ক এক মিসর গড়তে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তিনি জাতীয় নেতা না হয়ে স্বয়ং ইসলামিক ব্রাদারহুডের নেতাই থেকে গেলেন এবং ব্রাদারহুডের দর্শন বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয়েছিলেন। দুই. সেনাবাহিনীর পালস বুঝতে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। ২১০ বিলিয়ন ডলারের মিসরের যে অর্থনীতি, তার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে সেনাবাহিনী। জ্বালানি তেল, দুগ্ধজাত খামার, রুটি, খাবার পানি, সিমেন্ট, গ্যাসোলিন ইত্যাদি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে সেনাবাহিনী। মিসরীয় অর্থনীতিতে তাদের বিনিয়োগ বিশাল। এই বিনিয়োগে সেনাবাহিনীকে অন্যতম একটি অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেছে। মুরসি সেনাবাহিনীর এই শক্তিকে বেশি গুরুত্ব দেননি। আপাতত সংবিধান স্থগিত হওয়ায় শিগগিরই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। সেনাবাহিনীর উদ্যোগে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করার সম্ভাবনাও প্রচুর। ন্যাশনাল স্যালভেশন ফ্রন্টকেও সেনাবাহিনী 'প্রমোট' করতে পারে। আপাত দৃষ্টিতে মিসরে গণতন্ত্রের যে সম্ভাবনার জন্ম হয়েছিল, তা অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে গেল।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.