সোনার খাঁচার দিনগুলো by কাজী তামান্না
জীবনের সবচাইতে সুন্দর এবং আনন্দের সময় শৈশব ও কৈশোরকাল। মানুষের শৈশব জীবন তো উপভোগ করে বাবা-মা দাদা-দাদি নানা-নানি আপনজনেরা। শিশুর চলাফেরা হাসি-কান্না আধো আধো বোল পরম স্নেহ ভালবাসায় আপন-পর সকলেই ধারণ করে।
স্বগর্ীয় আনন্দে চিত্ত ভরে ওঠে। তারপর কৈশোরে পা রাখলে নিজেরাই আনন্দ সুখ ভাললাগাকে আত্মস্থ করে। সেটাও একেবারে নির্ভেজাল। কোনরকম দৈন্য, লোভ-লালসা, ঈর্ষা, দ্বেষ. হিংসা এসব সাধারণত তাদের স্পর্শ করতে পারে না। শৈশব-কৈশোরকে ফেলে আসার পর ধীরে ধীরে নিজের কথা ভাবতে শুরু করে। সমাজের কলুষতা, কপটতা, কিছু নিজের করে পাওয়ার ইচ্ছা_ মনকে জটিল থেকে জটিলতর করে তোলে। যাদের এসব স্পর্শ করতে পারে না তারাই প্রকৃত সুন্দর সুখী জীবনযাপন করে বলে আমার মনে হয়। আমি সেই সুন্দর নির্মল নিটোল স্বচ্ছ নির্ভেজাল জীবন ফেলে এসেছি। একান্তভাবে কষ্ট পাই যখন চারদিকে তাকিয়ে দেখি সেই শৈশব-কৈশোরের দিনগুলো এখনকার শিশু-কিশোরদের জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা সকলে গলা টিপে ধ্বংস করে দিচ্ছি। এত কথা বললাম নিজের স্কুলজীবনের কথা মনে করে। কোথায় গেল সেই সোনালী স্বচ্ছ দিনগুলো। সোনার খাঁচা থেকে বেরিয়ে কেমন জটিল কট্টর জীবনাচার মনকে অনেকটা মলিন করে তুলেছে। এসব ভাবলে আজও চোখ-মন ভরে ওঠে। তাই আমার প্রাণপ্রিয় স্কুল বাংলাবাজার সরকারী গার্লস স্কুলের পুনর্মিলনী উৎসবের বার্তা পেয়ে অংশ নেবার কথা স্থির করে ফেললাম। মনে নেই কত সালে বাংলাবাজারের কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। আমার সঙ্গে ছিল বড় ভাই কাজী মোঃ শীশ ও বড় বোন কাজী মদিনা। বুবু বোধহয় কাস ফোরে ভর্তি হয়েছিল। কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ছেলেমেয়ে সকলেই পড়তে পারত। সেসব কত দিন আগের কথা। তারপর ১৯৬৫ সালে কাস ফোরে হাইস্কুলে ভর্তি হলাম। তখন আমাদের হেডমিস্ট্রেস অর্থাৎ বড় আপা ছিলেন লুৎফুন্নেসা চৌধুরী। সকলের কাছে তিনি কিটি আপা বলে পরিচিত। আমরা ভাইবোনেরা তাঁকে চাচি বলতাম। তিনি ছিলেন আব্বার বন্ধু বিখ্যাত সাংবাদিক, সাহিত্যিক জহুর হোসেন চৌধুরীর স্ত্রী। নিঃসন্তান কিটি আপা স্কুলের সব ছাত্রীদের নিজের সন্তানের মতো স্নেহ করতেন। শ্যামলা রং, স্মার্ট, সবসময় ফিটফাট সুন্দর করে শাড়ি পরতেন। তাঁর একটা বৈশিষ্ট্য ছিল প্রতিটি শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে স্যান্ডেল জুতো পরতেন। কথাটা সহসা মনে পড়ল। স্কুলের প্রতিটি ছাত্রী তাঁকে আদর্শ মনে করত। তিনিই ষ্ক্র৫২ সালে বাংলাবাজার স্কুলকে সরকারী স্কুল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব আমাদের দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে। মনে পড়ছে সরোজিনি দিদির কথা। একপঁ্যাচ দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রের মায়েদের মতো বড় বড় পাড়ের সাদা শাড়ি, কি সুন্দরভাবে অাঁচলটা পিন আটকে দিতেন। মাতৃসম এই দিদির স্মৃতি এখনও মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। কোথায় সবাই হারিয়ে গেলেন। অসম্ভব দুষ্টু ছিলাম। কাসে গণ্ডগোল হৈ চৈ করতাম। অতিষ্ট হয়ে দিদি একদিন বলেছিলেন ঠিক আছে তোমরা তামান্নার জীবন কাহিনী লেখ। মহাউৎসাহে মনে যা এলো তাই লিখলাম। ছাত্রীকে শান্ত করার কি অভিনব উপায়। দিদি বাংলা পড়াতেন। তবে মার্গারেট আপাকে ভয় করতাম। বাপরে কি গম্ভীর আর রাশভারি ছিলেন। কিন্তু মনটা মাখনের মতো। আমাদের পিটি করাতেন। সকালে ঠিক সময় মতো এ্যাসেম্বলিতে উপস্থিত থাকতে হতো। কমলা রংয়ের স্কুল ড্রেস, দুটো টাইট বেণী বেঁধে পায়ে সাদা কেড্স পরে পাকিস্তানের উর্দু জাতীয় সঙ্গীত পাক সার জমিন সাদ বাদ গানটা গাইতে হতো। তবে তাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "তোমারও অসীমে প্রাণমন লয়ে। যতদূর আমি ধাই।ঃ এই গানটাও গাইতাম। মতিবাবু স্যার আমাদের নিয়মিত বাংলা গান শেখাতেন। মার্গারেট আপা বিরাট মোটা একটা বেণী কোমর থেকে পেঁচিয়ে এনে শাড়ির সঙ্গে গুঁজে দিতেন। এমন অভিনব দৃশ্য আমি আর কখনও দেখিনি। এতটুকু অনিয়ম হতে দিতেন না। তিনি আমাদের ভূগোলও পড়াতেন। হঠাৎ একদিন শুনলাম আপা হার্টএ্যাটাকে মারা গেছেন। সেদিন চোখের পাতা ভেজাই ছিল। জাকিয়া আপা ধর্ম বিষয়ে শিা দিতেন। জিয়াতন নাহার আপা ইংরেজী পড়াতেন। সরল সাদাসিধে রওশন আপা তাঁর বড় ছেলে শফিক রেহমানের নতুন বৌ তালেরা রহমানকে নিয়ে এসেছিলেন আমাদের দেখাতে। লিলি আপা, আননি আপা অঙ্কের স্যার নামটা মনে করতে পারছি না। স্যার কত ধৈর্য নিয়ে অঙ্ক শেখাতেন।আমাদের স্কুলে বিরাট একটা হলরুম ছিল। সেটা আমাদের চোখের সামনেই তৈরি হয়েছিল। ছাদটা টিনশেডের। একটা স্টেজও ছিল। সেখানে নিয়মিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। নাচ, গান, কবিতা, আবৃত্তি, বিতর্ক এমন নাটকও অভিনীত হতো। আমি যখন কাস ফোরে পড়ি তখন ওপর কাসের আপারা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গল্প বিন্দুর ছেলের নাট্যরূপ দিয়ে মঞ্চস্থ করেন। আমি অভিনয় করেছিলাম বিন্দুর ছেলে অমূল্যের ভূমিকায়। জীবনের প্রথম অভিনয়ই ছেলের ভূমিকায়। নাটকের দুই মায়ের কথা মনে আছে- দুম্বজনেরই নাম মনু। সেই আপারা কোথায় জানি না। কি পরম স্নেহে সবাই আমাকে অভিনয় শিখিয়েছিলেন। ভাবা যায় এখন কোন স্কুলে এমন অনুষ্ঠান করার উদ্যোগ নেবে। তারপর শরৎচন্দ্রের 'মামলার ফলম্ব বড় গল্পেরও নাট্যরূপ দিয়ে অভিনীত হয় সেই স্কুলের হলে। সেখানেও অভিনয় করি ছেলের ভূমিকায় পরম উৎসাহে, সুকুমার রায়ের 'গোঁফ চুরিম্ব কবিতাটা আবৃত্তি করতাম। নাচ গান হৈচৈ কেমন নির্ভেজাল আনন্দ। শুধু পড়া আর পড়া নিয়ে থাকিনি আমরা। অনুশীলন ও আনন্দ এই দুম্বটির মিলন না ঘটলে বিদ্যালয়ের শিা সম্পূর্ণ হয় না। এ কথাটা ভুললে চলবে না।
স্কুলে বিরাট মাঠ ছিল। সেখানে টিফিনের সময় কোনরকমে কিছু খেয়েই ছুটতাম খেলতে। অনেক সময় খেলতে খেলতে ঘণ্টা পড়ে যেত, হাঁপাতে হাঁপাতে কাসে যেতাম। এতে শিকদের বকুনি খেয়েছি কত। কিন্তু পরের দিন আর সে কথা মনে থাকতো না। আজকাল তো বহু স্কুলে খেলার মাঠও নেই।
একদিনের কথা আবছাভাবে মনে পড়ে। স্কুলের হঠাৎ সবাই কেমন সন্ত্রস্থ হয়ে উঠল, থমথমে ভাব। শুনলাম মানুষ খাবারের দাবিতে মিছিল করেছে, সরকার গুলি করে কয়েকজনকে মেরে ফেলেছে। ঘটনাটা আমাদের স্কুলের আশপাশেই ঘটেছে। তারপর ,৫৮ সালে স্কুলে পড়ি তখনই আয়ুব খানের সামরিক শাসন জারি হতে দেখেছি। এই বোধ আমাদের মনের মধ্যে কাজ করেছে এটা দেশ-দশের জন্য শুভ বয়ে আনবে না। এইভাবে স্কুলজীবন থেকে দেশের কথা আমাদের ভাবতে শিখিয়েছে। কচিমন আমাদের ভারি হয়ে উঠেছে। হৃদয় আন্দোলিত হয়েছে। হয়ত তাই পরবতর্ীকালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবার পথ খুলে দিয়েছে। এসব লিখলাম এই কারণে যে কৈশোর কাল অর্থাৎ স্কুল জীবন থেকেই আমাদের মন সুস্থ চিন্তার খোরাক যুগিয়েছে। আর আমাদের শিকরা এই বোধকে গভীর থেকে গভীরে প্রোথিত করেছেন। এখন কি এভাবে স্কুল ছাত্ররা ভাবে। জানি না আজ লিখতে বসে আমার কাসের সাথীদের কথা ভীষণ ভীষণভাবে মনে পড়ছে। রোজী, সুচি, নুকু নাজমুন, ছবি, জলি, রওশন, রুবি, চম্পা, বড় জারু, ছোট জারু. গৌরী আরও কত কত মুখ। আজ আমরা প্রৌঢ়ত্বে পা দিয়েছি। দাদি, নানি হয়ে গেছি। তবু সেই সুন্দর সুন্দর কচি কচি মুখগুলো মনে পড়ে। আমার প্রাণপ্রিয় বন্ধু রোজী (বুয়েটের পদার্থ বিজ্ঞানের শিকতা করেছে) যখন সপ্তম শ্রেণীতে অন্য স্কুলে চলে গেল তখন আমার কি কান্না। স্কুলে এসে মনটা হাহাকার করত। এখন ওর সঙ্গে কালেভদ্রে দেখা হয়। এই তো প্রকৃতির নিয়ম।
সহসাই আইভি আপার কথা মনে পড়লো। (আইভি রহমান আওয়ামী লীগের নেত্রী ছিলেন) জনি আপা, আইভি আপা কি সুন্দর দুম্ব বোন নাচতেন। আমাদের বন্ধু মমতাজও খুব সুন্দর নাচতো। আজ দুম্বজনই এই পৃথিবীতে নেই। যখন দানবদের পৈশাচিক উন্মাদনায় আইভি আপার পা দুটো সম্পূর্ণভাবে উড়ে গেল, সেই রক্তাক্ত আইভি আপাকে দেখে আমার প্রথমেই মনে পড়েছিল তাঁর ছন্দময় নূপুর পরা পা দুটোর কথা। নিয়তির কি করুণ পরিণতি। ফেরদৌসি রহমান (বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী) আমাদের স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীায় সমস্ত পূর্ব পাকিস্তান থেকে সপ্তম স্থান অধিকার করেছিলেন। সে কি আনন্দ, সে কি আনন্দ। অনুষ্ঠান হলো। আপা আমাদের গান শোনালেন। সেই বাংলাবাজার স্কুলের নাম এখন আর কম্বজনই বা জানে।
আমি বাংলাবাজার স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীা দেইনি। কিটি আপা কামরুন্নেসা গার্লস স্কুলে চলে গেলেন, এলেন মিসেস শান্তি নন্দী। বুবু (কাজী মদিনা) পাস করে বেরিয়ে গেছে। লুৎফুন্নেসা চৌধুরী (কিটি আপা) আমাদের নিজের সন্তানের মতো ভালবাসতেন। তাই নিজ উদ্যোগে আমাকে আর আমার ছোটবোন হেলিমাকে কামরুন্নেসা স্কুলে নিয়ে এলেন। স্কুলটা আমাদের বাড়ির কাছেই ছিল। আমার সে কি কান্না। একেবারে যেন শিকড় ছিঁড়ে চলে আসা। আমি যদিও শেষ দুম্ববছর বাংলাবাজার স্কুলে পড়িনি কিন্তু স্মৃতিতে সবসময় এই স্কুলের ছাপই গেঁথে আছে। নরম মাটি দিয়ে যা গড়া হয়, তা যখন শক্ত হয়ে যায়_ তা ভাঙ্গা কি সহজ ব্যাপার?
আমাদের মিরপুরের বাড়ির সামনে একটা স্কুল ছিল। বারান্দা থেকে দেখতাম মাঠে বাচ্চারা খেলা করছে। দাঁড়িয়ে "সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসিঃ, জাতীয় সঙ্গীত গাইছে একে আরেকজনের সঙ্গে মারামারি, বৃষ্টির দিনে কাদা ছোড়াছুড়ি করে স্কুলড্রেস মাখামাখি করে একাকার করত। দৌড়াদৌড়ি, হুটোপুটি, কারণে-অকারণে আনন্দে ফেটে পড়তে দেখতাম। স্কুল ছুটির পর হৈচৈ করে ব্যাগ ঝুলিয়ে এক সঙ্গে বেরুতে দেখে একটা ছোট্ট মেয়েকে কমলা রঙের ড্রেসে দুই বেণী ঝুলিয়ে যেতে দেখতাম। তখন পার্থিব সমস্ত কিছু ভুলে কেমন স্বপ্নের রাজ্যে চলে যেতাম। সেখানে ফিরে যাবার বাসনা আমৃতু্য আমি বহন করব।
বাংলা বাজার স্কুলের এই পুনর্মিলনী উৎসব স্বার্থক হোক, সুন্দর হোক। সকলের শুভ হোক।
No comments