পাঁচ খুনীর ফাঁসি জাতি কলঙ্কমুক্ত রাত ১২টা ১ মিনিটের পর পর্যায়ক্রমে মেজর (অব) বজলুল হুদা, লে. কর্নেল (বরখাসত্ম) সৈয়দ ফারম্নক রহমান, লে. কর্নেল (অব) মহিউদ্দিন আহম্মেদ (আর্টিলারি), লে. কর্নেল (অব) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও লে. কর্নেল (অব) একেএম মহিউদ্দিন আহম্মেদের (ল্যান্সার) ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে
গাফফার খান চৌধুরী কড়া নিরাপত্তার মধ্যে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধুর হত্যা মামলার ৫ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকরা করা হয়েছে। রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে পর্যায়ক্রমে শুরম্ন হয় ফাঁসি কার্যকরের প্রক্রিয়া।
প্রথমে মেজর (অব) বজলুল হুদাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। এরপর আর্টিলারি মহিউদ্দিনকে দ্বিতীয় দফায় ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। এরপর লে. কর্নেল (বরখাসত্ম) সৈয়দ ফারম্নক রহমান, লে. কর্নেল (অব) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও লে. কর্নেল (অব) একেএম মহিউদ্দিন আহম্মেদের (ল্যান্সার) ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এরআগে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ৫টি কফিন ঢোকে।ফাঁসির রায় কার্যকর করার বিষয়টি রাখা হয় কঠোর গোপনীয়। রাত বারোটার পর ঘুম থেকে জাগিয়ে খুনীদের জানানো হয় ফাঁসির রায় কার্যকর করার সংবাদ। ডাক্তার দিয়ে পরীৰা করনো হয় আসামির শারীরিক অবস্থা। আসামিদের তাদের শেষ ইচ্ছা কি তা ব্যক্ত করার সুযোগ দেয়া হয়। কোন্্ ধরনের খাবার খেতে ইচ্ছা করে তা জানতে চাওয়া হয়। আসামিদের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী দেয়া হয় তাদের পছন্দের খাবার। গোসলের জন্য প্রস্তুত হতে বলা হয়। মৌলভী ডেকে এনে তাদের তওবা করানো হয়।
এশার নামাজের সুযোগ দেয়া হয় ৫ খুনীর। তারপর খুনীদের ভাল খাবার খেতে দেয়া হয়। এরপর তাদের আরামে ঘুমানোর কথা বলা হয়। খুনীদের ঘুমের কথা বলা হলেও খানিক পরেই ফাঁসি কার্যকর করার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। ফাঁসি কার্যকর করার আগে খুনীদের পরানো হয় পোশাক। এরপর ধীরে ধীরে তাদের ডেকে নেয়া হয় ফাঁসির মঞ্চের দিকে। মঞ্চে যাওয়ার পর হাত বেঁধে ফেলা হয়। ধীর পদে আনা হয় ফাঁসির মঞ্চের সামনে। বেঁধে ফেলা হয় পা। মুখে পরিয়ে দেয়া হয় যমটুপি। ফাঁসির মঞ্চের দাঁড় করানো হয় আসামিদের। ম্যাজিষ্ট্রেট, পুলিশ, ডাক্তার, জেল কতর্ৃপৰসহ সংশিস্নষ্টরা উপস্থিত থেকে পর্যবেৰণ করেন। জলস্নাদকে প্রস্তুত হওয়ার সংকেত দেয়া হয়। গলায় পরিয়ে দেয়া হয় ফাঁসি কার্যকর করার ম্যানিলা রোপ। ফাঁসি কার্যকর করতে ৩ গজ ম্যানিলা রোপ ব্যবহৃত হয়। এক উর্ধতন কারা কর্মকর্তা হাত থেকে ফেলে দেন লাল রম্নমাল। এটা ফাঁসি কার্যকর করার ইঙ্গিত। ইঙ্গিত পেয়েই জলস্নাদ ফাঁসির মঞ্চের লিভারে টান দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফাঁসির সেলের কিপ সরে যায়। ম্যানিলা রোপ আটকে যায় গলায়, লেগে যায় ফাঁস।
ম্যানিলা রোপ গলায় আটকানোর সঙ্গে সঙ্গে ফাঁসির মঞ্চের কব্জা দিয়ে সংযুক্ত করা চারটি পাটাতন সরে যায়। পাটাতনের ওপর থাকা পেস্ননশেডটিও সরে যায়। ফাঁসিতে ঝুলে আসামিরা পড়ে যায় মঞ্চের ১০ ফুট গভীর পাকা চৌবাচ্চায়। দ-িতদের স্পাইনাল কর্ড ছিঁড়ে যায়। আধা ঘন্টা ধরে ফাঁসিতে ঝোলা অবস্থায় থাকে লাশ। তারপর লাশগুলোর ওপরে তুলে দু'হাত, দু'পা, ও ঘাড়ের রগ কেটে দেয়া হয়। এরপর সিভিল সার্জন পরীৰা নিরীৰা শেষে দ-িতদের মৃতু্য নিশ্চিত ঘোষণা দেন। এভাবেই ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর আত্মীয়স্বজনদের কাছে মৃতদেহ হসত্মানত্মর করা হয়। আত্মীয়স্বজনদের লাশ দাফনের জন্য কঠোর নিরাপত্তা দেয়া হয়।
বিকাশ দত্ত জানান, বুধবার বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়ের বিরম্নদ্ধে দায়ের করা রিভিউ আবেদন আপীল বিভাগ খারিজ করে দেয়। বুধবার সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে প্রধান বিচারপতি তাফাজ্জল ইসলামের নেতৃত্বে চার সদস্যের আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ পাঁচ আসামির রিভিউ পিটিশন খারিজ করে দেয়।
প্রধান বিচারপতি মোঃ তাফাজ্জাল ইসলাম তাঁর আদেশে বলেন, পাঁচ আসামির রিভিউ পিটিশনে যে সমসত্ম যুক্তি উত্থাপন করেছে সে বিষয়গুলো ইতোপূর্বে আপীল বিভাগের রায়ে খ-ন করা হয়েছে। এখন নতুন করে ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়োজন নেই। সে কারণে তাদের রিভিউ পিটিশন খারিজ করে দেয়া হলো। মোঃ তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বে অন্য বিচারকদের মধ্যে ছিলেন বিচারপতি বিজন কুমার দাস, বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেন ও বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। রিভিউর আদেশ দেয়াকে কেন্দ্র করে আদালত প্রাঙ্গণে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়।
আপীল বিভাগের আদেশ দেয়ার পর সরকারী ও আসামি পৰের আইনজীবীরা প্রেসব্রিফিং করেন। পাশাপাশি আপীল বিভাগের আদেশ কিভাবে কার্যকর করা হবে তা নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক বসে। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ বিষয়ে ব্রিফিং প্রদান করা হয়। এদিকে কারাকতর্ৃপৰ পাঁচ খুনীর মৃতু্যদ- কার্যকর করতে প্রস্তুত। জালস্নাদ, ম্যানিলা রোপ থেকে শুরম্ন করে যাবতীয় বিষয় ঠিক করে রাখা হয়েছে।
উচ্চপর্যায়ের বৈঠক : আইন মন্ত্রণালয়ে দুপুরে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক বসে। বৈঠকে আপীল বিভাগের আদেশ পর্যালোচনা করা হয়। বৈঠকে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, আইন প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরম্নল ইসলাম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, সরকার পৰের প্রধান কেঁৗসুলি এ্যাডভোকেট আনিসুল হক, আইজি (প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশরাফুল ইসলাম, জেল সুপার (ঢাকা) তৌহিদুল ইসলাম, স্বরাষ্ট্র সচিব আব্দুস সোবহান শিকদার, আইন মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব আনোয়ারম্নল হক। দুপুর দেড়টা থেকে দুপুর সাড়ে ৩টা পর্য়নত্ম এই বৈঠক চলে।
আইন মন্ত্রী : আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, আজকের বৈঠক শেষে জেল কোড অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলেছি। জেল কোড অনুযায়ী মৃৃতু্য পরোয়ানা যে দিন কারাগারে পৌঁছাবে সে দিন থেকে ২১ দিনের আগে নয়, বা ২৮ দিনের পরে নয়, এর মধ্যেই দ- কার্যকর করতে হবে। হিসেব অনুযায়ী ৩১ জানুয়ারির মধ্যে যে কোন দিন যে কোন মৃুহূর্তে মৃতু্যদ- কার্যকর করা হবে। জেলার এসেছিলেন, সেই মোতাবেক বলা হয়েছে। জেল কোড অনুযায়ী ৩১ জানুয়ারির মধ্যেই পাঁচ খুনীর মৃৃতু্যদ- কার্ডকর করা হবে। একজন আসামি রাষ্ট্রপতির নিকট প্রাণ ভিৰার আবেদন করেনি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন বলেছেন, খুনীদের ফাঁসি দেয়ার জন্য কারাকতর্ৃপৰ প্রস্তুত। যাতে কোথাও বিশৃঙ্খলা না ঘটে সে জন্য ঢাকাসহ সারাদেশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা বিভিন্ন ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছি। যে সমসত্ম খুনী বিদেশে পলাতক রয়েছে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। এ ব্যাপারে ইন্টারপোলের সাহায্য নেয়া হচ্ছে। কারাগারে এখনও এক খুনী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিৰার আবেদন করেনি, সে কি আদৌ করবে না_ এমন প্রশ্নের উত্তরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সে আবেদন করবে কিনা জানি না।
আনিসুল হক : রাষ্ট্রপৰের প্রধান কেঁৗসুলি আনিসুল হক বলেছেন, জেল কোডের যে বিধান আছে তা অনুসরণ করা হবে। তার কোন ব্যত্যয় হবে না। জেল কোডের ৯৯১ ধারার বিধান মোতাবেক বিচারিক আদালত থেকে 'লাল খামে' পাঁচ আসামির নামে মৃতৃ্য পরোয়ানা যখনই কারাগারে গেছে সেই সময় থেকেই ৰণ গণনা শুরম্ন হয়েছে। ৩ জানুয়ারি মৃতু্য পরোয়ানা গেছে, সেই মোতাবেক ৩ জানুয়ারি থেকে ৩১ জানুয়ারির মধ্যে ২১ দিনের আগে নায়, ২৮ দিনের মধ্যে করতে হবে। রিভিউ পিটিশন করলে সব প্রক্রিয়া স্থগিত হয়ে যায়। যে দিন আসামি পৰ পিটিশন দাখিল করেছে, সেই দিন থেকে গণনা হবে কিনা, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, দিন গণনার সঙ্গে রিভিউয়ের কোন সম্পর্ক নেই। আনিসুল হক বলেন, এটা ন্যায় বিচার পাবার সংগ্রাম। এটা প্রতিহিংসার সংগ্রাম নয়। ন্যায় বিচার পেয়েছি সে জন্য সন্তুষ্ট। বিচার বিভাগ প্রমাণ করেছে, এত বড় বিচার সুষ্ঠুভাবে হতে পারে।
মাহবুবে আলম : এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, পৃথিবীর জঘন্যতম হত্যাকা-ের চূড়ানত্ম রায় ঘোষিত হলো। যে পাঁচ আসামি রিভিউ পিটিশন দাখিল করেছিল আপীল বিভাগ তা খারিজ করে দিয়েছে। এখন আইন প্রক্রিয়ার পরবতর্ী কার্যক্রম গ্রহণ করবে জেল কর্তৃপৰ। বিচারিক আদালত, হাইকোর্ট, এবং আপীল বিভাগের স্বচ্ছতায় বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। এখন কোন আসামি প্রাণভিৰা চাইলে সে বিষয়টি জেল কর্তৃপৰ দেখবেন। তিনি বলেন, জেল কর্তর্পৰ কখন রায় কার্যকর করবে, তা তাদের এখতিয়ার।
খান সাইফুর রহমান : লে. কর্নেল (বরখাসত্ম) সৈয়দ ফারম্নক রহমান ও লে. কর্নেল (অব) মুহিউদ্দিন আহম্মেদ (আর্টিলারির) আইনজীবী খান সাইফুর রহমান। আপীল বিভাগের আদেশের পর তিনি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, এই ধরণীতে মানুষের অসহায়ত্বের স্বসত্মিই ধর্ম। লে. কর্নেল (বরখাসত্ম) সৈয়দ ফারম্নক রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিৰা চাইবে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমি জানি না।
আব্দুর রেজ্জাক খান : লে. কর্নেল (অব) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানের আইনজীবী আব্দুর রেজ্জাক খান। তিনি প্রতিক্রিয়ায় বলেন, সুপ্রীমকোর্টের রায় অবশ্যই মেনে নিতে হবে। হত্যাকা- নির্মম ও নিষ্ঠুর এবং নিন্দনীয়। তাই মামলা সম্পূর্ণ ঘটনা আগের এবং পরের প্রেৰিত বিবেচনা করে দেশের প্রশাসন, জুডিশিয়ারি, আর্ম ফোর্সেস প্রত্যেককে এ মামলা একটা মেসেস দিয়েছে। রাজনীতিবিরা এই রায়টা পৰপাতহীনভাবে যদি বিশেস্নষণ করেন, যাতে এ জাতীয় ঘটনার পুনরাবৃত্তি বাংলার মাটিতে আর না হয়। তিনি বলেন, আমার মক্কেলের হাত রক্তে রঞ্জিত নয়। তাকে দ-িত করা হয়েছে ষড়যন্ত্রের অংশীদার হিসেবে।
ব্যারিস্টার মামুন : লে. কর্নেল (অব) একেএম মহিউদ্দীন আহম্মেদ (ল্যান্সার) এবং মেজর (অব) বজলুল হুদার পৰের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুলস্নাহ আল মামুন বলেন, আমরা আপীল বিভাগের আদেশে আশাহত হয়েছি। আমাদের গ্রাউন্ডগুলো আদালত গ্রহণ করেনি।
শম রেজাউল কমির : সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সেক্রেটারি জেনারেল শম রেজাউল করিম তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ঘোষিত যে আদেশ হয়েছে তাতে আসামিদের মৃৃতু্যদ- কার্যকর করতে আর কোন প্রতিবন্ধকতা নেই।
No comments