যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে নতুন মূল্যবোধ- কুনত্মল রা
মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে একটি বহুল প্রতীৰিত ও বিতর্কিত প্রশ্নের উত্তর মিলবে মার্কিন নাগরিকদের সামনে; আর সেটি হলো 'একজন পুরম্নষ কি আরেক পুরম্নষকে অথবা একনারী কি আরেক নারীকে বিয়ে করে ঘর-সংসার করতে পারবে? প্রায় ৪০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে সমলিঙ্গের বিয়ে এবং সম্পর্কের বৈধতা নিয়ে আইনি লড়াই চলছে, রৰণশীল ও উদারতাবাদীদের মধ্যে তর্কযুদ্ধ হয়েছে কিন্তু গোটা জাতি কোন নির্দিষ্ট সিদ্ধানত্মে পৌছাতে পারেনি।
অপেৰার অবসান ঘটিয়ে এবছরেরই মার্চ মাসে রাজধানী ওয়াশিংটনের ফেডারেল আদালতে সিদ্ধানত্ম হয়ে যাবে, সমলিঙ্গের বিয়েকে জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি দিয়ে মার্কিনিরা সমকামিতাকে জাতীয় মূল্যবোধ হিসেবে গ্রহণ করবে কিনা। বিয়ে এক ধরনের সামাজিক, নৈতিক ও আইনগত বন্ধন। রাষ্ট্রের ৰুদ্রতম একক পরিবার গঠিত হয় বিয়ের মাধ্যমে। প্রথাগত বিয়ের কথা উঠলেই আমাদের মনে হয় একজন নারী ও পুরম্নষের মধ্যে রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা, যার ফলে তারা দু'জন একসঙ্গে বসবাস করতে পারবে, সনত্মান জন্মদান ও তাদের বড় করতে পারবে। বিশ্বের সব দেশেই বিয়ে স্বাধীন জনগণের অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসেবেই ধরা হয়।তখন, প্রথাগত বিয়ের বাইরে একটু চিনত্মা করে দেখুন। বিয়ে বলতেই আমাদের চোখের সামনে যে নারী ও পুরম্নষের মধ্যে বিয়ের দৃশ্য ভেসে ওঠে, তেমন তো নাও হতে পারে। যদি একজন নারী অপর এক নারীর সঙ্গে অথবা একজন পুরম্নষ অপর এক পুরম্নষের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে চায়, তখন কি হবে?
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন রাষ্ট্রযন্ত্র তখন কি একজন ব্যক্তির স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত জীবন ও পছন্দের উপর হসত্মৰেপ করবে? গণতন্ত্র কিন্তু সেকথা বলে না। গণতন্ত্র রাষ্ট্রের প্রত্যেক সদস্যের মৌলিক অধিকার সমুন্নত রাখার কথা বলে, তাহলে একজন নারী কিংবা পুরম্নষ নিজের পছন্দমতো কোন সমলিঙ্গের আরেকজনকে বিয়ে করতে পারবে না? এটা কি গণতন্ত্রের মূল্যবোধকে অস্বীকার করে না?
প্রশ্ন থেকে যায় এবং এই প্রশ্ন থেকে জন্ম নেয় বড় ধরনের বিতর্ক। ২০০৯ সালের ২ জুলাই দিলস্নী হাইকোর্ট ভারতীয় পেনাল কোডের ৩৭৭ নং সেকশনকে সংবিধানের সঙ্গে সংঘাতমূলক বলে রায় দেয় এবং প্রাপ্তবয়স্কদের সমকামীতাকে স্বীকৃতি দেয়। এর আগে পেনাল কোড অনুসারে প্রাকৃতিক নিয়মের বিপরীতে কোন কর্মকান্ড অবৈধ এবং শাসত্মিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হতো, হাইকোর্ট যাকে ভারতীয় সংবিধানে লিখিত জনগণের মৌলিক অধিকার অধ্যাদেশের পরিপন্থী বলে মনে করে। হাইকোর্টের এই রায়ে রৰণশীল ভারতীয়রা তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায়। তবে সমলিঙ্গের বিয়েকে ভারতে বৈধ করা হয়নি।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমকামীতা ও সমকামী বিয়েকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। কানাডা এদের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে। ২০০৫ সাল থেকে এখানে সমকামীতাকে আইনি বৈধতা ও সমকামী বিয়েকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। জাপানে সমকামীতাকে কখনোই নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়নি কারণ প্রাচীন জাপান ও চৈনিক সাহিত্যে সমকামীতার প্রচুর উলেস্নখ আছে। জাপানী সমাজ ও ধর্ম সমকামবিরোধী নয়। সরকার চাকুরিৰেত্রে লিঙ্গপরিচয় ভিত্তিক বৈষম্য আইন করে বন্ধ করেছে।
২০০৫ সালে জাপানের আইনসভায় সমকামী নারী সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। অস্ট্রেলিয়ায় একই লিঙ্গের সম্পর্ক বৈধতা ও স্বীকৃতি দেয়া হলেও সমকামী বিয়ে এখনও নিষিদ্ধ।
মার্কিন মূলস্নুকে সমলিঙ্গের সম্পর্ক নিয়ে আইনি যুদ্ধ চলছে বিগত চার দশক ধরে। আমেরিকার কয়েকটি রাজ্যে সমকামী সম্পর্ক ও বিয়েকে বৈধ ঘোষণা করেছে তাদের প্রাদেশিক বিচার বিভাগ। যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চাশটি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে পাঁচটি রাজ্যে সমকামী বিয়ে বৈধ। ২০০৮ সালের ১৬ জুন ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের আদালত সমলিঙ্গের বিয়ে এবং সম্পর্কেকে বৈধ করলেও সুপ্রীমকোর্ট ৪ নবেম্বর ফের বন্ধ করে দেয়। জনগণের দাবীতে সুপ্রীমকোর্ট নতুন আইন করে বলে, "ক্যালিফোর্নিয়ার একমাত্র নারী ও পুরম্নষের মধ্যে বিয়ে বৈধ এবং স্বীকৃত হবে।"
তবে অনেক মার্কিনী ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের সুপ্রীমকোর্টের সিদ্ধানত্মে খুশি নয়। মার্কিন সংবিধান রাষ্ট্রের সকল জনগণের ব্যক্তিগত জীবন, সম্পদ ও পছন্দের স্বাধীনতা এবং আইনের সমবন্টন নিশ্চিত করেছে এবং কোন অঙ্গরাজ্য তার জনগনের এই মৌলিক অধিকার পরিপন্থী আইন করতে পারবে না। সেৰেত্রে ক্যালিফোর্নিয়ার আইন রাষ্ট্রীয় সংবিধানের সঙ্গে সংঘাত সৃষ্টি করে বলে বিশেস্নষকদের মত। তারা আরও বলেন, প্রথাগতভাবে বিয়ে বলতে নারী ও পুরম্নষের মধ্যে বিয়েই বোঝায়, কিন্তু রাষ্ট্রীয় সংবিধানে নাগরিকের অধিকার ও স্বাধীনতার সমতা বলতে নারী-পুরম্নষ সম্পর্ককে নির্দিষ্ট করে না।
তবে 'প্রথাগত' বিয়েতে বিশ্বাসী অনেকেই মনে করেন, সমকামী বিয়েতে জনসম্পদ বৃদ্ধির মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থ রৰার বিষয়টি উপেৰিত হয়। উদারপন্থীরা অবশ্য এর বিরোধীতা করে বলেন, সমলিঙ্গের বিয়ে কখনোই বিপরীত লিঙ্গের বিয়ে, সনত্মান জন্মদান ও পরিবার গঠনের ৰেত্রে বাধা নয়।
মোট কথা, সমকামীতার প্রশ্নে মার্কিনীরা এখন বিভক্ত। রৰনশীল ও উদারবাদীরা একের পর্এক যুক্তি দিচ্ছেন সেই যুক্তি খ-ন করে নতুন যুক্তি উত্থাপন করছেন। তবে সমকামীতা নিয়ে কোন ব্যক্তির সহানুভূতি-ই থাকুক আর ঘৃণাবোধই থাকুক, একথা অবশ্যই সত্য যে সমকামীরা পরিবার ও সমাজেরই অংশ। এজন্যই মার্কিন সমাজ সমলিঙ্গের সম্পর্কের স্বীকৃতি এবং সমলিঙ্গের বিয়ে নিয়ে সৃষ্ট দ্বিধা-বিভক্তি দ্রম্নত দূর করতে বদ্ধ পরিকর। এখন শুধুই অপেৰা ওয়াশিংটন ট্রায়ালের, যার মাধ্যমে জানা যাবে, সমকামিতা মার্কিন মূল্যবোধে পরিণত হবে কি না?
No comments