সমসময়-সন্ত্রাসের ভারসাম্য by আতাউস সামাদ
গত মঙ্গলবার প্রত্যুষে রাজধানীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলের কপালে সন্ত্রাসের আরেকটি কলঙ্ক তিলক লাগিয়ে দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ।
ওই সংগঠনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠী 'অর্থ' মানে টাকা-পয়সা নামক নিতান্তই বৈষয়িক বস্তুটিকে কেন্দ্র করে যে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় তাতে পত্রিকা সূত্রমতে, কমপক্ষে ৫০ জন আহত হয়েছে। ওই মারামারিতে গুলি ও বোমা ব্যবহার করা হয়েছে বেপরোয়াভাবে
আজকাল মনে হয় সবই সম্ভব। মানুষ আজকে যা কল্পনা করবে কোনো না কোনো একদিন তা বাস্তবে পরিণত হবে। বর্তমান যুগে এমনটা ঘটতেও যেন সময় বেশি লাগছে না।
মাস কয়েক আগে একজন মার্কিন বৈজ্ঞানিক মন্তব্য করেছিলেন, হলিউডের সায়েন্স ফিকশন চলচ্চিত্রগুলো অর্থাৎ কোনো বিজ্ঞান বিষয়নির্ভর করে বা ছুঁয়ে কাল্পনিক কাহিনী নিয়ে তৈরি ছবিগুলোর অনেক কিছুই বাস্তবের খুব কাছাকাছি। কোনো কোনো চলচ্চিত্রে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার অথবা বিজ্ঞানের উদ্ভাবনাকে আগাম দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ সিনেমাতে যা দেখানো হয়েছে পরে তেমন ঘটনা ঘটেছে বা জিনিস আবিষ্কৃত হয়েছে। আমার মনে হয় শুধু বিজ্ঞান নিয়ে নয় এমন কী অপরাধ, অ্যাডভেঞ্চার ও রাজনীতি নিয়ে তৈরি বেশ কিছু হলিউড সিনেমা পরে বাস্তবে ঘটতে দেখা গেছে। অবশ্য কবি ও সাহিত্যিকরাও যুগ যুগ ধরে এ রকম পূর্বাভাস দিয়েছেন।
ফিরে আসি হলিউডি ছবির কথায়। আজকে দুটি চলচ্চিত্রের কথা মনে পড়ছে। একটাতে দেখানো হয়েছিল, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত তার একটা সাবেক অঙ্গরাজ্যের দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্র সেখান থেকে কয়েকটি আণবিক বোমা চুরি করে। এগুলোর একটি পেঁৗছে যায় একজন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদীর কাছে, যিনি তার স্ত্রী ও নাবালক সন্তানের হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য চুরি করা আণবিক বোমাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানোর চেষ্টা করেন। স্মরণ করা যেতে পারে, কাল্পনিক কিন্তু বিশ্ববিখ্যাত ব্রিটিশ সামরিক গোয়েন্দা জেমস বন্ডের স্রষ্টা তার এই '০০৭' কোড নামের চরিত্রটি নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন, যার কাহিনীটি ছিল আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের দ্বারা অ্যাটম বোমা চুরি করা। গতকাল পত্রিকায় পড়লাম উইকিলিকস মার্কিন সরকারের তথ্য প্রকাশ করেছে, খালিদ শেখ মোহাম্মদ নামে এক আল কায়দা নেতা কুখ্যাত গুয়ানতানামো বে কারাগারে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তার মার্কিন জেরাকারীদের বলেছেন, তার গোপন সংগঠনের হাতে একটা আণবিক বোমা আছে এবং সেটা ইউরোপে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। যদি পশ্চিমা সরকাররা কখনও আল কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে গ্রেফতার কিংবা হত্যা করে তাহলে সেই আণবিক বোমাটি তৎক্ষণাৎ ইউরোপেই ফাটানো হবে (সূত্র : আমার দেশ)। মাত্র গত পরশু চেরনোবিল আণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি চুলি্ল বিস্ফোরণের ২৫তম বার্ষিকী পালন করা হলো গভীর শোকের সঙ্গে। জাপানে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত আণবিক চুলি্ল থেকে ছড়িয়ে পড়া তেজস্ক্রিয়া নিয়ে বিশ্ববাসীর দুশ্চিন্তার শেষ নেই। তারই মাঝে একটি বিশেষ জঙ্গি রাজনৈতিক গোষ্ঠী, যার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র তাবৎ পশ্চিমা শক্তিদের একাট্টা করে আফগানিস্তানে যুদ্ধ চালাচ্ছে, সেই আল কায়দা আণবিক বোমা হস্তগত করেছে এ খবর আমাদের কেবল চমকেই দেয় না সবার কল্পনাকেও হার মানায়। পাশ্চাত্যের সব সরকারের এখন স্বীকার করে নেওয়া উচিত বর্তমান যুগে যে কোনো যুদ্ধের রণাঙ্গন রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক সীমারেখাগুলো ছাড়িয়ে বিশ্বের যে কোনো জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। শুধু তাই নয়, মহাকাশও যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে। এসব কথা বলে আমরা কোনো বাড়াবাড়ি করছি না। রাজনৈতিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে 'ঝঃধৎ ডধৎং' বা তারকাযুদ্ধ কথাটি পৃথিবীকে উপহার দিয়েছিলেন নিজ দেশের স্বার্থরক্ষায় সফলতম মার্কিন প্রেসিডেন্টদের মধ্যে অন্যতম রোনাল্ড রিগ্যান। প্রসঙ্গত, মনে করিয়ে দিই রিগ্যান তার যৌবনকালে হলিউডের 'কাউবয়' ছবিতে অভিনয় করে জনপ্রিয় হয়েছিলেন। ওসব ছবির অন্যতম আকর্ষণ থাকত বন্দুকযুদ্ধ। এখন বিশ্ব যাচ্ছে কোন যুদ্ধের দিকে_ বন্দুকযুদ্ধ না আণবিক যুদ্ধ, নাকি কোনো যুদ্ধ নয় তবে 'ব্যালাস অব টেরর'-এর দিকে, যেখানে আক্রমণাত্মক শক্তির ভারসাম্য যুদ্ধ বন্ধ রাখবে।
দ্বিতীয় যে হলিউডি ছবিটির কথা আজকের খবরের কাগজ পড়ে মনে আসছে সেটি একটি বিশেষ দৃশ্যের জন্য। দৃশ্যটি ছিল এক লোক জেল খেটে বেরিয়ে এসে এক পুলিশ অফিসারকে হত্যা করে প্রতিশোধ নেয়। ছবিতে দেখানো পুলিশ অফিসারটি একটি চৌরাস্তায় ট্রাফিক সিগন্যালের লাল বাতি দেখে গাড়ি থামিয়েছেন আর ঠিক তখনই দাগী অপরাধীটি ফুটপাত থেকে নেমে ওই গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পিস্তল দিয়ে গুলি করে অফিসারটিকে খুন করল। গাড়ির কাচ ভেঙে সে গুলি গিয়ে বিঁধেছিল পুলিশ অফিসারটির গায়ে। চলচ্চিত্রটির নাম মনে নেই তবে দৃশ্যটা মনে থেকে গিয়েছিল, আর গতকালকের পত্রিকায় টঙ্গীতে এক ব্যবসায়ীকে সন্ত্রাসীরা তার গাড়ি থামিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে_ এই খবর পড়ে সেটা মনে পড়ে গেল। সংবাদপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, নিহত ব্যবসায়ী হযরত আলী টঙ্গী থানা ছাত্রলীগের এক নেতার চাচা।
দেশের চারদিক থেকে ইদানীং যেসব সংঘর্ষ ও হত্যাকাণ্ডের খবর আসছে তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার বিভিন্ন সংগঠনের লোকদের জড়িত থাকার কথা বলা হচ্ছে। অর্থাৎ নিহত ও আহতরা এবং হত্যাকারী ও দাঙ্গাবাজরা উভয়েই ক্ষমতাসীন দলে প্রভাবশালী বা সে রকম ব্যক্তিদের সমর্থক। ইদানীং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং ও তার কিছু কিছু মন্ত্রী যে অনবরত নানা বিষয়ে অবিশ্রান্তভাবে বিরোধী দলগুলোর সমালোচনা করছেন, এ 'বাংলার মাটিতে তাদের বিচার হবে' বলে হুমকি দিচ্ছেন তা সম্ভবত তাদের নিজ দলের লোকদের অপরাধ ও অপকর্ম থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে রাখার জন্য করছেন বলে মাঝে মধ্যেই সন্দেহ জাগে। অন্য কি আর বলবেন_ খাদ্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির হার দুই অঙ্কের কোঠায় পেঁৗছেছে এ তথ্য জানিয়েছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। এ প্রতিষ্ঠানের উচ্চপর্যায়ে যদি কারও সঙ্গে সম্পর্ক থেকে থাকে তো তা আছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে। কাজেই আমরা আর কী বলব!
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বা শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বা এমনকি এক সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান যতই অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে রাখুন তাদের ছাত্রলীগ তো কিছুতেই রক্তারক্তি করার নেশা ছাড়তে পারছে না। গত মঙ্গলবার প্রত্যুষে রাজধানীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলের কপালে সন্ত্রাসের আরেকটি কলঙ্ক তিলক লাগিয়ে দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ। ওই সংগঠনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠী 'অর্থ' মানে টাকা-পয়সা নামক নিতান্তই বৈষয়িক বস্তুটিকে কেন্দ্র করে যে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় তাতে পত্রিকা সূত্রমতে, কমপক্ষে ৫০ জন আহত হয়েছে। ওই মারামারিতে গুলি ও বোমা ব্যবহার করা হয়েছে বেপরোয়াভাবে। প্রায় সব পত্রিকাই আহতদের ছবি ছেপেছে। ওই ঘটনা সংক্রান্ত খবরের শিরোনামগুলো এ রকম : 'ঢাবিতে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ, আহত অর্ধশতাধিক (সমকাল), 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের আধিপত্যের লড়াই, শেষ রাতে প্রকম্পিত ক্যাম্পাস, ৬০ শিক্ষার্থী আহত, ছাত্রলীগ থেকে ১১ জনকে বহিষ্কার (কালের কণ্ঠ), 'মুহসীন হলে ছাত্রলীগের লড়াই, গুলিবোমা, ভাংচুর, আহত শতাধিক' (বাংলাদেশ প্রতিদিন), 'ঢাবি মুহসীন হলে ছাত্রলীগের দু'গ্রুপের সংঘর্ষ, গোলাগুলি, দু'জন গুলিবিদ্ধসহ ৭০ জন আহত : ১৫টি কক্ষ ভাংচুর, হল কমিটি স্থগিত ও সংগঠন থেকে ১১ জনকে বহিষ্কার' (ইনকিলাব)। এই যে দৈনিক পত্রিকাগুলোর শিরোনাম উদৃব্দত করলাম এগুলো ইদানীং আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে পরিচিত। মেধাবী ছাত্র আবু বকর নিহত হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, 'ও রকম হতেই পারে, ওটা কোনো ব্যাপার না।' মুহসীন হলের মঙ্গলবারের সন্ত্রাস নিয়ে তিনি বা তার মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী অথবা প্রধানমন্ত্রী কী বলবেন? তা সেই যাই হোক কিন্তু আজ থেকে শতবর্ষ পরে কেউ প্রশ্ন করে ফেলতে পারে, হাজী মুহাম্মদ মুহসীন কি সন্ত্রাসীদের সর্দার ছিলেন? তা না হলে তার স্মরণে নামকরণ করা ছাত্রাবাসে এত সন্ত্রাস কেন? হায় দানবীর মুহসীন, আপনার সত্যিকার পরিচয় জানার জন্য বাংলাদেশিদের ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলী জেলায়ই যেতে হবে। আমাদেরও অদৃষ্ট!
আতাউস সামাদ : সাংবাদিক
আজকাল মনে হয় সবই সম্ভব। মানুষ আজকে যা কল্পনা করবে কোনো না কোনো একদিন তা বাস্তবে পরিণত হবে। বর্তমান যুগে এমনটা ঘটতেও যেন সময় বেশি লাগছে না।
মাস কয়েক আগে একজন মার্কিন বৈজ্ঞানিক মন্তব্য করেছিলেন, হলিউডের সায়েন্স ফিকশন চলচ্চিত্রগুলো অর্থাৎ কোনো বিজ্ঞান বিষয়নির্ভর করে বা ছুঁয়ে কাল্পনিক কাহিনী নিয়ে তৈরি ছবিগুলোর অনেক কিছুই বাস্তবের খুব কাছাকাছি। কোনো কোনো চলচ্চিত্রে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার অথবা বিজ্ঞানের উদ্ভাবনাকে আগাম দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ সিনেমাতে যা দেখানো হয়েছে পরে তেমন ঘটনা ঘটেছে বা জিনিস আবিষ্কৃত হয়েছে। আমার মনে হয় শুধু বিজ্ঞান নিয়ে নয় এমন কী অপরাধ, অ্যাডভেঞ্চার ও রাজনীতি নিয়ে তৈরি বেশ কিছু হলিউড সিনেমা পরে বাস্তবে ঘটতে দেখা গেছে। অবশ্য কবি ও সাহিত্যিকরাও যুগ যুগ ধরে এ রকম পূর্বাভাস দিয়েছেন।
ফিরে আসি হলিউডি ছবির কথায়। আজকে দুটি চলচ্চিত্রের কথা মনে পড়ছে। একটাতে দেখানো হয়েছিল, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত তার একটা সাবেক অঙ্গরাজ্যের দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্র সেখান থেকে কয়েকটি আণবিক বোমা চুরি করে। এগুলোর একটি পেঁৗছে যায় একজন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদীর কাছে, যিনি তার স্ত্রী ও নাবালক সন্তানের হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য চুরি করা আণবিক বোমাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানোর চেষ্টা করেন। স্মরণ করা যেতে পারে, কাল্পনিক কিন্তু বিশ্ববিখ্যাত ব্রিটিশ সামরিক গোয়েন্দা জেমস বন্ডের স্রষ্টা তার এই '০০৭' কোড নামের চরিত্রটি নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন, যার কাহিনীটি ছিল আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের দ্বারা অ্যাটম বোমা চুরি করা। গতকাল পত্রিকায় পড়লাম উইকিলিকস মার্কিন সরকারের তথ্য প্রকাশ করেছে, খালিদ শেখ মোহাম্মদ নামে এক আল কায়দা নেতা কুখ্যাত গুয়ানতানামো বে কারাগারে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তার মার্কিন জেরাকারীদের বলেছেন, তার গোপন সংগঠনের হাতে একটা আণবিক বোমা আছে এবং সেটা ইউরোপে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। যদি পশ্চিমা সরকাররা কখনও আল কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে গ্রেফতার কিংবা হত্যা করে তাহলে সেই আণবিক বোমাটি তৎক্ষণাৎ ইউরোপেই ফাটানো হবে (সূত্র : আমার দেশ)। মাত্র গত পরশু চেরনোবিল আণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি চুলি্ল বিস্ফোরণের ২৫তম বার্ষিকী পালন করা হলো গভীর শোকের সঙ্গে। জাপানে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত আণবিক চুলি্ল থেকে ছড়িয়ে পড়া তেজস্ক্রিয়া নিয়ে বিশ্ববাসীর দুশ্চিন্তার শেষ নেই। তারই মাঝে একটি বিশেষ জঙ্গি রাজনৈতিক গোষ্ঠী, যার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র তাবৎ পশ্চিমা শক্তিদের একাট্টা করে আফগানিস্তানে যুদ্ধ চালাচ্ছে, সেই আল কায়দা আণবিক বোমা হস্তগত করেছে এ খবর আমাদের কেবল চমকেই দেয় না সবার কল্পনাকেও হার মানায়। পাশ্চাত্যের সব সরকারের এখন স্বীকার করে নেওয়া উচিত বর্তমান যুগে যে কোনো যুদ্ধের রণাঙ্গন রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক সীমারেখাগুলো ছাড়িয়ে বিশ্বের যে কোনো জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। শুধু তাই নয়, মহাকাশও যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে। এসব কথা বলে আমরা কোনো বাড়াবাড়ি করছি না। রাজনৈতিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে 'ঝঃধৎ ডধৎং' বা তারকাযুদ্ধ কথাটি পৃথিবীকে উপহার দিয়েছিলেন নিজ দেশের স্বার্থরক্ষায় সফলতম মার্কিন প্রেসিডেন্টদের মধ্যে অন্যতম রোনাল্ড রিগ্যান। প্রসঙ্গত, মনে করিয়ে দিই রিগ্যান তার যৌবনকালে হলিউডের 'কাউবয়' ছবিতে অভিনয় করে জনপ্রিয় হয়েছিলেন। ওসব ছবির অন্যতম আকর্ষণ থাকত বন্দুকযুদ্ধ। এখন বিশ্ব যাচ্ছে কোন যুদ্ধের দিকে_ বন্দুকযুদ্ধ না আণবিক যুদ্ধ, নাকি কোনো যুদ্ধ নয় তবে 'ব্যালাস অব টেরর'-এর দিকে, যেখানে আক্রমণাত্মক শক্তির ভারসাম্য যুদ্ধ বন্ধ রাখবে।
দ্বিতীয় যে হলিউডি ছবিটির কথা আজকের খবরের কাগজ পড়ে মনে আসছে সেটি একটি বিশেষ দৃশ্যের জন্য। দৃশ্যটি ছিল এক লোক জেল খেটে বেরিয়ে এসে এক পুলিশ অফিসারকে হত্যা করে প্রতিশোধ নেয়। ছবিতে দেখানো পুলিশ অফিসারটি একটি চৌরাস্তায় ট্রাফিক সিগন্যালের লাল বাতি দেখে গাড়ি থামিয়েছেন আর ঠিক তখনই দাগী অপরাধীটি ফুটপাত থেকে নেমে ওই গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পিস্তল দিয়ে গুলি করে অফিসারটিকে খুন করল। গাড়ির কাচ ভেঙে সে গুলি গিয়ে বিঁধেছিল পুলিশ অফিসারটির গায়ে। চলচ্চিত্রটির নাম মনে নেই তবে দৃশ্যটা মনে থেকে গিয়েছিল, আর গতকালকের পত্রিকায় টঙ্গীতে এক ব্যবসায়ীকে সন্ত্রাসীরা তার গাড়ি থামিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে_ এই খবর পড়ে সেটা মনে পড়ে গেল। সংবাদপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, নিহত ব্যবসায়ী হযরত আলী টঙ্গী থানা ছাত্রলীগের এক নেতার চাচা।
দেশের চারদিক থেকে ইদানীং যেসব সংঘর্ষ ও হত্যাকাণ্ডের খবর আসছে তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার বিভিন্ন সংগঠনের লোকদের জড়িত থাকার কথা বলা হচ্ছে। অর্থাৎ নিহত ও আহতরা এবং হত্যাকারী ও দাঙ্গাবাজরা উভয়েই ক্ষমতাসীন দলে প্রভাবশালী বা সে রকম ব্যক্তিদের সমর্থক। ইদানীং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং ও তার কিছু কিছু মন্ত্রী যে অনবরত নানা বিষয়ে অবিশ্রান্তভাবে বিরোধী দলগুলোর সমালোচনা করছেন, এ 'বাংলার মাটিতে তাদের বিচার হবে' বলে হুমকি দিচ্ছেন তা সম্ভবত তাদের নিজ দলের লোকদের অপরাধ ও অপকর্ম থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে রাখার জন্য করছেন বলে মাঝে মধ্যেই সন্দেহ জাগে। অন্য কি আর বলবেন_ খাদ্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির হার দুই অঙ্কের কোঠায় পেঁৗছেছে এ তথ্য জানিয়েছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। এ প্রতিষ্ঠানের উচ্চপর্যায়ে যদি কারও সঙ্গে সম্পর্ক থেকে থাকে তো তা আছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে। কাজেই আমরা আর কী বলব!
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বা শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বা এমনকি এক সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান যতই অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে রাখুন তাদের ছাত্রলীগ তো কিছুতেই রক্তারক্তি করার নেশা ছাড়তে পারছে না। গত মঙ্গলবার প্রত্যুষে রাজধানীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলের কপালে সন্ত্রাসের আরেকটি কলঙ্ক তিলক লাগিয়ে দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ। ওই সংগঠনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠী 'অর্থ' মানে টাকা-পয়সা নামক নিতান্তই বৈষয়িক বস্তুটিকে কেন্দ্র করে যে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় তাতে পত্রিকা সূত্রমতে, কমপক্ষে ৫০ জন আহত হয়েছে। ওই মারামারিতে গুলি ও বোমা ব্যবহার করা হয়েছে বেপরোয়াভাবে। প্রায় সব পত্রিকাই আহতদের ছবি ছেপেছে। ওই ঘটনা সংক্রান্ত খবরের শিরোনামগুলো এ রকম : 'ঢাবিতে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ, আহত অর্ধশতাধিক (সমকাল), 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের আধিপত্যের লড়াই, শেষ রাতে প্রকম্পিত ক্যাম্পাস, ৬০ শিক্ষার্থী আহত, ছাত্রলীগ থেকে ১১ জনকে বহিষ্কার (কালের কণ্ঠ), 'মুহসীন হলে ছাত্রলীগের লড়াই, গুলিবোমা, ভাংচুর, আহত শতাধিক' (বাংলাদেশ প্রতিদিন), 'ঢাবি মুহসীন হলে ছাত্রলীগের দু'গ্রুপের সংঘর্ষ, গোলাগুলি, দু'জন গুলিবিদ্ধসহ ৭০ জন আহত : ১৫টি কক্ষ ভাংচুর, হল কমিটি স্থগিত ও সংগঠন থেকে ১১ জনকে বহিষ্কার' (ইনকিলাব)। এই যে দৈনিক পত্রিকাগুলোর শিরোনাম উদৃব্দত করলাম এগুলো ইদানীং আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে পরিচিত। মেধাবী ছাত্র আবু বকর নিহত হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, 'ও রকম হতেই পারে, ওটা কোনো ব্যাপার না।' মুহসীন হলের মঙ্গলবারের সন্ত্রাস নিয়ে তিনি বা তার মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী অথবা প্রধানমন্ত্রী কী বলবেন? তা সেই যাই হোক কিন্তু আজ থেকে শতবর্ষ পরে কেউ প্রশ্ন করে ফেলতে পারে, হাজী মুহাম্মদ মুহসীন কি সন্ত্রাসীদের সর্দার ছিলেন? তা না হলে তার স্মরণে নামকরণ করা ছাত্রাবাসে এত সন্ত্রাস কেন? হায় দানবীর মুহসীন, আপনার সত্যিকার পরিচয় জানার জন্য বাংলাদেশিদের ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলী জেলায়ই যেতে হবে। আমাদেরও অদৃষ্ট!
আতাউস সামাদ : সাংবাদিক
No comments