পরিবেশ-টাঙ্গুয়ার হাওরের ব্যবস্থাপনা by নজির হোসেন
ব্যবস্থাপনার প্রধান দুর্বলতা হলো সামাজিক মালিকানার ধরন। কেউই প্রকৃত অর্থে টাঙ্গুয়ার হাওরের জন্য একান্তভাবে কাজ করতে পারে না। কারও ব্যক্তিস্বার্থ জড়িত না থাকার কারণে সম্পদ রক্ষার্থে পদক্ষেপ নেয় না। দুর্নীতির সুযোগ বেড়ে যায়। এ জন্য ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারী নিয়োগ অত্যন্ত জরুরি।
অনেকে মনে করেন টাঙ্গুয়ার হাওর রামসার সাইট, আন্তর্জাতিক বিষয়। এটা নিয়ে কথা বলা যাবে না
১৯৯৬ সালে টাঙ্গয়ার হাওরের ইজারা বাতিলের পর এর ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। এখন পর্যন্ত একটিকেও আদর্শ, টেকসই বলা যাবে না। ত্রুটিযুক্ত বর্তমান ব্যবস্থাপনায় হাওর সম্পদশূন্য হয়ে পড়েছে। টাঙ্গুয়ার পারের জনগণের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, গত কয়েক বছরে হাওরে মাছের উৎপাদন কমেছে ৯০ শতাংশ, গাছ ও বন উজাড় হয়েছে ৯৫ শতাংশ। পাখির আগমন কমেছে ৭০ শতাংশ। এমনটি চললে হাওর সম্পদশূন্য হতে কতদিন?
সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর-ধর্মপাশা উপজেলায় টাঙ্গুয়ার হাওর অবস্থিত। এ এলাকার প্রধান সম্পদ হলো ধান, মাছ, বালি, পাথর। এই সম্পদের ওপর ভিত্তি করে পরিকল্পিত অর্থনীতি এলাকার চিত্র বদলে দিতে পারে।
ইতিমধ্যে হাওরটিকে রামসার এলাকা এবং ইটিএ জোন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার প্রকল্পটিকে সঠিকভাবে পরিচালনার ব্যবস্থা করে। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে প্রকল্পটি শুরু
করতে পারেনি।
এমনিতেই এনজিওদের প্রতি জনগণের একটি বিরূপ ধারণা বাংলাদেশে বিদ্যমান। ঝউঈ নামের সংস্থার আর্থিক সহায়তায় ৩ কোটি ৭৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকা খরচ নিয়ে জনগণের প্রশ্ন আছে। এত টাকা কীভাবে খরচ হলো সে বিষয়ে তদন্ত প্রয়োজন। দ্বিতীয় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১২ কোটি ২৫ লাখ টাকা।
ইজারা দেওয়া বন্ধ হওয়ায় প্রতিবছর ৫ হাজার পরিবার কর্মসংস্থান থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অভয়াশ্রম গড়ে তোলার ধারণা অবৈজ্ঞানিক। বোয়াল এবং গনিয়া ছাড়া টাঙ্গুয়ার হাওরে কোনো কার্প বা ক্যাটস জাতীয় মাছ ডিম পাড়ে না। সে ক্ষেত্রে রুই, কাতল, মৃগেল ইত্যাদি মাছের ডিম পাড়ার আশায় অভয়াশ্রম করার পরিকল্পনা অত্যন্ত ভুল। এ অঞ্চলে মৎস্য উৎপাদনের সমস্যা ও প্রকৃতি একেবারেই ভিন্ন। বর্তমান পাহারা ব্যবস্থা, টেকসই ব্যবস্থাপনা, সম্প্রদায়ভিত্তিক ব্যবস্থাপনার এনজিও তত্ত্ব অসার। বর্তমান ব্যবস্থাপনায় মৎস্য সম্পদ এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষা প্রায় অসম্ভব।
স্থানীয় জনগণের ৭৮ শতাংশ মাছ ধরার প্রতি আসক্ত; কেউ জীবিকার টানে, কেউ অভ্যাসবশত। পাশে কয়লা ও বালি পরিবহনে প্রচুর অর্থ রোজগারের সুযোগ থাকলেও ওই স্থানে কাজ করতে যেতে কেউ আগ্রহী হয় না। অনেক নির্যাতন সহ্য করে রাতে 'চোরা জালুয়া' হিসেবে মাছ ধরতে যায়। অথচ টেকসই উৎপাদনমুখী ব্যবস্থাপনার ফলে টাঙ্গুয়ার হাওরে ৫০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান সম্ভব। এটা করতে হলে শুধু এনজিওদের তাত্তি্বকতা যথেষ্ট নয়, জনগণের অভিজ্ঞতাকেও কাজে লাগাতে হবে।
হাওরে প্রচুর পাখির সমাবেশ ঘটেছে। হাওর ব্যবস্থাপনার কারণে পাখিদের অবস্থান এখানে নিরাপদ হয়েছে। আসলে টাঙ্গুয়ার হাওরকে রক্ষা করতে হলে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির বিকল্প নেই। যে যে কারণে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে পারে :
নিশ্ছিদ্র পাহারা ব্যবস্থা; পর্যাপ্ত কাঠা বাঁশ দেওয়া; নিবিড় বনায়ন; সহনশীল পাখি সমাবেশ ঘটানো প্রভৃতি।
বৃত্তাকার পাইল ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্রুড মাছের ফলন বৃদ্ধি পাবে এবং সহনশীল পাখি সমাবেশ ঘটানো সম্ভব হবে।
পুকুর ব্যবস্থাপনা এবং বিল নার্সারির মাধ্যমে ক্যাটস জাতীয় মাছের বিশাল মজুদ গড়ে তোলা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ইটিএর বাধাগুলো দূর করতে হবে।
টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে ধরা নেসেন্ট ব্রুড থেকে রেণু উৎপাদনের জন্য নার্সারি গড়ে তোলা, এতে মাছের জেনারেশন পারভারশন রোধ করা সম্ভব হবে।
টাঙ্গুয়ার হাওরের ঐতিহাসিক ইকো অবস্থান পুনরুদ্ধারের জন্য_
* ভরাট জলমহালগুলোকে খনন করতে হবে; ফিশ মার্গেটরি রোড গড়ে তুলতে হবে; স্পাউনিং গ্রাউন্ড চিহ্নিত করতে হবে; মাছের জেনেটিক আচরণ চিহ্নিত করে উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে।
তিন বছরের পাইল ব্যবস্থার কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সংশ্লিষ্টদের মৎস্য আইন মেনে চলতে বাধ্য করা চাই।
এ এলাকায় মাছের মাইগ্রেটরি রোড ছিল পাটলাই নদী, যাদুকাটা নদী, রক্তি নদী, আবুয়া নদী ও সুরমা নদী। মাছের স্পাউনিং গ্রাউন্ড ছিল সুরমা নদীর ডোয়ারগুলো এবং মেঘালয়ের রানীকরের গভীর খাদগুলো। সুরমা নদীতে ক্যাটস জাতীয় ও চিতল মাছ ডিম দিত। সুরমা, কুশিয়ারার ৬০টি গভীর ডোয়ার মৎস্য উৎপাদনের বিশাল উৎস ছিল। তাহিরপুর এলাকার মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতা হলো, প্রতি বছর আশ্বিন-কার্তিক মাসে যাদুকাটা নদী দিয়ে কার্প জাতীয় মাছের বিশাল বহর উজানে রানীকরের দিকে চলে যেত।
জেমস কাপাস্কি ছিলেন ফাওয়ের মৎস্য বিশেষজ্ঞ। ১৯৮৪ সালে তিনি টাঙ্গুয়ার হাওরের উন্নয়ন প্রকল্প করতে গিয়ে যাদুকাটা দিয়ে এই মাইগ্রেশনকে মাছের স্পাউনিং গ্রাউন্ডের দিকে যাত্রা বলে অভিহিত করেছেন।
১৯৯৪ সালে ভোটের আশায় জেলেদের জন্য নদীগুলো উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। মাছের মাইগ্রেটরি রোড এবং স্পাউনিং গ্রাউন্ড মারাত্মক হুমকির মধ্যে পড়ে। টাঙ্গুয়ার হাওরের মাছ কৃত্রিম প্রতিবন্ধকতায় প্রকৃতির কোলে বন্দি হয়ে পড়ে। সরকার এর পাহারার খরচ বহন করার বাইরে আর কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছে কি-না এ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন আছে। এরা সবাই পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধীনে টিএইচএসসির নেতৃত্বে কাজ করছে। পুলিশ এবং ম্যাজিস্ট্রেট টাঙ্গুয়ার হাওরের সম্পদ পাহারা দিচ্ছে।
সিএনআরএস প্রতিটি গ্রামে কমিউনিটি গ্রুপ তৈরি করছে 'টাঙ্গুয়ার হাওর টেকসই ব্যবস্থাপনা' কমিটি নাম দিয়ে। টাঙ্গুয়ার হাওরে ৪৬টি গ্রামে প্রায় ৪০ হাজার লোক বাস করে। এদের ৭৮ শতাংশ জীবনধারণ করে মাছ ধরে। বর্তমানে সিএইচটিএম গঠন করার ফলে এ এলাকার মৎস্যজীবী জনগণের মাত্র ৩০ শতাংশ টাঙ্গুয়ার কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ফলে জনগণের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে, যার কারণে সমাজভিত্তিক ব্যবস্থাপনা সংকটে পড়তে পারে।
ব্যবস্থাপনার প্রধান দুর্বলতা হলো সামাজিক মালিকানার ধরন। কেউই প্রকৃত অর্থে টাঙ্গুয়ার হাওরের জন্য একান্তভাবে কাজ করতে পারে না। কারও ব্যক্তিস্বার্থ জড়িত না থাকার কারণে সম্পদ রক্ষার্থে পদক্ষেপ নেয় না। দুর্নীতির সুযোগ বেড়ে যায়। এ জন্য ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারী নিয়োগ অত্যন্ত জরুরি। অনেকে মনে করেন টাঙ্গুয়ার হাওর রামসার সাইট, আন্তর্জাতিক বিষয়। এটা নিয়ে কথা বলা যাবে না। কিন্তু যারা রামসার কনভেনশনের চুক্তি পড়েছেন তারা জানেন, রামসার সাইট ব্যবস্থাপনার বিষয় নিয়ে কোনো চুক্তি হয়নি। এটা জাতীয় বিষয়।
বিনিয়োগকারীর কার্য পরিধি : বাণিজ্যিক মৎস্য উৎপাদনের সব খরচ বিনিয়োগকারী করবেন; কারিগরি প্রস্তাব তৈরি ও বাস্তবায়ন; মৎস্য উৎপাদনের বৃদ্ধির জন্য কাঁঠ, বাঁশের ব্যবস্থা; বনায়ন; পাখির অভয়ারণ্য তৈরি; রামসার চুক্তির আলোকে পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষা।
বিকল্প প্রস্তাবনা :সরকারকে সম্প্রদায়ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা ধারণা থেকে সরে আসতে হবে। টাঙ্গুয়ার হাওরের বর্তমান অবস্থায় এই ধারণা বাস্তবতাবর্জিত ও অবৈজ্ঞানিক। প্রকল্পটি পরিবেশ ও উৎপাদন সম্পৃক্ত হতে হবে। প্রকল্পটি পিপিপির ধারণায় বিকশিত করলেই কেবল বর্তমান হাওরের পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষা করা সম্ভব। এছাড়াও সরকারি তত্ত্বাবধানে পরিবেশসম্মত একটি অমৎড় নধংবফ রহফঁংঃৎরধষ তড়হব গড়ে তোলা যায়।
এতে ৫০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান সম্ভব। প্রাথমিকভাবে বিনিয়োগকারী পদ্ধতিতে এগোনো যায়। পরে অমৎড় নধংবফ রহফঁংঃৎরধষ তড়হব গড়ে তোলা এবং এর প্রসার ঘটানো। এনজিও অর্থায়নের বিপরীতে পিপিপির অধীনে অর্থায়ন করা। টাঙ্গুয়ার হাওরে একজন কো-পার্টনার অথবা ইনভেস্টর নিয়োগ করা। যার বিপুল ইনভেস্টমেন্ট সামর্থ্য ও ওয়েটল্যান্ড ম্যানেজমেন্টের প্রচুর অভিজ্ঞতা আছে।
বর্তমান ব্যবস্থাপনার মধ্যেই একজন কো-পার্টনার নিয়োগ সম্ভব। সম্প্রদায়ের স্থলে ব্যক্তি অথবা প্রতিষ্ঠানকে কো-পার্টনার (বিনিয়োগকারী) করলেই বর্তমান সংকট মিটে যায়।
নজির হোসেন : সাবেক এমপি
১৯৯৬ সালে টাঙ্গয়ার হাওরের ইজারা বাতিলের পর এর ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। এখন পর্যন্ত একটিকেও আদর্শ, টেকসই বলা যাবে না। ত্রুটিযুক্ত বর্তমান ব্যবস্থাপনায় হাওর সম্পদশূন্য হয়ে পড়েছে। টাঙ্গুয়ার পারের জনগণের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, গত কয়েক বছরে হাওরে মাছের উৎপাদন কমেছে ৯০ শতাংশ, গাছ ও বন উজাড় হয়েছে ৯৫ শতাংশ। পাখির আগমন কমেছে ৭০ শতাংশ। এমনটি চললে হাওর সম্পদশূন্য হতে কতদিন?
সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর-ধর্মপাশা উপজেলায় টাঙ্গুয়ার হাওর অবস্থিত। এ এলাকার প্রধান সম্পদ হলো ধান, মাছ, বালি, পাথর। এই সম্পদের ওপর ভিত্তি করে পরিকল্পিত অর্থনীতি এলাকার চিত্র বদলে দিতে পারে।
ইতিমধ্যে হাওরটিকে রামসার এলাকা এবং ইটিএ জোন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার প্রকল্পটিকে সঠিকভাবে পরিচালনার ব্যবস্থা করে। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে প্রকল্পটি শুরু
করতে পারেনি।
এমনিতেই এনজিওদের প্রতি জনগণের একটি বিরূপ ধারণা বাংলাদেশে বিদ্যমান। ঝউঈ নামের সংস্থার আর্থিক সহায়তায় ৩ কোটি ৭৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকা খরচ নিয়ে জনগণের প্রশ্ন আছে। এত টাকা কীভাবে খরচ হলো সে বিষয়ে তদন্ত প্রয়োজন। দ্বিতীয় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১২ কোটি ২৫ লাখ টাকা।
ইজারা দেওয়া বন্ধ হওয়ায় প্রতিবছর ৫ হাজার পরিবার কর্মসংস্থান থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অভয়াশ্রম গড়ে তোলার ধারণা অবৈজ্ঞানিক। বোয়াল এবং গনিয়া ছাড়া টাঙ্গুয়ার হাওরে কোনো কার্প বা ক্যাটস জাতীয় মাছ ডিম পাড়ে না। সে ক্ষেত্রে রুই, কাতল, মৃগেল ইত্যাদি মাছের ডিম পাড়ার আশায় অভয়াশ্রম করার পরিকল্পনা অত্যন্ত ভুল। এ অঞ্চলে মৎস্য উৎপাদনের সমস্যা ও প্রকৃতি একেবারেই ভিন্ন। বর্তমান পাহারা ব্যবস্থা, টেকসই ব্যবস্থাপনা, সম্প্রদায়ভিত্তিক ব্যবস্থাপনার এনজিও তত্ত্ব অসার। বর্তমান ব্যবস্থাপনায় মৎস্য সম্পদ এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষা প্রায় অসম্ভব।
স্থানীয় জনগণের ৭৮ শতাংশ মাছ ধরার প্রতি আসক্ত; কেউ জীবিকার টানে, কেউ অভ্যাসবশত। পাশে কয়লা ও বালি পরিবহনে প্রচুর অর্থ রোজগারের সুযোগ থাকলেও ওই স্থানে কাজ করতে যেতে কেউ আগ্রহী হয় না। অনেক নির্যাতন সহ্য করে রাতে 'চোরা জালুয়া' হিসেবে মাছ ধরতে যায়। অথচ টেকসই উৎপাদনমুখী ব্যবস্থাপনার ফলে টাঙ্গুয়ার হাওরে ৫০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান সম্ভব। এটা করতে হলে শুধু এনজিওদের তাত্তি্বকতা যথেষ্ট নয়, জনগণের অভিজ্ঞতাকেও কাজে লাগাতে হবে।
হাওরে প্রচুর পাখির সমাবেশ ঘটেছে। হাওর ব্যবস্থাপনার কারণে পাখিদের অবস্থান এখানে নিরাপদ হয়েছে। আসলে টাঙ্গুয়ার হাওরকে রক্ষা করতে হলে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির বিকল্প নেই। যে যে কারণে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে পারে :
নিশ্ছিদ্র পাহারা ব্যবস্থা; পর্যাপ্ত কাঠা বাঁশ দেওয়া; নিবিড় বনায়ন; সহনশীল পাখি সমাবেশ ঘটানো প্রভৃতি।
বৃত্তাকার পাইল ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্রুড মাছের ফলন বৃদ্ধি পাবে এবং সহনশীল পাখি সমাবেশ ঘটানো সম্ভব হবে।
পুকুর ব্যবস্থাপনা এবং বিল নার্সারির মাধ্যমে ক্যাটস জাতীয় মাছের বিশাল মজুদ গড়ে তোলা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ইটিএর বাধাগুলো দূর করতে হবে।
টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে ধরা নেসেন্ট ব্রুড থেকে রেণু উৎপাদনের জন্য নার্সারি গড়ে তোলা, এতে মাছের জেনারেশন পারভারশন রোধ করা সম্ভব হবে।
টাঙ্গুয়ার হাওরের ঐতিহাসিক ইকো অবস্থান পুনরুদ্ধারের জন্য_
* ভরাট জলমহালগুলোকে খনন করতে হবে; ফিশ মার্গেটরি রোড গড়ে তুলতে হবে; স্পাউনিং গ্রাউন্ড চিহ্নিত করতে হবে; মাছের জেনেটিক আচরণ চিহ্নিত করে উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে।
তিন বছরের পাইল ব্যবস্থার কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সংশ্লিষ্টদের মৎস্য আইন মেনে চলতে বাধ্য করা চাই।
এ এলাকায় মাছের মাইগ্রেটরি রোড ছিল পাটলাই নদী, যাদুকাটা নদী, রক্তি নদী, আবুয়া নদী ও সুরমা নদী। মাছের স্পাউনিং গ্রাউন্ড ছিল সুরমা নদীর ডোয়ারগুলো এবং মেঘালয়ের রানীকরের গভীর খাদগুলো। সুরমা নদীতে ক্যাটস জাতীয় ও চিতল মাছ ডিম দিত। সুরমা, কুশিয়ারার ৬০টি গভীর ডোয়ার মৎস্য উৎপাদনের বিশাল উৎস ছিল। তাহিরপুর এলাকার মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতা হলো, প্রতি বছর আশ্বিন-কার্তিক মাসে যাদুকাটা নদী দিয়ে কার্প জাতীয় মাছের বিশাল বহর উজানে রানীকরের দিকে চলে যেত।
জেমস কাপাস্কি ছিলেন ফাওয়ের মৎস্য বিশেষজ্ঞ। ১৯৮৪ সালে তিনি টাঙ্গুয়ার হাওরের উন্নয়ন প্রকল্প করতে গিয়ে যাদুকাটা দিয়ে এই মাইগ্রেশনকে মাছের স্পাউনিং গ্রাউন্ডের দিকে যাত্রা বলে অভিহিত করেছেন।
১৯৯৪ সালে ভোটের আশায় জেলেদের জন্য নদীগুলো উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। মাছের মাইগ্রেটরি রোড এবং স্পাউনিং গ্রাউন্ড মারাত্মক হুমকির মধ্যে পড়ে। টাঙ্গুয়ার হাওরের মাছ কৃত্রিম প্রতিবন্ধকতায় প্রকৃতির কোলে বন্দি হয়ে পড়ে। সরকার এর পাহারার খরচ বহন করার বাইরে আর কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছে কি-না এ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন আছে। এরা সবাই পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধীনে টিএইচএসসির নেতৃত্বে কাজ করছে। পুলিশ এবং ম্যাজিস্ট্রেট টাঙ্গুয়ার হাওরের সম্পদ পাহারা দিচ্ছে।
সিএনআরএস প্রতিটি গ্রামে কমিউনিটি গ্রুপ তৈরি করছে 'টাঙ্গুয়ার হাওর টেকসই ব্যবস্থাপনা' কমিটি নাম দিয়ে। টাঙ্গুয়ার হাওরে ৪৬টি গ্রামে প্রায় ৪০ হাজার লোক বাস করে। এদের ৭৮ শতাংশ জীবনধারণ করে মাছ ধরে। বর্তমানে সিএইচটিএম গঠন করার ফলে এ এলাকার মৎস্যজীবী জনগণের মাত্র ৩০ শতাংশ টাঙ্গুয়ার কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ফলে জনগণের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে, যার কারণে সমাজভিত্তিক ব্যবস্থাপনা সংকটে পড়তে পারে।
ব্যবস্থাপনার প্রধান দুর্বলতা হলো সামাজিক মালিকানার ধরন। কেউই প্রকৃত অর্থে টাঙ্গুয়ার হাওরের জন্য একান্তভাবে কাজ করতে পারে না। কারও ব্যক্তিস্বার্থ জড়িত না থাকার কারণে সম্পদ রক্ষার্থে পদক্ষেপ নেয় না। দুর্নীতির সুযোগ বেড়ে যায়। এ জন্য ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারী নিয়োগ অত্যন্ত জরুরি। অনেকে মনে করেন টাঙ্গুয়ার হাওর রামসার সাইট, আন্তর্জাতিক বিষয়। এটা নিয়ে কথা বলা যাবে না। কিন্তু যারা রামসার কনভেনশনের চুক্তি পড়েছেন তারা জানেন, রামসার সাইট ব্যবস্থাপনার বিষয় নিয়ে কোনো চুক্তি হয়নি। এটা জাতীয় বিষয়।
বিনিয়োগকারীর কার্য পরিধি : বাণিজ্যিক মৎস্য উৎপাদনের সব খরচ বিনিয়োগকারী করবেন; কারিগরি প্রস্তাব তৈরি ও বাস্তবায়ন; মৎস্য উৎপাদনের বৃদ্ধির জন্য কাঁঠ, বাঁশের ব্যবস্থা; বনায়ন; পাখির অভয়ারণ্য তৈরি; রামসার চুক্তির আলোকে পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষা।
বিকল্প প্রস্তাবনা :সরকারকে সম্প্রদায়ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা ধারণা থেকে সরে আসতে হবে। টাঙ্গুয়ার হাওরের বর্তমান অবস্থায় এই ধারণা বাস্তবতাবর্জিত ও অবৈজ্ঞানিক। প্রকল্পটি পরিবেশ ও উৎপাদন সম্পৃক্ত হতে হবে। প্রকল্পটি পিপিপির ধারণায় বিকশিত করলেই কেবল বর্তমান হাওরের পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষা করা সম্ভব। এছাড়াও সরকারি তত্ত্বাবধানে পরিবেশসম্মত একটি অমৎড় নধংবফ রহফঁংঃৎরধষ তড়হব গড়ে তোলা যায়।
এতে ৫০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান সম্ভব। প্রাথমিকভাবে বিনিয়োগকারী পদ্ধতিতে এগোনো যায়। পরে অমৎড় নধংবফ রহফঁংঃৎরধষ তড়হব গড়ে তোলা এবং এর প্রসার ঘটানো। এনজিও অর্থায়নের বিপরীতে পিপিপির অধীনে অর্থায়ন করা। টাঙ্গুয়ার হাওরে একজন কো-পার্টনার অথবা ইনভেস্টর নিয়োগ করা। যার বিপুল ইনভেস্টমেন্ট সামর্থ্য ও ওয়েটল্যান্ড ম্যানেজমেন্টের প্রচুর অভিজ্ঞতা আছে।
বর্তমান ব্যবস্থাপনার মধ্যেই একজন কো-পার্টনার নিয়োগ সম্ভব। সম্প্রদায়ের স্থলে ব্যক্তি অথবা প্রতিষ্ঠানকে কো-পার্টনার (বিনিয়োগকারী) করলেই বর্তমান সংকট মিটে যায়।
নজির হোসেন : সাবেক এমপি
No comments