বিরোধী দল বধের বটিকা by মিজানুর রহমান খান
আপনি আচরি ধর্ম পরকে শিখাও। আমরা সবাই জানি, দুই বড় দল পরস্পরকে ধাক্কা মারার তালে থাকে। যে যখন পারে ধাক্কা মারে। আজকে একটি উপযুক্ত পাঠের কথা বলব। রোগ হলে ওষুধ চাই। এটা তেমন এক ওষুধ। একটু তেতো। তবে নিশ্চিত উপশম মিলবে। আওয়ামী লীগ ধাক্কা মারতে পারবে। বিএনপিও ধাক্কা মারতে পারবে। উভয় দল যখন সমান বেগে ধাক্কা মারবে, তখন গণতন্ত্র পোক্ত হবে। আজ যেটা বলব সেটা হলো, জনগণ একটা মস্ত ফাঁকিতে আছে। সংসদ ফাঁকি দেয়। সুপ্রিম কোর্টও এক রকম ফাঁকি দিয়ে বসে আছেন। আসুন আগে রোগটা শনাক্ত করি।
সংসদ বয়কট একটি রোগ। এটা ক্যানসারে পরিণত হয়েছে। বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়া ও তাঁর দল সংসদে যাচ্ছে। আসন রক্ষার জন্য। কারণ সংবিধানের ৬৭(১) খ অনুচ্ছেদে বলা আছে, সংসদের অনুমতি না নিয়ে কেউ যদি একাদিক্রমে নব্বই বৈঠক দিবস (সিটিং ডে) অনুপস্থিত থাকেন, তাহলে তাঁর সংসদের আসন শূন্য হবে। বিশ্বব্যাপী সংসদে প্রতিবাদের ভাষা ওয়াকআউট। বয়কটও বিরল নয়। তবে আমাদের মতো ১৬ মাস ধরে সবেতন সংসদ বয়কটের নজির আর কেউ গড়তে পারেনি।
সংবিধান উপস্থিতি অনুমান করেছে। অনুমতিহীন অনুপস্থিতি সংবিধান নিরুৎসাহিত করেছে। ওয়াকঅউট বা বয়কট সংবিধানে লেখা নেই। সংসদে ‘অনুপস্থিতি’ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দুটি রায় এ প্রসঙ্গে আমরা আলোচনা করতে পারি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনে দীর্ঘতম সংসদ বয়কট চলে। আওয়ামী লীগ, জাপা ও জামায়াত সংসদ থেকে গণপদত্যাগ করে। এরপর ১৯৯৫ সালের ২৪ জুলাই রাষ্ট্রপতি রেফারেন্স পাঠান সুপ্রিম কোর্টে। সেই থেকে আমরা গুনতে শিখলাম, কী করে ৯০ দিন হয়। সুপ্রিম কোর্টের সেই রায় সেদিন আওয়ামী লীগ, জাপা ও জামায়াতের পছন্দ হয়েছিল। শাসক বিএনপির হয়নি।
প্রধান বিচারপতি এ টি এম আফজাল, বিচারপতি মোস্তাফা কামাল, বিচারপতি লতিফুর রহমান, বিচারপতি মোহাম্মদ আব্দুর রউফ ও বিচারপতি মোহাম্মদ ইসমাইল উদ্দিন সরকারের সমন্বয়ে গঠিত আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ একাদিক্রমে ৯০ কার্যদিবস কীভাবে গণনা হবে, সেটা শিখিয়ে দিয়েছিলেন। খালেদা জিয়ার দল সংসদে আসছে। কারণ তারা ৯০ দিনের ফাঁদে পড়ছে। আপিল বিভাগের ওই রায় পড়ে মনে হলো, এটাই তো বিরোধী দলের চিরকালীন ব্রহ্মাস্ত্র। আপিল বিভাগের বাতলে দেওয়া ফর্মুলা পড়ে আমি তো হতবাক। হতে পারে সেটাই আইনের অমোঘ গন্তব্য। কিন্তু তাতে সংসদের লালবাতি যে জ্বলবেই, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিরোধী দল এক্কা-দোক্কা খেলবে। এক দিনের জন্য যাবে। বেরিয়ে আসবে। ৯০ কার্যদিবস গুনতে বসবে। এক দিন ফের উদয় হবে। বেতন-ভাতা তুলতে থাকবে। সুপ্রিম কোর্টের ওই অভিমত তাঁদের বর্ম। বিরোধী দলের এহেন শত অনাচারেও সংবিধানের ইজ্জত যাবে না।
রাষ্ট্রপতির রেফারেন্সের প্রথম প্রশ্ন ছিল, ওয়াকআউট তো করল। এরপর অনুমতি নিল না। পলাতক হলো। অকস্মাৎ উদয় হলো। এই অন্তর্বর্তী সময় ‘অনুপস্থিতি’ হিসেবে গণ্য হবে কি না। দ্বিতীয়ত, বয়কটকে সংবিধান বর্ণিত অনুপস্থিতির মধ্যে ফেলা যাবে কি না। তৃতীয়ত, ৯০ দিন গণনা কীভাবে হবে। সংসদের দুই অধিবেশনের মধ্যে যে সময়টা সংসদ বৈঠকে থাকে না, সেই সময় ৯০ দিন থেকে বাদ যাবে কি না। চতুর্থত, স্পিকার অনুপস্থিতির সময় গণনা এবং তা নির্ধারণ করবেন কি না। আপিল বিভাগে সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ ও ড. কামাল হোসেন যুক্তি দিয়েছিলেন যে এসবের উত্তর সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া ঠিক হবে না। আদালত তাঁদের সঙ্গে একমত হননি। সেটা মনে হয় ঠিক ছিল। আদালত প্রথম ও দ্বিতীয় প্রশ্নের ইতিবাচক জবাব দেন। তৃতীয় প্রশ্নের জবাব ছিল ৯০ দিন গণনায় দুই অধিবেশনের মধ্যবর্তী সময় বাদ যাবে। গণনায় আসবে না। আর চতুর্থ প্রশ্নের জবাব ছিল, স্পিকারই অনুপস্থিতির সময় নির্ধারণ ও গণনা করবেন।
১৬ বছর পর আজ স্মরণ করছি যে এই রায় আমাদের কী উপকার করেছিল। উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি হয়েছে। যদি দুই অধিবেশনের মধ্যবর্তী সময়কে গণনায় নেওয়া যেত, তাহলে বিরোধী দল সংসদকে এত বেশি অকেজো করতে পারত না।
বিচারপতি মোস্তাফা কামাল দেখিয়েছিলেন, কয়েকটি দেশে অনুমতিবিহীন অনুপস্থিতির জন্য আসন শূন্য ঘোষণার সিদ্ধান্ত সংসদই নিতে পারে। ভারতের ১০১(৪) অনুচ্ছেদ, মালয়েশিয়ার (অনুচ্ছেদ ৫২), পাকিস্তানের সংবিধানে (অনুচ্ছেদ ৬২) ও ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ৬৮ ধারা এ কথাই বলেছে। তিনি পার্থক্য দেখান যে বাংলাদেশের সংবিধান কিন্তু কোনো সাংসদের আসন শূন্য ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত সংসদের হাতে ন্যস্ত করেনি। বাংলাদেশই শুধু নয়, শ্রীলঙ্কা (অনুচ্ছেদ ৬৬), নেপাল (অনুচ্ছেদ ৩৮) ও সিঙ্গাপুর (অনুচ্ছেদ ৪৬) সংসদকে কোনো আসন শূন্য ঘোষণার ক্ষমতা দেয়নি। আমাদের সংবিধানের ৬৭(১)(খ) অনুচ্ছেদে একটি অটোমেশন ধারা আছে। সংসদ সচিবের একমাত্র দায়িত্ব হলো সংসদ সদস্যদের জন্য একটি হাজিরা বই সংরক্ষণ করা। আর স্পিকারের সীমিত দায়িত্ব হচ্ছে কোনো আসন শূন্য হলে তা সংসদের নজরে আনা।
এখানে স্মরণে রাখা দরকার যে আসন শূন্য হওয়া বা তাঁর ঘোষণা দেওয়া নিয়ে আইনগত অস্পষ্টতা রয়েছে। এ নিয়ে সাম্প্রতিক কালেও নির্বাচন কমিশন ও জাতীয় সংসদের স্পিকারের মধ্যে চিঠি চালাচালি হয়েছে। এসব দেখেশুনে আমাদের স্থির বিশ্বাস জন্মেছে, এসব বিষয়ে সংবিধান সংশোধনের দরকার থাকতে পারে। বিশেষ কমিটি তা যাচাই করতে পারে।
রাষ্ট্রপতির ওই রেফারেন্সের শুনানিতে এস আর পাল, আসরারুল হোসেন, টি এইচ খান গণমুখী যুক্তি দিয়েছিলেন। ওয়াকআউট কিংবা বয়কট যখন গণ-অনুপস্থিতিতে রূপ নেয়, তখন ওয়াকআউট আর ওয়াকআউট থাকে না। পায়ে হাঁটা আর ঝেড়ে দৌড়ানো এক নয়। তা ছাড়া সংবিধান কোনোক্রমেই প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে প্রলম্বিত ওয়াকআউট বা বয়কট যে নামেই ডাকা হোক না কেন, এমন কিছু কল্পনা করেনি।
১৬ মাস ধরে বিরোধী দল সংসদে ছিল না। টি এইচ খান যুক্তি দিয়েছিলেন যে ওই সময়ে তাঁরা সংসদে উপস্থিত আছেন বলে ধরে না নিলে সংসদ আর সংসদ থাকে না। এটাকে অবশ্য আদালত ঠিকই দুর্বল যুক্তি বলেছিলেন।
আপিল বিভাগের যুক্তি ছিল, সব লিখিত সংবিধানে সংবিধান প্রণেতারা সংসদ থেকে সদস্যদের ‘অনুপস্থিতি’ কল্পনা করেছেন। বয়কটের কারণ যতই অসংসদীয় হোক না কেন, অনুপস্থিতির একটা সীমা বাঁধা হয়েছে। এর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে উপনির্বাচনের বিধান, যাতে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় থাকতে পারে। তবে বিচারপতি মোস্তাফা কামাল একটি বিষয় চিহ্নিত করেন। বিশ্বের অন্যান্য কিছু সংবিধানের সংশ্লিষ্ট বিধানাবলী পর্যালোচনান্তে দেখা যায়, আমাদের সংবিধানই দীর্ঘতম মেয়াদে স্পিকারের বিনা অনুমতিতে অনুপস্থিত থাকার সুযোগ করে দিয়েছে। এটা কিন্তু সংসদের বিশেষ কমিটি বিবেচনায় নিতে পারে। ৯০ দিনের বিধান পাল্টাতে হবে। এর মেয়াদ কমাতে হবে।
আপিল বিভাগের ব্যাখ্যায় আমাদের বয়কটাসক্ত বিরোধী দল উল্লসিত হয়। কারণ তারা বলেন, অনুপস্থিতি শব্দটি বিভিন্ন ধরনের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন ব্যাখ্যা পেতে পারে না। তাহলে সাংবিধানিক বিধানাবলীতে অনিশ্চয়তার উপাদান যুক্ত হবে। যদি আমরা রেফারেন্সে বর্ণিত অনুপস্থিতি মেনে নিই, তাহলে আমরা দুই ধরনের অনুপস্থিতি দেখতে পাব। প্রথমটি সংবিধানে বলা আছে, দ্বিতীয়টি সংবিধানে বলা নেই। আর তা হলে সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত হয়। তাই আমরা দুই ধরনের সংসদীয় অনুপস্থিতি অনুমোদন দিতে পারি না।
ওই রেফারেন্স যখন হয়, তখন ‘অনুপস্থিতি’ বিষয়ক একটি মাইলফলক রায় কিন্তু আপিল বিভাগে বিচারাধীন ছিল। ১৯৯৪ সালের ১১ ডিসেম্বর বিচারপতি কাজী শফিউদ্দীন ও বিচারপতি কাজী এ টি মনোয়ার উদ্দীনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ওই রায় দেন। সংসদ বয়কটরত আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতকে সংসদে ফেরাতে ওই বেঞ্চে রিট হয়েছিল। এখন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও সংসদ নেত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলকে সংসদে ফিরতে বলছেন। ওই সময় বিরোধী দলের নেতা ছিলেন তিনি। আদালতে তাঁর যুক্তি ছিল ‘যদি আবেদনকারীকে প্রতিকার দেওয়া হয়, তাহলে সেটা নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগের মধ্যকার ক্ষমতার বণ্টন নীতি ধ্বংসের শামিল হবে। বাংলাদেশের লিখিত সংবিধানের ভিত্তিটাই ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।’ এর অর্থ হলো, সাংসদেরা সংসদকে দোলনা বানাবে, তাতে আদালতের কী! সংসদের বিষয় সংসদ বুঝবে।
১৯৯৪ সালের ওই মামলাতেও আমরা দেখি অনুপস্থিতি ও বয়কটের মধ্যে পার্থক্য দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। প্রতিকার চাওয়া হয়েছে যে সংবিধান সাংসদদের প্রতিবাদের ভাষা ঠিক করে দিয়েছে। তারা ওয়াকআউট করবেন, সাময়িক বয়কট করবেন কিন্তু একাদিক্রমে ৯০ কার্যদিবস অনুপস্থিতির ফায়দা নেবেন না। হাইকোর্ট বলেছেন, সংসদের অনুমতি না নিয়ে অনুপস্থিত থাকা সাংসদদের বিশেষ অধিকার বলে গণ্য হতে পারে না। সরকারি দলের পক্ষে এই যুক্তি ছিল যে ‘স্পিকারের অনুমতি না নিয়ে একাদিক্রমে ৯০ কার্যদিবস অনুপস্থিত থাকা সম্ভব নয় কিংবা বাস্তবসম্মত নয়। যদি বৈঠক কথাটি বিলোপ করা না হয়, তাহলে সংবিধান প্রণেতাদের লক্ষ্য ব্যাহত হবে। তাই সংবিধানের ৬৭ (১)খ থেকে বৈঠক বা সিটিং কথাটি তুলে দিতে হবে। হাইকোর্ট আদেশ দিয়েছিলেন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সংসদ থেকে অব্যাহত অনুপস্থিতি অবৈধ, অসাংবিধানিক ও বাতিল। বয়কটরতদের সংসদে উপস্থিত হওয়া প্রয়োজন। তাঁদের সংসদে যোগ দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এর আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল, বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা ১ মার্চ ১৯৯৪ থেকে পরবর্তী ২৫০ দিন অনুপস্থিত থাকেন। এই সময়ের যে বেতন-ভাতা ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধা নেন, তা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত।
গোড়াতে বলেছিলাম, রোগের ওষুধ আছে। তবে তেতো বটিকা। হাইকোর্টের ওই রায় আমরা সমর্থন করি। আজকে আওয়ামী লীগেরও ওই রায় ভালো লাগবে। না, কথাটি ঠিক হলো না। এই রায় সেদিনের সরকারি দলের ভালো লেগেছিল। আজকের সরকারি দলেরও লাগবে। সেদিন রায়দানকারী এক বিচারকের বাসায় বোমা পড়েছিল। এই রায়কে বিরোধী দল ও তার মিত্ররা উপহাস করেছিল। আজ সরকারি দল ওই রায় মানতে পারে। এর বিরুদ্ধে আপিল এখনো পেন্ডিং রয়েছে। সেটি তুলে নেওয়া সহজ। সেদিনের পলাতক বিরোধী দল গরিব জনগণের ট্যাক্সের টাকা ফেরত দিক। তাহলে বেগম খালেদা জিয়ার দলটির কাছ থেকেও আমরা টাকা ফেরত পেতে পারি!
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
সংসদ বয়কট একটি রোগ। এটা ক্যানসারে পরিণত হয়েছে। বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়া ও তাঁর দল সংসদে যাচ্ছে। আসন রক্ষার জন্য। কারণ সংবিধানের ৬৭(১) খ অনুচ্ছেদে বলা আছে, সংসদের অনুমতি না নিয়ে কেউ যদি একাদিক্রমে নব্বই বৈঠক দিবস (সিটিং ডে) অনুপস্থিত থাকেন, তাহলে তাঁর সংসদের আসন শূন্য হবে। বিশ্বব্যাপী সংসদে প্রতিবাদের ভাষা ওয়াকআউট। বয়কটও বিরল নয়। তবে আমাদের মতো ১৬ মাস ধরে সবেতন সংসদ বয়কটের নজির আর কেউ গড়তে পারেনি।
সংবিধান উপস্থিতি অনুমান করেছে। অনুমতিহীন অনুপস্থিতি সংবিধান নিরুৎসাহিত করেছে। ওয়াকঅউট বা বয়কট সংবিধানে লেখা নেই। সংসদে ‘অনুপস্থিতি’ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দুটি রায় এ প্রসঙ্গে আমরা আলোচনা করতে পারি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনে দীর্ঘতম সংসদ বয়কট চলে। আওয়ামী লীগ, জাপা ও জামায়াত সংসদ থেকে গণপদত্যাগ করে। এরপর ১৯৯৫ সালের ২৪ জুলাই রাষ্ট্রপতি রেফারেন্স পাঠান সুপ্রিম কোর্টে। সেই থেকে আমরা গুনতে শিখলাম, কী করে ৯০ দিন হয়। সুপ্রিম কোর্টের সেই রায় সেদিন আওয়ামী লীগ, জাপা ও জামায়াতের পছন্দ হয়েছিল। শাসক বিএনপির হয়নি।
প্রধান বিচারপতি এ টি এম আফজাল, বিচারপতি মোস্তাফা কামাল, বিচারপতি লতিফুর রহমান, বিচারপতি মোহাম্মদ আব্দুর রউফ ও বিচারপতি মোহাম্মদ ইসমাইল উদ্দিন সরকারের সমন্বয়ে গঠিত আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ একাদিক্রমে ৯০ কার্যদিবস কীভাবে গণনা হবে, সেটা শিখিয়ে দিয়েছিলেন। খালেদা জিয়ার দল সংসদে আসছে। কারণ তারা ৯০ দিনের ফাঁদে পড়ছে। আপিল বিভাগের ওই রায় পড়ে মনে হলো, এটাই তো বিরোধী দলের চিরকালীন ব্রহ্মাস্ত্র। আপিল বিভাগের বাতলে দেওয়া ফর্মুলা পড়ে আমি তো হতবাক। হতে পারে সেটাই আইনের অমোঘ গন্তব্য। কিন্তু তাতে সংসদের লালবাতি যে জ্বলবেই, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিরোধী দল এক্কা-দোক্কা খেলবে। এক দিনের জন্য যাবে। বেরিয়ে আসবে। ৯০ কার্যদিবস গুনতে বসবে। এক দিন ফের উদয় হবে। বেতন-ভাতা তুলতে থাকবে। সুপ্রিম কোর্টের ওই অভিমত তাঁদের বর্ম। বিরোধী দলের এহেন শত অনাচারেও সংবিধানের ইজ্জত যাবে না।
রাষ্ট্রপতির রেফারেন্সের প্রথম প্রশ্ন ছিল, ওয়াকআউট তো করল। এরপর অনুমতি নিল না। পলাতক হলো। অকস্মাৎ উদয় হলো। এই অন্তর্বর্তী সময় ‘অনুপস্থিতি’ হিসেবে গণ্য হবে কি না। দ্বিতীয়ত, বয়কটকে সংবিধান বর্ণিত অনুপস্থিতির মধ্যে ফেলা যাবে কি না। তৃতীয়ত, ৯০ দিন গণনা কীভাবে হবে। সংসদের দুই অধিবেশনের মধ্যে যে সময়টা সংসদ বৈঠকে থাকে না, সেই সময় ৯০ দিন থেকে বাদ যাবে কি না। চতুর্থত, স্পিকার অনুপস্থিতির সময় গণনা এবং তা নির্ধারণ করবেন কি না। আপিল বিভাগে সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ ও ড. কামাল হোসেন যুক্তি দিয়েছিলেন যে এসবের উত্তর সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া ঠিক হবে না। আদালত তাঁদের সঙ্গে একমত হননি। সেটা মনে হয় ঠিক ছিল। আদালত প্রথম ও দ্বিতীয় প্রশ্নের ইতিবাচক জবাব দেন। তৃতীয় প্রশ্নের জবাব ছিল ৯০ দিন গণনায় দুই অধিবেশনের মধ্যবর্তী সময় বাদ যাবে। গণনায় আসবে না। আর চতুর্থ প্রশ্নের জবাব ছিল, স্পিকারই অনুপস্থিতির সময় নির্ধারণ ও গণনা করবেন।
১৬ বছর পর আজ স্মরণ করছি যে এই রায় আমাদের কী উপকার করেছিল। উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি হয়েছে। যদি দুই অধিবেশনের মধ্যবর্তী সময়কে গণনায় নেওয়া যেত, তাহলে বিরোধী দল সংসদকে এত বেশি অকেজো করতে পারত না।
বিচারপতি মোস্তাফা কামাল দেখিয়েছিলেন, কয়েকটি দেশে অনুমতিবিহীন অনুপস্থিতির জন্য আসন শূন্য ঘোষণার সিদ্ধান্ত সংসদই নিতে পারে। ভারতের ১০১(৪) অনুচ্ছেদ, মালয়েশিয়ার (অনুচ্ছেদ ৫২), পাকিস্তানের সংবিধানে (অনুচ্ছেদ ৬২) ও ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ৬৮ ধারা এ কথাই বলেছে। তিনি পার্থক্য দেখান যে বাংলাদেশের সংবিধান কিন্তু কোনো সাংসদের আসন শূন্য ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত সংসদের হাতে ন্যস্ত করেনি। বাংলাদেশই শুধু নয়, শ্রীলঙ্কা (অনুচ্ছেদ ৬৬), নেপাল (অনুচ্ছেদ ৩৮) ও সিঙ্গাপুর (অনুচ্ছেদ ৪৬) সংসদকে কোনো আসন শূন্য ঘোষণার ক্ষমতা দেয়নি। আমাদের সংবিধানের ৬৭(১)(খ) অনুচ্ছেদে একটি অটোমেশন ধারা আছে। সংসদ সচিবের একমাত্র দায়িত্ব হলো সংসদ সদস্যদের জন্য একটি হাজিরা বই সংরক্ষণ করা। আর স্পিকারের সীমিত দায়িত্ব হচ্ছে কোনো আসন শূন্য হলে তা সংসদের নজরে আনা।
এখানে স্মরণে রাখা দরকার যে আসন শূন্য হওয়া বা তাঁর ঘোষণা দেওয়া নিয়ে আইনগত অস্পষ্টতা রয়েছে। এ নিয়ে সাম্প্রতিক কালেও নির্বাচন কমিশন ও জাতীয় সংসদের স্পিকারের মধ্যে চিঠি চালাচালি হয়েছে। এসব দেখেশুনে আমাদের স্থির বিশ্বাস জন্মেছে, এসব বিষয়ে সংবিধান সংশোধনের দরকার থাকতে পারে। বিশেষ কমিটি তা যাচাই করতে পারে।
রাষ্ট্রপতির ওই রেফারেন্সের শুনানিতে এস আর পাল, আসরারুল হোসেন, টি এইচ খান গণমুখী যুক্তি দিয়েছিলেন। ওয়াকআউট কিংবা বয়কট যখন গণ-অনুপস্থিতিতে রূপ নেয়, তখন ওয়াকআউট আর ওয়াকআউট থাকে না। পায়ে হাঁটা আর ঝেড়ে দৌড়ানো এক নয়। তা ছাড়া সংবিধান কোনোক্রমেই প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে প্রলম্বিত ওয়াকআউট বা বয়কট যে নামেই ডাকা হোক না কেন, এমন কিছু কল্পনা করেনি।
১৬ মাস ধরে বিরোধী দল সংসদে ছিল না। টি এইচ খান যুক্তি দিয়েছিলেন যে ওই সময়ে তাঁরা সংসদে উপস্থিত আছেন বলে ধরে না নিলে সংসদ আর সংসদ থাকে না। এটাকে অবশ্য আদালত ঠিকই দুর্বল যুক্তি বলেছিলেন।
আপিল বিভাগের যুক্তি ছিল, সব লিখিত সংবিধানে সংবিধান প্রণেতারা সংসদ থেকে সদস্যদের ‘অনুপস্থিতি’ কল্পনা করেছেন। বয়কটের কারণ যতই অসংসদীয় হোক না কেন, অনুপস্থিতির একটা সীমা বাঁধা হয়েছে। এর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে উপনির্বাচনের বিধান, যাতে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় থাকতে পারে। তবে বিচারপতি মোস্তাফা কামাল একটি বিষয় চিহ্নিত করেন। বিশ্বের অন্যান্য কিছু সংবিধানের সংশ্লিষ্ট বিধানাবলী পর্যালোচনান্তে দেখা যায়, আমাদের সংবিধানই দীর্ঘতম মেয়াদে স্পিকারের বিনা অনুমতিতে অনুপস্থিত থাকার সুযোগ করে দিয়েছে। এটা কিন্তু সংসদের বিশেষ কমিটি বিবেচনায় নিতে পারে। ৯০ দিনের বিধান পাল্টাতে হবে। এর মেয়াদ কমাতে হবে।
আপিল বিভাগের ব্যাখ্যায় আমাদের বয়কটাসক্ত বিরোধী দল উল্লসিত হয়। কারণ তারা বলেন, অনুপস্থিতি শব্দটি বিভিন্ন ধরনের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন ব্যাখ্যা পেতে পারে না। তাহলে সাংবিধানিক বিধানাবলীতে অনিশ্চয়তার উপাদান যুক্ত হবে। যদি আমরা রেফারেন্সে বর্ণিত অনুপস্থিতি মেনে নিই, তাহলে আমরা দুই ধরনের অনুপস্থিতি দেখতে পাব। প্রথমটি সংবিধানে বলা আছে, দ্বিতীয়টি সংবিধানে বলা নেই। আর তা হলে সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত হয়। তাই আমরা দুই ধরনের সংসদীয় অনুপস্থিতি অনুমোদন দিতে পারি না।
ওই রেফারেন্স যখন হয়, তখন ‘অনুপস্থিতি’ বিষয়ক একটি মাইলফলক রায় কিন্তু আপিল বিভাগে বিচারাধীন ছিল। ১৯৯৪ সালের ১১ ডিসেম্বর বিচারপতি কাজী শফিউদ্দীন ও বিচারপতি কাজী এ টি মনোয়ার উদ্দীনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ওই রায় দেন। সংসদ বয়কটরত আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতকে সংসদে ফেরাতে ওই বেঞ্চে রিট হয়েছিল। এখন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও সংসদ নেত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলকে সংসদে ফিরতে বলছেন। ওই সময় বিরোধী দলের নেতা ছিলেন তিনি। আদালতে তাঁর যুক্তি ছিল ‘যদি আবেদনকারীকে প্রতিকার দেওয়া হয়, তাহলে সেটা নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগের মধ্যকার ক্ষমতার বণ্টন নীতি ধ্বংসের শামিল হবে। বাংলাদেশের লিখিত সংবিধানের ভিত্তিটাই ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।’ এর অর্থ হলো, সাংসদেরা সংসদকে দোলনা বানাবে, তাতে আদালতের কী! সংসদের বিষয় সংসদ বুঝবে।
১৯৯৪ সালের ওই মামলাতেও আমরা দেখি অনুপস্থিতি ও বয়কটের মধ্যে পার্থক্য দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। প্রতিকার চাওয়া হয়েছে যে সংবিধান সাংসদদের প্রতিবাদের ভাষা ঠিক করে দিয়েছে। তারা ওয়াকআউট করবেন, সাময়িক বয়কট করবেন কিন্তু একাদিক্রমে ৯০ কার্যদিবস অনুপস্থিতির ফায়দা নেবেন না। হাইকোর্ট বলেছেন, সংসদের অনুমতি না নিয়ে অনুপস্থিত থাকা সাংসদদের বিশেষ অধিকার বলে গণ্য হতে পারে না। সরকারি দলের পক্ষে এই যুক্তি ছিল যে ‘স্পিকারের অনুমতি না নিয়ে একাদিক্রমে ৯০ কার্যদিবস অনুপস্থিত থাকা সম্ভব নয় কিংবা বাস্তবসম্মত নয়। যদি বৈঠক কথাটি বিলোপ করা না হয়, তাহলে সংবিধান প্রণেতাদের লক্ষ্য ব্যাহত হবে। তাই সংবিধানের ৬৭ (১)খ থেকে বৈঠক বা সিটিং কথাটি তুলে দিতে হবে। হাইকোর্ট আদেশ দিয়েছিলেন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সংসদ থেকে অব্যাহত অনুপস্থিতি অবৈধ, অসাংবিধানিক ও বাতিল। বয়কটরতদের সংসদে উপস্থিত হওয়া প্রয়োজন। তাঁদের সংসদে যোগ দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এর আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল, বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা ১ মার্চ ১৯৯৪ থেকে পরবর্তী ২৫০ দিন অনুপস্থিত থাকেন। এই সময়ের যে বেতন-ভাতা ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধা নেন, তা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত।
গোড়াতে বলেছিলাম, রোগের ওষুধ আছে। তবে তেতো বটিকা। হাইকোর্টের ওই রায় আমরা সমর্থন করি। আজকে আওয়ামী লীগেরও ওই রায় ভালো লাগবে। না, কথাটি ঠিক হলো না। এই রায় সেদিনের সরকারি দলের ভালো লেগেছিল। আজকের সরকারি দলেরও লাগবে। সেদিন রায়দানকারী এক বিচারকের বাসায় বোমা পড়েছিল। এই রায়কে বিরোধী দল ও তার মিত্ররা উপহাস করেছিল। আজ সরকারি দল ওই রায় মানতে পারে। এর বিরুদ্ধে আপিল এখনো পেন্ডিং রয়েছে। সেটি তুলে নেওয়া সহজ। সেদিনের পলাতক বিরোধী দল গরিব জনগণের ট্যাক্সের টাকা ফেরত দিক। তাহলে বেগম খালেদা জিয়ার দলটির কাছ থেকেও আমরা টাকা ফেরত পেতে পারি!
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments