সেনাবাহিনী আছে, দেশ নেই by আহমেদ রশিদ
পাকিস্তানে জঙ্গিবাদী দ্বারা সংগঠিত রাজনৈতিক সহিংসতার লজ্জাকর নজিরগুলোর অন্যতম সংখ্যালঘুবিষয়ক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শাহবাজ ভাট্টির সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড। প্রকাশ্য দিবালোকে তাঁকে গুলি করে মেরে ফেলল চার অস্ত্রধারী। পাঞ্জাবের গভর্নর ও পাকিস্তানের উদারপন্থী কণ্ঠস্বর সালমান তাসির নিহত হওয়ার মাত্র দুই মাস পর ঘটল মর্মান্তিক এ ঘটনা। উভয় হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে সরকার ও রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া আরও লজ্জাজনক। এতে আশঙ্কা জাগে, এ অঞ্চলে পশ্চিমা নীতির বিরোধিতা করতে গিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীগুলো এখনো জঙ্গিবাদকে ব্যবহার করে চলেছে।
শাহবাজ ভাট্টি রোমান ক্যাথলিক। তাঁর বয়স হয়েছিল ৪০ বছর। প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির মন্ত্রিসভায় একমাত্র খ্রিষ্টান সদস্য তিনি। তাঁর এমন মৃত্যু আগেই আঁচ করা গিয়েছিল। সালমান তাসিরকে মেরে ফেলা হয় পাকিস্তানের ব্লাসফেমি আইন সংশোধনে তাঁর লড়াইয়ে সাহসী ভূমিকার কারণে। সংখ্যালঘুদের শায়েস্তা করার কাজে ব্যবহূত হতো সেই আইন। ব্লাসফেমি আইন সংশোধনের লড়াইয়ে শাহবাজও ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। কয়েক মাস আগে শাহবাজ একটি ভিডিও টেপ ধারণ করেন। উদ্দেশ্য, তাঁকে মেরে ফেলা হলে সেই টেপটি যেন বিবিসিকে পৌঁছে দেওয়া হয়। সেই টেপে ব্লাসফেমি আইন সংশোধনের প্রচারাভিযান অব্যাহত রাখতে তাঁর অঙ্গীকারের কথা বলেন, ‘আমার জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষার প্রশ্নে আদর্শের সঙ্গে আপসের চেয়ে আমি বরং মৃত্যুই বেছে নেব।’ তিনি আরও বলেন, ‘সহিংস গোষ্ঠী, জঙ্গিবাদী, নিষিদ্ধ সংগঠন, তালেবান ও আল-কায়েদা পাকিস্তানের ওপর তাদের কট্টরপন্থী দর্শন চাপিয়ে দিতে চায়। যে মানুষই এর বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, তাকেই তারা ভয় দেখায়।’
শাহবাজ জানতেন, তাঁর জীবনও ঝুঁকির মুখে। ইদানীং তাঁকে বারবার হুমকিও দেওয়া হচ্ছিল। সরকারের কাছে নিরাপত্তা আর বুলেটরোধী গাড়ি চেয়ে আবেদনও করেছিলেন। কিন্তু তাসিরের হত্যাকাণ্ডের পরও সরকার কিছু করল না। তাসিরের মতোই মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে তাঁরও মৃত্যু হলো। অবশ্য ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাড়ালে কোনো উপকার হতো কি না, তা স্পষ্ট নয়। তাসিরকে তো নিজের দেহরক্ষী—উচ্চপ্রশিক্ষিত এক পুলিশ কর্মকর্তাই গুলি করে মারলেন। উভয়ের খুনিরা যে সংস্কৃতির অংশ, সেটি গত কয়েক বছরে ক্রমেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে, সেখানে ষড়যন্ত্রতত্ত্বের অভাব নেই; আর জিহাদ ও বল প্রয়োগের শব্দমালা দিয়েই ইসলামকে ব্যাখ্যার অপচেষ্টা চলে।
পোপ, হিলারি ক্লিনটন কিংবা নিকোলা সারকোজির মতো বিশ্বনেতারা যখন শাহবাজ হত্যার তীব্র নিন্দা জানান, সেই মুহূর্তে পাকিস্তান সরকারের প্রতিক্রিয়া নিষ্প্রাণ। যেসব সহিংস জঙ্গিগোষ্ঠী এই দুজনের হত্যাকে স্বাগত জানিয়েছে, তাদের অবাধ কর্মকাণ্ড প্রতিহত করতে কোনো সক্রিয়তা দেখা যায়নি, কোনো প্রতিশ্রুতিও পাওয়া যায়নি। এসব জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী সিআইএর মার্কিন এজেন্ট রেমন্ড ডেভিসের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে এখন প্রতিদিন লাহোরে বিক্ষোভ করছে। দুই পাকিস্তানিকে হত্যার দায়ে রেমন্ড পাকিস্তানের হেফাজতে। নিহত দুই পাকিস্তানি সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) এজেন্ট বলে ধারণা করা হয়। (ডেভিস পাকিস্তানে সক্রিয় সিআইএর গোপন একটি দলের সদস্য হয়ে কাজ করছিলেন। তাঁর কর্মকাণ্ড প্রকাশ পেয়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের অস্বস্তিকর মিত্রতার ওপর তারও চাপ তৈরি হলো।)
শাহবাজ কিংবা তাসির হত্যা—কোনোটির ব্যাপারেই সেনাবাহিনী খেদ প্রকাশ করতে পারেনি। প্রকাশ্যে তাসির হত্যার নিন্দা জানানো, এমনকি তাঁর পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছেন সেনাপ্রধান জেনারেল আশফাক কায়ানি। জানুয়ারি মাসে ইসলামাবাদে তিনি পশ্চিমা কূটনীতিকদের বলেছেন, সেনাবাহিনীর ভেতরে বহু সেনা খুনির প্রতি সহমর্মী। খুনির সহকর্মী পুলিশ কর্মকর্তারা তাকে বীর হিসেবে অভিনন্দিত করার ছবিসংবলিত একটি খেরো খাতা তিনি কূটনীতিকদের দেখান। কায়ানি ইঙ্গিত দেন, যেকোনো প্রকাশ্য বিবৃতি সেনাবাহিনীর ঐক্যকে বিপন্ন করে তুলতে পারে।
সেনাবাহিনীর এই নীরবতার পেছনে আরও অশুভ কিছু ব্যাপার আছে। সেনাবাহিনী ও আইএসআই কয়েক দশকজুড়ে জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, আফগানিস্তান ও কাশ্মীরে প্রক্সি বাহিনী হিসেবে কাজ করার বিনিময়ে তাদের অস্ত্র সজ্জিত করা ও প্রশিক্ষণদানের কাজটিও করেছে। কিন্তু গত কয়েক বছরে সেনাবাহিনী এসব গোষ্ঠীর ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে, তারা এখন সেনাবাহিনীর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। সেনাবাহিনী ও আইএসআইয়ের ওপর জঙ্গিবাদীদের হামলা দিন দিন বেড়ে চলা সত্ত্বেও (গত পাঁচ বছরে তাদের হাতে অন্তত দুই হাজার সেনাসদস্য নিহত হয়েছেন) সেনাবাহিনী একসময়ের অনুগ্রহভাজনদের ওপর কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে যে বিপুল সম্পদ আছে, সেদিক থেকে এটা এক অশুভ লক্ষণ। ্পাকিস্তানের নিয়মিত সেনা পাঁচ লাখ। আরও পাঁচ লাখ রিজার্ভ সেনা। আছে ১১০টি পারমাণবিক অস্ত্র (মার্কিন গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী)। আর আছে দুনিয়ার অন্যতম বৃহৎ গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই, যার কর্মীসংখ্যা এক লাখ।
সেনাবাহিনীর দিক থেকে জঙ্গিবাদীদের মোকাবিলার ইচ্ছা ত্যাগ করা যদি সাম্প্রতিক ঘটনা হয়ে থাকে, তবে রাজনীতিকদের ক্ষেত্রে সেটা ঘটেছে বহু আগেই। প্রধানমন্ত্রী গিলানি ও প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) শীর্ষস্থানীয় নেতা। পিপিপি পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ জাতীয় রাজনৈতিক দল। প্রয়াত নেত্রী বেনজির ভুট্টোর স্বামী হিসেবে জারদারির কাছে জঙ্গিবাদ কোনো অচেনা বস্তু নয়। বরং যে জনগোষ্ঠী তাঁর জনপ্রিয়তার ভিত্তি, সেটি ঐতিহ্যগতভাবে মোল্লাতন্ত্রবিরোধী, সেনাশাসনের বিরোধী এবং গণমুখী নীতির পক্ষে ভোট দেয়। দুঃখজনকভাবে কিছুসংখ্যক দুর্নীতিপরায়ণ ও অযোগ্য নেতা এসব নীতি পরিত্যাগ করেছেন। আজকের পিপিসি অতীতের ছায়াও নয়।
ভারত ও আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের লক্ষ্য থেকে সরে এসেছেন জারদারি। পাশাপাশি জঙ্গিবাদীদের সামর্থ্যের সংকোচন ও নতুন করারোপের মতো অভ্যন্তরীণ কর্মসূচি থেকেও পিছু হটেছেন। পাকিস্তানের একটি আধুনিক রাষ্ট্র হয়ে ওঠার জন্য এগুলো সহায়ক হতো। প্রায় সব পালাবদলের সময় সেনাবাহিনী যে বেসামরিক নেতৃত্বকে প্রতিহত করতে সচেষ্ট থেকেছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু রাজনীতিকেরা প্রতিরোধ কিংবা পদত্যাগের পরিবর্তে শুধুই শোচনীয় আনুগত্য ও বশ্যতা স্বীকার করে গেছেন।
ফলে রাজপথে চলছে অশুভ ডাবল গেম, শাহবাজের মৃত্যুতে সৃষ্ট বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে উত্তেজনার আগুনে ঘি ঢালা হচ্ছে। নিরাপত্তা বাহিনীগুলো লাহোরের মাটিতে লেলিয়ে দিয়েছে লস্কর-ই-তাইয়্যেবাকে। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও জাতিসংঘ এই গোষ্ঠীকে নিষিদ্ধ করেছে, মনে করা হয় পাকিস্তানও একে নিষিদ্ধ করেছে। লস্কর সমর্থকেরা রেমন্ড ডেভিসের ফাঁসি নিশ্চিত করতে প্রতিদিন মার্কিন কনস্যুলেটের বাইরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে। এ ধরনের নিষিদ্ধ গোষ্ঠীকে অবাধে তৎ পরতা চালাতে দিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীগুলো হয়তো অনিচ্ছাকৃতভাবে সব জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর কাছে এই বার্তাই পাঠাচ্ছে যে, তারা নির্বিঘ্নে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারে। এই জটিল ও আতঙ্কজনক কৌশলের পেছনে কী আছে? এটা আসলে মার্কিন ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মধ্যকার বৃহৎ ইঁদুর-বিড়াল খেলারই অংশ। তালেবানের সঙ্গে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের যে শান্তি আলোচনাই হোক না কেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তা নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, যাতে কাবুলে পাকিস্তানপন্থী আফগান সরকার বসানোর পাকিস্তানি বাহিনীর বাসনা পূর্ণ হয়। সেনা নেতৃত্ব দ্বিগুণ নিশ্চিত হতে চায়, আফগানিস্তান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি কোনো আয়োজনে পাকিস্তানের প্রতিপক্ষ ভারত যেন সুবিধাজনক অবস্থানে না যেতে পারে।
এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র অবিচল রয়েছে। এরই মধ্যে তালেবানের কিছু অংশের সঙ্গে পরোক্ষ শান্তি আলোচনা শুরু করতে আইএসআইকে পাশ কাটিয়ে গেছে। ফলে যে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে ঘৃণা করে বলে বিবেচিত, তাদের রাজপথে নামতে দিচ্ছে সেনাবাহিনী। এ জন্য ডেভিসকে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে না। আর এ কারণেই পাকিস্তান-মার্কিন সম্পর্কও এখন গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সেনাবাহিনী ও সরকার প্রতিবছর প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা পেয়ে চলেছে।
আইএসআই হয়তো মার্কিনদের নিয়ে খেলছে, কিন্তু তা করতে গিয়ে ধীরে ধীরে জঙ্গিবাদীদের জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে। এই মুহূর্তে পাকিস্তান এমন এক জায়গায় পরিণত হচ্ছে, যেখানে এক সেনাবাহিনী আছে, যার দেশ নেই।
দ্য নিউইয়র্ক রিভিউ অব বুকস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
ড. আহমেদ রশিদ: পাকিস্তানি সাংবাদিক ও লেখক।
শাহবাজ ভাট্টি রোমান ক্যাথলিক। তাঁর বয়স হয়েছিল ৪০ বছর। প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির মন্ত্রিসভায় একমাত্র খ্রিষ্টান সদস্য তিনি। তাঁর এমন মৃত্যু আগেই আঁচ করা গিয়েছিল। সালমান তাসিরকে মেরে ফেলা হয় পাকিস্তানের ব্লাসফেমি আইন সংশোধনে তাঁর লড়াইয়ে সাহসী ভূমিকার কারণে। সংখ্যালঘুদের শায়েস্তা করার কাজে ব্যবহূত হতো সেই আইন। ব্লাসফেমি আইন সংশোধনের লড়াইয়ে শাহবাজও ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। কয়েক মাস আগে শাহবাজ একটি ভিডিও টেপ ধারণ করেন। উদ্দেশ্য, তাঁকে মেরে ফেলা হলে সেই টেপটি যেন বিবিসিকে পৌঁছে দেওয়া হয়। সেই টেপে ব্লাসফেমি আইন সংশোধনের প্রচারাভিযান অব্যাহত রাখতে তাঁর অঙ্গীকারের কথা বলেন, ‘আমার জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষার প্রশ্নে আদর্শের সঙ্গে আপসের চেয়ে আমি বরং মৃত্যুই বেছে নেব।’ তিনি আরও বলেন, ‘সহিংস গোষ্ঠী, জঙ্গিবাদী, নিষিদ্ধ সংগঠন, তালেবান ও আল-কায়েদা পাকিস্তানের ওপর তাদের কট্টরপন্থী দর্শন চাপিয়ে দিতে চায়। যে মানুষই এর বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, তাকেই তারা ভয় দেখায়।’
শাহবাজ জানতেন, তাঁর জীবনও ঝুঁকির মুখে। ইদানীং তাঁকে বারবার হুমকিও দেওয়া হচ্ছিল। সরকারের কাছে নিরাপত্তা আর বুলেটরোধী গাড়ি চেয়ে আবেদনও করেছিলেন। কিন্তু তাসিরের হত্যাকাণ্ডের পরও সরকার কিছু করল না। তাসিরের মতোই মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে তাঁরও মৃত্যু হলো। অবশ্য ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাড়ালে কোনো উপকার হতো কি না, তা স্পষ্ট নয়। তাসিরকে তো নিজের দেহরক্ষী—উচ্চপ্রশিক্ষিত এক পুলিশ কর্মকর্তাই গুলি করে মারলেন। উভয়ের খুনিরা যে সংস্কৃতির অংশ, সেটি গত কয়েক বছরে ক্রমেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে, সেখানে ষড়যন্ত্রতত্ত্বের অভাব নেই; আর জিহাদ ও বল প্রয়োগের শব্দমালা দিয়েই ইসলামকে ব্যাখ্যার অপচেষ্টা চলে।
পোপ, হিলারি ক্লিনটন কিংবা নিকোলা সারকোজির মতো বিশ্বনেতারা যখন শাহবাজ হত্যার তীব্র নিন্দা জানান, সেই মুহূর্তে পাকিস্তান সরকারের প্রতিক্রিয়া নিষ্প্রাণ। যেসব সহিংস জঙ্গিগোষ্ঠী এই দুজনের হত্যাকে স্বাগত জানিয়েছে, তাদের অবাধ কর্মকাণ্ড প্রতিহত করতে কোনো সক্রিয়তা দেখা যায়নি, কোনো প্রতিশ্রুতিও পাওয়া যায়নি। এসব জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী সিআইএর মার্কিন এজেন্ট রেমন্ড ডেভিসের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে এখন প্রতিদিন লাহোরে বিক্ষোভ করছে। দুই পাকিস্তানিকে হত্যার দায়ে রেমন্ড পাকিস্তানের হেফাজতে। নিহত দুই পাকিস্তানি সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) এজেন্ট বলে ধারণা করা হয়। (ডেভিস পাকিস্তানে সক্রিয় সিআইএর গোপন একটি দলের সদস্য হয়ে কাজ করছিলেন। তাঁর কর্মকাণ্ড প্রকাশ পেয়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের অস্বস্তিকর মিত্রতার ওপর তারও চাপ তৈরি হলো।)
শাহবাজ কিংবা তাসির হত্যা—কোনোটির ব্যাপারেই সেনাবাহিনী খেদ প্রকাশ করতে পারেনি। প্রকাশ্যে তাসির হত্যার নিন্দা জানানো, এমনকি তাঁর পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছেন সেনাপ্রধান জেনারেল আশফাক কায়ানি। জানুয়ারি মাসে ইসলামাবাদে তিনি পশ্চিমা কূটনীতিকদের বলেছেন, সেনাবাহিনীর ভেতরে বহু সেনা খুনির প্রতি সহমর্মী। খুনির সহকর্মী পুলিশ কর্মকর্তারা তাকে বীর হিসেবে অভিনন্দিত করার ছবিসংবলিত একটি খেরো খাতা তিনি কূটনীতিকদের দেখান। কায়ানি ইঙ্গিত দেন, যেকোনো প্রকাশ্য বিবৃতি সেনাবাহিনীর ঐক্যকে বিপন্ন করে তুলতে পারে।
সেনাবাহিনীর এই নীরবতার পেছনে আরও অশুভ কিছু ব্যাপার আছে। সেনাবাহিনী ও আইএসআই কয়েক দশকজুড়ে জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, আফগানিস্তান ও কাশ্মীরে প্রক্সি বাহিনী হিসেবে কাজ করার বিনিময়ে তাদের অস্ত্র সজ্জিত করা ও প্রশিক্ষণদানের কাজটিও করেছে। কিন্তু গত কয়েক বছরে সেনাবাহিনী এসব গোষ্ঠীর ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে, তারা এখন সেনাবাহিনীর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। সেনাবাহিনী ও আইএসআইয়ের ওপর জঙ্গিবাদীদের হামলা দিন দিন বেড়ে চলা সত্ত্বেও (গত পাঁচ বছরে তাদের হাতে অন্তত দুই হাজার সেনাসদস্য নিহত হয়েছেন) সেনাবাহিনী একসময়ের অনুগ্রহভাজনদের ওপর কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে যে বিপুল সম্পদ আছে, সেদিক থেকে এটা এক অশুভ লক্ষণ। ্পাকিস্তানের নিয়মিত সেনা পাঁচ লাখ। আরও পাঁচ লাখ রিজার্ভ সেনা। আছে ১১০টি পারমাণবিক অস্ত্র (মার্কিন গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী)। আর আছে দুনিয়ার অন্যতম বৃহৎ গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই, যার কর্মীসংখ্যা এক লাখ।
সেনাবাহিনীর দিক থেকে জঙ্গিবাদীদের মোকাবিলার ইচ্ছা ত্যাগ করা যদি সাম্প্রতিক ঘটনা হয়ে থাকে, তবে রাজনীতিকদের ক্ষেত্রে সেটা ঘটেছে বহু আগেই। প্রধানমন্ত্রী গিলানি ও প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) শীর্ষস্থানীয় নেতা। পিপিপি পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ জাতীয় রাজনৈতিক দল। প্রয়াত নেত্রী বেনজির ভুট্টোর স্বামী হিসেবে জারদারির কাছে জঙ্গিবাদ কোনো অচেনা বস্তু নয়। বরং যে জনগোষ্ঠী তাঁর জনপ্রিয়তার ভিত্তি, সেটি ঐতিহ্যগতভাবে মোল্লাতন্ত্রবিরোধী, সেনাশাসনের বিরোধী এবং গণমুখী নীতির পক্ষে ভোট দেয়। দুঃখজনকভাবে কিছুসংখ্যক দুর্নীতিপরায়ণ ও অযোগ্য নেতা এসব নীতি পরিত্যাগ করেছেন। আজকের পিপিসি অতীতের ছায়াও নয়।
ভারত ও আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের লক্ষ্য থেকে সরে এসেছেন জারদারি। পাশাপাশি জঙ্গিবাদীদের সামর্থ্যের সংকোচন ও নতুন করারোপের মতো অভ্যন্তরীণ কর্মসূচি থেকেও পিছু হটেছেন। পাকিস্তানের একটি আধুনিক রাষ্ট্র হয়ে ওঠার জন্য এগুলো সহায়ক হতো। প্রায় সব পালাবদলের সময় সেনাবাহিনী যে বেসামরিক নেতৃত্বকে প্রতিহত করতে সচেষ্ট থেকেছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু রাজনীতিকেরা প্রতিরোধ কিংবা পদত্যাগের পরিবর্তে শুধুই শোচনীয় আনুগত্য ও বশ্যতা স্বীকার করে গেছেন।
ফলে রাজপথে চলছে অশুভ ডাবল গেম, শাহবাজের মৃত্যুতে সৃষ্ট বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে উত্তেজনার আগুনে ঘি ঢালা হচ্ছে। নিরাপত্তা বাহিনীগুলো লাহোরের মাটিতে লেলিয়ে দিয়েছে লস্কর-ই-তাইয়্যেবাকে। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও জাতিসংঘ এই গোষ্ঠীকে নিষিদ্ধ করেছে, মনে করা হয় পাকিস্তানও একে নিষিদ্ধ করেছে। লস্কর সমর্থকেরা রেমন্ড ডেভিসের ফাঁসি নিশ্চিত করতে প্রতিদিন মার্কিন কনস্যুলেটের বাইরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে। এ ধরনের নিষিদ্ধ গোষ্ঠীকে অবাধে তৎ পরতা চালাতে দিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীগুলো হয়তো অনিচ্ছাকৃতভাবে সব জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর কাছে এই বার্তাই পাঠাচ্ছে যে, তারা নির্বিঘ্নে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারে। এই জটিল ও আতঙ্কজনক কৌশলের পেছনে কী আছে? এটা আসলে মার্কিন ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মধ্যকার বৃহৎ ইঁদুর-বিড়াল খেলারই অংশ। তালেবানের সঙ্গে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের যে শান্তি আলোচনাই হোক না কেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তা নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, যাতে কাবুলে পাকিস্তানপন্থী আফগান সরকার বসানোর পাকিস্তানি বাহিনীর বাসনা পূর্ণ হয়। সেনা নেতৃত্ব দ্বিগুণ নিশ্চিত হতে চায়, আফগানিস্তান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি কোনো আয়োজনে পাকিস্তানের প্রতিপক্ষ ভারত যেন সুবিধাজনক অবস্থানে না যেতে পারে।
এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র অবিচল রয়েছে। এরই মধ্যে তালেবানের কিছু অংশের সঙ্গে পরোক্ষ শান্তি আলোচনা শুরু করতে আইএসআইকে পাশ কাটিয়ে গেছে। ফলে যে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে ঘৃণা করে বলে বিবেচিত, তাদের রাজপথে নামতে দিচ্ছে সেনাবাহিনী। এ জন্য ডেভিসকে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে না। আর এ কারণেই পাকিস্তান-মার্কিন সম্পর্কও এখন গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সেনাবাহিনী ও সরকার প্রতিবছর প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা পেয়ে চলেছে।
আইএসআই হয়তো মার্কিনদের নিয়ে খেলছে, কিন্তু তা করতে গিয়ে ধীরে ধীরে জঙ্গিবাদীদের জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে। এই মুহূর্তে পাকিস্তান এমন এক জায়গায় পরিণত হচ্ছে, যেখানে এক সেনাবাহিনী আছে, যার দেশ নেই।
দ্য নিউইয়র্ক রিভিউ অব বুকস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
ড. আহমেদ রশিদ: পাকিস্তানি সাংবাদিক ও লেখক।
No comments