গল্প- 'একশ ছেচল্লিশ টাকার গল্প' by কৌশিক আহমেদ
যারা প্রচুর ধুমপান করে তাদের জন্য এক প্রকার সিগারেট রয়েছে যার তামাক দীর্ঘ বিরতিতেও নিভে যায় না। একটা মাঝারী গোছের বিরতিতে টান দেয়ার জন্য তামাকটাকে জ্বলন্ত রাখাই বোধহয় এ শলাকার বিশেষত্ব। র; অথচ আমি প্রচুর ধুমপান করি। একই ব্রান্ডের দুই ফ্লেবারের এই সিগারেটের চরিত্র আমার জানা হতোই না যদি তামাকবিক্রেতার কাছে আমার পছন্দসই শলাকাটা থাকতো। যার জন্য মনযোগ আমার বিক্ষিপ্ত, মুখটাও তেতো হয়ে আছে। তার উপরে এখন আমার সম্পাদককে একটা সমাজসচেতনতামূলক গল্প লিখে দিতে হবে আজকের মধ্যেই শুক্রবারের সাহিত্য পাতার জন্য।
গল্প কিছু আসছেই না, উপরন্তু স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত গৃহস্থালীর একটু বেঁচে যাওয়া অর্থ দিয়ে কী করা যায় তাই নিয়ে আন্দোলিত। কিছুদিন যাবত মাসিক উপার্জনের খরচ মিটিয়ে একটা বাড়তি অংক হাতে থেকে যাচ্ছে। উপার্জনের প্রথম দিনগুলোতে এই অর্থগুলো অপচয় হতো আড্ডায়, ঘুরতে আর ধারপ্রদানে। বিবাহিত জীবনের প্রথম দুই বছর যায় একটু বিলাসী অভ্যস্ততায়, উচ্চবিত্তীয় চর্চা পরখ করে দেখতে। সবচেয়ে ভাল প্রেক্ষাগৃহে ভাল আসনের টিকিট কেটে ছবি দেখে, ভাল রোস্তোরার খাবার চেখে তৃপ্তি নিয়ে বের হবার সময় অনর্থক বেশি মূল্য নির্ধারণের সমালোচনা করে, হলুদ ট্যাক্সি চেপে যাতায়াত করে, ঘরের মধ্য কৃত্রিম আধারে মৎস চাষ করে, আর নামি দোকানের পোশাক খরিদ করে। তারপরে অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অর্থগুলো সঞ্চিত হতে থাকে।
আমি অবশ্য এই সময়টাতে চলতে শুরু করে হোঁচট খেয়েছি। যাকে নিয়ে বিবাহিত সে ছেড়ে গেছে। তার জায়গা দখল করেছে স্বল্পকালীন একজন প্রেমিকা। যার আবার সংসার আছে, সন্তান আছে। আমার মধ্যবিত্ত মান ছাড়িয়ে তিনি এখন উচ্চবিত্তের সিঁড়িতে চড়েছেন স্বামীর কল্যাণে। সুতরাং বাড়তি অর্থ নিয়ে আমি এখন ঝামেলায় আছি। ব্রান্ড দেখে পণ্য কেনার বিকার, মৎস চাষ আর রোস্তোরায় খাওয়ার বাসনা উবে গেছে আগেই। উপরন্তু অবিবাহিত জীবনের বন্ধু, আড্ডা আর ধার দেয়ার চক্রও গত হয়েছে। নতুন কিছুতে আগ্রহ নেই, ধুমপানে নতুন শলাকার স্বাদ তেতো মনে হয়। এমন সময় একটা সুযোগ এলো অর্থগুলো খরচ করার, হয়তো আমার গল্প এখন কেনা যাবে, তার কিছু প্রয়োগে, পুরোটা খরচ করতেও আপত্তি নেই। একজন হাত পাতলেন, কিছু খাননি সকাল থেকে!
রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে যখন যানবাহন খুঁজছিলাম শারমিনকে ছেড়ে দিয়ে তখন জীর্ণকংকালের মানুষটিকে দেখে আমার আবেগ নাড়া দেবার কথা। ঠিক কিছুক্ষণ আগের জৈবিক পরিতৃপ্তির পরে এক ধরনের শূন্যতা গ্রাস করেছে। ভিক্ষুকটিকে জিজ্ঞেস করলাম কিছু খাওয়াতে চাইলে তিনি খাবেন কিনা! কিছুক্ষণ বোধহয় আমাকে বুঝে নেবার চেষ্টা করলেন, তারপরে মাথা নাড়লেন হ্যাঁ বোধক। আমি তাকে নিয়ে পাশের একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে গেলাম। খাবার দিতে বললাম মুরগি দিয়ে। টুকটাক আলাপ করলাম।
কী নাম?
আবুল হাশেম।
বাড়ি কোথায়?
টাংগাইল।
দ্বিপ্রহর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে আগেই। বয়স ছুঁই ছুঁই করছে সত্তর, কিন্তু দীর্ঘদিনের ভিখেরীদের বয়স আন্দাজ করা জটিল। কাউকে ত্রিশেও মনে হয় ষাট। তবে এর বয়স নিয়ে আমি নিশ্চিত হবার জন্য জিজ্ঞেস করে জেনে নিলাম।
কত দিন ভিক্ষে করছেন?
সাত বছর।
সংসারে কেউ নেই?
আছে। কিন্তু কোথায় আছে জানি না। ছেলে আছে তিনটা, মেয়ে পাঁচটা!
এতগুলো ছেলেমেয়ে থাকতে কেন ভিক্ষে করছেন?
কেউ খেতে দেয় না। কোথায় আছে তাও জানি না।
বউ?
মরে গেছে অনেক দিন!
অদ্ভুত মানুষের যাত্রা, শুরু থেকে শেষ অবধি কেবল বাঁকের পরে বাঁক। আবুল হাশেমের সাথে আমার থাকতে ইচ্ছে করছে। জানতে ইচ্ছে করছে কেন ছেলেমেয়েগুলো বাবার খোঁজ নিচ্ছে না। বৃদ্ধ মুরগির রোস্টে কামড় দিতে গিয়ে দাঁতের জটিলতায় ভূগছেন। শারমিনের এই সমস্যাটা আছে। সে দাতের বিষয়ে খুব সতর্ক। পয়তাল্লিশেই তিনটি দাঁত স্বর্ণের হয়েছে। অভিজাত রোস্তোরায় মুরগি বাহারী ও বিদেশী রান্না প্রণালীতে আমাদের ঘরোয়া রান্নার মত নরম হয় না, খেতে হয় সবগুলো দাঁতের চূড়ান্ত শক্তিপ্রয়োগে। শারমিন তেমন মুরগি খেতে খেতে দেশী খাবারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়। কিন্তু আবুল হাশেমের সাথে শক্রতা করছে তার বয়োপ্রাপ্ত ও পড়ে যাওয়া দাঁতের মাড়ি। মাংসটুকু আলাদা করার জন্য কখনও দুই হাতের আঙুলের প্রয়োজন হয়ে পড়ছে।
ছেলেমেয়েগুলো কোথায় আছে জানেন না কেন?
ঠিকানা দেয় নাই। বউটা মরে গেলো, তারপরে গ্রামে ভাল লাগলো না, ভাইয়ের ছেলেরা ছিল একই বাড়িতে, তারা খেতে দেয় না, অল্প জমি ছিল, চলতো মোটামুটি, কিন্তু নিয়ে গেল!
ভাইয়ের ছেলেরা!
হ্যাঁ। শয়তান হয়েছে। আল্লাহ ওদেরকে জাহান্মামে পাঠাবে!
কোথায় থাকেন?
মহাখালী বস্তিতে। ঘর নাই, একজনে থাকতে দেয় তার সাথে!
হাশেম আমার চেয়ে চল্লিশ বছরের বড়। তার দুঃখগুলো ছুঁয়ে যায় না। গল্প জানতে আগ্রহ হয় কেবল। জীবনের বিচিত্রতা দেখার এক ধরনের প্রয়োজন চেপে বসে। তাকে আমি হাশেম বলে ডেকে অন্তরঙ্গ হবার চেষ্টা করি। যেমন অফিসের পিয়ন, রিকশাআলা, পেপারওয়ালা, দুধওয়ালা, কাজের বুয়া, মাছওয়ালা, মুরগিওয়ালা, মুচি, নাপিত, ইলেক্ট্রিশিয়ান, ডিশওয়ালা, ধোপা এদের মধ্যে কেউ যদি বয়সে বড়ও হয়, অনায়াসে ‘তুমি’ সম্বোধনে নাম ধরে ডেকে থাকি। এই সম্বোধন তাদের জন্য আমাদের ভালোবাসার প্রকাশ। অথচ আমার চেয়ে উচুঁ অবস্থানের কেউ যদি আমাকে নাম ধরে ডাকে বা ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করে, আমার আত্মসম্মান আহত হয়। মধ্যবিত্তীয় প্রতিনিধিদের এই বস্তুটি সজাগ ও টনটনে। পুঁজিপতি হতে না পারলেও পুঁজিচরিত্রমানস ধারণ করে আছি। কিন্তু অন্তরঙ্গতা কতটুকু এইসব সেবাপ্রদানকারী নিম্নশ্রেণীর জন্য প্রকাশ করা হয়, তা বেশির ভাগের নাম অজ্ঞাততায় বোঝা যায়।
হাশেম, আপনি কি এখন বস্তিতে ফিরবেন?
হাশেম মাথা নাড়ে। খাবার শেষ হয়ে গেছে। ফিল্টার করা কয়েক গ্লাস পানি শেষ করে পকেট থেকে একটা ছোট্ট শলাকা বের করে সে দাত খুঁচতে ব্যস্ত। রেস্তোরাঁর অন্যান্য আগন্তুকরা কিছুটা বিরক্ত হয়ে তাকাচ্ছে হাশেম ও আমার দিকে। হাশেমের গা থেকে ভুরভুরে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। জামাকাপড় ততধিক ময়লা। খাদ্য পরিবেশনকারীদের বেশীর ভাগই বাচ্চাবয়সী, আমার দিকে একটু শ্রদ্ধামিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। একজন খাদ্যপরিবেশক হাশেমের খবর নিচ্ছে, চাচা আর কিছু লাগবে?
তার সহকর্মী আরেকজন যোগ করে, ‘বাবুল, চাচারে এক কাপ চা দে!’
‘চা আমি খাই না!’ হাশেম বলে ওঠে।
বাবুল হেসে ওঠে। বলে, ‘কেন? এক কাপ খান! সাব তো বিল দিবই!’
হাশেম এবার বিরক্ত হয়।
‘তোর এত খাতির করতে হবে না!’ বাবুলের সহকর্মী হেসে ওঠে।
আমি হাশেমকে নিয়ে বিল চুকে রাস্তায় বের হই। আমার শূন্যতা কিছুটা কমেছে। একটা বিষয় পাওয়া গেছে লেখার। হাশেমের আবার দুঃখ কীসের। ভালই আছে। খেয়ে পড়ে আছে, আমার মত অনেকেই তাকে করুণা দেখায় নিশ্চিত। এই সমাজে আমার মত শূন্যে বিরাজকারীর সংখ্যা তো কম হবার কথা নয়। তার জন্য জীবন পরিবর্তনকারী অনেক কিছু করার চেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে খুশী করা অনেক সহজ। নিজের কাছে একটা তৃপ্তি নিয়ে সময় বাঁচিয়ে ঘরে ফেরা যায়। মনুষ্যত্ব চর্চাও হলো, নিজের গল্পও হলো। আমি হাশেমের সাথে তার ঘর দেখে আসতে পারি। তাকে কোনো একটা বৃদ্ধাশ্রমে ভর্তি করে দিতে পারি। কিন্তু সেটা অনেক সময়বহুল কর্মকাণ্ড হবে; যা করেছি তাই তো অনেক কিছু বলে নিজেকে প্রবোধ দেই। আমার মুঠোফোনে সংকেত বেজে ওঠে।
একজন সম্পাদকের ফোন। ‘হ্যালো!’
‘কী ব্যাপার, আপনার গল্প হলো!’
‘এই তো, এইমাত্র লিখে ফেললাম। পেয়ে যাবেন দুই ঘণ্টার মধ্যে।’
আমি হিসেব কষে চলি, আবুল হাশেমের কাহিনী লিখতে আমার বড়জোর দুই ঘণ্টা লাগতে পারে। খরচ হয়েছে পঁচিশ মিনিট, খাবারের বিল ছিয়ানব্বই টাকা, আর এখন পঞ্চাশ টাকা হাশেমের হাতে দিয়ে দিলে হবে একশ ছেচল্লিশ। কিন্তু এই দামে দারুণ একটা সমাজ সচেতনতামূলক গল্প তৈরি করতে পারাটা বেশ সাশ্রয়ীই হয়েছে স্বীকার করতে হবে।
ডিসেম্বর ২০০৭
আমি অবশ্য এই সময়টাতে চলতে শুরু করে হোঁচট খেয়েছি। যাকে নিয়ে বিবাহিত সে ছেড়ে গেছে। তার জায়গা দখল করেছে স্বল্পকালীন একজন প্রেমিকা। যার আবার সংসার আছে, সন্তান আছে। আমার মধ্যবিত্ত মান ছাড়িয়ে তিনি এখন উচ্চবিত্তের সিঁড়িতে চড়েছেন স্বামীর কল্যাণে। সুতরাং বাড়তি অর্থ নিয়ে আমি এখন ঝামেলায় আছি। ব্রান্ড দেখে পণ্য কেনার বিকার, মৎস চাষ আর রোস্তোরায় খাওয়ার বাসনা উবে গেছে আগেই। উপরন্তু অবিবাহিত জীবনের বন্ধু, আড্ডা আর ধার দেয়ার চক্রও গত হয়েছে। নতুন কিছুতে আগ্রহ নেই, ধুমপানে নতুন শলাকার স্বাদ তেতো মনে হয়। এমন সময় একটা সুযোগ এলো অর্থগুলো খরচ করার, হয়তো আমার গল্প এখন কেনা যাবে, তার কিছু প্রয়োগে, পুরোটা খরচ করতেও আপত্তি নেই। একজন হাত পাতলেন, কিছু খাননি সকাল থেকে!
রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে যখন যানবাহন খুঁজছিলাম শারমিনকে ছেড়ে দিয়ে তখন জীর্ণকংকালের মানুষটিকে দেখে আমার আবেগ নাড়া দেবার কথা। ঠিক কিছুক্ষণ আগের জৈবিক পরিতৃপ্তির পরে এক ধরনের শূন্যতা গ্রাস করেছে। ভিক্ষুকটিকে জিজ্ঞেস করলাম কিছু খাওয়াতে চাইলে তিনি খাবেন কিনা! কিছুক্ষণ বোধহয় আমাকে বুঝে নেবার চেষ্টা করলেন, তারপরে মাথা নাড়লেন হ্যাঁ বোধক। আমি তাকে নিয়ে পাশের একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে গেলাম। খাবার দিতে বললাম মুরগি দিয়ে। টুকটাক আলাপ করলাম।
কী নাম?
আবুল হাশেম।
বাড়ি কোথায়?
টাংগাইল।
দ্বিপ্রহর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে আগেই। বয়স ছুঁই ছুঁই করছে সত্তর, কিন্তু দীর্ঘদিনের ভিখেরীদের বয়স আন্দাজ করা জটিল। কাউকে ত্রিশেও মনে হয় ষাট। তবে এর বয়স নিয়ে আমি নিশ্চিত হবার জন্য জিজ্ঞেস করে জেনে নিলাম।
কত দিন ভিক্ষে করছেন?
সাত বছর।
সংসারে কেউ নেই?
আছে। কিন্তু কোথায় আছে জানি না। ছেলে আছে তিনটা, মেয়ে পাঁচটা!
এতগুলো ছেলেমেয়ে থাকতে কেন ভিক্ষে করছেন?
কেউ খেতে দেয় না। কোথায় আছে তাও জানি না।
বউ?
মরে গেছে অনেক দিন!
অদ্ভুত মানুষের যাত্রা, শুরু থেকে শেষ অবধি কেবল বাঁকের পরে বাঁক। আবুল হাশেমের সাথে আমার থাকতে ইচ্ছে করছে। জানতে ইচ্ছে করছে কেন ছেলেমেয়েগুলো বাবার খোঁজ নিচ্ছে না। বৃদ্ধ মুরগির রোস্টে কামড় দিতে গিয়ে দাঁতের জটিলতায় ভূগছেন। শারমিনের এই সমস্যাটা আছে। সে দাতের বিষয়ে খুব সতর্ক। পয়তাল্লিশেই তিনটি দাঁত স্বর্ণের হয়েছে। অভিজাত রোস্তোরায় মুরগি বাহারী ও বিদেশী রান্না প্রণালীতে আমাদের ঘরোয়া রান্নার মত নরম হয় না, খেতে হয় সবগুলো দাঁতের চূড়ান্ত শক্তিপ্রয়োগে। শারমিন তেমন মুরগি খেতে খেতে দেশী খাবারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়। কিন্তু আবুল হাশেমের সাথে শক্রতা করছে তার বয়োপ্রাপ্ত ও পড়ে যাওয়া দাঁতের মাড়ি। মাংসটুকু আলাদা করার জন্য কখনও দুই হাতের আঙুলের প্রয়োজন হয়ে পড়ছে।
ছেলেমেয়েগুলো কোথায় আছে জানেন না কেন?
ঠিকানা দেয় নাই। বউটা মরে গেলো, তারপরে গ্রামে ভাল লাগলো না, ভাইয়ের ছেলেরা ছিল একই বাড়িতে, তারা খেতে দেয় না, অল্প জমি ছিল, চলতো মোটামুটি, কিন্তু নিয়ে গেল!
ভাইয়ের ছেলেরা!
হ্যাঁ। শয়তান হয়েছে। আল্লাহ ওদেরকে জাহান্মামে পাঠাবে!
কোথায় থাকেন?
মহাখালী বস্তিতে। ঘর নাই, একজনে থাকতে দেয় তার সাথে!
হাশেম আমার চেয়ে চল্লিশ বছরের বড়। তার দুঃখগুলো ছুঁয়ে যায় না। গল্প জানতে আগ্রহ হয় কেবল। জীবনের বিচিত্রতা দেখার এক ধরনের প্রয়োজন চেপে বসে। তাকে আমি হাশেম বলে ডেকে অন্তরঙ্গ হবার চেষ্টা করি। যেমন অফিসের পিয়ন, রিকশাআলা, পেপারওয়ালা, দুধওয়ালা, কাজের বুয়া, মাছওয়ালা, মুরগিওয়ালা, মুচি, নাপিত, ইলেক্ট্রিশিয়ান, ডিশওয়ালা, ধোপা এদের মধ্যে কেউ যদি বয়সে বড়ও হয়, অনায়াসে ‘তুমি’ সম্বোধনে নাম ধরে ডেকে থাকি। এই সম্বোধন তাদের জন্য আমাদের ভালোবাসার প্রকাশ। অথচ আমার চেয়ে উচুঁ অবস্থানের কেউ যদি আমাকে নাম ধরে ডাকে বা ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করে, আমার আত্মসম্মান আহত হয়। মধ্যবিত্তীয় প্রতিনিধিদের এই বস্তুটি সজাগ ও টনটনে। পুঁজিপতি হতে না পারলেও পুঁজিচরিত্রমানস ধারণ করে আছি। কিন্তু অন্তরঙ্গতা কতটুকু এইসব সেবাপ্রদানকারী নিম্নশ্রেণীর জন্য প্রকাশ করা হয়, তা বেশির ভাগের নাম অজ্ঞাততায় বোঝা যায়।
হাশেম, আপনি কি এখন বস্তিতে ফিরবেন?
হাশেম মাথা নাড়ে। খাবার শেষ হয়ে গেছে। ফিল্টার করা কয়েক গ্লাস পানি শেষ করে পকেট থেকে একটা ছোট্ট শলাকা বের করে সে দাত খুঁচতে ব্যস্ত। রেস্তোরাঁর অন্যান্য আগন্তুকরা কিছুটা বিরক্ত হয়ে তাকাচ্ছে হাশেম ও আমার দিকে। হাশেমের গা থেকে ভুরভুরে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। জামাকাপড় ততধিক ময়লা। খাদ্য পরিবেশনকারীদের বেশীর ভাগই বাচ্চাবয়সী, আমার দিকে একটু শ্রদ্ধামিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। একজন খাদ্যপরিবেশক হাশেমের খবর নিচ্ছে, চাচা আর কিছু লাগবে?
তার সহকর্মী আরেকজন যোগ করে, ‘বাবুল, চাচারে এক কাপ চা দে!’
‘চা আমি খাই না!’ হাশেম বলে ওঠে।
বাবুল হেসে ওঠে। বলে, ‘কেন? এক কাপ খান! সাব তো বিল দিবই!’
হাশেম এবার বিরক্ত হয়।
‘তোর এত খাতির করতে হবে না!’ বাবুলের সহকর্মী হেসে ওঠে।
আমি হাশেমকে নিয়ে বিল চুকে রাস্তায় বের হই। আমার শূন্যতা কিছুটা কমেছে। একটা বিষয় পাওয়া গেছে লেখার। হাশেমের আবার দুঃখ কীসের। ভালই আছে। খেয়ে পড়ে আছে, আমার মত অনেকেই তাকে করুণা দেখায় নিশ্চিত। এই সমাজে আমার মত শূন্যে বিরাজকারীর সংখ্যা তো কম হবার কথা নয়। তার জন্য জীবন পরিবর্তনকারী অনেক কিছু করার চেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে খুশী করা অনেক সহজ। নিজের কাছে একটা তৃপ্তি নিয়ে সময় বাঁচিয়ে ঘরে ফেরা যায়। মনুষ্যত্ব চর্চাও হলো, নিজের গল্পও হলো। আমি হাশেমের সাথে তার ঘর দেখে আসতে পারি। তাকে কোনো একটা বৃদ্ধাশ্রমে ভর্তি করে দিতে পারি। কিন্তু সেটা অনেক সময়বহুল কর্মকাণ্ড হবে; যা করেছি তাই তো অনেক কিছু বলে নিজেকে প্রবোধ দেই। আমার মুঠোফোনে সংকেত বেজে ওঠে।
একজন সম্পাদকের ফোন। ‘হ্যালো!’
‘কী ব্যাপার, আপনার গল্প হলো!’
‘এই তো, এইমাত্র লিখে ফেললাম। পেয়ে যাবেন দুই ঘণ্টার মধ্যে।’
আমি হিসেব কষে চলি, আবুল হাশেমের কাহিনী লিখতে আমার বড়জোর দুই ঘণ্টা লাগতে পারে। খরচ হয়েছে পঁচিশ মিনিট, খাবারের বিল ছিয়ানব্বই টাকা, আর এখন পঞ্চাশ টাকা হাশেমের হাতে দিয়ে দিলে হবে একশ ছেচল্লিশ। কিন্তু এই দামে দারুণ একটা সমাজ সচেতনতামূলক গল্প তৈরি করতে পারাটা বেশ সাশ্রয়ীই হয়েছে স্বীকার করতে হবে।
ডিসেম্বর ২০০৭
=======================
গল্প- আলিমের নিভৃতিচর্চা by রাশিদা সুলতানা গল্প- প্রত্যাবর্তন: আমার ‘ফেরা’ নিয়ে যে কাহিনী না ..মানষ চৌঃ গল্প- 'বীচিকলায় ঢেকে যায় মুখ ও শিরোনাম' by আনোয়ার ... গল্প- 'প্রীত পরায়া' by সিউতি সবুর গল্প- 'চলিতেছে' by মাহবুব মোর্শেদ গল্প- 'গোপন কথাটি' by উম্মে মুসলিমা গল্প- 'রূপকথা' by লুনা রুশদী সঞ্জীব চৌধুরীর কয়েকটি গল্প গল্প- 'অস্বস্তির সঙ্গে বসবাস' by ফাহমিদুল হক গল্প- 'মঙ্গামনস্ক শরীরীমুদ্রা' by ইমতিয়ার শামীম গল্প- 'হাজেরার বাপের দাইক দেনা' by জিয়া হাশান গল্প- ‘অপঘাতে মৃত্যু’ ও ‘সাদামাটা’ by লীসা গাজী গল্প- 'দ্বিতীয় জীবন' by ইরাজ আহমেদ গল্প- 'পুষ্পের মঞ্জিল' by সাগুফতা শারমীন তানিয়া
bdnews24 এর সৌজন্যে
লেখকঃ কৌশিক আহমেদ
এই গল্পটি পড়া হয়েছে...
লেখকঃ কৌশিক আহমেদ
এই গল্পটি পড়া হয়েছে...
No comments