দুর্যোগের ‘প্রত্যয়’ ফিরে দেখা by মাহবুবা নাসরীন
গত কয়েক দিনের পত্রপত্রিকাজুড়ে ছিল তুরাগ নদে যাত্রীসহ একটি বাস নিমজ্জনের এবং তার উদ্ধার তৎপরতার মন্থর গতিসম্পর্কিত খবর। যে বিষয়টি আজ (১৩ অক্টোবর, ২০১০) বিশ্ব দুর্যোগ হ্রাস দিবসে নতুন করে আমাদের দুর্যোগ, দুর্ঘটনা, আপদ প্রত্যয়গুলো নিয়ে ভাবনায় ফেলছে। নিমজ্জিত বাসটির হতভাগ্য যাত্রীরা আক্ষরিক অর্থে ‘ঝুঁকি’ শব্দটি বিশেষজ্ঞদের মতো সংজ্ঞায়িত না করতে পারলেও পথ চলতে প্রতি মুহূর্তে বাংলাদেশের মানুষ কী পরিমাণ ঝুঁকি নিয়ে চলছে, তা বুঝতে পারে।
পেছনে ফিরে তাকালে আমরা দেখি, বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য দক্ষিণ এশিয়ায় প্রশংসা কুড়িয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে এ নিয়ে আত্মতৃপ্তি থাকলেও তুরাগের বাস নিমজ্জনের ঘটনা আর তার সঙ্গে উদ্ধারকাজের মন্থর গতি সাধারণ মানুষকে আশ্বস্ত করে না। দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস বিষয়টি ২০০৫ সালের জানুয়ারি মাসে দুর্যোগ হ্রাসবিষয়ক সম্মেলনে একটি কর্মপরিকল্পনা ‘হিউগো ফ্রেমওয়ার্ক অন অ্যাকশন’ নেওয়া হয়। যার আদলে বাংলাদেশ সরকারও ঝুঁকি হ্রাস বিষয়ে বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাসে বিভিন্ন পদক্ষেপ ও নীতিমালা নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি সংসদে পাস হয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত আইন। নারী উন্নয়ন নীতিমালায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার বিষয়টি আগস্ট ২০১০-এ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এসব পদক্ষেপ আমাদের আশাবাদী করলেও স্বস্তিতে রাখতে পারছে না।
কারণ, আমরা দেখেছি, ২০০৫ সালে একটি নয়তলা ভবন ধসে পড়েছিল—যার উদ্ধারকাজে সময় লেগেছিল এক সপ্তাহের বেশি। ১০ অক্টোবর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আমিনবাজার সেতু পার হওয়ার পর সালেহপুর সেতুতে ওঠার আগ মুহূর্তে তুরাগ নদে নিমজ্জিত হওয়া বাসটি শনাক্ত করতে সময় লাগল ২৫ ঘণ্টা, আর হতভাগ্য মৃত যাত্রীদের সবাইকে আজও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। আমরা প্রত্যক্ষ করলাম, দক্ষ ডুবুরি আর একমাত্র স্যোনার (সাউন্ড নেভিগেশন অ্যান্ড রেঞ্জিং) যন্ত্র আনতে হলো চট্টগ্রাম থেকে। এ থেকে বোঝা যায়, একটি দুর্ঘটনাজনিত উদ্ধারকাজেই আমরা ঝুঁকিকে প্রাধান্য দিইনি। সেখানে ভূমিকম্পপ্রবণ ‘দুর্যোগ’-এর সম্মুখীন হলে বাংলাদেশের হতাহত মানুষদের উদ্ধার হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু আছে, তা সহজেই অনুমেয়।
আমাদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সংগঠন ও জনগণকে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। শিক্ষা নিতে হবে তুরাগের দুর্ঘটনা থেকে কীভাবে দুর্যোগের ঝুঁকি কমানো যায়, সে বিষয়েও। যানবাহনের চালক ও যাত্রীদেরও শিক্ষণীয় আছে ব্যাপকভাবে। ইতিমধ্যেই কমিউনিটি ঝুঁকি নিরূপণ নির্দেশনা কার্যকর তথ্য সংগ্রহ করছে ঝুঁকি হ্রাস পরিকল্পনার আওতায়। এগুলোর ফলাফল কী, জনগণকে সড়ক ও নৌপথ সম্পর্কে কীভাবে সচেতন করা যায়, তার কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
বিশ্ব ঝুঁকি হ্রাস দিবসেই শুধু নয়—বছর ধরেই ঝুঁকি সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। ঝুঁকি হ্রাস শুধু দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায়ই নয়, সব ধরনের আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনার সময়ই জরুরিভাবে সাড়া দেওয়াকে অন্তর্ভুক্ত করবে এই প্রত্যাশা করা বাংলাদেশের প্রতিনিয়ত লঞ্চ, বাস, সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত মানুষসহ সবার। কারণ, দুর্যোগের মতো এসব দুর্ঘটনারও মারাত্মক ফল থাকে, সর্বস্ব হারানোর বেদনা থাকে, আহত হওয়ার মতো ঘটনা থাকে, থাকে মৃত্যু। যদিও তা অল্পসংখ্যক মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তবুও তাদের যথাযথ সেবা না পাওয়ায় ঝুঁকি হ্রাস পরিকল্পনায় তাদের অন্তর্ভুক্ত না করাটা মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতোই।
বিশ্ব ঝুঁকি হ্রাস দিবসে বিষয়টি আজ আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে, যেকোনো ঝুঁকিজনিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমাদের কতটা প্রস্তুত থাকতে হবে। এর মধ্যে ঝুঁকিজনিত দুর্ঘটনা প্রশমন ও নিরসন করার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা যেকোনো দেশের জরুরি ব্যবস্থাপনার অংশ না হলে কোনো পরিকল্পনা, নীতিমালার বাস্তব প্রতিফলন হয়েছে বলে আমাদের বিশ্বাস হবে না।
সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ, সমন্বিত কর্মসূচির মাধ্যমে এবং সর্বোপরি যেসব কারণে দুর্ঘটনা ঘটে, তা প্রতিরোধে সর্বসাধারণের সচেতনতা বাড়ানো আজ সময়ের দাবি। আন্তর্জাতিকভাবে ঝুঁকি, দুর্ঘটনা, আপদ ও দুর্যোগের মধ্যে প্রত্যয়গত পার্থক্য থাকলেও বাংলাদেশের জন্য এরা সমার্থক। কারণ, একটি মৃত্যু একটি পরিবারকে যে নাজুকতা বা ঝুঁকির মুখোমুখি করে, তা পুষিয়ে নেওয়ার মতো বিকল্প নেই।
মাহবুবা নাসরীন: অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
পেছনে ফিরে তাকালে আমরা দেখি, বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য দক্ষিণ এশিয়ায় প্রশংসা কুড়িয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে এ নিয়ে আত্মতৃপ্তি থাকলেও তুরাগের বাস নিমজ্জনের ঘটনা আর তার সঙ্গে উদ্ধারকাজের মন্থর গতি সাধারণ মানুষকে আশ্বস্ত করে না। দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস বিষয়টি ২০০৫ সালের জানুয়ারি মাসে দুর্যোগ হ্রাসবিষয়ক সম্মেলনে একটি কর্মপরিকল্পনা ‘হিউগো ফ্রেমওয়ার্ক অন অ্যাকশন’ নেওয়া হয়। যার আদলে বাংলাদেশ সরকারও ঝুঁকি হ্রাস বিষয়ে বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাসে বিভিন্ন পদক্ষেপ ও নীতিমালা নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি সংসদে পাস হয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত আইন। নারী উন্নয়ন নীতিমালায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার বিষয়টি আগস্ট ২০১০-এ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এসব পদক্ষেপ আমাদের আশাবাদী করলেও স্বস্তিতে রাখতে পারছে না।
কারণ, আমরা দেখেছি, ২০০৫ সালে একটি নয়তলা ভবন ধসে পড়েছিল—যার উদ্ধারকাজে সময় লেগেছিল এক সপ্তাহের বেশি। ১০ অক্টোবর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আমিনবাজার সেতু পার হওয়ার পর সালেহপুর সেতুতে ওঠার আগ মুহূর্তে তুরাগ নদে নিমজ্জিত হওয়া বাসটি শনাক্ত করতে সময় লাগল ২৫ ঘণ্টা, আর হতভাগ্য মৃত যাত্রীদের সবাইকে আজও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। আমরা প্রত্যক্ষ করলাম, দক্ষ ডুবুরি আর একমাত্র স্যোনার (সাউন্ড নেভিগেশন অ্যান্ড রেঞ্জিং) যন্ত্র আনতে হলো চট্টগ্রাম থেকে। এ থেকে বোঝা যায়, একটি দুর্ঘটনাজনিত উদ্ধারকাজেই আমরা ঝুঁকিকে প্রাধান্য দিইনি। সেখানে ভূমিকম্পপ্রবণ ‘দুর্যোগ’-এর সম্মুখীন হলে বাংলাদেশের হতাহত মানুষদের উদ্ধার হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু আছে, তা সহজেই অনুমেয়।
আমাদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সংগঠন ও জনগণকে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। শিক্ষা নিতে হবে তুরাগের দুর্ঘটনা থেকে কীভাবে দুর্যোগের ঝুঁকি কমানো যায়, সে বিষয়েও। যানবাহনের চালক ও যাত্রীদেরও শিক্ষণীয় আছে ব্যাপকভাবে। ইতিমধ্যেই কমিউনিটি ঝুঁকি নিরূপণ নির্দেশনা কার্যকর তথ্য সংগ্রহ করছে ঝুঁকি হ্রাস পরিকল্পনার আওতায়। এগুলোর ফলাফল কী, জনগণকে সড়ক ও নৌপথ সম্পর্কে কীভাবে সচেতন করা যায়, তার কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
বিশ্ব ঝুঁকি হ্রাস দিবসেই শুধু নয়—বছর ধরেই ঝুঁকি সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। ঝুঁকি হ্রাস শুধু দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায়ই নয়, সব ধরনের আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনার সময়ই জরুরিভাবে সাড়া দেওয়াকে অন্তর্ভুক্ত করবে এই প্রত্যাশা করা বাংলাদেশের প্রতিনিয়ত লঞ্চ, বাস, সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত মানুষসহ সবার। কারণ, দুর্যোগের মতো এসব দুর্ঘটনারও মারাত্মক ফল থাকে, সর্বস্ব হারানোর বেদনা থাকে, আহত হওয়ার মতো ঘটনা থাকে, থাকে মৃত্যু। যদিও তা অল্পসংখ্যক মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তবুও তাদের যথাযথ সেবা না পাওয়ায় ঝুঁকি হ্রাস পরিকল্পনায় তাদের অন্তর্ভুক্ত না করাটা মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতোই।
বিশ্ব ঝুঁকি হ্রাস দিবসে বিষয়টি আজ আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে, যেকোনো ঝুঁকিজনিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমাদের কতটা প্রস্তুত থাকতে হবে। এর মধ্যে ঝুঁকিজনিত দুর্ঘটনা প্রশমন ও নিরসন করার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা যেকোনো দেশের জরুরি ব্যবস্থাপনার অংশ না হলে কোনো পরিকল্পনা, নীতিমালার বাস্তব প্রতিফলন হয়েছে বলে আমাদের বিশ্বাস হবে না।
সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ, সমন্বিত কর্মসূচির মাধ্যমে এবং সর্বোপরি যেসব কারণে দুর্ঘটনা ঘটে, তা প্রতিরোধে সর্বসাধারণের সচেতনতা বাড়ানো আজ সময়ের দাবি। আন্তর্জাতিকভাবে ঝুঁকি, দুর্ঘটনা, আপদ ও দুর্যোগের মধ্যে প্রত্যয়গত পার্থক্য থাকলেও বাংলাদেশের জন্য এরা সমার্থক। কারণ, একটি মৃত্যু একটি পরিবারকে যে নাজুকতা বা ঝুঁকির মুখোমুখি করে, তা পুষিয়ে নেওয়ার মতো বিকল্প নেই।
মাহবুবা নাসরীন: অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments