গল্প- 'লাল ব্যাসার্ধ্ব' by শামীমা বিনতে রহমান
তখন ট্রান্সপোর্টের পাশের লেকের ধারের সিঁড়িতে বসে উমা বলেছিল, “আমরা কখনো বিয়ে করবো না। মানে ‘বিবাহ’ করবো না। বুঝলি?” উমার কথা শুনতে শুনতে আমি সিঁড়ির তল থেকে চুঁয়াতে থাকা পানির মধ্যকার গোল গোল গোলকগুলাকে গুনতেছিলাম। এর আগে সে ‘আমরা পরাজয় মানবো না/দুর্বলতায় বাঁচতে শুধু জানবো না’ গাচ্ছিল; এর মধ্যে বলে কিনা জীবনে বিবাহ করবে না! আমার জলের গোলক গোনার মধ্যে গোলমাল লেগে গেল, বলালম, ‘মানে?’
‘মানে বিয়ে হইলো এক জাতীয় বন্ধন, এক পুরুষের সাথে–সারাজীবন! চিন্তা কর, কী দুর্বিষহ?’
আমি চিন্তা করতে থাকলাম আর ভাবতে থাকলাম, এই জীবনে কারও সঙ্গেই তো আমার সম্পর্ক বেশি দিন আগায় নাই। মানে ভাল্লাগে নাই। তাই যোগাযোগ রাখি নাই। আমার কলেজ ফ্রেন্ডরা আমার ওপর খুব বিরক্ত এই একটা কারণে। উমার কথা শুনে আমার ঠোঁট পানির গোলক গোনা বন্ধ করেছিল যেই পজিশনে, সেই পজিশন থেকে ঠোঁট ফুটে একটাই শব্দ বের হোল, ‘তাই তো!’ উমা বলতে থাকলো, ‘তাই-তো মানে তাইতো-ই, ওইটা একটা বন্দিখানা। তুই কি চাস তোর লাইফটা জেলখানায় বন্দি হইয়া থাক, আর আরেকজন চাবি হাতে লইয়া নাকের সামনে ঘুর ঘুর করবো? মানে, ওই ঘর ছাড়া পৃথিবীর সব খানে স্বাধীনতার বাতাস ঘুরাঘুরি করবো, আর তুমি ওই ঘরে বইসা ঝিমাইবা আর আফসোস করবা! বুঝছিস এবার।’
আমার মাথায় খাট করে আরেক চিন্তা জেগে উঠলো। ‘শোন ছেলারা তো সেক্স করে যখন, মেয়েরা তো তখন নিচে শুয়ে থাকে, এটাও তো একটা প্রবলেম।’
‘অনেক প্রবলেম, সেক্স, সেক্সের বাইরে সবখানে।’
আমরা এরপর ক্যাম্পাসের নানা অলি-গলি ঘুরে, নানা রকম আড্ডা দিতে দিতে লোপামুদ্রা আর মৌসুমী ভৌমিক গাইতে গাইতে রাত ১১টায় হলে ফিরলাম। হলের গেইটে খানিকটা কড়াকড়ি ফেইস করতে গিয়ে প্রথমে হাসি দিয়ে শুরু করে পরে কঠিন কঠিন সংলাপ উচ্চারণে জবাব শেষ করলাম। হাউজ টিউটর কবিতা ম্যাডামের চোখ ছানাবড়া করে ফেলেছিলাম। হলের ভেতর ঢুকে শুনি কবিতা ম্যাডাম সবাইকেই এক কথা বলেছেন, ‘এ্যাতো রাতে তোমরা কোথায় ছিলা জানি না? ইউনিভার্সিটি স্কুলের পেছনের পেয়ারা বাগানে বসে ছিলা। আমি সন্ধ্যার সময় ইনকোয়ারি করছি, সব জাহানারা ইমাম হলের ফাস্ট ইয়ার/সেকেন্ড ইয়ারের মেয়ে বইসা আছো ছেলেদের হাত ধইরা।’
শিল্পা তো মোটামুটি চিৎকার করে প্রতিবাদ করতে থাকলো। আরো অনেকে জড়ো হলো, সেইম কাহিনী, সেইম এক্সপেরিয়েন্স। কবিতা ম্যাডামের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বারুদের সেক্স পেয়ে ধুম্রশলাকার মতো জ্বলতে থাকলো। সঙ্গে সঙ্গে রুমে যেতে হলো। করিডোরে রাখা টেবিল আর আলোকিত করা বাল্বের নিচে বসে আমরা লিখতে বসলাম, ‘অপমানজনক আচরণ করায় হাউস টিউটর কবিতা ম্যাডামের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’ এরকম দাবি সম্বলিত অ্যাপ্লিকেশন। বরাবর হল প্রভোস্ট। প্রভাত পাশেই ছিল, ও অ্যানথ্রপলজির স্টুডেন্ট, বোঝে ভালো। আমাকে হেল্প করছিল, পরামর্শ দিচ্ছিল কীভাবে আমাদের অপমানিত হওয়াকে যথেষ্ঠ আর তীব্র শব্দে বোঝানো যায়। রাত পৌনে বারটার মধ্যেই অ্যাপ্লিকেশন লেখা শেষ। শুরু হলো সিগনেচার ক্যাম্পেইন। প্রথমেই নিচতলা থেকে। শিল্পাকে বললাম, ‘তুই আগে সাইন কর।’ সে বললো, ‘না।’ প্রভাত জিজ্ঞেস করলো, ‘ক্যান, তুমিই তো বেশি করে বলছিলা, এখন পিছলাইয়া যাচ্ছ কেন?’ শিল্পা প্রভাতের উত্তর না দিয়ে আমাকে রিক্যুয়েস্ট করতে থাকলো, ‘তুই আগে কর দোস্ত।’ শিল্পা সবাইকেই তুই বলে, কিন্তু প্রভাত কাউকে কাউকে বলে। শিল্পা প্রভাতের প্রশ্নে ভ্যাবাচেকা খেয়ে আমার উপর পড়লো। তো সাইন করলাম, এরপর প্রভাত, তারপর শিল্পা, এরপর অমিতা–এতক্ষণ যে কোনো প্রকার বিপ্লবী ভূমিকাই রাখে নাই, অথচ তার অনেক ভারি কথাতেই আমার কান পঁচেছে, তবে অনেক ক্ষেত্রেই খুব এক হয়ে গেছিলাম।
সিগনেচার কালেকশন শেষে, কবিতা ম্যাডামের একটা উচিৎ শিক্ষা হতে যাচ্ছে (আদৌ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কী-না, সে আলোচনায় না গিয়ে), শাস্তি তাকে পেতেই হবে এবং পাবেই এমনটাই বলছিলাম। বলতে বলতে রাত মধ্য। আমি ততক্ষণে জীবনে বিয়ে করবো না–এরকম প্রতিজ্ঞার সঙ্গে একমত হয়ে গেলাম আর একাকী জীবনের স্বাধীনতার মুগ্ধতায় ভবিষ্যত রোমাঞ্চে ভাসছিলাম।
চারতলার ফোর সিটেড রুমগুলো নতুন কোনো ছাত্রীকে বরাদ্দ না দেয়ায় ওখানকার উল্টানো চেয়ার-টেবিল-চৌকিতে দুই পা গোল করে বসে অথবা পা মেলে, দুলিয়ে দুলিয়ে, আজগুবি, অনাজগুবি, ইতিহাস, ফ্যান্টাসি ইত্যাদি নানা বিষয়ে গল্প করছিলাম আমরা। পড়াশোনার কথা বাদ দিয়ে আর সব কিছু। আমাদের কথা ফাঁকা রুমে ঘুরে ঘুরে মাঝে মাঝে একা কথা কইতে শুরু করলো। আমরা বলছিলাম কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙ পড়ে জমে থেকে হলের দিকে যাবার ঢালু পথটাকে কেমন মায়াবি করে রাখে। পলাশের মত লাল, নাকি কৃষ্ণচুড়ার লালই কেবল ওই লাল। অন্য কিছুর সাথে তুলনা হতে পারে না। যাই হোক, ওই দৃশ্য যে অদ্ভুত সুন্দর, তাতে আমাদের কারোই কোনো দ্বিমত নাই। কিন্তু আলো-আঁধারি রুমটা হঠাৎ বলতে থাকে ওটা মিনস্ট্রেশনের রঙ। আমরা এদিক-ওদিক তাকাই–মিনস্ট্রেশন–মিনস্ট্রেশন– মিনস্ট্রেশন–লাল পাবন। সেসময় একটা চড়ুই ঢুকে পড়ে জানালা দিয়ে, যদিও চড়–ই’র ঢুকবার কথা না। এত রাত, কী খোঁজে চড়–ই, একা কেন? আচ্ছা, মেয়ে চড়ুই’র কি মিনস্ট্রেশন হয়? সেও কি ‘লালপ্লাবনলালপ্লাবন’ ব্যাথায় চিৎকারে কুঁকিয়ে একদিন না খেয়ে থাকে? সে-ও কি প্যান্টি চুপসিয়ে সিএনজি অটো রিক্সা থেকে নামবার সময় টিস্যু দিয়ে লাল মোছে? এসব ভাবছিলাম আমি, কিন্তু উমা হাসছিল ঠাঃ–ঠাঃ–ঠাঃ। ওর হাসির কারণ জানি না, অল্প কিছুক্ষণের জন্য আমরা যুথবদ্ধতা থেকে ব্যক্তিগততার দূরত্বতায় চলে গেছিলাম। কোনো ব্রিজ ছিল না। ‘প্যারি কমিউনের স্বপ্ন’ আমাদের রোমাঞ্চিত করলেও আমরা এখন দুজন দুই দরজা খুলে বসে আছি। সেসময় এ ব্লকেরই কোনো এক রুম থেকে কোনো এক মেয়ে শিস বাজিয়ে গাচ্ছিল–এই রাত তোমার আমার/শুধু-উ-উ দুজনে-এ-এ…।’ শব্দের মতো ওর শিসও জায়গামতো দোল খাচ্ছিল। উমা আর আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। উমা আমার হাত ধরলো। আমরা করিডোরের হাল্কা আলোয় নিজেদের চেহারার দিকে তাকিয়ে, চিক ফলো করে আস্তে আস্তে আরো ওপরে উঠে চোখ বরাবর তাকিয়ে ছিলাম। আমরা দূরত্বের ব্যাসার্ধ মাপছিলাম, মাপতে মাপতে ঘাড় উঁচু করে হলের গোলাকার বৃত্তাকার আকাশ দেখছিলাম আর ক্ষয়াচাঁদ দেখছিলাম আর ছাগল যেমন ঘাড় চুলকানোর জন্য মাথা ঘুরিয়ে ঘাড়ের কাছে মুখ নেয়, তেমনি করে ব্রার স্ট্রিপ দেখছিলাম আমি। আর উমা দেখছিল ছাদে লাগানো সবুজ ক্যাকটাস।
ফার্স্ট ইয়ারে যা করতাম, দুনিয়াদারির যাবতীয় বিষয়ে তর্ক। হেগেল-মার্কস-লেনিন-মাও সে দং-ট্রটস্কি-ফ্রেডরিক জেমসন-সিমন দ্য ব্যুভোয়া-জাঁ পল সার্ত্র। অস্তিত্ববাদ-মার্কসবাদ-ভাববাদ। এসব তর্ক, ঠিক তর্ক না বলে তর্কের ছলে গল্প জমতো বেশি ছাত্রফ্রন্ট আর ছাত্র ইউনিয়নের ভাইয়া আর আপুদের সাথে। নিজেদের বেশ লাগতো, কারণ ওরা আমাদের অনেক সময় দিতেন সংগঠনের দল ভারির স্বার্থে। স্বার্থ বুঝে গিয়ে আমরা স্বার্থের আশপাশ দিয়ে হাঁটতাম আর তাদের টাকায় চা খেতাম। ট্রান্সপোর্টটার চত্বরে, সুপারি তলায়। পরে অবশ্য এখান থেকে মিছিলও করেছি। মিছিলে শ্লোগান দিছি, ‘এই সমাজ পঁচা গলা/এই সমাজ ভাঙতে হবে; এই সমাজ ভাত দেয় না/এই সমাজ ভাঙতে হবে…।’ তখন ভাঙার মন্ত্র ঢুকে গেছে আমাদের ভেতর। মানে আমরা রাজনৈতিক কর্মী হয়ে গেলাম পুরোদস্তুর। নিয়মিত মিছিল করি, শ্লোগান দেই। মাঝে মাঝে মিছিলে লিড দেই। শিপু ভাই-বাবুল ভাই-শিবলী ভাই-ইউরেকা-শাকিল-জয়-রাহিদ-লিমন-রকিব ভাই-শাহিদ ভাই-সেবা আপা-জেসমিন আপা-রুম্পা-রুবামা। ওরা ব্যক্তিগত প্রেমহীন, নৈর্ব্যক্তিক জীবনচর্চায় শান দিয়ে যাচ্ছিল ক্রমাগত। আর একই সঙ্গে ডেইরি ফার্মের খাবারের দোকানের পিছনে গিয়ে সেন্ট্রাল মাঠের আলো আঁধারে ক্যানাবিসের টানের মায়াজালে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছিল কেউ কেউ।
এরকম এক দুপুরে মিছিল শেষ করে ক্যাফেটেরিয়ায় গিয়ে পানি খেয়েও যখন গলা শুকানো ফুরায় না, তখন ডেইরি ফার্ম গেইটে গেলাম একটা কোক খাওয়ার উদ্দেশ্যে। গেট ক্রস করে দোকানের কাছে যাওয়া মাত্রই জনের সঙ্গে দেখা। হন্তদন্ত হয়ে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলো সে। আমি কোক কিনেই দৌড়ে গেলাম জনের দিকে। ও ঘড় ঘড় করে পানি খাচ্ছিল আর ঘামাচ্ছিল। ওর ফর্সা চেহারার দুই পাশ, গালের অংশ, যেটাকে আমরা চিক্ বলি ওই খানে দুইটা ব্যান্ডেজ। আমি অবাক। এই কি! ‘কী হইছে তোর গালে?’ জন পানির গ্লাস রেখে হাসে, জিজ্ঞেস করে, ‘কেমন আছিস?’
‘গাল কাটছে ক্যামনে? যে জায়গায় ব্যান্ডেজ, ওইখানে তো সেভিং রেজার যাওয়ার কথা না। তাইলে?’
জন আবার হাসে। আমি তার উত্তর পাই না, সে-ও আমার উত্তর পায় না। কিন্তু প্রশ্নের পিঠে প্রশ্নের এক অদ্ভুদ টার্মিনালে বাসেরা জমা হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত চা খেতে খেতে জন যা বললো তা অনেকটা এরকম: ও মিরপুরের পীরেরবাগ বাসায় ফেন্সিডিল আর ক্যানাবিস খেয়ে ফিরেছে। বাসায় তার সৎ, সরকারি আমলা পিতা ঘরে নেই ভেবে, ভলিয়াম ফুল বাড়ায়া পিঙ্ক ফ্লয়েড শুনছিল, লার্নিং টু ফ্লাই। ‘শোন ওই সময়–এ ফ্যাটাল অ্যাট্রাকশন ইজ হোল্ডিং মি ফ্যাস্ট/ হাউ ক্যান আই এসকেপ দিজ ইরেজিসটেবল গ্রাসপ–শুইনা আমি য্যান শূন্যে ভাসতে থাকলাম। আমার রুমের আয়নাটা দেখছিস না। ওইটার সামনে গিয়া দাঁড়াইলাম। মনে হইলো গাল দুইটাতে ব্লেড দিয়া স্টার আঁকি। ব্লেড নিলাম। তারপর ছয়টা করে দাগ পোচলাম, আমার একটুও ব্যাথা লাগে নাই। কিন্তু রক্ত দেইখা আঁৎকাইয়া উঠলাম, ওই সময়ই সচিব সাহেব ঢুকলেন। আমারে দেইখা তো গালাগালি। জ্যোতির লগে তুলনা দিছে, আমার ছোট ভাই জ্যোতি, মনে নাই? ওই পুচকা পোলার কাছ থেইকা নাকি আমারে ভালো মানুষ হওন শিখা লাগবো! মেজাজটা এমন খারাপ হইছে সিলিং ফ্যান বাইড়াইয়া ভাইঙ্গা বাইর হয়া পড়ছি। কইয়া আইছি আর বুয়েটে যামু না পড়াশুনা শ্যাষ। এরপর এক চোটে বাসে জাহাঙ্গীরনগর।’
তারপর আবার একটা মুচকি হাসি। জোরে হাসতে পারে না ব্যান্ডেজের চোটে। আমারে জিজ্ঞাস করলো, ‘রাহিদ কই, রাহিদরে দ্যাখছো আজকে?’
রাহিদ আর জন ক্যাডেট কলেজের ব্যাচ মেট। ক্যাডেট ছেড়ে দুইজন দুই উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হলেও, দুজন এখনও ডাইল-গাঁজার ব্যাচমেট। ওরা গাঁজার আবেশে আবেশায়িত হয়ে অনেক অনেক পরিকল্পনা করে। বিনয় মজুমদারের পোস্টার বানাবে ‘ফিরে এসো চাকা’। গায়ত্রী চক্রবর্তী, যিনি দেশের বাইরে গায়ত্রী স্পিভাক নামে পরিচিত, সেই নারী কেন বিনয়ের মতো এমন নিবেদিত প্রেমিককে বিয়ে করলেন না–এটা তাদের দৈনন্দিনতার অনেক আজগুবি, বে-বাস্তব, বাস্তব আলোচনার একটা নিয়মিত নির্ধারিত অংশ।
এর মধ্যে বেশ কিছু মাস চলে যাওয়ার পর আমি উমার রুমে আবিষ্কার করি গীতবিতান। খুব সুন্দর হাতের লেখায় লেখা, ‘তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।’ নিচে ছোট্ট করে লেখা ‘-জাহিদ ভাই’। উমাকে তার ৪০৬ নম্বর রুমের বেড থেকে উঠিয়ে এ প্রশ্ন করতে আমার লেগেছিল ঘণ্টা দুয়েক। ভর দুপুর বেলা। আর ও ঘুমায়। শুধু ঘুম না, ঘুমের ঘোর। অনেক চিল্লা-চাল্লা দিয়া যখন তারে উঠায়া বসালাম, তখন সে ঠিক মতো বসতে পারে না। বডি সোজা থাকে তো মাথা ঝুলে পড়ে অথবা মাথা সোজা থাকে তো বডি কুচকায়া যায়। ঘটনার মুশকিলে পড়ে তাকে একটা কড়া থাপ্পড় দিলাম। চোখ খুললো, জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হইছে?’
একটা এপনিল খাইছি।
ক্যান?
বইটা দ্যাখছিস?
জাহিদ ভাই আমারে ভালোবাসে বলছে আজকে।
সমস্যা কী? তাতে ঘুমের ওষুধ খাওয়ার সম্পর্ক কী?
আমি বুঝতাছি না কী বোলব। ক্যামন প্যাচ-ঘোচের চক্কর লাগতেছে।
তুই কি জাহিদ ভাইকে ভালোবাসিস?
বুঝতেছি না।
জাহিদ ভাই কই এখন?
সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনে দাঁড়ায়া আছে। আমার অ্যানসার শুনতে চায়।
কতক্ষণ থেকে দাঁড়ায় আছে?
সকাল সাড়ে ৯টা থেকে। ইউনিভার্সিটির বাসে করে নামলাম ডিপার্টমেন্টের সামনে। দেখি জাহিদ ভাই। হাতে গীতবিতান। আমাকে ডাকলেন। গীতবিতান খুলে তার লেখাটা দেখালেন। বইটা নিতে বললেন, আমি নিলাম। তারপর থেকে মাথা ঘুরতাছে। ক্লাস বাদ দিয়া হলে চইলা আসছি। মাথায় কিছুই কাজ করতেছে না দেইখা একটা এপনিল খাইলাম।
সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দাঁড়ায়া আছে? এখন বাজে দুপুর আড়াইটা। তোমার প্রেমিক চম্পট দিছে। চলো ক্যান্টিনে গিয়া খায়া আসি। তারপর রিকসায় ঘুরবো।
উমা চুপ করে বেডশিটের রঙ দেখতে থাকলো। কোনো জবাব না দিয়ে দুই হাঁটুর ভাঁজের মধ্যে গাল এক কাত করে আমার উল্টা দিকে খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর হঠাৎ করে বললো, ‘শুন, জাহিদ ভাই যায় নাই।’
ক্যামনে বুঝলা?
এম্নিই। চল প্রথমে রিকশায় ঘুরি, তারপর ডেইরিফার্ম গেটে গিয়া ভাত খাব।
রিকশা সেন্ট্রাল লাইব্রেরির কাছে আসতেই আমি দূর থেকে দেখলাম ঝুটিবাঁধা এক ভাবুক প্রকৃতির পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়ানোর পুরো ভঙ্গিতে অপেক্ষা। হল থেকে বেরিয়ে আমাদের প্রথম চক্করটা প্রান্তিকের দিকে দেয়ার কথা ছিল, কিন্তু উমার রিক্যুয়েস্টে সেটা ট্রান্সপোর্ট হয়ে সেন্ট্রাল লাইব্রেরির দিকে যেতে হলো। উমা রিকশা থামিয়ে হেঁটে গেল জাহিদ ভাইয়ের কাছে। একটু পর ফিরে এসে বললো, ‘চল পরিচয় করিয়ে দেই।’
‘জাহিদ ভাই, ও হলো মায়া। আমার খুব ভালো বন্ধু। আর জাহিদ ভাই আর্কিটেকচারে পড়ে।’
আমি একটা ছোট্ট টা-টা বলে রিকশা নিয়ে এলোমেলো ঘুরতে থাকলাম–প্রেম মানে তো বিয়ে না, তাই না? প্রেম মানে তো শারীরিক সম্পর্কও না, আর শারীরিক সম্পর্ক থাকলেই বা কী! মানে তো এই না, আমি বিয়ে করতে বাধ্য–ট্রান্সপোর্টের লেকের তলার সিঁড়ি থেকে পানির টপ টপ শব্দে পড়া জলগোলক গোনা শুরু হলো আবার মনে মনে। আচ্ছা ওই জলগোলকের ভেতর তো বে-নি-আ-স-হ-ক-লা থাকে। সাতরঙ, বর্ণমালা, বাংলা ফাইভ, শচীন দেব বর্মন। ‘না আমারে শশী চেও না/চেও না চেও না চেও না…না!…’ এইসব করতে করতে বিজ্ঞান কারখানার সামনে এসে দেখি বন্ধ সাঁটারে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে লিমন। খায়রুল হাবিবের উল্লাস পীরের মজমা পড়ছিল আর চিৎকার করছিল। ওখানে জনের বন্ধু রাহিদ ছিল, যে একজনকে ভালোবেসে, সেই মেয়ে এক ধনী ছেলেকে বিয়ে করার শোকে কাতর। রুমে মোম জ্বালিয়ে অপেক্ষার কথা শোনায় নাকি। এটা নিয়ে এমএইচ হলের মাকড়শার জাল ছুঁয়ে ফ্লোরের তল পর্যন্তও নাকি গল্প চালু আছে। তবে এখন খানিক ফিকা। বিশ্বজগতে এখন পরাজিত প্রেমে জ্বলা কয়লার কার্বন ফরটিন ডেটিং নির্ণয় পদ্ধতিতে এর সময়কাল জানা গেছে নাকি মাত্র কয়েকদিন। অবশ্য ‘নাকি’সহ সময়কালটা স্বতসিদ্ধে সিদ্ধ রূপ নিছে কথিকার এক ইনফরমেশনে। ও আমাকে একদিন মুক্তমঞ্চের পেছনে ডেকে নিয়ে বলেছিল, ‘জান, রাহিদ না রুবামার প্রেমে পড়ছে।’ কথিকা কি রাহিদকে চাইছিল? প্রশ্ন করা হয় নাই। তবে এটা ঠিক অপেক্ষার আতরে আতরায়িত হতে হতে একদিন ট্রান্সপোর্টের সুপারিতলায় রাহিদ রুবামাকে বলেছিল, ‘তুমি কবিতা।’ এরপর তাকে কবিতার বই পড়তে দিতো। বিনয়ের কবিতা শোনাত, আবুল হাসান শোনাত আর ডাকতো ‘হেই গার্ল ফ্রম টুমরো, হাউ আর ইউ?’ অল্প কয়েকদিনেই রুবামা তার আরাধ্য হয়ে উঠেছিল। রুবামা তখন ওই গ্রুপটার সাথে মিশে গিয়েছিল। সমাজ ভাঙনের পা ফেলা মিছিলটা তখন ভেতরে ভেতরে দুই গ্রুপ হয়ে গেছিল। এক গ্রুপ সমাজতান্ত্রিক সন্ত আর আরেক গ্রুপ জুলেখা সিরাপ খেয়ে ‘যে একা সে ভীড়’ এমন অ্যালিয়ানেইশন আর যৌথতার দ্বন্দ্বের খাতায় নাম লেখায়। ওই গ্রুপটারই নির্ধারিত জায়গা বিজ্ঞান কারখানার সাটার নামানো খরখরে দুপুর বা আলো-আঁধারির রাত। ওই গ্রুপ মার্কসীয় গণসঙ্গীতের বদলে জাহিদ পাপ্পুর গান গায় ‘আমি যারে ভালোবাসি/তারে আবার বাসি না/তারে ভালো লাগে না/লাগে না গো…।’
রুবামা প্রায়ই যে কাজটা করতো, বিজ্ঞান কারখানার নামানো সাঁটারে ঠেস দিয়ে, পা মেলে লিমনের পাশে বসে, কাঁধে মাথা রেখে, পরবাসে বসবাস পড়তো। মুস্তফা আনোয়ার মলি-ল্যাজারাসের এমন বিধ্বংসী প্রেম কেমন করে লিখলো ভাবতে ভাবতে লিমনকে বলতো ‘চল্ আবার পড়ি; আমি মলি, তুই ল্যাজারাস।’
‘আয় পারফর্ম করি। কাব্য নাটক না!’
একদিন এইসব দেখে ফেললো রাহিদ। প্রতিযোগিতায় না গিয়ে জন আর রাহিদ কবিতা লিখে নিয়ে আসতে থাকলো ওইখানে। কবিতায় ভাসতে ভাসতে একটা অনুচ্চারিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়ে গেল তিনজনের মধ্যে। ত্রিভূজ জ্যামিতিক প্রেম। রুবামা কি এটা প্রেমসুলভ এনজয় করতো নাকি বন্ধুসুলভ মহব্বতে মিছিল শেষেই বিজ্ঞান কারখানার মৌচাকে এসে জমতো–এটা অবশ্য বোঝা যেত না। কারণ ও বেশিরভাগ সময় হয় জুলেখাসিরাপপায়ীদের সাথে থাকতো, নইলে ঢাকায় চলে যেত ভোরবেলায়; অনেক রাতে হলে ফিরতো। ওকে জিজ্ঞেস করার সময় পাওয়া যেত না। তবে রুবামাকে মনে হতো সব সময়ই আক্রান্ত-বিভ্রান্তের উল্লাসময় ফটোগ্রাফ। কিন্তু ধীরে ধীরে রাহিদ রুবামার ব্যাপারে জনের গাওয়া সঞ্জীব চৌধুরীর গানের মাদকতা আর লিমনের অদ্ভুদ সুন্দর দরদী আবৃত্তির প্রেমজ পিয়াসকে টেক্কা দেয়া শুরু করে দিছিল। মানে ‘চাই-ই চাই’র দশা তার। কবিতা ঠাসা ভালোবাসা, ফটোগ্রাফি, পোস্টার বানানোর প্ল্যানের মধ্যে, মিছিলের মধ্যে, দেয়ালে চিকা মারার মধ্যে আর সংগঠনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় শাখার বরাদ্দ গণচাঁদা তুলবার মধ্যে প্রেম প্রেম গন্ধরাজ ছড়িয়ে দিতে থাকলো সে। রুবামা সুবাস নিত। রুবামা কাঁঠালিচাঁপা নাকে ঠেসে রাহিদের চোখের ভেতরকার লম্ফমান প্রেম দেখতে দেখতে আরাফের গালের ওপর তার গাল অনুভবের রোমাঞ্চ বানাতো। আরাফও ফটোগ্রাফি করে। রুবামা আরাফকে ভালোবাসে কি-না কে জানে, আরাফ তাকে জান দিয়ে ভালোবাসে, ওটা রুম্পার বুঝতে বাকি থাকে না। রুম্পা এই তথ্য মোটামুটি সবাইকে একই ভঙ্গিতে জানিয়ে দিয়ে, রুবামার প্রেমিকদেরও বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিল, ‘আর যাই কর, রুবামার সাথে যাইস না।’ রুম্পার আম্মুসুলভ আবেদন কোথাও কোথাও খেটেছিল, তবে সেটা ছিল পজ, কিন্তু রাহিদ পজ-টজে নাই, ও রানিং মিউজিক, র্যাগে মিউজিকের মতো। কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই (পরিকল্পনা বেশি করলে পস্তাতে হয়, তাই যখনই জাগিবে চিত্ত, তখনই দুলিয়া ওঠ–এটা বিশ্বাস করতো সে।) রাহিদ কাঁঠালিচাঁপা হাতে নিয়ে রুবামার গাল ছোঁয়ালো। রুবামা তখন গালে আরাফের গাল ঘষার স্পর্শ পেতে থাকলো। সে তখনো রাহিদের চোখের গোল ব্যাসে ভালোবাসার কৌণিক দূরত্ব মাপতে থাকলো আর আরাফের পিঠে কৃষ্ণবর্ণ চাঁদ থেকে রুপালি আলো চুষে চুষে মদির হওয়ার স্মৃতি টানতে থাকলো। আরাফ তার স্তনের এপার ওপারে চুমুর উল্কি এঁকে দিতো। যতবার ব্রা খুলতো রুবামা, ততবার ওই উল্কিতে তাকিয়ে থাকতো আনমনা। একবার আরাফেরই প্রস্তাব ছিল, ‘চলো দুইটা রুপালি রিং বানাই।’
‘মানে?’
‘মানে একটা তোমার নাভীতে থাকবে আরেকটা জলপদ্মের প্রবেশ পথে, এরপর আমরা সেক্স করবো। দুরন্ত-দুর্বার-উন্মাদনায়। কেমন আইডিয়া?’
বিজ্ঞান কারখানার বন্ধ সাঁটারে ঠেস দেয়া আলোচনায় এখন কবিতার চেয়ে বেশি জায়গা করে নিয়েছে সমসাময়িক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি। এত দুর্নীতিবাজ ধরেও শান্তি নাই। চালের দাম কমে না। আবার সরকার কী কী সব নীতি বাস্তবায়ণের ঘোষণা দিচ্ছে, তথ্য অধিকার আইন, কমিউনিটি রেডিও করার প্রস্তাব, নারী উন্নয়ন নীতি, , , ইত্যাদি ইত্যাদি। হুট করে ইউরেকা, যে নিয়মিত বিজ্ঞান কারখানার আগুন্তক, বেশিরভাগ সময়ই চুপ মেরে বসে থাকা ছাড়া তেমন মত দেয় না; সে হুট করে বলে ফেললো, ‘হেই খালেদা সরকার না একটা ছাগল উন্নয়ন জাতীয় কী একটা করছিল? নারী উন্নয়ন নীতি কি সে জাতীয় কিছু একটা? মায়া এবং রুবামা এবং উমা একসঙ্গে প্রতিবাদ করলো ঠিকই, কিন্তু নারী প্রাণীটি যে আজ পর্যন্ত সংখ্যালঘু, প্রতিবন্ধীদের মতো বিশেষ একটা প্রজাতিই রইলো, মানুষ ভাবলো না এই ‘বালের রাষ্ট্র’ –ইউরেকার প্রতিবাদ করতে করতে নিজেরাই মর্মান্তিক ক্ষোভের আলোচনায় ঢুকে পড়লো। ইউরেকা বলতে থাকলো, ‘বুঝলা আমরা হইলাম বাংলা সিনেমার স্যাক্রিফাইসিং জেনারেশন। মানে বাংলা সিনেমায় দেখিস না হিরোরে ভিলেনগুলি করতে আসলে সাইড প্রেমিকা বা বড়, নইলে ছোট ভাই সামনে খাড়াইয়া গুলি খায়, হিরো বাঁইচা যায়। আমরা হইলাম এই স্যাক্রিফাইসিং জেনারেশন। আমগো বাপের জেনারেশনে অনেক হিরো ছিল–জহির রায়হান–মুনির চৌধুরী–সেলিনা পারভীন–জাহানারা ইমাম। আমাদের জেনারেশনে নাই, হইবো-ও না। দুনিয়ার সব জায়গায় কিছু কিছু জেনারেশন যায়, হিরোর পয়দা দেওনের লাইগা বাংলা ছবির স্যাক্রিফাইসিং সাইড ক্যারেক্টার হইয়া যায়। আমার অবজারভেশন কিন্তু রাইট, কী বলিস? তোরা আমার এক বছরের জুনিয়র, চোখ বন্ধ কইরা থিওরিটা মাইনা নে। সমাজটা তো কুঁড়েঘর না, লাত্থি দিয়া ভাইঙ্গা ফালামু। এইটা কংক্রিটের শক্ত দেয়াল। বলে সে গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে বলতে থাকলো ‘এই সমাজ ভাত দেয় না/এই সমাজ ভাঙতে হবে/ভাঙতে গেলেই বাঁধবে লড়াই/সেই লড়াইয়ে হবো সাইড ক্যারেক্টার।’
‘স্যাক্রিফাইসিং।’ ‘সাইড।’ ‘ক্যারেক্টার।’ থেমে থেমে উচ্চারণ করে আবার আগের জায়গায় বসে পড়লো ইউরেকা। রুবামার খুব পছন্দ হয়েছে, মায়ারও খুব পছন্দ হয়েছে ডায়ালগগুলা। কেবল উমা উদাস। ওর কোনো বিকার নাই, উন্মাদনা নাই।
এরপর আবার লিমন একটা স্টিক ধরায়া বলা শুরু করলো, ‘শোন্ সবাই, আরে আমরা হইলাম কুকিল। আমাদের চক্ষু লাল। খালি চোক্ষে সাটার নামাইয়া রাখি। যে যারে চোদে চুদুক, যে না খায়া মরে মরুক। আমগো কী? আমরা হইলাম কুকিল। সুসময় আইলে কু-উ-উ কু-উ-উ ডাকুম। বসন্তের সাইরেন।’
রাহিদ নাই। রাহিদ এখন আর বিজ্ঞান কারখানার আড্ডায় আসে না। ও থাকলে একটা ঠাঃ–ঠাঃ–ঠাঃ হাসি দিয়া মোটা ঠোঁট দুইটারে গোল করে কু-উ-উ-উ ডাক শুনাতো। কিন্তু আহা রাহিদ নাই। রুবামার কিছু যায় আসে না। ও লেফট-রাইটের মতো মার্চ করতে থাকলো ‘স্যাক্রিফাইসিং ক্যারেক্টার। সাইড ক্যারেক্টার।’ একবার ফুট সাতেক দূরে যায় আবার ফিরে আসে। আবার যায়। আবার যায়। আবার আসে। আবার আসে।
উমার এসব ভাল্লাগছিলো না। তাগাদা দিচ্ছিল অনেকবার। হলে ফিরে যাবার জন্য। ওর এখন রাতে বেশি থাকতে ভাল্লাগে না। মাস ছয়েক হলো বিয়েও করে ফেলেছে। যথারীতি এক হিন্দু ছেলেকে। স্থাপত্য বিভাগের জাহিদ ভাইয়ের সঙ্গে কী এক অজ্ঞাত কারণে আগায় নাই। তার সাংবাদিক স্বামী রোজই সান্ধ্য আইনের মতো নিয়ম করে রাত ৯টায় ফোন করে, বউটা কেমন আছে?
উমার এসব ভাল্লাগে না। কেন জানি। তার সাংবাদিক স্বামীর অনেক গুণ। ভালো তবলা বাজায়, ছবি আঁকে, অসাধারণ গায় আর অনেক অনেক নাকি লিখে পত্রিকায়। কিন্তু উমার এতে মন বসে না। উমা উদাস হয়ে যায়। আকাশ দেখে। ঘাস দেখে। ক্ষুদি পানা পানিতে চুবিয়ে রোদের ঝলকের রুপালি রূপের ঝলমলি দেখে আনন্দে হাসে। মাঝে মাঝে ভোরে গোলাপী রঙের শাপলা তুলে নিয়ে আসে লেক থেকে। উমার মনে শান্তি নাই। একটা ছটফটানি। ছটফটানি।
এরপর একদিন ঢাকাইয়্যা আড্ডার আড্ডাখানা আজিজ মার্কেট থেকে রিকশায় ফেরত যেতে যেতে আমরা পাইকপাড়ায় চলে যাই। একটা জ্বিলাপীর দোকানে জ্বিলাপী খেয়ে আবার রিকশায় ঘুরি। অবিকশিত মফস্বল মার্কা রাজধানী শহরের গলিতে গলিতে রিকশা চক্কর মারতে মারতে উমা হঠাৎ আমার হাত চেপে আর্তস্বরে প্রশ্ন করলো, ‘আচ্ছা মায়া জাহিদ ভাইয়ের নামের শেষে চক্রবর্তী থাকলে কী হইতো অথবা আমি তোর মতো, তার মতো মুসলমান হইলে কার ক্ষতি হইতো?
আমি রিকশাওয়ালার গেঞ্জির ছেঁড়া গোল ফাঁকে বাতাসের নড়চড় দেখতে থাকি। ট্রান্সপোর্টের লেকের ধারের বাঁধানো সিঁড়ি থেকে চুইয়ে পড়া পানির গোলক আবার ফিরে আসত থাকলো আমার ভেতর। এবার সাদা জলগোলকের বদলে পড়বে লাল রঙের জলগোলক। টপ্ ট্প টপ্ টপাটপ্ টপ্টপ্টপ্…লাল টপাটপ্।
ঢাকা, ৭/৪/৮
‘মানে বিয়ে হইলো এক জাতীয় বন্ধন, এক পুরুষের সাথে–সারাজীবন! চিন্তা কর, কী দুর্বিষহ?’
আমি চিন্তা করতে থাকলাম আর ভাবতে থাকলাম, এই জীবনে কারও সঙ্গেই তো আমার সম্পর্ক বেশি দিন আগায় নাই। মানে ভাল্লাগে নাই। তাই যোগাযোগ রাখি নাই। আমার কলেজ ফ্রেন্ডরা আমার ওপর খুব বিরক্ত এই একটা কারণে। উমার কথা শুনে আমার ঠোঁট পানির গোলক গোনা বন্ধ করেছিল যেই পজিশনে, সেই পজিশন থেকে ঠোঁট ফুটে একটাই শব্দ বের হোল, ‘তাই তো!’ উমা বলতে থাকলো, ‘তাই-তো মানে তাইতো-ই, ওইটা একটা বন্দিখানা। তুই কি চাস তোর লাইফটা জেলখানায় বন্দি হইয়া থাক, আর আরেকজন চাবি হাতে লইয়া নাকের সামনে ঘুর ঘুর করবো? মানে, ওই ঘর ছাড়া পৃথিবীর সব খানে স্বাধীনতার বাতাস ঘুরাঘুরি করবো, আর তুমি ওই ঘরে বইসা ঝিমাইবা আর আফসোস করবা! বুঝছিস এবার।’
আমার মাথায় খাট করে আরেক চিন্তা জেগে উঠলো। ‘শোন ছেলারা তো সেক্স করে যখন, মেয়েরা তো তখন নিচে শুয়ে থাকে, এটাও তো একটা প্রবলেম।’
‘অনেক প্রবলেম, সেক্স, সেক্সের বাইরে সবখানে।’
আমরা এরপর ক্যাম্পাসের নানা অলি-গলি ঘুরে, নানা রকম আড্ডা দিতে দিতে লোপামুদ্রা আর মৌসুমী ভৌমিক গাইতে গাইতে রাত ১১টায় হলে ফিরলাম। হলের গেইটে খানিকটা কড়াকড়ি ফেইস করতে গিয়ে প্রথমে হাসি দিয়ে শুরু করে পরে কঠিন কঠিন সংলাপ উচ্চারণে জবাব শেষ করলাম। হাউজ টিউটর কবিতা ম্যাডামের চোখ ছানাবড়া করে ফেলেছিলাম। হলের ভেতর ঢুকে শুনি কবিতা ম্যাডাম সবাইকেই এক কথা বলেছেন, ‘এ্যাতো রাতে তোমরা কোথায় ছিলা জানি না? ইউনিভার্সিটি স্কুলের পেছনের পেয়ারা বাগানে বসে ছিলা। আমি সন্ধ্যার সময় ইনকোয়ারি করছি, সব জাহানারা ইমাম হলের ফাস্ট ইয়ার/সেকেন্ড ইয়ারের মেয়ে বইসা আছো ছেলেদের হাত ধইরা।’
শিল্পা তো মোটামুটি চিৎকার করে প্রতিবাদ করতে থাকলো। আরো অনেকে জড়ো হলো, সেইম কাহিনী, সেইম এক্সপেরিয়েন্স। কবিতা ম্যাডামের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বারুদের সেক্স পেয়ে ধুম্রশলাকার মতো জ্বলতে থাকলো। সঙ্গে সঙ্গে রুমে যেতে হলো। করিডোরে রাখা টেবিল আর আলোকিত করা বাল্বের নিচে বসে আমরা লিখতে বসলাম, ‘অপমানজনক আচরণ করায় হাউস টিউটর কবিতা ম্যাডামের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’ এরকম দাবি সম্বলিত অ্যাপ্লিকেশন। বরাবর হল প্রভোস্ট। প্রভাত পাশেই ছিল, ও অ্যানথ্রপলজির স্টুডেন্ট, বোঝে ভালো। আমাকে হেল্প করছিল, পরামর্শ দিচ্ছিল কীভাবে আমাদের অপমানিত হওয়াকে যথেষ্ঠ আর তীব্র শব্দে বোঝানো যায়। রাত পৌনে বারটার মধ্যেই অ্যাপ্লিকেশন লেখা শেষ। শুরু হলো সিগনেচার ক্যাম্পেইন। প্রথমেই নিচতলা থেকে। শিল্পাকে বললাম, ‘তুই আগে সাইন কর।’ সে বললো, ‘না।’ প্রভাত জিজ্ঞেস করলো, ‘ক্যান, তুমিই তো বেশি করে বলছিলা, এখন পিছলাইয়া যাচ্ছ কেন?’ শিল্পা প্রভাতের উত্তর না দিয়ে আমাকে রিক্যুয়েস্ট করতে থাকলো, ‘তুই আগে কর দোস্ত।’ শিল্পা সবাইকেই তুই বলে, কিন্তু প্রভাত কাউকে কাউকে বলে। শিল্পা প্রভাতের প্রশ্নে ভ্যাবাচেকা খেয়ে আমার উপর পড়লো। তো সাইন করলাম, এরপর প্রভাত, তারপর শিল্পা, এরপর অমিতা–এতক্ষণ যে কোনো প্রকার বিপ্লবী ভূমিকাই রাখে নাই, অথচ তার অনেক ভারি কথাতেই আমার কান পঁচেছে, তবে অনেক ক্ষেত্রেই খুব এক হয়ে গেছিলাম।
সিগনেচার কালেকশন শেষে, কবিতা ম্যাডামের একটা উচিৎ শিক্ষা হতে যাচ্ছে (আদৌ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কী-না, সে আলোচনায় না গিয়ে), শাস্তি তাকে পেতেই হবে এবং পাবেই এমনটাই বলছিলাম। বলতে বলতে রাত মধ্য। আমি ততক্ষণে জীবনে বিয়ে করবো না–এরকম প্রতিজ্ঞার সঙ্গে একমত হয়ে গেলাম আর একাকী জীবনের স্বাধীনতার মুগ্ধতায় ভবিষ্যত রোমাঞ্চে ভাসছিলাম।
চারতলার ফোর সিটেড রুমগুলো নতুন কোনো ছাত্রীকে বরাদ্দ না দেয়ায় ওখানকার উল্টানো চেয়ার-টেবিল-চৌকিতে দুই পা গোল করে বসে অথবা পা মেলে, দুলিয়ে দুলিয়ে, আজগুবি, অনাজগুবি, ইতিহাস, ফ্যান্টাসি ইত্যাদি নানা বিষয়ে গল্প করছিলাম আমরা। পড়াশোনার কথা বাদ দিয়ে আর সব কিছু। আমাদের কথা ফাঁকা রুমে ঘুরে ঘুরে মাঝে মাঝে একা কথা কইতে শুরু করলো। আমরা বলছিলাম কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙ পড়ে জমে থেকে হলের দিকে যাবার ঢালু পথটাকে কেমন মায়াবি করে রাখে। পলাশের মত লাল, নাকি কৃষ্ণচুড়ার লালই কেবল ওই লাল। অন্য কিছুর সাথে তুলনা হতে পারে না। যাই হোক, ওই দৃশ্য যে অদ্ভুত সুন্দর, তাতে আমাদের কারোই কোনো দ্বিমত নাই। কিন্তু আলো-আঁধারি রুমটা হঠাৎ বলতে থাকে ওটা মিনস্ট্রেশনের রঙ। আমরা এদিক-ওদিক তাকাই–মিনস্ট্রেশন–মিনস্ট্রেশন– মিনস্ট্রেশন–লাল পাবন। সেসময় একটা চড়ুই ঢুকে পড়ে জানালা দিয়ে, যদিও চড়–ই’র ঢুকবার কথা না। এত রাত, কী খোঁজে চড়–ই, একা কেন? আচ্ছা, মেয়ে চড়ুই’র কি মিনস্ট্রেশন হয়? সেও কি ‘লালপ্লাবনলালপ্লাবন’ ব্যাথায় চিৎকারে কুঁকিয়ে একদিন না খেয়ে থাকে? সে-ও কি প্যান্টি চুপসিয়ে সিএনজি অটো রিক্সা থেকে নামবার সময় টিস্যু দিয়ে লাল মোছে? এসব ভাবছিলাম আমি, কিন্তু উমা হাসছিল ঠাঃ–ঠাঃ–ঠাঃ। ওর হাসির কারণ জানি না, অল্প কিছুক্ষণের জন্য আমরা যুথবদ্ধতা থেকে ব্যক্তিগততার দূরত্বতায় চলে গেছিলাম। কোনো ব্রিজ ছিল না। ‘প্যারি কমিউনের স্বপ্ন’ আমাদের রোমাঞ্চিত করলেও আমরা এখন দুজন দুই দরজা খুলে বসে আছি। সেসময় এ ব্লকেরই কোনো এক রুম থেকে কোনো এক মেয়ে শিস বাজিয়ে গাচ্ছিল–এই রাত তোমার আমার/শুধু-উ-উ দুজনে-এ-এ…।’ শব্দের মতো ওর শিসও জায়গামতো দোল খাচ্ছিল। উমা আর আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। উমা আমার হাত ধরলো। আমরা করিডোরের হাল্কা আলোয় নিজেদের চেহারার দিকে তাকিয়ে, চিক ফলো করে আস্তে আস্তে আরো ওপরে উঠে চোখ বরাবর তাকিয়ে ছিলাম। আমরা দূরত্বের ব্যাসার্ধ মাপছিলাম, মাপতে মাপতে ঘাড় উঁচু করে হলের গোলাকার বৃত্তাকার আকাশ দেখছিলাম আর ক্ষয়াচাঁদ দেখছিলাম আর ছাগল যেমন ঘাড় চুলকানোর জন্য মাথা ঘুরিয়ে ঘাড়ের কাছে মুখ নেয়, তেমনি করে ব্রার স্ট্রিপ দেখছিলাম আমি। আর উমা দেখছিল ছাদে লাগানো সবুজ ক্যাকটাস।
ফার্স্ট ইয়ারে যা করতাম, দুনিয়াদারির যাবতীয় বিষয়ে তর্ক। হেগেল-মার্কস-লেনিন-মাও সে দং-ট্রটস্কি-ফ্রেডরিক জেমসন-সিমন দ্য ব্যুভোয়া-জাঁ পল সার্ত্র। অস্তিত্ববাদ-মার্কসবাদ-ভাববাদ। এসব তর্ক, ঠিক তর্ক না বলে তর্কের ছলে গল্প জমতো বেশি ছাত্রফ্রন্ট আর ছাত্র ইউনিয়নের ভাইয়া আর আপুদের সাথে। নিজেদের বেশ লাগতো, কারণ ওরা আমাদের অনেক সময় দিতেন সংগঠনের দল ভারির স্বার্থে। স্বার্থ বুঝে গিয়ে আমরা স্বার্থের আশপাশ দিয়ে হাঁটতাম আর তাদের টাকায় চা খেতাম। ট্রান্সপোর্টটার চত্বরে, সুপারি তলায়। পরে অবশ্য এখান থেকে মিছিলও করেছি। মিছিলে শ্লোগান দিছি, ‘এই সমাজ পঁচা গলা/এই সমাজ ভাঙতে হবে; এই সমাজ ভাত দেয় না/এই সমাজ ভাঙতে হবে…।’ তখন ভাঙার মন্ত্র ঢুকে গেছে আমাদের ভেতর। মানে আমরা রাজনৈতিক কর্মী হয়ে গেলাম পুরোদস্তুর। নিয়মিত মিছিল করি, শ্লোগান দেই। মাঝে মাঝে মিছিলে লিড দেই। শিপু ভাই-বাবুল ভাই-শিবলী ভাই-ইউরেকা-শাকিল-জয়-রাহিদ-লিমন-রকিব ভাই-শাহিদ ভাই-সেবা আপা-জেসমিন আপা-রুম্পা-রুবামা। ওরা ব্যক্তিগত প্রেমহীন, নৈর্ব্যক্তিক জীবনচর্চায় শান দিয়ে যাচ্ছিল ক্রমাগত। আর একই সঙ্গে ডেইরি ফার্মের খাবারের দোকানের পিছনে গিয়ে সেন্ট্রাল মাঠের আলো আঁধারে ক্যানাবিসের টানের মায়াজালে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছিল কেউ কেউ।
এরকম এক দুপুরে মিছিল শেষ করে ক্যাফেটেরিয়ায় গিয়ে পানি খেয়েও যখন গলা শুকানো ফুরায় না, তখন ডেইরি ফার্ম গেইটে গেলাম একটা কোক খাওয়ার উদ্দেশ্যে। গেট ক্রস করে দোকানের কাছে যাওয়া মাত্রই জনের সঙ্গে দেখা। হন্তদন্ত হয়ে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলো সে। আমি কোক কিনেই দৌড়ে গেলাম জনের দিকে। ও ঘড় ঘড় করে পানি খাচ্ছিল আর ঘামাচ্ছিল। ওর ফর্সা চেহারার দুই পাশ, গালের অংশ, যেটাকে আমরা চিক্ বলি ওই খানে দুইটা ব্যান্ডেজ। আমি অবাক। এই কি! ‘কী হইছে তোর গালে?’ জন পানির গ্লাস রেখে হাসে, জিজ্ঞেস করে, ‘কেমন আছিস?’
‘গাল কাটছে ক্যামনে? যে জায়গায় ব্যান্ডেজ, ওইখানে তো সেভিং রেজার যাওয়ার কথা না। তাইলে?’
জন আবার হাসে। আমি তার উত্তর পাই না, সে-ও আমার উত্তর পায় না। কিন্তু প্রশ্নের পিঠে প্রশ্নের এক অদ্ভুদ টার্মিনালে বাসেরা জমা হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত চা খেতে খেতে জন যা বললো তা অনেকটা এরকম: ও মিরপুরের পীরেরবাগ বাসায় ফেন্সিডিল আর ক্যানাবিস খেয়ে ফিরেছে। বাসায় তার সৎ, সরকারি আমলা পিতা ঘরে নেই ভেবে, ভলিয়াম ফুল বাড়ায়া পিঙ্ক ফ্লয়েড শুনছিল, লার্নিং টু ফ্লাই। ‘শোন ওই সময়–এ ফ্যাটাল অ্যাট্রাকশন ইজ হোল্ডিং মি ফ্যাস্ট/ হাউ ক্যান আই এসকেপ দিজ ইরেজিসটেবল গ্রাসপ–শুইনা আমি য্যান শূন্যে ভাসতে থাকলাম। আমার রুমের আয়নাটা দেখছিস না। ওইটার সামনে গিয়া দাঁড়াইলাম। মনে হইলো গাল দুইটাতে ব্লেড দিয়া স্টার আঁকি। ব্লেড নিলাম। তারপর ছয়টা করে দাগ পোচলাম, আমার একটুও ব্যাথা লাগে নাই। কিন্তু রক্ত দেইখা আঁৎকাইয়া উঠলাম, ওই সময়ই সচিব সাহেব ঢুকলেন। আমারে দেইখা তো গালাগালি। জ্যোতির লগে তুলনা দিছে, আমার ছোট ভাই জ্যোতি, মনে নাই? ওই পুচকা পোলার কাছ থেইকা নাকি আমারে ভালো মানুষ হওন শিখা লাগবো! মেজাজটা এমন খারাপ হইছে সিলিং ফ্যান বাইড়াইয়া ভাইঙ্গা বাইর হয়া পড়ছি। কইয়া আইছি আর বুয়েটে যামু না পড়াশুনা শ্যাষ। এরপর এক চোটে বাসে জাহাঙ্গীরনগর।’
তারপর আবার একটা মুচকি হাসি। জোরে হাসতে পারে না ব্যান্ডেজের চোটে। আমারে জিজ্ঞাস করলো, ‘রাহিদ কই, রাহিদরে দ্যাখছো আজকে?’
রাহিদ আর জন ক্যাডেট কলেজের ব্যাচ মেট। ক্যাডেট ছেড়ে দুইজন দুই উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হলেও, দুজন এখনও ডাইল-গাঁজার ব্যাচমেট। ওরা গাঁজার আবেশে আবেশায়িত হয়ে অনেক অনেক পরিকল্পনা করে। বিনয় মজুমদারের পোস্টার বানাবে ‘ফিরে এসো চাকা’। গায়ত্রী চক্রবর্তী, যিনি দেশের বাইরে গায়ত্রী স্পিভাক নামে পরিচিত, সেই নারী কেন বিনয়ের মতো এমন নিবেদিত প্রেমিককে বিয়ে করলেন না–এটা তাদের দৈনন্দিনতার অনেক আজগুবি, বে-বাস্তব, বাস্তব আলোচনার একটা নিয়মিত নির্ধারিত অংশ।
এর মধ্যে বেশ কিছু মাস চলে যাওয়ার পর আমি উমার রুমে আবিষ্কার করি গীতবিতান। খুব সুন্দর হাতের লেখায় লেখা, ‘তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।’ নিচে ছোট্ট করে লেখা ‘-জাহিদ ভাই’। উমাকে তার ৪০৬ নম্বর রুমের বেড থেকে উঠিয়ে এ প্রশ্ন করতে আমার লেগেছিল ঘণ্টা দুয়েক। ভর দুপুর বেলা। আর ও ঘুমায়। শুধু ঘুম না, ঘুমের ঘোর। অনেক চিল্লা-চাল্লা দিয়া যখন তারে উঠায়া বসালাম, তখন সে ঠিক মতো বসতে পারে না। বডি সোজা থাকে তো মাথা ঝুলে পড়ে অথবা মাথা সোজা থাকে তো বডি কুচকায়া যায়। ঘটনার মুশকিলে পড়ে তাকে একটা কড়া থাপ্পড় দিলাম। চোখ খুললো, জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হইছে?’
একটা এপনিল খাইছি।
ক্যান?
বইটা দ্যাখছিস?
জাহিদ ভাই আমারে ভালোবাসে বলছে আজকে।
সমস্যা কী? তাতে ঘুমের ওষুধ খাওয়ার সম্পর্ক কী?
আমি বুঝতাছি না কী বোলব। ক্যামন প্যাচ-ঘোচের চক্কর লাগতেছে।
তুই কি জাহিদ ভাইকে ভালোবাসিস?
বুঝতেছি না।
জাহিদ ভাই কই এখন?
সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনে দাঁড়ায়া আছে। আমার অ্যানসার শুনতে চায়।
কতক্ষণ থেকে দাঁড়ায় আছে?
সকাল সাড়ে ৯টা থেকে। ইউনিভার্সিটির বাসে করে নামলাম ডিপার্টমেন্টের সামনে। দেখি জাহিদ ভাই। হাতে গীতবিতান। আমাকে ডাকলেন। গীতবিতান খুলে তার লেখাটা দেখালেন। বইটা নিতে বললেন, আমি নিলাম। তারপর থেকে মাথা ঘুরতাছে। ক্লাস বাদ দিয়া হলে চইলা আসছি। মাথায় কিছুই কাজ করতেছে না দেইখা একটা এপনিল খাইলাম।
সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দাঁড়ায়া আছে? এখন বাজে দুপুর আড়াইটা। তোমার প্রেমিক চম্পট দিছে। চলো ক্যান্টিনে গিয়া খায়া আসি। তারপর রিকসায় ঘুরবো।
উমা চুপ করে বেডশিটের রঙ দেখতে থাকলো। কোনো জবাব না দিয়ে দুই হাঁটুর ভাঁজের মধ্যে গাল এক কাত করে আমার উল্টা দিকে খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর হঠাৎ করে বললো, ‘শুন, জাহিদ ভাই যায় নাই।’
ক্যামনে বুঝলা?
এম্নিই। চল প্রথমে রিকশায় ঘুরি, তারপর ডেইরিফার্ম গেটে গিয়া ভাত খাব।
রিকশা সেন্ট্রাল লাইব্রেরির কাছে আসতেই আমি দূর থেকে দেখলাম ঝুটিবাঁধা এক ভাবুক প্রকৃতির পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়ানোর পুরো ভঙ্গিতে অপেক্ষা। হল থেকে বেরিয়ে আমাদের প্রথম চক্করটা প্রান্তিকের দিকে দেয়ার কথা ছিল, কিন্তু উমার রিক্যুয়েস্টে সেটা ট্রান্সপোর্ট হয়ে সেন্ট্রাল লাইব্রেরির দিকে যেতে হলো। উমা রিকশা থামিয়ে হেঁটে গেল জাহিদ ভাইয়ের কাছে। একটু পর ফিরে এসে বললো, ‘চল পরিচয় করিয়ে দেই।’
‘জাহিদ ভাই, ও হলো মায়া। আমার খুব ভালো বন্ধু। আর জাহিদ ভাই আর্কিটেকচারে পড়ে।’
আমি একটা ছোট্ট টা-টা বলে রিকশা নিয়ে এলোমেলো ঘুরতে থাকলাম–প্রেম মানে তো বিয়ে না, তাই না? প্রেম মানে তো শারীরিক সম্পর্কও না, আর শারীরিক সম্পর্ক থাকলেই বা কী! মানে তো এই না, আমি বিয়ে করতে বাধ্য–ট্রান্সপোর্টের লেকের তলার সিঁড়ি থেকে পানির টপ টপ শব্দে পড়া জলগোলক গোনা শুরু হলো আবার মনে মনে। আচ্ছা ওই জলগোলকের ভেতর তো বে-নি-আ-স-হ-ক-লা থাকে। সাতরঙ, বর্ণমালা, বাংলা ফাইভ, শচীন দেব বর্মন। ‘না আমারে শশী চেও না/চেও না চেও না চেও না…না!…’ এইসব করতে করতে বিজ্ঞান কারখানার সামনে এসে দেখি বন্ধ সাঁটারে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে লিমন। খায়রুল হাবিবের উল্লাস পীরের মজমা পড়ছিল আর চিৎকার করছিল। ওখানে জনের বন্ধু রাহিদ ছিল, যে একজনকে ভালোবেসে, সেই মেয়ে এক ধনী ছেলেকে বিয়ে করার শোকে কাতর। রুমে মোম জ্বালিয়ে অপেক্ষার কথা শোনায় নাকি। এটা নিয়ে এমএইচ হলের মাকড়শার জাল ছুঁয়ে ফ্লোরের তল পর্যন্তও নাকি গল্প চালু আছে। তবে এখন খানিক ফিকা। বিশ্বজগতে এখন পরাজিত প্রেমে জ্বলা কয়লার কার্বন ফরটিন ডেটিং নির্ণয় পদ্ধতিতে এর সময়কাল জানা গেছে নাকি মাত্র কয়েকদিন। অবশ্য ‘নাকি’সহ সময়কালটা স্বতসিদ্ধে সিদ্ধ রূপ নিছে কথিকার এক ইনফরমেশনে। ও আমাকে একদিন মুক্তমঞ্চের পেছনে ডেকে নিয়ে বলেছিল, ‘জান, রাহিদ না রুবামার প্রেমে পড়ছে।’ কথিকা কি রাহিদকে চাইছিল? প্রশ্ন করা হয় নাই। তবে এটা ঠিক অপেক্ষার আতরে আতরায়িত হতে হতে একদিন ট্রান্সপোর্টের সুপারিতলায় রাহিদ রুবামাকে বলেছিল, ‘তুমি কবিতা।’ এরপর তাকে কবিতার বই পড়তে দিতো। বিনয়ের কবিতা শোনাত, আবুল হাসান শোনাত আর ডাকতো ‘হেই গার্ল ফ্রম টুমরো, হাউ আর ইউ?’ অল্প কয়েকদিনেই রুবামা তার আরাধ্য হয়ে উঠেছিল। রুবামা তখন ওই গ্রুপটার সাথে মিশে গিয়েছিল। সমাজ ভাঙনের পা ফেলা মিছিলটা তখন ভেতরে ভেতরে দুই গ্রুপ হয়ে গেছিল। এক গ্রুপ সমাজতান্ত্রিক সন্ত আর আরেক গ্রুপ জুলেখা সিরাপ খেয়ে ‘যে একা সে ভীড়’ এমন অ্যালিয়ানেইশন আর যৌথতার দ্বন্দ্বের খাতায় নাম লেখায়। ওই গ্রুপটারই নির্ধারিত জায়গা বিজ্ঞান কারখানার সাটার নামানো খরখরে দুপুর বা আলো-আঁধারির রাত। ওই গ্রুপ মার্কসীয় গণসঙ্গীতের বদলে জাহিদ পাপ্পুর গান গায় ‘আমি যারে ভালোবাসি/তারে আবার বাসি না/তারে ভালো লাগে না/লাগে না গো…।’
রুবামা প্রায়ই যে কাজটা করতো, বিজ্ঞান কারখানার নামানো সাঁটারে ঠেস দিয়ে, পা মেলে লিমনের পাশে বসে, কাঁধে মাথা রেখে, পরবাসে বসবাস পড়তো। মুস্তফা আনোয়ার মলি-ল্যাজারাসের এমন বিধ্বংসী প্রেম কেমন করে লিখলো ভাবতে ভাবতে লিমনকে বলতো ‘চল্ আবার পড়ি; আমি মলি, তুই ল্যাজারাস।’
‘আয় পারফর্ম করি। কাব্য নাটক না!’
একদিন এইসব দেখে ফেললো রাহিদ। প্রতিযোগিতায় না গিয়ে জন আর রাহিদ কবিতা লিখে নিয়ে আসতে থাকলো ওইখানে। কবিতায় ভাসতে ভাসতে একটা অনুচ্চারিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়ে গেল তিনজনের মধ্যে। ত্রিভূজ জ্যামিতিক প্রেম। রুবামা কি এটা প্রেমসুলভ এনজয় করতো নাকি বন্ধুসুলভ মহব্বতে মিছিল শেষেই বিজ্ঞান কারখানার মৌচাকে এসে জমতো–এটা অবশ্য বোঝা যেত না। কারণ ও বেশিরভাগ সময় হয় জুলেখাসিরাপপায়ীদের সাথে থাকতো, নইলে ঢাকায় চলে যেত ভোরবেলায়; অনেক রাতে হলে ফিরতো। ওকে জিজ্ঞেস করার সময় পাওয়া যেত না। তবে রুবামাকে মনে হতো সব সময়ই আক্রান্ত-বিভ্রান্তের উল্লাসময় ফটোগ্রাফ। কিন্তু ধীরে ধীরে রাহিদ রুবামার ব্যাপারে জনের গাওয়া সঞ্জীব চৌধুরীর গানের মাদকতা আর লিমনের অদ্ভুদ সুন্দর দরদী আবৃত্তির প্রেমজ পিয়াসকে টেক্কা দেয়া শুরু করে দিছিল। মানে ‘চাই-ই চাই’র দশা তার। কবিতা ঠাসা ভালোবাসা, ফটোগ্রাফি, পোস্টার বানানোর প্ল্যানের মধ্যে, মিছিলের মধ্যে, দেয়ালে চিকা মারার মধ্যে আর সংগঠনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় শাখার বরাদ্দ গণচাঁদা তুলবার মধ্যে প্রেম প্রেম গন্ধরাজ ছড়িয়ে দিতে থাকলো সে। রুবামা সুবাস নিত। রুবামা কাঁঠালিচাঁপা নাকে ঠেসে রাহিদের চোখের ভেতরকার লম্ফমান প্রেম দেখতে দেখতে আরাফের গালের ওপর তার গাল অনুভবের রোমাঞ্চ বানাতো। আরাফও ফটোগ্রাফি করে। রুবামা আরাফকে ভালোবাসে কি-না কে জানে, আরাফ তাকে জান দিয়ে ভালোবাসে, ওটা রুম্পার বুঝতে বাকি থাকে না। রুম্পা এই তথ্য মোটামুটি সবাইকে একই ভঙ্গিতে জানিয়ে দিয়ে, রুবামার প্রেমিকদেরও বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিল, ‘আর যাই কর, রুবামার সাথে যাইস না।’ রুম্পার আম্মুসুলভ আবেদন কোথাও কোথাও খেটেছিল, তবে সেটা ছিল পজ, কিন্তু রাহিদ পজ-টজে নাই, ও রানিং মিউজিক, র্যাগে মিউজিকের মতো। কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই (পরিকল্পনা বেশি করলে পস্তাতে হয়, তাই যখনই জাগিবে চিত্ত, তখনই দুলিয়া ওঠ–এটা বিশ্বাস করতো সে।) রাহিদ কাঁঠালিচাঁপা হাতে নিয়ে রুবামার গাল ছোঁয়ালো। রুবামা তখন গালে আরাফের গাল ঘষার স্পর্শ পেতে থাকলো। সে তখনো রাহিদের চোখের গোল ব্যাসে ভালোবাসার কৌণিক দূরত্ব মাপতে থাকলো আর আরাফের পিঠে কৃষ্ণবর্ণ চাঁদ থেকে রুপালি আলো চুষে চুষে মদির হওয়ার স্মৃতি টানতে থাকলো। আরাফ তার স্তনের এপার ওপারে চুমুর উল্কি এঁকে দিতো। যতবার ব্রা খুলতো রুবামা, ততবার ওই উল্কিতে তাকিয়ে থাকতো আনমনা। একবার আরাফেরই প্রস্তাব ছিল, ‘চলো দুইটা রুপালি রিং বানাই।’
‘মানে?’
‘মানে একটা তোমার নাভীতে থাকবে আরেকটা জলপদ্মের প্রবেশ পথে, এরপর আমরা সেক্স করবো। দুরন্ত-দুর্বার-উন্মাদনায়। কেমন আইডিয়া?’
বিজ্ঞান কারখানার বন্ধ সাঁটারে ঠেস দেয়া আলোচনায় এখন কবিতার চেয়ে বেশি জায়গা করে নিয়েছে সমসাময়িক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি। এত দুর্নীতিবাজ ধরেও শান্তি নাই। চালের দাম কমে না। আবার সরকার কী কী সব নীতি বাস্তবায়ণের ঘোষণা দিচ্ছে, তথ্য অধিকার আইন, কমিউনিটি রেডিও করার প্রস্তাব, নারী উন্নয়ন নীতি, , , ইত্যাদি ইত্যাদি। হুট করে ইউরেকা, যে নিয়মিত বিজ্ঞান কারখানার আগুন্তক, বেশিরভাগ সময়ই চুপ মেরে বসে থাকা ছাড়া তেমন মত দেয় না; সে হুট করে বলে ফেললো, ‘হেই খালেদা সরকার না একটা ছাগল উন্নয়ন জাতীয় কী একটা করছিল? নারী উন্নয়ন নীতি কি সে জাতীয় কিছু একটা? মায়া এবং রুবামা এবং উমা একসঙ্গে প্রতিবাদ করলো ঠিকই, কিন্তু নারী প্রাণীটি যে আজ পর্যন্ত সংখ্যালঘু, প্রতিবন্ধীদের মতো বিশেষ একটা প্রজাতিই রইলো, মানুষ ভাবলো না এই ‘বালের রাষ্ট্র’ –ইউরেকার প্রতিবাদ করতে করতে নিজেরাই মর্মান্তিক ক্ষোভের আলোচনায় ঢুকে পড়লো। ইউরেকা বলতে থাকলো, ‘বুঝলা আমরা হইলাম বাংলা সিনেমার স্যাক্রিফাইসিং জেনারেশন। মানে বাংলা সিনেমায় দেখিস না হিরোরে ভিলেনগুলি করতে আসলে সাইড প্রেমিকা বা বড়, নইলে ছোট ভাই সামনে খাড়াইয়া গুলি খায়, হিরো বাঁইচা যায়। আমরা হইলাম এই স্যাক্রিফাইসিং জেনারেশন। আমগো বাপের জেনারেশনে অনেক হিরো ছিল–জহির রায়হান–মুনির চৌধুরী–সেলিনা পারভীন–জাহানারা ইমাম। আমাদের জেনারেশনে নাই, হইবো-ও না। দুনিয়ার সব জায়গায় কিছু কিছু জেনারেশন যায়, হিরোর পয়দা দেওনের লাইগা বাংলা ছবির স্যাক্রিফাইসিং সাইড ক্যারেক্টার হইয়া যায়। আমার অবজারভেশন কিন্তু রাইট, কী বলিস? তোরা আমার এক বছরের জুনিয়র, চোখ বন্ধ কইরা থিওরিটা মাইনা নে। সমাজটা তো কুঁড়েঘর না, লাত্থি দিয়া ভাইঙ্গা ফালামু। এইটা কংক্রিটের শক্ত দেয়াল। বলে সে গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে বলতে থাকলো ‘এই সমাজ ভাত দেয় না/এই সমাজ ভাঙতে হবে/ভাঙতে গেলেই বাঁধবে লড়াই/সেই লড়াইয়ে হবো সাইড ক্যারেক্টার।’
‘স্যাক্রিফাইসিং।’ ‘সাইড।’ ‘ক্যারেক্টার।’ থেমে থেমে উচ্চারণ করে আবার আগের জায়গায় বসে পড়লো ইউরেকা। রুবামার খুব পছন্দ হয়েছে, মায়ারও খুব পছন্দ হয়েছে ডায়ালগগুলা। কেবল উমা উদাস। ওর কোনো বিকার নাই, উন্মাদনা নাই।
এরপর আবার লিমন একটা স্টিক ধরায়া বলা শুরু করলো, ‘শোন্ সবাই, আরে আমরা হইলাম কুকিল। আমাদের চক্ষু লাল। খালি চোক্ষে সাটার নামাইয়া রাখি। যে যারে চোদে চুদুক, যে না খায়া মরে মরুক। আমগো কী? আমরা হইলাম কুকিল। সুসময় আইলে কু-উ-উ কু-উ-উ ডাকুম। বসন্তের সাইরেন।’
রাহিদ নাই। রাহিদ এখন আর বিজ্ঞান কারখানার আড্ডায় আসে না। ও থাকলে একটা ঠাঃ–ঠাঃ–ঠাঃ হাসি দিয়া মোটা ঠোঁট দুইটারে গোল করে কু-উ-উ-উ ডাক শুনাতো। কিন্তু আহা রাহিদ নাই। রুবামার কিছু যায় আসে না। ও লেফট-রাইটের মতো মার্চ করতে থাকলো ‘স্যাক্রিফাইসিং ক্যারেক্টার। সাইড ক্যারেক্টার।’ একবার ফুট সাতেক দূরে যায় আবার ফিরে আসে। আবার যায়। আবার যায়। আবার আসে। আবার আসে।
উমার এসব ভাল্লাগছিলো না। তাগাদা দিচ্ছিল অনেকবার। হলে ফিরে যাবার জন্য। ওর এখন রাতে বেশি থাকতে ভাল্লাগে না। মাস ছয়েক হলো বিয়েও করে ফেলেছে। যথারীতি এক হিন্দু ছেলেকে। স্থাপত্য বিভাগের জাহিদ ভাইয়ের সঙ্গে কী এক অজ্ঞাত কারণে আগায় নাই। তার সাংবাদিক স্বামী রোজই সান্ধ্য আইনের মতো নিয়ম করে রাত ৯টায় ফোন করে, বউটা কেমন আছে?
উমার এসব ভাল্লাগে না। কেন জানি। তার সাংবাদিক স্বামীর অনেক গুণ। ভালো তবলা বাজায়, ছবি আঁকে, অসাধারণ গায় আর অনেক অনেক নাকি লিখে পত্রিকায়। কিন্তু উমার এতে মন বসে না। উমা উদাস হয়ে যায়। আকাশ দেখে। ঘাস দেখে। ক্ষুদি পানা পানিতে চুবিয়ে রোদের ঝলকের রুপালি রূপের ঝলমলি দেখে আনন্দে হাসে। মাঝে মাঝে ভোরে গোলাপী রঙের শাপলা তুলে নিয়ে আসে লেক থেকে। উমার মনে শান্তি নাই। একটা ছটফটানি। ছটফটানি।
এরপর একদিন ঢাকাইয়্যা আড্ডার আড্ডাখানা আজিজ মার্কেট থেকে রিকশায় ফেরত যেতে যেতে আমরা পাইকপাড়ায় চলে যাই। একটা জ্বিলাপীর দোকানে জ্বিলাপী খেয়ে আবার রিকশায় ঘুরি। অবিকশিত মফস্বল মার্কা রাজধানী শহরের গলিতে গলিতে রিকশা চক্কর মারতে মারতে উমা হঠাৎ আমার হাত চেপে আর্তস্বরে প্রশ্ন করলো, ‘আচ্ছা মায়া জাহিদ ভাইয়ের নামের শেষে চক্রবর্তী থাকলে কী হইতো অথবা আমি তোর মতো, তার মতো মুসলমান হইলে কার ক্ষতি হইতো?
আমি রিকশাওয়ালার গেঞ্জির ছেঁড়া গোল ফাঁকে বাতাসের নড়চড় দেখতে থাকি। ট্রান্সপোর্টের লেকের ধারের বাঁধানো সিঁড়ি থেকে চুইয়ে পড়া পানির গোলক আবার ফিরে আসত থাকলো আমার ভেতর। এবার সাদা জলগোলকের বদলে পড়বে লাল রঙের জলগোলক। টপ্ ট্প টপ্ টপাটপ্ টপ্টপ্টপ্…লাল টপাটপ্।
ঢাকা, ৭/৪/৮
===========================
গল্প- আলিমের নিভৃতিচর্চা by রাশিদা সুলতানা গল্প- প্রত্যাবর্তন: আমার ‘ফেরা’ নিয়ে যে কাহিনী না ..মানষ চৌঃ গল্প- 'বীচিকলায় ঢেকে যায় মুখ ও শিরোনাম' by আনোয়ার ... গল্প- 'প্রীত পরায়া' by সিউতি সবুর গল্প- 'চলিতেছে' by মাহবুব মোর্শেদ গল্প- 'গোপন কথাটি' by উম্মে মুসলিমা গল্প- 'রূপকথা' by লুনা রুশদী সঞ্জীব চৌধুরীর কয়েকটি গল্প গল্প- 'অস্বস্তির সঙ্গে বসবাস' by ফাহমিদুল হক গল্প- 'মঙ্গামনস্ক শরীরীমুদ্রা' by ইমতিয়ার শামীম গল্প- 'হাজেরার বাপের দাইক দেনা' by জিয়া হাশান গল্প- ‘অপঘাতে মৃত্যু’ ও ‘সাদামাটা’ by লীসা গাজী গল্প- 'দ্বিতীয় জীবন' by ইরাজ আহমেদ গল্প- 'পুষ্পের মঞ্জিল' by সাগুফতা শারমীন তানিয়া গল্প- 'একশ ছেচল্লিশ টাকার গল্প' by কৌশিক আহমেদ গল্প- 'একে আমরা কাকতালীয় বলতে পারি' by মঈনুল আহসান.. গল্প 'গহ্বর' by জাহিদ হায়দার গল্প- 'পুরির গল্প' by ইমরুল হাসান গল্প- 'নওমির এক প্রহর' by সাইমুম পারভেজ গল্প- 'মরিবার হলো তার সাধ' by আহমাদ মোস্তফা কামাল গল্প- 'নিষুপ্ত শেকড়' by নিরমিন শিমেল
bdnews24 এর সৌজন্যে
লেখকঃ শামীমা বিনতে রহমান
এই গল্পটি পড়া হয়েছে...
লেখকঃ শামীমা বিনতে রহমান
এই গল্পটি পড়া হয়েছে...
No comments