গল্প- 'নগর পিতা বৃষ্টি নামান' by অদিতি ফাল্গুনী
ক.
কিছুদিন হয় সেই নগরে কোন বৃষ্টি হচ্ছিল না। কিছুদিন বলতে টানা এক মাস কোন বৃষ্টি নাই। চৈত্রের মধ্য হতে বৈশাখের মধ্যভাগ…নগরবাসী দেখে শুধু সকাল হতে তেতে ওঠা সূর্য, সকাল এগারোটা হতেই গনগনে গরম লু হাওয়ার আঁচ, হাওয়ার সাথে সাথে দুপুর নাগাদ পাক খেয়ে উড়তে থাকা ধূলার শুনশান বিভীষিকা আর তারও চেয়ে ভারি ও স্তব্ধ, নিরেট সন্ধ্যা আর রাত্রি! বলতে কী, গোটা দেশেই গরম পড়েছিল খুব। তবু, সমুদ্রের নিকটবর্তী দেশের দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পূর্বাংশের শহর ও গ্রামগুলোয় যদি বা এর ভেতর দু/একটা সপ্তাহ এক/দু’দিন হলেও বৃষ্টি হয়েছে…দেশের উত্তরাঞ্চলের এই প্রধান শহরে গত একমাস ধরে বৃষ্টি দূরের কথা, প্রতিবছর গরমের সময়টা গরমের অনুষঙ্গ হিসেবেই যেমন অন্ততঃ তিন/চারদিন গুমোট গরমের পর হঠাৎই একদিন কালবৈশাখীর ঝড় ওঠে, বাতাস গরম হতে হতে একদিন নিজেই ঠাণ্ডা ও শিলীভূত হয়ে পড়ে প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মে এবং তারপর এক ফোঁটা, দু/ফোঁটা করে ধীরে ধীরে দেখা দেয় বৃষ্টি কী শিল পড়ে, আকাশ হতে ঝরে পড়া সেই তুষারকণা জিহ্বায় আস্বাদ করে শিশুরা…সেবার তা-ও হচ্ছিল না! রাস্তাঘাটে মানুষ গরমে হঠাৎই নুয়ে পড়ছিল অচৈতন্য। পশু-পাখিদেরও নিস্তার মিলল না সেবারের গরমে। শহরের পাশ ঘেঁষে বয়ে চলা দেশের একসময়ের সবচেয়ে বড় নদী আর বর্তমানে যে নদীতে জল একদমই নিস্তরঙ্গ পড়শি দেশের দেওয়া একটি প্রকাণ্ড বাঁধের কারণে…যে বাঁধ নিয়ে প্রতিবছর পড়শি দেশের কূটনীতিকদের সাথে এদেশের কূটনীতিকরা ঝাণ্ডা খাড়া করে বৈঠক করেন এবং শিশুরাও জলের কিউসেক জাতীয় পরিভাষা শিখে ফ্যালে…এবছর সেই বড় নদী হয়ে উঠেছিল নিতান্ত নালা…তার ওপর বিদ্যুৎ এই আসে কি যায়, ধানের চারাও মানুষের মতো বা মানুষ ধানের চারার মতো নুইয়ে পড়ছে বৃষ্টিহীন ঠা-ঠা- রোদে…তেমন একদিনে উত্তরের প্রধানতম নগরীর সদ্য নির্বাচিত নগর পিতা তার পারিষদদের সবাইকে নিয়ে তদানীন্তন নগর ভবনে চলমান খরা পরিস্থিতি মোকাবেলায় আশু করণীয় বিষয়ক একটি বৈঠক ডাকেন।
এখানে বলে রাখা ভালো যে উত্তরের প্রধান শহরের সদ্য নির্বাচিত এ নগর পিতা বয়সে অতিশয় তরুণ। সত্যি বলতে তিনি নির্বাচিত হবার পর সবাই কপালে চোখ তুলে বলেছিল, ‘হা-হা-মজার কাণ্ড বঠে! ই কে নগর পিতা কে ব্যুলবে? নগর ভাই বেরাদার বলা যায়!’ রসিক জনেরা আরো এক কাঠি সরেস হয়ে মন্তব্য করেছিল এতদিন বয়োবৃদ্ধ যে নগর পিতাদের স্ত্রীরা স্বামীদের পদমর্যাদার দরুণই ‘নগর মাতা’ পদটি অলংকৃত করেছেন, এই তরুণের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী বিয়ের ঠিক যতদিন ন্যূনতম ব্যবধানে একজন নারী সন্তানসম্ভবা হতে পারে…সে ক’টা দিনও অতিবাহিত করেনি…তাকে কী করে ‘নগরমাতা’ বলা যায়? তাকে ‘নগরভাবি’ বলাই কি অধিকতর যুক্তিযুক্ত নয়? তা এই সদ্য নির্বাচিত নগর পিতা বয়সে নিতান্ত তরুণ। মাত্র ত্রিশ বছর বয়স। উত্তরের প্রধান শহরের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের কদিন আগেও নামী বামপন্থী ছাত্র নেতা ছিলেন। লোকে বলে গোটা হেগেল ও মার্ক্স-লেনিন-মাও রচনাবলী তার ঠোঁটের আগায় থাকতো বা এখনো পর্যন্ত আছে। বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের সূচনা অবশ্য তার বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম বর্ষে পড়ার সময় ছত্রিশ বছর আগের এক যুদ্ধের নরহত্যাকারী বাহিনীর বর্তমান সদস্যদের সাথে সরাসরি আর্মড কাউন্টার অ্যাকশনে জড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে। তিনি ছাত্র অবস্থায়ই জেলে গেছেন ছয়বার, তাঁর বিরুদ্ধে সরাসরি খুনের অভিযোগ আছে মোট আঠারোটি (যদিও প্রতিটি হত্যাই বৈধ বলে সাধারণ মানুষ মনে করে) যার এগারোটিরই আছে প্রচুর প্রত্যক্ষ ও আইনসিদ্ধ প্রমাণ, তিনি সুদর্শন ও নারী মনোহর হিসেবে পরিচিত হলেও কৈশোর বয়সের নিতান্ত সাদাসিধা চেহারার প্রেমিকাকেই দীর্ঘ প্রেমের পর বিয়ে করেছেন বলে জনশ্র“তি রয়েছে। একমাত্র তার জন্যই উত্তরের প্রত্যন্ততম গ্রাম হতে যে ক্ষুদ্র কৃষকের ছেলে বাবার শেষ জমিটুকু বিক্রি করে মধ্যবিত্ত হবার বাসনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছিল, তেমন সব ছাত্রও পড়া ছেড়ে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছে বলে শোনা যায়। একটি অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত ও অর্থবান পরিবারের তিনি কনিষ্ঠ পুত্র যে পরিবারটি দেশের দুটো বৃহৎ বুর্জোয়া দলের অপেক্ষাকৃত লিবারেল ও সাংস্কৃতিক চেহারাসম্পন্ন অংশটিকে সমর্থন দিয়ে এসেছে আগাগোড়া। একমাত্র তিনিই নিয়ম ভঙ্গ করে সেই বাম দলে যোগ দিলেন যারা লিবারেল বুর্জোয়া দলের ছাতা হিসেবে কাজ করে না। তবে, বুর্জোয়াদের লিবারেল অংশটুকু এই ভেবে স্বস্তি পেত যেহেতু বাম ছাত্র নেতারা শেষ জীবনে তাদের দুটো বুর্জোয়া দলের যে কোনো একটিতে যোগদান করে এবং এই পরিমাণ পড়াশুনা করা ও বিশেষতঃ ছত্রিশ বছর আগের যুদ্ধের নরহত্যাকারী বাহিনীর বর্তমান সদস্যদের সাথে সরাসরি আর্মড কাউন্টার অ্যাকশনে জড়িয়ে পড়ার কারণেই এই তরুণ তাদের দলেই যোগ দেবে। মূলতঃ একারণেই বুর্জোয়াদের লিবারেল দলটি টানা বছর বিশেক ক্ষমতাহীন থাকার পর একবার ক্ষমতায় এসেও তার একটি মামলা নিয়েও ফাইল নাড়াচাড়া করেনি। গেরোটা বাঁধল আরো বছর পাঁচেক পর। বুর্জোয়াদের রক্ষণশীল দলটি পরের দফায় ক্ষমতায় এসেই প্রথম যে কাজটি করে তা হলো সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশ দিয়ে ছাত্রনেতার বাড়ি ঘেরাও করে সরাসরি প্রস্তাব পাঠায়। হয় ক্ষমতা ও রাজ্যভোগ অথবা নিশ্চিত ফাঁসি। আরো বিশেষতঃ ক্ষমতায় যেহেতু তাদের রাজনৈতিক সহযোগি হলো বহু আগের যুদ্ধের নরহত্যাকারী বাহিনী।
কিংবদন্তি আছে ছাত্রনেতা ও পরবর্তী সময়ের নগরপিতা শেষোক্তটি বেছে নেন। হতচকিত রাজনৈতিক সাথীদের কাউকে কাউকে তিনি এই বলে বোঝাতে সক্ষম হন, ‘বিপ্লব আসবে আসবে করে গত পঞ্চাশ বছরে উপমহাদেশের হাজার নেতা-কর্মী শেষ হয়েছে। এই অপচয় অর্থহীন। যদি আমি বুর্জোয়া দলের প্ল্যাটফর্মে থেকে জনগণের টাকা চুরি হওয়া বাঁচাই? রাস্তা বানাই, স্কুল খুলি কী কৃষককে সেচ আর বিদ্যুতের ব্যবস্থা করে দিই ভাদিমির উলিয়ানভের মতো? গত টার্মে লিবারেল বুর্জোয়াদের দলে যে একমাত্র মহিলা মন্ত্রী কাজ করেছে, যার জন্য দেশের মানুষ খেতে পেরেছে দুবেলা, তিনিও তো বামই ছিলেন, তবে?’
‘কিন্তু, সেই মহিলা মন্ত্রী দেশী ধান দফারফা করে হাইব্রিডে দেশ ছেয়ে ফেলেছেন!’ তার সাথীরা কেউ কেউ প্রশ্ন করেছিল। ছ’ফুট লম্বা, শ্যামবর্ণ, ক্লিনশেভড ও ঘন মোচের এই ত্রিশ বছরের যুবক তখন মুচকি হেসে বলেছেন, ‘তবু মানুষ তো ভাত খেতে পেরেছে কমরেড!’ শোনা যায়, এরপর তার ঘনিষ্ঠতম ছয়জন রাজনৈতিক সহযোগির দু’জন আতাউল ও রেজাউর পালায়, দু’জন সহযোগি সারোয়ার ও রঞ্জন ফাঁসিকাঠে স্বেচ্ছায় ধরা দেয় ও অন্য দুইজন অর্থাৎ ইরফান ও সাব্বির তার সাথে নতুন রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশের মাধ্যমে নগর ভবনের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত হয়। প্রবল গরমে শুকিয়ে আসা দেশের দীর্ঘতম নদীটি নগরের শেষ যে বিন্দুতে গিয়ে শেষ হয়, সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ওপরে ছাত্র-ছাত্রীরা নব্য নগরপিতা ও তাদের এককালের ছাত্রনেতা বা বড়ভাই আবুল কালাম টুকুকে নিয়ে নানা গল্প গেঁথে চলে, ‘টুকু ভাই নাকি সকালেই খোদ নগর ভবন অফিসে বসে তার তিন সহযোগিকে নিয়ে এক ঘণ্টা মার্ক্সবাদের ক্লাস নেন!’
‘মার্ক্সবাদের ক্লাস! দূর! নিজের হাতে যাদের সে কাটছে, আজ তাদের সাথেই কোলাকুলি!’
‘টুকু ভাই নাকি এখন বলছেন যতই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা বলা হোক, তাকে তার দেশীয় পরিপ্রেক্ষিত হতে আলাদা করে দেখলে চলবে না। গ্রামের কৃষক আজো বৃষ্টি পড়ার জন্য ব্যাঙের বিয়ে দেয়, বৃষ্টির ফেরেশতা মিকাইলকে ডাকে…এই ফেরেশতা মিকাইলকে ডাকা হতে শুরু করে ব্যাঙের বিয়ে পড়ানো সব নাকি শ্রদ্ধা করতে হবে। জনবিশ্বাসকে অশ্রদ্ধা করা যাবে না!’
‘আরে এখন পর্যন্ত টুকু ভাই টাকা তো চুরি করা শুরু করে নাই। বা, করলেও শহরের ভাঙা রাস্তাও বাঁধাচ্ছে! বস্তির মানুষকে পানি খাওয়াবার ব্যবস্থা করছে। স্কুল খুলছে কী টিকা দিচ্ছে! টুকু ভাই জিন্দাবাদ!’
‘হ্যাঁ, রিক্সাঅলারা পর্যন্ত টুকু ভাইকে দোওয়া দেয়!’
‘দিত। এখন দিচ্ছে না। এই খরা পড়ার পর থেকে পাব্লিক রোদকে টুকু নামে ডাকছে।’
‘আরে মূর্খ পাব্লিক…বৃষ্টি না হওয়া মানে তো আর দুর্নীতি করা না! বৃষ্টি না হওয়া তো টুকু ভাইয়ের হাতে নাই!’
‘উফ্…কী গরম…আল্লা…কম্যুনিস্ট হোক আর ক্যাপিটালিস্ট হোক…কেউ যদি এখন একটু বৃষ্টি নামাইতে পারত!’
খ.
সেদিনের সকালটাও তেম্নি ক্ষুব্ধ ও খরাময় ছিল। এককালীন কমরেড এবং বর্তমানের নগরপিতা আবুল কালাম টুকু তার পড়ার টেবিলে ঝুঁকে নোট নিচ্ছিলেন। কিম্বা, বলা ভালো কিছু ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন ভাবনাকে একত্র করছিলেন : ‘‘এগারোশ’ সালে আরব ঐতিহাসিক আলবেরুনী ভারতে এসে সংস্কৃত শিখেছিলেন এবং গীতার শ্লোকের সংখ্যা সাতশ’র বেশি এমন একটি হিসাব করেছেন। তিনি তাঁর গ্রন্থে, এমনকি, গীতার কিছু হারিয়ে যাওয়া শ্লোক উদ্ধার করেছিলেন যা প্রচলিত গীতায় নেই। সেক্যুলারিজমের আন্দোলন এই জায়গা হতে শুরু করা এদেশে উদারনৈতিক বুর্জোয়ারাও পারে নি, বামরা তো পারেই নি। …গ্রামের কৃষক কী দ্বান্দিক আর বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র বুঝবে? তার কাছে বৃষ্টির জন্য আজো ফেরেশতা মিকাইলের কাছে সুরা পড়তে হয়। রক্ষাকালীর কাছে জোড়া পাঁঠা বলি দিতে হয়। কিম্বা, লোকাচার হিসেবে ব্যাঙের বিয়ে দিতে হয়। আমি যদি সত্যিকারের জনপ্রতিনিধি হই, তাহলে তাদের বিশ্বাসকে ‘কুসংস্কার’ বলবো নাকি ‘শ্রদ্ধা’ করবো? অবশ্যই বৃষ্টি হয় প্রাকৃতিক নানা নিয়ম মেনে। অবশ্যই ধর্মীয় প্রার্থনা করে বা ব্যাঙের বিয়ে দিয়ে বৃষ্টি হয় না।…
একাকী শীতল শরতে
উত্তর বাহিনী শিয়াঙ নদীর সঙ্গে
কমলালেবুর দ্বীপে
আমি দেখেছি লক্ষ পাহাড়
সর্বত্র লালরঙের পাতায় ধনী,
আর দর্শক সবুজ নদী,
যাতে ভাসছে অসংখ্য তরণী
অসীম অনন্ত আকাশে উড়ন্ত বাজ
আকাশের নিচে জীবন নানা রঙে
স্বাধীনতার জন্য…
শিন্-য়ুবান-চুনের সুরে লেখা এই গানটি চেয়ারম্যান মাও সে তুঙ লিখেছিলেন ১৯২০-২১ সালের দিকে। চাঙ-শা শহরের পাশে শিয়াঙ নদীতে শরতের রাতে জ্যোৎস্না দেখতে দেখতে তিনি এই গানটি লিখেছিলেন। লিখেছিলেন, ‘দেবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ — কী আনন্দ / পৃথিবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ — কী আনন্দ!’ পরে চীনের নেতা হবার পর ভয়ে কবিতা লিখলেও জনসমক্ষে আর প্রকাশ করতেন না।…আমি কী করছি? না, আমি ঠিকই তো করছি! কতদিনে বিপ্লব হতো? কত লক্ষ বছরে রেভল্যুশন আসতো? তার চেয়ে এই যে উত্তরাঞ্চলের বিভাগীয় শহরের আমি মেয়র…সিটি কর্পোরেশনের আওতায় তিনটা সুইপার কলোনির ত্রিশ হাজার মানুষের জন্য গতকাল এক স্বাক্ষরে বারোটা নতুন টিউবওয়েলের সুপারিশ করেছি আমি। তাদের পুরনো টিউবওয়েলগুলো অচল হয়ে পড়ছিল। কোনটা বিপ্লব আসলে? সারোয়ার আর রঞ্জন সারেণ্ডার করে নি। তারা ফাঁসিতে ঝুলল। তারা কি আমাকে বেঈমান বলবে? ওদের মৃত আত্মা?…’
স্ত্রী চা নিয়ে ঢোকে।
‘নোট নেওয়ায় ডিস্টার্ব করলাম না তো?’
‘নাহ্’… তিনি ক্লান্ত ভাবে হাসেন, ‘আজ সকালে ভাল করে পড়া হলো না। অদ্ভুত সব চিন্তা ভিড় করছে মাথায়।’
‘আজ কি তোমার খরা নিয়ে মিটিং?’
‘হ্যাঁ।’
‘তার আগে কি জুমার নামাজ পড়তে যাবে?’
‘ন্ না…মানে হ্যাঁ যাবো আর কি বারোটার দিকে।’
তিনি অস্বস্তির সাথে লক্ষ্য করেন তার স্ত্রী নাজমত আরা শিউলি ভারি অদ্ভুত চোখে তার দিকে চেয়ে আছে। অস্বস্তিই বটে। শিউলির সাথে যখন তার প্রথম পরিচয়, তখন আজান পড়লে শিউলি মাথায় কাপড় দিত। তিনি এ ব্যাপারটা কুসংস্কার বলে শিউলিকে বোঝাতে থাকেন। এক পর্যায়ে শিউলি…তাকে খুশি করতেই…আজান পড়ার সময় মাথায় কাপড় তোলাটা বাদ দিয়ে দেয়। বিব্রত শিউলি তার দিকে তাকিয়েই শেষমেশ মাথায় আর ওড়না দিত না। ক্রমে ক্রমে নামাজ বা রোজা রাখাও কমে এসেছে তার। আজ সেই শিউলি শুক্রবারের জুমার নামাজের কথা শুনে কেমন অদ্ভুত ভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে!
‘গতকাল আলিমুজ্জামান সাহেবের ওয়াইফ ফোন করেছিলেন বিকালবেলা।’
‘কী বলেছেন?’
‘এম্নি কেমন আছি ভাল আছি এই সব জিজ্ঞাসা করলেন। আগামী রবিবার রাতে ওনাদের বাসায় খাবারের দাওয়াত দিয়েছেন।’
শালা আলিমুজ্জামান! ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার এই লোকটি সবচেয়ে ত্যান্দোর প্রকৃতির। গোদাগাড়ি উপজেলার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তপথে গরু হতে ফেন্সিডিল সহ যাবতীয় চোরাই ব্যবসার সে গডফাদার। মুখে আবার সারাক্ষণ আল্লাহ-বিল্লাহ করে। এই শহরের পার্টি পলিটিক্সে সে-ই প্রধান নিয়ন্তা। আলিমুজ্জামানকে বসিয়ে তাকে নগরপিতা করা হয়েছে পিপলের কাছে একটা ফ্রেশ ইমেজের জন্য। খুব চালাক বলেই এই আলিমুজ্জামান এখনো সরাসরি তার বিরোধিতা করা শুরু করে নি। এমনকি প্রচ্ছন্নভাবেও করছে না। যা করছে তাহলো তার চোরাচালান ব্যবসায় মেয়র হিসেবে তিনি যেন কোনো বিরোধিতা না করেন, সেজন্য দলের প্রকাশ্য সমাবেশে নামাজের দাওয়াত দিচ্ছেন কী নিজের বউকে দিয়ে তার বউকে ফোন করাচ্ছেন। এত চালাক লোকটা! ঠিক তিন দিন আগে দলের নগর কমিটির মূল মিটিংয়ে একথা সেকথার পর হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘ভয়ে ভয়ে একটা কথা বলি টুকু ভাই! আগে ত শুনছি কী সব কম্যুনিস্ট না নক্সাল রাজনীতি করতেন। আল্লা-রসুল বয়সের গরমে অস্বীকার করা…আমার নিজের এক ছোটো ফুপাতো ভাই ছিল এমন পাগলা…খুব মেধাবী…সব মানুষকে সমান করবে…আরে, হাতের পাঁচটা আঙুলই সমান হয় নাকি…হেঃ হেঃ হেঃ…এখন লাখো কোটি জনতার খেদমতে নামছেন…একাজে মহান আল্লাহপাক রাব্বুল আল-আমিনের দোওয়া চাই। আসেন, আমাদের…ইয়ে মানে যাকে বলে আপনার তৌহিদী ভ্রাতৃত্ব …আমাদের তৌহিদী ভ্রাতৃত্ব … আগামী শুক্রবার আমার ওয়ার্ডেরই সবচেয়ে বড় মসজিদে জুম্মার নামাজ আদায় দিয়া শুরু করি, কী বলেন আপনারা সবাই?’
‘মারহাবা — মারহাবা!’ মিটিংয়ে উপস্থিত অন্যান্য নেতা-কর্মীরা শোর তোলে।
‘জ্বি, আচ্ছা!’ দাঁতে দাঁত চেপে সম্মত হয়েছিল সে। সম্মত না হলে তার নাস্তিকতার কথা ছড়িয়ে পড়তো।
নাহ্, এদেশে বুর্জোয়া রাজনীতিতে নামলে ধর্মকে মানতেই হবে। এমনকি বাম রাজনীতিতেও ধর্মকে বাদ দেয়া ভুল যেমন অতীতে ভুল হয়েছে। গ্রামের যে ভূমিহীন কৃষক নামাজ পড়ে, তার ঘনিষ্ঠ হতে হলে তার পাশে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করায় কোনো ভুল নাই। তাই বলে এই চোরাচালানী আর মাফিয়া গডফাদার আলিমুজ্জামানের পাশে থেকে নামাজ পড়া? নামাজই নষ্ট হয়ে যাবে! কিন্তু, আলিমুজ্জামানের হাতে শহরের পুলিশ, বিডিআর সবকিছু। এবং তাঁর বিরুদ্ধে আঠারোটি খুনের মামলা এবং ঢাকা হতে পার্টির সেন্ট্রাল কমান্ড তাকে আলিমুজ্জামানের সাথে মিলে-মিশেই কাজ করতে বলেছে।
‘জুমার নামাজে যাবেই যখন, তখন গত সপ্তাহে আমার ছোট আপা আড়ং থেকে তোমার জন্য যে সাদা সূতির পাঞ্জাবিটা এনেছেন…বুকে নক্সী কাঁথা স্টিচ সবুজ আর হাল্কা মেরুন সূতায়…ঐটা তোমার জন্য বের করে রাখি?’
‘রাখো — ’ তিনি তেতো মুখে মাথা নাড়েন।
‘জুমার নামাজের পর কি বাসায় আসবে না সোজা নগর ভবনে মিটিং?’
‘নাহ্…আজ আর আসতে পারবো না। নগর ভবনে মিটিংয়েই খাওয়া হবে।’
‘মিটিং করে কি বৃষ্টি নামাতে পারবে?’
বউয়ের এহেন প্রশ্নে হঠাৎই বিরক্তি ধরে যায় তার। চেঁচিয়ে ওঠেন তিনি, ‘সব কথার ভেতর থেকো না তো! এম্নিতেই হাজারটা চিন্তায় মারা যাচ্ছি!’
শিউলি এই চেঁচিয়ে ওঠাতেও দমে না। বরাবরের শান্ত, বাধ্য ও অনুগত শিউলি সেই অদ্ভুত তেরছা চোখে (এমন চোখে আগে তাকাতো না সে) চেয়ে থাকতে থাকতেই সপ্তাহের অন্ততঃ একটি দিনের দাম্পত্য প্রত্যাশা পেশ করে, ‘সারা সপ্তাহ এত ব্যস্ত। খরার মিটিং এই শুক্রবারই করতে হচ্ছে?’
‘হ্যাঁ — হচ্ছে — কী পরিমাণ ব্যস্ত আমি — তুমি কি ভাবতে পারো যে আমি এই সিটি কর্পোরেশনের মেয়র? গোটা শহরের সব ঝামেলা আমার ঘাড়ে! পলিটিশিয়ান বিয়ে করেছো কেন? কলেজ কী ইনোভার্সিটির প্রফেসরকে বিয়ে করলেই চলতো! যত সব — আর এক কাপ চা দাও!’
রেগে-মেগে অতঃপর আমাদের পৌরপিতা স্নানঘরে ঢুকে শাওয়ারের তলে দাঁড়িয়ে পড়েন এবং মাথা ভেজাতে থাকেন যতক্ষণ স্ত্রীর তেরছা চাহনি ও বাক্য তার মাথা হতে না সরে!
গ.
লোড শেডিংয়ে জুমার আজানে মাইক বন্ধ ছিল। কাজেই জুমার আজান খুব জোরে শোনা যায় না। নগরপিতার উপস্থিতিতেই সাধারণ নামাজিদের ভেতর নগরপিতার লোড শেডিং কমাতে ব্যর্থতা নিয়ে ফিসফাস টিপ্পনি ও হাসি শুরু হয়।
‘মেয়র সাহেব…লোডশেডিংয়ের কী হবে?’ নামাজ শুরু হবার ঠিক আগ মুহূর্তে নামাজের একদম পেছন সারি হতে মুখ ও কণ্ঠস্বর গোপন রাখার সুবিধা নিয়ে কেউ জোরেই প্রশ্ন করে ফেলে।
‘আন আবী হুরাইরাতা রাদিয়াল্লাহ আনহু আন্নাহু ক্বালা ক্বালা রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা ইন্না লিল্লাহি তিস্আ’তাও ওয়া তিস্য়ীনা ইসমান মান আহ্সাহা দাখালাল জান্নাতা’…
ইমাম সাহেব গলা চড়ান, ‘অর্থাৎ হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন — নিঃসন্দেহে আল্লাহ তায়ালার নিরানব্বইটি নাম রয়েছে। যে ব্যক্তি এ নামসমূহ গণনা করে কণ্ঠস্থ করবে ও যিকির করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। উপস্থিত ভাইসকল, আস্সালামু আলাইকুম! আজ আমাদের ভেতর আমাদের এই শহরের মাননীয় মেয়র সাহেব তার তশরিফ রেখেছেন। মাননীয় মেয়র সাহেব আমার বেয়াদবি মাফ করবেন…অতীত জীবনে তিনি কম্যুনিস্ট ছিলেন…যারা নাছারা বেদ্বীন মতাদর্শে আল্লাহ্ ও তার রাসুলের পাক কালাম স্বীকার করে না! অথচ, আজ তিনি আমাদের ভেতর এসেছেন। মহান আল্লাহ তাঁর কালামে পাকে ইরশাদ করেছেন — ফায্কুরূনী আয্কুরকুম — ‘তোমরা আমাকে স্মরণ করলে আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করব।’ সমাগত মুসল্লি ভাইয়েরা, আপনারা নামাজের কাতারে দাঁড়ায় পড়েন। লোড শেডিংয়ের সাময়িক কষ্ট স্বীকার করে আসেন আমরা আল্লাহর দরবারে বান্দা হিসাবে শুকরিয়া আদায় করি! সেই সাথে মহামান্য মেয়র সাহেবের কাছে বিশেষ আর্জি যে অত্র এলাকার বাসিন্দারা এই খরার পাশাপাশি গত একমাস যাবত লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণায় অস্থির। পানিও ঠিকঠাক আসে না! এ প্রায় গোরের আজাবের সমান। তবু, আফযালুয্ যিক্রি যিক্রুল্লাহি — অর্থাৎ, আল্লাহর নামের যিকিরই সর্বোত্তম। আসেন, সবাই নামাজ কায়েম শুরু করি!’
মসজিদের ভেতর ফ্যান বন্ধ। জুমাবার বলে নামাজে অংশ নেওয়া মানুষের সংখ্যা এম্নিতেই মসজিদ ছাড়িয়ে রাস্তায়। এছাড়া খোদ নগরপিতা এসেছেন বলে দলের ছেলেরাও অনেকে যোগ দিয়েছে আজ। গরমে আর ঘামে আর তারও চেয়ে বেশি খোদ নামাজের আসরে লোডশেডিং আর পানি দিতে না পারার সমালোচনায় আমাদের আজকের গল্পের নায়ক এবং এ দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রধান শহরের নগরপিতা দরদর করে ঘামতে থাকেন। পাশে আবার শয়তান ব্যাটা আলিমুজ্জামানের লোডশেডিংয়ের সমালোচনায় মুখে মুচকি মুচকি হাসি! উরে বাবা! ঘাম নামছে ভুরু হতে নাক-চিবুক-গলা হয়ে বুক-পেট-উরু বেয়ে পায়ের নখ অবধি! গোসল আর ওজু কিছুই অবশিষ্ট আছে কি এই গ্রীষ্মে? তিনি বোঝেন যে ঘামে আড়ংয়ের অমন সুন্দর সাদা পাঞ্জাবি, পাঞ্জাবির নিচে গেঞ্জি, পাজামা ও পাজামার নিচে আণ্ডারঅয়্যার…সবই তার ভিজে সপসপ করছে! হে আল্লাহ্, বৃষ্টি কবে নামবে? দু’হাত তুলে মোনাজাত করার সময় চাতক পাখির মতো এমন মনোবাসনাই কি কাতর প্রার্থনাই সম্ভবতঃ তার নিঃশ্বাসের সাথে নির্গত হয়ে থাকবে। মসজিদের গরম হয়ে ওঠা মেঝেতে নতজানু মুহূর্তে মাথা ছোঁয়াতে গিয়ে কান্না এসে পড়ে তার! তিনিও ক্ষমতায় এলেন আর খরাও শুরু হলো! ক্ষমতায় এসে গত একবছরে সাধ্যমতো কী না করেছেন? ক্ষমতায় টিঁকতে কাউকে কাউকে অনেক ছাড় দিতে হচ্ছে তার, কিন্তু নিজে তিনি এখনো পয়সা খাওয়া শুরু করেন নি! সাধ্যমতো এখনো জনগণের ভাল করার চেষ্টা করছেন। খুব বেশিদিন হয়তো পারবেন না। তবু, শহরের রাস্তায় বিচারবোধহীন জনতা রোদকে এখন ‘টুকু’ বলে ডাক দিচ্ছে। কী হবে হেগেল-মার্ক্স-মাওয়ে? কী এসে যায় বিজ্ঞানে? প্রকৃতি নারীর মতোই…এত বছরের চেনা প্রেমিকা কাম বউ শিউলির বদলে যাওয়া তেরছা চাহনির মতোই নিষ্ঠুর…ওরে প্রকৃতি, তুই কি একটু বৃষ্টিও দিতে পারিস না? নাহয় মাত্র এক ফোঁটা বৃষ্টি?
ঘ.
নগর ভবনের ‘খরা পরিস্থিতি মোকাবেলায় আশু করণীয়’ বিষয়ক শুক্রবারের জরুরি মিটিং যা দুপুর সোয়া একটায় শুরু হবার কথা ছিল, তা কার্যতঃ শুরু হলো দুপুর পৌনে চারটায়। নামাজের শেষে ইমাম সাহেব খুতবা পাঠ করেছিলেন আরো কিছুক্ষণ। খুতবায় অচিরেই আল্লাহ তা’য়ালা খরার অবসান ঘটিয়ে বৃষ্টি নামাবেন এমন আশা প্রকাশের পর যথারীতি আবার গোটা শহরের বিদ্যুৎ ও পানি পরিস্থিতি নিয়ে কাতরোক্তি করলেন ইমাম সাহেব। মসজিদে জেনারেটর সাহায্যও তিনি প্রার্থনা করলেন। এদিকে গরম ও টানা বিদ্যুৎহীনতায় মসজিদের ভেতরে দু’জন ও বাইরে ঠা-ঠা রোদে জামাতে অংশ নেওয়া চারজন জ্ঞান হারালো। তখন ‘হাতপাখা আনো রে!’ ‘বরফ আনো রে!’ কী ‘এ্যাম্বুলেন্স আনো রে!’ হৈ চৈ শুরু হলো। এই প্রবল গরমে কোথায় তিনি নামাজ শেষেই পড়িমরি গাড়িতে উঠে সোজা নগর ভবন গিয়ে জেনারেটরে চলা এসি রুমে গিয়ে বসবেন তা না জনপ্রতিনিধি হবার শাস্তি চুকাও! পাঁচজন অচৈতন্য ব্যক্তির কাছেই তাকে দাঁড়াতে হলো। আবার তার কাছে কে হাতপাখা ও ঠাণ্ডা পানি নিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়েও কিছুক্ষণ একটা খণ্ডযুদ্ধ মতো হলো। পাঁচজন সংজ্ঞাহারার তিনজনের জ্ঞান থাকতে থাকতে ফিরল। অন্য কারো কাঁধে ভর করে তাদের হাঁটিয়েই বা রিকশায় তুলে বাসায় নিতে হলো। তিনজনের অবস্থা মারাত্মক। তাদের টেক্সিতে তুলে হাসপাতালে পাঠাতে হলো। বাঙালী পারেও! এর পরপরই তিনি ভেবেছিলেন তার মুক্তি মিলবে। কিন্তু, দেখা গেল মুক্তি অত সহজ বস্তু নয়। মসজিদের সামনের ঠা ঠা রোদে একটি চেয়ারে বসিয়ে স্থানীয় জনতা…নামাজি ও অ-নামাজি নির্বিশেষে…ভাঙা ড্রেন ও ডাস্টবিনের ময়লা অপসারিত না হওয়া সহ নানা বিষয়ে অভিযোগ দাখিল করলো। জনতা ভিড় করে গোল হয়ে ধরেছে তাকে। সাহসী খালাম্মা টাইপের দু’একজন গিন্নি-বান্নি মহিলা পর্যন্ত এসে অভিযোগে শামিল হলো। এম্নিতে তিনি নামাজ পড়তে আসার সময় মসজিদের সামনে কাগজের নক্সার ঝালর টাঙানো থেকে শুরু করে যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা তো একদফা হয়েই গেছিল! আশ-পাশের বাড়ির ছাদ হতে এমন গরমেও…বিশেষতঃ বৃদ্ধ ও তরুণীরা তাকে দেখতে থাকে কৌতূহলী চোখে! অবশ্য এলাকাবাসী যতেœর ত্র“টি করেনি। এর ভেতরেই দু’দফা শরবত ও এই ভয়ঙ্কর গরমে স্থানীয় ‘হাজি এণ্ড সনস্ রেস্টুরেন্টের’ গরম গরুর বিরানীর প্যাকেট ও বোরহানি খাওয়ানো হয় তাকে। সাথের পার্টির নেতা-কর্মীরাও বাদ যায় না। খেতে গিয়ে তার রীতিমতো আতঙ্ক বোধ হয়। নগর ভবনে গিয়েই ওর স্যালাইনের নির্দেশ দিতে হবে। মাস্ট। এরই ভেতর শয়তান আলিমুজ্জামানের লেলানো লোকজন ভিড়ের ভেতর হতে শ্লোগান তোলে, ‘১৪ নং ওয়ার্ডে বিদ্যুৎ নাই কেন? মুরতাদ মেয়র জবাব চাই! সারা শহরে পানি নাই কেন? নাস্তিক মেয়র জবাব চাই!’
আলিমুজ্জামানের লোকজনই আবার শ্লোগানকারীদের দিকে তেড়ে যায়, ‘অই বেত্তমিজ পোলাপান কথা বুল্যে কে র্যা?’
আলিমুজ্জামান নিজেও দাঁত কেলিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, ‘খবরদার বেআক্কল পুলাপান! মেয়র ছাহেব আমাদের খুব ইজ্জতের মানুষ!’
বেলা পৌনে তিনটা নাগাদ তিনি বোঝেন যে কোন মুহূর্তে তিনি নিজেই হিট স্ট্রোকে মাথা ঘুরে পড়ে যেতে পারেন। তার গলার স্বর উদাত্ত ও সুদূরপ্রসারী। দুই হাত দু’পাশে ছড়িয়ে, ভিজে চুপচুপ পাজামা-পাঞ্জাবিতেই তিনি যখন উঠে দাঁড়ান, জনতা বরাবরের মতো তার রূপে মুগ্ধ হয়ে একধরনের নীরবতায় থেমে যায়।
‘প্রিয় ১৪ নং ওয়ার্ডবাসী! আস্সালামু আলাইকুম! বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম!’
আরে কী সুন্দর পারছেন তিনি এখন! ক্যাম্পাসে থাকতে কী জানি বলতেন? ‘সংগ্রামী সাথী ও বন্ধুগণ’? হ্যাঁ, তাইই তো বলতেন তিনি। যাই বলেন না কেন তিনি, তার কথনে জনতা সম্মোহিত হয়ে পড়ে। বিমুগ্ধ ও নিশ্চুপ হয়ে মন্ত্রবন্দির মতো শোনে।
‘অত্র এলাকায় আমার মুরব্বি ও ভাই-বোনেরা!’
আহ্, এবারো পারলেন দেখা গেল! ঠিক এদের ভাষাতেই এদের তিনি চমৎকার সম্বোধন করতে পারছেন।
‘আপনারা সবাই আমার সালাম গ্রহণ করুন। বিগত সিটি কর্পোরেশন ইলেকশনে আপনারা আমায় নির্বাচনে জয়যুক্ত করায় আপনাদের অশেষ মেহেরবানী। আজ এই শুক্রবারে আপনাদের সবার সাথে পবিত্র জুমার নামাজে অংশ নিতে পেরে নিজেকে আমি সৌভাগ্যবান মনে করছি। আমি জানি আমি এমন এক সময়ে আপনাদের ওয়ার্ডে এসেছি যখন সারা দেশেই বয়ে যাচ্ছে অব্যাহত তাপপ্রদাহ। তার ভেতর উত্তরের মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে যদি বা গত এক/দেড় মাসে কিছু বৃষ্টি হয়েছে, আমাদের উত্তরাঞ্চলে এক ফোঁটা বৃষ্টি নেই। প্রকৃতির এমন ভয়ঙ্কর বিরূপতা, আবহাওয়াবিদদের মতে, গত কয়েক দশকে দেখা দেয় নি। তবে, ধৈর্য্য ধরুন আপনারা। লোডশেডিং বা পানির কষ্ট…সরকার ও সিটি কর্পোরেশন হতে অমানুষিক চেষ্টার পরও কিছু সমস্যা থেকেই যাচ্ছে…আপনারা সেই ভুল বা সমস্যার জন্য আমাদের মাফ করবেন! আমরা চেষ্টার কোনো ত্র“টি রাখছি না। আর আপনাদের এলাকার ওয়ার্ড কমিশনার আলিমুজ্জামান ভাই…উনি বয়সে ও সব ধরনের যোগ্যতাতেই আমার চেয়ে অনেক বড়…আমার আপন বড়ভাইয়ের মতো মানুষ…এই এলাকায় উনি আমার প্রতিনিধি…আপনাদের যা ফরিয়াদ, ওনাকে জানাবেন! রোজ ত আমি আসতে পারব না! ওনার মুখ থেকে আমরা শুনব!’
নগরপিতা এক গ্লাস পানির জন্য হাত বাড়ালে তাকে কোক ঢেলে দেওয়া হলো গ্লাসে। হ্যাঁ, সব ঠিক আছে। তৃতীয় বিশ্বের যেসব দেশে জনতার শিক্ষার স্তর নিচু, সেদেশে নেতৃত্বে উচ্চতা বা রূপ একটা বড় ফ্যাক্টর। সব দেশেই ফ্যাক্টর। তবে, ক্ষুধার্ত ও নিরন্ন মানুষ ধবধব ফর্সা, স্বাস্থ্যবান কী দীর্ঘ মানুষকে নেতা হিসেবে দেখতে বড় পছন্দ করে। পছন্দ করে নিজের ঠিক বিপরীত চেহারাটি দেখতে। হ্যাঁ, একদম ঠিক খোঁচাটিই দিয়েছেন তিনি। এই এলাকার কমিশনার আলিমুজ্জামান। এই ওয়ার্ডে পানি-বিদ্যুৎ না আসার ব্যর্থতা তার। ঐ দ্যাখো, আলিমুজ্জামানের মুখ কেমন কালো হয়ে গেছে!
‘আজ অনেক বেলা হয়েছে। বাদ জুম্মা আপনারা অনেকেই খাওয়া-দাওয়া করেন নি। আপনারা ক্লান্ত। গরমে কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। বেলা বাড়তে থাকলে অসুস্থতাও বাড়বে। আমি আপনাদের সব অভিযোগ মন দিয়ে শুনেছি। আমার বিশেষ তাড়া আছে। দুপুর সোয়া একটায় নগর ভবনে ‘খরা পরিস্থিতি মোকাবেলায় আশু করণীয়’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বসার কথা ছিল। যেখানে এই নগরীর আবহাওয়া অধিদপ্তর শাখার প্রধান আবহাওয়াবিদ, সেচ ও পানি প্রকৌশলী, বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজন, নগর ভবনের কর্মকর্তাসহ সবাই আপনাদের সমস্যা কীভাবে কাটানো যায় সে বিষয়ে গোল টেবিলে বসবে। আমি আপনাদের এলাকায় আরো কিছু টিউব-ওয়েল স্থাপনের উদ্যোগ নেব। ইমাম সাহেব মসজিদে জেনারেটর লাগাতে বলেছেন। আমি সে অনুরোধও তার রাখব। কিন্তু, আর মনে হয় আপনাদের এখানে থাকতে পারছি না! খরা পরিস্থিতি মোকাবেলার মিটিংয়ে আমার জন্য সবাই বসে আছে! আপনারা সবাই আমাকে আজকের মতো আসতে দিলে আপনাদের আল্লাহ হাফেজ! বাংলাদেশ জিন্দাবাদ!’
‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ!’ জনতা আছড়ে পড়ে তরুণ, সুদর্শন ও শিক্ষিত নেতার প্রতি অভিভূত মূর্চ্ছনায়।
এখন নগর ভবনের সাংবাদিক সম্মেলন কক্ষে বিদ্যুৎহীন জেনারেটরে এসি চলছে। নগরভবনে এসেই তিনি ভাল করে হাত-মুখ একদফা ধুয়ে, বাথরুমে রাখা বডি স্প্রে গায়ে ঢেলে কোনো রকমে দিনের দ্বিতীয় বৈঠকের জন্য প্রস্তুত হয়েছেন। দুপুরের বিরিয়ানি বলতে গেলে কিছুই তিনি মুখে দেন নি। সমস্যা নেই। খরা পরিস্থিতি শীর্ষক গোলটেবিলে এক্ষুনি ভেজিটেবল সমোচা, চিকেন রোল, কলা, রসগোল্লা ও চা সার্ভ করা হবে। এসির ঠাণ্ডা বাতাসে এতক্ষণে শরীরটা একটু ঝিরঝির লাগছে! ঘুম পাচ্ছে রীতিমতো। নগরীর বিভিন্ন এলাকার টিউবওয়েল বা পানি সরবরাহ নিয়ে কথা হলো। সেচ ও পানি বিষয়ক প্রকৌশলী ম্যাপ ও পাওয়ার পয়েন্টের সাহায্যে ফারাক্কা বাঁধের বিভিন্ন পয়েন্টে নদীর পানি কমে যাওয়া এবং বৃষ্টিহীনতার দরুন ভূগর্ভস্থ পানি তুলতে নলকূপগুলোর অসহায়ত্বের কথা বোঝালেন। পিডিবির বিভাগীয় প্রধান সিস্টেম লসের কথা তুলে আত্মরক্ষার চেষ্টা করলেন। এক কৃষিবিদ হাত তুলে অনেকক্ষণ ধরেই দৃষ্টি আকর্ষণের কথা তুলছিলেন। তাকে ফ্লোর দেওয়ায় তিনি এই প্রবল গরমে মাঠে পড়ে থাকা বৃষ্টি ও সেচহীন কৃষকদের সবার অবস্থা একবার ভাবতে বলায় এসির নিচে জুড়োতে থাকা লোকগুলো হঠাৎই সারা দিন গরম ধোঁয়াশায় ভুগে এখন এই এক ঘণ্টার ঠাণ্ডাঘরের গরমোত্তর ঠাণ্ডা পোহানোর সময়টা মিলিয়ে এ ওর দিকে বিকল দৃষ্টিতে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। তারা আর কিছুই আসলে ভাবতে বা বুঝতে পারছিল না! আবহাওয়াবিদের বক্তব্যের আগে জেনারেটরও কুঁই কুঁই শব্দ করে তার ফুরিয়ে আসা রসদের ইঙ্গিত জানায়। কিছু মোম নিয়ে আসা হয় ঝটিতি করে।
‘এক কাজ করা যাক। আমরা অন্ধকারের ভেতরেই খেতে থাকি। কারণ, আমাদের ভেতর উপস্থিত আবহাওয়াবিদকেও হয়তো তার বক্তব্যের সমর্থনে অনেক ম্যাপ বা ম্যাটেরিয়াল প্রদর্শন করতে হবে। কী বলেন?’ নগরপিতা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন।
আবহাওয়াবিদ এ কথায় খুশি হয়ে মাথা নাড়েন।
ঝটাঝট সাদা-লম্বা-মোটা মোমগুলো গো-ল ও দীর্ঘ টেবিলটির নানা কোণায় বসানো হতে থাকে। জানালা-দরজা খুলে ও পর্দা টেনে সরিয়ে দেওয়া হয়। ঘরে বাতাস আসে বা আসে না। ঘড়িতে প্রায় সন্ধ্যা ছ’টা। গরমের ভেতর মোমের আলোয় সবার মুখে রসগোল্লা-কলা-ভেজিটেবল সমোচা-চিকেন রোল দলিত হতে থাকে। বিদ্যুৎহীনতার দরুন বিশেষজ্ঞ আবহাওয়াবিদের বক্তব্য বন্ধ আপাততঃ। গোলটেবিলের মানুষেরা নানা খুচরা আড্ডায় মেতে উঠেছে।
‘অই কারেন্ট এসেছে…’ কেউ বললো। আবারো হুড়মুড় পর্দা টেনে, জানালা-দরজা আটকে এসি ছাড়া হলো। দেখতে দেখতে গরমে ধুঁকতে থাকা মানুষগুলো আবার ঠাণ্ডায় জমতে শুরু করবে। এসির রিমোট হাতে তখন ঠাণ্ডা কমানো বা বাড়ানো হবে। আবার কারেন্ট যাবে।
‘সম্মানিত সুধীজন,’ তরুণ নগরপিতা নিজের হাতে টেবিলে রাখা হ্যাণ্ড মাইক্রোফোন সেট তুলে নেন। ‘আমাদের সবার বৈকালিক চা-পান শেষে…হ্যাঁ, বিদ্যুৎও চলে এসেছে…আলোচনার এ পর্যায়ে আমি আজকের অনুষ্ঠানের শেষ বক্তা এবং বিভাগীয় আবহাওয়া অফিসের প্রধান বিজয়েন্দ্র পাল মহাশয়কে বক্তব্য জানাতে আহ্বান করছি!’
বিজয়েন্দ্র পাল মহাশয় তার কপালের সাদা-কালো চুল সরিয়ে ইতস্থতঃ ভঙ্গিতে শুরু করেন। ‘শুভসন্ধ্যা। আপনাদের ফোল্ডারে সবাই দেখবেন আমরা আবহাওয়া বিভাগ হতে গত ১২ই চৈত্র অর্থাৎ ২৬শে মার্চ হতে ১২ই বৈশাখ অর্থাৎ ২৬শে এপ্রিল পর্যন্ত সারা দেশের আবহাওয়ার প্রতিদিনকার তথ্য বিবরণী দিয়েছি।’
আবহাওয়াবিদের কথামতো সবাই কিছুক্ষণের জন্যও ফোল্ডারের আবহাওয়া ব্যুলেটিনে চোখ বুলায়।
‘১২ই চৈত্র । ২৬শে মার্চ। শুষ্ক তাপমাত্রা।
কিছুদিন হয় সেই নগরে কোন বৃষ্টি হচ্ছিল না। কিছুদিন বলতে টানা এক মাস কোন বৃষ্টি নাই। চৈত্রের মধ্য হতে বৈশাখের মধ্যভাগ…নগরবাসী দেখে শুধু সকাল হতে তেতে ওঠা সূর্য, সকাল এগারোটা হতেই গনগনে গরম লু হাওয়ার আঁচ, হাওয়ার সাথে সাথে দুপুর নাগাদ পাক খেয়ে উড়তে থাকা ধূলার শুনশান বিভীষিকা আর তারও চেয়ে ভারি ও স্তব্ধ, নিরেট সন্ধ্যা আর রাত্রি! বলতে কী, গোটা দেশেই গরম পড়েছিল খুব। তবু, সমুদ্রের নিকটবর্তী দেশের দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পূর্বাংশের শহর ও গ্রামগুলোয় যদি বা এর ভেতর দু/একটা সপ্তাহ এক/দু’দিন হলেও বৃষ্টি হয়েছে…দেশের উত্তরাঞ্চলের এই প্রধান শহরে গত একমাস ধরে বৃষ্টি দূরের কথা, প্রতিবছর গরমের সময়টা গরমের অনুষঙ্গ হিসেবেই যেমন অন্ততঃ তিন/চারদিন গুমোট গরমের পর হঠাৎই একদিন কালবৈশাখীর ঝড় ওঠে, বাতাস গরম হতে হতে একদিন নিজেই ঠাণ্ডা ও শিলীভূত হয়ে পড়ে প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মে এবং তারপর এক ফোঁটা, দু/ফোঁটা করে ধীরে ধীরে দেখা দেয় বৃষ্টি কী শিল পড়ে, আকাশ হতে ঝরে পড়া সেই তুষারকণা জিহ্বায় আস্বাদ করে শিশুরা…সেবার তা-ও হচ্ছিল না! রাস্তাঘাটে মানুষ গরমে হঠাৎই নুয়ে পড়ছিল অচৈতন্য। পশু-পাখিদেরও নিস্তার মিলল না সেবারের গরমে। শহরের পাশ ঘেঁষে বয়ে চলা দেশের একসময়ের সবচেয়ে বড় নদী আর বর্তমানে যে নদীতে জল একদমই নিস্তরঙ্গ পড়শি দেশের দেওয়া একটি প্রকাণ্ড বাঁধের কারণে…যে বাঁধ নিয়ে প্রতিবছর পড়শি দেশের কূটনীতিকদের সাথে এদেশের কূটনীতিকরা ঝাণ্ডা খাড়া করে বৈঠক করেন এবং শিশুরাও জলের কিউসেক জাতীয় পরিভাষা শিখে ফ্যালে…এবছর সেই বড় নদী হয়ে উঠেছিল নিতান্ত নালা…তার ওপর বিদ্যুৎ এই আসে কি যায়, ধানের চারাও মানুষের মতো বা মানুষ ধানের চারার মতো নুইয়ে পড়ছে বৃষ্টিহীন ঠা-ঠা- রোদে…তেমন একদিনে উত্তরের প্রধানতম নগরীর সদ্য নির্বাচিত নগর পিতা তার পারিষদদের সবাইকে নিয়ে তদানীন্তন নগর ভবনে চলমান খরা পরিস্থিতি মোকাবেলায় আশু করণীয় বিষয়ক একটি বৈঠক ডাকেন।
এখানে বলে রাখা ভালো যে উত্তরের প্রধান শহরের সদ্য নির্বাচিত এ নগর পিতা বয়সে অতিশয় তরুণ। সত্যি বলতে তিনি নির্বাচিত হবার পর সবাই কপালে চোখ তুলে বলেছিল, ‘হা-হা-মজার কাণ্ড বঠে! ই কে নগর পিতা কে ব্যুলবে? নগর ভাই বেরাদার বলা যায়!’ রসিক জনেরা আরো এক কাঠি সরেস হয়ে মন্তব্য করেছিল এতদিন বয়োবৃদ্ধ যে নগর পিতাদের স্ত্রীরা স্বামীদের পদমর্যাদার দরুণই ‘নগর মাতা’ পদটি অলংকৃত করেছেন, এই তরুণের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী বিয়ের ঠিক যতদিন ন্যূনতম ব্যবধানে একজন নারী সন্তানসম্ভবা হতে পারে…সে ক’টা দিনও অতিবাহিত করেনি…তাকে কী করে ‘নগরমাতা’ বলা যায়? তাকে ‘নগরভাবি’ বলাই কি অধিকতর যুক্তিযুক্ত নয়? তা এই সদ্য নির্বাচিত নগর পিতা বয়সে নিতান্ত তরুণ। মাত্র ত্রিশ বছর বয়স। উত্তরের প্রধান শহরের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের কদিন আগেও নামী বামপন্থী ছাত্র নেতা ছিলেন। লোকে বলে গোটা হেগেল ও মার্ক্স-লেনিন-মাও রচনাবলী তার ঠোঁটের আগায় থাকতো বা এখনো পর্যন্ত আছে। বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের সূচনা অবশ্য তার বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম বর্ষে পড়ার সময় ছত্রিশ বছর আগের এক যুদ্ধের নরহত্যাকারী বাহিনীর বর্তমান সদস্যদের সাথে সরাসরি আর্মড কাউন্টার অ্যাকশনে জড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে। তিনি ছাত্র অবস্থায়ই জেলে গেছেন ছয়বার, তাঁর বিরুদ্ধে সরাসরি খুনের অভিযোগ আছে মোট আঠারোটি (যদিও প্রতিটি হত্যাই বৈধ বলে সাধারণ মানুষ মনে করে) যার এগারোটিরই আছে প্রচুর প্রত্যক্ষ ও আইনসিদ্ধ প্রমাণ, তিনি সুদর্শন ও নারী মনোহর হিসেবে পরিচিত হলেও কৈশোর বয়সের নিতান্ত সাদাসিধা চেহারার প্রেমিকাকেই দীর্ঘ প্রেমের পর বিয়ে করেছেন বলে জনশ্র“তি রয়েছে। একমাত্র তার জন্যই উত্তরের প্রত্যন্ততম গ্রাম হতে যে ক্ষুদ্র কৃষকের ছেলে বাবার শেষ জমিটুকু বিক্রি করে মধ্যবিত্ত হবার বাসনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছিল, তেমন সব ছাত্রও পড়া ছেড়ে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছে বলে শোনা যায়। একটি অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত ও অর্থবান পরিবারের তিনি কনিষ্ঠ পুত্র যে পরিবারটি দেশের দুটো বৃহৎ বুর্জোয়া দলের অপেক্ষাকৃত লিবারেল ও সাংস্কৃতিক চেহারাসম্পন্ন অংশটিকে সমর্থন দিয়ে এসেছে আগাগোড়া। একমাত্র তিনিই নিয়ম ভঙ্গ করে সেই বাম দলে যোগ দিলেন যারা লিবারেল বুর্জোয়া দলের ছাতা হিসেবে কাজ করে না। তবে, বুর্জোয়াদের লিবারেল অংশটুকু এই ভেবে স্বস্তি পেত যেহেতু বাম ছাত্র নেতারা শেষ জীবনে তাদের দুটো বুর্জোয়া দলের যে কোনো একটিতে যোগদান করে এবং এই পরিমাণ পড়াশুনা করা ও বিশেষতঃ ছত্রিশ বছর আগের যুদ্ধের নরহত্যাকারী বাহিনীর বর্তমান সদস্যদের সাথে সরাসরি আর্মড কাউন্টার অ্যাকশনে জড়িয়ে পড়ার কারণেই এই তরুণ তাদের দলেই যোগ দেবে। মূলতঃ একারণেই বুর্জোয়াদের লিবারেল দলটি টানা বছর বিশেক ক্ষমতাহীন থাকার পর একবার ক্ষমতায় এসেও তার একটি মামলা নিয়েও ফাইল নাড়াচাড়া করেনি। গেরোটা বাঁধল আরো বছর পাঁচেক পর। বুর্জোয়াদের রক্ষণশীল দলটি পরের দফায় ক্ষমতায় এসেই প্রথম যে কাজটি করে তা হলো সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশ দিয়ে ছাত্রনেতার বাড়ি ঘেরাও করে সরাসরি প্রস্তাব পাঠায়। হয় ক্ষমতা ও রাজ্যভোগ অথবা নিশ্চিত ফাঁসি। আরো বিশেষতঃ ক্ষমতায় যেহেতু তাদের রাজনৈতিক সহযোগি হলো বহু আগের যুদ্ধের নরহত্যাকারী বাহিনী।
কিংবদন্তি আছে ছাত্রনেতা ও পরবর্তী সময়ের নগরপিতা শেষোক্তটি বেছে নেন। হতচকিত রাজনৈতিক সাথীদের কাউকে কাউকে তিনি এই বলে বোঝাতে সক্ষম হন, ‘বিপ্লব আসবে আসবে করে গত পঞ্চাশ বছরে উপমহাদেশের হাজার নেতা-কর্মী শেষ হয়েছে। এই অপচয় অর্থহীন। যদি আমি বুর্জোয়া দলের প্ল্যাটফর্মে থেকে জনগণের টাকা চুরি হওয়া বাঁচাই? রাস্তা বানাই, স্কুল খুলি কী কৃষককে সেচ আর বিদ্যুতের ব্যবস্থা করে দিই ভাদিমির উলিয়ানভের মতো? গত টার্মে লিবারেল বুর্জোয়াদের দলে যে একমাত্র মহিলা মন্ত্রী কাজ করেছে, যার জন্য দেশের মানুষ খেতে পেরেছে দুবেলা, তিনিও তো বামই ছিলেন, তবে?’
‘কিন্তু, সেই মহিলা মন্ত্রী দেশী ধান দফারফা করে হাইব্রিডে দেশ ছেয়ে ফেলেছেন!’ তার সাথীরা কেউ কেউ প্রশ্ন করেছিল। ছ’ফুট লম্বা, শ্যামবর্ণ, ক্লিনশেভড ও ঘন মোচের এই ত্রিশ বছরের যুবক তখন মুচকি হেসে বলেছেন, ‘তবু মানুষ তো ভাত খেতে পেরেছে কমরেড!’ শোনা যায়, এরপর তার ঘনিষ্ঠতম ছয়জন রাজনৈতিক সহযোগির দু’জন আতাউল ও রেজাউর পালায়, দু’জন সহযোগি সারোয়ার ও রঞ্জন ফাঁসিকাঠে স্বেচ্ছায় ধরা দেয় ও অন্য দুইজন অর্থাৎ ইরফান ও সাব্বির তার সাথে নতুন রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশের মাধ্যমে নগর ভবনের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত হয়। প্রবল গরমে শুকিয়ে আসা দেশের দীর্ঘতম নদীটি নগরের শেষ যে বিন্দুতে গিয়ে শেষ হয়, সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ওপরে ছাত্র-ছাত্রীরা নব্য নগরপিতা ও তাদের এককালের ছাত্রনেতা বা বড়ভাই আবুল কালাম টুকুকে নিয়ে নানা গল্প গেঁথে চলে, ‘টুকু ভাই নাকি সকালেই খোদ নগর ভবন অফিসে বসে তার তিন সহযোগিকে নিয়ে এক ঘণ্টা মার্ক্সবাদের ক্লাস নেন!’
‘মার্ক্সবাদের ক্লাস! দূর! নিজের হাতে যাদের সে কাটছে, আজ তাদের সাথেই কোলাকুলি!’
‘টুকু ভাই নাকি এখন বলছেন যতই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা বলা হোক, তাকে তার দেশীয় পরিপ্রেক্ষিত হতে আলাদা করে দেখলে চলবে না। গ্রামের কৃষক আজো বৃষ্টি পড়ার জন্য ব্যাঙের বিয়ে দেয়, বৃষ্টির ফেরেশতা মিকাইলকে ডাকে…এই ফেরেশতা মিকাইলকে ডাকা হতে শুরু করে ব্যাঙের বিয়ে পড়ানো সব নাকি শ্রদ্ধা করতে হবে। জনবিশ্বাসকে অশ্রদ্ধা করা যাবে না!’
‘আরে এখন পর্যন্ত টুকু ভাই টাকা তো চুরি করা শুরু করে নাই। বা, করলেও শহরের ভাঙা রাস্তাও বাঁধাচ্ছে! বস্তির মানুষকে পানি খাওয়াবার ব্যবস্থা করছে। স্কুল খুলছে কী টিকা দিচ্ছে! টুকু ভাই জিন্দাবাদ!’
‘হ্যাঁ, রিক্সাঅলারা পর্যন্ত টুকু ভাইকে দোওয়া দেয়!’
‘দিত। এখন দিচ্ছে না। এই খরা পড়ার পর থেকে পাব্লিক রোদকে টুকু নামে ডাকছে।’
‘আরে মূর্খ পাব্লিক…বৃষ্টি না হওয়া মানে তো আর দুর্নীতি করা না! বৃষ্টি না হওয়া তো টুকু ভাইয়ের হাতে নাই!’
‘উফ্…কী গরম…আল্লা…কম্যুনিস্ট হোক আর ক্যাপিটালিস্ট হোক…কেউ যদি এখন একটু বৃষ্টি নামাইতে পারত!’
খ.
সেদিনের সকালটাও তেম্নি ক্ষুব্ধ ও খরাময় ছিল। এককালীন কমরেড এবং বর্তমানের নগরপিতা আবুল কালাম টুকু তার পড়ার টেবিলে ঝুঁকে নোট নিচ্ছিলেন। কিম্বা, বলা ভালো কিছু ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন ভাবনাকে একত্র করছিলেন : ‘‘এগারোশ’ সালে আরব ঐতিহাসিক আলবেরুনী ভারতে এসে সংস্কৃত শিখেছিলেন এবং গীতার শ্লোকের সংখ্যা সাতশ’র বেশি এমন একটি হিসাব করেছেন। তিনি তাঁর গ্রন্থে, এমনকি, গীতার কিছু হারিয়ে যাওয়া শ্লোক উদ্ধার করেছিলেন যা প্রচলিত গীতায় নেই। সেক্যুলারিজমের আন্দোলন এই জায়গা হতে শুরু করা এদেশে উদারনৈতিক বুর্জোয়ারাও পারে নি, বামরা তো পারেই নি। …গ্রামের কৃষক কী দ্বান্দিক আর বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র বুঝবে? তার কাছে বৃষ্টির জন্য আজো ফেরেশতা মিকাইলের কাছে সুরা পড়তে হয়। রক্ষাকালীর কাছে জোড়া পাঁঠা বলি দিতে হয়। কিম্বা, লোকাচার হিসেবে ব্যাঙের বিয়ে দিতে হয়। আমি যদি সত্যিকারের জনপ্রতিনিধি হই, তাহলে তাদের বিশ্বাসকে ‘কুসংস্কার’ বলবো নাকি ‘শ্রদ্ধা’ করবো? অবশ্যই বৃষ্টি হয় প্রাকৃতিক নানা নিয়ম মেনে। অবশ্যই ধর্মীয় প্রার্থনা করে বা ব্যাঙের বিয়ে দিয়ে বৃষ্টি হয় না।…
একাকী শীতল শরতে
উত্তর বাহিনী শিয়াঙ নদীর সঙ্গে
কমলালেবুর দ্বীপে
আমি দেখেছি লক্ষ পাহাড়
সর্বত্র লালরঙের পাতায় ধনী,
আর দর্শক সবুজ নদী,
যাতে ভাসছে অসংখ্য তরণী
অসীম অনন্ত আকাশে উড়ন্ত বাজ
আকাশের নিচে জীবন নানা রঙে
স্বাধীনতার জন্য…
শিন্-য়ুবান-চুনের সুরে লেখা এই গানটি চেয়ারম্যান মাও সে তুঙ লিখেছিলেন ১৯২০-২১ সালের দিকে। চাঙ-শা শহরের পাশে শিয়াঙ নদীতে শরতের রাতে জ্যোৎস্না দেখতে দেখতে তিনি এই গানটি লিখেছিলেন। লিখেছিলেন, ‘দেবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ — কী আনন্দ / পৃথিবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ — কী আনন্দ!’ পরে চীনের নেতা হবার পর ভয়ে কবিতা লিখলেও জনসমক্ষে আর প্রকাশ করতেন না।…আমি কী করছি? না, আমি ঠিকই তো করছি! কতদিনে বিপ্লব হতো? কত লক্ষ বছরে রেভল্যুশন আসতো? তার চেয়ে এই যে উত্তরাঞ্চলের বিভাগীয় শহরের আমি মেয়র…সিটি কর্পোরেশনের আওতায় তিনটা সুইপার কলোনির ত্রিশ হাজার মানুষের জন্য গতকাল এক স্বাক্ষরে বারোটা নতুন টিউবওয়েলের সুপারিশ করেছি আমি। তাদের পুরনো টিউবওয়েলগুলো অচল হয়ে পড়ছিল। কোনটা বিপ্লব আসলে? সারোয়ার আর রঞ্জন সারেণ্ডার করে নি। তারা ফাঁসিতে ঝুলল। তারা কি আমাকে বেঈমান বলবে? ওদের মৃত আত্মা?…’
স্ত্রী চা নিয়ে ঢোকে।
‘নোট নেওয়ায় ডিস্টার্ব করলাম না তো?’
‘নাহ্’… তিনি ক্লান্ত ভাবে হাসেন, ‘আজ সকালে ভাল করে পড়া হলো না। অদ্ভুত সব চিন্তা ভিড় করছে মাথায়।’
‘আজ কি তোমার খরা নিয়ে মিটিং?’
‘হ্যাঁ।’
‘তার আগে কি জুমার নামাজ পড়তে যাবে?’
‘ন্ না…মানে হ্যাঁ যাবো আর কি বারোটার দিকে।’
তিনি অস্বস্তির সাথে লক্ষ্য করেন তার স্ত্রী নাজমত আরা শিউলি ভারি অদ্ভুত চোখে তার দিকে চেয়ে আছে। অস্বস্তিই বটে। শিউলির সাথে যখন তার প্রথম পরিচয়, তখন আজান পড়লে শিউলি মাথায় কাপড় দিত। তিনি এ ব্যাপারটা কুসংস্কার বলে শিউলিকে বোঝাতে থাকেন। এক পর্যায়ে শিউলি…তাকে খুশি করতেই…আজান পড়ার সময় মাথায় কাপড় তোলাটা বাদ দিয়ে দেয়। বিব্রত শিউলি তার দিকে তাকিয়েই শেষমেশ মাথায় আর ওড়না দিত না। ক্রমে ক্রমে নামাজ বা রোজা রাখাও কমে এসেছে তার। আজ সেই শিউলি শুক্রবারের জুমার নামাজের কথা শুনে কেমন অদ্ভুত ভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে!
‘গতকাল আলিমুজ্জামান সাহেবের ওয়াইফ ফোন করেছিলেন বিকালবেলা।’
‘কী বলেছেন?’
‘এম্নি কেমন আছি ভাল আছি এই সব জিজ্ঞাসা করলেন। আগামী রবিবার রাতে ওনাদের বাসায় খাবারের দাওয়াত দিয়েছেন।’
শালা আলিমুজ্জামান! ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার এই লোকটি সবচেয়ে ত্যান্দোর প্রকৃতির। গোদাগাড়ি উপজেলার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তপথে গরু হতে ফেন্সিডিল সহ যাবতীয় চোরাই ব্যবসার সে গডফাদার। মুখে আবার সারাক্ষণ আল্লাহ-বিল্লাহ করে। এই শহরের পার্টি পলিটিক্সে সে-ই প্রধান নিয়ন্তা। আলিমুজ্জামানকে বসিয়ে তাকে নগরপিতা করা হয়েছে পিপলের কাছে একটা ফ্রেশ ইমেজের জন্য। খুব চালাক বলেই এই আলিমুজ্জামান এখনো সরাসরি তার বিরোধিতা করা শুরু করে নি। এমনকি প্রচ্ছন্নভাবেও করছে না। যা করছে তাহলো তার চোরাচালান ব্যবসায় মেয়র হিসেবে তিনি যেন কোনো বিরোধিতা না করেন, সেজন্য দলের প্রকাশ্য সমাবেশে নামাজের দাওয়াত দিচ্ছেন কী নিজের বউকে দিয়ে তার বউকে ফোন করাচ্ছেন। এত চালাক লোকটা! ঠিক তিন দিন আগে দলের নগর কমিটির মূল মিটিংয়ে একথা সেকথার পর হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘ভয়ে ভয়ে একটা কথা বলি টুকু ভাই! আগে ত শুনছি কী সব কম্যুনিস্ট না নক্সাল রাজনীতি করতেন। আল্লা-রসুল বয়সের গরমে অস্বীকার করা…আমার নিজের এক ছোটো ফুপাতো ভাই ছিল এমন পাগলা…খুব মেধাবী…সব মানুষকে সমান করবে…আরে, হাতের পাঁচটা আঙুলই সমান হয় নাকি…হেঃ হেঃ হেঃ…এখন লাখো কোটি জনতার খেদমতে নামছেন…একাজে মহান আল্লাহপাক রাব্বুল আল-আমিনের দোওয়া চাই। আসেন, আমাদের…ইয়ে মানে যাকে বলে আপনার তৌহিদী ভ্রাতৃত্ব …আমাদের তৌহিদী ভ্রাতৃত্ব … আগামী শুক্রবার আমার ওয়ার্ডেরই সবচেয়ে বড় মসজিদে জুম্মার নামাজ আদায় দিয়া শুরু করি, কী বলেন আপনারা সবাই?’
‘মারহাবা — মারহাবা!’ মিটিংয়ে উপস্থিত অন্যান্য নেতা-কর্মীরা শোর তোলে।
‘জ্বি, আচ্ছা!’ দাঁতে দাঁত চেপে সম্মত হয়েছিল সে। সম্মত না হলে তার নাস্তিকতার কথা ছড়িয়ে পড়তো।
নাহ্, এদেশে বুর্জোয়া রাজনীতিতে নামলে ধর্মকে মানতেই হবে। এমনকি বাম রাজনীতিতেও ধর্মকে বাদ দেয়া ভুল যেমন অতীতে ভুল হয়েছে। গ্রামের যে ভূমিহীন কৃষক নামাজ পড়ে, তার ঘনিষ্ঠ হতে হলে তার পাশে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করায় কোনো ভুল নাই। তাই বলে এই চোরাচালানী আর মাফিয়া গডফাদার আলিমুজ্জামানের পাশে থেকে নামাজ পড়া? নামাজই নষ্ট হয়ে যাবে! কিন্তু, আলিমুজ্জামানের হাতে শহরের পুলিশ, বিডিআর সবকিছু। এবং তাঁর বিরুদ্ধে আঠারোটি খুনের মামলা এবং ঢাকা হতে পার্টির সেন্ট্রাল কমান্ড তাকে আলিমুজ্জামানের সাথে মিলে-মিশেই কাজ করতে বলেছে।
‘জুমার নামাজে যাবেই যখন, তখন গত সপ্তাহে আমার ছোট আপা আড়ং থেকে তোমার জন্য যে সাদা সূতির পাঞ্জাবিটা এনেছেন…বুকে নক্সী কাঁথা স্টিচ সবুজ আর হাল্কা মেরুন সূতায়…ঐটা তোমার জন্য বের করে রাখি?’
‘রাখো — ’ তিনি তেতো মুখে মাথা নাড়েন।
‘জুমার নামাজের পর কি বাসায় আসবে না সোজা নগর ভবনে মিটিং?’
‘নাহ্…আজ আর আসতে পারবো না। নগর ভবনে মিটিংয়েই খাওয়া হবে।’
‘মিটিং করে কি বৃষ্টি নামাতে পারবে?’
বউয়ের এহেন প্রশ্নে হঠাৎই বিরক্তি ধরে যায় তার। চেঁচিয়ে ওঠেন তিনি, ‘সব কথার ভেতর থেকো না তো! এম্নিতেই হাজারটা চিন্তায় মারা যাচ্ছি!’
শিউলি এই চেঁচিয়ে ওঠাতেও দমে না। বরাবরের শান্ত, বাধ্য ও অনুগত শিউলি সেই অদ্ভুত তেরছা চোখে (এমন চোখে আগে তাকাতো না সে) চেয়ে থাকতে থাকতেই সপ্তাহের অন্ততঃ একটি দিনের দাম্পত্য প্রত্যাশা পেশ করে, ‘সারা সপ্তাহ এত ব্যস্ত। খরার মিটিং এই শুক্রবারই করতে হচ্ছে?’
‘হ্যাঁ — হচ্ছে — কী পরিমাণ ব্যস্ত আমি — তুমি কি ভাবতে পারো যে আমি এই সিটি কর্পোরেশনের মেয়র? গোটা শহরের সব ঝামেলা আমার ঘাড়ে! পলিটিশিয়ান বিয়ে করেছো কেন? কলেজ কী ইনোভার্সিটির প্রফেসরকে বিয়ে করলেই চলতো! যত সব — আর এক কাপ চা দাও!’
রেগে-মেগে অতঃপর আমাদের পৌরপিতা স্নানঘরে ঢুকে শাওয়ারের তলে দাঁড়িয়ে পড়েন এবং মাথা ভেজাতে থাকেন যতক্ষণ স্ত্রীর তেরছা চাহনি ও বাক্য তার মাথা হতে না সরে!
গ.
লোড শেডিংয়ে জুমার আজানে মাইক বন্ধ ছিল। কাজেই জুমার আজান খুব জোরে শোনা যায় না। নগরপিতার উপস্থিতিতেই সাধারণ নামাজিদের ভেতর নগরপিতার লোড শেডিং কমাতে ব্যর্থতা নিয়ে ফিসফাস টিপ্পনি ও হাসি শুরু হয়।
‘মেয়র সাহেব…লোডশেডিংয়ের কী হবে?’ নামাজ শুরু হবার ঠিক আগ মুহূর্তে নামাজের একদম পেছন সারি হতে মুখ ও কণ্ঠস্বর গোপন রাখার সুবিধা নিয়ে কেউ জোরেই প্রশ্ন করে ফেলে।
‘আন আবী হুরাইরাতা রাদিয়াল্লাহ আনহু আন্নাহু ক্বালা ক্বালা রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা ইন্না লিল্লাহি তিস্আ’তাও ওয়া তিস্য়ীনা ইসমান মান আহ্সাহা দাখালাল জান্নাতা’…
ইমাম সাহেব গলা চড়ান, ‘অর্থাৎ হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন — নিঃসন্দেহে আল্লাহ তায়ালার নিরানব্বইটি নাম রয়েছে। যে ব্যক্তি এ নামসমূহ গণনা করে কণ্ঠস্থ করবে ও যিকির করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। উপস্থিত ভাইসকল, আস্সালামু আলাইকুম! আজ আমাদের ভেতর আমাদের এই শহরের মাননীয় মেয়র সাহেব তার তশরিফ রেখেছেন। মাননীয় মেয়র সাহেব আমার বেয়াদবি মাফ করবেন…অতীত জীবনে তিনি কম্যুনিস্ট ছিলেন…যারা নাছারা বেদ্বীন মতাদর্শে আল্লাহ্ ও তার রাসুলের পাক কালাম স্বীকার করে না! অথচ, আজ তিনি আমাদের ভেতর এসেছেন। মহান আল্লাহ তাঁর কালামে পাকে ইরশাদ করেছেন — ফায্কুরূনী আয্কুরকুম — ‘তোমরা আমাকে স্মরণ করলে আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করব।’ সমাগত মুসল্লি ভাইয়েরা, আপনারা নামাজের কাতারে দাঁড়ায় পড়েন। লোড শেডিংয়ের সাময়িক কষ্ট স্বীকার করে আসেন আমরা আল্লাহর দরবারে বান্দা হিসাবে শুকরিয়া আদায় করি! সেই সাথে মহামান্য মেয়র সাহেবের কাছে বিশেষ আর্জি যে অত্র এলাকার বাসিন্দারা এই খরার পাশাপাশি গত একমাস যাবত লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণায় অস্থির। পানিও ঠিকঠাক আসে না! এ প্রায় গোরের আজাবের সমান। তবু, আফযালুয্ যিক্রি যিক্রুল্লাহি — অর্থাৎ, আল্লাহর নামের যিকিরই সর্বোত্তম। আসেন, সবাই নামাজ কায়েম শুরু করি!’
মসজিদের ভেতর ফ্যান বন্ধ। জুমাবার বলে নামাজে অংশ নেওয়া মানুষের সংখ্যা এম্নিতেই মসজিদ ছাড়িয়ে রাস্তায়। এছাড়া খোদ নগরপিতা এসেছেন বলে দলের ছেলেরাও অনেকে যোগ দিয়েছে আজ। গরমে আর ঘামে আর তারও চেয়ে বেশি খোদ নামাজের আসরে লোডশেডিং আর পানি দিতে না পারার সমালোচনায় আমাদের আজকের গল্পের নায়ক এবং এ দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রধান শহরের নগরপিতা দরদর করে ঘামতে থাকেন। পাশে আবার শয়তান ব্যাটা আলিমুজ্জামানের লোডশেডিংয়ের সমালোচনায় মুখে মুচকি মুচকি হাসি! উরে বাবা! ঘাম নামছে ভুরু হতে নাক-চিবুক-গলা হয়ে বুক-পেট-উরু বেয়ে পায়ের নখ অবধি! গোসল আর ওজু কিছুই অবশিষ্ট আছে কি এই গ্রীষ্মে? তিনি বোঝেন যে ঘামে আড়ংয়ের অমন সুন্দর সাদা পাঞ্জাবি, পাঞ্জাবির নিচে গেঞ্জি, পাজামা ও পাজামার নিচে আণ্ডারঅয়্যার…সবই তার ভিজে সপসপ করছে! হে আল্লাহ্, বৃষ্টি কবে নামবে? দু’হাত তুলে মোনাজাত করার সময় চাতক পাখির মতো এমন মনোবাসনাই কি কাতর প্রার্থনাই সম্ভবতঃ তার নিঃশ্বাসের সাথে নির্গত হয়ে থাকবে। মসজিদের গরম হয়ে ওঠা মেঝেতে নতজানু মুহূর্তে মাথা ছোঁয়াতে গিয়ে কান্না এসে পড়ে তার! তিনিও ক্ষমতায় এলেন আর খরাও শুরু হলো! ক্ষমতায় এসে গত একবছরে সাধ্যমতো কী না করেছেন? ক্ষমতায় টিঁকতে কাউকে কাউকে অনেক ছাড় দিতে হচ্ছে তার, কিন্তু নিজে তিনি এখনো পয়সা খাওয়া শুরু করেন নি! সাধ্যমতো এখনো জনগণের ভাল করার চেষ্টা করছেন। খুব বেশিদিন হয়তো পারবেন না। তবু, শহরের রাস্তায় বিচারবোধহীন জনতা রোদকে এখন ‘টুকু’ বলে ডাক দিচ্ছে। কী হবে হেগেল-মার্ক্স-মাওয়ে? কী এসে যায় বিজ্ঞানে? প্রকৃতি নারীর মতোই…এত বছরের চেনা প্রেমিকা কাম বউ শিউলির বদলে যাওয়া তেরছা চাহনির মতোই নিষ্ঠুর…ওরে প্রকৃতি, তুই কি একটু বৃষ্টিও দিতে পারিস না? নাহয় মাত্র এক ফোঁটা বৃষ্টি?
ঘ.
নগর ভবনের ‘খরা পরিস্থিতি মোকাবেলায় আশু করণীয়’ বিষয়ক শুক্রবারের জরুরি মিটিং যা দুপুর সোয়া একটায় শুরু হবার কথা ছিল, তা কার্যতঃ শুরু হলো দুপুর পৌনে চারটায়। নামাজের শেষে ইমাম সাহেব খুতবা পাঠ করেছিলেন আরো কিছুক্ষণ। খুতবায় অচিরেই আল্লাহ তা’য়ালা খরার অবসান ঘটিয়ে বৃষ্টি নামাবেন এমন আশা প্রকাশের পর যথারীতি আবার গোটা শহরের বিদ্যুৎ ও পানি পরিস্থিতি নিয়ে কাতরোক্তি করলেন ইমাম সাহেব। মসজিদে জেনারেটর সাহায্যও তিনি প্রার্থনা করলেন। এদিকে গরম ও টানা বিদ্যুৎহীনতায় মসজিদের ভেতরে দু’জন ও বাইরে ঠা-ঠা রোদে জামাতে অংশ নেওয়া চারজন জ্ঞান হারালো। তখন ‘হাতপাখা আনো রে!’ ‘বরফ আনো রে!’ কী ‘এ্যাম্বুলেন্স আনো রে!’ হৈ চৈ শুরু হলো। এই প্রবল গরমে কোথায় তিনি নামাজ শেষেই পড়িমরি গাড়িতে উঠে সোজা নগর ভবন গিয়ে জেনারেটরে চলা এসি রুমে গিয়ে বসবেন তা না জনপ্রতিনিধি হবার শাস্তি চুকাও! পাঁচজন অচৈতন্য ব্যক্তির কাছেই তাকে দাঁড়াতে হলো। আবার তার কাছে কে হাতপাখা ও ঠাণ্ডা পানি নিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়েও কিছুক্ষণ একটা খণ্ডযুদ্ধ মতো হলো। পাঁচজন সংজ্ঞাহারার তিনজনের জ্ঞান থাকতে থাকতে ফিরল। অন্য কারো কাঁধে ভর করে তাদের হাঁটিয়েই বা রিকশায় তুলে বাসায় নিতে হলো। তিনজনের অবস্থা মারাত্মক। তাদের টেক্সিতে তুলে হাসপাতালে পাঠাতে হলো। বাঙালী পারেও! এর পরপরই তিনি ভেবেছিলেন তার মুক্তি মিলবে। কিন্তু, দেখা গেল মুক্তি অত সহজ বস্তু নয়। মসজিদের সামনের ঠা ঠা রোদে একটি চেয়ারে বসিয়ে স্থানীয় জনতা…নামাজি ও অ-নামাজি নির্বিশেষে…ভাঙা ড্রেন ও ডাস্টবিনের ময়লা অপসারিত না হওয়া সহ নানা বিষয়ে অভিযোগ দাখিল করলো। জনতা ভিড় করে গোল হয়ে ধরেছে তাকে। সাহসী খালাম্মা টাইপের দু’একজন গিন্নি-বান্নি মহিলা পর্যন্ত এসে অভিযোগে শামিল হলো। এম্নিতে তিনি নামাজ পড়তে আসার সময় মসজিদের সামনে কাগজের নক্সার ঝালর টাঙানো থেকে শুরু করে যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা তো একদফা হয়েই গেছিল! আশ-পাশের বাড়ির ছাদ হতে এমন গরমেও…বিশেষতঃ বৃদ্ধ ও তরুণীরা তাকে দেখতে থাকে কৌতূহলী চোখে! অবশ্য এলাকাবাসী যতেœর ত্র“টি করেনি। এর ভেতরেই দু’দফা শরবত ও এই ভয়ঙ্কর গরমে স্থানীয় ‘হাজি এণ্ড সনস্ রেস্টুরেন্টের’ গরম গরুর বিরানীর প্যাকেট ও বোরহানি খাওয়ানো হয় তাকে। সাথের পার্টির নেতা-কর্মীরাও বাদ যায় না। খেতে গিয়ে তার রীতিমতো আতঙ্ক বোধ হয়। নগর ভবনে গিয়েই ওর স্যালাইনের নির্দেশ দিতে হবে। মাস্ট। এরই ভেতর শয়তান আলিমুজ্জামানের লেলানো লোকজন ভিড়ের ভেতর হতে শ্লোগান তোলে, ‘১৪ নং ওয়ার্ডে বিদ্যুৎ নাই কেন? মুরতাদ মেয়র জবাব চাই! সারা শহরে পানি নাই কেন? নাস্তিক মেয়র জবাব চাই!’
আলিমুজ্জামানের লোকজনই আবার শ্লোগানকারীদের দিকে তেড়ে যায়, ‘অই বেত্তমিজ পোলাপান কথা বুল্যে কে র্যা?’
আলিমুজ্জামান নিজেও দাঁত কেলিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, ‘খবরদার বেআক্কল পুলাপান! মেয়র ছাহেব আমাদের খুব ইজ্জতের মানুষ!’
বেলা পৌনে তিনটা নাগাদ তিনি বোঝেন যে কোন মুহূর্তে তিনি নিজেই হিট স্ট্রোকে মাথা ঘুরে পড়ে যেতে পারেন। তার গলার স্বর উদাত্ত ও সুদূরপ্রসারী। দুই হাত দু’পাশে ছড়িয়ে, ভিজে চুপচুপ পাজামা-পাঞ্জাবিতেই তিনি যখন উঠে দাঁড়ান, জনতা বরাবরের মতো তার রূপে মুগ্ধ হয়ে একধরনের নীরবতায় থেমে যায়।
‘প্রিয় ১৪ নং ওয়ার্ডবাসী! আস্সালামু আলাইকুম! বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম!’
আরে কী সুন্দর পারছেন তিনি এখন! ক্যাম্পাসে থাকতে কী জানি বলতেন? ‘সংগ্রামী সাথী ও বন্ধুগণ’? হ্যাঁ, তাইই তো বলতেন তিনি। যাই বলেন না কেন তিনি, তার কথনে জনতা সম্মোহিত হয়ে পড়ে। বিমুগ্ধ ও নিশ্চুপ হয়ে মন্ত্রবন্দির মতো শোনে।
‘অত্র এলাকায় আমার মুরব্বি ও ভাই-বোনেরা!’
আহ্, এবারো পারলেন দেখা গেল! ঠিক এদের ভাষাতেই এদের তিনি চমৎকার সম্বোধন করতে পারছেন।
‘আপনারা সবাই আমার সালাম গ্রহণ করুন। বিগত সিটি কর্পোরেশন ইলেকশনে আপনারা আমায় নির্বাচনে জয়যুক্ত করায় আপনাদের অশেষ মেহেরবানী। আজ এই শুক্রবারে আপনাদের সবার সাথে পবিত্র জুমার নামাজে অংশ নিতে পেরে নিজেকে আমি সৌভাগ্যবান মনে করছি। আমি জানি আমি এমন এক সময়ে আপনাদের ওয়ার্ডে এসেছি যখন সারা দেশেই বয়ে যাচ্ছে অব্যাহত তাপপ্রদাহ। তার ভেতর উত্তরের মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে যদি বা গত এক/দেড় মাসে কিছু বৃষ্টি হয়েছে, আমাদের উত্তরাঞ্চলে এক ফোঁটা বৃষ্টি নেই। প্রকৃতির এমন ভয়ঙ্কর বিরূপতা, আবহাওয়াবিদদের মতে, গত কয়েক দশকে দেখা দেয় নি। তবে, ধৈর্য্য ধরুন আপনারা। লোডশেডিং বা পানির কষ্ট…সরকার ও সিটি কর্পোরেশন হতে অমানুষিক চেষ্টার পরও কিছু সমস্যা থেকেই যাচ্ছে…আপনারা সেই ভুল বা সমস্যার জন্য আমাদের মাফ করবেন! আমরা চেষ্টার কোনো ত্র“টি রাখছি না। আর আপনাদের এলাকার ওয়ার্ড কমিশনার আলিমুজ্জামান ভাই…উনি বয়সে ও সব ধরনের যোগ্যতাতেই আমার চেয়ে অনেক বড়…আমার আপন বড়ভাইয়ের মতো মানুষ…এই এলাকায় উনি আমার প্রতিনিধি…আপনাদের যা ফরিয়াদ, ওনাকে জানাবেন! রোজ ত আমি আসতে পারব না! ওনার মুখ থেকে আমরা শুনব!’
নগরপিতা এক গ্লাস পানির জন্য হাত বাড়ালে তাকে কোক ঢেলে দেওয়া হলো গ্লাসে। হ্যাঁ, সব ঠিক আছে। তৃতীয় বিশ্বের যেসব দেশে জনতার শিক্ষার স্তর নিচু, সেদেশে নেতৃত্বে উচ্চতা বা রূপ একটা বড় ফ্যাক্টর। সব দেশেই ফ্যাক্টর। তবে, ক্ষুধার্ত ও নিরন্ন মানুষ ধবধব ফর্সা, স্বাস্থ্যবান কী দীর্ঘ মানুষকে নেতা হিসেবে দেখতে বড় পছন্দ করে। পছন্দ করে নিজের ঠিক বিপরীত চেহারাটি দেখতে। হ্যাঁ, একদম ঠিক খোঁচাটিই দিয়েছেন তিনি। এই এলাকার কমিশনার আলিমুজ্জামান। এই ওয়ার্ডে পানি-বিদ্যুৎ না আসার ব্যর্থতা তার। ঐ দ্যাখো, আলিমুজ্জামানের মুখ কেমন কালো হয়ে গেছে!
‘আজ অনেক বেলা হয়েছে। বাদ জুম্মা আপনারা অনেকেই খাওয়া-দাওয়া করেন নি। আপনারা ক্লান্ত। গরমে কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। বেলা বাড়তে থাকলে অসুস্থতাও বাড়বে। আমি আপনাদের সব অভিযোগ মন দিয়ে শুনেছি। আমার বিশেষ তাড়া আছে। দুপুর সোয়া একটায় নগর ভবনে ‘খরা পরিস্থিতি মোকাবেলায় আশু করণীয়’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বসার কথা ছিল। যেখানে এই নগরীর আবহাওয়া অধিদপ্তর শাখার প্রধান আবহাওয়াবিদ, সেচ ও পানি প্রকৌশলী, বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজন, নগর ভবনের কর্মকর্তাসহ সবাই আপনাদের সমস্যা কীভাবে কাটানো যায় সে বিষয়ে গোল টেবিলে বসবে। আমি আপনাদের এলাকায় আরো কিছু টিউব-ওয়েল স্থাপনের উদ্যোগ নেব। ইমাম সাহেব মসজিদে জেনারেটর লাগাতে বলেছেন। আমি সে অনুরোধও তার রাখব। কিন্তু, আর মনে হয় আপনাদের এখানে থাকতে পারছি না! খরা পরিস্থিতি মোকাবেলার মিটিংয়ে আমার জন্য সবাই বসে আছে! আপনারা সবাই আমাকে আজকের মতো আসতে দিলে আপনাদের আল্লাহ হাফেজ! বাংলাদেশ জিন্দাবাদ!’
‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ!’ জনতা আছড়ে পড়ে তরুণ, সুদর্শন ও শিক্ষিত নেতার প্রতি অভিভূত মূর্চ্ছনায়।
এখন নগর ভবনের সাংবাদিক সম্মেলন কক্ষে বিদ্যুৎহীন জেনারেটরে এসি চলছে। নগরভবনে এসেই তিনি ভাল করে হাত-মুখ একদফা ধুয়ে, বাথরুমে রাখা বডি স্প্রে গায়ে ঢেলে কোনো রকমে দিনের দ্বিতীয় বৈঠকের জন্য প্রস্তুত হয়েছেন। দুপুরের বিরিয়ানি বলতে গেলে কিছুই তিনি মুখে দেন নি। সমস্যা নেই। খরা পরিস্থিতি শীর্ষক গোলটেবিলে এক্ষুনি ভেজিটেবল সমোচা, চিকেন রোল, কলা, রসগোল্লা ও চা সার্ভ করা হবে। এসির ঠাণ্ডা বাতাসে এতক্ষণে শরীরটা একটু ঝিরঝির লাগছে! ঘুম পাচ্ছে রীতিমতো। নগরীর বিভিন্ন এলাকার টিউবওয়েল বা পানি সরবরাহ নিয়ে কথা হলো। সেচ ও পানি বিষয়ক প্রকৌশলী ম্যাপ ও পাওয়ার পয়েন্টের সাহায্যে ফারাক্কা বাঁধের বিভিন্ন পয়েন্টে নদীর পানি কমে যাওয়া এবং বৃষ্টিহীনতার দরুন ভূগর্ভস্থ পানি তুলতে নলকূপগুলোর অসহায়ত্বের কথা বোঝালেন। পিডিবির বিভাগীয় প্রধান সিস্টেম লসের কথা তুলে আত্মরক্ষার চেষ্টা করলেন। এক কৃষিবিদ হাত তুলে অনেকক্ষণ ধরেই দৃষ্টি আকর্ষণের কথা তুলছিলেন। তাকে ফ্লোর দেওয়ায় তিনি এই প্রবল গরমে মাঠে পড়ে থাকা বৃষ্টি ও সেচহীন কৃষকদের সবার অবস্থা একবার ভাবতে বলায় এসির নিচে জুড়োতে থাকা লোকগুলো হঠাৎই সারা দিন গরম ধোঁয়াশায় ভুগে এখন এই এক ঘণ্টার ঠাণ্ডাঘরের গরমোত্তর ঠাণ্ডা পোহানোর সময়টা মিলিয়ে এ ওর দিকে বিকল দৃষ্টিতে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। তারা আর কিছুই আসলে ভাবতে বা বুঝতে পারছিল না! আবহাওয়াবিদের বক্তব্যের আগে জেনারেটরও কুঁই কুঁই শব্দ করে তার ফুরিয়ে আসা রসদের ইঙ্গিত জানায়। কিছু মোম নিয়ে আসা হয় ঝটিতি করে।
‘এক কাজ করা যাক। আমরা অন্ধকারের ভেতরেই খেতে থাকি। কারণ, আমাদের ভেতর উপস্থিত আবহাওয়াবিদকেও হয়তো তার বক্তব্যের সমর্থনে অনেক ম্যাপ বা ম্যাটেরিয়াল প্রদর্শন করতে হবে। কী বলেন?’ নগরপিতা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন।
আবহাওয়াবিদ এ কথায় খুশি হয়ে মাথা নাড়েন।
ঝটাঝট সাদা-লম্বা-মোটা মোমগুলো গো-ল ও দীর্ঘ টেবিলটির নানা কোণায় বসানো হতে থাকে। জানালা-দরজা খুলে ও পর্দা টেনে সরিয়ে দেওয়া হয়। ঘরে বাতাস আসে বা আসে না। ঘড়িতে প্রায় সন্ধ্যা ছ’টা। গরমের ভেতর মোমের আলোয় সবার মুখে রসগোল্লা-কলা-ভেজিটেবল সমোচা-চিকেন রোল দলিত হতে থাকে। বিদ্যুৎহীনতার দরুন বিশেষজ্ঞ আবহাওয়াবিদের বক্তব্য বন্ধ আপাততঃ। গোলটেবিলের মানুষেরা নানা খুচরা আড্ডায় মেতে উঠেছে।
‘অই কারেন্ট এসেছে…’ কেউ বললো। আবারো হুড়মুড় পর্দা টেনে, জানালা-দরজা আটকে এসি ছাড়া হলো। দেখতে দেখতে গরমে ধুঁকতে থাকা মানুষগুলো আবার ঠাণ্ডায় জমতে শুরু করবে। এসির রিমোট হাতে তখন ঠাণ্ডা কমানো বা বাড়ানো হবে। আবার কারেন্ট যাবে।
‘সম্মানিত সুধীজন,’ তরুণ নগরপিতা নিজের হাতে টেবিলে রাখা হ্যাণ্ড মাইক্রোফোন সেট তুলে নেন। ‘আমাদের সবার বৈকালিক চা-পান শেষে…হ্যাঁ, বিদ্যুৎও চলে এসেছে…আলোচনার এ পর্যায়ে আমি আজকের অনুষ্ঠানের শেষ বক্তা এবং বিভাগীয় আবহাওয়া অফিসের প্রধান বিজয়েন্দ্র পাল মহাশয়কে বক্তব্য জানাতে আহ্বান করছি!’
বিজয়েন্দ্র পাল মহাশয় তার কপালের সাদা-কালো চুল সরিয়ে ইতস্থতঃ ভঙ্গিতে শুরু করেন। ‘শুভসন্ধ্যা। আপনাদের ফোল্ডারে সবাই দেখবেন আমরা আবহাওয়া বিভাগ হতে গত ১২ই চৈত্র অর্থাৎ ২৬শে মার্চ হতে ১২ই বৈশাখ অর্থাৎ ২৬শে এপ্রিল পর্যন্ত সারা দেশের আবহাওয়ার প্রতিদিনকার তথ্য বিবরণী দিয়েছি।’
আবহাওয়াবিদের কথামতো সবাই কিছুক্ষণের জন্যও ফোল্ডারের আবহাওয়া ব্যুলেটিনে চোখ বুলায়।
‘১২ই চৈত্র । ২৬শে মার্চ। শুষ্ক তাপমাত্রা।
আজ সারা দেশে তাপমাত্রা শুষ্ক থাকবে। সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও এবং টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের কিছু এলাকায় হঠাৎই দমকা হাওয়া ও বজ্র বা বিদ্যুৎ সহযোগে বৃষ্টি দেখা দিলেও দেশের উত্তরাঞ্চলে আবহাওয়া প্রধানতঃ শুষ্ক থাকবে। চব্বিশ ঘণ্টার ভেতর সারা দেশেই দিনের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে, আবহাওয়া অধিদফতরের পূর্বাভাস জানিয়েছে। গতকাল রাঙামাটিতে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৫.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং শ্রীমঙ্গলে সর্বনিম্ন ১৮.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। রাজধানী ঢাকা শহরে সূর্যাস্ত সন্ধ্যা ৬:১৭ মিনিটে এবং সূর্যোদয় আগামী কাল সকাল ৫:৪৪ মিনিটে। দেশের কিছু প্রধান নগরী ও শহরে গতকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ও বাতাসের আর্দ্রতার পরিমাণ ছিল নিম্নরূপ:
নগর/শহর
তাপমাত্রা
(সেলসিয়াস)
বাতাসের আর্দ্রতা
(শতাংশ)
সর্বোচ্চ সর্বনিম্ন সকাল সন্ধ্যা
ঢাকা ৩৬.০ ২৩.০ ৬৬ ৫০
চট্টগ্রাম ৩২.৪ ২৫.০ ৭৭ ৭১
রাজশাহী ৩৮.৮ ২৫.২ ৭৪ ৪৪
খুলনা ৩৫.৫ ২৬.০ ৭৬ ৬২
বরিশাল ৩৪.৭ ২৫.৮ ৮৩ ৬৫
সিলেট ৩৪.৫ ২৬.০ ৬৮ ৫৯
কক্সবাজার ৩৪.২ ২৫.২ ৬৮ ৫৯
তাপমাত্রা
(সেলসিয়াস)
বাতাসের আর্দ্রতা
(শতাংশ)
সর্বোচ্চ সর্বনিম্ন সকাল সন্ধ্যা
ঢাকা ৩৬.০ ২৩.০ ৬৬ ৫০
চট্টগ্রাম ৩২.৪ ২৫.০ ৭৭ ৭১
রাজশাহী ৩৮.৮ ২৫.২ ৭৪ ৪৪
খুলনা ৩৫.৫ ২৬.০ ৭৬ ৬২
বরিশাল ৩৪.৭ ২৫.৮ ৮৩ ৬৫
সিলেট ৩৪.৫ ২৬.০ ৬৮ ৫৯
কক্সবাজার ৩৪.২ ২৫.২ ৬৮ ৫৯
আবহাওয়াবিদ এখন একটি স্কেল হাতে দেয়ালে প্রকাণ্ড ম্যাপ টাঙিয়ে ঠোঁট নাড়ছেন। ছোটবেলায় ভূগোল পড়তে নগরপিতা ভালবাসতেন। ‘তুন্দ্রা অঞ্চলের জলবায়ু’, ‘গর্জনশীল চল্লিশা’ কী ‘নিশীথ সূর্যের দেশ’ ভাবাতো তাকে। ধীরে-সুস্থে ফোল্ডারের প্রতিটি পাতা উল্টে চলেন তিনি। মধ্য চৈত্র হতে এই যে খরা শুরু হয়েছে, এখন কী অবস্থা?
২রা বৈশাখ । ১৫ই এপ্রিল। তাপপ্রদাহ অব্যাহত থাকবে।
ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল বিভাগসহ এবং রাঙামাটি ও মাইজদি কোর্টে আগামী বারো ঘণ্টা ধরে সন্ধ্যা ছ’টা অবধি সারাদিন ধরে মৃদু হতে মাঝারি তাপপ্রদাহ অব্যাহত থাকবে। পাশাপাশি, আকাশে মাঝে মাঝে মেঘ দেখা দিলেও বৃষ্টি হবে না। রাজশাহী অঞ্চলে অত্যধিক গরম তাপমাত্রা ও সেই সাথে লু হাওয়া বইতে পারে। গতকাল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় রাজশাহীতে ৩৯.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং দিনাজপুরে সর্বনিম্ন ২২.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাজধানীতে আজ সূর্যাস্ত সন্ধ্যা ৬:২৪ মিনিটে এবং আগামীকাল সূর্যোদয় ৫:৩১ মিনিটে। গতকাল দেশের কিছু প্রধান নগর ও শহরে রেকর্ডকৃত সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ও বাতাসের আর্দ্রতা ছিল যথাক্রমে:
২রা বৈশাখ । ১৫ই এপ্রিল। তাপপ্রদাহ অব্যাহত থাকবে।
ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল বিভাগসহ এবং রাঙামাটি ও মাইজদি কোর্টে আগামী বারো ঘণ্টা ধরে সন্ধ্যা ছ’টা অবধি সারাদিন ধরে মৃদু হতে মাঝারি তাপপ্রদাহ অব্যাহত থাকবে। পাশাপাশি, আকাশে মাঝে মাঝে মেঘ দেখা দিলেও বৃষ্টি হবে না। রাজশাহী অঞ্চলে অত্যধিক গরম তাপমাত্রা ও সেই সাথে লু হাওয়া বইতে পারে। গতকাল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় রাজশাহীতে ৩৯.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং দিনাজপুরে সর্বনিম্ন ২২.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাজধানীতে আজ সূর্যাস্ত সন্ধ্যা ৬:২৪ মিনিটে এবং আগামীকাল সূর্যোদয় ৫:৩১ মিনিটে। গতকাল দেশের কিছু প্রধান নগর ও শহরে রেকর্ডকৃত সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ও বাতাসের আর্দ্রতা ছিল যথাক্রমে:
নগর/শহর
তাপমাত্রা
(সেলসিয়াস)
বাতাসের আর্দ্রতা
(শতাংশ)
সর্বোচ্চ সর্বনিম্ন সকাল সন্ধ্যা
ঢাকা ৩৬.৬ ২৬.৭ ৭৪ ৫৩
চট্টগ্রাম ৩২.৫ ২৫.৮ ৭৮ ৭৬
রাজশাহী ৩৯.৮ ২৩.৬ ৭২ ৩৮
খুলনা ৩৭.৫ ২৬.৬ ৭৬ ৫৪
বরিশাল ৩৬.৮ ২৬.৫ ৮০ ৬৭
সিলেট ৩৫.৩ ২৫.৬ ৬৯ ৫৫
কক্সবাজার ৩৪.৪ ২৫.০ ৭৩ ৭৭
তাপমাত্রা
(সেলসিয়াস)
বাতাসের আর্দ্রতা
(শতাংশ)
সর্বোচ্চ সর্বনিম্ন সকাল সন্ধ্যা
ঢাকা ৩৬.৬ ২৬.৭ ৭৪ ৫৩
চট্টগ্রাম ৩২.৫ ২৫.৮ ৭৮ ৭৬
রাজশাহী ৩৯.৮ ২৩.৬ ৭২ ৩৮
খুলনা ৩৭.৫ ২৬.৬ ৭৬ ৫৪
বরিশাল ৩৬.৮ ২৬.৫ ৮০ ৬৭
সিলেট ৩৫.৩ ২৫.৬ ৬৯ ৫৫
কক্সবাজার ৩৪.৪ ২৫.০ ৭৩ ৭৭
অসম্ভব পানি পিপাসা পেয়েছে। সেই সাথে সিগারেটের তৃষ্ণাও। কিন্তু, এই এসি কক্ষে এবং জরুরি বৈঠকের মাঝখানে ধূমপান করা যাবে না। ফোল্ডারে শেষতম দিন অর্থাৎ আজকের আবহাওয়া সংবাদের দিকে শেষ নজর বোলান তিনি।
২৬ এপ্রিল, ১২ই বৈশাখ। সহসা এ তাপপ্রদাহ কমার কোনো সম্ভাবনা নেই।
আগামী বারো ঘণ্টা ধরে অর্থাৎ সন্ধ্যা ছ’টা পর্যন্ত দেশের সর্বত্র আবহাওয়া শুষ্ক থাকবে।
ঢাকা ও খুলনা, শ্রীমঙ্গল, রাঙামাটি ও চাঁদপুরে মৃদু মাত্রার তাপপ্রদাহ এবং রাজশাহী অঞ্চলে মাঝারি হতে গুরু মাত্রার তাপপ্রদাহ বয়ে যেতে পারে, আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে।
সারাদিন ধরে দিনের তাপমাত্রা অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
গতকাল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রাজশাহীতে ৩৮.৮ ডিগ্রি এবং সৈয়দপুরে ২২.৮ ডিগ্রি রেকর্ড করা হয়েছে।
রাজধানীতে আজ সন্ধ্যা ছ’টায় সূর্যাস্ত এবং আগামীকাল সকাল ৫:২৮ মিনিটে সূর্যোদয়। গতকাল দেশের কিছু প্রধান নগর ও শহরে রেকর্ডকৃত সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ও বাতাসের আর্দ্রতা ছিল যথাক্রমে:
২৬ এপ্রিল, ১২ই বৈশাখ। সহসা এ তাপপ্রদাহ কমার কোনো সম্ভাবনা নেই।
আগামী বারো ঘণ্টা ধরে অর্থাৎ সন্ধ্যা ছ’টা পর্যন্ত দেশের সর্বত্র আবহাওয়া শুষ্ক থাকবে।
ঢাকা ও খুলনা, শ্রীমঙ্গল, রাঙামাটি ও চাঁদপুরে মৃদু মাত্রার তাপপ্রদাহ এবং রাজশাহী অঞ্চলে মাঝারি হতে গুরু মাত্রার তাপপ্রদাহ বয়ে যেতে পারে, আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে।
সারাদিন ধরে দিনের তাপমাত্রা অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
গতকাল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রাজশাহীতে ৩৮.৮ ডিগ্রি এবং সৈয়দপুরে ২২.৮ ডিগ্রি রেকর্ড করা হয়েছে।
রাজধানীতে আজ সন্ধ্যা ছ’টায় সূর্যাস্ত এবং আগামীকাল সকাল ৫:২৮ মিনিটে সূর্যোদয়। গতকাল দেশের কিছু প্রধান নগর ও শহরে রেকর্ডকৃত সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ও বাতাসের আর্দ্রতা ছিল যথাক্রমে:
নগর/শহর
তাপমাত্রা
(সেলসিয়াস)
বাতাসের আর্দ্রতা
(শতাংশ)
সর্বোচ্চ সর্বনিম্ন সকাল সন্ধ্যা
ঢাকা ৩৬.০ ২৩.০ ৬৬ ৫০
চট্টগ্রাম ৩২.৪ ২৫.০ ৭৭ ৭১
রাজশাহী ৩৮.৮ ২৫.২ ৭৪ ৪৪
খুলনা ৩৫.৫ ২৬.০ ৭৬ ৬৪
বরিশাল ৩৪.৭ ২৫.৮ ৮৩ ৬৫
সিলেট ৩৪.৫ ২৬.০ ৬৮ ৫৯
কক্সবাজার ৩৪.২ ২৫.২ ৬৮ ৫৯
তাপমাত্রা
(সেলসিয়াস)
বাতাসের আর্দ্রতা
(শতাংশ)
সর্বোচ্চ সর্বনিম্ন সকাল সন্ধ্যা
ঢাকা ৩৬.০ ২৩.০ ৬৬ ৫০
চট্টগ্রাম ৩২.৪ ২৫.০ ৭৭ ৭১
রাজশাহী ৩৮.৮ ২৫.২ ৭৪ ৪৪
খুলনা ৩৫.৫ ২৬.০ ৭৬ ৬৪
বরিশাল ৩৪.৭ ২৫.৮ ৮৩ ৬৫
সিলেট ৩৪.৫ ২৬.০ ৬৮ ৫৯
কক্সবাজার ৩৪.২ ২৫.২ ৬৮ ৫৯
আবহাওয়াবিদ সমরেন্দ্র পাল সমানে ব্যাটন নেড়ে চলেছেন দেয়ালে টাঙানো ম্যাপ বরাবর। রুমের মাঝ বরাবর প্রজেক্টরে আলো ফেলে কম্পিউটার হতে মেঘের নানা স্লাইড দেখানো হচ্ছে।
‘প্রকৃতপক্ষে, দেশের বায়ুমণ্ডল এবং মাটি এখন প্রচণ্ড রকম উত্তপ্ত। এ অবস্থায় উচ্চ চাপ বলয়ের শক্তি কমে গেলে এবং বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয়বাষ্প ভেসে এলে তীব্র কালবৈশাখী এবং টর্নেডো হতে পারে। ভূমধ্যসাগরে সৃষ্ট পশ্চিমা লঘুচাপ হিমালয়ের গা বেয়ে পূর্বদিকে বিস্তৃত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এর সঙ্গে পুবালী লঘুচাপের সংযোগ এবং পশ্চিমবঙ্গের শুকনো হাওয়া মিলেমিশে তৈরি করে বজ্র মেঘ। এই বজ্র মেঘই কালবৈশাখী হয়ে লণ্ডভণ্ড করে দেয় সমগ্র চরাচর!’
আবহাওয়াবিদ টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি তুলে খান।
‘সবই তো বুঝলাম। কালবৈশাখী আসছে না কেন? একটু ঝড় কেন হচ্ছে না?’ আবহাওয়াবিদকে ঘিরে টেবিলে বসে থাকা মানুষগুলো ছটফটাতে থাকে।
‘বাংলাদেশে এপ্রিল ও মে মাসে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে। এ সময় তীব্র গরমের পরপরই আধ ঘণ্টার ব্যবধানে ঝড়ো আবহাওয়া তৈরি হয়। প্রাক-বর্ষা মৌসুমে তাপমাত্রা বেশি থাকায় কালবৈশাখীর দাপটও থাকে বেশি। চীন সাগরে বিরাজমান একটি সাইক্লোন এই তাপপ্রবাহ দীর্ঘায়িত হওয়ার মূল কারণ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে বিরাজমান তাপীয় লঘুচাপ। এশিয়া মহাদেশের আকাশের সব মেঘমালা চীন সাগরের সাইক্লোনের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে। নতুন মেঘও তৈরি হচ্ছে না। ফলে আকাশ মেঘহীন হয়ে বৃষ্টিপাত বন্ধ হয়ে গেছে। কালবৈশাখীও হয় নি।’
‘বুঝলাম…আপনার এত টেকনিক্যাল কথা-বার্তা আমরা তো বুঝব না। কথা হলো, কালবৈশাখী এখনো হচ্ছে না! কিন্তু, হবে না?
‘ঝড়-বৃষ্টি হবে না?’
‘হবে!’ আবহাওয়াবিদ হাত তুলে আশ্বস্ত করেন।
মুহূর্তে শুনশান নীরবতা নেমে আসে।
‘হবে? বৃষ্টি কি হবে? ঝড় হবে?’
‘কবে নাগাদ হবে? কবে?’ নগরপিতা দেখেন তিনিও কখন অধৈর্য্য অন্য সব শ্রোতার সাথে গলা মিলিয়েছেন।
‘চীন সাগরের সাইক্লোনটা কাটতে আরো প্রায় দুই সপ্তাহ লাগবে। পশ্চিমবঙ্গের তাপীয় লঘুচাপ মিলাতেও দুই সপ্তাহ। তারপরই বৃষ্টি হবে!’ যেন বা কোনো পরম দৈবজ্ঞ মানুষকে আশ্বস্ত করছেন।
‘তারপরই বৃষ্টি হবে?’
‘হওয়ার কথা। যদি আবহাওয়া বিজ্ঞান মিথ্যা না হয়,’ আবহাওয়াবিদ আরো এক গ্লাস পানিতে চুমুক দেন।
ঙ.
‘সম্মানিত নগরবাসী, আসসালামু আলাইকুম। বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। মাননীয় মেয়র আবুল কালাম টুকু দেশব্যপী বিশেষতঃ উত্তর বাংলার গত একমাস ব্যপী তীব্র খরার প্রেক্ষিতে আগামী ১১ই মে শুক্রবার শহরের কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মসজিদে বৃষ্টি নামানোর জন্য পরম করুণাময় আল্লাহ্ তা’য়ালার দরবারে বিশেষ নামাজ ও ইবাদত-বন্দেগির আয়োজন করেছেন। আপনারা দলে দলে যোগ দিন! দলে দলে যোগ দিন!’
ইরফান ও সাব্বির মুখ নিচু করে বসে আছে।
‘এটা না করলে চলতো না?’
আবুল কালাম টুকু হাসেন, ‘নাচতে নামলে ঘোমটা রাখা যায় না! এই বুর্জোয়া রাজনীতি যখন মেনেই নিয়েছি, ভোটের রাজনীতিতে যখন দাঁড়িয়েছি…তখন জনপ্রিয়তা অর্জন করতে হবে! আলিমুজ্জামান নামের চোরাকারবারীটা আমার অতীতের কমিউনিস্ট পরিচয়টা নিয়ে মানুষের কাছে আমাকে নাস্তিক প্রমাণ করতে চাইছে। আমি তার সেই ফাঁদে ধরা দেব কেন?’
‘ঠিক আছে…কিন্তু, বৃষ্টি যদি না নামে?’ ইরফান উত্তেজিত হয়ে সিগারেট ধরায়।
‘আবহাওয়া অফিসের পরিচালক তো বললেন যে বৃষ্টি নামবে!’
‘হায়, আবহাওয়া অফিসের কথায় কোনো ঠিক আছে?’ সাব্বির মুখ খোলে।
‘বন্ধুগণ, আমরা সবাই কিন্তু বৈজ্ঞানিক ও দ্বান্দিক বস্তুশাস্ত্রের এবং সমাজতন্ত্রের দীক্ষা নিয়েছি। সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি সেলডম মেকস আ রং। ভুল একেবারে করে না, সেটা বলবো না! তবে কদাচিৎ ভুল করে! আবহাওয়া বিজ্ঞান বিজ্ঞানের অন্তর্গত। সে ভুল করে কম।’
‘আর যদি করে?’
‘ইন দ্যাট কেস, ইউ মাস্ট টেক আ চান্স অর রিস্ক। গ্রেট থিংস আর অ্যাচিভড্ থ্রু গ্রেট ডেঞ্জারস। ইরফান- সাব্বির, আমরা আমাদের অতীতের জীবন ছেড়ে এসেছি। বিপ্লবীর সারা জীবনের আদর্শ আমরা…হ্যাঁ, সত্যি বলতে…রাখি নাই। রঞ্জন ও সারোয়ার মারা গেছে। কিন্তু, আমাদের মরবার সাহস হয় নি। আতাউল ও রেজাউর পলাতক। সম্ভবতঃ তারা বগুড়ার আশপাশে যমুনার কোনো চরে লুকিয়ে আছে। আমরা আরো সত্তর বছরেও বিপ্লব করতে পারতাম না! বুর্জোয়া দলের জনপ্রতিনিধি হয়েই দেখা যাক কী করতে পারি। এই বুর্জোয়া দলটি আমাদের ইনোভার্সিটির ক্লিন এন্ড আইডিয়াল লেফটিস্ট ইমেজটা কাজে লাগিয়েছে। আমাদের ফ্রেশ স্টুডেন্ট ইমেজটা। কিন্তু, একবার নির্বাচনে জেতা আর একটা নগরে কালো টাকা আর সন্ত্রাস নির্ভর সংগঠন গড়ে তোলা…যা ছাড়া এ ধরনের দলে বেশিদিন রাজনীতি করা যায় না…সেটা আছে আলিমুজ্জামানের। হয়তো আমিও খুব দ্রুতই পচে উঠব কি টেন পার্সেন্ট কমিশন খাব…কিন্তু, এখনো যখন হই নি…একজন আলিমুজ্জামানের চেয়ে আমি হয়তো মানুষের জন্য কম ক্ষতিকর…তাছাড়া, আমরা যে নিতান্ত নাগরিক মধ্যবিত্ত ঘেঁষা নিরীশ্বরবাদী বাম রাজনীতি করে এসেছি এতদিন…তা কি আদৌ স্পর্শ করেছে কাউকে? সো, লেট আস মেক অ্যানাদার ডিফারেন্ট ট্রাই! গ্রামের কৃষক বৃষ্টির জন্য ফেরেশতা মিকাইলের সুরা পড়ে, রক্ষাকালীর মানত দেয় হিন্দুরা কিম্বা ধর্মেরও আগের যে লোকাচার…সেই ব্যাঙের বিয়ে দেয়! কী বলবে তোমরা একে?’
চ.
নগরীর কেন্দ্রীয় মসজিদে আজ বিশাল নামাজের জমায়েত। এই নামাজ বৃষ্টির জন্য। যেন ধারাজল স্পর্শ করে মাটি। যেন কৃষক ফলাতে পারে শস্য। গ্রাম হতে এই নামাজের খবর পেয়ে কৃষকেরাও এসেছে। (আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীনাররাহমানির রাহীম। মালিকি ইয়াউমিদ দীনি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ইয়াফআলু মা য়ুরিদ। আল্লাহুম্মা আনতাল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা আনতাল গানিয়্যু ওয়া নাহ্নুল ফুক্বারাউ আনযিল আলাইনাল গাইছা ওয়াজ্বআল মা আনযালতা লানা কুওয়্যাতান ওয়া বালাগান ইলা খাইরিন) — ‘সকল প্রশংসা পৃথিবীর পালনকর্তা আল্লাহ্র জন্য, তিনি পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু এবং শেষ বিচারের দিনের মালিক। আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোনো মাবূদ নেই, তিনি যা ইচ্ছা করেন তা করেন। হে আল্লাহ্! তুমি একমাত্র মাবূদ, তুমি ছাড়া আর কোনো মাবূদ নেই। তুমি অতি ধনী ও আমরা গরীব, আমাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষণ কর এবং আমাদের জন্য যা নাযিল কর তা আমাদের জন্য শক্তিময় ও ফলদায়ক।’
‘ওয়া ফাজ্জ্বারনাল আরদ্বা উয়ূনান ফালতাক্বাল মাউ আ’লা আমরিন (এবং আমিই পৃথিবীতে আকাশের পানি দ্বারা ঝরনাসমূহ প্রবাহিত করেছিলাম। তদ্বারা নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি জমা হয়েছিল)।’
ইমাম সাহেব দু’হাত আকাশের দিকে তোলেন, ‘হযরত নূহ (আঃ)-এর সময় মহাপ্লাবনে আল্লাহ তায়ালা ঐ সময় আসমান হতে পানি বর্ষণ করে প্রবল বন্যায় জগত ভাসিয়ে দিয়েছিলেন।’
‘আল্লাহ মহান। তিনিই তোমাদের বিদ্যুৎ দেখান যা আশংকা ও আশা সঞ্চার করে এবং তিনিই পানিতে পরিপূর্ণ মেঘমালা উত্থিত করেন। বজ্র নির্ঘোষ প্রশংসার সাথে তাঁর মহিমা-পবিত্রতা ঘোষণা করে এবং অন্যান্য ফেরেশতারাও তাঁকে ভয় করে। আর তিনি বজ্রপাত করেন এবং যাকে ইচ্ছে তাকে তা দিয়ে আঘাত করেন। তথাপি তারা আল্লাহ সম্বন্ধে বিতর্ক করে। অথচ, তিনি মহাশক্তিমান!’
সবাই সেজদায় নত হয়।
মাঠে মাঠে কৃষকেরা নামাজে রত। হা ফেরেশতা মিকাইল! বৃষ্টি দরকার। আল্লাহ মেঘ দে পানি দে ছায়া দে। এত বেরহম কেন তুই আল্লাহ্ মালিক? পানি — এক ফোঁটা পানি দে ইয়া রব —
নামাজের পর সারা দুপুর মৌন, খরাময় ও ভ্রুকুটিভয়াল। সন্ধ্যাতেও তাই। রাতটা ভারি হয়ে রইলো নিস্তব্ধ। রাত গড়াচ্ছে কেবলি রাতের কোলে। রাতটা অমনি গেল। রাত পেরিয়ে সকালেও ঠা ঠা রোদ। দুপুর আবার গুমোট, আবার ভারি। সন্ধ্যা নাগাদ ঈশান কোণে দেখা দিল অল্প অল্প মেঘ। শিরশিরিয়ে একটু যেন হিম বাতাস বয়ে গেল! আরে, তাজ্জব তো? সত্যি সত্যি বৃষ্টি নামছে নাকি? আহ্…এক ফোঁটা…এক ফোঁটা বৃষ্টিও যদি…পিপাসার্ত হাত, জিভ আর শরীর নিয়ে ঘরের বাইরে বের হয়ে এলো সবাই। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে! আহ্ বৃষ্টি…আয়..আয়…বাবা, আর ভোগাবি না…
ওওওওওওওওওওওওওওওওওওওওওওওওওওওও
বৃষ্টি আসছে!
আল্লাহর কি বরকত!
ঘরের জানালা দাও!
না-জানালা খোলা থাক –
ভিজে যাবে ত’ সব –
ভিজুক না! এতদিন পুড়ছে সব!
এই বৃষ্টির পানি ধরো –
খোকার গায়ে ঘামাচি — বৃষ্টিতে দাঁড় করায় দাও –
মেয়র সাহেবের কী কুদরত!
তার কুদরত না। আল্লাহরই কুদরত! তবে তিনি আল্লাহর মোমিন বান্দা।
এই শয়তান আবুল কালাম টুকু ছিল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বড় ছাত্রনেতা। তারপর লেফট পলিটিক্স ছেড়ে বুর্জোয়া রাজনীতিতে আসলো তো আসলো — এখন কিনা আবহাওয়াবিদের কাছ থেকে কনফার্ম হইয়া মসজিদে নামাজ পইড়া পপ্যুলার হইলো — কমন পিপলের ধর্মান্ধতা আর সুপার¯িটশন বাড়াইলো!
আরে বাদ দাও রাজনীতির কচকচি! আজ খিচুড়ি-ইলিশ করো না! এ ক’দিন গরমে গানও শুনতে ইচ্ছা করে নি! গতকাল কলিম শরাফির একটি নতুন সিডি কিনেছি রবীন্দ্রসঙ্গীতের — বিশেষ করে ঐ গানটা — আমি তখনো ছিলেম মগন গহন ঘুমের ঘোরে — যখন বৃষ্টি নামলো –
আল্লাহ বিছটি দিল! ক্ষেতে বোরো ধান হামার সব পুড়বার লাগ্যছিল! আল্লাহ মেহেরবান!
গাঙে ঢেউ আস্যলো রে পরাণ — হামাক মাছ মারিবার যাইতে হব্যেক!
ছিল বিছটিতে (শিলা বৃষ্টিতে) হামার খ্যাতের তরমুজ আবার ক্ষতি হবেক লাই?
আরে না — কুনো ক্ষতি লাই — বিছটি নাম্যেছে তাই কত!
বেঙা-বেঙির বিহা দিয়াছিলাম — তাই না বিছটি হলো –
এই পালপাড়ায় মা কালী জাগ্রত। জোড়া পাঁঠা বলি দিল বলে না বৃষ্টি হলো!
চীন সাগরের সাইক্লোন কেটে গিয়ে এবং পশ্চিমবঙ্গের তাপীয় লঘুচাপ মুক্ত হয়ে কালবৈশাখীর মেঘমালায় বৃষ্টি হতে এবার প্রায় একমাস দেরি হলো!
মেয়র টুকু জিন্দাবাদ!
টুকু একটা শয়তান…
ওঁ কালী করালবদনী –
টুকু বৃষ্টি নামাইলো রে…
সকল প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার!
নগরপিতা জিন্দাবাদ!
মার্চ-এপ্রিল ২০০৮
‘প্রকৃতপক্ষে, দেশের বায়ুমণ্ডল এবং মাটি এখন প্রচণ্ড রকম উত্তপ্ত। এ অবস্থায় উচ্চ চাপ বলয়ের শক্তি কমে গেলে এবং বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয়বাষ্প ভেসে এলে তীব্র কালবৈশাখী এবং টর্নেডো হতে পারে। ভূমধ্যসাগরে সৃষ্ট পশ্চিমা লঘুচাপ হিমালয়ের গা বেয়ে পূর্বদিকে বিস্তৃত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এর সঙ্গে পুবালী লঘুচাপের সংযোগ এবং পশ্চিমবঙ্গের শুকনো হাওয়া মিলেমিশে তৈরি করে বজ্র মেঘ। এই বজ্র মেঘই কালবৈশাখী হয়ে লণ্ডভণ্ড করে দেয় সমগ্র চরাচর!’
আবহাওয়াবিদ টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি তুলে খান।
‘সবই তো বুঝলাম। কালবৈশাখী আসছে না কেন? একটু ঝড় কেন হচ্ছে না?’ আবহাওয়াবিদকে ঘিরে টেবিলে বসে থাকা মানুষগুলো ছটফটাতে থাকে।
‘বাংলাদেশে এপ্রিল ও মে মাসে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে। এ সময় তীব্র গরমের পরপরই আধ ঘণ্টার ব্যবধানে ঝড়ো আবহাওয়া তৈরি হয়। প্রাক-বর্ষা মৌসুমে তাপমাত্রা বেশি থাকায় কালবৈশাখীর দাপটও থাকে বেশি। চীন সাগরে বিরাজমান একটি সাইক্লোন এই তাপপ্রবাহ দীর্ঘায়িত হওয়ার মূল কারণ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে বিরাজমান তাপীয় লঘুচাপ। এশিয়া মহাদেশের আকাশের সব মেঘমালা চীন সাগরের সাইক্লোনের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে। নতুন মেঘও তৈরি হচ্ছে না। ফলে আকাশ মেঘহীন হয়ে বৃষ্টিপাত বন্ধ হয়ে গেছে। কালবৈশাখীও হয় নি।’
‘বুঝলাম…আপনার এত টেকনিক্যাল কথা-বার্তা আমরা তো বুঝব না। কথা হলো, কালবৈশাখী এখনো হচ্ছে না! কিন্তু, হবে না?
‘ঝড়-বৃষ্টি হবে না?’
‘হবে!’ আবহাওয়াবিদ হাত তুলে আশ্বস্ত করেন।
মুহূর্তে শুনশান নীরবতা নেমে আসে।
‘হবে? বৃষ্টি কি হবে? ঝড় হবে?’
‘কবে নাগাদ হবে? কবে?’ নগরপিতা দেখেন তিনিও কখন অধৈর্য্য অন্য সব শ্রোতার সাথে গলা মিলিয়েছেন।
‘চীন সাগরের সাইক্লোনটা কাটতে আরো প্রায় দুই সপ্তাহ লাগবে। পশ্চিমবঙ্গের তাপীয় লঘুচাপ মিলাতেও দুই সপ্তাহ। তারপরই বৃষ্টি হবে!’ যেন বা কোনো পরম দৈবজ্ঞ মানুষকে আশ্বস্ত করছেন।
‘তারপরই বৃষ্টি হবে?’
‘হওয়ার কথা। যদি আবহাওয়া বিজ্ঞান মিথ্যা না হয়,’ আবহাওয়াবিদ আরো এক গ্লাস পানিতে চুমুক দেন।
ঙ.
‘সম্মানিত নগরবাসী, আসসালামু আলাইকুম। বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। মাননীয় মেয়র আবুল কালাম টুকু দেশব্যপী বিশেষতঃ উত্তর বাংলার গত একমাস ব্যপী তীব্র খরার প্রেক্ষিতে আগামী ১১ই মে শুক্রবার শহরের কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মসজিদে বৃষ্টি নামানোর জন্য পরম করুণাময় আল্লাহ্ তা’য়ালার দরবারে বিশেষ নামাজ ও ইবাদত-বন্দেগির আয়োজন করেছেন। আপনারা দলে দলে যোগ দিন! দলে দলে যোগ দিন!’
ইরফান ও সাব্বির মুখ নিচু করে বসে আছে।
‘এটা না করলে চলতো না?’
আবুল কালাম টুকু হাসেন, ‘নাচতে নামলে ঘোমটা রাখা যায় না! এই বুর্জোয়া রাজনীতি যখন মেনেই নিয়েছি, ভোটের রাজনীতিতে যখন দাঁড়িয়েছি…তখন জনপ্রিয়তা অর্জন করতে হবে! আলিমুজ্জামান নামের চোরাকারবারীটা আমার অতীতের কমিউনিস্ট পরিচয়টা নিয়ে মানুষের কাছে আমাকে নাস্তিক প্রমাণ করতে চাইছে। আমি তার সেই ফাঁদে ধরা দেব কেন?’
‘ঠিক আছে…কিন্তু, বৃষ্টি যদি না নামে?’ ইরফান উত্তেজিত হয়ে সিগারেট ধরায়।
‘আবহাওয়া অফিসের পরিচালক তো বললেন যে বৃষ্টি নামবে!’
‘হায়, আবহাওয়া অফিসের কথায় কোনো ঠিক আছে?’ সাব্বির মুখ খোলে।
‘বন্ধুগণ, আমরা সবাই কিন্তু বৈজ্ঞানিক ও দ্বান্দিক বস্তুশাস্ত্রের এবং সমাজতন্ত্রের দীক্ষা নিয়েছি। সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি সেলডম মেকস আ রং। ভুল একেবারে করে না, সেটা বলবো না! তবে কদাচিৎ ভুল করে! আবহাওয়া বিজ্ঞান বিজ্ঞানের অন্তর্গত। সে ভুল করে কম।’
‘আর যদি করে?’
‘ইন দ্যাট কেস, ইউ মাস্ট টেক আ চান্স অর রিস্ক। গ্রেট থিংস আর অ্যাচিভড্ থ্রু গ্রেট ডেঞ্জারস। ইরফান- সাব্বির, আমরা আমাদের অতীতের জীবন ছেড়ে এসেছি। বিপ্লবীর সারা জীবনের আদর্শ আমরা…হ্যাঁ, সত্যি বলতে…রাখি নাই। রঞ্জন ও সারোয়ার মারা গেছে। কিন্তু, আমাদের মরবার সাহস হয় নি। আতাউল ও রেজাউর পলাতক। সম্ভবতঃ তারা বগুড়ার আশপাশে যমুনার কোনো চরে লুকিয়ে আছে। আমরা আরো সত্তর বছরেও বিপ্লব করতে পারতাম না! বুর্জোয়া দলের জনপ্রতিনিধি হয়েই দেখা যাক কী করতে পারি। এই বুর্জোয়া দলটি আমাদের ইনোভার্সিটির ক্লিন এন্ড আইডিয়াল লেফটিস্ট ইমেজটা কাজে লাগিয়েছে। আমাদের ফ্রেশ স্টুডেন্ট ইমেজটা। কিন্তু, একবার নির্বাচনে জেতা আর একটা নগরে কালো টাকা আর সন্ত্রাস নির্ভর সংগঠন গড়ে তোলা…যা ছাড়া এ ধরনের দলে বেশিদিন রাজনীতি করা যায় না…সেটা আছে আলিমুজ্জামানের। হয়তো আমিও খুব দ্রুতই পচে উঠব কি টেন পার্সেন্ট কমিশন খাব…কিন্তু, এখনো যখন হই নি…একজন আলিমুজ্জামানের চেয়ে আমি হয়তো মানুষের জন্য কম ক্ষতিকর…তাছাড়া, আমরা যে নিতান্ত নাগরিক মধ্যবিত্ত ঘেঁষা নিরীশ্বরবাদী বাম রাজনীতি করে এসেছি এতদিন…তা কি আদৌ স্পর্শ করেছে কাউকে? সো, লেট আস মেক অ্যানাদার ডিফারেন্ট ট্রাই! গ্রামের কৃষক বৃষ্টির জন্য ফেরেশতা মিকাইলের সুরা পড়ে, রক্ষাকালীর মানত দেয় হিন্দুরা কিম্বা ধর্মেরও আগের যে লোকাচার…সেই ব্যাঙের বিয়ে দেয়! কী বলবে তোমরা একে?’
চ.
নগরীর কেন্দ্রীয় মসজিদে আজ বিশাল নামাজের জমায়েত। এই নামাজ বৃষ্টির জন্য। যেন ধারাজল স্পর্শ করে মাটি। যেন কৃষক ফলাতে পারে শস্য। গ্রাম হতে এই নামাজের খবর পেয়ে কৃষকেরাও এসেছে। (আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীনাররাহমানির রাহীম। মালিকি ইয়াউমিদ দীনি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ইয়াফআলু মা য়ুরিদ। আল্লাহুম্মা আনতাল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা আনতাল গানিয়্যু ওয়া নাহ্নুল ফুক্বারাউ আনযিল আলাইনাল গাইছা ওয়াজ্বআল মা আনযালতা লানা কুওয়্যাতান ওয়া বালাগান ইলা খাইরিন) — ‘সকল প্রশংসা পৃথিবীর পালনকর্তা আল্লাহ্র জন্য, তিনি পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু এবং শেষ বিচারের দিনের মালিক। আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোনো মাবূদ নেই, তিনি যা ইচ্ছা করেন তা করেন। হে আল্লাহ্! তুমি একমাত্র মাবূদ, তুমি ছাড়া আর কোনো মাবূদ নেই। তুমি অতি ধনী ও আমরা গরীব, আমাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষণ কর এবং আমাদের জন্য যা নাযিল কর তা আমাদের জন্য শক্তিময় ও ফলদায়ক।’
‘ওয়া ফাজ্জ্বারনাল আরদ্বা উয়ূনান ফালতাক্বাল মাউ আ’লা আমরিন (এবং আমিই পৃথিবীতে আকাশের পানি দ্বারা ঝরনাসমূহ প্রবাহিত করেছিলাম। তদ্বারা নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি জমা হয়েছিল)।’
ইমাম সাহেব দু’হাত আকাশের দিকে তোলেন, ‘হযরত নূহ (আঃ)-এর সময় মহাপ্লাবনে আল্লাহ তায়ালা ঐ সময় আসমান হতে পানি বর্ষণ করে প্রবল বন্যায় জগত ভাসিয়ে দিয়েছিলেন।’
‘আল্লাহ মহান। তিনিই তোমাদের বিদ্যুৎ দেখান যা আশংকা ও আশা সঞ্চার করে এবং তিনিই পানিতে পরিপূর্ণ মেঘমালা উত্থিত করেন। বজ্র নির্ঘোষ প্রশংসার সাথে তাঁর মহিমা-পবিত্রতা ঘোষণা করে এবং অন্যান্য ফেরেশতারাও তাঁকে ভয় করে। আর তিনি বজ্রপাত করেন এবং যাকে ইচ্ছে তাকে তা দিয়ে আঘাত করেন। তথাপি তারা আল্লাহ সম্বন্ধে বিতর্ক করে। অথচ, তিনি মহাশক্তিমান!’
সবাই সেজদায় নত হয়।
মাঠে মাঠে কৃষকেরা নামাজে রত। হা ফেরেশতা মিকাইল! বৃষ্টি দরকার। আল্লাহ মেঘ দে পানি দে ছায়া দে। এত বেরহম কেন তুই আল্লাহ্ মালিক? পানি — এক ফোঁটা পানি দে ইয়া রব —
নামাজের পর সারা দুপুর মৌন, খরাময় ও ভ্রুকুটিভয়াল। সন্ধ্যাতেও তাই। রাতটা ভারি হয়ে রইলো নিস্তব্ধ। রাত গড়াচ্ছে কেবলি রাতের কোলে। রাতটা অমনি গেল। রাত পেরিয়ে সকালেও ঠা ঠা রোদ। দুপুর আবার গুমোট, আবার ভারি। সন্ধ্যা নাগাদ ঈশান কোণে দেখা দিল অল্প অল্প মেঘ। শিরশিরিয়ে একটু যেন হিম বাতাস বয়ে গেল! আরে, তাজ্জব তো? সত্যি সত্যি বৃষ্টি নামছে নাকি? আহ্…এক ফোঁটা…এক ফোঁটা বৃষ্টিও যদি…পিপাসার্ত হাত, জিভ আর শরীর নিয়ে ঘরের বাইরে বের হয়ে এলো সবাই। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে! আহ্ বৃষ্টি…আয়..আয়…বাবা, আর ভোগাবি না…
ওওওওওওওওওওওওওওওওওওওওওওওওওওওও
বৃষ্টি আসছে!
আল্লাহর কি বরকত!
ঘরের জানালা দাও!
না-জানালা খোলা থাক –
ভিজে যাবে ত’ সব –
ভিজুক না! এতদিন পুড়ছে সব!
এই বৃষ্টির পানি ধরো –
খোকার গায়ে ঘামাচি — বৃষ্টিতে দাঁড় করায় দাও –
মেয়র সাহেবের কী কুদরত!
তার কুদরত না। আল্লাহরই কুদরত! তবে তিনি আল্লাহর মোমিন বান্দা।
এই শয়তান আবুল কালাম টুকু ছিল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বড় ছাত্রনেতা। তারপর লেফট পলিটিক্স ছেড়ে বুর্জোয়া রাজনীতিতে আসলো তো আসলো — এখন কিনা আবহাওয়াবিদের কাছ থেকে কনফার্ম হইয়া মসজিদে নামাজ পইড়া পপ্যুলার হইলো — কমন পিপলের ধর্মান্ধতা আর সুপার¯িটশন বাড়াইলো!
আরে বাদ দাও রাজনীতির কচকচি! আজ খিচুড়ি-ইলিশ করো না! এ ক’দিন গরমে গানও শুনতে ইচ্ছা করে নি! গতকাল কলিম শরাফির একটি নতুন সিডি কিনেছি রবীন্দ্রসঙ্গীতের — বিশেষ করে ঐ গানটা — আমি তখনো ছিলেম মগন গহন ঘুমের ঘোরে — যখন বৃষ্টি নামলো –
আল্লাহ বিছটি দিল! ক্ষেতে বোরো ধান হামার সব পুড়বার লাগ্যছিল! আল্লাহ মেহেরবান!
গাঙে ঢেউ আস্যলো রে পরাণ — হামাক মাছ মারিবার যাইতে হব্যেক!
ছিল বিছটিতে (শিলা বৃষ্টিতে) হামার খ্যাতের তরমুজ আবার ক্ষতি হবেক লাই?
আরে না — কুনো ক্ষতি লাই — বিছটি নাম্যেছে তাই কত!
বেঙা-বেঙির বিহা দিয়াছিলাম — তাই না বিছটি হলো –
এই পালপাড়ায় মা কালী জাগ্রত। জোড়া পাঁঠা বলি দিল বলে না বৃষ্টি হলো!
চীন সাগরের সাইক্লোন কেটে গিয়ে এবং পশ্চিমবঙ্গের তাপীয় লঘুচাপ মুক্ত হয়ে কালবৈশাখীর মেঘমালায় বৃষ্টি হতে এবার প্রায় একমাস দেরি হলো!
মেয়র টুকু জিন্দাবাদ!
টুকু একটা শয়তান…
ওঁ কালী করালবদনী –
টুকু বৃষ্টি নামাইলো রে…
সকল প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার!
নগরপিতা জিন্দাবাদ!
মার্চ-এপ্রিল ২০০৮
==================================
অদিতি ফাল্গুনী
জন্ম
যশোর, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৪
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে আইন শাস্ত্রে সম্মান ও স্নাতকোত্তর।
বই
১) অধিবর্ষ অপরিচয়ের (কাব্যগ্রন্থ, ফেব্রুয়ারি ২০০৮, বাঙলায়ন কর্তৃক প্রকাশিত)।
২) মিকেলেঞ্জেলো: জীবন ও কর্ম (অনুবাদগ্রন্থ, মূল: আলেক্সান্দ্রা গ্রুমলিং, ফেব্রুয়ারি ২০০৮, বাঙলায়ন কর্তৃক প্রকাশিত)।
৩) চিহ্নিত বারুদ বিনিময় (গল্পগ্রন্থ, এপ্রিল ২০০৭, অঙ্কুর কর্তৃক প্রকাশিত)।
৪) দ্য রাখাইনস্ অফ পটুয়াখালি এণ্ড বরগুনা রিজিয়ন: ইন কোয়েস্ট ফর অ্যা ডিসট্যান্ট হোমল্যাণ্ড (গবেষণাগ্রন্থ, কোডেক কর্তৃক প্রকাশিত, ফেব্রুয়ারি ২০০৬)।
৫) বানিয়ালুকা ও অন্যান্য গল্প (গল্পগ্রন্থ, ফেব্রুয়ারি ২০০৫, ঐতিহ্য কর্তৃক প্রকাশিত)।
৬) গোত্রপিতার হেমন্ত (অনুবাদগ্রন্থ, মূল: দ্য অটাম অফ দ্য প্যাট্রিয়ার্ক, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, ফেব্র“য়ারি ২০০৪, সন্দেশ কর্তৃক প্রকাশিত)।
৭) আমার জীবন (অনুবাদগ্রন্থ, মূল: মাই লাইফ, মার্ক শাগাল, ফেব্রুয়ারি ২০০১, ঐতিহ্য কর্তৃক প্রকাশিত)।
৮) খসড়াখাতা: নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (প্রবন্ধ সঙ্কলন, ফেব্র“য়ারি ২০০০, শ্রাবণ কর্তৃক প্রকাশিত)।
৯) ইমানুয়েলের গৃহপ্রবেশ (গল্পগ্রন্থ, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯, স্টুডেন্ট ওয়েজ কর্তৃক প্রকাশিত)।
১০) বাংলার নারী সংগ্রামী: ঐতিহ্যের অনুসন্ধানী (গবেষণাগ্রন্থ, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮, স্টেপস্ টুওয়ার্ডস্ ডেভেলপমেন্ট কর্তৃক প্রকাশিত)।
১১) পারিবারিক আইনে বাংলাদেশের নারী (যৌথ গবেষণাগ্রন্থ, সেপ্টেম্বর ১৯৯৭, আইন ও সালিশ কেন্দ্র কর্তৃক প্রকাশিত)।
============================
যশোর, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৪
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে আইন শাস্ত্রে সম্মান ও স্নাতকোত্তর।
বই
১) অধিবর্ষ অপরিচয়ের (কাব্যগ্রন্থ, ফেব্রুয়ারি ২০০৮, বাঙলায়ন কর্তৃক প্রকাশিত)।
২) মিকেলেঞ্জেলো: জীবন ও কর্ম (অনুবাদগ্রন্থ, মূল: আলেক্সান্দ্রা গ্রুমলিং, ফেব্রুয়ারি ২০০৮, বাঙলায়ন কর্তৃক প্রকাশিত)।
৩) চিহ্নিত বারুদ বিনিময় (গল্পগ্রন্থ, এপ্রিল ২০০৭, অঙ্কুর কর্তৃক প্রকাশিত)।
৪) দ্য রাখাইনস্ অফ পটুয়াখালি এণ্ড বরগুনা রিজিয়ন: ইন কোয়েস্ট ফর অ্যা ডিসট্যান্ট হোমল্যাণ্ড (গবেষণাগ্রন্থ, কোডেক কর্তৃক প্রকাশিত, ফেব্রুয়ারি ২০০৬)।
৫) বানিয়ালুকা ও অন্যান্য গল্প (গল্পগ্রন্থ, ফেব্রুয়ারি ২০০৫, ঐতিহ্য কর্তৃক প্রকাশিত)।
৬) গোত্রপিতার হেমন্ত (অনুবাদগ্রন্থ, মূল: দ্য অটাম অফ দ্য প্যাট্রিয়ার্ক, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, ফেব্র“য়ারি ২০০৪, সন্দেশ কর্তৃক প্রকাশিত)।
৭) আমার জীবন (অনুবাদগ্রন্থ, মূল: মাই লাইফ, মার্ক শাগাল, ফেব্রুয়ারি ২০০১, ঐতিহ্য কর্তৃক প্রকাশিত)।
৮) খসড়াখাতা: নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (প্রবন্ধ সঙ্কলন, ফেব্র“য়ারি ২০০০, শ্রাবণ কর্তৃক প্রকাশিত)।
৯) ইমানুয়েলের গৃহপ্রবেশ (গল্পগ্রন্থ, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯, স্টুডেন্ট ওয়েজ কর্তৃক প্রকাশিত)।
১০) বাংলার নারী সংগ্রামী: ঐতিহ্যের অনুসন্ধানী (গবেষণাগ্রন্থ, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮, স্টেপস্ টুওয়ার্ডস্ ডেভেলপমেন্ট কর্তৃক প্রকাশিত)।
১১) পারিবারিক আইনে বাংলাদেশের নারী (যৌথ গবেষণাগ্রন্থ, সেপ্টেম্বর ১৯৯৭, আইন ও সালিশ কেন্দ্র কর্তৃক প্রকাশিত)।
============================
গল্প- আলিমের নিভৃতিচর্চা by রাশিদা সুলতানা গল্প- প্রত্যাবর্তন: আমার ‘ফেরা’ নিয়ে যে কাহিনী না ..মানষ চৌঃ গল্প- 'বীচিকলায় ঢেকে যায় মুখ ও শিরোনাম' by আনোয়ার ... গল্প- 'প্রীত পরায়া' by সিউতি সবুর গল্প- 'চলিতেছে' by মাহবুব মোর্শেদ গল্প- 'গোপন কথাটি' by উম্মে মুসলিমা গল্প- 'রূপকথা' by লুনা রুশদী সঞ্জীব চৌধুরীর কয়েকটি গল্প গল্প- 'অস্বস্তির সঙ্গে বসবাস' by ফাহমিদুল হক গল্প- 'মঙ্গামনস্ক শরীরীমুদ্রা' by ইমতিয়ার শামীম গল্প- 'হাজেরার বাপের দাইক দেনা' by জিয়া হাশান গল্প- ‘অপঘাতে মৃত্যু’ ও ‘সাদামাটা’ by লীসা গাজী গল্প- 'দ্বিতীয় জীবন' by ইরাজ আহমেদ গল্প- 'পুষ্পের মঞ্জিল' by সাগুফতা শারমীন তানিয়া গল্প- 'একশ ছেচল্লিশ টাকার গল্প' by কৌশিক আহমেদ গল্প- 'একে আমরা কাকতালীয় বলতে পারি' by মঈনুল আহসান.. গল্প 'গহ্বর' by জাহিদ হায়দার গল্প- 'পুরির গল্প' by ইমরুল হাসান গল্প- 'নওমির এক প্রহর' by সাইমুম পারভেজ গল্প- 'মরিবার হলো তার সাধ' by আহমাদ মোস্তফা কামাল গল্প- 'নিষুপ্ত শেকড়' by নিরমিন শিমেল গল্প- 'লাল ব্যাসার্ধ্ব' by শামীমা বিনতে রহমান গল্প- 'সেদিন বৃষ্টি ছিল' by মৃদুল আহমেদ
bdnews24 এর সৌজন্যে
লেখকঃ অদিতি ফাল্গুনী
এই গল্পটি পড়া হয়েছে...
লেখকঃ অদিতি ফাল্গুনী
এই গল্পটি পড়া হয়েছে...
No comments