গল্প- 'সম্পর্ক' by তারিক আল বান্না
দুই বন্ধু রফিক আর সাইফুলের গল্প এটা। গত শতকের শেষ দশকের প্রথমার্ধের এক অদ্ভুত সময় তখন; বয়স্কদের শাসন করছে শিশুরা (গণতন্ত্র)। নতুন সরকারের আগমনের সাথে সাথে নতুন উদ্যমে ঢুকছে ফারাক্কার পর স্বাধীনতা পরবর্তী গত ৩৭ বছরে প্রতিবেশীর দেয়া ২য় শ্রেষ্ঠ প্রীতি উপহার। ১ নম্বরটার উপলক্ষ্য ছিল পেট-খাদ্য-কৃষি, আর ২ নম্বরটা উপলক্ষ্য ছিল আসক্তি—মগজহীন একটা গোটা প্রজন্ম। আরও অনেকের মত রফিক আর সাইফুলও কৈশোর থেকে একত্রে বড় হওয়া—নৌকায় করে বছিলা, রায়েরবাজার পার হয়ে কামরাঙ্গীর চর হয়ে সদরঘাট পর্যন্ত চলে যাওয়া, মিরপুর ব্রিজ থেকে একত্রে তুরাগে লাফিয়ে পড়ার দুঃসাহসী নির্মল আনন্দ, টার্মিনালের মতিগো লগে লাগলে একত্রে হকিস্টিক-রামদা নিয়ে হিটে যাওয়া, আরও কয়েক বছর পরে, ততদিনে ডাইল চিনে গেছে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা নৌকায় বাগবাড়ী, মুন্সীবাড়ির ঘাট পার হয়ে মাইলের পর মাইল ভিতরের নির্জনতার মধ্যে একান্ত-আসল-নিজস্ব আড্ডা দেয়া প্রজন্মের প্রতিনিধি। অন্যদের মত তারাও এই যুক্তিহীন বয়স্কদের বালখিল্যতায় ভরা এই সময়ের বলি।
‘এমন মুহূর্ত, সময় বা দিনও আসে মানুষের জীবনে!’ রফিকের কাহিনী শুনতে শুনতে ভাবছিলাম। এই সুন্দর পৃথিবীতে বড় জটিল, বিচিত্র আর কখনো কখনো বীভৎস মানুষের জীবন। একটা নদীর মত সাবলীল, গতিশীল, দীর্ঘমেয়াদী ও ধারাবাহিকভাবে সফল হতে থাকা পরিকল্পনার নিরাপত্তাসহ পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার আশ্বাসে ঘেরা দুই পাড়ের মাঝ দিয়ে বইতে থাকা নিরাপদ, নিশ্চিত জীবনের অন্তঃস্রোত মুহূর্তে নিমজ্জিত হয় অচিন্তনীয় পঙ্কিলতার মুক্তিহীন ক্লেদাক্ত আবর্তে। কোনো স্বর্গীয় মোহনায় পৌঁছানো তো দূরের কথা, তার চিন্তা করাও তখন বিরক্তি উদ্রেককারী ও হাস্যকরভাবে অর্থহীন; শুভ্রতার ফলদায়ক ভূমিকার অপরাজেয়, অন্তহীন, জীবনস্পর্শী আসল সত্যও তখন, একবারের জন্য হলেও মনে হয়, বা চিরকালের জন্য হয়ে যায়, কুৎসিত জঘন্য মিথ্যা, মনে হয়, চিরকালীন মানবাত্মার প্রতি বিধাতার তীব্র বিদ্রুপ, হৃদয়ের প্রতি জীবনের বীভৎস ঠাট্টা। রফিকের গল্প শুনতে শুনতে এসব ভাবনা ভাঙাচোরা কাচের টুকরার মত ঝলকে উঠছিল আমার মাথায়।
‘বাই, বাপে মরার আগ পর্যন্ত ঠিক আছিল, কোনো অসুবিধা আছিল না। বড় বইন আর মা আছিলো। আমি স্কুলে পড়তাম। বাপে কোচ চালাইত, ইনকাম খারাপ আছিল না। আউট ইনকামও আছিল। স্কুলে পড়তো বড় বইনও। আমার চে দুই কেলাস উপ্রে। আমি স্কুলে থাকতেই, কেলাস সিক্সে পড়ার সময়, বড় বইনের বিয়া অয়। তয় উডায়া দিছে আরও ২ বছর পর। বইনের মেট্রিকের পর। হেরপর আর পড়ে নাই, নিজেই। দুলাভাইও খারাপ আছিলো না। আমারে ছোট ভাইয়ের চেয়ে বেশি বালোবাসতো। মায় অনেক কড়া আছিল। ছোটবেলার তনই আমার সব আবদার আছিল বইনের কাছে, বাবারে অনেক ডরাইতাম, তয় বাপে কিন্তু তেমন কড়া আছিল না, আমাগো বাই-বইনরে কখনও কিছু কইত না, জীবনে আমাগো কারো গায়ে হাত তোলে নাই। তয় খুব রাগী আছিল তো, তাই কেমন জানি ডর করতাম, আমরা বাই-বইন দুইজনেই। মায় অনেক মারলেও আমাগো দুই ভাই বইনের গায়ে বাবা কিন্তু জীবনেও আত তোলে নাই। জীবনেও না। আবার মায় যেইদিন আমাগো মারতো, বাপে হেদিন মায়ের লগে রাগ কইরা বাত খাইতো না, আমরা দুইজন অনেকক্ষণ সাদাসাদি করলে হেরপর খাইতে রাজি অইত। বইনের বিয়া অইল অয় যহন কেলাস এইটে, তয় উডাইয়া দিছে আরও ২ বছর পর।’
ওর ছোটখাট ২/১টা পুনরাবৃত্তিতে বাধা দিচ্ছিলাম না ইচ্ছা করেই। চুপচাপ শুনে যাচ্ছিলাম। ১টা নির্মীয়মান সরকারী বিশাল ভবনের বাউন্ডারী টিনের গায়ে হেলান দিয়ে বসেছিলাম আমরা। বোঝাই যাচ্ছিল, কথায় পেয়ে বসেছে ছেলেটাকে। কাজেই আমার মূল কাজ শেষ। এখন শুধু মাঝে মাঝে ক্লেয়ারিফাই হওয়ার জন দুয়েকটা প্রশ্ন করা বা মাঝে মাঝে কোনো মন্তব্য করা; সান্ত্বনাসূচক, বিদ্রুপাত্মক, প্রশংসাবাচক বা তাচ্ছিল্যবোধক। গোধূলি শেষ হয়ে গেছে। আলোর চে অন্ধকার বেশি এখন। দূরে ক্ষেতের পাড়ে, পুকুরের পাড়ে শ্যামলী এক নম্বর রোডের উজ্জ্বল আকাশী অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংটার আসল রঙ এখন আর দৃশ্যমান না। এখন তা লোকাল রঙে ঝাপসা প্রায়। কাছেই ১০/১৫ গজ দূরের আড্ডাগুলার হট্টগোল আমাদের স্পর্শ করছে না আর। ইতস্তত ঘোরাফেরা করতে থাকা নেশাখোররাও দৃষ্টিসীমার মধ্যে থেকেও অদৃশ্য। আর কোনো বিষয় না তারা এখন।
যদিও আমাদের মত ওরাও সমাজছুট একটা সম্প্রদায়। আমাদের চারপাশেই থাকে, আমাদের নিয়েই। রাস্তাঘাটে চলতে ফিরতে আপনি ওদের দেখেন। এক ধরনের লোক দেখবেন রাস্তায়, কাঁধে চটের বা প্লাস্টিকের বস্তা, উস্কোখুস্কো, দীর্ঘ মাসাধিককাল গোসল না করার ফলে একহাত তফাত দিয়ে হেঁটে গেলেও শরীরের কটূ গন্ধ নাকে এসে লাগে, ময়লা ছেঁড়া জামা অথবা বোতামহীন শার্ট, রঙ পুরা পাল্টে যাওয়া এখানে-সেখানে ছেঁড়া টিশার্ট, বা বোতাম ছাড়া হয়তবা হাতের কনুইয়ের পর বাকিটুকু নাই এমন পাঞ্জাবী, ছেঁড়া কখনও বা বেসাইজ লুঙ্গি, কোমড়ের কাছে দড়ি বা ফিতা দিয়ে বানানো বেল্টালা এক পায়ে হাঁটু পর্যন্ত ফোল্ডিং করা তো আরেক পায়ের প্যান্টের ঝুল রাস্তা ঝাড় দিচ্ছে। ময়লা-কালো গায়ের রঙ, হলদে বা জবালাল ভেতরে বসে যাওয়া চোখ। ওদের বয়স ৮/৯ থেকে মোটামুটি ৬০/৭০ বছরের মধ্যে, অর্থাৎ প্রায় সব বয়সীরাই। অন্য যে কোনো সম্প্রদায়ে যেমন হয়। সে ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক বা আন্তর্জাতিক কোনো কোয়ালিশন, যেই হোক না কেন।
কখনও বস্তা কাঁধে সামনের দিকে অনেকখানি কূঁজা হয়ে হাঁটতে হাঁটতে আবাসিক মহল্লার গলিতে বা রাজপথে ওরা কী যেন কুড়ায়। কী আর! এই পচা গলা সমাজের বর্জ্য কুড়ায়। ছেঁড়া চানাচুরের প্যাকেট থেকে ময়লা রক্তমাখা প্যাড থেকে শুরু করে ছেঁড়া পেপারে রেখার ছবি পর্যন্ত—সব। অ্যালসেশিয়ানের নেতৃত্বাধীন সমাজের ভদ্র কুকুরদের মাঝে ওরা রাস্তার চামড়ায় ঘাঅলা এক ঠ্যাং খোঁড়া লেড়িকুত্তা। মশার রক্ত চুষে জীবন ধারণের মত মমতায় ওরা চুষে নেয় সমাজের যাবতীয় বর্জ্য, ডাস্টবিনে কুকুরের সাথে মারামারি করে আদায় করা অধিকারের বিনিময়ে। কখনও ট্রাফিক সিগন্যালে থাকে গাড়ির বন্ধ কাচের বা অধুনার সিএনজির খোলা অংশের পাশে হাত পেতে দাঁড়ায় এদের কেউ কেউ। ওদের চোখের আকূল আকুতিতে হয়ত একটা ভিক্ষুকও ওকে ভিক্ষা দেবে না, যদি ওর মূল সামাজিক পরিচয় জানে; অর্থাৎ সামাজিক পরিভাষায় যারা নেশাখোর।
পুরা নেশাখোর সম্প্রদায়ের সংখ্যাগুরু বৃহদাংশ ওরা, রাস্তার নেশাখোররা। অপর অংশ বাসা-বাড়িতে থাকা। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এদের মূল পরিচয় নেশাখোর হলেও পেশাগতভাবে এরা কেউ পকেটমার (রাস্তার নেশাখোরদের মধ্যে সবচেয়ে অভিজাত অংশ এরা, এদের পায়ে স্যান্ডেল বা জুতা থাকে, বা পোশাক অন্তত লোকাল পাবলিক বাসে ওঠার মত মোটামুটি চলনসই, কেননা এটুকু না থাকলে, বাসে উঠতে গেলে সমাজের শিক্ষিত অংশ পুরাপুরি সচেতনভাবে ওদের মৌলিক নাগরিক অধিকারে প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের মাধ্যমে, ‘ঐ কন্ডাকটার, হিরোঞ্চি উঠছে, দেখছ না?’ বলে সর্বসম্মতভাবে একত্রে চিৎকার করে ওঠে। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে ধমকে ওঠে, ‘নামাহ্! হারামজাদারে নামা তাড়াতাড়ি,’ বলে), বস্তা কাঁধে যারা ঘোরে তাদের কেউ কেউ ভাঙ্গারি দোকানের সাপ্লায়ার তো কেউ কেউ ছদ্মবেশি চোর (বাসা বাড়ি থেকে এরা পরিস্থিতে ভেদে শার্ট-প্যান্ট-শাড়ি-পেটিকোট থেকে গয়না-মোবাইল ফোন এমনকি টিভি পর্যন্ত সবকিছু চুরি করে)। এদের কেউ বাসে বা রাজপথের ফুটপাতে ঘড়ি-মোবাইল ফোন চুরি করে দৌড় দেয়, দৌড়ানোর ক্ষমতা কম বলে মাঝে মাঝে ধরাও খায়। হাড্ডি-মাংস এক হয়ে তখন রাস্তার পাশে পড়ে থাকে।
মেয়েদের কেউ কেউ বেশ্যা, তবে সবচেয়ে কম রেটের। ১৫/২০/২৫ টাকায় উচ্ছেদকৃত বিয়েনপি বস্তির বিস্তীর্ণ উঁচু নিচু খোলা প্রান্তরে এদের একবার ভোগ করা যায়। অথবা পার্কে কি যে কোনো অন্ধকার কোণে, খোলা আকাশের নিচে। কেউ রক্ত বেচে, এদের বলে ডোনার। সম্প্রদায়ের সবচেয়ে নিচু জাত হিসেবে গণ্য এই ডোনারদের চামড়া ক্রমশ ফ্যাকাশে-হলদে হয়ে যায়। রাস্তার নেশাখোরদের শরীরে কোথাও ঘা হলে, বিশেষ করে ডোনারদের, সহজে শুকায় না, মাসাধিককাল লেগে যায় তো কখনও চিরস্থায়ী হয়ে যায়; অর্থাৎ গ্যাংগ্রিন। হাঁটু বা কোমড়ের নিচ থেকে পা কেটে ফেলা। এদের শতকরা নব্বইভাগ সমাজের উচ্চ ও মধ্য বা নিম্ন মধ্য ও নিম্নবিত্ত বিভিন্ন সব শ্রেণী থেকে আসা হলেও, একসময় বাসা-বাড়িতেই থাকত। ড্রাগ নিতে নিতে নিতে নিতে একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ে এলে এরা ছাদের নিচ থেকে আপনা-আপনি চলে আসে খোলা আকাশের নিচে। টিভিতে বাৎসরিক শীতের রিপোর্টিংয়ে আমরা যাদের দেখি, কোনো রকম আবরণ ছাড়া কি বড়জোর একটা ছেঁড়া লুঙ্গি বা শাড়ি মুড়ি দিয়ে সদরঘাটে, রেল-বাস স্টেশনে, ফুটপাতে, পার্কে শুয়ে থাকতে দেখি তাদের একটা অংশ এই সম্প্রদায়ের।
একদল আছে শিশু নেশাখোর। বয়স ৭/৮ থেকে ১৩/১৪। খুব সম্ভবত এই সম্প্রদায়ের ২য় প্রজন্ম এরা, প্রজনন অর্থে, পুরা সম্প্রদায়ে এরাই একমাত্র খোলা আকাশের নিচে জন্ম নেয়া অংশ। ২০ বছরের বেশি এদের কেউই বাঁচে না। এই সম্প্রদায় শ্রেণীহীন (সম্ভবত একমাত্র, কেননা, বুর্জোয়া পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার মূল ভিত্তি সম্প্রদায়ের সঞ্চয়কে প্রত্যক্ষভাবে প্রত্যাখ্যান ও অস্বীকার করে এরা দিনের অর্জন দিনেই শেষ করার মাধ্যমে। সেটা ২৫ টাকা হলে ২৫ টাকাই, আবার ২/৩ হাজার হলেও সেটাও পুরাটাই এরা একদিনেই খরচ করে। এদের মধ্যেকার কোনো কোনো পকেটমারের মাসিক অর্জন লক্ষাধিক টাকা ও মাসিক সঞ্চয় একশ টাকাও না। ১২ বছরের কোনো চোর বা পকেটমার দিনে ২/৩ ঘণ্টা কাজ করে জোগাড় করে ২/৩ হাজার টাকা, তারপর ১৫ থেকে ১৬ ঘণ্টা টানা নেশা করে। কেউ রিকশা চালায়, এক দেড় ঘণ্টায় ৫০/১০০ টাকা জোগাড় হলেই একবার আড্ডায় এসে শেষ করে যায়। এভাবে সারা দিনে ৩/৪ থেকে ৬/৭ বার। রক্ত বেচতে বেচতে, না খেতে খেতে, দিনের পর দিন চা-রুটি-বিস্কুটের উপর নির্ভরশীল থেকে থেকে, শীর্ণ থেকে আরও, আরও শীর্ণ হতে হতে একসময় চিকন একটা রেখার মত হয়ে যায় এদের কেউ কেউ। অবশেষে আড্ডার বা রাস্তার পাশে পড়ে থেকে কেউ কেউ মরেও যায়। অন্যরা তখন কোথাও থেকে কোনো রকমে একটা সাদা চাদর (ময়লা হলেও ক্ষতি নাই) জোগাড় করে, মাথার কাছে আগরবাতি জ্বেলে, খাটিয়ায় শুইয়ে, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দাফনের জন্য সাহায্য চায় পথচারিদের কাছে। সচেতন ভদ্র নাগরিকদের কাছ থেকে ‘যে যত পারেন দিয়ে যান,’ বলে চাঁদা তোলে। মোটামুটি নেশা করার পয়সা জমা হলে রাস্তার পাশে মড়া শরীরটাকে একা ফেলে আড্ডায় চলে যায়।
ছোট সমতলে গজানো ঘাসের উপর বসে টিনের দেয়ালে হেলান দিয়ে আমরা গল্প করি নিজেদের নিয়ে। সবাইকে নিয়ে ভাবার সময় ফুরিয়ে গেছে।
‘বালো জামাই পাইয়া বাপে আতছাড়া করতে চায় নাই, তাই আগেই বিয়া দিয়া রাখছিল (হুঁহ, এতো বালো জামাই যে ৪ বছর কিছু বুঝিই নাই), বাবার মরার পর ২ বছর আমাগো সংসার খরচ পুরা চালাইছে, আমার পড়ার খরচসহ। তয় তহন আমার পড়ার মন উইঠা গেছে। ইসকুলে যাইতাম না, দুলাভাইর তন বেতন নিয়া বন্ধু-বান্ধবের লগে খর্চা করতাম। ডাইল তামুক খাইতাম। বান্দের পারেই তো আছিল আমাগো বাড়ি, বাগবাড়ির এক কোণায়, নদীর পাড় ঘেঁইষা।
তয় টার্মিনালে বাবারে সবাই চিনত দেইক্কা আমি চলতাম ছোডত্ তনই আমিনবাজারের পোলাপানগো লগে। আর আপনেরা তো জানেনই, আমিনবাজার কী জিনিস! না চাইলেও আতে আয়া পড়ব ফেন্সির বোতল, টু-টু-থ্রি-এইটের মত গরম জিনিস। কয়েকমাসের মইদ্যেই বাসায় জাইন্যা গেল ইশকুলের কতা। দুলাবাই রাগ তো করলই না, উল্টা বালো কৈরা আমারে অনেক বুজাইলো। কিন্তু আমি রাজি অইলাম না। মায়ে-বইনে কত কানলো, কত কইলো। আমার মাতায় তহন বাই খালি একটা চিন্তাই গোরতো, কতদিন আর মাইনষের টাকায় চলুম আমরা? দুলাবাইর টাকায় চলতে মার যে কেমন লাগতো হেইডা তো খালি আমিই জানতাম। আমার বাল্লাগতো না। আমার বইনডা আছিল ইকটু ভোদাই টাইপের, বোকামতন, অত প্যাচগোচ বোজতো না, তয় মনডা আছিল মাডির মত, সোজা, অয় অতকিছু বোজতো না, তয় আমি জানতাম মার কেমন লাগে, হেল্লেইগা আমি তহন থিকাই খালি চিনতা করতাম ক্যামনে, রোজগারের ধান্দা শুরু করা যায়, কেমনে রোজগার করুম নিজে, কবের তন করুম, এইসব।’
এসব ভাবনা চিন্তাই ১৩/১৪ বছরের রফিককে দখল করে ছিল। টাকা রোজগারের চিন্তা ছাড়া তখন আর কোনো চিন্তাই সে করতে পারত না, তাও যত সংক্ষিপ্ততম সময়ে, স্বল্প পরিশ্রমে। কাজেই একটা পথই খোলা ছিল, আর তা তো হাতের কাছেই। আর রফিকের বানানো কল্পিত প্রয়োজনের তীব্রতাজাত শর্তপূরণ করেই যা হয় আর কী। এমন পরিস্থিতি ও পরিবেশে। সুন্দরবনের সীমান্তবর্তী বাসিন্দারা যেমন বাওয়ালী বা কাঠুরে। সিরাপ তামুক তো আরও বছর দুয়েক আগেই শুরু হয়েছে। কাজেই, এই সময়েই রফিকদের বাড়ির বিপরীতে নদীর ওপারের মহল্লা বেগুনবাড়ির সাইফুল যখন বাল্যবন্ধু রফিককে ফেন্সিডেলের ব্যবসা করার প্রস্তাব দেয়—হৃদয়ে জাগ্রত মৌহূর্তিক দ্বিধা সত্ত্বেও আমিনবাজারের ছেলেদের কোনো বেগই পেতে হয় না—তা ফিরিয়ে দেয়ার কোনো কারণ তখন খুঁজে পায় না সে। সবাই তো করছে চারপাশে। যখনকার কথা হচ্ছে সে সময়ের স্মৃতি যাদের মগজে আছে তারা নিশ্চয়ই মানবেন।
এ সময়ই একদিন বেগুনবাড়ির সাইফুল রফিককে প্রস্তাব দেয় ফেন্সিডিলের ব্যবসা করার। তখন এর দাম বর্তমানের ১০ ভাগের ১ ভাগ। সব খরচের পরও লাভ শতকরা ২০০। দুই বন্ধু ৫-৫ মোট ১০ হাজার নিয়ে ব্যবসা শুরু করবে, ব্যবসা হবে পাইকারী। বেনাপোল থেকে মাল আসবে। ওদের শুধু আমিনবাজারে ডেলিভারি নিতে হবে। আর খুচরা বিক্রেতার তো অভাব নাই। আরিচা রোডের দু’পাশেই আমিনবাজারে, বিশেষ করে মিরপুর ব্রিজের পর থেকে, আনুমানিক আধা মাইল জুড়ে।
আশপাশের ৮/১০ টা গ্রামের কিশোর যুবকদের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ আর বয়স্ক বখাটেদের সবাই তখন কোনো না কোনোভাবে এই ব্যবসায় জড়িত। ৬ মাসের মাথায় নিজেদের খাওয়া ও অন্যান্য খরচের পরও ওদের মূলধন ৫০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। রফিকের বাসার লোকেরাও তখন জেনে গেছে। মা-বোন-দুলাভাই সবার অনুরোধ উপেক্ষা করে সে ব্যবসা চালিয়ে যেতে থাকে। পুলিশকে কিছু না দিয়েই, স্বাধীনভাবে। শুধু ইমিডিয়েট সিনিয়র ব্যাচের শাহীন ভাইকে এলাকার ভাল হর্তাকর্তা হিসেবে মৌখিকভাবে জানিয়ে এবং মাঝেমাঝে ২/৪/৫ হাজার টাকার খাম ধরিয়ে দিয়ে।
‘কী কমু বাই, না দেকলে বিশ্বাস করবেন না। সব্জির ট্রাকে কৈরা মাল আইতো, উপরে তরকারীর ঝাঁপি, নিচে ডাইলের বস্তা। কনডেস মিল্কের কার্টনের মত শক্ত বোর্ড কাগজের প্যাকেটে। ডজনের প্যাকেট সব। নামানোর আগেই মাল এডভান্স বিক্রি হৈয়া যাইত। অনেকে ৫০ হাজার ১ লাখ টাকা এডভান্স দিত, যাতে একবারে বেশি কৈরা আনতে পারি।
‘কিন্তু এসব তো আরও পরের কতা। পরথম যহন খাওয়া শিকছি, তহন আমরা অর্ধেক দামে পাইতাম। খাওয়ার মালের চেয়ে বেশি কৈরা কিনতাম, বাকিতে। বাকিগুলা খুচরা রেটে বেইচা দিতাম, খাওয়ার খর্চডা উইডা যাইত। ব্যবসা শুরুর আগে খাওয়ার খরচ চালানর লেইগ্যা ২/১ সময় খুচরা বেচছিলাম। আমার লগে লগে তহন ১০/১২ জন বন্দু-বান্দব থাকত। বছর না গোরতে পুঁজি এত ঐলো যে আমার ১৪ গুষ্টিও এত টাকা কুনুদিন দেহে নাই। ঈদে বইন-দুলাভাইরে দামি কাপড় দিতাম। মারেও দিতাম, তয় মায় ঐ কাপড় পরত না, হারামের টাকা কইতো, হোনতে খারাপ লাগতো, তয় সবাই জানে কতা তো সত্যি।’ একটু থেমে আবার, ‘এর মধ্যেই একদিন, ব্যবসা শুরু করার বছর দেড়েকের মাতায় দুলাভাই দিলো চোখ পাল্টি। আমি আইজও বুজি না হে এই কামডা কেন করল। কেমনে করল। বাপ মরার পর থিকা ৪ বছর দৈরা হেই তো আমাগো সব। মনে করেন, ফ্যামিলির কোনো ব্যাপারে হে যা কইবো ঐডাই ফাইনাল। চাইল-ডাইল, জামা কাপড়ের খরচ থিকা বাড়ি ভাড়ার খরচ পর্যন্ত সবই তো হে দিত। কাজেই হে যহন স্ট্যামালা সাদা কাগজে আমারে সই দিতে কৈলো, আমি জিগাইও নাই কেন। মাতায়ই আহে নাই।’
‘মাজে মাজে মনে লয়, আমার লেইগাই সব ঐলো। বাবায় মরার পরও সোনার সংসার আছিলো আমাগো মৈদ্যে, মার কান্নাকাটি ছাড়া। অহন হে কী করব? মনে পড়লে না কাইন্দা পারে? মনে লয় দুলাভাইডা আমার লেইগাই অমন ঐয়া গেলো। যহন বুজায়া-হুনায়াও আমারে বালো করতে পারলো না। ঐতে পারে, হেয় তহন বোজলো আর বেশিদিন একলগে থাকন কপালে নাই, ঐতে পারে, আমার আতে সম্পত্তি আইলে থাকবো না, কে জানে! কে জানে, ক্যান হে বদলায় গেলো?’
‘মায় কিছুটা বোজতে পারছিল, তয় শরমে জিগায় নাই, কিল্লেইগ্যা। বাবায় বছরের পর বছর দৈরা আড্ডি কালা কৈরা ৫ কাঠার উপরে ১৫/১৬ বছরে ২ তলা পর্যন্ত করছিল। বাড়িডা লেখাইয়া নিলো।’
‘আমার মায় আবার অন্যরকম। সম্পত্তির দিকে নজর কম। বাবারে কইত, এতগুলা টাকা হুদাহুদি বাড়িতে না লাগায়া পোলাপানের খাওন-দাওন লেহাপড়ার খরচ করন বালা।’
‘বাড়িত্তে বাইর কৈরা দেয় নাই আমগো। তয় কাগজপত্র সব নিজের নামে লেখাইয়া নিছে। তছিল অফিসে দলিলপত্রের কী কাম আছে কৈয়া আমার কাছে দেকতে চাইছে, আমি মার তন নিয়া দিছি। বাই, আপনেরে বাল্লাগছে আলাপ কৈরা, তাই এত কতা কইতাছি। বাই, হেই প্রথম মানুষ চিনলাম, তয় হ্যাতে কোনো লাভ অয় নাই। যদি ঐতো তাইলে আজকে এমন জায়গায় বৈয়া আপনের লগে এইসব কৈতে হৈতো না।’
‘সাইফুলের খবর কী? তোমার পার্টনার? লোকটা কেমন ছিল?’
কিছুক্ষণ ধরেই মনের মধ্যে জাগা ধারণাটি প্রশ্নের মাধ্যমে একটু ঘুরিয়ে ব্যক্ত করি। হাত দশেক দূরে, মাটি থেকে কিছু তুলতে যাবে, তোলার জন্য কিছুটা ঝুঁকেছেও, কিন্তু হঠাৎ গভীর গুরুত্বপূর্ণ কোনো চিন্তায় যেন ডুবে গেছে তাই এক ফালি চাঁদের মত বাঁকানো অবস্থায় স্থির হয়ে হয়ে থাকা শুধু একটা কামিজ পরা কালিঝুলিমাখা চেহারার ১টা (বয়স বোঝা যায় না, ২০ থেকে ৩৫ এর মধ্যে হতে পারে) মেয়েকে দেখতে দেখতে প্রশ্ন করি, ‘ফিক্সড হৈয়া গেছে’?
দৃষ্টি অন্যত্র নিবদ্ধ হলেও কান পাতা ছিল রফিকের জবাবের প্রত্যাশায়, মেয়েটার মতই আকৃতির ১ ফালি কুমড়ার মত চাঁদ আকাশে, বিকিরিত আলো কম বলেই হয়ত বেশিক্ষণ দেখতে ভাল্লাগে না। একটু দূরে নির্জনে বসে গল্প করলেও, সামান্য দূরে ইতস্তত ঘোরাফেরা করতে থাকা লোকগুলাকে তখনও দেখা যাচ্ছিল। নোংরা, ময়লা বেশবাস, শারীরিক ভঙ্গিতে প্রতিভাত অন্তর্গত হীনম্মন্যতা আর চোখ খোলা অথচ কিছুই না দেখা দৃষ্টি মনে করিয়ে দিচ্ছিল জোলার কয়লাখনির চরিত্রদের, পার্থক্য শুধু পুঁজির বদলে এরা নিজেদের ভুল আত্মবিশ্বাসজাত প্রবৃত্তির দাস। ধীরে ধীরে অন্ধকার নামছে চারপাশে। পকেট থেকে একটা স্টিক বের করে ধরাই। প্রশ্নের জবাবের আশায় রফিকের চোখের দিকে তাকাই। ‘হেইডাই তো কইতাছিলাম, শাহীন ভাই, অনেকদিন দৈরাই সাইফুলরে ফুসলাইতাছিল আমারে ছাড়ান দেওয়ার লেইগা। কিন্তু সাইফুল রাজি আছিল না, লেংটা কাল থিকা একলগে বড় অইছি, বাগবাড়ির পোলা ঐয়াও বন্ধুত্বের খাতিরে বেগুনবাড়ির পক্ষে বাগবাড়িতে হিটে গেছি, আমিনবাজার ব্রিজ থিকা তুরাগে একলগে লাফ দিয়া মজা করছি’—এটুকু বলে একটু থেমে যোগ করে, ‘সবই তো একলগে। কিন্তু বাই, কী কমু, আমার মনে বড় কষ্ট।’
এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে রফিকের ডান চোখ থেকে, হাতের তালু দিয়ে মোছে সে। আমি অর্ধেক টানা স্টিকটা ওর দিকে বাড়িয়ে দেই।
‘হেই সাইফুল কিনা চোখ পাল্টি দিলো। আমাগো নিয়ম আছিলো, যখন পুঁজি এক লাখ ছাড়ায়া গেছে, লাভের অর্ধেক দুইজনে সমান ভাগ কৈরা নিতাম, শতকরা ৩০ ভাগ পুঁজিতে যোগ ঐতো আর বাকি ২০ ভাগ খরচাপাতি। ব্যবসা বড় অওয়ার পর থিকা পুলিশরেও দিতে ঐতো। কিন্তু শাহীন ভাইয়ের খাম তহন আর দিতাম না। বাজারের দখল তখন শাহীন ভাইয়ের থিকা ছুইটা গেছে। হ্যারে তহন পাগলা কুত্তায়ও পোন্দায় না। হরিরামপুরের মজিবরগো লগে লাগছিল। বাইল্যাপাড়ার রেজাউলরা শাহীন ভাইয়ের ২ হাত কব্জির তন কাইট্টা দিছে। বাজারের দখল তহন আব্বাসগো আতে। ছোডবেলার বন্দু-বান্দব হিসেবে আব্বাস আমাগোত্তে কিছু নিত না। আমরা খাম সাদছিলাম, লয় নাই। তয় অর লগের পোলাপানের যার যহন বোতল দরকার ঐতো, দিতাম।’
‘আর দিতাম মজিবর বাইরে। টার্মিনালের ডিপু ছাড়া গাবতলি থিকা সাভার পর্যন্ত মজিবর তহন ১ নম্বরে। ডিপুর ক্ষমতা তো খালি টার্মিনালে, ব্রিজের ঐপারে, ব্রিজের এইপারে হের আত নাই। আরিচা রোডের সব গাড়ির, যাত্রীকোচ অউক আর গার্মেন্সের লরি অউক, তহন মজিবর ভাইরে খরচ দিতে ঐত। তো আমাগো শেল্টার দিতো মজিবর ভাই। কিন্তু সাইফুলে এইডা কী করলো? অর লেইগা আমি, হেমায়েতপুর থিকা ৮ জনের গ্রুপ অরে আইছে মারতে। আমার পুরান পরিচিত ডাবল মার্ডারের আসামী আব্বাসও আছিলো অগো লগে। একটানে জামার চাইর বুতাম ছিইড়া গেছে—অর লেইগা সিনা পাইতা দিয়া কইছি, যদি একদিনের লেইগাও বন্ধু মনে কইরা থাকছ তাইলে আমার কতা হোন, সাইফুলের গায়ে ফুলের টোক্কা দেওয়ার আগে আমার রক্ত ঝরবো। আব্বাস কয়—রফিক সর, তোর লগে কোনো কাইজ্জা না, কিন্তু অর হিসাব আলাদা, অরে ছাড়ন যাইবো না। বাইজান, আমি সরি নাই। অগো লগে কথা কওয়ার উসিলায় চার দোকানে বইয়া ১৬ টা ডাইল আনাইলাম এক পিচ্চিরে দিয়া, সাইফুলরে চোখের ইশারা করলাম। অয় চামে কাইটা পড়লো, আর আমি আব্বাসেরে বুজায়া হুনায়া আদর-টাদর কৈরা ফেরত পাডাইলাম।’
‘আসল ঘটনাটা কী ছিলো, বলো তো?’
‘অর একটা কালা বইন আছে, বিয়া হয় না। ইয়া মোটকা। ৩০ পার অয়া গেছে তাও বিয়া হয় না। আর আমাগো এলাকায়, মনে করেন, ৩০ পার হওয়া মাইয়ারা বাপ-মায়ের উপরে চাপ। সাইফুল এইডা মনে রাকলো না!’
‘মাল আসার কথা ছিল রাত ২.৩০ টায়। আমার বাসায় কাম আছিল দেইখা আমি স্পটে থাকি নাই। সাইফুলরে কইছি ম্যানেজ কইরা নিতে। এইরকম ২ জনেই কোনো একজনের কাম থাকলে একা সামলায়া নিছি। আমি জীবনেও কল্পনা করি নাই — সাইফুল এমন কাম করতে পারব। ৪ বছর যাবত আমাগো ব্যবসা। সবকিছু চলতো হিসাব মত, লাভ-লোকসান সব। কোনোদিন একপয়সা গড়মিল অয় নাই। হেরপর ২ দিন ধৈরা আমি সাইফুলরে বিচড়াই, সাইফুল আমারে এড়ায়া চলে। বাসায় গেলে হুনি, নাই। স্ট্যান্ডেও আহে না। ২/৩ দিন পর দেহা স্ট্যান্ডের লগের পাম্পের সামনেই।’
‘অয় আমারে কয়, পার্টি বোলে চোক পাল্টি দিছে। মাল পাডাইছে, তয় বোতলের মধ্যে গুড়ের শরবত বৈরা দিছে। টাকা ঠিকই বুইজা নিছে। অয় কয়, পার্টি যাওয়ার আগে অয় নাকি মাল টেস্ করে নাই। আমি যা বোজার তহনই বোজলাম। এইডা বোজন যায়, বাইজান আপনে বোজবেন, যায় না? আমি জিগাইলামও না ২ দিন ধৈরা অয় আমারে এড়ায়া চলে কেন? জিগাইলামও না, অয় আমার চোখের দিকে চায়া কতা কয় না কেন? আমরা যেই লাইনের লোক আমাগো চোখ দেইক্কা মানুষ চিনতে অয়। এই লাইনে বিশ্বাসই আসল কতা। কোন পার্টি সলিড, কোন পার্টি ভূয়া, আমরা চোক দেইখ্যা নগদ কইতে পারি। এইডা মায়ের পেডেরতে কেউ শিইক্যা আহে না। কাম করতে করতে এমনেই শিখা ঐয়া যায়। কইলাম না, আমগো লাইনের কাম ঐলো বিশ্বাসের উপর? ১০ মিনিটের আলাপে বুইজ্জা লইতে অয় পার্টি সলিড কিনা? ১০ মিনিটের মধ্যেই সিদ্ধান্ত লইতে অয়, পার্টিরে এডভান্স দেওন যাইবো কি না। সেইটা লাখ টাকাও ঐতে পারে। সবসময় এমন অয়, আমি তা কইতাছি না, তয় মাজে মইদ্যে এমন পরিস্থিতিতেও পড়তে অয়। কাজেই অর চোক দেইখ্যাই আমি যা বোজার বোজলাম, কিন্তু বিশ্বাস করলাম না। করতে পারলাম না। ক্যামনে করে কন? ক্যামনে করুম কন?’
যেন সত্যি সত্যি জবাব চায়, যেন সত্যি সত্যিই ও বিশ্বাস করে, আমার কাছে প্রশ্নের জবাব আছে এমন ব্যাকুল চোখে চেয়ে থাকে রফিক আমার দিকে। যেন আমার জবাবের সিওর সাকসেস মলম ওর আত্মার ক্ষতকে সারিয়ে বদলে দেবে নির্মল কোনো ভোরের রঙে। অনেকক্ষণ চেয়ে থাকে রফিক, আমার চোখে চোখ রেখে। কোনো অস্বস্তি বোধ না করলেও কিছু না বলে আমিও চুপ করে থাকি। ওকে ধাতস্থ হওয়ার সময় দেয়া আর কাহিনীর বাকিটুকু শোনা এই ২ জন্যই।
‘আমি কিছুই করলাম না অরে। আমাগো দুইজনেরই জমাইন্যা টাকা তখন ২/৩ লাখের উপরে। আর ঐ চালানে আমাগো দুইজনেরই ইনভেস্ট আছিল ৬০ হাজার কৈরা। আমি যশোর যায়া পার্টির লগে নিজে দেহা করলাম। অরা কইলো, অরা সাইফুলরে মাল ডেলিবারি দিছে। আর মালে কোনো ভেজাল আছিল না। অরা আমারে চ্যালেঞ্জ দিয়া কৈলো, আমি যদি ১০ বোতল মালও ইনটেক আইনা দেহাইতে পারি তাইলে অরা আমারে পুরা টাকা ফেরত দিবো। অরা জানতো ছিপি লাগানোর মেশিন, লেবেল তৈরির মেশিন এইসব আমাগো নাই। আমরা যে নতুন কৈরা শরবত বানায়া, বোতলে ভৈরা, লেবেল মাইরা, অগোরে নিয়া দেহাইতে পারমু না, এইডা অরা ভালই জানতো। মাঝখান দিয়া অরা আমার উপর চেতলো, আমি কেমনে এই কতা কইলাম? ৩ বছর দৈরা সম্পর্ক। আমি কেমনে সাইফুলের কতায় অগোরে চার্জ করলাম? আমি যা বোজার বোজলাম, চিন্তা কৈরা দেকলাম, ঠিকইতো কইছে।’
‘আমিনবাজার ফিইরা আমি সাইফুলরে কইলাম, দেক, পুরানা বন্ধুর খাতিরে আমি কোনো ঝামেলায় যাইতে চাই না। পার্টি আমারে কী কইছে কইলাম। তয় কথা শেষ করতে না দিয়া অয় পাট নেওয়া শুরু করলো। ‘তুই আমারে বিশ্বাস না কৈরা অগো কতা বিশ্বাস করলি! তুই আমারে না কৈয়া কেমনে গেলি একলা?’ — এইসব আর কি। আমি হাসলাম। পরে কইলাম চালানের থিকা ১০ টা বোতল দে। পার্টি চ্যালেঞ্জ দিছে ১০ বোতলও ইনটেক মাল যদি আমরা দেহাইতে পারি তাইলে অরা পুরা টাকা ফেরত দিবো। হুনেন, বাই, অর চেহারা যা অইলো। কতক্ষণ তো মোক কালা কৈরা কতাই কৈতে পারলো না। এট্টু পরে কৈলো, ‘মাল তো সব ভাইঙ্গা তুরাগে হালাইয়া দিছি। এত বড় চালান কয়দিন গোডাউনে রাহার রিক্স নিমু?’
‘দেখ, আমি কোন ঝামেলা চাইনা। আইজ থিকা পাটনারে ব্যবসা শেষ। তয় আমি আমার ইনভেস্টের টাকা ফেরত চাই। আমার টাকা ফেরত পাইলে আমি আর কোনো ঝামেলা করুম না।’ অয়, বহুত হাউকাউ করলো। কান্দাকান্দির ঢং করলো। আমি অরে অবিশ্বাস করলাম? কেমনে করলাম? এইসব।’
‘আমার তহন, বাই, মন ভাইঙ্গা গেছে। অর চেহারা দেকতেও রুচি অয় না। আমি চুপচাপ কতক্ষণ অর ঢং দেইক্যা কইলাম, ওটতে ওটতে — দেখ, ২ দিন সময় দিলাম। পরশু সন্ধ্যায় তুই স্ট্যান্ডে টাকা নিয়া হাজির থাকবি। অয় পিছন থিকা কৈলো — আমি তহন আডা শুরু করছি — দেখ, বেশি বাড়াবাড়ি করিছ না। আমার লগে ঝামেলা করিছ না। আমারে তুই চিনছ না …। যাইতে যাইতে এটুকই কানে ডোকলো, বাকি কতা হুনার লেইগা দাড়াইলামও না। ঠিকইতো কৈছে, আমার হাসি পাইলো, সত্যিই তো অরে চিনি না। মানি, এতদিন চিনি নাই আর কি। স্ট্যান্ড থিকা বাড়ি ফিইর্যা সোজা মজিবরের বাসায় গিয়া হাজির হয়া সব খুইলা কইলাম। মজিবর ভাই সব হুইনা কৈলো, সাইফুলরে কালকের মইদ্যে আমার লগে দেহা করতে কইছ। তুইও লগে আহিছ। আমি সাইফুলরে বাসায় না পায়া ভাবিরে কৈয়া আইলাম, কালকে বিকাল পাঁচটায় মজিবর ভাই অরে দেহা করতে কইছে। কী জানি জরুরি দরকার। আমার সাথে যাইতে অইব এইডা কইলাম না, কেননা অয় যদি তাইলে না যায়? কিন্তু সাইফুল ভুল করলো,’ বলে একটু থেমে যোগ করে, ‘অয় আইলো না।’
‘সাইফুল শাহীন ভাইয়ের পরামর্শে, আমি পরে জানছি, মতিগো লগে জোট বানছে। আমি স্ট্যান্ডে অনেকক্ষণ অপেক্ষা কৈরা শেষে মজিবর বাইয়ের বাসায় গেলাম গা। মজিবর বাই আমারে কৈলো বাড়িত যায়া চুপচাপ বৈয়া থাকতে। হ্যায় নিজে ব্যাপারডা দেকবো। আমি বাসার দিকে রওনা দিলাম। স্ট্যান্ডে নাইমা ললিত মোহন দাস রোড গুদারা ঘাটে আইলাম। আমাগো বাড়ি, বাই, বাগবাড়িতে এট্টু ভিতরের দিকে পড়লেও নদীর পাড়েই। আমি সব সময় নৌকা দিয়া বাড়ি ফিরি। এইডা সবাই জানে। মাঝনদীতে মতিরা নৌকা ঠেকা দিলো, অরা মোট সাতজন আছিলো। অরা আমারে মারতে চাইছিলো। সাইফুলও আইছিলো। আমারে অরা জোর কৈরা অগো নৌকায় উঠায়া হিজলা পার হৈয়া আরও ২/৩ মাইল ভিতরের দিকে নিয়া গেলো। এর মধ্যে সাইফুল একবারও আমার চোখের দিকে তাকাইতাছিলো না। একবার খালি চোখাচোখি হৈলে আমি কইলাম, তুই এমন করবি আমার কল্পনায়ও আহে নাই। অয় চোক সরায়া নিয়া কৈলো, আমি জানি। কিন্তু তুই আমার নামে মজিবর বাইর কাছে লাগাইলি ক্যা? তুই আমারে অবিশ্বাস করলি ক্যা? আমি কিছু না কৈয়া হুঁহ্ কৈয়া চুপচাপ বৈয়া থাকলাম বাকি পথ। অর দিকে আর তাকাইলামও না।’
“মাইল তিনেক ভিতরে নেওয়ার পর মতি নৌকা থামাইতে কৈলো। আশপাশে আর কোনো নৌকা নাই। একপাড়ে ধানক্ষেত, আরেক পাড়ে বটগাছালা একটা বিরাট মাঠ। আমার ৪ হাত-পা ৪ জন চাইপা ধৈরা জোর কৈরা হোয়াইল, মতি আমার বুকে হাঁটুর চাপ দিয়া সাইফুলের দিকে ক্ষুর বাড়াইয়া দিয়া ডাক দিলো ‘আয়’। সাইফুল কিন্তু নৌকা থামানের পর ধ্যান্দা মাইরা একটা জায়গায়ই চুপচাপ বৈয়া রৈছিলো, নৌকায় রাখা অর নিজের পায়ের দিকে তাকায়া। ঐখান থিকা উইঠা আইসা মতির হাত থিকা ক্ষুর নিয়া কৈলো, ‘মতি ভাই, একটা রিকয়েস্ট, জানে মাইরেন না। আমারে লৈয়াই তো এতকিছু, আমি হাতজোড় কৈরা অনুরোধ, জানে মাইরেন না। অরে না মাইরা ছাইড়া দেন।”
তোর কি মাথা খারাপ হৈছেরে? অহন অরে ছাড়লে মজিবর বাই আমগোরে ছাড়বো?
তাইলে অন্তত অরে সেন্টারে আটকায়া রাখেন।
‘হালার তার ছিড়া গেছে,’ অন্যদের দিকে ফিরে বলে মতি, তারপর আবার সাইফুলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, ‘সেন্টারে কয়দিন আটকায়া রাখমু? হেরপর কী অইবো?’
“বলতে বলতে মতি ডান পাশেরটারে, নাম জানি না, ঈশারা করলো। ঐ পোলায় পকেটত্যে ক্ষুর বাইর করতাছে তহন, এমন সময় অন্ধকারে বইসা থাকা সাইফুল কৈয়া ওডে , ‘মতি ভাই!’।”
“ওর গলা শুইনা সবার পাশাপাশি আমিও চমকায়া উডি। আমি আসলে সাইফুলের হঠাৎ চেঞ্জে টাসকি খায়া গেছি। প্রথমে মনে হৈছিলো নাটক করতাছে। পরে যহন ‘মতি ভাই’ কৈয়া ডাক দিলো তহনই আমি বুঝলাম, নাটক না। জানের আশা ততক্ষণে ছাইড়াই দিছিলাম। এহন ইট্টু জাগলো। সবার চক্ষু তহন সাইফুলের দিকে। মতি আমার বুকের তন হাঁটু উডায়া দাঁড়ায়া গেছে। সাইফুল একহাতে ক্ষুর আরেক হাতে আমারে ছুইয়া কয়, ‘অরে মারনের আগে আমারে মারতে ঐবো,’ শান্ত গলায় এই কথা কৈয়াই দ্রুত জোড়াহাতে মিনতি কৈরা কৈলো, ‘মতি ভাই, প্লিজ, বোজনের চেষ্টা করেন, ছোটবেলা থেইকা একলগে বড় হৈছি। এহন একটা ভুল বুঝাবুঝির কারণে জানে মাইরা ফালামু? এইটা বেইনসাফি হৈবো, মতি ভাই। আমারে দিয়া এইটা করায়েন না। অর গলায় ক্ষুর চালানের আগে আমি আমার গলায় চালামু।’ নিজের গলায় ক্ষুর ঠেকায়া কয় সাইফুল। আবার দম নিয়াই কয়, ‘এরচে আমি একটা বিকল্প প্রস্তাব … ’
তাইলে মিটিংয়ে রাজি হৈছিলি ক্যা? সাইফুলের কথা শেষ করতে না দিয়ে প্রশ্ন করে মতি।
ভুল করছিলাম, মতি ভাই, ভুল করছিলাম। খোদার কসম তহন বুজি নাই। আমি হাতজোড় কৈরা সেইজন্য মাপ চাই।
তোর বিকল্প প্রস্তাবডা কী? প্রশ্ন করে মতি।
‘অরে সেন্টারে নিয়া আটকায়া রাখেন। আমি ডিপু ভাইরে ম্যানেজ কৈরা, মজিবর ভাইয়ের লগে আপোসের ব্যবস্থা করুম। ট্যাকা ডেমারেজ দিতে হইলে আমি দিমু। আর সবকিছু ঠিকঠাক ম্যানেজ হৈলে এরপরেও আমি আপনের লগেই থাকুম।’
তোর তো যেই অবস্থা দেকতাছি, তুই অর লগেই ভাগবি, অরে সেন্টারে রাখলে।
আচ্ছা যান, আমি সেন্টারে যামু না। পুরা ঘটনা মিটমাট না হওয়া পর্যন্ত রফিক আপনের দায়িত্বে থাকব। আর এই পুরা সময়ের মধ্যে একবারও আমি সেন্টারে যামু না।
কতা ঠিক থাকবো?
থাকবো, কসম থাকবো।
দেহিছ আবার?
দেহুম। আমি কথা দিলাম, দেহুম।
মরতে মরতেও এভাবেই বেঁচে যায় রফিক, অবশ্য, যদি ওর বর্তমান জীবনযাপন মাথায় রেখে, এটাকে বেঁচে যাওয়া বলা যায়। ৩ মাস ১৯ দিন মোট ওরা রফিককে একটি ২ চালা খালি ঘরের ১টি রুমে আটকে রাখে। মতিদের ব্যাচটা ছিল হিরোঞ্চিদের, ১২/১৩ জনের একটা বড় গ্রুপ, যারা এই সেন্টারকে ব্যবহার করত হিরোইন খাওয়ার জায়গা হিসেবে। ৩ মাস ১৯ দিন ধরে ওরা রফিককে জোর করে হেরোইন খাওয়ায়। প্রথম দিকে খেতে না চাইলে ওরা মারধোর করত। সপ্তাহ ২/১ এর মধ্যেই রফিক প্রতিবাদ করা বন্ধ করে দেয়। তৈরি হতে থাকে নির্ভরশীলতা, শারীরিক ও মানসিক। ওরা শুধু ওকে গালানোর টানটা দিত। প্রথমদিকে ২/৩ টা ও শেষের দিকে ৮/১০ টা মাল গালাত ওকে দিয়ে।
এদিকে সাইফুল আবার ব্যস্ত হয়ে উঠেছে, এগুলা রফিক পরে জানতে পারে, মাসখানেক যেতে না যেতেই রফিকের সাথে দেখা করার জন্য। সে মতিদের ওপর চাপ দিতে থাকে রফিকের সাথে সামনা-সামনি দেখা করার জন্য। মতি যতই না করে, সাইফুলের সন্দেহ ততই বাড়ে। রফিককে সরায়া ফেলছে সন্দেহের কথা সে মতিকে জানায়ও। ‘তরা অরে মাইরা ফেলছস, নাইলে দেহা করতে সমস্যা কী? ডিপু ভাই তো কইছে ৫ লাখ টেকা ক্যাশ লাগবো মজিবর ভাইরে ম্যানেজ করতে। আমি তো ট্যাকা যোগাইতাছি। সাপ্তাহ খানেক তো লাগবো পুরাটা যোগাইতে, দেখতে দিতে অসুবিধা কী?’
কথা কিন্তু সেইরকম আছিলো না।
আরে ভাই, কতবার কমু, মজিবর ভাই আমারে বার বার কৈছে, নিজের চোখে একবার রফিকের অবস্থা দেইখা আইতে, নাইলে হ্যায় কোনো ডিলে যাইবো না। সাফ কথা হ্যার।
কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে চিন্তা করার পর মতি সিদ্ধান্ত জানায়, ‘ঠিকাছে, দেহা করতে পারবি, তয় কথা কৈতে পারবি না। তুই সেন্টারে আইবি, রফিকের রুম খুইলা আমাগো সামনে রফিকরে দেখবি, রফিকও তোরে দেকবো, কিন্তু কেউ কোনো কতা কবি না। ডিপু বাইর পারমিশন পাইলে আমি রফিকরে ছাইড়া দিমু।’
এদিকে রফিককে মতি হুমকি দিল, যদি সাইফুলের সামনে কোনো কথা বলার চেষ্টা করে বা কিছু জানায় তবে সাইফুল যাওয়ার পর রফিককে তারা শেষ করে ফেলবে। কথামত নির্দিষ্ট দিনে সাইফুল সেন্টারে আসে। তালা খুলে ওকে রফিকের রুমে ঢোকানো হয়। দরজায় ১ জন ও রুমের ভেতরে ২ জন পুরা সাক্ষাতের সময় দাঁড়িয়ে থাকে। ৩০ দিন পর ২ বন্ধুর দেখা। রফিক ঝর ঝর করে কাঁদে। সাইফুলও একসময় শর্তভঙ্গ করে বলে ওঠে, ‘দোস্, কেমন আছোস্?’ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা সাইফুলের কাঁধে হাত দিয়ে থামানোর চেষ্টা করতে গিয়েও দরজায় দাঁড়ানো মতির হাতের ইশারায় থেমে যায়।
‘ভালোই,’ বন্ধুর চোখে চোখ রেখে জবার দেয় রফিক, ‘বাইরের খবর কী?’
‘ভালো, সব খবর ভালো। চিন্তা করিছ না, সাপ্তাহ খানেকের মইদ্যে তুই বাড়ি যাইতে পারবি।’ অনেক কথাই বলতে চাচ্ছিল রফিক। কিন্তু দরজা থেকে মতি বলে ওঠে, ‘হৈছে, দেখলি তো, এহন আয়।’
সপ্তাহ খানেক বললেও এবং আরও মাস দেড়েক কেটে গেলেও মজিবর ভাই রাজি হচ্ছিল না বলে অনেক তদ্বিরের পরও সাইফুল কিছু করে উঠতে পারছিল না। মজিবর ভাইয়ের মত বদলে গেছে তখন। তার এখন এক কথা, ‘টাকা লাগবো না। খালি রফিকরে ফেরত দে।’ আর এতেই অন্য ইঙ্গিত পেয়ে ভড়কে গিয়েছিল সাইফুল। সে সম্ভবত মজিবর ভাইয়ের উদ্দেশ্য বুঝতে পারছিল। আর সাইফুলের নিশ্চয়তার পরও মজিবর ভাই সন্দেহ করছিল রফিকের বেঁচে থাকা নিয়ে। যদিও সে তা মুখে বলছিল না। শেষে ৩ মাস ১৯ দিনের মাথায় বিনা শর্তেই রফিককে ছেড়ে দেয় ওরা। সম্ভবত ইনডেমনিটির আশায়। সকালে বাড়ি ফিরে বিকালে রফিক মজিবর ভাইয়ের কাছে যেয়ে সব খুলে বলে। মনোযোগ দিয়ে মজিবর ভাই সব শুনে বিস্ময়ে বলে ওঠে, ‘কস কী? বেড়া হয়া গেছে?’
বেড়া-টেড়া বুজি না, তয় বিকালের আগে আগেই আত-পার আড্ডির মইদ্যে কুড় কড় করে, হামি ওঠে, চোখ দিয়া পানি পড়ে।
‘শোন, তুই ১ সপ্তা বাড়ি থিকা বাইর অবি না। বেড়া ওঠলে ডাইল-তামুক খাবি, সব ঠিক হয়া যাইব। মাত্র ৩ সাড়ে ৩ মাসের ব্যাপার তো, তেমন কষ্ট ঐবো না। তয় ঠিক ১ সপ্তা পর তুই আমার লগে দেহা করবি। ডরের কিছু নাই। নিজের মন ঠিক রাখতে পারলেই অয়। অনেক দেখছি আমি, কোনো ব্যাপার না। পরে সব বিষয়ে আলাপ করন যাইব, কারে কী করন যায়।’
বাইল্যাপাড়া থেকে আমিনবাজার স্ট্যান্ডে ফিরতে ফিরতে রাত ৮টা। আড্ডায় যেয়ে পৌঁছতেই বন্ধুরা, অর্থাৎ গ্র“পের পোলাপানরা সব হৈ-চৈ করে ওঠে, ‘শুভেচ্ছা, স্বাগতম!’ সাইফুলও ছিল, সে চায়ের হোটেলের চেয়ার ছেড়ে ওঠে। রফিকের হাত ধরে বলে, ‘দোস্! মাফ কইরা দে।’
সাইফুলের ক্ষমা প্রার্থনার ধরন এমনই। রফিক বহুদিন ধরেই এর সাথে পরিচিত। কোনো ছোটখাট বা বড় অপরাধেও, একত্রে ব্যবসা করতে গেলে যা হয়, এমনি করেই মাফ চায় সে, বরাবর। রফিকেরটা আবার অন্যরকম। কোনো দোষ করলে, চুপচাপ এসে ওর কোঁকড়া চুলের কালো চেহারা আরও কালো করে বসে থাকে। সাইফুল যখন চায়ের অর্ডার দিয়ে একটা ট্রেডমার্ক হাসি মুখে নিয়ে তাকায়, তখন কেবল রফিকের মুখে তার নিজস্ব হাসি ফোটে। পেছনের ব্যাপার নিয়ে কোনো কথা আর হয় না। যে সমস্যা তৈরি হয়েছে তার সমাধানের ব্যাপারে কথা বলতে শুরু করে তারা তখন। বরাবর এইই রীতি, তবে আজকের পরিস্থিতি অস্বস্তিকর ও ব্যতিক্রমী হওয়াতে পরিবেশ হালকা করার জন্য রফিক আন্তরিকভাবে বলে — আব্বাস, আবুল হোসেন ও গ্র“পের অন্য ছেলেদের সবার উদ্দেশ্য, সাইফুলের সাথে হাত মিলায়ে, ওর সাথে বুক মিলায়ে কোলাকুলি করে, ওর চোখে চোখ রেখে, ‘না দোস্, মাফ করার কিছু নাই, বন্দু-বান্দবগো মইদ্যে এমন অয়, আর মানুষ ভুল করে না? তুই তো দেরিতে ঐলেও তোর বুল বোজতে পারছিলি, নাইলে তো আমারে মতি, টোকা অরা ঐদিনই নৌকায় জবাই করতো। তুইই তো আমারে বাঁচাইলি। আর এই ৩ মাস তুই আমার লিগা কী করছ নাই, ক। তুই শাহিনের লগে মিইল্যা অর ফুসকানিতে যোগ দিলি, ডিপুগো লগে, মতিগো লগে, খালি এইডাই খারাপ লাগে। তয় তুই চিন্তা করিছ না, ডরাইছ না, মজিবর বাই খেইপা রৈছে তো! এইডা আমি সামলামু। তুই চিন্তা করিছ না। তয় দোস, সত্যি একটা কথা কই? যেই মতি তোর আপন ছোড ভায়ের চক্ষু উপড়ায়া নিছিলো, যেই মতি আমাগো গ্রুপের কাউরে গাবতলি টার্মিনালে পাইলেই ঠাট্টা-মস্করা-অপমান কইরা দৌড়ানি দেয়, যেই মতি মজিবর বাইয়ের লগে চোখ পাল্টি দিয়া ডিপুর লগে যোগ দিছে (অয় মনে করছিল, পলিটিকাল পাটির লগে যোগাযোগ রাখা এক কথা, আর ওয়ার্ড কমিশনারের শেল্টার অনেক কথা) তুই কিনা অগো লগে হাত মিলাইলি!’ বলতে বলতে আবেগী হয়ে ওঠে সে, ‘মতির হাতে তর বাইয়ের, আমার কথা নাইলে বাদই দিলাম, রক্ত লাইগা আছে — এইটা তুই ভুইলা গেলি? আর আমার কথাই বা বাদ যাইবো কেন? কী করি নাই তোর লেইগা। আড়াপাড়া থিকা যহন সেন্টুরা ৭/৮ জনের দল আইছিল তোরে হিট করতে, তুই সেন্টুর বইনেরে ফুসলায়া কুকাম করছিলি, এইটা জাইন্যাও আমি আউগাই নাই? সিনা পাইত্যা দেই নাই? আউগাইছি। আমি তরে কবে এক পয়সা ঠকাইছি? তুইও তো আমারে ঠকাছ নাই কোনোদিন। গত ৪ বছর দৈরা আমরা যে ব্যবসা করি, আমগো লগে কোনদিন সিরাসলি লাগছে? ব্যবসা করতে গেলে ছোটখাট ঝুট-ঝামেলা, ফ্যাসাদ, মন ব্যাকা এইসব তো অয়ই। কিন্তু ঐ হিসাব তো আলাদা। ঐটা তুইও মনে রাহছ নাই, আমিও রাহি নাই। কিন্তু দোস্,’ এটুকু বলে রফিক কয়েকবার ঢোক গিলে, দুইবার নাক টানে, যেন সর্দি, তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় পরের কথাটা শুরু করতে গিয়ে ২/৩ বার চেষ্টা করেও পারে না গলা আটকে যাচ্ছিল বলে। জোর করে একটু ধাতস্থ হয়ে শেষে কোনোরকমে বলে, ‘আমি তোর কিছু করছিলাম? মিন্টুর চিকিৎসার অর্ধেক টাকা আমি দিছি। তুই তো টাকা জমাইতে পারছ না,’ আবার গলা আটকে আসে রফিকের, ‘আমার কোন কামটা তোর খারাপ লাগছে? আর যদি লাগেও, তুই তো কৈতে পারতি। আমি তোর কোন বাড়া ভাতে ছাই দিছি। আমি তোর কী করছিলাম?’ হু হু করে না, কেননা ওরা ওভাবে কাঁদে না, তবে হৃদয়ের আক্ষেপ বা আত্মার যন্ত্রণা মেলে ধরার সময় যা হয়, অর্থাৎ মানুষ যখন কাঁদে, কথা শেষ করার পর রফিকের চোখে, কে জানে কোন শিরা রগ বেয়ে বেয়ে মানুষের শরীরের ভেতর অনির্দেশ্য বেদনার নিরাময় হয়ে, হৃদয়ের অতল থেকে অনেকক্ষণ ধরে উঠে আসা পানি তখন ছলছল করে রফিকের চোখে, অনতিবিলম্বে গড়িয়েও পড়ে। উপস্থিত সবাই না দেখার ভান করলেও সাইফুল সরাসরি চেয়ে থাকে রফিকের দিকে। গড়াতে শুরু করার সাথে সাথেই হাতের চেটো দিয়ে মুছে ফেলে রফিক চোখের পানি। এবারও সবাই চুপচাপ থেকে না দেখার ভান করে। শুধু সাইফুল তখনও চেয়ে থাকে, অপলক। বেদনায় বাঁকা হয়ে যাওয়া রফিকের হৃদয়ের মত করে বসে থাকে সে। নিজেই অভিযুক্ত জন, তবু কোনো নিরাময় বাক্য খুঁজে পায় না সে রফিকের জন্য, অনেক চিন্তা করেও। বরং বলে, ‘দোস্ত, কইলাম তো, মাফ কইরা দে, আর করুম না। এহন আমার পরিস্থিতি তো তুই বোজছ। মতিগো লগে থাকা ছাড়া আমার আর উপায় নাই। মজিবর বাই আমারে ছাড়ব না। তুই যতই কস, তুই সব ম্যানেজ করবি, আর আমি জানি তুই চেষ্টাও করবি, কিন্তু তুই হ্যারে চিনছ না। নিজের ১৯ বছরের ভাতিজারে নিজের হাতে জবাই করছে। সবাই জানে, তুইও জানছ। লাশ পাওয়া যায় নাই দেইখা কেস টিকে নাই। দোষ একটাই — গ্রুপের পোলাপান মজিবর ভাইয়ের চেয়ে ভাতিজারে বেশি পছন্দ করতে শুরু করছিল। মাত্র ২ বছরে ভাতিজা যেই পজিশনে গেছিল গা, ঐদিকে সাভারের সালাউদ্দিন এমপি থিকা শুরু কৈরা এইদিকে আমিনবাজার পার হৈয়া মজিবর বাইয়ের চিরশত্রু টার্মিনালের মতির লগেও অর কানেকশন তৈরি হৈয়া গেছিল। মজিবর বাই নিজেই এইডা করতে চাইছিলো, বিশেষ কইরা ডিপু-মতির লগে একটা সম্পর্ক তৈরি। কিন্তু বছর ২ এর মদ্যেই বাতিজা যহন খালি গ্র“পের সবার পছন্দের হইয়া উঠলো না, বরং মজিবর বাইয়ের ২/৩ ডবল এলাকায় সম্পর্ক/যোগাযোগ তৈরি কৈরা ফালাইলো অথচ মজিবর বাই নিজেই অয় কথাবার্তায় স্মার্ট আছিলো দেইখা গাবতলি টার্মিনাল থিকা আরিচা ঘাট পর্যন্ত নিজের এলাকা বানাইতে অরে সিলেক্ট করছিলো। পরে কী ঐলো সবই তো জানছ।’
‘মজিবর বাইয়ের কতা না হয় বাদ দিলাম,’ রফিক আবার কথা বলতে শুরু করে, ‘আমার কী দোষ আছিলো? আমি নিজে টিভি কিনার আগে তরে কিন্যা দিছি, তাও ব্যবসার ট্যাকা থিকা না, আমার লাভের অংশের ট্যাকা থিকা। সাইফুল, আমি কল্পনাও করতে পারি নাই এমন ঐবো। এইডা তুই কী করলি, সাইফুল? আমি অহন কী করুম?’
কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে উপস্থিত প্রত্যেকেই। কী বলা যায় বুঝতে না পেরে ঠাণ্ডাই থাকে। শেষে দীর্ঘ বিরতির পর নিজেদের সামলে নিয়ে রফিক সাইফুলকে বলে, ‘তুই বাড়ি যা, আগামী ১ সাপ্তাহ গরে থাকবি। টার্মিনালেও যাবি না। আমি ইনশাল্লাহ, আতে-পায়ে দৈরা ঐলেও মজিবর বাইরে ম্যানেজ করুম। তয় মতি-ডিপুগো লগ ছাড়তে হৈবো তর। এইডা মাথায় রাখিছ।’
ঠিক ১ সপ্তাহ পর রফিক মজিবর ভাইয়ের বাসায় যায় নির্ধারিত সময়ের ১০ মিনিট আগেই। মনের মধ্যে একটা ভয়ানক আশঙ্কা। আর সে নিজেও বুঝতে পারছিল না কেন কেমন যেন লাগছিল এই কয়দিন। ঠিক বুঝতেও পারে না চিন্তাটা, যা ঝাপসা, অস্পষ্ট কিন্তু জান্তব, যা একেবারেই ভ্রুণ পর্যায়ে আছে বলে অস্পষ্ট। একটা চিন্তার বীজ ছিল সেটা আসলে। একটা জিঘাংসার এত সামান্য ও ক্ষুদ্র ও প্রাথমিক রূপ যে প্রথম দিকে রফিকের ভূল করে তা মাঝে মাঝে মায়া বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু মনের গভীর ভেতরে যেখানে বাসনা-ইচ্ছা-প্রতিজ্ঞা-অনুভূতি খেলা করে সেখানে গত কয়েকটা দিন ধরে বিলম্বিত কিন্তু নির্দিষ্ট বিরতিতে ফিরে ফিরে আসছিল সেই ঝাপসা অনুভূতি, রফিকের সচেতন মন যা ভাবতেই শিউরে উঠছিল। ২/১ দিনেই রফিক বুঝে যায়, এটা মায়া না; সপ্তাহকাল ধরে মাঝে মাঝেই চলতে থাকা অস্বস্তিকর অস্পষ্ট ভাবনাটা যে জিঘাংসা, রফিক তা তখনো জানে না। বলা বাহুল্য, রফিকের এই ব্যক্তিগত জিঘাংসার সাথে মজিবর ভাইয়ের গ্র“প ডিসিপ্লিনের কোনো সম্পর্ক নাই। এটা রফিকের একার খেলা। রফিক অবশ্য এটাও জানে না। হৃদয়হীন মাঠে ব্যক্তিগত কালো পীচে একাই বল করছে ও ব্যাট চালাচ্ছে রফিক গত ৬/৭ দিন ধরে। ‘এই পুরা ব্যাপারটার নামই কি নিয়তি?’ আমি ভাবি, ‘তবে তো কোনো কথা থাকে না। আর যদি তা না হয়, এর নাম নাম হয় কর্মফল, কার্যকারণ সম্পর্ক ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি, বা অন্য কোনো কিছু, তবে তো কথা থাকতেই পারে।’
কিন্তু পাঠকের বিরক্তির ভয়ে আমি সে আলাপে যাব না। আমি শুধু আমার কাহিনী বলতে পারলেই খালাস।
যা বলছিলাম, একটা ভয়ানক আশঙ্কা মনে নিয়ে ড্রইংরুমে মজিবর ভাইয়ের অপেক্ষায় বসে আছে রফিক। রাজ্যের চিন্তা, কখনো কখানো বিপরীতমুখী, তার মাথায় বহতা নদীর ঢেউয়ের মত ওঠে নামে, কিন্তু কৈ তীরে এসে আছড়ে ভেঙে পড়ে না তো!
কীরে কী অবস্থা?
কখন রুমে এসে ঢুকেছে খেয়ালও করে নাই, এক কোণে রাখা একটা মিনিয়েচার পৃথিবীর দিকে অপলক চেয়ে থেকে ভাবনায় ডুবে ছিল, এতক্ষণে মজিবর ভাইয়ের প্রশ্নে ধ্যান ভাঙে রফিকের।
এই তো। অবস্থা ভালই। ১ম ২ দিন একটু শরীর ব্যতা করছে, রাইতে গুম হয় নাই। খালি হামি ওডে আর চোখ দিয়া পানি পড়ে। তয় এহন ভালোই আছি, রাইতে ঘুমও অয়। জ্বালাপোড়া কমছে।
সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে জবাব দেয় রফিক, শেষের অংশটুকু মিথ্যা। কেননা টানা ৪৮ ঘণ্টা চরম মানসিক অস্থিরতা আর শারীরিক ব্যথা নিয়ে নির্ঘুম রাত কাটানোর পর ৩য় দিন ভোর থাকতে থাকতেই ধামরাইয়ের বাসে চেপে, ৮ বা ৭ নম্বরে উঠলে ড্রাইভার কন্ডাক্টররা চিনে ফেলতে পারে তাই, সোজা বিয়েনপি বস্তিতে হাজির হয় রফিক। ডাইল খেতে ঢাকার তৎকালীন বৃহত্তম বস্তিতে সে আগেও এসেছে বলে এলাকাটা তার পরিচিত। হিরোইন বিক্রি হয় এটা শুনত তখন, তবে কখনো যেচে দেখারও সাধ হয় নাই। আসলে হিরোঞ্চিদের বাহ্যিক কন্ডিশন দেখে আর বিভিন্ন জনের কাছে এর সম্পর্কে শুনে শুনে, সে একরকম ঘৃণাই করত ব্যাপারটা। তবে সেদিন নিজস্ব প্রয়োজনে, ভালবাসার টানে আসা বলে খুঁজে পেতে ৫ মিনিটও লাগে নাই। আসলে ১ম ২ দিন প্রতিটা মুহূর্তই আসতে চেয়েছিল সে, তবে মজিবর ভাই, বন্ধু-বান্ধবসহ দুলাভাইয়ের উদ্বেগাকূল যতœ ও নিজের সাথে করা প্রতিজ্ঞার (‘আর জীবনেও একটানও দিমু না’) কারণে আসা হয় নাই।
তবে বস্তিতে আসার পর খুঁজে বের করে মাল খেতে খেতে রফিকের খুব মন খারাপ হয়ে যায়, শুভানুধ্যায়ীরা সবাই কত কষ্ট পাবে কল্পনা করে। তবে, সে খেয়ালও করে না, নিজের উপর স্বারোপিত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে সে মতিরা যা চেয়েছিল ঠিক সেটই করে বসল। তারপর ৪র্থ-৫ম দিন পুনরায় নিয়ন্ত্রণ কঠোর করে ৬ষ্ঠ দিন আবার। এভাবে গত ৭ দিনে মোট ২ দিন। স্বাভাবিকভাবেই ঝাড়ি খাবার ভয়ে ব্যাপারটা চেপে যায় রফিক মজিবর ভাইয়ের কাছে। এভাবে চূড়ান্ত ভুলটাও করে বসে সে।
বাসার খবরাখবর জানতে চায় মজিবর ভাই টুকটাক প্রশ্নের মাধ্যমে। সংক্ষিপ্ত জবাবের মাধ্যমে কথা চালিয়ে যায় রফিক। ধীরে ধীরে আধা ঘণ্টার মধ্যেই আড়াপাড়ার সেন্টু, হেমায়েতপুরের বাবলা, সাভারের লাকিসহ মোট ৬ জন এসে জমা হয় মজিবর ভাই’র ড্রয়িংরুমে। এদের মধ্যে মাত্র ১ জনকে রফিক চেনে না। ‘শোন সবাই,’ মিটিং শুরু করে মজিবর ভাই। প্রস্তাব জানানোর স্বরে আসলে সিদ্ধান্তই জানায় সে, ‘মতি আর সাইফুল ২ জনরেই ফালায়া দিতে ঐবো। ব্যাপারডা আসলে প্রেস্টিজের ব্যাপার হৈয়া দাড়াইছে।’
কিন্তু, মজিবর বাই, সাইফুলই তো আমারে বাঁচাইলো! অয় না থাকলে আমারে নৌকায়ই শ্যাষ কইরা দিতো।
‘প্রথমে বেঈমানিডা করছিলো কে?’ রফিকের চোখে চোখ রেখে শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন করে মজিবর ভাই। কিছুক্ষণ জবাবের আশায় অপেক্ষা করে রফিক যখন মাত্র মুখ খুলতে যাবে তখন হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিয়ে মজিবর ভাই যোগ করে, ‘আর তাছাড়া, খালি তর একার লগেই বেঈমানি করে নাই, সবাইর লগে করছে। ক্ষতিপূরণই সব! তরে ক্ষতিপূরণের ট্যাকাটা দিলেই সব শ্যাষ অইয়া গেল? আমার অপমানের কী অইব? কী জবাব দিবি, ডিপুর পোলাপানরা যহন হাসাহাসি করব?’
মজিবর ভাই থামতেই রফিক দ্রুত কথা শুরু করে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে, ‘বিশ্বাস করেন, মজিবর বাই, অয় একটা বুল করছিলো লুলা শাহীনের পাল্লায় পইরা। কিন্তু পরে তো বুল বোজতে পারছে। অয় না থাকলে আমি ঐদিন বাচতাম না। তাছাড়া অয় কতা দিছে, আপনে মাফ দিলে অয় নাকে ক্ষত দিয়া ডিপু-মতিগো গ্রুপ ছাইড়া আবার আমাগো কাছে ফেরত আইবো।’
‘খানকি চিনছ, খানকি!’ মজিবর ভাইয়ের মুচকি হাসিমাখা প্রশ্ন শুনে প্রথমে অর্থ বুঝতে পারে না রফিক। তারপরে বুঝতে পেরে কার্পেটের দিকে চেয়ে বলে, ‘মতিরে মারেন! সাইফুলরে মাইরেন না। জীবনে এই পরথম বুল করল, প্রথমবারও মাফ করবেন না? আপনের কাছে হাত জোর কৈরা অনুরোধ করি …।’
কথা শেষ করতে পারে না রফিক, মজিবর ভাইয়ের পাশে বসে থাকা নাম না জানা (পরিচয় পর্বের সময় বলেছিল, তবে রফিক মনে রাখতে পারে নাই) লোকটা, ‘এই হিজড়াডারে কৈত্যে জোগাইছেন?’ মজিবর ভাইর দিকে ফিরে প্রশ্ন করে। রফিকের দিকে ফিরে লোকটা তার কথা শেষ করে, ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠের ২ বাক্যে, ‘শোনো, ছোডবাই, বয়স কম তো, অহনও সব বুইজা ওটতে পারো নাই। সবকিছুর একটা নিয়ম আছে।’
তর্ক বিতর্ক বা রফিকের উপর্যুপরি অনুরোধ ও বাকি সবাই মিলে তাকে বোঝানোর পর্ব চলে ঘণ্টাখানেক। রফিকের অনুনয় মাখা কণ্ঠ শুনে কে বলবে, তখনও, তার মনের গভীরে বইছে সেই চোরা স্রোত। ভাবনার, আবেগের বা ছদ্মযুক্তির চিরাচরিত অধঃপতন।
‘কুত্তার বাচ্চা, আমার লগে এমন করলো, একবারও ভাবলো না আমি অরে মাফ কইরা দিলে স্ট্যান্ডের সবাই আমারে নিয়া হাসবো। ক্যামনে পারলো অয়! মজিবর বাইয়ের লগে নাইলে স্বার্থের সম্পর্ক, কিন্তু আমার লগেও স্বার্থের সম্পর্ক তর, সাইফুল? এইডা ভাবলি তুই? আমি কিন্তু ভাবি নাই। আমি কোনোদিনও ভাবি নাই। অহন আমি যদি মজিবর ভাইগো কতায় রাজি ঐয়া যাই, তাইলে? তাইলে কেমন লাগবো? কী বাল ফালাইতে পারবি তুই? নিজের বাইয়ের রক্ত লাইগা থাকা হাতে হাত মিলায় যে, অয় কি মানুষ? অর বাঁচনের দরকার আছে কোনো?’ সেই কার্পেটের দিকে চেয়েই এসব ভাবছিল রফিক।
তবু এসব ছিল তার ভেতরের ভাবনা। বাইরে সে সাইফুলকে বাঁচানোর চেষ্টা তখনো করে যাচ্ছিল, যদিও টের পাচ্ছিল তার প্রতিটা যুক্তিই এই লাইনে হাস্যকর ও ভুল, এমনকি ক্ষতিকরও হতে পারে। ৫ জনের সাথে আর কতক্ষণ পারা যায়, একা একা? অথবা ৫ জনের সামনে আর কতক্ষণ চাপা রাখা যায় আত্মতৃপ্তির ঢেকুর? একসময় রাজি হয়, বা হতে বাধ্য হয়, বা, কে জানে, হয়ত সানন্দেই রাজি হয় রফিক। পরিকল্পনা শুরু করে ৬ জন। আর রফিকও তাতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। প্রথমে মতিকে টার্গেট করা হয়। এতে পাল্টা হিটের সম্ভাবনা থাকলে তা যথেষ্ট বিলম্বিত হবে যা তাদেরকে আলোচনা ও ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে মীমাংসার পর্যাপ্ত সময় দেবে। থানা পেমেন্ট নিয়ে আলোচনা হয়; গাবতলি ও সাভার থানা ২ থানায়ই পেমেন্ট দিতে হবে। থানার সাথে যোগাযোগের দায়িত্ব দেয়া হয় বাবলাকে। মোট ৪০/৫০ জনের টিম যাবে মতির হরিরামপুরের বাড়িতে হিটে। মূল হিটার থাকবে ৪ জন। রফিককে অব্যহতি দেয়া হয় হিটার টিম থেকে, তবে মূল টিমে থাকতে হবে তাকে। মতিকে সরানোর দায়িত্ব নেয় মজিবর ভাই নিজে, তবে সাহায্যকারী হিসাবে নাম না জানা লোকটা, লাকি আর ইফতি সাথে থাকবে। একই এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় বাবলাকে বাদ দেয়া হয় হিটার টিম থেকে। তবে তাকে দায়িত্ব দেয়া হয় পুলিশকে সামলানোর। টাকা খাওয়ার পরও পুলিশ যদি চোখ পাল্টি দেয়, তবে সেন্টু তাদের অপেক্ষায় থাকবে ট্রলারে। আমিনবাজার থেকে বইলাপুর পর্যন্ত আরিচা রোডের বিস্তীর্ণ দিগন্তছোঁয়া বিলে। থানায় ইনফরমার আছে, বিশ্বাসী হাবিলদার। ২ থানাতেই। গাবতলী থানা সামলানোর জন্য আরেকটা টিম (৫/৬ জনের) থাকবে মিরপুর ব্রিজের গোড়ায়। নিচে তুরাগে ট্রলার রেডি থাকবে কেটে পড়ার জন্য।
‘তবে খেয়াল রাখবি পুলিশের গায়ে বা গাড়িতে য্যান গুলি না লাগে, তরা খালি ফাঁকা গুলি করবি আর ডিব্বা ফুটাবি টানা ২ মিনিট। তারপরেই ভাগবি। গুলির শব্দ পাইলেই আমি ওসির লগে কথা কমু।’
ঠিক ৩ দিন পর অপারেশনের দিন ঠিক হয়। রাত ১০ টায়। মতির বাড়িতেই ঘটনা ঘটানো হবে। আর সাইফুলের জীবনকাল আরও ১ সপ্তাহ বাড়ানো হয়। এর মধ্যে রফিক প্রতিদিন সাইফুলের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাবে, আশা দিয়ে যাবে ক্রমাগত মিটমাটের, মজিবর ভাইয়ের কাছে ফেরত এলে মাফ করা হবে তাকে এই আশ্বাস দিয়ে। আরও বিভিন্ন খুঁটিনাটি দিক নিয়ে আলোচনায় রাত গড়ায় ১০ টায়।
মনে ক্রোধ আর হৃদয়ে প্রতিশোধের তীব্র বাসনা নিয়ে আমিনবাজার স্ট্যান্ডের দিকে রওনা হয় রফিক। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, ‘আর ৭ দিন। শুয়োরের বাচ্চারে শ্যাষ করার দিনই লাস্ট খামু। এরপর জীবনেও আর না। অয় মনে করছিলো, সবকিছুই অর মনমত অইবো। সেরের উপ্রে সোয়া সের আছে, অয় অহনও জানে নাই।’
এ তো গেল মতিকে নিয়ে ভাবনা। সাইফুলের ভাবনা মাথায় এলে আরও উত্তেজিত হয়ে পড়ে সে; জানালার পাশের সিটে বসেছে, হু হু বাতাস তীব্র আবেগের মত আছড়ে পড়ছে তার চোখে-মুখে-চুলে। বাইরের না দেখা দিগন্তবিস্তৃত জলরাশির অন্ধকারের দিকে চেয়ে, তীব্র বাতাসেও যতটা পারা যায়, শীতল ও ক্রুর চোখে, বিড় বিড় করে সে, পাশে বসা প্যাসেঞ্জারের অবাক দৃষ্টির সামনে, ‘বুকের বদলে পিঠ দিলি? তুই পারলে আমিও পারুম।’
স্ট্যান্ডে এসে দেখে সাইফুল ওর জন্য বসে আছে তখনও। উদ্বেগাকূল, ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে। দক্ষতার সাথে অভিনয় করে রফিক, সাইফুলের অস্থিরচিত্তকে প্রায় শান্ত করে দেয়, এত নিখুঁতভাবে। ‘মজিবর বাই রাজি অইছে। পরে একদিন দেহা করার ডেট দিবো, তয় ৭টা শর্ত আছে।’ ৬ নম্বরটায় কেমন জানি একটু খুঁতখুঁতানি থাকলেও, বাকি ৬টায় কোনো সন্দেহজনক কিছু খুঁজে পায় না সাইফুল। মোটামুটি নিশ্চিত হয়েই, নিরাপদ সে, বাড়ি ফেরে। পরদিন বিকালের পর থেকে রফিকের খোঁজ পাওয়া যায় না। মোবাইলও বন্ধ। কই গেছে বা কোথায় গেছে কেউ এমনকি বাড়ির লোকও জানে না।
সেদিন সারারাত ঘুম হয় না রফিকের। দ্বিধার দুধারী করাতে ফালা ফালা হয় তার চৈতন্য। তার দৌড় তো ছিল বড় জোর হকিস্টিক পর্যন্ত; তাও ব্যবসা শুরু করার পর থেকে ঐসব বন্ধ। স্কুলে পড়ার সময়কার উত্তেজনায় ১২/১৫ জনের দল নিয়ে অন্য মহল্লায় হিটে গেছে জুনিয়র পোলাপান সামনে সিগারেট খেয়েছে বলে। তাও, কাপুরুষ, না-মরদ হওয়ার ভয়ে। তাও সতর্কতার সাথে সবার অলক্ষ্যে পেছন দিকে থেকেছে সে, যাতে হিটে অংশ নিতে না হয়। পেছন থেকে, ‘মার হালারে, হাড্ডি ছেঁইচ্যা দে বাঞ্চোতের …’ ইত্যাদি গলাবাজী করা পর্যন্তই ছিল তার দৌড়। হকিস্টিক হাতে নেয়াই সার, কারো গায়ে হিট করতে হয় নাই। ঐটা রফিকের কাজ না, রফিক পারে না। যদিও ৪০/৫০ জনের বিশাল টিম যাবে, যদিও ৫ জনের হিটার তালিকায় রফিক নাই, তবুও, জ্জ ঘণ্টা আগে মজিবর ভাইয়ের বাড়ি থেকে ফেরার সময়কার গরম ক্রোধ গলে পরিণত হয়েছে শীতল গ্লানিতে। চেষ্টা করেও ক্রুদ্ধ হতে পারছে না সে। বাইরে বৃষ্টি ঝরছে অঝোরে, বৃষ্টির ছাঁট জানালা দিয়ে এসে বিছানার একপাশসহ রফিকের চোখে-মুখে পড়ছে, তবু উঠে জানালা বন্ধ করতে ইচ্ছা হয় না, শক্তি পায় না শরীরে। যেন কয়েক টন হয়ে গেছে শরীরের ওজন, তার মনে অবসাদে। খোলা চোখে নিঃসাড়, সটান বিছানায় শুয়ে ভিজতে থাকে রফিক।
‘বাই, বিশ্বাস করবেন না জানি, এতো বছর এই লাইনে, তাও কোনোদিন কারো গায়ে ফুলের টোক্কাও দেই নাই।’
‘জানি আমি,’ বলে ফেলেই, কোনো পূর্ব ভাবনা ছাড়াই মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায় কথাটা, রফিককে চিনতে পারি আমি। অনেক্ষণ ধরেই খচ খচ করছিল মনের ভেতর। কোথায় যেন? কোথায় যেন দেখেছি! নাকি শুনেছি কোথাও এই কণ্ঠ? এতক্ষণে হঠাৎ ‘ফুলের টোক্কা’ শুনে দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়ে যায় সব। প্রায় ১০/১২ বছর আগের ঘটনাটা স্পষ্ট মনে পড়ে আমার। অবশ্য না চেনার কারণও আছে। সাক্ষাৎটা হয়েছিল অন্ধকারে। ১০/১২ মিনিটের একটা ঘটনা।
১০/১২ মিনিটের ঘটনা। বাসে আমিনবাজার ক্রস করার সময় ভার্সিটির উদ্দেশে, রাত ১১ টার দিকে, আধা ঘণ্টার দ্বিধা-দ্বন্ধের অবসান ঘটিয়ে, অবশ্যম্ভাবী সিদ্ধান্ত নিয়ে, বাজার বাসস্ট্যান্ডে নেমে পড়ি। তখনও পাতায় আসি নাই, সিরাপে ছিলাম। মুন্সীবাড়ির দিকে যাওয়ার ফুটব্রিজে পার হয়ে মহল্লার ভিতরে এক বাসায় বিক্রির ব্যবস্থা ছিল। বাইরে রাস্তায় বা ব্রিজের উপর ঘুরঘুর করা খুচরা বিক্রেতাদের চেয়ে ২০/২৫ টাকা কম নিত। বাস থেকে নেমেই ফুটব্রিজের দিকে আগাই। চারপাশ অনেকটা নির্জন হয়ে এসেছে, যদিও রাস্তার ওপাশের হোটেল-রেস্তোরাঁগুলা তাদের লাউড স্পিকারের উচ্চ শব্দের গান-বাজনাসহ জ্বলজ্বলে।
ব্রিজের গোড়ায় আমার বয়সী ২টা পোলা স্টিকে গাঁজা ভরছে। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করে, ‘কী ভাই, মাল লাগবো।’
‘না’ সংক্ষেপে জবাব দিয়ে ওদের ক্রস করে ব্রিজে উঠে যাই।
‘আছে তো, লগেই আছে।’
খাঙ্গালীবাজ ভেবেছি ওদের আমি, সম্ভবত এটা ভেবেই আবার অ্যাপ্রোচ করে ওদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কালোজন। আমি থেমে ওদের দিকে ফিরে শান্ত স্বরে বলি, ‘বললাম তো লাগবে না। কী মনে করেন আপনেরা। সবাই একরকম ?’
আমার কথা শুনে সশব্দে একটা বাঁকা হাসি হাসে ছেলেটা।
‘যাইতাছেন তো খাইতেই,’ বলতে বলতে শার্ট উঁচিয়ে কোমড়ে লুঙ্গিতে অর্ধেক গোঁজা ২টা ফেন্সিডিলের বোতল দেখিয়ে, ‘আমাগো কাছ থিকা নিলে অসুবিধা কী? ইনটেক মাল আছিল।’
হঠাৎ কী যে হয়! মারাত্মক একটা ভুল করে বসি। ভণ্ডামির একটা সীমা থাকা উচিত, আমার তা মনে থাকে না। চিৎকার করে বলে উঠি, ‘ঐ মাদারচোত, কথা কানে যায় না? কইতাছি না, লাগবো না? তারপরো ঘ্যান ঘ্যান করতাছোস ক্যান? মানুষ মনে হয় না, না?’
ওদের মধ্যে কালোজন তখন বেশ শান্ত স্বরে বলে, ‘সরি, সরি ভাই, বোজতে পারি নাই। আপনে যান।’ ছেলেটার মুখের কথার সাথে আবছা আলোয় দেখা চোখের ভাষার কোনো মিল নাই দেখে বুঝতে পারি, ভুল হয়ে গেছে। আমরা ছাড়া ব্রিজে আর কোনো লেকাজন নাই। ওদের দাঁড়ানোর ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে এখন যদি রাস্তায় ফেরত যাওয়ার চেষ্টাও করি, তবুও ঝামেলা করবে ওরা। চিন্তা করার সময় বেশি ছিল না। আমি ঘুরে ব্রিজ পার হয়ে মহল্লার দিকে যাওয়ার রিস্কটাই নেই। ৪/৫ পা আগাতেই টের পাই ওরাও পেছন পেছন আসছে। পকেটে একটা নোটই ছিল। ৫০০। পকেটে হাত দিয়ে হাঁটছিলাম আমি।
নোটটা পকেটের ভেতর হাতে নিয়ে ভাঁজ করতে করতে আধা বর্গইঞ্চির সমান করে, মধ্যমা আর অনামিকার মাঝে চেপে ধরে সেট করে পকেট থেকে হাত বের করে হাঁটতে থাকি। ব্রিজ পার হয়ে ৮/১০ গজ পর ডানদিকে একটা চিপা গলিতে ঢুকতে হয়। ইনট্যুশন বলছিল, ঐ গলিতে ঢুকেই ধরবে। একবার ভাবি, গলিতে না ঢুকে সোজা সামনে আগাই, তারপর কী ভেবে ডানের নির্ধারিত চিপা গলিতেই ঢুকে পড়ি। ঘুটঘুটে অন্ধকার গলি। ৭/৮ গজ আগাতেই পেছন থেকে ডাকে ছেলেটা, ‘এই যে ভাই, দাড়ান একটু।’ আমি থেমে যাই। খেয়াল করি, প্রথম থেকেই এই ১ জনই কথা বলছে। কাছে এসে ছেলেটা আমার কলার চেপে ধরে, ‘মাদারচোত মানে কী? মাদারচোত মানে কী?’ বলতে বলতে আমাকে পেছনের বিল্ডিংয়ের গায়ে ধড়াম করে চেপে ধরলে আমি সারেন্ডারের ভঙ্গিতে হাত উঁচিয়ে দু’আঙুলের ভাঁজের নোটটা তখন যৌক্তিক কারণেই অদৃশ্য, শান্তস্বরে বোঝানোর ভঙ্গিতে বলি, ‘ভাই, আমার কথাটা শোনেন আগে।’
‘চোপ, খানকির পোলা! তোর আবার কথা কী? মাদারচোত মানে কী? মাদারচোত মানে কী?’ বাঁ হাতে কলার চেপে ধরে ডান হাতে আমার সারা বডি সার্চ করে ছেলেটা। অন্য ছেলেটা একটা ক্ষুর বের করে, ভাঁজ খুলে, আমার গলার কাছে হালকা ছুঁইয়ে, এই প্রথমবারের মত আশ্চর্য ঠাণ্ডা কণ্ঠে প্রশ্ন করে, সেই একই প্রশ্ন, ‘মাদারচোত মানে কী?’
আমি বুঝি সত্যি সত্যি অপমানিত হয়েছে ওরা। মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে এখন। গলায় ক্ষুর ঠেকানোর সাথে সাথেই নড়াচড়া বন্ধ করে দিয়েছি আমি। ২ হাত সারেন্ডারের ভঙ্গিতে উঁচু করে রাখা। আমি শান্তভাবে, উত্তেজিত না হয়ে, ভুল শব্দ ব্যবহার না করে, গলায় আন্তরিকতা মেখে ওদের বোঝাই, ‘ভাই, সত্যি কথা বলি, মাল খাইতেই আসছি। তবে আমার নির্দিষ্ট ঘর আছে। সবসময় সেখানেই খাই। দাম ২০ টাকা কম রাখে বাইরের চেয়ে। আসলে অন্য একটা ব্যাপারে খুব চিন্তিত ছিলাম। ২ বার না করার পরও যখন আপনেরা শোনলেন না, তখন হঠাৎ মেজাজ খারাপ হয়া গেল। সরি, ভাই, সত্যি সরি। আমি দেখতাছি আমার কথায় আপনেরা কষ্ট পাইছেন। তবে বিশ্বাস করেন, আমি সত্যি কষ্ট দিতে চাই নাই। হঠাৎ বইলা ফেলছি। সরি, মাফ কৈরা দিয়েন।’
‘মাল খাইতে যাইতাছেন টাকা কই?’ ইতোমধ্যে ২ বার পুরাপুরি সার্চ করেছে ওরা, কাজেই স্বাভাবিক প্রশ্নটাই করল, ‘আপনের তো, যাওয়ার ভাড়াও নাই।’
আমি বাকিতে মাল খায়া, যাওয়ার ভাড়া নিয়া তারপর যামু।
অন্ধকারে আমার উপরের দিকে তোলা হাত দেখা যাচ্ছিল না বলে সঙ্গত কারণেই আমাকে বিশ্বাস করে ওরা। কোথায় যাব, কার বাড়ি ইত্যাদি জিগ্যেস করে শেষে আমাকে ছেড়ে দেয়।
‘শোনেন, আমাগো কী মনে করেন, জানি না, তয় জীবনে কারো গায়ে ফুলের টোক্কাও দেই নাই। হেল্লেইগা কিছু করলাম না। বাঁইচ্চা গেলেন। আইজকা যান, ভবিষ্যতে এইরম আর কৈরেন না।’
তো সেই নির্ঘুম রাতে এদিক-ওদিক অনেক ভেবে, পরদিন ভোরেই মার কাছ থেকে, ‘বাসায় কয়েকদিন থাকা রিস্ক হৈবো, মজিবর ভাইও জানে না, কাউরে কিছু কইবা না, কইবা সকালে আইতাছি কৈয়া বারাইছে, এহনও আহে নাই, কৈ গ্যাছে কিছু তো কইয়া যায় নাই,’ বলে হাজার পাঁচেক টাকা নিয়ে বের হয়ে যায়।
বিয়েনপি বস্তি থেকে ৫ গ্রাম হেরোইন কিনে শ্যামলী হানিফ কাউন্টারে টিকেট কেটে সোজা যশোর।
ফেরে ৫ দিন পর। স্ট্যান্ডে নেমেই সাইফুলের সাথে দেখা, ওর কাছেই সব শোনে। গ্র“পের ড্রেস পরা ২৫/৩০ জনের বিশাল ১ গ্র“প মজিবর ভাইয়ের নেতৃত্বে গত পরশু রাতে নির্ধারিত সময়ে মতির বাড়ির সামনে মতিকে মুখের ভেতর রিভলবারের নল ঢুকিয়ে গুলি করে মেরে ফেলেছে। শুনে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে রফিক। চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে শুধু চায়ে চুমুক দিয়ে যায়। চারিদিকের হট্টগোল ওকে স্পর্শ করে না। কয়েক মিনিট কেটে গেল হঠাৎ অদ্ভুত জান্তব, নির্দয় ও সব-বুঝে-ফেলা একটা হাসি ফোটে তার মুখে। সাইফুলকে বলে, ‘জানছ, আমারো না হিটে থাকার কথা আছিলো, তুই তো আমারে চিনছ, জীবনে কেউর গায়ে হাত তুলি নাই। যদিও কইছিল কাউরে মারতে ঐবো না, খালি মাল ক্যারি করতে ঐবো। আর দরকার ঐলে ফাঁকা গুলি করতে ঐবো, তবু আমি হালায় ডরে ৩ দিন আগেই ভাগছি,’ বলতে বলতে রফিকের মনে পড়ে পরবর্তী অপারেশনের টার্গেট ও তারিখ। কিছু না ভেবেই, হাসিটা কন্টিনিউ করে সে বলে, ‘আমি ঠিক করছি মজিবর বাইয়ের কাছে যারা মাফ চায়া কমু, ‘বস, ব্যবসা করতে পারুম, একলা সবকিছু ডিল করতে পারুম, কিন্তু মারামারি করতে পারুম না।’
কথা শেষ হলে আবারও হাসে মতির এক সময়ে বলা একটা দাম্ভিক উক্তির কথা মনে করে, সাইফুলের জীবন্মৃত চোখ রফিকের দৃষ্টি না এড়ালেও, সে হাসতে হাসতে মতির সেই কাহিনীটা শোনাতে থাকে, যেন এই মুহূর্তে ও পরিস্থিতিতে মতির ঐ হাস্যকর ছ্যাবলামিমূলক গল্পটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যেন না বললেই না। কিন্তু গল্প শেষ হবার আগেই সাইফুল নিজেকে আর চেপে রাখতে না পেরে বলে ফেলে, ‘দোস, মজিবর ভাইয়ের লগে আমারে নিয়া আলাপ করছছ? হ্যায় কী কয়?’
‘চিন্তা করিস না। আলাপ করছি। মজিবর বাই মাপ করতে রাজি ঐছে। তয় আমি যে কইছিলাম,’ কণ্ঠে গর্ব এনে যোগ করে রফিক, ‘ডিপুর লগ ছাড়তে অইব আর ১ বছর তুই কোনো ব্যবসা করতে পারবি না,’ ২/১ বার সাইফুলের চোখের দিকে তাকালেও অধিকাংশ সময় রাস্তা দেখার ভান করে বলে সে। রফিক এসব কথা বলার সময় মনে মনে ভাবছিল কীভাবে মজিবর ভাইয়ের কাছে প্রস্তাবটা তুলবে, কী যুক্তি দিয়ে, কী নিশ্চয়তা দিয়ে ইত্যাদি।
বেশ কিছুক্ষণ দুইজনে নিশ্চুপ বসে থাকে। শেষে সাইফুল রফিকের বর্ণিত শর্ত শোনার সাথে সাথে, ‘আমি রাজি, দোস, আমি রাজি, আমারে ফেরত নিলে যে কোনো শর্তে আমি রাজি,’ বলার পর থেকে ২ জনের কেউই কী বলা যায় ভেবে পাচ্ছিল না বলে, ধীরে ধীরে ওদের মাঝে একটা অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে আসে। অথচ ২ জনেই প্রাণপণে বলতে চাইছিল কথা। আসল কথা, মিথ্যা কথা, সন্দেহের কথা, আজে বাজে হাস্যকর কথা, যে কোনো কিছু, শুধু কথা হলেই হয়, কথা শুধু, কথা, কথা, কথা। অথচ ২ জনের কেউই বলতে পারল না তা। অনেকক্ষণ পর নীরবতা ভাঙে রফিক। হঠাৎ সাইফুলের চোখে চেয়ে মুখে একটা আগের হাসির সম্পূর্ণ বিপরীত, অথচ ভয়ানক হাসি নিয়ে বলতে থাকে, ‘দোস, আমি না ধরা খায়া গেছি।’ গত ১২/১৩ দিনের হেরোইন বিষয়ক ঘটনা সবিস্তারে, সাইফুলের বিস্ফারিত চোখের সামনে বলার পর যোগ করে, ‘দোস, কেউ কিন্তু জানে না। বাসায়ও না। মজিবর বাইও না। তুই কিন্তু কেউরে কইছ না।’
‘আমি না অয় না-ই কইলাম, কিন্তু তুই এইটা কী করতাছস, তুই তো বাঁচবি না, মতি তো অর কাম ঠিকই কৈরা গেল,’ এই প্রথম মতির নামের শেষে ভাই বলে না সাইফুল, ‘দোস, এইটা করিছ না। আমারে এই শাস্তি দিছ না। তাইলে সব দোষের দোষী অমু আমি। এত বড় পাপ করি নাই যে এই শাস্তি দিবি।’
এটুকু বলে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে সাইফুল। তারপর হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায় একটা কথা বলে, ‘আর দেখ, তাইলে মজিবর বাইও আমারে ছাড়বো না। হেরে তুই চিনছ না?’
কিন্তু সাইফুলের উদ্বেগকে পাত্তা না দিয়ে আবার খোলসে ঢুকে যেতে যেতে রফিক বলে, ‘না দোস, চিন্তা করিস না। ২/১ দিন যে মাঝখানে না খাইয়া থাকছি অত কষ্ট তো অয় নাই। আর ডাইল খাইয়া লইলে বেড়াও তেমন থাকে না। আর খামু না, আসার সময় যশোর থিকা একটু নিয়া আইছি, আজকে রাইতে অইটুক খায়া। তুই চিন্তা করিস না, আমি মজিবর বাইরে লগে আবার কতা কমু। হে তোরে নিয়া যাইতে কইলেই আমি তোর লগে যোগাযোগ করুম। তুই এই কয়দিন চুপচাপ বাসায় থাক। টার্মিনালে কারো লগে যোগাযোগ রাহিছ না। একদম চুপচাপ বাসায় পইড়া থাক।’ কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ায় রফিক। গুদারা ঘাট পর্যন্ত বন্ধুকে পৌঁছে দিয়ে বাসায় ফিরে যায় সাইফুল।
আসলে রফিক যেমন কখনো ভাবে নাই সাইফুল তার সাথে চোখ পাল্টি দিতে পারে, বিপরীত ভাবে সাইফুলও কোনোদিন ভাবে নাই রফিক তার সাথে বেঈমানি করতে পারে। অনেক অনুরোধ, কাকুতি-মিনতির পরও রফিক যখন মজিবর ভাইয়ের মন গলাতে ব্যর্থ হয়, তখন বাধ্য হয়েই সিদ্ধান্তটা নিতেই হয় রফিককে।
মজিবর ভাইয়ের ড্রইংরুমে বসে অপেক্ষা করছিল সে। মজিবর ভাই ঢুকলে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দেয়।
‘হারামজাদা, তুই আমার সাথে ইর্য়াকি করছ?’ সালামের জবাবে এ প্রশ্ন করে কিছুক্ষণ তীব্র চোখে চেয়ে থাকে মজিবর ভাই। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে রফিক। আরও কিছুক্ষণ গায়ের ঝাল ঝেড়ে মজিবর ভাই শেষে বলে, ‘শোন তুই গ্র“পের শেল্টারে ব্যবসা করবি, আর গ্র“পের দরকারের সময় থাকবি না, এইটা চলব না। তোর কাজ আমারে করতে হৈলো ক্যান? মতিরে মারা তো তোর জন্যই। তাও তো তোরে হিটার গ্র“পে রাখি নাই, তারপরও ভাগলি? তুই যে বিপদের সময় ভাগবি না, গেরান্টি কী?’
‘কিন্তু, মজিবর বাই, একটা জিনিস দেহেন মামলায় তো আমার নাম দিবই, কেস পাটনার ঐতে তো আমার আপত্তি নাই। তাইলে আমি গ্র“পের লগে থাকলাম না কেমনে?’ স্বভাবসুলভ বিনয়ের সাথে বলে রফিক। ‘শোন্,’ মজিবর ভাইয়ের কণ্ঠ চড়ে যায়, ‘আমার লগে প্যাচ দিয়া কথা কবি না,’ বলে থেমে কপালে হাত দিয়ে ২/১ সেকেন্ড চেপে ধরে কিছু একটা ভেবে হাত নামাতে নামাতে বলে, ‘পরশুর হিটে তুই সাইফুলের ডানহাত কাটবি, অরে ২ হাত ২ পা কাইটা ছাইড়া দিমু। জানে মারুম না। এখন বাসায় যা।’ কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ায় মজিবর ভাই।
সোফায় বসে রফিক আসার পথে কীভাবে সাইফুলকে ফেরত নেয়ার জন্য মজিবর ভাইকে রাজি করাবে বলে যেসব কথা ভেবে রেখেছিল তা মনে করে। রফিক বুঝতে পারছিল এটাই শেষ মুহূর্ত সাইফুলকে বাঁচানোর, টের পাছিল মুহূর্তটা ওর করপুট থেকে পিছলে পড়ে যাচ্ছে অতীতের গর্ভে। তবু কিছুই না বলে সে উঠে দাঁড়িয়ে মজিবর ভাইকে সালাম দিয়ে বেরিয়ে যায়, কয়েকদিনের দোলচলের পর সিদ্ধান্তটা এই মাত্র, একটু আগে সোফা থেকে উঠতে উঠতে নিতে পেরেছে বলে, থমথমে মুখে।
শুধু মা-ভাবি বাসায় ছিল সাইফুলের। ২৭ জনের দল গিয়েছিল ওরা। সবার পরনে কালো প্যান্ট, কালো শার্ট, কালো জুতা, মাথায় কালো ক্যাপ আর নাক পর্যন্ত রুমালে ঢাকা। শুধু চোখ খোলা। থানায় বলা ছিল, টাকাও অগ্রিম দেয়া ছিল, কাজেই সে দিক থেকে কোনো ঝামেলা ছিল না। আসলে কোনো দিক থেকেই কোনো ঝামেলা হয় নাই। ভাবি একটু ঝামেলা করেছিল। একজন তাকে ধাক্কা মেরে মেঝেতে ফেলে দেয়, আর মা বিছানার কোনায় বসে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে ছিল শুধু, গলা দিয়ে চেষ্টা করেও শেষে শব্দ বের করতে পারছিল না বলে। কাগজের মত সাদা হয়ে যাওয়া ‘রফিক, তুই কই! মজিবর ভাই, আপনে কই! আমার একটা কথা শোনেন, আমার একটা কথা শোনেন!’ বলতে থাকা সাইফুলকে টেনে হিঁচড়ে ওদের একতলা বাড়ির উঠানে নিয়ে আসা হয়। পরিকল্পনা মত ৪ জন সাইফুলের ৪ হাত-পা চেপে ধরলে, বাবলা আজকের উপলক্ষ্যে কেনা চাইনিজ কুড়ালটা দিয়ে সাইফুলের বাম হাত কনুইয়ে কাছ থেকে ১ কোপে কেটে ফেলে। ২ কোপ লাগে পুরাপুরি বিচ্ছিন্ন করতে। বুকের উপর একজন হাঁটু দিয়ে চেপে ধরে মুখে রুমাল গুঁজে দিয়ে মুখ চেপে ধরে রেখেছিল বলে উল্লেখযোগ্য কোনো চিৎকার হয় না। তবে খিঁচুনিতে সারা শরীর কেঁপে উঠলে ছেলেটার হাত ফসকে যায় ১ বার — বাবলা ততক্ষণে রফিকের হাতে কুড়ালটা দিয়ে একপাশে সরে দাঁড়ালে এগিয়ে যায় রফিক — ‘দোস্, তুই!’ এত আড়ালের পরও দীর্ঘকালের বন্ধুকে ঠিকই চিনতে পারে সাইফুল। চিনে ফেলেছে বলে পরবর্তীতে বাড়তি কী কী ঝামেলা হতে পারে এসব তখন মাথায় নাই রফিকের, একটানে মুখের রুমাল খুলে ফেলে সে বলে, ‘নাচতে নাইমা ঘোমটা দিয়া লাভ কী?’
‘দোস, একটা তো নিছস, এইটা নিছ না,’ রিকয়েস্ট করে সাইফুল।
‘দোস তোর তো অন্তত হিসাব ঐবো, তোর লেইগা দাঁড়ি-পাল্লাও থাকবো। আমার যেন্ কোন পাল্লাও না থাকে।’ মজিবর সবে, ‘নাটক চো … ’ পর্যন্ত বলেছে, ততক্ষণে রফিক দুহাতে হাতল আঁকড়ে মাথার উপর কুড়াল তুলে, ‘দোস! মাফ কইরা দিছ্!’ বলতে বলতে জান্তব দীর্ঘ এক আর্তচিৎকারসহ কোপ মারে নির্ধারিত জায়গায়। চোখে সত্যি সত্যি রেডিমেড অনুতাপ তার। ব্যথা-বেদনা-বিস্ময়-অবিশ্বাস মাখা সাইফুলের লাথি খাওয়া নেড়ী কুকুরের ক্যেউ ক্যেউয়ের মত তীক্ষ্ণ গোঙানির সাথে রফিকের তখনও না থামা আর্তচিৎকার মিলে এক অশ্রুতপূর্ব যুগলবন্দি তৈরি হয়। ঝালরে নেমে যা কান্নায় একীভূত হয়।
আরও মিনিট দশেক, প্রসঙ্গ বদলে, গল্প করে বাসায় ফেরার জন্য উঠি আমি। রফিক যেখানে ছিল সেখানেই বসে থাকে স্থবির হয়ে, বরফ গলা হৃদয়ে।
ডিসেম্বর ২০০৭
‘এমন মুহূর্ত, সময় বা দিনও আসে মানুষের জীবনে!’ রফিকের কাহিনী শুনতে শুনতে ভাবছিলাম। এই সুন্দর পৃথিবীতে বড় জটিল, বিচিত্র আর কখনো কখনো বীভৎস মানুষের জীবন। একটা নদীর মত সাবলীল, গতিশীল, দীর্ঘমেয়াদী ও ধারাবাহিকভাবে সফল হতে থাকা পরিকল্পনার নিরাপত্তাসহ পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার আশ্বাসে ঘেরা দুই পাড়ের মাঝ দিয়ে বইতে থাকা নিরাপদ, নিশ্চিত জীবনের অন্তঃস্রোত মুহূর্তে নিমজ্জিত হয় অচিন্তনীয় পঙ্কিলতার মুক্তিহীন ক্লেদাক্ত আবর্তে। কোনো স্বর্গীয় মোহনায় পৌঁছানো তো দূরের কথা, তার চিন্তা করাও তখন বিরক্তি উদ্রেককারী ও হাস্যকরভাবে অর্থহীন; শুভ্রতার ফলদায়ক ভূমিকার অপরাজেয়, অন্তহীন, জীবনস্পর্শী আসল সত্যও তখন, একবারের জন্য হলেও মনে হয়, বা চিরকালের জন্য হয়ে যায়, কুৎসিত জঘন্য মিথ্যা, মনে হয়, চিরকালীন মানবাত্মার প্রতি বিধাতার তীব্র বিদ্রুপ, হৃদয়ের প্রতি জীবনের বীভৎস ঠাট্টা। রফিকের গল্প শুনতে শুনতে এসব ভাবনা ভাঙাচোরা কাচের টুকরার মত ঝলকে উঠছিল আমার মাথায়।
‘বাই, বাপে মরার আগ পর্যন্ত ঠিক আছিল, কোনো অসুবিধা আছিল না। বড় বইন আর মা আছিলো। আমি স্কুলে পড়তাম। বাপে কোচ চালাইত, ইনকাম খারাপ আছিল না। আউট ইনকামও আছিল। স্কুলে পড়তো বড় বইনও। আমার চে দুই কেলাস উপ্রে। আমি স্কুলে থাকতেই, কেলাস সিক্সে পড়ার সময়, বড় বইনের বিয়া অয়। তয় উডায়া দিছে আরও ২ বছর পর। বইনের মেট্রিকের পর। হেরপর আর পড়ে নাই, নিজেই। দুলাভাইও খারাপ আছিলো না। আমারে ছোট ভাইয়ের চেয়ে বেশি বালোবাসতো। মায় অনেক কড়া আছিল। ছোটবেলার তনই আমার সব আবদার আছিল বইনের কাছে, বাবারে অনেক ডরাইতাম, তয় বাপে কিন্তু তেমন কড়া আছিল না, আমাগো বাই-বইনরে কখনও কিছু কইত না, জীবনে আমাগো কারো গায়ে হাত তোলে নাই। তয় খুব রাগী আছিল তো, তাই কেমন জানি ডর করতাম, আমরা বাই-বইন দুইজনেই। মায় অনেক মারলেও আমাগো দুই ভাই বইনের গায়ে বাবা কিন্তু জীবনেও আত তোলে নাই। জীবনেও না। আবার মায় যেইদিন আমাগো মারতো, বাপে হেদিন মায়ের লগে রাগ কইরা বাত খাইতো না, আমরা দুইজন অনেকক্ষণ সাদাসাদি করলে হেরপর খাইতে রাজি অইত। বইনের বিয়া অইল অয় যহন কেলাস এইটে, তয় উডাইয়া দিছে আরও ২ বছর পর।’
ওর ছোটখাট ২/১টা পুনরাবৃত্তিতে বাধা দিচ্ছিলাম না ইচ্ছা করেই। চুপচাপ শুনে যাচ্ছিলাম। ১টা নির্মীয়মান সরকারী বিশাল ভবনের বাউন্ডারী টিনের গায়ে হেলান দিয়ে বসেছিলাম আমরা। বোঝাই যাচ্ছিল, কথায় পেয়ে বসেছে ছেলেটাকে। কাজেই আমার মূল কাজ শেষ। এখন শুধু মাঝে মাঝে ক্লেয়ারিফাই হওয়ার জন দুয়েকটা প্রশ্ন করা বা মাঝে মাঝে কোনো মন্তব্য করা; সান্ত্বনাসূচক, বিদ্রুপাত্মক, প্রশংসাবাচক বা তাচ্ছিল্যবোধক। গোধূলি শেষ হয়ে গেছে। আলোর চে অন্ধকার বেশি এখন। দূরে ক্ষেতের পাড়ে, পুকুরের পাড়ে শ্যামলী এক নম্বর রোডের উজ্জ্বল আকাশী অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংটার আসল রঙ এখন আর দৃশ্যমান না। এখন তা লোকাল রঙে ঝাপসা প্রায়। কাছেই ১০/১৫ গজ দূরের আড্ডাগুলার হট্টগোল আমাদের স্পর্শ করছে না আর। ইতস্তত ঘোরাফেরা করতে থাকা নেশাখোররাও দৃষ্টিসীমার মধ্যে থেকেও অদৃশ্য। আর কোনো বিষয় না তারা এখন।
যদিও আমাদের মত ওরাও সমাজছুট একটা সম্প্রদায়। আমাদের চারপাশেই থাকে, আমাদের নিয়েই। রাস্তাঘাটে চলতে ফিরতে আপনি ওদের দেখেন। এক ধরনের লোক দেখবেন রাস্তায়, কাঁধে চটের বা প্লাস্টিকের বস্তা, উস্কোখুস্কো, দীর্ঘ মাসাধিককাল গোসল না করার ফলে একহাত তফাত দিয়ে হেঁটে গেলেও শরীরের কটূ গন্ধ নাকে এসে লাগে, ময়লা ছেঁড়া জামা অথবা বোতামহীন শার্ট, রঙ পুরা পাল্টে যাওয়া এখানে-সেখানে ছেঁড়া টিশার্ট, বা বোতাম ছাড়া হয়তবা হাতের কনুইয়ের পর বাকিটুকু নাই এমন পাঞ্জাবী, ছেঁড়া কখনও বা বেসাইজ লুঙ্গি, কোমড়ের কাছে দড়ি বা ফিতা দিয়ে বানানো বেল্টালা এক পায়ে হাঁটু পর্যন্ত ফোল্ডিং করা তো আরেক পায়ের প্যান্টের ঝুল রাস্তা ঝাড় দিচ্ছে। ময়লা-কালো গায়ের রঙ, হলদে বা জবালাল ভেতরে বসে যাওয়া চোখ। ওদের বয়স ৮/৯ থেকে মোটামুটি ৬০/৭০ বছরের মধ্যে, অর্থাৎ প্রায় সব বয়সীরাই। অন্য যে কোনো সম্প্রদায়ে যেমন হয়। সে ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক বা আন্তর্জাতিক কোনো কোয়ালিশন, যেই হোক না কেন।
কখনও বস্তা কাঁধে সামনের দিকে অনেকখানি কূঁজা হয়ে হাঁটতে হাঁটতে আবাসিক মহল্লার গলিতে বা রাজপথে ওরা কী যেন কুড়ায়। কী আর! এই পচা গলা সমাজের বর্জ্য কুড়ায়। ছেঁড়া চানাচুরের প্যাকেট থেকে ময়লা রক্তমাখা প্যাড থেকে শুরু করে ছেঁড়া পেপারে রেখার ছবি পর্যন্ত—সব। অ্যালসেশিয়ানের নেতৃত্বাধীন সমাজের ভদ্র কুকুরদের মাঝে ওরা রাস্তার চামড়ায় ঘাঅলা এক ঠ্যাং খোঁড়া লেড়িকুত্তা। মশার রক্ত চুষে জীবন ধারণের মত মমতায় ওরা চুষে নেয় সমাজের যাবতীয় বর্জ্য, ডাস্টবিনে কুকুরের সাথে মারামারি করে আদায় করা অধিকারের বিনিময়ে। কখনও ট্রাফিক সিগন্যালে থাকে গাড়ির বন্ধ কাচের বা অধুনার সিএনজির খোলা অংশের পাশে হাত পেতে দাঁড়ায় এদের কেউ কেউ। ওদের চোখের আকূল আকুতিতে হয়ত একটা ভিক্ষুকও ওকে ভিক্ষা দেবে না, যদি ওর মূল সামাজিক পরিচয় জানে; অর্থাৎ সামাজিক পরিভাষায় যারা নেশাখোর।
পুরা নেশাখোর সম্প্রদায়ের সংখ্যাগুরু বৃহদাংশ ওরা, রাস্তার নেশাখোররা। অপর অংশ বাসা-বাড়িতে থাকা। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এদের মূল পরিচয় নেশাখোর হলেও পেশাগতভাবে এরা কেউ পকেটমার (রাস্তার নেশাখোরদের মধ্যে সবচেয়ে অভিজাত অংশ এরা, এদের পায়ে স্যান্ডেল বা জুতা থাকে, বা পোশাক অন্তত লোকাল পাবলিক বাসে ওঠার মত মোটামুটি চলনসই, কেননা এটুকু না থাকলে, বাসে উঠতে গেলে সমাজের শিক্ষিত অংশ পুরাপুরি সচেতনভাবে ওদের মৌলিক নাগরিক অধিকারে প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের মাধ্যমে, ‘ঐ কন্ডাকটার, হিরোঞ্চি উঠছে, দেখছ না?’ বলে সর্বসম্মতভাবে একত্রে চিৎকার করে ওঠে। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে ধমকে ওঠে, ‘নামাহ্! হারামজাদারে নামা তাড়াতাড়ি,’ বলে), বস্তা কাঁধে যারা ঘোরে তাদের কেউ কেউ ভাঙ্গারি দোকানের সাপ্লায়ার তো কেউ কেউ ছদ্মবেশি চোর (বাসা বাড়ি থেকে এরা পরিস্থিতে ভেদে শার্ট-প্যান্ট-শাড়ি-পেটিকোট থেকে গয়না-মোবাইল ফোন এমনকি টিভি পর্যন্ত সবকিছু চুরি করে)। এদের কেউ বাসে বা রাজপথের ফুটপাতে ঘড়ি-মোবাইল ফোন চুরি করে দৌড় দেয়, দৌড়ানোর ক্ষমতা কম বলে মাঝে মাঝে ধরাও খায়। হাড্ডি-মাংস এক হয়ে তখন রাস্তার পাশে পড়ে থাকে।
মেয়েদের কেউ কেউ বেশ্যা, তবে সবচেয়ে কম রেটের। ১৫/২০/২৫ টাকায় উচ্ছেদকৃত বিয়েনপি বস্তির বিস্তীর্ণ উঁচু নিচু খোলা প্রান্তরে এদের একবার ভোগ করা যায়। অথবা পার্কে কি যে কোনো অন্ধকার কোণে, খোলা আকাশের নিচে। কেউ রক্ত বেচে, এদের বলে ডোনার। সম্প্রদায়ের সবচেয়ে নিচু জাত হিসেবে গণ্য এই ডোনারদের চামড়া ক্রমশ ফ্যাকাশে-হলদে হয়ে যায়। রাস্তার নেশাখোরদের শরীরে কোথাও ঘা হলে, বিশেষ করে ডোনারদের, সহজে শুকায় না, মাসাধিককাল লেগে যায় তো কখনও চিরস্থায়ী হয়ে যায়; অর্থাৎ গ্যাংগ্রিন। হাঁটু বা কোমড়ের নিচ থেকে পা কেটে ফেলা। এদের শতকরা নব্বইভাগ সমাজের উচ্চ ও মধ্য বা নিম্ন মধ্য ও নিম্নবিত্ত বিভিন্ন সব শ্রেণী থেকে আসা হলেও, একসময় বাসা-বাড়িতেই থাকত। ড্রাগ নিতে নিতে নিতে নিতে একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ে এলে এরা ছাদের নিচ থেকে আপনা-আপনি চলে আসে খোলা আকাশের নিচে। টিভিতে বাৎসরিক শীতের রিপোর্টিংয়ে আমরা যাদের দেখি, কোনো রকম আবরণ ছাড়া কি বড়জোর একটা ছেঁড়া লুঙ্গি বা শাড়ি মুড়ি দিয়ে সদরঘাটে, রেল-বাস স্টেশনে, ফুটপাতে, পার্কে শুয়ে থাকতে দেখি তাদের একটা অংশ এই সম্প্রদায়ের।
একদল আছে শিশু নেশাখোর। বয়স ৭/৮ থেকে ১৩/১৪। খুব সম্ভবত এই সম্প্রদায়ের ২য় প্রজন্ম এরা, প্রজনন অর্থে, পুরা সম্প্রদায়ে এরাই একমাত্র খোলা আকাশের নিচে জন্ম নেয়া অংশ। ২০ বছরের বেশি এদের কেউই বাঁচে না। এই সম্প্রদায় শ্রেণীহীন (সম্ভবত একমাত্র, কেননা, বুর্জোয়া পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার মূল ভিত্তি সম্প্রদায়ের সঞ্চয়কে প্রত্যক্ষভাবে প্রত্যাখ্যান ও অস্বীকার করে এরা দিনের অর্জন দিনেই শেষ করার মাধ্যমে। সেটা ২৫ টাকা হলে ২৫ টাকাই, আবার ২/৩ হাজার হলেও সেটাও পুরাটাই এরা একদিনেই খরচ করে। এদের মধ্যেকার কোনো কোনো পকেটমারের মাসিক অর্জন লক্ষাধিক টাকা ও মাসিক সঞ্চয় একশ টাকাও না। ১২ বছরের কোনো চোর বা পকেটমার দিনে ২/৩ ঘণ্টা কাজ করে জোগাড় করে ২/৩ হাজার টাকা, তারপর ১৫ থেকে ১৬ ঘণ্টা টানা নেশা করে। কেউ রিকশা চালায়, এক দেড় ঘণ্টায় ৫০/১০০ টাকা জোগাড় হলেই একবার আড্ডায় এসে শেষ করে যায়। এভাবে সারা দিনে ৩/৪ থেকে ৬/৭ বার। রক্ত বেচতে বেচতে, না খেতে খেতে, দিনের পর দিন চা-রুটি-বিস্কুটের উপর নির্ভরশীল থেকে থেকে, শীর্ণ থেকে আরও, আরও শীর্ণ হতে হতে একসময় চিকন একটা রেখার মত হয়ে যায় এদের কেউ কেউ। অবশেষে আড্ডার বা রাস্তার পাশে পড়ে থেকে কেউ কেউ মরেও যায়। অন্যরা তখন কোথাও থেকে কোনো রকমে একটা সাদা চাদর (ময়লা হলেও ক্ষতি নাই) জোগাড় করে, মাথার কাছে আগরবাতি জ্বেলে, খাটিয়ায় শুইয়ে, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দাফনের জন্য সাহায্য চায় পথচারিদের কাছে। সচেতন ভদ্র নাগরিকদের কাছ থেকে ‘যে যত পারেন দিয়ে যান,’ বলে চাঁদা তোলে। মোটামুটি নেশা করার পয়সা জমা হলে রাস্তার পাশে মড়া শরীরটাকে একা ফেলে আড্ডায় চলে যায়।
ছোট সমতলে গজানো ঘাসের উপর বসে টিনের দেয়ালে হেলান দিয়ে আমরা গল্প করি নিজেদের নিয়ে। সবাইকে নিয়ে ভাবার সময় ফুরিয়ে গেছে।
‘বালো জামাই পাইয়া বাপে আতছাড়া করতে চায় নাই, তাই আগেই বিয়া দিয়া রাখছিল (হুঁহ, এতো বালো জামাই যে ৪ বছর কিছু বুঝিই নাই), বাবার মরার পর ২ বছর আমাগো সংসার খরচ পুরা চালাইছে, আমার পড়ার খরচসহ। তয় তহন আমার পড়ার মন উইঠা গেছে। ইসকুলে যাইতাম না, দুলাভাইর তন বেতন নিয়া বন্ধু-বান্ধবের লগে খর্চা করতাম। ডাইল তামুক খাইতাম। বান্দের পারেই তো আছিল আমাগো বাড়ি, বাগবাড়ির এক কোণায়, নদীর পাড় ঘেঁইষা।
তয় টার্মিনালে বাবারে সবাই চিনত দেইক্কা আমি চলতাম ছোডত্ তনই আমিনবাজারের পোলাপানগো লগে। আর আপনেরা তো জানেনই, আমিনবাজার কী জিনিস! না চাইলেও আতে আয়া পড়ব ফেন্সির বোতল, টু-টু-থ্রি-এইটের মত গরম জিনিস। কয়েকমাসের মইদ্যেই বাসায় জাইন্যা গেল ইশকুলের কতা। দুলাবাই রাগ তো করলই না, উল্টা বালো কৈরা আমারে অনেক বুজাইলো। কিন্তু আমি রাজি অইলাম না। মায়ে-বইনে কত কানলো, কত কইলো। আমার মাতায় তহন বাই খালি একটা চিন্তাই গোরতো, কতদিন আর মাইনষের টাকায় চলুম আমরা? দুলাবাইর টাকায় চলতে মার যে কেমন লাগতো হেইডা তো খালি আমিই জানতাম। আমার বাল্লাগতো না। আমার বইনডা আছিল ইকটু ভোদাই টাইপের, বোকামতন, অত প্যাচগোচ বোজতো না, তয় মনডা আছিল মাডির মত, সোজা, অয় অতকিছু বোজতো না, তয় আমি জানতাম মার কেমন লাগে, হেল্লেইগা আমি তহন থিকাই খালি চিনতা করতাম ক্যামনে, রোজগারের ধান্দা শুরু করা যায়, কেমনে রোজগার করুম নিজে, কবের তন করুম, এইসব।’
এসব ভাবনা চিন্তাই ১৩/১৪ বছরের রফিককে দখল করে ছিল। টাকা রোজগারের চিন্তা ছাড়া তখন আর কোনো চিন্তাই সে করতে পারত না, তাও যত সংক্ষিপ্ততম সময়ে, স্বল্প পরিশ্রমে। কাজেই একটা পথই খোলা ছিল, আর তা তো হাতের কাছেই। আর রফিকের বানানো কল্পিত প্রয়োজনের তীব্রতাজাত শর্তপূরণ করেই যা হয় আর কী। এমন পরিস্থিতি ও পরিবেশে। সুন্দরবনের সীমান্তবর্তী বাসিন্দারা যেমন বাওয়ালী বা কাঠুরে। সিরাপ তামুক তো আরও বছর দুয়েক আগেই শুরু হয়েছে। কাজেই, এই সময়েই রফিকদের বাড়ির বিপরীতে নদীর ওপারের মহল্লা বেগুনবাড়ির সাইফুল যখন বাল্যবন্ধু রফিককে ফেন্সিডেলের ব্যবসা করার প্রস্তাব দেয়—হৃদয়ে জাগ্রত মৌহূর্তিক দ্বিধা সত্ত্বেও আমিনবাজারের ছেলেদের কোনো বেগই পেতে হয় না—তা ফিরিয়ে দেয়ার কোনো কারণ তখন খুঁজে পায় না সে। সবাই তো করছে চারপাশে। যখনকার কথা হচ্ছে সে সময়ের স্মৃতি যাদের মগজে আছে তারা নিশ্চয়ই মানবেন।
এ সময়ই একদিন বেগুনবাড়ির সাইফুল রফিককে প্রস্তাব দেয় ফেন্সিডিলের ব্যবসা করার। তখন এর দাম বর্তমানের ১০ ভাগের ১ ভাগ। সব খরচের পরও লাভ শতকরা ২০০। দুই বন্ধু ৫-৫ মোট ১০ হাজার নিয়ে ব্যবসা শুরু করবে, ব্যবসা হবে পাইকারী। বেনাপোল থেকে মাল আসবে। ওদের শুধু আমিনবাজারে ডেলিভারি নিতে হবে। আর খুচরা বিক্রেতার তো অভাব নাই। আরিচা রোডের দু’পাশেই আমিনবাজারে, বিশেষ করে মিরপুর ব্রিজের পর থেকে, আনুমানিক আধা মাইল জুড়ে।
আশপাশের ৮/১০ টা গ্রামের কিশোর যুবকদের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ আর বয়স্ক বখাটেদের সবাই তখন কোনো না কোনোভাবে এই ব্যবসায় জড়িত। ৬ মাসের মাথায় নিজেদের খাওয়া ও অন্যান্য খরচের পরও ওদের মূলধন ৫০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। রফিকের বাসার লোকেরাও তখন জেনে গেছে। মা-বোন-দুলাভাই সবার অনুরোধ উপেক্ষা করে সে ব্যবসা চালিয়ে যেতে থাকে। পুলিশকে কিছু না দিয়েই, স্বাধীনভাবে। শুধু ইমিডিয়েট সিনিয়র ব্যাচের শাহীন ভাইকে এলাকার ভাল হর্তাকর্তা হিসেবে মৌখিকভাবে জানিয়ে এবং মাঝেমাঝে ২/৪/৫ হাজার টাকার খাম ধরিয়ে দিয়ে।
‘কী কমু বাই, না দেকলে বিশ্বাস করবেন না। সব্জির ট্রাকে কৈরা মাল আইতো, উপরে তরকারীর ঝাঁপি, নিচে ডাইলের বস্তা। কনডেস মিল্কের কার্টনের মত শক্ত বোর্ড কাগজের প্যাকেটে। ডজনের প্যাকেট সব। নামানোর আগেই মাল এডভান্স বিক্রি হৈয়া যাইত। অনেকে ৫০ হাজার ১ লাখ টাকা এডভান্স দিত, যাতে একবারে বেশি কৈরা আনতে পারি।
‘কিন্তু এসব তো আরও পরের কতা। পরথম যহন খাওয়া শিকছি, তহন আমরা অর্ধেক দামে পাইতাম। খাওয়ার মালের চেয়ে বেশি কৈরা কিনতাম, বাকিতে। বাকিগুলা খুচরা রেটে বেইচা দিতাম, খাওয়ার খর্চডা উইডা যাইত। ব্যবসা শুরুর আগে খাওয়ার খরচ চালানর লেইগ্যা ২/১ সময় খুচরা বেচছিলাম। আমার লগে লগে তহন ১০/১২ জন বন্দু-বান্দব থাকত। বছর না গোরতে পুঁজি এত ঐলো যে আমার ১৪ গুষ্টিও এত টাকা কুনুদিন দেহে নাই। ঈদে বইন-দুলাভাইরে দামি কাপড় দিতাম। মারেও দিতাম, তয় মায় ঐ কাপড় পরত না, হারামের টাকা কইতো, হোনতে খারাপ লাগতো, তয় সবাই জানে কতা তো সত্যি।’ একটু থেমে আবার, ‘এর মধ্যেই একদিন, ব্যবসা শুরু করার বছর দেড়েকের মাতায় দুলাভাই দিলো চোখ পাল্টি। আমি আইজও বুজি না হে এই কামডা কেন করল। কেমনে করল। বাপ মরার পর থিকা ৪ বছর দৈরা হেই তো আমাগো সব। মনে করেন, ফ্যামিলির কোনো ব্যাপারে হে যা কইবো ঐডাই ফাইনাল। চাইল-ডাইল, জামা কাপড়ের খরচ থিকা বাড়ি ভাড়ার খরচ পর্যন্ত সবই তো হে দিত। কাজেই হে যহন স্ট্যামালা সাদা কাগজে আমারে সই দিতে কৈলো, আমি জিগাইও নাই কেন। মাতায়ই আহে নাই।’
‘মাজে মাজে মনে লয়, আমার লেইগাই সব ঐলো। বাবায় মরার পরও সোনার সংসার আছিলো আমাগো মৈদ্যে, মার কান্নাকাটি ছাড়া। অহন হে কী করব? মনে পড়লে না কাইন্দা পারে? মনে লয় দুলাভাইডা আমার লেইগাই অমন ঐয়া গেলো। যহন বুজায়া-হুনায়াও আমারে বালো করতে পারলো না। ঐতে পারে, হেয় তহন বোজলো আর বেশিদিন একলগে থাকন কপালে নাই, ঐতে পারে, আমার আতে সম্পত্তি আইলে থাকবো না, কে জানে! কে জানে, ক্যান হে বদলায় গেলো?’
‘মায় কিছুটা বোজতে পারছিল, তয় শরমে জিগায় নাই, কিল্লেইগ্যা। বাবায় বছরের পর বছর দৈরা আড্ডি কালা কৈরা ৫ কাঠার উপরে ১৫/১৬ বছরে ২ তলা পর্যন্ত করছিল। বাড়িডা লেখাইয়া নিলো।’
‘আমার মায় আবার অন্যরকম। সম্পত্তির দিকে নজর কম। বাবারে কইত, এতগুলা টাকা হুদাহুদি বাড়িতে না লাগায়া পোলাপানের খাওন-দাওন লেহাপড়ার খরচ করন বালা।’
‘বাড়িত্তে বাইর কৈরা দেয় নাই আমগো। তয় কাগজপত্র সব নিজের নামে লেখাইয়া নিছে। তছিল অফিসে দলিলপত্রের কী কাম আছে কৈয়া আমার কাছে দেকতে চাইছে, আমি মার তন নিয়া দিছি। বাই, আপনেরে বাল্লাগছে আলাপ কৈরা, তাই এত কতা কইতাছি। বাই, হেই প্রথম মানুষ চিনলাম, তয় হ্যাতে কোনো লাভ অয় নাই। যদি ঐতো তাইলে আজকে এমন জায়গায় বৈয়া আপনের লগে এইসব কৈতে হৈতো না।’
‘সাইফুলের খবর কী? তোমার পার্টনার? লোকটা কেমন ছিল?’
কিছুক্ষণ ধরেই মনের মধ্যে জাগা ধারণাটি প্রশ্নের মাধ্যমে একটু ঘুরিয়ে ব্যক্ত করি। হাত দশেক দূরে, মাটি থেকে কিছু তুলতে যাবে, তোলার জন্য কিছুটা ঝুঁকেছেও, কিন্তু হঠাৎ গভীর গুরুত্বপূর্ণ কোনো চিন্তায় যেন ডুবে গেছে তাই এক ফালি চাঁদের মত বাঁকানো অবস্থায় স্থির হয়ে হয়ে থাকা শুধু একটা কামিজ পরা কালিঝুলিমাখা চেহারার ১টা (বয়স বোঝা যায় না, ২০ থেকে ৩৫ এর মধ্যে হতে পারে) মেয়েকে দেখতে দেখতে প্রশ্ন করি, ‘ফিক্সড হৈয়া গেছে’?
দৃষ্টি অন্যত্র নিবদ্ধ হলেও কান পাতা ছিল রফিকের জবাবের প্রত্যাশায়, মেয়েটার মতই আকৃতির ১ ফালি কুমড়ার মত চাঁদ আকাশে, বিকিরিত আলো কম বলেই হয়ত বেশিক্ষণ দেখতে ভাল্লাগে না। একটু দূরে নির্জনে বসে গল্প করলেও, সামান্য দূরে ইতস্তত ঘোরাফেরা করতে থাকা লোকগুলাকে তখনও দেখা যাচ্ছিল। নোংরা, ময়লা বেশবাস, শারীরিক ভঙ্গিতে প্রতিভাত অন্তর্গত হীনম্মন্যতা আর চোখ খোলা অথচ কিছুই না দেখা দৃষ্টি মনে করিয়ে দিচ্ছিল জোলার কয়লাখনির চরিত্রদের, পার্থক্য শুধু পুঁজির বদলে এরা নিজেদের ভুল আত্মবিশ্বাসজাত প্রবৃত্তির দাস। ধীরে ধীরে অন্ধকার নামছে চারপাশে। পকেট থেকে একটা স্টিক বের করে ধরাই। প্রশ্নের জবাবের আশায় রফিকের চোখের দিকে তাকাই। ‘হেইডাই তো কইতাছিলাম, শাহীন ভাই, অনেকদিন দৈরাই সাইফুলরে ফুসলাইতাছিল আমারে ছাড়ান দেওয়ার লেইগা। কিন্তু সাইফুল রাজি আছিল না, লেংটা কাল থিকা একলগে বড় অইছি, বাগবাড়ির পোলা ঐয়াও বন্ধুত্বের খাতিরে বেগুনবাড়ির পক্ষে বাগবাড়িতে হিটে গেছি, আমিনবাজার ব্রিজ থিকা তুরাগে একলগে লাফ দিয়া মজা করছি’—এটুকু বলে একটু থেমে যোগ করে, ‘সবই তো একলগে। কিন্তু বাই, কী কমু, আমার মনে বড় কষ্ট।’
এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে রফিকের ডান চোখ থেকে, হাতের তালু দিয়ে মোছে সে। আমি অর্ধেক টানা স্টিকটা ওর দিকে বাড়িয়ে দেই।
‘হেই সাইফুল কিনা চোখ পাল্টি দিলো। আমাগো নিয়ম আছিলো, যখন পুঁজি এক লাখ ছাড়ায়া গেছে, লাভের অর্ধেক দুইজনে সমান ভাগ কৈরা নিতাম, শতকরা ৩০ ভাগ পুঁজিতে যোগ ঐতো আর বাকি ২০ ভাগ খরচাপাতি। ব্যবসা বড় অওয়ার পর থিকা পুলিশরেও দিতে ঐতো। কিন্তু শাহীন ভাইয়ের খাম তহন আর দিতাম না। বাজারের দখল তখন শাহীন ভাইয়ের থিকা ছুইটা গেছে। হ্যারে তহন পাগলা কুত্তায়ও পোন্দায় না। হরিরামপুরের মজিবরগো লগে লাগছিল। বাইল্যাপাড়ার রেজাউলরা শাহীন ভাইয়ের ২ হাত কব্জির তন কাইট্টা দিছে। বাজারের দখল তহন আব্বাসগো আতে। ছোডবেলার বন্দু-বান্দব হিসেবে আব্বাস আমাগোত্তে কিছু নিত না। আমরা খাম সাদছিলাম, লয় নাই। তয় অর লগের পোলাপানের যার যহন বোতল দরকার ঐতো, দিতাম।’
‘আর দিতাম মজিবর বাইরে। টার্মিনালের ডিপু ছাড়া গাবতলি থিকা সাভার পর্যন্ত মজিবর তহন ১ নম্বরে। ডিপুর ক্ষমতা তো খালি টার্মিনালে, ব্রিজের ঐপারে, ব্রিজের এইপারে হের আত নাই। আরিচা রোডের সব গাড়ির, যাত্রীকোচ অউক আর গার্মেন্সের লরি অউক, তহন মজিবর ভাইরে খরচ দিতে ঐত। তো আমাগো শেল্টার দিতো মজিবর ভাই। কিন্তু সাইফুলে এইডা কী করলো? অর লেইগা আমি, হেমায়েতপুর থিকা ৮ জনের গ্রুপ অরে আইছে মারতে। আমার পুরান পরিচিত ডাবল মার্ডারের আসামী আব্বাসও আছিলো অগো লগে। একটানে জামার চাইর বুতাম ছিইড়া গেছে—অর লেইগা সিনা পাইতা দিয়া কইছি, যদি একদিনের লেইগাও বন্ধু মনে কইরা থাকছ তাইলে আমার কতা হোন, সাইফুলের গায়ে ফুলের টোক্কা দেওয়ার আগে আমার রক্ত ঝরবো। আব্বাস কয়—রফিক সর, তোর লগে কোনো কাইজ্জা না, কিন্তু অর হিসাব আলাদা, অরে ছাড়ন যাইবো না। বাইজান, আমি সরি নাই। অগো লগে কথা কওয়ার উসিলায় চার দোকানে বইয়া ১৬ টা ডাইল আনাইলাম এক পিচ্চিরে দিয়া, সাইফুলরে চোখের ইশারা করলাম। অয় চামে কাইটা পড়লো, আর আমি আব্বাসেরে বুজায়া হুনায়া আদর-টাদর কৈরা ফেরত পাডাইলাম।’
‘আসল ঘটনাটা কী ছিলো, বলো তো?’
‘অর একটা কালা বইন আছে, বিয়া হয় না। ইয়া মোটকা। ৩০ পার অয়া গেছে তাও বিয়া হয় না। আর আমাগো এলাকায়, মনে করেন, ৩০ পার হওয়া মাইয়ারা বাপ-মায়ের উপরে চাপ। সাইফুল এইডা মনে রাকলো না!’
‘মাল আসার কথা ছিল রাত ২.৩০ টায়। আমার বাসায় কাম আছিল দেইখা আমি স্পটে থাকি নাই। সাইফুলরে কইছি ম্যানেজ কইরা নিতে। এইরকম ২ জনেই কোনো একজনের কাম থাকলে একা সামলায়া নিছি। আমি জীবনেও কল্পনা করি নাই — সাইফুল এমন কাম করতে পারব। ৪ বছর যাবত আমাগো ব্যবসা। সবকিছু চলতো হিসাব মত, লাভ-লোকসান সব। কোনোদিন একপয়সা গড়মিল অয় নাই। হেরপর ২ দিন ধৈরা আমি সাইফুলরে বিচড়াই, সাইফুল আমারে এড়ায়া চলে। বাসায় গেলে হুনি, নাই। স্ট্যান্ডেও আহে না। ২/৩ দিন পর দেহা স্ট্যান্ডের লগের পাম্পের সামনেই।’
‘অয় আমারে কয়, পার্টি বোলে চোক পাল্টি দিছে। মাল পাডাইছে, তয় বোতলের মধ্যে গুড়ের শরবত বৈরা দিছে। টাকা ঠিকই বুইজা নিছে। অয় কয়, পার্টি যাওয়ার আগে অয় নাকি মাল টেস্ করে নাই। আমি যা বোজার তহনই বোজলাম। এইডা বোজন যায়, বাইজান আপনে বোজবেন, যায় না? আমি জিগাইলামও না ২ দিন ধৈরা অয় আমারে এড়ায়া চলে কেন? জিগাইলামও না, অয় আমার চোখের দিকে চায়া কতা কয় না কেন? আমরা যেই লাইনের লোক আমাগো চোখ দেইক্কা মানুষ চিনতে অয়। এই লাইনে বিশ্বাসই আসল কতা। কোন পার্টি সলিড, কোন পার্টি ভূয়া, আমরা চোক দেইখ্যা নগদ কইতে পারি। এইডা মায়ের পেডেরতে কেউ শিইক্যা আহে না। কাম করতে করতে এমনেই শিখা ঐয়া যায়। কইলাম না, আমগো লাইনের কাম ঐলো বিশ্বাসের উপর? ১০ মিনিটের আলাপে বুইজ্জা লইতে অয় পার্টি সলিড কিনা? ১০ মিনিটের মধ্যেই সিদ্ধান্ত লইতে অয়, পার্টিরে এডভান্স দেওন যাইবো কি না। সেইটা লাখ টাকাও ঐতে পারে। সবসময় এমন অয়, আমি তা কইতাছি না, তয় মাজে মইদ্যে এমন পরিস্থিতিতেও পড়তে অয়। কাজেই অর চোক দেইখ্যাই আমি যা বোজার বোজলাম, কিন্তু বিশ্বাস করলাম না। করতে পারলাম না। ক্যামনে করে কন? ক্যামনে করুম কন?’
যেন সত্যি সত্যি জবাব চায়, যেন সত্যি সত্যিই ও বিশ্বাস করে, আমার কাছে প্রশ্নের জবাব আছে এমন ব্যাকুল চোখে চেয়ে থাকে রফিক আমার দিকে। যেন আমার জবাবের সিওর সাকসেস মলম ওর আত্মার ক্ষতকে সারিয়ে বদলে দেবে নির্মল কোনো ভোরের রঙে। অনেকক্ষণ চেয়ে থাকে রফিক, আমার চোখে চোখ রেখে। কোনো অস্বস্তি বোধ না করলেও কিছু না বলে আমিও চুপ করে থাকি। ওকে ধাতস্থ হওয়ার সময় দেয়া আর কাহিনীর বাকিটুকু শোনা এই ২ জন্যই।
‘আমি কিছুই করলাম না অরে। আমাগো দুইজনেরই জমাইন্যা টাকা তখন ২/৩ লাখের উপরে। আর ঐ চালানে আমাগো দুইজনেরই ইনভেস্ট আছিল ৬০ হাজার কৈরা। আমি যশোর যায়া পার্টির লগে নিজে দেহা করলাম। অরা কইলো, অরা সাইফুলরে মাল ডেলিবারি দিছে। আর মালে কোনো ভেজাল আছিল না। অরা আমারে চ্যালেঞ্জ দিয়া কৈলো, আমি যদি ১০ বোতল মালও ইনটেক আইনা দেহাইতে পারি তাইলে অরা আমারে পুরা টাকা ফেরত দিবো। অরা জানতো ছিপি লাগানোর মেশিন, লেবেল তৈরির মেশিন এইসব আমাগো নাই। আমরা যে নতুন কৈরা শরবত বানায়া, বোতলে ভৈরা, লেবেল মাইরা, অগোরে নিয়া দেহাইতে পারমু না, এইডা অরা ভালই জানতো। মাঝখান দিয়া অরা আমার উপর চেতলো, আমি কেমনে এই কতা কইলাম? ৩ বছর দৈরা সম্পর্ক। আমি কেমনে সাইফুলের কতায় অগোরে চার্জ করলাম? আমি যা বোজার বোজলাম, চিন্তা কৈরা দেকলাম, ঠিকইতো কইছে।’
‘আমিনবাজার ফিইরা আমি সাইফুলরে কইলাম, দেক, পুরানা বন্ধুর খাতিরে আমি কোনো ঝামেলায় যাইতে চাই না। পার্টি আমারে কী কইছে কইলাম। তয় কথা শেষ করতে না দিয়া অয় পাট নেওয়া শুরু করলো। ‘তুই আমারে বিশ্বাস না কৈরা অগো কতা বিশ্বাস করলি! তুই আমারে না কৈয়া কেমনে গেলি একলা?’ — এইসব আর কি। আমি হাসলাম। পরে কইলাম চালানের থিকা ১০ টা বোতল দে। পার্টি চ্যালেঞ্জ দিছে ১০ বোতলও ইনটেক মাল যদি আমরা দেহাইতে পারি তাইলে অরা পুরা টাকা ফেরত দিবো। হুনেন, বাই, অর চেহারা যা অইলো। কতক্ষণ তো মোক কালা কৈরা কতাই কৈতে পারলো না। এট্টু পরে কৈলো, ‘মাল তো সব ভাইঙ্গা তুরাগে হালাইয়া দিছি। এত বড় চালান কয়দিন গোডাউনে রাহার রিক্স নিমু?’
‘দেখ, আমি কোন ঝামেলা চাইনা। আইজ থিকা পাটনারে ব্যবসা শেষ। তয় আমি আমার ইনভেস্টের টাকা ফেরত চাই। আমার টাকা ফেরত পাইলে আমি আর কোনো ঝামেলা করুম না।’ অয়, বহুত হাউকাউ করলো। কান্দাকান্দির ঢং করলো। আমি অরে অবিশ্বাস করলাম? কেমনে করলাম? এইসব।’
‘আমার তহন, বাই, মন ভাইঙ্গা গেছে। অর চেহারা দেকতেও রুচি অয় না। আমি চুপচাপ কতক্ষণ অর ঢং দেইক্যা কইলাম, ওটতে ওটতে — দেখ, ২ দিন সময় দিলাম। পরশু সন্ধ্যায় তুই স্ট্যান্ডে টাকা নিয়া হাজির থাকবি। অয় পিছন থিকা কৈলো — আমি তহন আডা শুরু করছি — দেখ, বেশি বাড়াবাড়ি করিছ না। আমার লগে ঝামেলা করিছ না। আমারে তুই চিনছ না …। যাইতে যাইতে এটুকই কানে ডোকলো, বাকি কতা হুনার লেইগা দাড়াইলামও না। ঠিকইতো কৈছে, আমার হাসি পাইলো, সত্যিই তো অরে চিনি না। মানি, এতদিন চিনি নাই আর কি। স্ট্যান্ড থিকা বাড়ি ফিইর্যা সোজা মজিবরের বাসায় গিয়া হাজির হয়া সব খুইলা কইলাম। মজিবর ভাই সব হুইনা কৈলো, সাইফুলরে কালকের মইদ্যে আমার লগে দেহা করতে কইছ। তুইও লগে আহিছ। আমি সাইফুলরে বাসায় না পায়া ভাবিরে কৈয়া আইলাম, কালকে বিকাল পাঁচটায় মজিবর ভাই অরে দেহা করতে কইছে। কী জানি জরুরি দরকার। আমার সাথে যাইতে অইব এইডা কইলাম না, কেননা অয় যদি তাইলে না যায়? কিন্তু সাইফুল ভুল করলো,’ বলে একটু থেমে যোগ করে, ‘অয় আইলো না।’
‘সাইফুল শাহীন ভাইয়ের পরামর্শে, আমি পরে জানছি, মতিগো লগে জোট বানছে। আমি স্ট্যান্ডে অনেকক্ষণ অপেক্ষা কৈরা শেষে মজিবর বাইয়ের বাসায় গেলাম গা। মজিবর বাই আমারে কৈলো বাড়িত যায়া চুপচাপ বৈয়া থাকতে। হ্যায় নিজে ব্যাপারডা দেকবো। আমি বাসার দিকে রওনা দিলাম। স্ট্যান্ডে নাইমা ললিত মোহন দাস রোড গুদারা ঘাটে আইলাম। আমাগো বাড়ি, বাই, বাগবাড়িতে এট্টু ভিতরের দিকে পড়লেও নদীর পাড়েই। আমি সব সময় নৌকা দিয়া বাড়ি ফিরি। এইডা সবাই জানে। মাঝনদীতে মতিরা নৌকা ঠেকা দিলো, অরা মোট সাতজন আছিলো। অরা আমারে মারতে চাইছিলো। সাইফুলও আইছিলো। আমারে অরা জোর কৈরা অগো নৌকায় উঠায়া হিজলা পার হৈয়া আরও ২/৩ মাইল ভিতরের দিকে নিয়া গেলো। এর মধ্যে সাইফুল একবারও আমার চোখের দিকে তাকাইতাছিলো না। একবার খালি চোখাচোখি হৈলে আমি কইলাম, তুই এমন করবি আমার কল্পনায়ও আহে নাই। অয় চোক সরায়া নিয়া কৈলো, আমি জানি। কিন্তু তুই আমার নামে মজিবর বাইর কাছে লাগাইলি ক্যা? তুই আমারে অবিশ্বাস করলি ক্যা? আমি কিছু না কৈয়া হুঁহ্ কৈয়া চুপচাপ বৈয়া থাকলাম বাকি পথ। অর দিকে আর তাকাইলামও না।’
“মাইল তিনেক ভিতরে নেওয়ার পর মতি নৌকা থামাইতে কৈলো। আশপাশে আর কোনো নৌকা নাই। একপাড়ে ধানক্ষেত, আরেক পাড়ে বটগাছালা একটা বিরাট মাঠ। আমার ৪ হাত-পা ৪ জন চাইপা ধৈরা জোর কৈরা হোয়াইল, মতি আমার বুকে হাঁটুর চাপ দিয়া সাইফুলের দিকে ক্ষুর বাড়াইয়া দিয়া ডাক দিলো ‘আয়’। সাইফুল কিন্তু নৌকা থামানের পর ধ্যান্দা মাইরা একটা জায়গায়ই চুপচাপ বৈয়া রৈছিলো, নৌকায় রাখা অর নিজের পায়ের দিকে তাকায়া। ঐখান থিকা উইঠা আইসা মতির হাত থিকা ক্ষুর নিয়া কৈলো, ‘মতি ভাই, একটা রিকয়েস্ট, জানে মাইরেন না। আমারে লৈয়াই তো এতকিছু, আমি হাতজোড় কৈরা অনুরোধ, জানে মাইরেন না। অরে না মাইরা ছাইড়া দেন।”
তোর কি মাথা খারাপ হৈছেরে? অহন অরে ছাড়লে মজিবর বাই আমগোরে ছাড়বো?
তাইলে অন্তত অরে সেন্টারে আটকায়া রাখেন।
‘হালার তার ছিড়া গেছে,’ অন্যদের দিকে ফিরে বলে মতি, তারপর আবার সাইফুলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, ‘সেন্টারে কয়দিন আটকায়া রাখমু? হেরপর কী অইবো?’
“বলতে বলতে মতি ডান পাশেরটারে, নাম জানি না, ঈশারা করলো। ঐ পোলায় পকেটত্যে ক্ষুর বাইর করতাছে তহন, এমন সময় অন্ধকারে বইসা থাকা সাইফুল কৈয়া ওডে , ‘মতি ভাই!’।”
“ওর গলা শুইনা সবার পাশাপাশি আমিও চমকায়া উডি। আমি আসলে সাইফুলের হঠাৎ চেঞ্জে টাসকি খায়া গেছি। প্রথমে মনে হৈছিলো নাটক করতাছে। পরে যহন ‘মতি ভাই’ কৈয়া ডাক দিলো তহনই আমি বুঝলাম, নাটক না। জানের আশা ততক্ষণে ছাইড়াই দিছিলাম। এহন ইট্টু জাগলো। সবার চক্ষু তহন সাইফুলের দিকে। মতি আমার বুকের তন হাঁটু উডায়া দাঁড়ায়া গেছে। সাইফুল একহাতে ক্ষুর আরেক হাতে আমারে ছুইয়া কয়, ‘অরে মারনের আগে আমারে মারতে ঐবো,’ শান্ত গলায় এই কথা কৈয়াই দ্রুত জোড়াহাতে মিনতি কৈরা কৈলো, ‘মতি ভাই, প্লিজ, বোজনের চেষ্টা করেন, ছোটবেলা থেইকা একলগে বড় হৈছি। এহন একটা ভুল বুঝাবুঝির কারণে জানে মাইরা ফালামু? এইটা বেইনসাফি হৈবো, মতি ভাই। আমারে দিয়া এইটা করায়েন না। অর গলায় ক্ষুর চালানের আগে আমি আমার গলায় চালামু।’ নিজের গলায় ক্ষুর ঠেকায়া কয় সাইফুল। আবার দম নিয়াই কয়, ‘এরচে আমি একটা বিকল্প প্রস্তাব … ’
তাইলে মিটিংয়ে রাজি হৈছিলি ক্যা? সাইফুলের কথা শেষ করতে না দিয়ে প্রশ্ন করে মতি।
ভুল করছিলাম, মতি ভাই, ভুল করছিলাম। খোদার কসম তহন বুজি নাই। আমি হাতজোড় কৈরা সেইজন্য মাপ চাই।
তোর বিকল্প প্রস্তাবডা কী? প্রশ্ন করে মতি।
‘অরে সেন্টারে নিয়া আটকায়া রাখেন। আমি ডিপু ভাইরে ম্যানেজ কৈরা, মজিবর ভাইয়ের লগে আপোসের ব্যবস্থা করুম। ট্যাকা ডেমারেজ দিতে হইলে আমি দিমু। আর সবকিছু ঠিকঠাক ম্যানেজ হৈলে এরপরেও আমি আপনের লগেই থাকুম।’
তোর তো যেই অবস্থা দেকতাছি, তুই অর লগেই ভাগবি, অরে সেন্টারে রাখলে।
আচ্ছা যান, আমি সেন্টারে যামু না। পুরা ঘটনা মিটমাট না হওয়া পর্যন্ত রফিক আপনের দায়িত্বে থাকব। আর এই পুরা সময়ের মধ্যে একবারও আমি সেন্টারে যামু না।
কতা ঠিক থাকবো?
থাকবো, কসম থাকবো।
দেহিছ আবার?
দেহুম। আমি কথা দিলাম, দেহুম।
মরতে মরতেও এভাবেই বেঁচে যায় রফিক, অবশ্য, যদি ওর বর্তমান জীবনযাপন মাথায় রেখে, এটাকে বেঁচে যাওয়া বলা যায়। ৩ মাস ১৯ দিন মোট ওরা রফিককে একটি ২ চালা খালি ঘরের ১টি রুমে আটকে রাখে। মতিদের ব্যাচটা ছিল হিরোঞ্চিদের, ১২/১৩ জনের একটা বড় গ্রুপ, যারা এই সেন্টারকে ব্যবহার করত হিরোইন খাওয়ার জায়গা হিসেবে। ৩ মাস ১৯ দিন ধরে ওরা রফিককে জোর করে হেরোইন খাওয়ায়। প্রথম দিকে খেতে না চাইলে ওরা মারধোর করত। সপ্তাহ ২/১ এর মধ্যেই রফিক প্রতিবাদ করা বন্ধ করে দেয়। তৈরি হতে থাকে নির্ভরশীলতা, শারীরিক ও মানসিক। ওরা শুধু ওকে গালানোর টানটা দিত। প্রথমদিকে ২/৩ টা ও শেষের দিকে ৮/১০ টা মাল গালাত ওকে দিয়ে।
এদিকে সাইফুল আবার ব্যস্ত হয়ে উঠেছে, এগুলা রফিক পরে জানতে পারে, মাসখানেক যেতে না যেতেই রফিকের সাথে দেখা করার জন্য। সে মতিদের ওপর চাপ দিতে থাকে রফিকের সাথে সামনা-সামনি দেখা করার জন্য। মতি যতই না করে, সাইফুলের সন্দেহ ততই বাড়ে। রফিককে সরায়া ফেলছে সন্দেহের কথা সে মতিকে জানায়ও। ‘তরা অরে মাইরা ফেলছস, নাইলে দেহা করতে সমস্যা কী? ডিপু ভাই তো কইছে ৫ লাখ টেকা ক্যাশ লাগবো মজিবর ভাইরে ম্যানেজ করতে। আমি তো ট্যাকা যোগাইতাছি। সাপ্তাহ খানেক তো লাগবো পুরাটা যোগাইতে, দেখতে দিতে অসুবিধা কী?’
কথা কিন্তু সেইরকম আছিলো না।
আরে ভাই, কতবার কমু, মজিবর ভাই আমারে বার বার কৈছে, নিজের চোখে একবার রফিকের অবস্থা দেইখা আইতে, নাইলে হ্যায় কোনো ডিলে যাইবো না। সাফ কথা হ্যার।
কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে চিন্তা করার পর মতি সিদ্ধান্ত জানায়, ‘ঠিকাছে, দেহা করতে পারবি, তয় কথা কৈতে পারবি না। তুই সেন্টারে আইবি, রফিকের রুম খুইলা আমাগো সামনে রফিকরে দেখবি, রফিকও তোরে দেকবো, কিন্তু কেউ কোনো কতা কবি না। ডিপু বাইর পারমিশন পাইলে আমি রফিকরে ছাইড়া দিমু।’
এদিকে রফিককে মতি হুমকি দিল, যদি সাইফুলের সামনে কোনো কথা বলার চেষ্টা করে বা কিছু জানায় তবে সাইফুল যাওয়ার পর রফিককে তারা শেষ করে ফেলবে। কথামত নির্দিষ্ট দিনে সাইফুল সেন্টারে আসে। তালা খুলে ওকে রফিকের রুমে ঢোকানো হয়। দরজায় ১ জন ও রুমের ভেতরে ২ জন পুরা সাক্ষাতের সময় দাঁড়িয়ে থাকে। ৩০ দিন পর ২ বন্ধুর দেখা। রফিক ঝর ঝর করে কাঁদে। সাইফুলও একসময় শর্তভঙ্গ করে বলে ওঠে, ‘দোস্, কেমন আছোস্?’ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা সাইফুলের কাঁধে হাত দিয়ে থামানোর চেষ্টা করতে গিয়েও দরজায় দাঁড়ানো মতির হাতের ইশারায় থেমে যায়।
‘ভালোই,’ বন্ধুর চোখে চোখ রেখে জবার দেয় রফিক, ‘বাইরের খবর কী?’
‘ভালো, সব খবর ভালো। চিন্তা করিছ না, সাপ্তাহ খানেকের মইদ্যে তুই বাড়ি যাইতে পারবি।’ অনেক কথাই বলতে চাচ্ছিল রফিক। কিন্তু দরজা থেকে মতি বলে ওঠে, ‘হৈছে, দেখলি তো, এহন আয়।’
সপ্তাহ খানেক বললেও এবং আরও মাস দেড়েক কেটে গেলেও মজিবর ভাই রাজি হচ্ছিল না বলে অনেক তদ্বিরের পরও সাইফুল কিছু করে উঠতে পারছিল না। মজিবর ভাইয়ের মত বদলে গেছে তখন। তার এখন এক কথা, ‘টাকা লাগবো না। খালি রফিকরে ফেরত দে।’ আর এতেই অন্য ইঙ্গিত পেয়ে ভড়কে গিয়েছিল সাইফুল। সে সম্ভবত মজিবর ভাইয়ের উদ্দেশ্য বুঝতে পারছিল। আর সাইফুলের নিশ্চয়তার পরও মজিবর ভাই সন্দেহ করছিল রফিকের বেঁচে থাকা নিয়ে। যদিও সে তা মুখে বলছিল না। শেষে ৩ মাস ১৯ দিনের মাথায় বিনা শর্তেই রফিককে ছেড়ে দেয় ওরা। সম্ভবত ইনডেমনিটির আশায়। সকালে বাড়ি ফিরে বিকালে রফিক মজিবর ভাইয়ের কাছে যেয়ে সব খুলে বলে। মনোযোগ দিয়ে মজিবর ভাই সব শুনে বিস্ময়ে বলে ওঠে, ‘কস কী? বেড়া হয়া গেছে?’
বেড়া-টেড়া বুজি না, তয় বিকালের আগে আগেই আত-পার আড্ডির মইদ্যে কুড় কড় করে, হামি ওঠে, চোখ দিয়া পানি পড়ে।
‘শোন, তুই ১ সপ্তা বাড়ি থিকা বাইর অবি না। বেড়া ওঠলে ডাইল-তামুক খাবি, সব ঠিক হয়া যাইব। মাত্র ৩ সাড়ে ৩ মাসের ব্যাপার তো, তেমন কষ্ট ঐবো না। তয় ঠিক ১ সপ্তা পর তুই আমার লগে দেহা করবি। ডরের কিছু নাই। নিজের মন ঠিক রাখতে পারলেই অয়। অনেক দেখছি আমি, কোনো ব্যাপার না। পরে সব বিষয়ে আলাপ করন যাইব, কারে কী করন যায়।’
বাইল্যাপাড়া থেকে আমিনবাজার স্ট্যান্ডে ফিরতে ফিরতে রাত ৮টা। আড্ডায় যেয়ে পৌঁছতেই বন্ধুরা, অর্থাৎ গ্র“পের পোলাপানরা সব হৈ-চৈ করে ওঠে, ‘শুভেচ্ছা, স্বাগতম!’ সাইফুলও ছিল, সে চায়ের হোটেলের চেয়ার ছেড়ে ওঠে। রফিকের হাত ধরে বলে, ‘দোস্! মাফ কইরা দে।’
সাইফুলের ক্ষমা প্রার্থনার ধরন এমনই। রফিক বহুদিন ধরেই এর সাথে পরিচিত। কোনো ছোটখাট বা বড় অপরাধেও, একত্রে ব্যবসা করতে গেলে যা হয়, এমনি করেই মাফ চায় সে, বরাবর। রফিকেরটা আবার অন্যরকম। কোনো দোষ করলে, চুপচাপ এসে ওর কোঁকড়া চুলের কালো চেহারা আরও কালো করে বসে থাকে। সাইফুল যখন চায়ের অর্ডার দিয়ে একটা ট্রেডমার্ক হাসি মুখে নিয়ে তাকায়, তখন কেবল রফিকের মুখে তার নিজস্ব হাসি ফোটে। পেছনের ব্যাপার নিয়ে কোনো কথা আর হয় না। যে সমস্যা তৈরি হয়েছে তার সমাধানের ব্যাপারে কথা বলতে শুরু করে তারা তখন। বরাবর এইই রীতি, তবে আজকের পরিস্থিতি অস্বস্তিকর ও ব্যতিক্রমী হওয়াতে পরিবেশ হালকা করার জন্য রফিক আন্তরিকভাবে বলে — আব্বাস, আবুল হোসেন ও গ্র“পের অন্য ছেলেদের সবার উদ্দেশ্য, সাইফুলের সাথে হাত মিলায়ে, ওর সাথে বুক মিলায়ে কোলাকুলি করে, ওর চোখে চোখ রেখে, ‘না দোস্, মাফ করার কিছু নাই, বন্দু-বান্দবগো মইদ্যে এমন অয়, আর মানুষ ভুল করে না? তুই তো দেরিতে ঐলেও তোর বুল বোজতে পারছিলি, নাইলে তো আমারে মতি, টোকা অরা ঐদিনই নৌকায় জবাই করতো। তুইই তো আমারে বাঁচাইলি। আর এই ৩ মাস তুই আমার লিগা কী করছ নাই, ক। তুই শাহিনের লগে মিইল্যা অর ফুসকানিতে যোগ দিলি, ডিপুগো লগে, মতিগো লগে, খালি এইডাই খারাপ লাগে। তয় তুই চিন্তা করিছ না, ডরাইছ না, মজিবর বাই খেইপা রৈছে তো! এইডা আমি সামলামু। তুই চিন্তা করিছ না। তয় দোস, সত্যি একটা কথা কই? যেই মতি তোর আপন ছোড ভায়ের চক্ষু উপড়ায়া নিছিলো, যেই মতি আমাগো গ্রুপের কাউরে গাবতলি টার্মিনালে পাইলেই ঠাট্টা-মস্করা-অপমান কইরা দৌড়ানি দেয়, যেই মতি মজিবর বাইয়ের লগে চোখ পাল্টি দিয়া ডিপুর লগে যোগ দিছে (অয় মনে করছিল, পলিটিকাল পাটির লগে যোগাযোগ রাখা এক কথা, আর ওয়ার্ড কমিশনারের শেল্টার অনেক কথা) তুই কিনা অগো লগে হাত মিলাইলি!’ বলতে বলতে আবেগী হয়ে ওঠে সে, ‘মতির হাতে তর বাইয়ের, আমার কথা নাইলে বাদই দিলাম, রক্ত লাইগা আছে — এইটা তুই ভুইলা গেলি? আর আমার কথাই বা বাদ যাইবো কেন? কী করি নাই তোর লেইগা। আড়াপাড়া থিকা যহন সেন্টুরা ৭/৮ জনের দল আইছিল তোরে হিট করতে, তুই সেন্টুর বইনেরে ফুসলায়া কুকাম করছিলি, এইটা জাইন্যাও আমি আউগাই নাই? সিনা পাইত্যা দেই নাই? আউগাইছি। আমি তরে কবে এক পয়সা ঠকাইছি? তুইও তো আমারে ঠকাছ নাই কোনোদিন। গত ৪ বছর দৈরা আমরা যে ব্যবসা করি, আমগো লগে কোনদিন সিরাসলি লাগছে? ব্যবসা করতে গেলে ছোটখাট ঝুট-ঝামেলা, ফ্যাসাদ, মন ব্যাকা এইসব তো অয়ই। কিন্তু ঐ হিসাব তো আলাদা। ঐটা তুইও মনে রাহছ নাই, আমিও রাহি নাই। কিন্তু দোস্,’ এটুকু বলে রফিক কয়েকবার ঢোক গিলে, দুইবার নাক টানে, যেন সর্দি, তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় পরের কথাটা শুরু করতে গিয়ে ২/৩ বার চেষ্টা করেও পারে না গলা আটকে যাচ্ছিল বলে। জোর করে একটু ধাতস্থ হয়ে শেষে কোনোরকমে বলে, ‘আমি তোর কিছু করছিলাম? মিন্টুর চিকিৎসার অর্ধেক টাকা আমি দিছি। তুই তো টাকা জমাইতে পারছ না,’ আবার গলা আটকে আসে রফিকের, ‘আমার কোন কামটা তোর খারাপ লাগছে? আর যদি লাগেও, তুই তো কৈতে পারতি। আমি তোর কোন বাড়া ভাতে ছাই দিছি। আমি তোর কী করছিলাম?’ হু হু করে না, কেননা ওরা ওভাবে কাঁদে না, তবে হৃদয়ের আক্ষেপ বা আত্মার যন্ত্রণা মেলে ধরার সময় যা হয়, অর্থাৎ মানুষ যখন কাঁদে, কথা শেষ করার পর রফিকের চোখে, কে জানে কোন শিরা রগ বেয়ে বেয়ে মানুষের শরীরের ভেতর অনির্দেশ্য বেদনার নিরাময় হয়ে, হৃদয়ের অতল থেকে অনেকক্ষণ ধরে উঠে আসা পানি তখন ছলছল করে রফিকের চোখে, অনতিবিলম্বে গড়িয়েও পড়ে। উপস্থিত সবাই না দেখার ভান করলেও সাইফুল সরাসরি চেয়ে থাকে রফিকের দিকে। গড়াতে শুরু করার সাথে সাথেই হাতের চেটো দিয়ে মুছে ফেলে রফিক চোখের পানি। এবারও সবাই চুপচাপ থেকে না দেখার ভান করে। শুধু সাইফুল তখনও চেয়ে থাকে, অপলক। বেদনায় বাঁকা হয়ে যাওয়া রফিকের হৃদয়ের মত করে বসে থাকে সে। নিজেই অভিযুক্ত জন, তবু কোনো নিরাময় বাক্য খুঁজে পায় না সে রফিকের জন্য, অনেক চিন্তা করেও। বরং বলে, ‘দোস্ত, কইলাম তো, মাফ কইরা দে, আর করুম না। এহন আমার পরিস্থিতি তো তুই বোজছ। মতিগো লগে থাকা ছাড়া আমার আর উপায় নাই। মজিবর বাই আমারে ছাড়ব না। তুই যতই কস, তুই সব ম্যানেজ করবি, আর আমি জানি তুই চেষ্টাও করবি, কিন্তু তুই হ্যারে চিনছ না। নিজের ১৯ বছরের ভাতিজারে নিজের হাতে জবাই করছে। সবাই জানে, তুইও জানছ। লাশ পাওয়া যায় নাই দেইখা কেস টিকে নাই। দোষ একটাই — গ্রুপের পোলাপান মজিবর ভাইয়ের চেয়ে ভাতিজারে বেশি পছন্দ করতে শুরু করছিল। মাত্র ২ বছরে ভাতিজা যেই পজিশনে গেছিল গা, ঐদিকে সাভারের সালাউদ্দিন এমপি থিকা শুরু কৈরা এইদিকে আমিনবাজার পার হৈয়া মজিবর বাইয়ের চিরশত্রু টার্মিনালের মতির লগেও অর কানেকশন তৈরি হৈয়া গেছিল। মজিবর বাই নিজেই এইডা করতে চাইছিলো, বিশেষ কইরা ডিপু-মতির লগে একটা সম্পর্ক তৈরি। কিন্তু বছর ২ এর মদ্যেই বাতিজা যহন খালি গ্র“পের সবার পছন্দের হইয়া উঠলো না, বরং মজিবর বাইয়ের ২/৩ ডবল এলাকায় সম্পর্ক/যোগাযোগ তৈরি কৈরা ফালাইলো অথচ মজিবর বাই নিজেই অয় কথাবার্তায় স্মার্ট আছিলো দেইখা গাবতলি টার্মিনাল থিকা আরিচা ঘাট পর্যন্ত নিজের এলাকা বানাইতে অরে সিলেক্ট করছিলো। পরে কী ঐলো সবই তো জানছ।’
‘মজিবর বাইয়ের কতা না হয় বাদ দিলাম,’ রফিক আবার কথা বলতে শুরু করে, ‘আমার কী দোষ আছিলো? আমি নিজে টিভি কিনার আগে তরে কিন্যা দিছি, তাও ব্যবসার ট্যাকা থিকা না, আমার লাভের অংশের ট্যাকা থিকা। সাইফুল, আমি কল্পনাও করতে পারি নাই এমন ঐবো। এইডা তুই কী করলি, সাইফুল? আমি অহন কী করুম?’
কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে উপস্থিত প্রত্যেকেই। কী বলা যায় বুঝতে না পেরে ঠাণ্ডাই থাকে। শেষে দীর্ঘ বিরতির পর নিজেদের সামলে নিয়ে রফিক সাইফুলকে বলে, ‘তুই বাড়ি যা, আগামী ১ সাপ্তাহ গরে থাকবি। টার্মিনালেও যাবি না। আমি ইনশাল্লাহ, আতে-পায়ে দৈরা ঐলেও মজিবর বাইরে ম্যানেজ করুম। তয় মতি-ডিপুগো লগ ছাড়তে হৈবো তর। এইডা মাথায় রাখিছ।’
ঠিক ১ সপ্তাহ পর রফিক মজিবর ভাইয়ের বাসায় যায় নির্ধারিত সময়ের ১০ মিনিট আগেই। মনের মধ্যে একটা ভয়ানক আশঙ্কা। আর সে নিজেও বুঝতে পারছিল না কেন কেমন যেন লাগছিল এই কয়দিন। ঠিক বুঝতেও পারে না চিন্তাটা, যা ঝাপসা, অস্পষ্ট কিন্তু জান্তব, যা একেবারেই ভ্রুণ পর্যায়ে আছে বলে অস্পষ্ট। একটা চিন্তার বীজ ছিল সেটা আসলে। একটা জিঘাংসার এত সামান্য ও ক্ষুদ্র ও প্রাথমিক রূপ যে প্রথম দিকে রফিকের ভূল করে তা মাঝে মাঝে মায়া বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু মনের গভীর ভেতরে যেখানে বাসনা-ইচ্ছা-প্রতিজ্ঞা-অনুভূতি খেলা করে সেখানে গত কয়েকটা দিন ধরে বিলম্বিত কিন্তু নির্দিষ্ট বিরতিতে ফিরে ফিরে আসছিল সেই ঝাপসা অনুভূতি, রফিকের সচেতন মন যা ভাবতেই শিউরে উঠছিল। ২/১ দিনেই রফিক বুঝে যায়, এটা মায়া না; সপ্তাহকাল ধরে মাঝে মাঝেই চলতে থাকা অস্বস্তিকর অস্পষ্ট ভাবনাটা যে জিঘাংসা, রফিক তা তখনো জানে না। বলা বাহুল্য, রফিকের এই ব্যক্তিগত জিঘাংসার সাথে মজিবর ভাইয়ের গ্র“প ডিসিপ্লিনের কোনো সম্পর্ক নাই। এটা রফিকের একার খেলা। রফিক অবশ্য এটাও জানে না। হৃদয়হীন মাঠে ব্যক্তিগত কালো পীচে একাই বল করছে ও ব্যাট চালাচ্ছে রফিক গত ৬/৭ দিন ধরে। ‘এই পুরা ব্যাপারটার নামই কি নিয়তি?’ আমি ভাবি, ‘তবে তো কোনো কথা থাকে না। আর যদি তা না হয়, এর নাম নাম হয় কর্মফল, কার্যকারণ সম্পর্ক ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি, বা অন্য কোনো কিছু, তবে তো কথা থাকতেই পারে।’
কিন্তু পাঠকের বিরক্তির ভয়ে আমি সে আলাপে যাব না। আমি শুধু আমার কাহিনী বলতে পারলেই খালাস।
যা বলছিলাম, একটা ভয়ানক আশঙ্কা মনে নিয়ে ড্রইংরুমে মজিবর ভাইয়ের অপেক্ষায় বসে আছে রফিক। রাজ্যের চিন্তা, কখনো কখানো বিপরীতমুখী, তার মাথায় বহতা নদীর ঢেউয়ের মত ওঠে নামে, কিন্তু কৈ তীরে এসে আছড়ে ভেঙে পড়ে না তো!
কীরে কী অবস্থা?
কখন রুমে এসে ঢুকেছে খেয়ালও করে নাই, এক কোণে রাখা একটা মিনিয়েচার পৃথিবীর দিকে অপলক চেয়ে থেকে ভাবনায় ডুবে ছিল, এতক্ষণে মজিবর ভাইয়ের প্রশ্নে ধ্যান ভাঙে রফিকের।
এই তো। অবস্থা ভালই। ১ম ২ দিন একটু শরীর ব্যতা করছে, রাইতে গুম হয় নাই। খালি হামি ওডে আর চোখ দিয়া পানি পড়ে। তয় এহন ভালোই আছি, রাইতে ঘুমও অয়। জ্বালাপোড়া কমছে।
সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে জবাব দেয় রফিক, শেষের অংশটুকু মিথ্যা। কেননা টানা ৪৮ ঘণ্টা চরম মানসিক অস্থিরতা আর শারীরিক ব্যথা নিয়ে নির্ঘুম রাত কাটানোর পর ৩য় দিন ভোর থাকতে থাকতেই ধামরাইয়ের বাসে চেপে, ৮ বা ৭ নম্বরে উঠলে ড্রাইভার কন্ডাক্টররা চিনে ফেলতে পারে তাই, সোজা বিয়েনপি বস্তিতে হাজির হয় রফিক। ডাইল খেতে ঢাকার তৎকালীন বৃহত্তম বস্তিতে সে আগেও এসেছে বলে এলাকাটা তার পরিচিত। হিরোইন বিক্রি হয় এটা শুনত তখন, তবে কখনো যেচে দেখারও সাধ হয় নাই। আসলে হিরোঞ্চিদের বাহ্যিক কন্ডিশন দেখে আর বিভিন্ন জনের কাছে এর সম্পর্কে শুনে শুনে, সে একরকম ঘৃণাই করত ব্যাপারটা। তবে সেদিন নিজস্ব প্রয়োজনে, ভালবাসার টানে আসা বলে খুঁজে পেতে ৫ মিনিটও লাগে নাই। আসলে ১ম ২ দিন প্রতিটা মুহূর্তই আসতে চেয়েছিল সে, তবে মজিবর ভাই, বন্ধু-বান্ধবসহ দুলাভাইয়ের উদ্বেগাকূল যতœ ও নিজের সাথে করা প্রতিজ্ঞার (‘আর জীবনেও একটানও দিমু না’) কারণে আসা হয় নাই।
তবে বস্তিতে আসার পর খুঁজে বের করে মাল খেতে খেতে রফিকের খুব মন খারাপ হয়ে যায়, শুভানুধ্যায়ীরা সবাই কত কষ্ট পাবে কল্পনা করে। তবে, সে খেয়ালও করে না, নিজের উপর স্বারোপিত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে সে মতিরা যা চেয়েছিল ঠিক সেটই করে বসল। তারপর ৪র্থ-৫ম দিন পুনরায় নিয়ন্ত্রণ কঠোর করে ৬ষ্ঠ দিন আবার। এভাবে গত ৭ দিনে মোট ২ দিন। স্বাভাবিকভাবেই ঝাড়ি খাবার ভয়ে ব্যাপারটা চেপে যায় রফিক মজিবর ভাইয়ের কাছে। এভাবে চূড়ান্ত ভুলটাও করে বসে সে।
বাসার খবরাখবর জানতে চায় মজিবর ভাই টুকটাক প্রশ্নের মাধ্যমে। সংক্ষিপ্ত জবাবের মাধ্যমে কথা চালিয়ে যায় রফিক। ধীরে ধীরে আধা ঘণ্টার মধ্যেই আড়াপাড়ার সেন্টু, হেমায়েতপুরের বাবলা, সাভারের লাকিসহ মোট ৬ জন এসে জমা হয় মজিবর ভাই’র ড্রয়িংরুমে। এদের মধ্যে মাত্র ১ জনকে রফিক চেনে না। ‘শোন সবাই,’ মিটিং শুরু করে মজিবর ভাই। প্রস্তাব জানানোর স্বরে আসলে সিদ্ধান্তই জানায় সে, ‘মতি আর সাইফুল ২ জনরেই ফালায়া দিতে ঐবো। ব্যাপারডা আসলে প্রেস্টিজের ব্যাপার হৈয়া দাড়াইছে।’
কিন্তু, মজিবর বাই, সাইফুলই তো আমারে বাঁচাইলো! অয় না থাকলে আমারে নৌকায়ই শ্যাষ কইরা দিতো।
‘প্রথমে বেঈমানিডা করছিলো কে?’ রফিকের চোখে চোখ রেখে শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন করে মজিবর ভাই। কিছুক্ষণ জবাবের আশায় অপেক্ষা করে রফিক যখন মাত্র মুখ খুলতে যাবে তখন হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিয়ে মজিবর ভাই যোগ করে, ‘আর তাছাড়া, খালি তর একার লগেই বেঈমানি করে নাই, সবাইর লগে করছে। ক্ষতিপূরণই সব! তরে ক্ষতিপূরণের ট্যাকাটা দিলেই সব শ্যাষ অইয়া গেল? আমার অপমানের কী অইব? কী জবাব দিবি, ডিপুর পোলাপানরা যহন হাসাহাসি করব?’
মজিবর ভাই থামতেই রফিক দ্রুত কথা শুরু করে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে, ‘বিশ্বাস করেন, মজিবর বাই, অয় একটা বুল করছিলো লুলা শাহীনের পাল্লায় পইরা। কিন্তু পরে তো বুল বোজতে পারছে। অয় না থাকলে আমি ঐদিন বাচতাম না। তাছাড়া অয় কতা দিছে, আপনে মাফ দিলে অয় নাকে ক্ষত দিয়া ডিপু-মতিগো গ্রুপ ছাইড়া আবার আমাগো কাছে ফেরত আইবো।’
‘খানকি চিনছ, খানকি!’ মজিবর ভাইয়ের মুচকি হাসিমাখা প্রশ্ন শুনে প্রথমে অর্থ বুঝতে পারে না রফিক। তারপরে বুঝতে পেরে কার্পেটের দিকে চেয়ে বলে, ‘মতিরে মারেন! সাইফুলরে মাইরেন না। জীবনে এই পরথম বুল করল, প্রথমবারও মাফ করবেন না? আপনের কাছে হাত জোর কৈরা অনুরোধ করি …।’
কথা শেষ করতে পারে না রফিক, মজিবর ভাইয়ের পাশে বসে থাকা নাম না জানা (পরিচয় পর্বের সময় বলেছিল, তবে রফিক মনে রাখতে পারে নাই) লোকটা, ‘এই হিজড়াডারে কৈত্যে জোগাইছেন?’ মজিবর ভাইর দিকে ফিরে প্রশ্ন করে। রফিকের দিকে ফিরে লোকটা তার কথা শেষ করে, ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠের ২ বাক্যে, ‘শোনো, ছোডবাই, বয়স কম তো, অহনও সব বুইজা ওটতে পারো নাই। সবকিছুর একটা নিয়ম আছে।’
তর্ক বিতর্ক বা রফিকের উপর্যুপরি অনুরোধ ও বাকি সবাই মিলে তাকে বোঝানোর পর্ব চলে ঘণ্টাখানেক। রফিকের অনুনয় মাখা কণ্ঠ শুনে কে বলবে, তখনও, তার মনের গভীরে বইছে সেই চোরা স্রোত। ভাবনার, আবেগের বা ছদ্মযুক্তির চিরাচরিত অধঃপতন।
‘কুত্তার বাচ্চা, আমার লগে এমন করলো, একবারও ভাবলো না আমি অরে মাফ কইরা দিলে স্ট্যান্ডের সবাই আমারে নিয়া হাসবো। ক্যামনে পারলো অয়! মজিবর বাইয়ের লগে নাইলে স্বার্থের সম্পর্ক, কিন্তু আমার লগেও স্বার্থের সম্পর্ক তর, সাইফুল? এইডা ভাবলি তুই? আমি কিন্তু ভাবি নাই। আমি কোনোদিনও ভাবি নাই। অহন আমি যদি মজিবর ভাইগো কতায় রাজি ঐয়া যাই, তাইলে? তাইলে কেমন লাগবো? কী বাল ফালাইতে পারবি তুই? নিজের বাইয়ের রক্ত লাইগা থাকা হাতে হাত মিলায় যে, অয় কি মানুষ? অর বাঁচনের দরকার আছে কোনো?’ সেই কার্পেটের দিকে চেয়েই এসব ভাবছিল রফিক।
তবু এসব ছিল তার ভেতরের ভাবনা। বাইরে সে সাইফুলকে বাঁচানোর চেষ্টা তখনো করে যাচ্ছিল, যদিও টের পাচ্ছিল তার প্রতিটা যুক্তিই এই লাইনে হাস্যকর ও ভুল, এমনকি ক্ষতিকরও হতে পারে। ৫ জনের সাথে আর কতক্ষণ পারা যায়, একা একা? অথবা ৫ জনের সামনে আর কতক্ষণ চাপা রাখা যায় আত্মতৃপ্তির ঢেকুর? একসময় রাজি হয়, বা হতে বাধ্য হয়, বা, কে জানে, হয়ত সানন্দেই রাজি হয় রফিক। পরিকল্পনা শুরু করে ৬ জন। আর রফিকও তাতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। প্রথমে মতিকে টার্গেট করা হয়। এতে পাল্টা হিটের সম্ভাবনা থাকলে তা যথেষ্ট বিলম্বিত হবে যা তাদেরকে আলোচনা ও ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে মীমাংসার পর্যাপ্ত সময় দেবে। থানা পেমেন্ট নিয়ে আলোচনা হয়; গাবতলি ও সাভার থানা ২ থানায়ই পেমেন্ট দিতে হবে। থানার সাথে যোগাযোগের দায়িত্ব দেয়া হয় বাবলাকে। মোট ৪০/৫০ জনের টিম যাবে মতির হরিরামপুরের বাড়িতে হিটে। মূল হিটার থাকবে ৪ জন। রফিককে অব্যহতি দেয়া হয় হিটার টিম থেকে, তবে মূল টিমে থাকতে হবে তাকে। মতিকে সরানোর দায়িত্ব নেয় মজিবর ভাই নিজে, তবে সাহায্যকারী হিসাবে নাম না জানা লোকটা, লাকি আর ইফতি সাথে থাকবে। একই এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় বাবলাকে বাদ দেয়া হয় হিটার টিম থেকে। তবে তাকে দায়িত্ব দেয়া হয় পুলিশকে সামলানোর। টাকা খাওয়ার পরও পুলিশ যদি চোখ পাল্টি দেয়, তবে সেন্টু তাদের অপেক্ষায় থাকবে ট্রলারে। আমিনবাজার থেকে বইলাপুর পর্যন্ত আরিচা রোডের বিস্তীর্ণ দিগন্তছোঁয়া বিলে। থানায় ইনফরমার আছে, বিশ্বাসী হাবিলদার। ২ থানাতেই। গাবতলী থানা সামলানোর জন্য আরেকটা টিম (৫/৬ জনের) থাকবে মিরপুর ব্রিজের গোড়ায়। নিচে তুরাগে ট্রলার রেডি থাকবে কেটে পড়ার জন্য।
‘তবে খেয়াল রাখবি পুলিশের গায়ে বা গাড়িতে য্যান গুলি না লাগে, তরা খালি ফাঁকা গুলি করবি আর ডিব্বা ফুটাবি টানা ২ মিনিট। তারপরেই ভাগবি। গুলির শব্দ পাইলেই আমি ওসির লগে কথা কমু।’
ঠিক ৩ দিন পর অপারেশনের দিন ঠিক হয়। রাত ১০ টায়। মতির বাড়িতেই ঘটনা ঘটানো হবে। আর সাইফুলের জীবনকাল আরও ১ সপ্তাহ বাড়ানো হয়। এর মধ্যে রফিক প্রতিদিন সাইফুলের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাবে, আশা দিয়ে যাবে ক্রমাগত মিটমাটের, মজিবর ভাইয়ের কাছে ফেরত এলে মাফ করা হবে তাকে এই আশ্বাস দিয়ে। আরও বিভিন্ন খুঁটিনাটি দিক নিয়ে আলোচনায় রাত গড়ায় ১০ টায়।
মনে ক্রোধ আর হৃদয়ে প্রতিশোধের তীব্র বাসনা নিয়ে আমিনবাজার স্ট্যান্ডের দিকে রওনা হয় রফিক। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, ‘আর ৭ দিন। শুয়োরের বাচ্চারে শ্যাষ করার দিনই লাস্ট খামু। এরপর জীবনেও আর না। অয় মনে করছিলো, সবকিছুই অর মনমত অইবো। সেরের উপ্রে সোয়া সের আছে, অয় অহনও জানে নাই।’
এ তো গেল মতিকে নিয়ে ভাবনা। সাইফুলের ভাবনা মাথায় এলে আরও উত্তেজিত হয়ে পড়ে সে; জানালার পাশের সিটে বসেছে, হু হু বাতাস তীব্র আবেগের মত আছড়ে পড়ছে তার চোখে-মুখে-চুলে। বাইরের না দেখা দিগন্তবিস্তৃত জলরাশির অন্ধকারের দিকে চেয়ে, তীব্র বাতাসেও যতটা পারা যায়, শীতল ও ক্রুর চোখে, বিড় বিড় করে সে, পাশে বসা প্যাসেঞ্জারের অবাক দৃষ্টির সামনে, ‘বুকের বদলে পিঠ দিলি? তুই পারলে আমিও পারুম।’
স্ট্যান্ডে এসে দেখে সাইফুল ওর জন্য বসে আছে তখনও। উদ্বেগাকূল, ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে। দক্ষতার সাথে অভিনয় করে রফিক, সাইফুলের অস্থিরচিত্তকে প্রায় শান্ত করে দেয়, এত নিখুঁতভাবে। ‘মজিবর বাই রাজি অইছে। পরে একদিন দেহা করার ডেট দিবো, তয় ৭টা শর্ত আছে।’ ৬ নম্বরটায় কেমন জানি একটু খুঁতখুঁতানি থাকলেও, বাকি ৬টায় কোনো সন্দেহজনক কিছু খুঁজে পায় না সাইফুল। মোটামুটি নিশ্চিত হয়েই, নিরাপদ সে, বাড়ি ফেরে। পরদিন বিকালের পর থেকে রফিকের খোঁজ পাওয়া যায় না। মোবাইলও বন্ধ। কই গেছে বা কোথায় গেছে কেউ এমনকি বাড়ির লোকও জানে না।
সেদিন সারারাত ঘুম হয় না রফিকের। দ্বিধার দুধারী করাতে ফালা ফালা হয় তার চৈতন্য। তার দৌড় তো ছিল বড় জোর হকিস্টিক পর্যন্ত; তাও ব্যবসা শুরু করার পর থেকে ঐসব বন্ধ। স্কুলে পড়ার সময়কার উত্তেজনায় ১২/১৫ জনের দল নিয়ে অন্য মহল্লায় হিটে গেছে জুনিয়র পোলাপান সামনে সিগারেট খেয়েছে বলে। তাও, কাপুরুষ, না-মরদ হওয়ার ভয়ে। তাও সতর্কতার সাথে সবার অলক্ষ্যে পেছন দিকে থেকেছে সে, যাতে হিটে অংশ নিতে না হয়। পেছন থেকে, ‘মার হালারে, হাড্ডি ছেঁইচ্যা দে বাঞ্চোতের …’ ইত্যাদি গলাবাজী করা পর্যন্তই ছিল তার দৌড়। হকিস্টিক হাতে নেয়াই সার, কারো গায়ে হিট করতে হয় নাই। ঐটা রফিকের কাজ না, রফিক পারে না। যদিও ৪০/৫০ জনের বিশাল টিম যাবে, যদিও ৫ জনের হিটার তালিকায় রফিক নাই, তবুও, জ্জ ঘণ্টা আগে মজিবর ভাইয়ের বাড়ি থেকে ফেরার সময়কার গরম ক্রোধ গলে পরিণত হয়েছে শীতল গ্লানিতে। চেষ্টা করেও ক্রুদ্ধ হতে পারছে না সে। বাইরে বৃষ্টি ঝরছে অঝোরে, বৃষ্টির ছাঁট জানালা দিয়ে এসে বিছানার একপাশসহ রফিকের চোখে-মুখে পড়ছে, তবু উঠে জানালা বন্ধ করতে ইচ্ছা হয় না, শক্তি পায় না শরীরে। যেন কয়েক টন হয়ে গেছে শরীরের ওজন, তার মনে অবসাদে। খোলা চোখে নিঃসাড়, সটান বিছানায় শুয়ে ভিজতে থাকে রফিক।
‘বাই, বিশ্বাস করবেন না জানি, এতো বছর এই লাইনে, তাও কোনোদিন কারো গায়ে ফুলের টোক্কাও দেই নাই।’
‘জানি আমি,’ বলে ফেলেই, কোনো পূর্ব ভাবনা ছাড়াই মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায় কথাটা, রফিককে চিনতে পারি আমি। অনেক্ষণ ধরেই খচ খচ করছিল মনের ভেতর। কোথায় যেন? কোথায় যেন দেখেছি! নাকি শুনেছি কোথাও এই কণ্ঠ? এতক্ষণে হঠাৎ ‘ফুলের টোক্কা’ শুনে দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়ে যায় সব। প্রায় ১০/১২ বছর আগের ঘটনাটা স্পষ্ট মনে পড়ে আমার। অবশ্য না চেনার কারণও আছে। সাক্ষাৎটা হয়েছিল অন্ধকারে। ১০/১২ মিনিটের একটা ঘটনা।
১০/১২ মিনিটের ঘটনা। বাসে আমিনবাজার ক্রস করার সময় ভার্সিটির উদ্দেশে, রাত ১১ টার দিকে, আধা ঘণ্টার দ্বিধা-দ্বন্ধের অবসান ঘটিয়ে, অবশ্যম্ভাবী সিদ্ধান্ত নিয়ে, বাজার বাসস্ট্যান্ডে নেমে পড়ি। তখনও পাতায় আসি নাই, সিরাপে ছিলাম। মুন্সীবাড়ির দিকে যাওয়ার ফুটব্রিজে পার হয়ে মহল্লার ভিতরে এক বাসায় বিক্রির ব্যবস্থা ছিল। বাইরে রাস্তায় বা ব্রিজের উপর ঘুরঘুর করা খুচরা বিক্রেতাদের চেয়ে ২০/২৫ টাকা কম নিত। বাস থেকে নেমেই ফুটব্রিজের দিকে আগাই। চারপাশ অনেকটা নির্জন হয়ে এসেছে, যদিও রাস্তার ওপাশের হোটেল-রেস্তোরাঁগুলা তাদের লাউড স্পিকারের উচ্চ শব্দের গান-বাজনাসহ জ্বলজ্বলে।
ব্রিজের গোড়ায় আমার বয়সী ২টা পোলা স্টিকে গাঁজা ভরছে। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করে, ‘কী ভাই, মাল লাগবো।’
‘না’ সংক্ষেপে জবাব দিয়ে ওদের ক্রস করে ব্রিজে উঠে যাই।
‘আছে তো, লগেই আছে।’
খাঙ্গালীবাজ ভেবেছি ওদের আমি, সম্ভবত এটা ভেবেই আবার অ্যাপ্রোচ করে ওদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কালোজন। আমি থেমে ওদের দিকে ফিরে শান্ত স্বরে বলি, ‘বললাম তো লাগবে না। কী মনে করেন আপনেরা। সবাই একরকম ?’
আমার কথা শুনে সশব্দে একটা বাঁকা হাসি হাসে ছেলেটা।
‘যাইতাছেন তো খাইতেই,’ বলতে বলতে শার্ট উঁচিয়ে কোমড়ে লুঙ্গিতে অর্ধেক গোঁজা ২টা ফেন্সিডিলের বোতল দেখিয়ে, ‘আমাগো কাছ থিকা নিলে অসুবিধা কী? ইনটেক মাল আছিল।’
হঠাৎ কী যে হয়! মারাত্মক একটা ভুল করে বসি। ভণ্ডামির একটা সীমা থাকা উচিত, আমার তা মনে থাকে না। চিৎকার করে বলে উঠি, ‘ঐ মাদারচোত, কথা কানে যায় না? কইতাছি না, লাগবো না? তারপরো ঘ্যান ঘ্যান করতাছোস ক্যান? মানুষ মনে হয় না, না?’
ওদের মধ্যে কালোজন তখন বেশ শান্ত স্বরে বলে, ‘সরি, সরি ভাই, বোজতে পারি নাই। আপনে যান।’ ছেলেটার মুখের কথার সাথে আবছা আলোয় দেখা চোখের ভাষার কোনো মিল নাই দেখে বুঝতে পারি, ভুল হয়ে গেছে। আমরা ছাড়া ব্রিজে আর কোনো লেকাজন নাই। ওদের দাঁড়ানোর ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে এখন যদি রাস্তায় ফেরত যাওয়ার চেষ্টাও করি, তবুও ঝামেলা করবে ওরা। চিন্তা করার সময় বেশি ছিল না। আমি ঘুরে ব্রিজ পার হয়ে মহল্লার দিকে যাওয়ার রিস্কটাই নেই। ৪/৫ পা আগাতেই টের পাই ওরাও পেছন পেছন আসছে। পকেটে একটা নোটই ছিল। ৫০০। পকেটে হাত দিয়ে হাঁটছিলাম আমি।
নোটটা পকেটের ভেতর হাতে নিয়ে ভাঁজ করতে করতে আধা বর্গইঞ্চির সমান করে, মধ্যমা আর অনামিকার মাঝে চেপে ধরে সেট করে পকেট থেকে হাত বের করে হাঁটতে থাকি। ব্রিজ পার হয়ে ৮/১০ গজ পর ডানদিকে একটা চিপা গলিতে ঢুকতে হয়। ইনট্যুশন বলছিল, ঐ গলিতে ঢুকেই ধরবে। একবার ভাবি, গলিতে না ঢুকে সোজা সামনে আগাই, তারপর কী ভেবে ডানের নির্ধারিত চিপা গলিতেই ঢুকে পড়ি। ঘুটঘুটে অন্ধকার গলি। ৭/৮ গজ আগাতেই পেছন থেকে ডাকে ছেলেটা, ‘এই যে ভাই, দাড়ান একটু।’ আমি থেমে যাই। খেয়াল করি, প্রথম থেকেই এই ১ জনই কথা বলছে। কাছে এসে ছেলেটা আমার কলার চেপে ধরে, ‘মাদারচোত মানে কী? মাদারচোত মানে কী?’ বলতে বলতে আমাকে পেছনের বিল্ডিংয়ের গায়ে ধড়াম করে চেপে ধরলে আমি সারেন্ডারের ভঙ্গিতে হাত উঁচিয়ে দু’আঙুলের ভাঁজের নোটটা তখন যৌক্তিক কারণেই অদৃশ্য, শান্তস্বরে বোঝানোর ভঙ্গিতে বলি, ‘ভাই, আমার কথাটা শোনেন আগে।’
‘চোপ, খানকির পোলা! তোর আবার কথা কী? মাদারচোত মানে কী? মাদারচোত মানে কী?’ বাঁ হাতে কলার চেপে ধরে ডান হাতে আমার সারা বডি সার্চ করে ছেলেটা। অন্য ছেলেটা একটা ক্ষুর বের করে, ভাঁজ খুলে, আমার গলার কাছে হালকা ছুঁইয়ে, এই প্রথমবারের মত আশ্চর্য ঠাণ্ডা কণ্ঠে প্রশ্ন করে, সেই একই প্রশ্ন, ‘মাদারচোত মানে কী?’
আমি বুঝি সত্যি সত্যি অপমানিত হয়েছে ওরা। মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে এখন। গলায় ক্ষুর ঠেকানোর সাথে সাথেই নড়াচড়া বন্ধ করে দিয়েছি আমি। ২ হাত সারেন্ডারের ভঙ্গিতে উঁচু করে রাখা। আমি শান্তভাবে, উত্তেজিত না হয়ে, ভুল শব্দ ব্যবহার না করে, গলায় আন্তরিকতা মেখে ওদের বোঝাই, ‘ভাই, সত্যি কথা বলি, মাল খাইতেই আসছি। তবে আমার নির্দিষ্ট ঘর আছে। সবসময় সেখানেই খাই। দাম ২০ টাকা কম রাখে বাইরের চেয়ে। আসলে অন্য একটা ব্যাপারে খুব চিন্তিত ছিলাম। ২ বার না করার পরও যখন আপনেরা শোনলেন না, তখন হঠাৎ মেজাজ খারাপ হয়া গেল। সরি, ভাই, সত্যি সরি। আমি দেখতাছি আমার কথায় আপনেরা কষ্ট পাইছেন। তবে বিশ্বাস করেন, আমি সত্যি কষ্ট দিতে চাই নাই। হঠাৎ বইলা ফেলছি। সরি, মাফ কৈরা দিয়েন।’
‘মাল খাইতে যাইতাছেন টাকা কই?’ ইতোমধ্যে ২ বার পুরাপুরি সার্চ করেছে ওরা, কাজেই স্বাভাবিক প্রশ্নটাই করল, ‘আপনের তো, যাওয়ার ভাড়াও নাই।’
আমি বাকিতে মাল খায়া, যাওয়ার ভাড়া নিয়া তারপর যামু।
অন্ধকারে আমার উপরের দিকে তোলা হাত দেখা যাচ্ছিল না বলে সঙ্গত কারণেই আমাকে বিশ্বাস করে ওরা। কোথায় যাব, কার বাড়ি ইত্যাদি জিগ্যেস করে শেষে আমাকে ছেড়ে দেয়।
‘শোনেন, আমাগো কী মনে করেন, জানি না, তয় জীবনে কারো গায়ে ফুলের টোক্কাও দেই নাই। হেল্লেইগা কিছু করলাম না। বাঁইচ্চা গেলেন। আইজকা যান, ভবিষ্যতে এইরম আর কৈরেন না।’
তো সেই নির্ঘুম রাতে এদিক-ওদিক অনেক ভেবে, পরদিন ভোরেই মার কাছ থেকে, ‘বাসায় কয়েকদিন থাকা রিস্ক হৈবো, মজিবর ভাইও জানে না, কাউরে কিছু কইবা না, কইবা সকালে আইতাছি কৈয়া বারাইছে, এহনও আহে নাই, কৈ গ্যাছে কিছু তো কইয়া যায় নাই,’ বলে হাজার পাঁচেক টাকা নিয়ে বের হয়ে যায়।
বিয়েনপি বস্তি থেকে ৫ গ্রাম হেরোইন কিনে শ্যামলী হানিফ কাউন্টারে টিকেট কেটে সোজা যশোর।
ফেরে ৫ দিন পর। স্ট্যান্ডে নেমেই সাইফুলের সাথে দেখা, ওর কাছেই সব শোনে। গ্র“পের ড্রেস পরা ২৫/৩০ জনের বিশাল ১ গ্র“প মজিবর ভাইয়ের নেতৃত্বে গত পরশু রাতে নির্ধারিত সময়ে মতির বাড়ির সামনে মতিকে মুখের ভেতর রিভলবারের নল ঢুকিয়ে গুলি করে মেরে ফেলেছে। শুনে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে রফিক। চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে শুধু চায়ে চুমুক দিয়ে যায়। চারিদিকের হট্টগোল ওকে স্পর্শ করে না। কয়েক মিনিট কেটে গেল হঠাৎ অদ্ভুত জান্তব, নির্দয় ও সব-বুঝে-ফেলা একটা হাসি ফোটে তার মুখে। সাইফুলকে বলে, ‘জানছ, আমারো না হিটে থাকার কথা আছিলো, তুই তো আমারে চিনছ, জীবনে কেউর গায়ে হাত তুলি নাই। যদিও কইছিল কাউরে মারতে ঐবো না, খালি মাল ক্যারি করতে ঐবো। আর দরকার ঐলে ফাঁকা গুলি করতে ঐবো, তবু আমি হালায় ডরে ৩ দিন আগেই ভাগছি,’ বলতে বলতে রফিকের মনে পড়ে পরবর্তী অপারেশনের টার্গেট ও তারিখ। কিছু না ভেবেই, হাসিটা কন্টিনিউ করে সে বলে, ‘আমি ঠিক করছি মজিবর বাইয়ের কাছে যারা মাফ চায়া কমু, ‘বস, ব্যবসা করতে পারুম, একলা সবকিছু ডিল করতে পারুম, কিন্তু মারামারি করতে পারুম না।’
কথা শেষ হলে আবারও হাসে মতির এক সময়ে বলা একটা দাম্ভিক উক্তির কথা মনে করে, সাইফুলের জীবন্মৃত চোখ রফিকের দৃষ্টি না এড়ালেও, সে হাসতে হাসতে মতির সেই কাহিনীটা শোনাতে থাকে, যেন এই মুহূর্তে ও পরিস্থিতিতে মতির ঐ হাস্যকর ছ্যাবলামিমূলক গল্পটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যেন না বললেই না। কিন্তু গল্প শেষ হবার আগেই সাইফুল নিজেকে আর চেপে রাখতে না পেরে বলে ফেলে, ‘দোস, মজিবর ভাইয়ের লগে আমারে নিয়া আলাপ করছছ? হ্যায় কী কয়?’
‘চিন্তা করিস না। আলাপ করছি। মজিবর বাই মাপ করতে রাজি ঐছে। তয় আমি যে কইছিলাম,’ কণ্ঠে গর্ব এনে যোগ করে রফিক, ‘ডিপুর লগ ছাড়তে অইব আর ১ বছর তুই কোনো ব্যবসা করতে পারবি না,’ ২/১ বার সাইফুলের চোখের দিকে তাকালেও অধিকাংশ সময় রাস্তা দেখার ভান করে বলে সে। রফিক এসব কথা বলার সময় মনে মনে ভাবছিল কীভাবে মজিবর ভাইয়ের কাছে প্রস্তাবটা তুলবে, কী যুক্তি দিয়ে, কী নিশ্চয়তা দিয়ে ইত্যাদি।
বেশ কিছুক্ষণ দুইজনে নিশ্চুপ বসে থাকে। শেষে সাইফুল রফিকের বর্ণিত শর্ত শোনার সাথে সাথে, ‘আমি রাজি, দোস, আমি রাজি, আমারে ফেরত নিলে যে কোনো শর্তে আমি রাজি,’ বলার পর থেকে ২ জনের কেউই কী বলা যায় ভেবে পাচ্ছিল না বলে, ধীরে ধীরে ওদের মাঝে একটা অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে আসে। অথচ ২ জনেই প্রাণপণে বলতে চাইছিল কথা। আসল কথা, মিথ্যা কথা, সন্দেহের কথা, আজে বাজে হাস্যকর কথা, যে কোনো কিছু, শুধু কথা হলেই হয়, কথা শুধু, কথা, কথা, কথা। অথচ ২ জনের কেউই বলতে পারল না তা। অনেকক্ষণ পর নীরবতা ভাঙে রফিক। হঠাৎ সাইফুলের চোখে চেয়ে মুখে একটা আগের হাসির সম্পূর্ণ বিপরীত, অথচ ভয়ানক হাসি নিয়ে বলতে থাকে, ‘দোস, আমি না ধরা খায়া গেছি।’ গত ১২/১৩ দিনের হেরোইন বিষয়ক ঘটনা সবিস্তারে, সাইফুলের বিস্ফারিত চোখের সামনে বলার পর যোগ করে, ‘দোস, কেউ কিন্তু জানে না। বাসায়ও না। মজিবর বাইও না। তুই কিন্তু কেউরে কইছ না।’
‘আমি না অয় না-ই কইলাম, কিন্তু তুই এইটা কী করতাছস, তুই তো বাঁচবি না, মতি তো অর কাম ঠিকই কৈরা গেল,’ এই প্রথম মতির নামের শেষে ভাই বলে না সাইফুল, ‘দোস, এইটা করিছ না। আমারে এই শাস্তি দিছ না। তাইলে সব দোষের দোষী অমু আমি। এত বড় পাপ করি নাই যে এই শাস্তি দিবি।’
এটুকু বলে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে সাইফুল। তারপর হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায় একটা কথা বলে, ‘আর দেখ, তাইলে মজিবর বাইও আমারে ছাড়বো না। হেরে তুই চিনছ না?’
কিন্তু সাইফুলের উদ্বেগকে পাত্তা না দিয়ে আবার খোলসে ঢুকে যেতে যেতে রফিক বলে, ‘না দোস, চিন্তা করিস না। ২/১ দিন যে মাঝখানে না খাইয়া থাকছি অত কষ্ট তো অয় নাই। আর ডাইল খাইয়া লইলে বেড়াও তেমন থাকে না। আর খামু না, আসার সময় যশোর থিকা একটু নিয়া আইছি, আজকে রাইতে অইটুক খায়া। তুই চিন্তা করিস না, আমি মজিবর বাইরে লগে আবার কতা কমু। হে তোরে নিয়া যাইতে কইলেই আমি তোর লগে যোগাযোগ করুম। তুই এই কয়দিন চুপচাপ বাসায় থাক। টার্মিনালে কারো লগে যোগাযোগ রাহিছ না। একদম চুপচাপ বাসায় পইড়া থাক।’ কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ায় রফিক। গুদারা ঘাট পর্যন্ত বন্ধুকে পৌঁছে দিয়ে বাসায় ফিরে যায় সাইফুল।
আসলে রফিক যেমন কখনো ভাবে নাই সাইফুল তার সাথে চোখ পাল্টি দিতে পারে, বিপরীত ভাবে সাইফুলও কোনোদিন ভাবে নাই রফিক তার সাথে বেঈমানি করতে পারে। অনেক অনুরোধ, কাকুতি-মিনতির পরও রফিক যখন মজিবর ভাইয়ের মন গলাতে ব্যর্থ হয়, তখন বাধ্য হয়েই সিদ্ধান্তটা নিতেই হয় রফিককে।
মজিবর ভাইয়ের ড্রইংরুমে বসে অপেক্ষা করছিল সে। মজিবর ভাই ঢুকলে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দেয়।
‘হারামজাদা, তুই আমার সাথে ইর্য়াকি করছ?’ সালামের জবাবে এ প্রশ্ন করে কিছুক্ষণ তীব্র চোখে চেয়ে থাকে মজিবর ভাই। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে রফিক। আরও কিছুক্ষণ গায়ের ঝাল ঝেড়ে মজিবর ভাই শেষে বলে, ‘শোন তুই গ্র“পের শেল্টারে ব্যবসা করবি, আর গ্র“পের দরকারের সময় থাকবি না, এইটা চলব না। তোর কাজ আমারে করতে হৈলো ক্যান? মতিরে মারা তো তোর জন্যই। তাও তো তোরে হিটার গ্র“পে রাখি নাই, তারপরও ভাগলি? তুই যে বিপদের সময় ভাগবি না, গেরান্টি কী?’
‘কিন্তু, মজিবর বাই, একটা জিনিস দেহেন মামলায় তো আমার নাম দিবই, কেস পাটনার ঐতে তো আমার আপত্তি নাই। তাইলে আমি গ্র“পের লগে থাকলাম না কেমনে?’ স্বভাবসুলভ বিনয়ের সাথে বলে রফিক। ‘শোন্,’ মজিবর ভাইয়ের কণ্ঠ চড়ে যায়, ‘আমার লগে প্যাচ দিয়া কথা কবি না,’ বলে থেমে কপালে হাত দিয়ে ২/১ সেকেন্ড চেপে ধরে কিছু একটা ভেবে হাত নামাতে নামাতে বলে, ‘পরশুর হিটে তুই সাইফুলের ডানহাত কাটবি, অরে ২ হাত ২ পা কাইটা ছাইড়া দিমু। জানে মারুম না। এখন বাসায় যা।’ কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ায় মজিবর ভাই।
সোফায় বসে রফিক আসার পথে কীভাবে সাইফুলকে ফেরত নেয়ার জন্য মজিবর ভাইকে রাজি করাবে বলে যেসব কথা ভেবে রেখেছিল তা মনে করে। রফিক বুঝতে পারছিল এটাই শেষ মুহূর্ত সাইফুলকে বাঁচানোর, টের পাছিল মুহূর্তটা ওর করপুট থেকে পিছলে পড়ে যাচ্ছে অতীতের গর্ভে। তবু কিছুই না বলে সে উঠে দাঁড়িয়ে মজিবর ভাইকে সালাম দিয়ে বেরিয়ে যায়, কয়েকদিনের দোলচলের পর সিদ্ধান্তটা এই মাত্র, একটু আগে সোফা থেকে উঠতে উঠতে নিতে পেরেছে বলে, থমথমে মুখে।
শুধু মা-ভাবি বাসায় ছিল সাইফুলের। ২৭ জনের দল গিয়েছিল ওরা। সবার পরনে কালো প্যান্ট, কালো শার্ট, কালো জুতা, মাথায় কালো ক্যাপ আর নাক পর্যন্ত রুমালে ঢাকা। শুধু চোখ খোলা। থানায় বলা ছিল, টাকাও অগ্রিম দেয়া ছিল, কাজেই সে দিক থেকে কোনো ঝামেলা ছিল না। আসলে কোনো দিক থেকেই কোনো ঝামেলা হয় নাই। ভাবি একটু ঝামেলা করেছিল। একজন তাকে ধাক্কা মেরে মেঝেতে ফেলে দেয়, আর মা বিছানার কোনায় বসে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে ছিল শুধু, গলা দিয়ে চেষ্টা করেও শেষে শব্দ বের করতে পারছিল না বলে। কাগজের মত সাদা হয়ে যাওয়া ‘রফিক, তুই কই! মজিবর ভাই, আপনে কই! আমার একটা কথা শোনেন, আমার একটা কথা শোনেন!’ বলতে থাকা সাইফুলকে টেনে হিঁচড়ে ওদের একতলা বাড়ির উঠানে নিয়ে আসা হয়। পরিকল্পনা মত ৪ জন সাইফুলের ৪ হাত-পা চেপে ধরলে, বাবলা আজকের উপলক্ষ্যে কেনা চাইনিজ কুড়ালটা দিয়ে সাইফুলের বাম হাত কনুইয়ে কাছ থেকে ১ কোপে কেটে ফেলে। ২ কোপ লাগে পুরাপুরি বিচ্ছিন্ন করতে। বুকের উপর একজন হাঁটু দিয়ে চেপে ধরে মুখে রুমাল গুঁজে দিয়ে মুখ চেপে ধরে রেখেছিল বলে উল্লেখযোগ্য কোনো চিৎকার হয় না। তবে খিঁচুনিতে সারা শরীর কেঁপে উঠলে ছেলেটার হাত ফসকে যায় ১ বার — বাবলা ততক্ষণে রফিকের হাতে কুড়ালটা দিয়ে একপাশে সরে দাঁড়ালে এগিয়ে যায় রফিক — ‘দোস্, তুই!’ এত আড়ালের পরও দীর্ঘকালের বন্ধুকে ঠিকই চিনতে পারে সাইফুল। চিনে ফেলেছে বলে পরবর্তীতে বাড়তি কী কী ঝামেলা হতে পারে এসব তখন মাথায় নাই রফিকের, একটানে মুখের রুমাল খুলে ফেলে সে বলে, ‘নাচতে নাইমা ঘোমটা দিয়া লাভ কী?’
‘দোস, একটা তো নিছস, এইটা নিছ না,’ রিকয়েস্ট করে সাইফুল।
‘দোস তোর তো অন্তত হিসাব ঐবো, তোর লেইগা দাঁড়ি-পাল্লাও থাকবো। আমার যেন্ কোন পাল্লাও না থাকে।’ মজিবর সবে, ‘নাটক চো … ’ পর্যন্ত বলেছে, ততক্ষণে রফিক দুহাতে হাতল আঁকড়ে মাথার উপর কুড়াল তুলে, ‘দোস! মাফ কইরা দিছ্!’ বলতে বলতে জান্তব দীর্ঘ এক আর্তচিৎকারসহ কোপ মারে নির্ধারিত জায়গায়। চোখে সত্যি সত্যি রেডিমেড অনুতাপ তার। ব্যথা-বেদনা-বিস্ময়-অবিশ্বাস মাখা সাইফুলের লাথি খাওয়া নেড়ী কুকুরের ক্যেউ ক্যেউয়ের মত তীক্ষ্ণ গোঙানির সাথে রফিকের তখনও না থামা আর্তচিৎকার মিলে এক অশ্রুতপূর্ব যুগলবন্দি তৈরি হয়। ঝালরে নেমে যা কান্নায় একীভূত হয়।
আরও মিনিট দশেক, প্রসঙ্গ বদলে, গল্প করে বাসায় ফেরার জন্য উঠি আমি। রফিক যেখানে ছিল সেখানেই বসে থাকে স্থবির হয়ে, বরফ গলা হৃদয়ে।
ডিসেম্বর ২০০৭
===========================
গল্প- আলিমের নিভৃতিচর্চা by রাশিদা সুলতানা গল্প- প্রত্যাবর্তন: আমার ‘ফেরা’ নিয়ে যে কাহিনী না ..মানষ চৌঃ গল্প- 'বীচিকলায় ঢেকে যায় মুখ ও শিরোনাম' by আনোয়ার ... গল্প- 'প্রীত পরায়া' by সিউতি সবুর গল্প- 'চলিতেছে' by মাহবুব মোর্শেদ গল্প- 'গোপন কথাটি' by উম্মে মুসলিমা গল্প- 'রূপকথা' by লুনা রুশদী সঞ্জীব চৌধুরীর কয়েকটি গল্প গল্প- 'অস্বস্তির সঙ্গে বসবাস' by ফাহমিদুল হক গল্প- 'মঙ্গামনস্ক শরীরীমুদ্রা' by ইমতিয়ার শামীম গল্প- 'হাজেরার বাপের দাইক দেনা' by জিয়া হাশান গল্প- ‘অপঘাতে মৃত্যু’ ও ‘সাদামাটা’ by লীসা গাজী গল্প- 'দ্বিতীয় জীবন' by ইরাজ আহমেদ গল্প- 'পুষ্পের মঞ্জিল' by সাগুফতা শারমীন তানিয়া গল্প- 'একশ ছেচল্লিশ টাকার গল্প' by কৌশিক আহমেদ গল্প- 'একে আমরা কাকতালীয় বলতে পারি' by মঈনুল আহসান.. গল্প 'গহ্বর' by জাহিদ হায়দার গল্প- 'পুরির গল্প' by ইমরুল হাসান গল্প- 'নওমির এক প্রহর' by সাইমুম পারভেজ গল্প- 'মরিবার হলো তার সাধ' by আহমাদ মোস্তফা কামাল গল্প- 'নিষুপ্ত শেকড়' by নিরমিন শিমেল গল্প- 'লাল ব্যাসার্ধ্ব' by শামীমা বিনতে রহমান গল্প- 'সেদিন বৃষ্টি ছিল' by মৃদুল আহমেদ ক. কিছুদিন হয় সেই নগরে কোন বৃষ্টি হচ্ছিল না। কিছুদ.. গল্প- 'তুষার-ধবল' by সায়েমা খাতুন গল্প- 'কোষা' by পাপড়ি রহমান গল্প- 'কর্কট' by রাশিদা সুলতানা গল্প- 'তিতা মিঞার জঙ্গনামা' by অদিতি ফাল্গুনী
bdnews24 এর সৌজন্যে
লেখকঃ তারিক আল বান্না
এই গল্পটি পড়া হয়েছে...
লেখকঃ তারিক আল বান্না
এই গল্পটি পড়া হয়েছে...
No comments