গল্প- 'নওমির এক প্রহর' by সাইমুম পারভেজ
শীতের আমেজ এখনো কাটেনি। পঞ্জিকা অনুযায়ী অবশ্য শীত শেষ। ফাগুন এসেছে প্রায় এক মাস আগেই। তারপরও বসন্তের যে মিষ্টি মিষ্টি ভাব তা আসেনি। কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে সকালের আলসেমি কাটতেই যেন চায় না। নওমি যখন প্রথম এখানটায় এসে বসে তখন আশেপাশে অল্প একটু জায়গা ছাড়া দূরে কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না। তারপর তার চোখের সামনেই সূর্যের দস্যু আলো আস্তে আস্তে নিরাবরণ করলো সকালকে। এখন রাস্তায় মাঝে মাঝে দু একটা রিকশা চলছে। প্রায় সবই খালি অবশ্য। আরো একটু দূরে ফুটপাতের পাশের চায়ের দোকানে ধোয়ামোছা চলছে। চা বানানোর প্রস্তুতি। সকালের প্রথম চায়ের গন্ধের কথা মনে পড়ে তৃষ্ণা পেলো নওমির। কিন্তু এখান থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না। জোরে চিৎকার দিলে অবশ্য চায়ের দোকানের পিচ্চিটা চা দিয়ে যাবে। এ শান্ত সকালে চিৎকারও দিতে ইচ্ছে করছে না।
এত সকালে ইউনিভার্সিটিতে কেউ আসে না। সেন্ট্রাল লাইব্রেরির পেছন দিকে আসার সম্ভাবনা তো আরো কম। কবিতা উৎসব ছাড়া এখানটায় মানুষজন এমনিতেই আসে না। মাঝেমাঝে দু একটা জোড়া এসে বসে বটে। তবে রাজনীতির মহান রক্ষকদের শ্যেন দৃষ্টি থাকে তাদের উপর। ডাল মাল খাবার এমন ভালো জায়গায় অযথা উৎপাত তারা পছন্দ করে না। এখানে বসতেই নওমির ভালো লাগে। একটা পড়ে যাওয়া গাছের ডালে বসে আছে সে। গাছটা ঝড়ে পড়েছে দিন তিনেক আগে। শীতের অসময়ের ঝড়ে গাছটার পড়ে কার কী লাভ হয়েছে জানা নেই। তবে নওমির একটা লাভ হয়েছে। গাছের ডালপালার আড়ালে বেশ মজার একটা জায়গা পাওয়া গেছে। কেউ দেখতে পারছে না। অথচ নওমি দেখতে পারছে চারিদিক।
একা একা বসে থাকতে কখনোই খারাপ লাগে না ওর। আসলে একাই মনে হয় না নিজেকে। সকালের সাথেই কথা বলা যায়। চারিদিকের ছোটছোট ঝোপঝাড়ের বুনো গন্ধটাও মাথার মাঝে ঢুকে গুনগুন করে গান গায়। ঘাসগুলো যদিও খুব বেশি সবুজ নয়, তবু শিশির নিয়ে কথার তালে মাথা দোলাতে পারে তারা। গাছগুলোর মধ্যে যারা সিনিয়র, বুড়ো হয়ে গেছেন, তাদের নড়াচড়ার মধ্যেও কেমন একটা গম্ভীর ভাব থাকে। এরা কথা বলে খুব কম। শুধু বাতাসের দোলে বিরক্ত হয়ে মাঝে মাঝে সরসর শব্দ করে। নওমি ওদের খুব একটা ঘাটায় না। অবশ্য মনটা খুব খারাপ করলে তাদের একটার তলায় গিয়ে বসে। বিশাল কিছু একটার সামনা-সামনি ওর দু ধরনের অনুভূতি হয়। হয় ভয় পায়, না হলে সান্ত্বনা পায়। বেশির ভাগ সময় সান্ত্বনাই পায়।
মানুষের মনে হয় পেছন দিকেও চোখ থাকে। ওর মনে হলো কেউ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। পেছনে ফেরে অবশ্য কাউকে দেখতে পেলো না ও। তার মানে কি ওর অনুভূতি জানানোর স্নায়ুগুলো ঠিক মত কাজ করছে না। মানুষ মরে যাবার আগে আগে অথবা বেশি বয়স হয়ে গেলে এমন হয়। আস্তে আস্তে বিকল হতে থাকে শরীরের যন্ত্রপাতি। হাত মাথাকে বলে, বস আমরা ঠিকমত কাজ করতে পারছি না। ঠিকমত ধরতেই পারি না। কেমন খালি কাঁপে। পা বলে, বহুদিন তো শরীরটা টেনে বেড়ালাম এখন আর গাধার মত শরীর বয়ে বেড়াতে ভালো লাগে না। মাথার নিউরনগুলোও কাজ করতে পারে না, ভুলে যায় সবকিছু।
‘আপনি কতক্ষণ এখানে।’
সাদা চাদরে মোড়া ছেলেটির শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করে নাম ভুলে গেলো নওমি। এমন না যে এই প্রথম তাকে দেখলো। গত পাঁচ ছয় মাস ধরে নিয়মিত দেখা হয় ওর সাথে। কথা হয়। একসাথে হাঁটে বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা ছাড়িয়ে এ শহরের নানা পথে। ওর নাম ভুলে যাবার কোনো যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে না। হঠাৎ করে খুব অসহায় লাগলো তার।
‘কী ব্যাপার, কথা বলেন না কেন? আমার আসতে একটু দেরি হয়ে গেলো। ঘুম ভাঙসিলো অনেক আগেই। রাতে একটা বই পড়তে পড়তে ঘুমাইয়া গেসিলাম। চোখ খুলতেই মনে হইলো বইটা শেষ করি। শালা আমার রুমটাতে এত তাড়াতাড়ি সূর্যের আলো ঢুকে। চোখের উপর কড়কড় করে।’
‘কেন বই দিয়া চোখ ঢাকা যায় না?’
‘বই দিয়া ঢাকাও দেয়া যায় না। আলো আসে তো মাথার পেছন দিয়া। শেষে পড়াটাই বাদ দিলাম।’
ছেলেটার গায়ের চাদরটা অনেক নোংরা। প্যান্টটাও। চুলগুলো দড়ির মত পাকিয়ে মাথার উপরে দাঁড়িয়ে আছে। কয়দিন ধোয়া হয় না কে জানে। শিল্প, সাহিত্য আর দর্শনের কথা বললেই চুল কাটতে হবে না, পরিষ্কার জামা কাপড় পড়া যাবে না এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। যেকোনো ধরনের নোংরামি একদমই পছন্দ নয় নওমির। তারপরও কেন জানি এ পাগলের সাথে থাকতে ভালোই লাগে ওর। একটা কারণ হতে পারে কথা বলার ব্যাপ্তি আর গভীরতা। ওর ইউনিভার্সিটির বেশির ভাগ ক্লাসমেটদের মত চটুল আর হালকা নয়।
‘কী চা খাবেন নাকি? বিল্লাল তো দোকান খুলছে দেখলাম।’
নওমি কিছু বললো না। বলার অপেক্ষায়ও কেউ ছিলো না। একটা গগনবিদারী চিৎকারের প্রায় সাথে সাথেই চা চলে আসলো।
‘আপনি কি আসার সময়ই চায়ের কথা বলে আসছিলেন নাকি।’
‘ঐ যে রাস্তার ওপাশটায়। রাজু ভাস্কর্যের উল্টাদিকে। দেখতে পাচ্ছেন না? ঐ কোনাটায় ভালো একটা চায়ের দোকান আছে। ওরা আবার দুপুরে ভাত-তরকারিও করে। কাল খাইলাম। টেস্ট আছে ভালো। খাইসেন কখনো?’
প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে অভ্যাস আছে নওমির। কিন্তু কেউ প্রশ্ন করলে উত্তর না দিয়ে পারে না। প্রশ্নটা কেমন মাথার মাঝে ঘুরঘুর করে। ‘না খাই নাই কোনো দিন। ওখানে তো মাঝে মাঝে রিকশাওয়ালাদের খেতে দেখি।’
‘হ্যা। ওদের সাথে বসেই তো খাইলাম। যার পাশে বসছিলাম ওর বাড়িও জামালপুর। আমারে অবশ্য মনে হয় চিনে নাই। আমিও তো ওরে চিনি নাই। ওর বন্ধু, আরেক রিকশায়ালা, ভালো গান গায়। আমি চ্যালেঞ্জ দিলাম, বুঝছেন, বাপ্পার চেয়েও ভালো গান গায়। পিংক ফ্লয়েডের চাইতেও।’
‘তো?’
‘তো মানে। আপনি কি আন্ডার এস্টিমেট করছেন। গরীব হইসে তো কী হইসে? গান গাইতে পারবে না। এমন কোনো কথা আছে নাকি?’
‘আপনি শস্তা সিনেমার ডায়ালগ দিচ্ছেন। গানের পেছনে অনেক সময় খরচ করতে হয়। রেওয়াজ করতে হয়। একটা দীর্ঘ সময়ের প্রস্তুতি দরকার। এ ধরনের প্রস্তুতি সবাই নিতে পারে না। আপনার এ রিকশাওয়ালা কখনো এ সুযোগ পাইসে? বলেন? তাই ওর সম্ভাবনার মাত্রাও কম?’
‘দ্যাখেন, আপনি স্ট্যাটিসটিকসের ছাত্রী তো। অলওয়েজ প্রবাবিলিটি খুঁজেন। থিওরি দিয়ে লাইফ চলে না। লঞ্চে বরিশাল গেসেন কখনো। রাতে যাইতে হবে। আকাশে চাঁদ থাকবে। পুরাপুরি পূর্ণিমার জোস্না না থাকলেও হইবো। একটা জোস্না জোস্না ভাব থাকবো। একটুও ঘুমানো যাবে না। ডেকের মধ্যে হু হু করে হাওয়া। রাত দুটা তিনটা বাজে। বাতাস তখন কানের কাছে ঝাপটা মারে। চড়ের মত না। মোলায়েম, ভালো লাগার, আদর করার মত। তখন দূর থেকে ভেসে আসছিলো অদ্ভুত সুর। কোনো জেলে মনে হয়। রাতেই রিস্ক নিয়ে মাছ ধরে। কী ভরাট গলারে ভাই। বুকের মধ্যে ঢুকে যায়, মনটা কেমন খারাপ করে দেয়। এমন গান শুনতে পাবেন কোথাও। আপনার পছন্দের কোনো অ্যালবামে।’
কয়দিন আগে হঠাৎ করে ডুব দিয়েছিলো ও। নওমিকে কিছুই জানায় নি। এমন অবশ্য মাঝেই মাঝেই করে। তারপরও গা সহা হয়নি এখনো। খুব অস্থির লাগে। পরে প্রশ্ন করেও যথারীতি কোনো উত্তর পায়নি।
‘বরিশালে কী কাজে গেসলেন?’
‘বরিশাল তো যাই নাই। বরিশালের লঞ্চে উঠসিলাম।’
‘লঞ্চে উঠে?’
‘বরিশাল যাই নাই। আবার ঐ লঞ্চেই ফিরে আসছি। লঞ্চেই ঘুমাইয়া ছিলাম।’
চা অনেক আগেই ঠাণ্ডা হয়েছে। অবশ্য ঠাণ্ডা চা খেতেই অভ্যস্ত শুকনো মুখের ছেলেটি। চায়ের কাপ গালে ঠেকিয়ে বললো, ‘চলেন হেঁটে আসি।’
হাঁটাহাঁটিটা একটা শিল্পের জায়গায় নিয়ে গেছে এরা দুজন। প্রতিদিন কলাভবনের চারপাশ দিয়েই শুরু হয় তাদের পদযাত্রা। অপরাজেয় বাঙলার পাশ দিয়ে একটু এগিয়ে মলচত্বরের সমান্তরাল পথে হাঁটাচলা। এ সময়টায় জারুল তেমন ফোটে না, ভালোলাগা কৃষ্ণচূড়ারও নেই তেমন উৎপাত। পাতাঝরা শুকনো ডাল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুরনো বৃক্ষের নিচ দিয়েই হেঁটে যায় দুটি প্রাণ। হাওয়ায় ভেসে ভেসে ঝরাপাতার সাথে নামে কথার ঝুরি। এভাবেই শুরু হয় প্রতিদিনের একদিন। রুক্ষ প্রকৃতির মাঝেই জেগে ওঠে বাঙময় কচিপাতা। কথা হয় নানা বিষয়ে। কবিতা, গল্প, গান, দর্শন, ভালবাসা আর ভালবাসাবাসি নিয়ে।
টিএসসির পাশ দিয়ে একটু এগোলেই জগন্নাথ হলের সীমানা। আরো একটু সামনেই শহীদ মিনার। বেশির ভাগ মানুষই ফেব্র“য়ারি মাস ছাড়া এখানে আসে না। আসে। আন্দোলনে দাবি আদায়ের প্রয়োজনে বা অনুষ্ঠানের মিডিয়া কাভারেজ পাওয়ার জন্য শহীদ মিনার একটা ভালো জায়গা। তবে এসব লোকজনের ভিড়ে এ স্থাপত্যের আসল সৌন্দর্য বোঝা যায় না। নওমিরা সবসময় একটু অসময়ে শহীদ মিনারে আসে। এনেক্স বিল্ডিং-এ ক্লাশ শেষে ঝা ঝা দুপুরে বা খুব ভোরে। তখন স্থাপত্যের ভাষাটা বোঝা যায়। হাহাকারটা বুকের মধ্যে ঢোকে। ফুলার রোডটাও হাঁটার জন্য খারাপ না। তবে বড় বড় টাওয়ারগুলো গলায় কাঁটার মত বিঁধে। কেমন যেন বেমানান মনে হয়। তা বাদে এ এলাকার শান্ত সৌর্ন্দযকে এ শহর মরুভূমির মাঝে মরুদ্যান মনে হয়। এ মরুদ্যানে তৃষ্ণা মেটায় সুশীতল ছায়া। স্বপ্ন এসে যেন ধরা দেয় হাতের মুঠোয়।
ইউনিভার্সিটির একটা সুইমিং পুলও আছে। অনেক কষ্ট করে এখানে সাঁতার শিখেছে নওমি। পুলের ক্লোরিনের প্রভাবে বেশ কদিন কৃষ্ণবর্ণ নিয়ে ঘুরতে হয়েছে তার। তবে খারাপ লাগেনি। দুটি কারণে। এক নম্বর, কৃষ্ণবর্ণের প্রতি তার কোনো বিরাগ নেই। বরং আলাদা একটা ভালোলাগা আছে। দুই নম্বর, সাঁতারটা একটা বিশেষ কারণে শেখা খুব দরকার ছিলো। নওমির নদী খুব ভালো লাগা। নদীর ঢেউ তার হৃদয়ে এসে অপূর্ব এক অনুভূতির জন্ম দেয়। নদী যেন অদ্ভুত এক ভাষায় তাকে টানে। নৌকায় দীর্ঘ সময় কাটিয়েছে সে। বিরিসিরি, ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, বুড়িগঙ্গা, রূপসা–প্রায় সব নদীর সাথেই হয়েছে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। সাঁতার না শিখে নদীর বুকে চলাচলে যে তার খুব একটা অসুবিধা হতো তা কিন্তু নয়, মাঝে মাঝে মনে হতো ডুবে গেলে মন্দ হয় না। কিন্তু নদীতে ডোবার পর ডেডবডির যে অবস্থা হয়, ফুলে ঢোল হয়ে যায়, তা খুবই বিচ্ছিরি লাগে নওমির। তাই প্রিয়তম নদী সঙ্গমে মরতে চায় না সে। সৌন্দর্যটুকুই শুধু শুষে নিতে চায় প্রাণভরে।
কংক্রিটের দোয়েলের ঠোঁট ঘেঁষে বৃটিশ লর্ডের নামে লাল বিল্ডিংটা এক বিশেষ কারণে সারা জীবনই নওমির মনে থাকবে। সবুজ গালিচা ঘেরা সৌম্য সৌন্দর্য, পেছনে চুমুক দেয়া পুকুর–এসব নানা কারণই থাকতে পারে পুরনো শান্ত এ ভবনকে ভালোবাসার। কিংবা দুর্লভ নানা জাতের ফুল। কিন্তু এসব কারণকে ছাপিয়ে উঠেছে বিশেষ এক ঘটনা।
মাস আটেক আগের একদিন। অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্সের আহসানের সাথে দেখা করা দরকার। নওমি কেবল কার্জন হলের গেট দিয়ে ঢুকছে। চায়ের দোকানগুলোর পাশে সিঁড়িতেই আহসানের থাকার কথা। নেই। এ সময় সিগারেট বিক্রি করে এমন এক ছেলে ওর কাছে আসলো। টিনের এক বাক্সের উপর বেশ কিছু সিগারেটের প্যাকেট। বেনসন, গোল্ড লিফ, পলমল। নাসির বিড়ির প্যাকেটও আছে। একদিকে চকলেটের বৈয়াম। বেশ সাজানো গোছানো বাক্সটা ছেলেটার গলায় টকটকে লাল এক গামছা দিয়ে বাধা। ছেলেটি কাছে এসেই একটু হাসলো। ‘আপা, কারে খুঁজেন?’
নওমি বিরক্ত হলো না। ক্যাম্পাসের বেশির ভাগ তৃণমূল মানুষের সাথে ওর বেশ খাতির। দুপুরে খাওয়ার সময় এদের দুএকজনকে নিয়ে প্রায়ই খায় ও। এর চেহারাটা অবশ্য তেমন পরিচিত মনে হচ্ছে না। নওমি একটু হাসলো। ‘এক বন্ধুর সাথে দেখা হওয়ার কথারে। একটু দরকার ছিলো।’
‘আহসান ভাই নাকি? একটু আগেই ছিলো। শহীদুল্লাহ হলে গেছে। আমারে বইলা গেলো একজন আসবে।’
সিঁড়ির উপর বসলো নওমি। ওর পাশে ছেলেটিও।
‘কী দরকার আপনার উনার কাছে?’
এবার বিরক্ত হলো নওমি। এ ধরনের প্রশ্ন পছন্দ করে না ও। ‘কেন? জেনে কী হবে?’
‘না, এমনি জিগাইলাম। বলেন না।’
‘ওর কাছে একটা পড়াশুনার জিনিস বুঝতে আসছিলাম। কালকে হঠাৎ করে একটা বইয়ে এম থিওরি নামে একটা থিওরি, মানে কী বলবো, একটা পড়া যা দিয়ে অন্য আরো কিছু পড়া বোঝা যায়, ওটা বুঝতে আসছিলাম। ও যে সাবজেক্টে পড়ে ওটার সাথে মিল আছে।’
ছেলেটা কিছুক্ষণ নওমির দিকে তাকালো। তারপর আস্তে আস্তে বললো। ‘এম থিওরি তো অনেক জটিল। আহসানের বোঝাতে পারার কথা নয়। কারণ এ থিওরিটা এখনো ঠিকমত দাঁড়ায়নি। ফিজিক্সে সুপার স্ট্রিং থিওরি নামে আরেকটা ব্যাপার আছে। এরকম পাঁচটি থিওরি মিলিয়ে একসাথে এম থিওরি বলে। ক্রিস হল, পল টাউনসেন্ড আর, আর দু জনের নাম যেন কী। ও হ্যাঁ, জন শোয়ার্জ ও অশোক সেন। এ ব্যাটা সেন মনে হয় আমাদের এদিকেরই। এ পাঁচজনের থিওরিগুলো মিলে এম থিওরি। যেকোনো একটি বস্তু একটা সুপার স্ট্রিং থিওরিতে কী অবস্থায় আছে, আরেকটা বস্তু আরেকটা থিওরি অনুযায়ী আরেক অবস্থায় আছে, এ দু বস্তুর মধ্যে সম্পর্ক বের করা যায় এম থিওরি দিয়ে। খুব জটিল জিনিস। ঊনিশ শতকের আগেই ইলেকট্রিসিটি ও ম্যাগনেটিজমের মধ্যে সম্পর্ক আছে এটা ধারণা করা হতো। পরে ম্যাক্সওয়েল এসে তো থিওরি অভ ইলোকট্রোম্যাগনেটিজম বের করলো। ঊনিশশো সালের আগে এ থিওরিটা যেমন অবস্থায় ছিলো, এম থিওরিটাও এখন এ অবস্থায় আছে।’
ছেলেটার পায়ে একটা বাথরুমের স্লিপার। পরনে প্যান্টও না, রাতে শোয়ার মত দুমড়ানো মুচড়ানো ট্রাউজার। টি শার্টটাও মনে হচ্ছে কুড়িয়ে পাওয়া। এমনকি চোখের কোণে সাদা ময়লাও আছে। ছেলেটি ওর দিকে তাকিয়ে আবার হাসলো। ‘সরি, আপনাকে কনফিউজড করার জন্য। আমি আহসানের বন্ধু। ফিজিক্সেই পড়ি। আমি সজলেরও বন্ধু। মানে এ দোকান যার। ও নাস্তা করতে গেসে। ব্যবসাটা আমি দেখতেসি।’
‘কী হলো? অনেকক্ষণ ধরে কোনো কথা বলছেন না।’
‘এমনিই। আজ আগের কথা অনেক মনে পড়ছে। নানা ঘটনা। কেমন অস্থির লাগছে।’
‘আপনি কি যোগ ব্যায়াম করসেন কখনো?’ উত্তরের জন্য কোনো অপেক্ষা নেই। ‘বড় করে শ্বাস নেন। বুক ভরে, মানে হৃদয় ভরে। আস্তে আস্তে বাতাস ভিতরে নেন, আবার আস্তে আস্তে ছেড়ে দেন। ভালো লাগবে দেখেন। এর নাম হচ্ছে নিশ্বাসানন্দ চিকিৎসা।’
‘নিশ্বাসানন্দ?’
‘যে সন্নাসী এটা প্রথম উদ্ভাবন করসিলো উনার নাম নিশ্বাসানন্দ।’
‘য়ু আর লাইয়িং।’
‘আই অ্যাম।’
‘চুপ থাকেন।’
আবার নিঃসঙ্গতা সাথে নিয়ে হাঁটা। ন্যাওটা অস্থিরতা পিছে ছাড়ে না নওমির। ‘এই আমি যাই।’
‘কই যাবেন?’
‘টিউশ্যনিতে।’
‘আপনার টিউশ্যনি তো বিকেলে। এই সকালে যাবেন ক্যান?’
‘আমার টিউশ্যনির সময়ের তো ঠিক নাই। ভাল্লাগতেসে না এখানে। আপনি কই যাবেন।’
‘আমি কোথায় যাবো না। দেখি একটু গাঁজা খাবো।’
নওমির টিউশ্যনি বেইলি রোডে। একটা বিচ্ছিরি রুট। ইউনিভার্সিটি থেকে বাসে যাওয়া যায় না। রিকশা নিয়ে গেলে অনেক ঘুরে যেতে হয়। নওমি হেঁটেই যায়। শাহবাগ দিয়ে ডায়াবেটিক রোগীদের পাশ কাটিয়ে শেরাটন পার হলেই নিশ্চিন্তি। একটু নিরিবিলি।
শাহবাগের ফুলের বাগানে ফুল বিক্রি আজ বেশ। আজকে কত তারিখ? কী মাস? সামনে কি কোনো উপলক্ষ্য আছে নাকি। একুশে ফেব্রুয়ারি, ভ্যালেনটাইনস ডে, পহেলা ফাল্গুন, ক্রিসমাস। কিছু একটা। দিন মাস ঘণ্টার হিসাব কি রাখে বটের এই ঝিরিঝিরি পাতা। সৌন্দর্য আর সুগন্ধ বাণিজ্যের কতটুকু তাদের বোধের নাগালে? দিনটা আজ কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে। আজকে কি আবার ঝড় হবে নাকি। নওমি আকাশের দিকে তাকালো। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে কেমন রহস্যময় জালে আটকে আছে আকাশটা। বুড়ো গম্ভীর নির্জীব মুখে যেন তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ওখান থেকেই কি ভেসে আসছে মন খারাপ করা একটা গানের সুর। কী গান এটা। কথাগুলো ঠিক ধরতে পারছে না ও। সুরটা চেনা চেনা, রবীন্দ্রসঙ্গীত নাকি। না, বিদেশি গান মনে হচ্ছে। বিদেশি কোনো ফোক গানও হতে পারে। নওমির মাথায় সুরটা ঘুরতে লাগলো। ঝমঝম করে বাজছে অচেনা সঙ্গীতের অদ্ভুত ভালোলাগা বাজনা। তীব্র বিউগলের শব্দে সঙ্গীতের ছন্দপতন ঘটলো।
ঘাড় ফেরাতেই নওমি দেখলো বিশাল একটি বাস ওর দিকে ছুটে আসছে। বাসের গায়ে কো¬জআপের বিজ্ঞাপন। বড় বড় দাঁত বের করে দুটি ছেলেমেয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ভেঙচি কাটছে। না, হাসছে। ওর মনে হলো বাসভর্তি লোকজনই ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনও। সবার হাসি দেখে ওরও হাসি পেলো। দিগন্ত বিস্তৃত এক হলুদ ক্ষেতে দোল খেতে লাগলো ও। ছুটে বেড়াতে লাগলো সরিষা ক্ষেতের মাঝ দিয়ে। অবাক হয়ে দেখলো, ওর পা মাটিতে স্পর্শ করছে না। একরাশ আনন্দ নিয়ে হলুদ গালিচায় উড়ে উড়ে দূর কুয়াশার দিকে এগিয়ে চললো ও।
এত সকালে ইউনিভার্সিটিতে কেউ আসে না। সেন্ট্রাল লাইব্রেরির পেছন দিকে আসার সম্ভাবনা তো আরো কম। কবিতা উৎসব ছাড়া এখানটায় মানুষজন এমনিতেই আসে না। মাঝেমাঝে দু একটা জোড়া এসে বসে বটে। তবে রাজনীতির মহান রক্ষকদের শ্যেন দৃষ্টি থাকে তাদের উপর। ডাল মাল খাবার এমন ভালো জায়গায় অযথা উৎপাত তারা পছন্দ করে না। এখানে বসতেই নওমির ভালো লাগে। একটা পড়ে যাওয়া গাছের ডালে বসে আছে সে। গাছটা ঝড়ে পড়েছে দিন তিনেক আগে। শীতের অসময়ের ঝড়ে গাছটার পড়ে কার কী লাভ হয়েছে জানা নেই। তবে নওমির একটা লাভ হয়েছে। গাছের ডালপালার আড়ালে বেশ মজার একটা জায়গা পাওয়া গেছে। কেউ দেখতে পারছে না। অথচ নওমি দেখতে পারছে চারিদিক।
একা একা বসে থাকতে কখনোই খারাপ লাগে না ওর। আসলে একাই মনে হয় না নিজেকে। সকালের সাথেই কথা বলা যায়। চারিদিকের ছোটছোট ঝোপঝাড়ের বুনো গন্ধটাও মাথার মাঝে ঢুকে গুনগুন করে গান গায়। ঘাসগুলো যদিও খুব বেশি সবুজ নয়, তবু শিশির নিয়ে কথার তালে মাথা দোলাতে পারে তারা। গাছগুলোর মধ্যে যারা সিনিয়র, বুড়ো হয়ে গেছেন, তাদের নড়াচড়ার মধ্যেও কেমন একটা গম্ভীর ভাব থাকে। এরা কথা বলে খুব কম। শুধু বাতাসের দোলে বিরক্ত হয়ে মাঝে মাঝে সরসর শব্দ করে। নওমি ওদের খুব একটা ঘাটায় না। অবশ্য মনটা খুব খারাপ করলে তাদের একটার তলায় গিয়ে বসে। বিশাল কিছু একটার সামনা-সামনি ওর দু ধরনের অনুভূতি হয়। হয় ভয় পায়, না হলে সান্ত্বনা পায়। বেশির ভাগ সময় সান্ত্বনাই পায়।
মানুষের মনে হয় পেছন দিকেও চোখ থাকে। ওর মনে হলো কেউ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। পেছনে ফেরে অবশ্য কাউকে দেখতে পেলো না ও। তার মানে কি ওর অনুভূতি জানানোর স্নায়ুগুলো ঠিক মত কাজ করছে না। মানুষ মরে যাবার আগে আগে অথবা বেশি বয়স হয়ে গেলে এমন হয়। আস্তে আস্তে বিকল হতে থাকে শরীরের যন্ত্রপাতি। হাত মাথাকে বলে, বস আমরা ঠিকমত কাজ করতে পারছি না। ঠিকমত ধরতেই পারি না। কেমন খালি কাঁপে। পা বলে, বহুদিন তো শরীরটা টেনে বেড়ালাম এখন আর গাধার মত শরীর বয়ে বেড়াতে ভালো লাগে না। মাথার নিউরনগুলোও কাজ করতে পারে না, ভুলে যায় সবকিছু।
‘আপনি কতক্ষণ এখানে।’
সাদা চাদরে মোড়া ছেলেটির শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করে নাম ভুলে গেলো নওমি। এমন না যে এই প্রথম তাকে দেখলো। গত পাঁচ ছয় মাস ধরে নিয়মিত দেখা হয় ওর সাথে। কথা হয়। একসাথে হাঁটে বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা ছাড়িয়ে এ শহরের নানা পথে। ওর নাম ভুলে যাবার কোনো যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে না। হঠাৎ করে খুব অসহায় লাগলো তার।
‘কী ব্যাপার, কথা বলেন না কেন? আমার আসতে একটু দেরি হয়ে গেলো। ঘুম ভাঙসিলো অনেক আগেই। রাতে একটা বই পড়তে পড়তে ঘুমাইয়া গেসিলাম। চোখ খুলতেই মনে হইলো বইটা শেষ করি। শালা আমার রুমটাতে এত তাড়াতাড়ি সূর্যের আলো ঢুকে। চোখের উপর কড়কড় করে।’
‘কেন বই দিয়া চোখ ঢাকা যায় না?’
‘বই দিয়া ঢাকাও দেয়া যায় না। আলো আসে তো মাথার পেছন দিয়া। শেষে পড়াটাই বাদ দিলাম।’
ছেলেটার গায়ের চাদরটা অনেক নোংরা। প্যান্টটাও। চুলগুলো দড়ির মত পাকিয়ে মাথার উপরে দাঁড়িয়ে আছে। কয়দিন ধোয়া হয় না কে জানে। শিল্প, সাহিত্য আর দর্শনের কথা বললেই চুল কাটতে হবে না, পরিষ্কার জামা কাপড় পড়া যাবে না এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। যেকোনো ধরনের নোংরামি একদমই পছন্দ নয় নওমির। তারপরও কেন জানি এ পাগলের সাথে থাকতে ভালোই লাগে ওর। একটা কারণ হতে পারে কথা বলার ব্যাপ্তি আর গভীরতা। ওর ইউনিভার্সিটির বেশির ভাগ ক্লাসমেটদের মত চটুল আর হালকা নয়।
‘কী চা খাবেন নাকি? বিল্লাল তো দোকান খুলছে দেখলাম।’
নওমি কিছু বললো না। বলার অপেক্ষায়ও কেউ ছিলো না। একটা গগনবিদারী চিৎকারের প্রায় সাথে সাথেই চা চলে আসলো।
‘আপনি কি আসার সময়ই চায়ের কথা বলে আসছিলেন নাকি।’
‘ঐ যে রাস্তার ওপাশটায়। রাজু ভাস্কর্যের উল্টাদিকে। দেখতে পাচ্ছেন না? ঐ কোনাটায় ভালো একটা চায়ের দোকান আছে। ওরা আবার দুপুরে ভাত-তরকারিও করে। কাল খাইলাম। টেস্ট আছে ভালো। খাইসেন কখনো?’
প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে অভ্যাস আছে নওমির। কিন্তু কেউ প্রশ্ন করলে উত্তর না দিয়ে পারে না। প্রশ্নটা কেমন মাথার মাঝে ঘুরঘুর করে। ‘না খাই নাই কোনো দিন। ওখানে তো মাঝে মাঝে রিকশাওয়ালাদের খেতে দেখি।’
‘হ্যা। ওদের সাথে বসেই তো খাইলাম। যার পাশে বসছিলাম ওর বাড়িও জামালপুর। আমারে অবশ্য মনে হয় চিনে নাই। আমিও তো ওরে চিনি নাই। ওর বন্ধু, আরেক রিকশায়ালা, ভালো গান গায়। আমি চ্যালেঞ্জ দিলাম, বুঝছেন, বাপ্পার চেয়েও ভালো গান গায়। পিংক ফ্লয়েডের চাইতেও।’
‘তো?’
‘তো মানে। আপনি কি আন্ডার এস্টিমেট করছেন। গরীব হইসে তো কী হইসে? গান গাইতে পারবে না। এমন কোনো কথা আছে নাকি?’
‘আপনি শস্তা সিনেমার ডায়ালগ দিচ্ছেন। গানের পেছনে অনেক সময় খরচ করতে হয়। রেওয়াজ করতে হয়। একটা দীর্ঘ সময়ের প্রস্তুতি দরকার। এ ধরনের প্রস্তুতি সবাই নিতে পারে না। আপনার এ রিকশাওয়ালা কখনো এ সুযোগ পাইসে? বলেন? তাই ওর সম্ভাবনার মাত্রাও কম?’
‘দ্যাখেন, আপনি স্ট্যাটিসটিকসের ছাত্রী তো। অলওয়েজ প্রবাবিলিটি খুঁজেন। থিওরি দিয়ে লাইফ চলে না। লঞ্চে বরিশাল গেসেন কখনো। রাতে যাইতে হবে। আকাশে চাঁদ থাকবে। পুরাপুরি পূর্ণিমার জোস্না না থাকলেও হইবো। একটা জোস্না জোস্না ভাব থাকবো। একটুও ঘুমানো যাবে না। ডেকের মধ্যে হু হু করে হাওয়া। রাত দুটা তিনটা বাজে। বাতাস তখন কানের কাছে ঝাপটা মারে। চড়ের মত না। মোলায়েম, ভালো লাগার, আদর করার মত। তখন দূর থেকে ভেসে আসছিলো অদ্ভুত সুর। কোনো জেলে মনে হয়। রাতেই রিস্ক নিয়ে মাছ ধরে। কী ভরাট গলারে ভাই। বুকের মধ্যে ঢুকে যায়, মনটা কেমন খারাপ করে দেয়। এমন গান শুনতে পাবেন কোথাও। আপনার পছন্দের কোনো অ্যালবামে।’
কয়দিন আগে হঠাৎ করে ডুব দিয়েছিলো ও। নওমিকে কিছুই জানায় নি। এমন অবশ্য মাঝেই মাঝেই করে। তারপরও গা সহা হয়নি এখনো। খুব অস্থির লাগে। পরে প্রশ্ন করেও যথারীতি কোনো উত্তর পায়নি।
‘বরিশালে কী কাজে গেসলেন?’
‘বরিশাল তো যাই নাই। বরিশালের লঞ্চে উঠসিলাম।’
‘লঞ্চে উঠে?’
‘বরিশাল যাই নাই। আবার ঐ লঞ্চেই ফিরে আসছি। লঞ্চেই ঘুমাইয়া ছিলাম।’
চা অনেক আগেই ঠাণ্ডা হয়েছে। অবশ্য ঠাণ্ডা চা খেতেই অভ্যস্ত শুকনো মুখের ছেলেটি। চায়ের কাপ গালে ঠেকিয়ে বললো, ‘চলেন হেঁটে আসি।’
হাঁটাহাঁটিটা একটা শিল্পের জায়গায় নিয়ে গেছে এরা দুজন। প্রতিদিন কলাভবনের চারপাশ দিয়েই শুরু হয় তাদের পদযাত্রা। অপরাজেয় বাঙলার পাশ দিয়ে একটু এগিয়ে মলচত্বরের সমান্তরাল পথে হাঁটাচলা। এ সময়টায় জারুল তেমন ফোটে না, ভালোলাগা কৃষ্ণচূড়ারও নেই তেমন উৎপাত। পাতাঝরা শুকনো ডাল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুরনো বৃক্ষের নিচ দিয়েই হেঁটে যায় দুটি প্রাণ। হাওয়ায় ভেসে ভেসে ঝরাপাতার সাথে নামে কথার ঝুরি। এভাবেই শুরু হয় প্রতিদিনের একদিন। রুক্ষ প্রকৃতির মাঝেই জেগে ওঠে বাঙময় কচিপাতা। কথা হয় নানা বিষয়ে। কবিতা, গল্প, গান, দর্শন, ভালবাসা আর ভালবাসাবাসি নিয়ে।
টিএসসির পাশ দিয়ে একটু এগোলেই জগন্নাথ হলের সীমানা। আরো একটু সামনেই শহীদ মিনার। বেশির ভাগ মানুষই ফেব্র“য়ারি মাস ছাড়া এখানে আসে না। আসে। আন্দোলনে দাবি আদায়ের প্রয়োজনে বা অনুষ্ঠানের মিডিয়া কাভারেজ পাওয়ার জন্য শহীদ মিনার একটা ভালো জায়গা। তবে এসব লোকজনের ভিড়ে এ স্থাপত্যের আসল সৌন্দর্য বোঝা যায় না। নওমিরা সবসময় একটু অসময়ে শহীদ মিনারে আসে। এনেক্স বিল্ডিং-এ ক্লাশ শেষে ঝা ঝা দুপুরে বা খুব ভোরে। তখন স্থাপত্যের ভাষাটা বোঝা যায়। হাহাকারটা বুকের মধ্যে ঢোকে। ফুলার রোডটাও হাঁটার জন্য খারাপ না। তবে বড় বড় টাওয়ারগুলো গলায় কাঁটার মত বিঁধে। কেমন যেন বেমানান মনে হয়। তা বাদে এ এলাকার শান্ত সৌর্ন্দযকে এ শহর মরুভূমির মাঝে মরুদ্যান মনে হয়। এ মরুদ্যানে তৃষ্ণা মেটায় সুশীতল ছায়া। স্বপ্ন এসে যেন ধরা দেয় হাতের মুঠোয়।
ইউনিভার্সিটির একটা সুইমিং পুলও আছে। অনেক কষ্ট করে এখানে সাঁতার শিখেছে নওমি। পুলের ক্লোরিনের প্রভাবে বেশ কদিন কৃষ্ণবর্ণ নিয়ে ঘুরতে হয়েছে তার। তবে খারাপ লাগেনি। দুটি কারণে। এক নম্বর, কৃষ্ণবর্ণের প্রতি তার কোনো বিরাগ নেই। বরং আলাদা একটা ভালোলাগা আছে। দুই নম্বর, সাঁতারটা একটা বিশেষ কারণে শেখা খুব দরকার ছিলো। নওমির নদী খুব ভালো লাগা। নদীর ঢেউ তার হৃদয়ে এসে অপূর্ব এক অনুভূতির জন্ম দেয়। নদী যেন অদ্ভুত এক ভাষায় তাকে টানে। নৌকায় দীর্ঘ সময় কাটিয়েছে সে। বিরিসিরি, ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, বুড়িগঙ্গা, রূপসা–প্রায় সব নদীর সাথেই হয়েছে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। সাঁতার না শিখে নদীর বুকে চলাচলে যে তার খুব একটা অসুবিধা হতো তা কিন্তু নয়, মাঝে মাঝে মনে হতো ডুবে গেলে মন্দ হয় না। কিন্তু নদীতে ডোবার পর ডেডবডির যে অবস্থা হয়, ফুলে ঢোল হয়ে যায়, তা খুবই বিচ্ছিরি লাগে নওমির। তাই প্রিয়তম নদী সঙ্গমে মরতে চায় না সে। সৌন্দর্যটুকুই শুধু শুষে নিতে চায় প্রাণভরে।
কংক্রিটের দোয়েলের ঠোঁট ঘেঁষে বৃটিশ লর্ডের নামে লাল বিল্ডিংটা এক বিশেষ কারণে সারা জীবনই নওমির মনে থাকবে। সবুজ গালিচা ঘেরা সৌম্য সৌন্দর্য, পেছনে চুমুক দেয়া পুকুর–এসব নানা কারণই থাকতে পারে পুরনো শান্ত এ ভবনকে ভালোবাসার। কিংবা দুর্লভ নানা জাতের ফুল। কিন্তু এসব কারণকে ছাপিয়ে উঠেছে বিশেষ এক ঘটনা।
মাস আটেক আগের একদিন। অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্সের আহসানের সাথে দেখা করা দরকার। নওমি কেবল কার্জন হলের গেট দিয়ে ঢুকছে। চায়ের দোকানগুলোর পাশে সিঁড়িতেই আহসানের থাকার কথা। নেই। এ সময় সিগারেট বিক্রি করে এমন এক ছেলে ওর কাছে আসলো। টিনের এক বাক্সের উপর বেশ কিছু সিগারেটের প্যাকেট। বেনসন, গোল্ড লিফ, পলমল। নাসির বিড়ির প্যাকেটও আছে। একদিকে চকলেটের বৈয়াম। বেশ সাজানো গোছানো বাক্সটা ছেলেটার গলায় টকটকে লাল এক গামছা দিয়ে বাধা। ছেলেটি কাছে এসেই একটু হাসলো। ‘আপা, কারে খুঁজেন?’
নওমি বিরক্ত হলো না। ক্যাম্পাসের বেশির ভাগ তৃণমূল মানুষের সাথে ওর বেশ খাতির। দুপুরে খাওয়ার সময় এদের দুএকজনকে নিয়ে প্রায়ই খায় ও। এর চেহারাটা অবশ্য তেমন পরিচিত মনে হচ্ছে না। নওমি একটু হাসলো। ‘এক বন্ধুর সাথে দেখা হওয়ার কথারে। একটু দরকার ছিলো।’
‘আহসান ভাই নাকি? একটু আগেই ছিলো। শহীদুল্লাহ হলে গেছে। আমারে বইলা গেলো একজন আসবে।’
সিঁড়ির উপর বসলো নওমি। ওর পাশে ছেলেটিও।
‘কী দরকার আপনার উনার কাছে?’
এবার বিরক্ত হলো নওমি। এ ধরনের প্রশ্ন পছন্দ করে না ও। ‘কেন? জেনে কী হবে?’
‘না, এমনি জিগাইলাম। বলেন না।’
‘ওর কাছে একটা পড়াশুনার জিনিস বুঝতে আসছিলাম। কালকে হঠাৎ করে একটা বইয়ে এম থিওরি নামে একটা থিওরি, মানে কী বলবো, একটা পড়া যা দিয়ে অন্য আরো কিছু পড়া বোঝা যায়, ওটা বুঝতে আসছিলাম। ও যে সাবজেক্টে পড়ে ওটার সাথে মিল আছে।’
ছেলেটা কিছুক্ষণ নওমির দিকে তাকালো। তারপর আস্তে আস্তে বললো। ‘এম থিওরি তো অনেক জটিল। আহসানের বোঝাতে পারার কথা নয়। কারণ এ থিওরিটা এখনো ঠিকমত দাঁড়ায়নি। ফিজিক্সে সুপার স্ট্রিং থিওরি নামে আরেকটা ব্যাপার আছে। এরকম পাঁচটি থিওরি মিলিয়ে একসাথে এম থিওরি বলে। ক্রিস হল, পল টাউনসেন্ড আর, আর দু জনের নাম যেন কী। ও হ্যাঁ, জন শোয়ার্জ ও অশোক সেন। এ ব্যাটা সেন মনে হয় আমাদের এদিকেরই। এ পাঁচজনের থিওরিগুলো মিলে এম থিওরি। যেকোনো একটি বস্তু একটা সুপার স্ট্রিং থিওরিতে কী অবস্থায় আছে, আরেকটা বস্তু আরেকটা থিওরি অনুযায়ী আরেক অবস্থায় আছে, এ দু বস্তুর মধ্যে সম্পর্ক বের করা যায় এম থিওরি দিয়ে। খুব জটিল জিনিস। ঊনিশ শতকের আগেই ইলেকট্রিসিটি ও ম্যাগনেটিজমের মধ্যে সম্পর্ক আছে এটা ধারণা করা হতো। পরে ম্যাক্সওয়েল এসে তো থিওরি অভ ইলোকট্রোম্যাগনেটিজম বের করলো। ঊনিশশো সালের আগে এ থিওরিটা যেমন অবস্থায় ছিলো, এম থিওরিটাও এখন এ অবস্থায় আছে।’
ছেলেটার পায়ে একটা বাথরুমের স্লিপার। পরনে প্যান্টও না, রাতে শোয়ার মত দুমড়ানো মুচড়ানো ট্রাউজার। টি শার্টটাও মনে হচ্ছে কুড়িয়ে পাওয়া। এমনকি চোখের কোণে সাদা ময়লাও আছে। ছেলেটি ওর দিকে তাকিয়ে আবার হাসলো। ‘সরি, আপনাকে কনফিউজড করার জন্য। আমি আহসানের বন্ধু। ফিজিক্সেই পড়ি। আমি সজলেরও বন্ধু। মানে এ দোকান যার। ও নাস্তা করতে গেসে। ব্যবসাটা আমি দেখতেসি।’
‘কী হলো? অনেকক্ষণ ধরে কোনো কথা বলছেন না।’
‘এমনিই। আজ আগের কথা অনেক মনে পড়ছে। নানা ঘটনা। কেমন অস্থির লাগছে।’
‘আপনি কি যোগ ব্যায়াম করসেন কখনো?’ উত্তরের জন্য কোনো অপেক্ষা নেই। ‘বড় করে শ্বাস নেন। বুক ভরে, মানে হৃদয় ভরে। আস্তে আস্তে বাতাস ভিতরে নেন, আবার আস্তে আস্তে ছেড়ে দেন। ভালো লাগবে দেখেন। এর নাম হচ্ছে নিশ্বাসানন্দ চিকিৎসা।’
‘নিশ্বাসানন্দ?’
‘যে সন্নাসী এটা প্রথম উদ্ভাবন করসিলো উনার নাম নিশ্বাসানন্দ।’
‘য়ু আর লাইয়িং।’
‘আই অ্যাম।’
‘চুপ থাকেন।’
আবার নিঃসঙ্গতা সাথে নিয়ে হাঁটা। ন্যাওটা অস্থিরতা পিছে ছাড়ে না নওমির। ‘এই আমি যাই।’
‘কই যাবেন?’
‘টিউশ্যনিতে।’
‘আপনার টিউশ্যনি তো বিকেলে। এই সকালে যাবেন ক্যান?’
‘আমার টিউশ্যনির সময়ের তো ঠিক নাই। ভাল্লাগতেসে না এখানে। আপনি কই যাবেন।’
‘আমি কোথায় যাবো না। দেখি একটু গাঁজা খাবো।’
নওমির টিউশ্যনি বেইলি রোডে। একটা বিচ্ছিরি রুট। ইউনিভার্সিটি থেকে বাসে যাওয়া যায় না। রিকশা নিয়ে গেলে অনেক ঘুরে যেতে হয়। নওমি হেঁটেই যায়। শাহবাগ দিয়ে ডায়াবেটিক রোগীদের পাশ কাটিয়ে শেরাটন পার হলেই নিশ্চিন্তি। একটু নিরিবিলি।
শাহবাগের ফুলের বাগানে ফুল বিক্রি আজ বেশ। আজকে কত তারিখ? কী মাস? সামনে কি কোনো উপলক্ষ্য আছে নাকি। একুশে ফেব্রুয়ারি, ভ্যালেনটাইনস ডে, পহেলা ফাল্গুন, ক্রিসমাস। কিছু একটা। দিন মাস ঘণ্টার হিসাব কি রাখে বটের এই ঝিরিঝিরি পাতা। সৌন্দর্য আর সুগন্ধ বাণিজ্যের কতটুকু তাদের বোধের নাগালে? দিনটা আজ কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে। আজকে কি আবার ঝড় হবে নাকি। নওমি আকাশের দিকে তাকালো। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে কেমন রহস্যময় জালে আটকে আছে আকাশটা। বুড়ো গম্ভীর নির্জীব মুখে যেন তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ওখান থেকেই কি ভেসে আসছে মন খারাপ করা একটা গানের সুর। কী গান এটা। কথাগুলো ঠিক ধরতে পারছে না ও। সুরটা চেনা চেনা, রবীন্দ্রসঙ্গীত নাকি। না, বিদেশি গান মনে হচ্ছে। বিদেশি কোনো ফোক গানও হতে পারে। নওমির মাথায় সুরটা ঘুরতে লাগলো। ঝমঝম করে বাজছে অচেনা সঙ্গীতের অদ্ভুত ভালোলাগা বাজনা। তীব্র বিউগলের শব্দে সঙ্গীতের ছন্দপতন ঘটলো।
ঘাড় ফেরাতেই নওমি দেখলো বিশাল একটি বাস ওর দিকে ছুটে আসছে। বাসের গায়ে কো¬জআপের বিজ্ঞাপন। বড় বড় দাঁত বের করে দুটি ছেলেমেয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ভেঙচি কাটছে। না, হাসছে। ওর মনে হলো বাসভর্তি লোকজনই ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনও। সবার হাসি দেখে ওরও হাসি পেলো। দিগন্ত বিস্তৃত এক হলুদ ক্ষেতে দোল খেতে লাগলো ও। ছুটে বেড়াতে লাগলো সরিষা ক্ষেতের মাঝ দিয়ে। অবাক হয়ে দেখলো, ওর পা মাটিতে স্পর্শ করছে না। একরাশ আনন্দ নিয়ে হলুদ গালিচায় উড়ে উড়ে দূর কুয়াশার দিকে এগিয়ে চললো ও।
=====================
গল্প- আলিমের নিভৃতিচর্চা by রাশিদা সুলতানা গল্প- প্রত্যাবর্তন: আমার ‘ফেরা’ নিয়ে যে কাহিনী না ..মানষ চৌঃ গল্প- 'বীচিকলায় ঢেকে যায় মুখ ও শিরোনাম' by আনোয়ার ... গল্প- 'প্রীত পরায়া' by সিউতি সবুর গল্প- 'চলিতেছে' by মাহবুব মোর্শেদ গল্প- 'গোপন কথাটি' by উম্মে মুসলিমা গল্প- 'রূপকথা' by লুনা রুশদী সঞ্জীব চৌধুরীর কয়েকটি গল্প গল্প- 'অস্বস্তির সঙ্গে বসবাস' by ফাহমিদুল হক গল্প- 'মঙ্গামনস্ক শরীরীমুদ্রা' by ইমতিয়ার শামীম গল্প- 'হাজেরার বাপের দাইক দেনা' by জিয়া হাশান গল্প- ‘অপঘাতে মৃত্যু’ ও ‘সাদামাটা’ by লীসা গাজী গল্প- 'দ্বিতীয় জীবন' by ইরাজ আহমেদ গল্প- 'পুষ্পের মঞ্জিল' by সাগুফতা শারমীন তানিয়া গল্প- 'একশ ছেচল্লিশ টাকার গল্প' by কৌশিক আহমেদ গল্প- 'একে আমরা কাকতালীয় বলতে পারি' by মঈনুল আহসান.. গল্প 'গহ্বর' by জাহিদ হায়দার গল্প- 'পুরির গল্প' by ইমরুল হাসান
bdnews24 এর সৌজন্যে
লেখকঃ সাইমুম পারভেজ
এই গল্পটি পড়া হয়েছে...
লেখকঃ সাইমুম পারভেজ
এই গল্পটি পড়া হয়েছে...
No comments