গল্প 'গহ্বর' by জাহিদ হায়দার

১.
এক হালকা বৃষ্টির সন্ধ্যায় রিয়ার সঙ্গে রিংকুর বিয়ে হলো, বেজেছিল সানাই।

বিবাহ, এই শব্দ উচ্চারণে আজও অনেকের মনে শিহরণ জাগে। শিহরণে চোখ চঞ্চল হয়। চঞ্চলতা যে ছবি ধরে, সেখানে প্রকাশিত আনন্দকর সঙ্গ। বিবাহের পরে অনেকের মধ্যে বিবাহ বিষয়ে বিষাদ জন্মায়। এ কী এক জটজটিল খাঁচা! মুক্তি আসবে কীভাবে? কবে রেহাই পাওয়া যাবে। বৌটা মরে না কেন, স্বামীটা বেঁচে আছে কেন? আবার অনেকে মনে করে, আহা কী আনন্দ, দুজন বৃষ্টির দিনে হালকা নরম কাঁথার নিচে। কাঁথা ছাড়া অন্য কোনোকিছুতে বিহ্বলতা আসে না, বিশেষ করে বঙ্গে যাদের জন্ম, তাদের। আজকাল এই বাংলাদেশেও, শোনা যায়, অনেক তরুণতরুণী পাশ্চাত্য-ধরনে বিয়ে না করেই একসঙ্গে থাকাথাকি করে। ঐ থাকাথাকির ভেতর আছে প্রয়োজন আর শরীর-সম্পর্কের কথা। এদের কাছে বিবাহ প্রাচীন প্রতিষ্ঠান। প্রাচীনে কে থাকিতে চায় রে কে থাকিতে চায়! প্রেম চলা পর্বে রিংকুকে হাসি টেনে রিয়া বলেছিল, লিভ টুগেদার করলে কেমন হয়? সংক্ষেপে রিংকুও হেসে বলেছিল, তুমি আর আমি মনে হয় অতটা ওয়েস্টার্ন হইনি, আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র ঐসব টুগেদাররে অনুমতি দেয় না।

মহসিন হাফিজ, ডাক নাম রিংক, সুদর্শন তরুণ। এক বহুজাতিক কোম্পানিতে অনেক বেতনের চাকরী করে। অফিসে হাফ হাতা শার্ট পরে না। বহুজাতিকের অনেক কৌশলের এই একটি কৌশল; কর্মীদের, বিশেষ করে এই দেশের কর্মীদের টাই, বেল্ট, পলিশ করা জুতো, সফ্ট কালারের, বিশেষ করে হালকা নীল কাপড়ের ফুল স্লিভ শার্ট, পরতে হয়। অকারণে ইংরেজি বলতে হয়। কথায় কথায় প্লিজ, থ্যাঙ্কিউ, এক্সকিউজমি বলতে হয় মৃদু হেসে। না হাসলে অফিস-ম্যানারের ঘাটতি পড়ে। রিংকুর প্যান্টের ঝুল ৪১, কোমর ৩৩, উচ্চতা ৫ ফিট ৯ ইঞ্চি, মাথায় চুল কম। শরীর গরম গরম থাকে। সিংহ রাশির জাতক। ঐ রাশির জাতকদের শরীর নাকি গরম গরমই থাকে, রিংকুর এক পামিস্ট বন্ধু বলেছিল। চুল বাড়াবার জন্যে অনেক রকম টনিক গিলেছে। কাজ হয়নি। অনেক রকম হারবাল চুলে ঘষেছে, ওতেও কাজ হয়নি। চুলে হারবাল লাগানো দেখে ছোট বোন শিলা অনেকবার বলেছে, তোমার চুল পড়া বন্ধ হবে না। রিংকু এখন বলে, ইটস আ ফ্যামিলি প্রবলেম, আমার ছোট আঙ্কেলের তো ২৫/২৬ থেকেই টাক হয়ে যাচ্ছিল।
জীবনের লক্ষ্য ঠিক করা কঠিন কাজ। এই দেশের মানুষ সাধারণত কম বয়েসে বড় বড় সিদ্ধান্ত নিতেই পারে না। লক্ষ্য ঠিক করতে পারে না। কিন্তু মাত্র ১৬ বছর বয়সেই রিংকু সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, অপরিচিত মেয়েকে কখনোই বিয়ে করবে না। বিয়ের আগে প্রেম করতে হবে। প্রেমকে ভালবাসার সুন্দর আগুনে পুড়িয়ে ‘যে আমারে দেখিবারে পায় অসীম ক্ষমায় ভালমন্দ মিলায়ে সকলি’র মতো ‘লাবণ্য’ময় করে তুলতে হবে। বিনোদন পত্রিকায়, মেয়েরা পুরুষের মধ্যে কী কী গুণাবলি পছন্দ করে,কী কী করে না, মেয়েদের সঙ্গে কীভাবে কথা বললে, মেয়েরা কথা-বলা পুরুষকে আকাঙ্খা করে–এইসব রিংকু কলেজের দরজা পার হওয়ার পরে খুঁজে খঁজে পড়তো। মেয়েদের শরীর নিয়ে, মনের মহল নিয়ে কত রাত নিদ্রাহীন কেটেছে তার, কতবার যে শরীরাঙ্গ উষ্ণ হয়েছে, হিসাব নাই। হিসাব করবার দরকারই বা কী!

ভালবেসে বিয়ে করবার ধারণা তার মাথায় প্রথমে আসে ১৫ বছর বয়সে। তখন তার গোঁফ উঠেছে। আয়নার সামনে একদিন নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে হেসেছিল। বোন শিলা পাশের ঘর থেকে জিগ্যেশ করেছিল, কী হলো, দরজা বন্ধ করে হাসছো কেন? উত্তরে নগ্ন কিশোর বলেছিল, এমনি। ‘এমনি’ এই শব্দের ভেতর অনেক রহস্য ঘুরপাক খায়। শ্রোতা তার অর্থ বোঝে না। আয়নায় নিজেকে দেখার দুদিন পরে ওদের শান্তিনগরের দোতলা বাসায় এসেছিলেন এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়। তিনি বায়োকেমিস্ট্রিতে পিএইচডি করবার জন্যে আড়াই বছর লন্ডনে ছিলেন। ১৫ বাই ১২ সাইজের অফ হোয়াইট রং করা ড্রয়িং রুমে বসে তিনি লন্ডনের গল্প করেছিলেন। গল্পের মাঝখানে একবার বলেছিলেন, ও-দেশে প্রেম করা ছাড়া কেউ বিয়ের কথা চিন্তাই করতে পারে না। অচেনা কাউকে কি বিয়ে করা যায়, অসম্ভব। বিয়ে করার আগে, ছেলেমেয়ে একসাথে থাকে, দুজন দুজনকে বোঝে। তারপর বিয়ে করবার দরকার হলে বিয়ে করে। কোনো অসুবিধা নেই, কেউ ও নিয়ে মাথাই ঘামায় না। বিলেতি মানুষের বিবাহপূর্ব প্রেম আর ভালবাসার গল্প রিংকুকে ভাবায়। সেদিন, আত্মীয়কে জিগ্যেশ করতে পারেনি, বিবাহপূর্ব প্রেমের সময় ওরা নিয়মিত শয্যায় যায় কি-না। এ লেবেল পড়া এক বন্ধুকে, যার কাছে প্রথম রিংকু প্লেবয় দেখেছিল, বন্ধুটি তার বাবামার বিছানার তল থেকে পত্রিকাটি আনে, লন্ডনের তরুণতরুণীদের মেলামেশার কথা বলে রিংকু প্রশ্ন করেছিল, তরুণতরুণীরা যখন একসাথে থাকে তখন নিশ্চয়ই সেক্সও করে, সঙ্গম শব্দটি রিংকু বলেনি। বন্ধুটি উত্তরে বলেছিল, না নুনু দাঁড়ালে ছেলেরা নুনুতে ঠাণ্ডা পানি দেয়, শীতের দেশ তো। সঙ্গের অন্য বন্ধুরা রিংকুকে বলেছিল, তুই একটা টোটাল গোট। সেদিন মধ্যরাত পর্যন্ত রিংকু ঘুমাতে পারেনি। যখনি চোখ একটু লেগে এসেছে, চোখের পর্দায় সুন্দর স্তন, নিতম্ব আর উরু সমৃদ্ধ প্লেবয়ের শাদা নারীরা কী দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছে। নগ্ন নারীর নৃত্যময় শরীর চোখের সামনে থাকলে সাধুরও তো ঘুম আসে না। একটি ছবি চোখ থেকে কিছুতেই রিংকু সরাতে পারছিল না, নগ্ন এক তরুণী সমুদ্র সৈকত ধরে হেঁটে যাচ্ছে, তার ঠিক স্তনের পাশ দিয়ে ডুবছে সূর্য। ভোরের দিকে স্বপ্নের ভেতর এক নারী রিংকুকে রেপ করে। কী সুখকর শিহরণ! সে কথা বলতে অনেক আর্য ভাষা লাগে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রিংকুর বিষয় ছিল সমাজবিজ্ঞান। সাধারণ মানের ছাত্র ছিল। অনার্স আর এম এ-তে পেয়েছিল সেকেন্ড ক্লাস। রিয়া সামাদের সঙ্গে রিংকুর প্রথম পরিচয় হয় টিএসসির অডিটোরিয়ামে। সেদিন রিয়া বসেছিল রিংকুর সামনের সারির চেয়ারে। চুল খোলা। সিল্কি চুল। লেয়ার কাট। টিএসসিতে নারী ও পুরুষের অধিকারের উপরে বিতর্ক প্রতিযোগিতা চলছিল। একজন তার্কিক বলছিল, নারীর সৌন্দর্যকে কীভাবে একদিকে পণ্য করা হয়েছে আবার অন্যদিকে কবিরা নারীদের সৌন্দর্যকে এমন করে বর্ণনা করেছেন যাতে নারী আর মানুষ থাকেনি। জগতের কত কত প্রসঙ্গের মধ্যে, আলোচনার মধ্যে কারণে অকারণে নারীর কথা চলে আসে তার শেষ নেই, নারী প্রথমত মানুষ এই বোধটা আমাদের একদমই নেই। নজরুল বলেছেন, এই জগতের অর্ধেক করেছে নারী আর অর্ধেক করেছে নর। নারীর চুলকে নিয়েও শ্যাম্পু কোম্পানী যে-কত রকম ব্যবসা করে সে-প্রসঙ্গ আসতেই তার্কিক মৃদু হেসে, তার্কিকরা সাহিত্যের শিক্ষকদের থেকে একটু বেশি হাসে, ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা’ বলে। দ্বিতীয়বার মৃদু হেসে, তখন তার চোখ ছিল সামনে বসা এক ছাত্রীর ঘন কালো চুলের দিকে, ছাত্রী নিশ্চয়ই ছিল না বনলতা সেন, তার্কিক যেন সামনের সারিতে বসা মেয়েটিকে প্রশ্ন করছে এমন ভঙ্গিতে, তার্কিকরা প্রশ্ন করতে ভালবাসে, কবিতার যে পঙ্ক্তিটি বললাম কার লেখা? মেয়েটি, স্মার্টলি উত্তর দিয়েছিল, আমি জানি না, বাংলা কবিতা আমি পড়িনি। শ্রোতারা জোরে হেসে দেয়। রিয়া তার পাশে বসা বান্ধবীকে বলেছিল, জীবনানন্দের। আর তখনি, পেছন থেকে, বেশ ভদ্র স্বরে রিংকু, পাশের বন্ধুকে বলেছিল, উত্তর তো তারই জানার কথা, কী সুন্দর চুল! স্বয়ং ইশ্বর তার স্তুতিতে স্বর্গের ঘর দিয়ে দেয়। মানুষ তার সীমিত সাধ্যের মধ্যে স্তুতিকারীর জন্যে কত কিছু করে। দেখা গেছে, পুরুষের চেয়ে নারীরা স্তুতি শুনতে বেশি পছন্দ করে, করবেই তো, নারী কত সুন্দর। তো, রিয়া, তার গ্রীবা ঘুরিয়ে, ঠোঁটে হালকা সহনযোগ্য বিদ্যুৎ চমকিয়ে, নিচু স্বরে বলেছিল–কমপ্লিমেন্টের জন্যে ধন্যবাদ। বসন্তের ঐ হলো শুরু।

সমাজবিজ্ঞানের সাধারণ মানের ছাত্র রিংকু এম এ পরীক্ষার পরে রিয়ার পরামর্শে খুবই খেটেখুটে, যাকে বলে গাধার খাটনি, মনে রাখা দরকার আজ পর্যন্ত দেখা গেছে গাধাদের খাটুনি বেশিরভাগ সময় বৃথা যায় না, এমবিএ পড়াটা শেষ করে। রিয়া পড়তো জার্নালিজমে। বেশ সচ্ছল পরিবারের মেয়ে। বাবা ব্যবসা করে। বাসা, নিজেদের নয়, ভাড়া, ইস্কাটনে। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে রিয়া মেজ। ফুটবল নয়, পছন্দ করে ক্রিকেট খেলা, ব্রায়ান লারা আর আশরাফুল প্রিয় খেলোয়াড়। বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট নিয়ে কথা বলবার সময় যখন ও বলে আশরাফুলের স্কুপ প্যাডেল বা স্কয়ার কাটগুলি দেখার মত তখন বন্ধুরা রিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। রিংকু ক্রিকেট তেমন বুঝতো না, খেলাটা মাঝে মধ্যে দেখতো, কিন্তু গালি আর পয়েন্ট কি, লং অন কোথায়, সিলি পয়েন্ট কাকে বলে এইসব জেনেছে রিয়ার কাছে। রিয়াদের বাসায় ভালো ভালো বই আছে। বইগুলি শুধু সাজিয়ে রাখা হয়নি, পড়াও হয়েছে। রিয়া জানে ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র হোসেন মিয়ার গানগুলি কী রহস্যময়, জানে ‘জীবন আমার বোনের’ খোকার মানসিক শূন্যতাটা কোথায়।

যখন ওদের প্রেম ঘন থেকে ঘনতর হচ্ছিল, ভালো লাগছিল হাত ধরে রৌদ্রের ভেতর দুজনের হেঁটে যাওয়া। রিয়া একদিন অপেক্ষা করছিল শিল্পকলা একাডেমির গেইটে। কথা ছিল, একসঙ্গে দুজনের নাটক দেখার কিন্তু নাটক শুরু হয়ে যাওয়ার বেশ কিছক্ষণ পরে আসে রিংকু। রিয়া কোনো প্রশ্ন করবার আগেই, নিজে অপরাধী স্বরে রিংকু বলে ফেলেছিল, আসলে বলতে চাইনি, পীর সাহেবের জন্যে দেরী হয়ে গেল। সেইদিনই রিয়া প্রথম জানলো, রিংকুদের বাড়ির সবাই ফরিদপুরের কোনো এক পীরের মুরিদ। পীরের কথা শুনে রিয়ার প্রথমে বিশ্বাসই হয়নি রিংকু পীরের মুরিদ হতে পারে। কথা বলায়, চলাফেরায়, হাল ফ্যাসনের কাপড়চোপড় পরা, প্রায় নিয়মিত ব্যান্ডের গান আর ইংরেজি গান শোনা ২৭ বছর বয়সের তরুণ কীভাবে মুরিদ হয়! অবাক হওয়া স্বরে রিয়া, কী বললে তুমি? ‘না মানে আমাদের একজন পারিবারিক পীর আছেন, আমরা সবাই তার মুরিদ’। ‘তুমি আগে কখনো তো পীরের কথা বলোনি’, রিয়ার কথা শুনে রিংকু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। রিয়া তার খয়েরি রঙের চামড়ার ব্যাগ থেকে নাটকের টিকেট দুটি বের করে ছিঁড়ে রাস্তায় ফেলে দেয়। টিকেটে ছাপানো দুটি মুখ রাস্তার কালো পিচের উপর ঘষতে ঘষতে সামান্য দূরে চলে যায়। বাতাস বইছিল।

‘সরি, লক্ষ্মী আমার সরি, আমি বলছি, আমাদের জীবনে পীরের কোনো ভূমিকা থাকবে না’। ‘তুমি বলছো তোমাদের পারিবারিক পীর, তার মানে যে কোনো কাজে তোমরা পীরের পরামর্শ নাও’। রিংকু কি উত্তর দেবে ভেবে পায় না। ‘শোনো রিংকু, আমি কিন্তু পীরের মুরিদ হতে পারবো না, তোমাকেও পীরভক্তি ছাড়তে হবে।’ রিয়ার কথা শুনে রিংকু সঙ্গে সঙ্গে, মাথা দুলিয়ে, ‘না না আমাদের জীবনে পীররে আনতে যাবো কেন?’ ‘কথাটা যেন মনে থাকে, আমি বাসায় যাচ্ছি, কিছু ভাল লাগছে না’। বেশ আবেগ ভরা স্বরে রিংকু জিগ্যেশ করে, ‘আমাকেও না’, ‘না এখন তোমাকেও না’ খুবই ঠাণ্ডা কণ্ঠে উত্তর দিয়ে রিয়া, ‘এই রিকশা ইস্কাটন যাবে?’ জিগ্যেশ করে। রিংকু আর কোনো কথা বললো না। ছয মাসের চেনাজানায় রিংকু জেনেছে, বুঝেছে রিয়াকে ডাকলে কোনো ফল হবে না। রাতে বরং ফোনে কথা বলা ভালো হবে।

টিএসিতে যে বসন্তের শরু তার দেড় বছর পরে রিয়া-রিংকুর বিয়ে হলো। বিয়ের দিন ছিল বৃষ্টি। অতিথিদের মধ্যে কেউ কেউ হেসে হেসে, খাবার পরে, মুখে পান দিতে দিতে বলেছিল, মেয়ে মাঝেমধ্যেই পোড়া ভাত খেত মনে হয়, না হলে বৃষ্টি হয়! বিয়েতে পীর সাহেব আসতে পারেননি। তার বড় ছেলে, বয়স ৩০-এর কাছাকাছি, যিনি বাবার ইন্তেকালের পর গদিনশিন হবেন, বিয়েতে এসেছিলেন।

বিয়ের পরের দিন, বিকালবেলা, তখন বৃষ্টি নেই, রিংকুদের বাসার ড্রয়িংরুমে নতুন বৌয়ের সামনে রিংকুর ছোট খালা বিয়েতে পাওয়া উপহারগুলি খোলে। এক একটা গিফটের মসৃণ বহুবর্ণ র‌্যাপিং পেপার খোলার আগে ছোট খালা যে গিফট দিয়েছে তার নাম পড়ছে। পড়তে পড়তে কখনো কখনো হাসছে, কখনো মোড়ক খোলার আগে উপস্থিত দর্শকদের, বলতে পারবা এই প্যাকেটে কী, ধাঁধাঁ ধরছে। এবার দুলাভাই বলেন, মোহাম্মদ কাশেমের প্যাকেটে কী আছে? রিংকুর বাবা মৃদু হাসলেন। নতুন বৌমার সামনে শ্যালিকার সঙ্গে রসিকতা করতে পারলেন না। শ্যালিকা মোড়ক খুলতে খুলতে, বলতে পারলেন না তো, শো পিস, কী সুন্দর দুটো ঘোড়া, বৌমা ঘোড়া তোমার পছন্দ না? আমার খুব পছন্দ, কী র্স্মাট অ্যানিমেল! রিয়ার মতামত না শুনেই, তোমার শোবার ঘরে রেখ, বলে তার পড়ে যাওয়া আঁচল ঠিক করে। আঁচল তোলার আগে উপস্থিতদের কেউ কেউ দেখে রিংকুর খালার ছোট দুটি স্তনের সংযোগে সৌন্দর্যের খাদ। দুলাভাই, আঙুল দিয়ে দেখিয়ে, এই দুইটা প্যাকেট আপনে খোলেন, আপনার পীর সাহেবের উপহার, কোরান শরীফ হতে পারে, আমার অজু নেই। রিংকুর বাবা মোহাম্মদ হাফিজউদ্দিন শ্যালিকার কথামত প্যাকেট খুললেন। পীর সাহেব উপহার দিয়েছেন কোরান শরীফ, আরবের এক শিশি আতর, সৌদির বোরকা, মোকছুদুল মোমিনিন আর বেহেশ্তি জেওর। দুলাভাই এইসব গিফট আপনার, তবে বোরকা পরবেন না। শ্যালিকার কথায় রিংকুর বাবা ছাড়া উপস্থিত সবাই হেসে দেয়, রিয়ার হাসি ছিল স্মিত। গম্ভীর গলায়, মোহাম্মদ হাফিজউদ্দিন বললেন, না, আমার পীরের সব উপহার বৌমার ঘরে যাবে, বৌমা প্রতিদিন পবিত্র কোরান পড়বে, মোকছুদুল মোমিনিন পড়বে, বোরকাটা ঘরে নেবে। বলে রিয়ার ৬০ বছর বয়স্ক শ্বশুর তার এক মুঠি সমান শাদাপাকা দাড়ি ডান হাতে নেড়ে গিফট খোলার আসর থেকে উঠে গেলেন। রিয়া একবার তাকালো রিংকুর দিকে, একবার তাকালো ছোট খালার দিকে। ‘আরে না না, তুমি দুলা ভাইয়ের কথা চিন্তা করো না, কোরান তো আমরা পড়িই, তোমারও তো কোরান পড়তে আপত্তি নেই, বোরকাটোরকা পরতে হবে না, তুমিও কি পীরের মুরিদ হবা নাকি?’ ছোট খালার কথার সঙ্গে কে একমত আর কে একমত নয়, তা বোঝা গেল না। হাস্যময় পরিবেশটিতে হঠাৎ পৌষের শীত পড়া শুরু করেছে। রিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে কারো বুঝতে অসুবিধা হলো না, বিষয়টি রিয়ার পছন্দ হয়নি।

২.
বাসর ঘরের খাটের মশারি স্ট্যান্ডে গাঁদা আর বেলী ফুলের মালাগুলি তখনো শুকায়নি। মালাগুলি ফ্যানের বাতাসে দুলছে। ঘরে ফুলের গন্ধ। কেবল ২৭-২৮ ঘণ্টা আগে ওদের বিয়ে হয়েছে। কিছুক্ষণ আগে রিংকু এসেছে বিছানায়। রিয়া ঘরে ঢোকার আগে রিংকুর খালা রিয়াকে বলেছে, এই বাড়িতে ধর্ম নিয়ে একটু বাড়াবাড়ি আছে, তুমি মানিয়ে চলো মা। খালার সঙ্গে প্রায় গা ঘেষে শিলা দাঁড়িয়ে ছিল। ভাবী তুমি কিছু মনে করো না, আমি আর তুমি এই পীররে বাড়ির থেকে তাড়াবো, ব্যাটা আর ব্যাটার শযতান পোলাটা আইসা আইসা খালি খায় আর আব্বার কাছ থেকে টাকা নেয়, পোলাটা তেরছা চোখে খালি তাকায়। রিয়া ছোট খালাকে বলেছে, ধর্মান্ধ না হলেই হয়। না না ওরা ধর্মান্ধ না, দুলাভাই পীরকে একটু বেশি বেশি করে, এই নিয়ে আপার আর শিলার সাথে দুলাভাইয়ের মাঝে মাঝে লাগে, তুমি রিংকুকে টাইট দিয়া রাখবা, ধর্ম নিয়া বাড়াবাড়ি করা তো ঠিক না, কী বলো। নতুন বৌ রিয়া সুবোধ বালিকার মত মাথা দুলিয়ে খালার কথাকে সায় দিয়েছে। রিয়ার কাছে এইসব কথা বলতে খালা এসেছিল রিংকুর মায়ের পরামর্শে।

বিয়ের প্রথম রাতেই বেড়াল মারতে হয়। গ্রামের এক বোকা লোক নাকি বাসর ঘরে বেড়াল নিয়ে হত্যা করেছিল। লোকটা নিরীহ বেড়ালকে ধারালো দায়ের এককোপে গলা কেটে বৌকে বলেছিল, বিয়ের রাতে বেড়াল মারলাম। নতুন বৌ ভয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠলে পাশের ঘরে লোকটির রড় ভাই তার বৌকে বলেছিল, ব্যাডা একখান, পরথম রাতেই বেড়াল মারছে। রিংকু বিয়ের প্রথম রাতে কোনো বেড়াল মারতে পারেনি, না মারবার কারণ আছে, রিয়ার মিনেস্ট্রেশন চলছিল, তবে ওরা পরস্পরকে অনেক চুমু খায়। বিয়ের আগেও চুমু খেয়েছে, বাসর ঘরে চুমু সমাজ স্বীকৃত।

৩.
বিয়ে হয়েছে সাত দিন। বিকাল বেলা। ড্রয়িং রুমে সবাই চা খাচ্ছে। রিয়ার শ্বশুর চা খেতে খেতে মৃদু হেসে বলে, রিয়ার ছবি তার পীরসাহেব দেখে তাকে বলেছিল তোমার বৌমা খুব লক্ষ্মী মেয়ে হবে। শ্বশুরের কথা শুনে রিয়া অবাক হয়ে যায়। তা হলে বিয়ের আগে কি তার ছবি পীরকে দেখিয়ে পীরের অনুমতি নেয়া হয়েছিল? রিংকু সারাদিন কোথায় কী করলো সব বলে কিন্তু এই কথাটি বলে নাই কেন? রিয়ার শ্বশুর যখন পীরের কথা বলছিলেন, রিংকু রিয়ার মুখের দিকে তাকায়। রিংকুর মনে হয়, আজ রাতে রিয়া পীরকে নিয়ে প্রশ্ন করবে।

নীল ডিম লাইট জ্বলছে ঘরে। মশারিটাও নীল। হালকা নীল চারকোণা আকাশের ভেতর রিয়া আর রিংকু পাশাপাশি শুয়ে আছে। রিয়ার মুড মেঘলা। ভাবছে কী বলা যায়, কী করা যায়। রিয়াকে সহজ করবার জন্যে রিয়ার পায়ের পাতার উপর রিংকু পা দিল। পায়ে ঘষলো পা। রিয়া পা সরায় না। রিংকু বোঝে খেলা হতে পারে। উচ্ছল আনন্দে শরীরের কাঠামো কখনো পরিমিত শব্দে, কখনো স্মিত হাসির তোড়ে উত্তাল হতে পারে। রিয়া বললো, ‘রিংকু আমি কালকে মার ওখানে যাবো, রাতে থাকবো, তুমিও যাবে, কী বলো’। ঐ স্বরে কোনো অভিযোগ নেই, অভিমান নেই, আছে অতি সাধারণ প্রস্তাব মাত্র।

রিংকু সেই বিকাল থেকে ভেবে আসছিল, রিয়া আজ রাতে তাকে পীর নিয়ে অনেক প্রশ্ন করবে, রিয়া তার ধারে কাছেও নেই। নাকি ও তাদের পরিবারের হালচাল গভীরভাবে বুঝতে চাইছে? রিয়া তো, মানে বিয়ের আগে, যে-কোনো বিষয়ে অনেক প্রশ্ন করতো। বিয়ের পর থেকে তেমন একটা প্রশ্ন করছে না, সবার সামনে না হয় নতুন বৌ কিন্তু রিংকুর কাছে রিয়া তো নতুন না। রিংকুর উত্তরের অপেক্ষা না করে রিয়া বললো, বেশ গরম লাগছে, ব্লাউজ খুলবো, রিংকু তুমি রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটা সিডি তুলে দাও, ভলিয়ুমটা আস্তে দিও। রিংকুর মনে পরে, অনেকদিন আগে রিয়া তাকে বলেছিল, গান শুনতে শুনতে তার এক বান্ধবী সেক্স করে। দ্রুত বিছানা ছেড়ে রিংকু সিডি দিয়েই আবার বিছানায় চলে আসে। ‘শূন্য হাতে ফিরি, হে নাথ, পথে পথে’, রবীন্দ্রনাথ যখন ঈশ্বরের সামনে শূন্য হাতে পথে পথে দীন হয়ে ঘুরছেন, রিয়া গভীর চুমুতে রিংকুর ঠোঁট চৌচির করে বললো, হে পুরুষঈশ্বর পূর্ণ করো দেহ।’
প্রাণী জগতের সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও হিংস্র পশু মানুষ, তার লীলার উৎসবে ঘরের নীল আলোর সৌন্দর্য তছনছ হয়ে যায়।

৪.
আত্মীয়জন আর বন্ধুবান্ধবীরা বলাবলি করছিল রিয়া-রিংকু হ্যাপি কাপল। তারা চোখের সামনে দেখছিল, নব দম্পতি দিবসরজনী আহ্লাদে আনন্দে, এ-বাড়ি সে-বাড়িতে নেমতন্ন খায়, হেসে হেসে কথা কয়। রিয়ার কোনো বান্ধবী, একটু আড়ালে, কিরে চোখের নিচে এত ঘন কালি কেন, এক রাতও বাদ দিস না, গলার নিচে দাগ নিয়ে তোর বাইরে বেরতে লজ্জা করলো না? বলে আর হাসে, তখন অন্য ঘর থেকে হয়তো কেউ বলে, কিরে এত হাসি কিসের? রিয়াকে হাসতে হয়, পরিপার্শ্বকে বোঝাতে হয়, বিবাহ সুখের। অন্য কেউ নয়,এক ছাদের নিচে, যে দুজন নারীপুরুষ রাতদিন যাপন করে কেবল তারাই জানে, তাদের রাত ও দিনের প্রহরগুলি রঙিন, নাকি ধূসর।

তো, এক শুক্রবার বিকালে রিয়ার শ্বশুর মক্কার ছবিঅলা মখমলের লালনীল রঙের নরম জায়নামাজ রিয়ার হাতে দিয়ে অমায়িক স্বরে বললেন, মা তোমার জন্যে আমার পীরসাহেব দিয়েছেন। শ্বশুর বললেন না, এখন থেকে পাঁচবেলা তুমি নামাজ পড়বে। বিয়ের আগে রিংকুকে তার বাবা বলেছিল, প্রেম করে বিয়ে করছো তাতে আমার আপত্তি নেই কিন্তু বৌ যেন নামাজকালাম পড়ে। রিয়াকে কখনো রিংকু তার বাবার ইচ্ছাটি জানায়নি, মনে করেছে, রিয়া বৌ হয়ে আসবার পরে সবকিছু মানিয়ে নেবে, আফটার অল রিয়া বুদ্ধিমতি। রিয়া নামাজকালাম পড়ে, তবে অনিয়মিত। কেন মাঝে মাঝে পড়ে? এই প্রশ্নে রিয়ার উত্তর, ও যখন কিছু একটা ফিল করে, তখন পড়ে, ফিলিংটা কী তার ব্যাখ্যা রিয়া নিজেও জানে না। মানুষ তো নিজের বোধবুদ্ধির সব ব্যাখ্যা করতেও পারে না। রিয়া বিশ্বাস করে, ধর্ম কারো উপর চাপিয়ে দেওয়ার ব্যাপার না, ধর্মকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করা ঠিক না, ধর্মাচারণ সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার। রিয়া জায়নামাজ নিয়ে ঘরে ঢুকে দ্যাখে, রিংকু শুয়ে আছে। জায়নামাজটা পবিত্রভাবে সুন্দর করে আলনার উপর রেখে দিল। শুয়ে শুয়ে রিংকু রিয়ার ধীর পায়ে ঘরে ঢোকা, জায়নামাজ রাখা দেখলো, কিছু বললো না। ‘রিংকু উঠে বস, তুমি এক দমবন্ধ বাড়িতে আমারে নিয়ে আসছো ক্যান, পীর পীর করে করে তোমার বাবা সবাইরে লাঠির আগায় রাখতে চায়, তোমাদের বাড়ির সবকিছু যে পীরের কথায় চলে আমারে আগে বলোনি ক্যান, কথার জবাব দাও?’ রিয়ার মুখে রক্তের রাগ জমে গেছে। রিংকু যেন একটু ভয় পেয়েছে, ‘প্লিজ লক্ষ্মী সব ঠিক হয়ে যাবে, আমারে কয়টা দিন সময় দাও’ রিংকুর স্বরে মিনতি, স্বরে পরাজয়। ‘ঠিক আছে, কথা যেন মনে থাকে’ বলে রিয়া বাথরুমে ঢোকে। প্রশ্রাব পেয়েছিল।

‘গত শুক্রবার তুমি জুম্মায় যাওনি কেন?’ রিংকু তার বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে বোঝে বাবা রিংকুর চালচলন প্রছন্দ করছে না। ‘না মানে, শরীরটা ভালো ছিল না’ রিংকুর উত্তরে তিনি বললেন, ‘কেন বিকালে তো বৌ মাকে নিয়ে বেড়াতে গেলে’। রিংকু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। ‘আমি চাই তুমি নিয়মিত নামাজ পড়বে, বৌমাকেও পড়াবে’ বলে রিংকুর বাবা মোহাম্মদ হাফিজউদ্দিন বাইরে কী একটা কাজে চলে গেলেন।

৫.

ড্রয়িং রুম সাফ করা হচ্ছে। দেয়ালে রিংকুর পরহেজগার চেহারার দাদাদাদির ছবি টাঙানো ছিল, সরানো হলো। রিয়া রিংকুকে জিগ্যেশ করে, বাসায় কেউ আসবে না-কি। আজ মাগরিবের আগে পীর সাহেব রিংকুদের বাসায় তসরিফ রাখবেন। সবার জন্যে তিনি দোয়া করবেন, পীর সাহেবের সঙ্গে তার ছেলেও আসবেন, রাত্রে খাবার আগে একটু দোয়া কালাম পড়বেন, তবে এ বাসায় থাকবেন না। তিনি গুলশানের এক বড় ব্যবসায়ীর বাড়িতে থাকবেন। পীর সাহেবের আসবার কথা রিয়াকে কেউই জানায়নি। জানাবার প্রয়োজনও মনে করেনি, আসলে প্রথমে রিংকুও জানতো না। মোহাম্মদ হাফিজউদ্দিন কখন তার পীর সাহেবকে বাসায় আনবেন তার কালক্ষণ কেবল তিনিই জানেন। হয়তো, দুপুরেই তিনি গম্ভীর গলায় রিংকুর মাকে বলেছেন, রাত্রে আয়োজন করবা, হুজুর আসবেন। আসলে হুজুর ঢাকায় প্রায়ই আসেন এবং ইচ্ছেমত এক এক মুরিদের বাসায় মোবাইল করে বলেন, তিনি তসরিফ রাখবেন। জ্বী হুজুর জ্বী হুজুর কী ভাগ্য আমার বাসায় আসবেন, গলায় ভক্তি নিয়ে মুরিদ জানায। হুজুর তসরিফ রাখবার কথা বলে কাউকে বলেন, তোমার বাড়ির মুরগী আর খাশি রান্নাটা ভালো; কাউকে বলেন, তোমার বাসায় গতবার চিতলের কোপ্তা কে করছিল, বড় ভালো হইছিল। বুদ্ধিমান মুরিদ বাজারে চলে যান।

পীর সাহেব আসবার পরে বাসার সবাইকে তার সামনে ডাকা হলো। রিয়া দেখে খুবই অবাক, পীর সাহেবকে সালাম করবার পরে রিংকু, শিলা পীরের ছেলের পা ছুঁয়ে সালাম করলো। ছেলেটি রিংকুর থেকে বয়সে খুব একটা বড় হবে না। রিংকুর সালাম করা দেখেই রিয়া পীর সাহেবকেও সালাম না করেই তার ঘরে চলে যায়। পীর সাহেবের সামনে রিয়ার এই ঔদ্ধত্ব , রিংকুর বাবার একদম ভালো লাগেনি। বৌ মাকে কি ডাক দেব, ডাক দিলে যদি না আসে সেটা আমার জন্যে আরো অপমানের হবে, পীর সাহেব চলে গেলে দেখা যাবে, বৌমাকে কিছু বলতে হবে; নিজের রাগকে নিজের সঙ্গে কথা বলে আপাতত ঠাণ্ডা করলো রিংকুর বাবা। পীর সাহেব রিয়ার চলে যাওয়া দেখে কিছুই বললেন না। মনে মনে ভাবলেন, আমারে অসম্মান, দেখা যাবে। রিয়া খেয়াল করেছে পীরের ছেলে তাকে কয়েকবার আড় চোখে দেখেছে।

খাবার টেবিলে পীর সাহেব খাসির নরম সিনা মুখে দিয়ে বললেন, খুবই স্বাদ হইছে, রাঁধছে কে? রিয়ার শাশুরি বলে ফেললেন, আমাদের নতুন বৌ মা। তিনি মিথ্যে বললেন। রিয়া পীরকে সালাম করেনি তাতে ওর শ্বশুর যে খুবই রেগে গেছেন সেটাকে কিছুটা শান্ত করবার জন্যে রিংকুর মা ঐ মিথ্যে বলেছে। মিথ্যে বলে সমস্যা আরো বাড়লো, পীর সাহেব মুখে পৌলাও তুলতে তুলতে, কই বৌমারে তো দেখলাম না, আপনার বৌ মা বড় পর্দানশিন, একটু ডাক দেন, মা টারে দেখি, এত্ত সুন্দর রাঁধে।

রিয়া সাধারণত মাথায় ঘোমটা দেয় না, তবে আজানের সময় দেয়। রিংকু আর শাশুরির সঙ্গে মাথায় কাপড় দিয়ে রিয়া তার ঘর থেকে পীর সাহেবের সামনে এলো। তিনি রিয়াকে এক পলক দেখলেন। মাথা দোলালেন। রিংকুর বাবাকে বললেন, বড় লক্ষ্মী বৌ, হে হে, খাসির গোশটা রান্না বড় ভালো করছো, কত আদব জানে, খাওয়ার সময় সালাম দিতে হয় না সেটা জানে। কথাগুলি বললেন টেনে টেনে, স্বরে এক ধরনের টিটকারী ছিল, বুঝিয়ে দিলেন, অন্য সময় তো সালাম করা যেত। ‘না না আমি রান্না করিনি’, রিয়ার কথার মাঝে ওর শাশুরি, ‘বৌমা আমি দেখলাম রান্নাঘরে তুমি রাঁধছিলে’, রিয়া বললো না যে, ‘আমি তো আজ রান্না ঘরেই যাইনি’। পীর সাহেবের ছেলে, ‘আরে আপনি রাঁধছেন, কত মজা হইছে, আব্বাজানের খুব পছন্দ হইছে আপনার রান্না, রাঁধছেন তা কইতে শরম পান ক্যান।’ পীরের ছেলের কথা শেষ হতেই শাশুরি রিয়াকে বলে, মা তুমি রান্না ঘরে যাও, দইটা ঠিক করো।’ পীর সাহেবকে পাতে আরো দুতিন টুকরো খাসির গোশত তুলে দিতে দিতে রিংকুর বাবা বললেন, নতুন বৌ তো, লজ্জা পায়। ‘আজকাল তো, লজ্জা নাই, বেলাজ বাড়ছে’ পীর সাহেব সিনার গোশতের নরম হাড়ে কামড় দিয়ে যেন মূল্যবান কথাটি বললেন।

৬.
রিয়া শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রিংকু টয়লেটে দাঁত মাজছে। দরজায় টোকা পড়লো। শাশুরি ঘরে ঢুকে ফিস ফিস করে বললেন, তোমার শ্বশুর যা বলেন, প্রতিবাদ করো না, কোনো উল্টাপাল্টা জবাব দিও না, আচ্ছা আচ্ছা কইরো, আমিও তো মা এই পীররে লইয়া শান্তিতে নাই, তুমি আমার সাথে আসো।

‘বৌমা তুমি আইজ যা করলা, ভবিষ্যতে আর এরম বেয়াদবী করবা না, হুজুরের পা ছোঁবার জন্যি কত লোক বইসা থাকে আর তুমি উনারে সালাম করলা না, আমার মাথা নিচু কইরা দিলা, কিছু কও না ক্যান?’ ‘আমি সবাইরে সালাম করি না’, রিয়ার জবাবের ভেতর দৃঢ়তা দেখে শ্বশুর ভুরু কুচকায়, গলা আরো ভারী করে বলেন, ‘তুমি তো দেখি বেয়াদবী শুরু করছো, এই বাড়ির আদবকায়দা আছে, এমএ বিয়ে পাশ করলে কি আদব লেহাজ মানতে হয় না?’ খুবই নম্র স্বরে রিয়া বলে, ‘বাবা আমি তো কোনো বেয়াদবী করিনি,’ কথা শেষ হয়নি, রিয়া আরো কিছু বলতে চাইছিল, বলা হলো না। ‘রিংকু’, পাশেই রিংকু দাঁড়িয়ে ছিল, তবু বেশ জোরে ডাক দিলেন মোহাম্মদ হাফিজউদ্দিন; ‘জ্বী আব্বা’ চমকে জবাব দেয় রিংকু। ‘তোমার বৌয়ের কাছে আমার আদব কায়দা শেখা লাগবে’ বলে তিনি চেয়ার কাঁপিয়ে উঠে, বাটার স্যান্ডেলে সপাত সপাত রাগ তুলে ড্রয়িং রুম থেকে নিজের ঘরে চলে গেলেন।

রিংকু তার আব্বার উপর বেশ রেগে গেছে। ঘরে যাবার আগে মাকে বলে গেল, আব্বা পীররে নিয়া বেশি মাতছে, তুমি উনারে বুঝাবা, দিন বদলাইছে, আরো কই, রিয়া কিন্তু ধর্ম মানা মেয়ে, কিন্তু ওর উপ্রে কিছু চাপায়ে দেয়া যাবে না, আব্বারে এইটা কইও। ’ওর রাগ হওয়ার আরো একটি কারণ, আজ রাত্রির মিলনটা মনে হয় হবে না। মিসেস হাফিজউদ্দিন বড় সংকটে পড়েছে।

কোনো কোনো নারীর রাগ বা অভিমান হলে ঐ রূপকে আনন্দে রূপান্তরিত করতে ঐ নারীরা চুম্বন পেতে ভালোবাসে। রিংকু ভেবেছিল, বিছানায় শোবার পরেই রিয়া তাকে রেগে কেঁদে কেঁদে কিছু কথা শোনাবে। রিয়া তার শ্বশুরবাড়ির পীরটির নিয়ে কথা বলেছে ঠিকই কিন্তু কাঁদেনি, তবে রিংকুকে বুঝিয়ে দিয়েছে, এইভাবে বেশিদিন এই বাড়িতে থাকা যাবে না। যখন রিয়া আর রিংকু মুখোমুখি শুয়ে কথা বলছিল, রিংকু একটু সাহস করে রিয়ার বুকের উপর দিয়ে, মানে স্তনের উপর হাত আড়াআড়ি দিয়ে, কথা শুনছিল। রিয়া হাত সরায়নি। রিংকুর মাথার ভেতর নীল বিদ্যুৎ চমকে যায়, আজ হতে পারে। কথা শুনতে শুনতে রিংকু রিয়ার চুলে বিলি কাটে, রিয়া তাতেও বাধা দেয় না। ‘আমি বাথরুম থেকে আসি’ রিয়া বাথরুম থেকে ফিরে এসে দেখে রিংকু ঘরের মাঝখানে নতুন কার্পেটের উপর শুয়ে আছে। অর্ধ নগ্ন। বিযের পরে কার্পেটের উপর মিলনে রিংকু, যেন নতুন এক আবিস্কার, খুব উৎফুল্ল। ‘দিন দিন কী হচ্ছে তোমার, সময় কমছে কেন, পারছো না কেন, মাথাটা ধরে থাকবে?’ রিয়ার বিরক্তিভরা কথাগুলি রিংকুকে চুপসে দেয়।

৭.
রিংকুর সারারাত ভালো ঘুম হয়নি। নিজের পৌরুষ নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেছে। বিয়ের পাঁচ মাসও গেল না, এরই মধ্যে রিয়া বলে ফেললো, পারছো না কেন। গতরাতে বলা রিয়ার কথাগুলি রিংকুর মাথা থেকে কিছুতেই যাচ্ছে না। সারাদিন অফিসে রিয়ার কথাগুলি রিংকুকে বিমর্ষ করে রেখেছিল। ইমিডিয়েট বস একবার বলেছিল, হাই ইয়াং ম্যান, লুকিং স্যাড, হোয়াট হ্যাপেন্ড?’ ‘নাথিং, জাস্ট ফিলিং ড্রাউজি, লাস্ট নাইট ডিড নট স্লিপ ওয়েল।’ বস, হে হে, ভদ্রতামাফিক হেসে, নতুন বিয়ের পরে আমাদেরও ঠিকমত ঘুম হতো না, হ্যাভ এ কাপ অব ব্লাক কফি, ফ্রেশ হয়ে যাবেন’ বলেছিল।

বিকালে অফিস থেকে সিএনজিতে বাসায় ফেরার সময় রিংকুর মনে হয়, ডাক্তার বন্ধু রসুলের সাথে কথা বলা দরকার কিনা। না না, ও শুনলে হাসবে, অন্য ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। আশ্চর্য, এইসব ভাবতে ভাবতে রিংকু লিঙ্গে একবার হাতও দিল। আজ রাতে যদি রিয়ার ইচ্ছে হয়, রিয়া যত চায় সেমত যদি না পারি? চোখমুখে চিন্তা, কষ্ট, ঘাম।

সিএনজি মগবাজার মোড়ের ট্রাফিক সিগন্যালে আটকা পড়েছে। এক মেয়ে রিংকুর উরুর উপর ক্ষিপ্র হাতে ছুঁড়ে দিল সবুজ আর লালে ছাপানো ছোটো আকারের এক লিফলেট। রিংকু বেশ মনোযোগ দিয়ে লিফলেট দ্যাখে। এক ভাঁজ করা লিফলেটের উপরে লেখা : সুস্থ হওয়ার গ্যারান্টিসহ চিকিৎসা নিন; দ্বিতীয় পাতায়: হতাশ জীবনে আশার আলো; তৃতীয় পাতায় : যুবক ও বিবাহিত ভাইদের জন্যে বিশেষ আকর্ষণ।

আগে বেশ অনেকবার, তখনো ওদের বিয়ে হয়নি, রিংকু আর রিয়া একসঙ্গে রিকশয় বা সিএনজিতে হয়তো কোথাও যাচ্ছিল, এরকম কাগজ কোনো পুরুষ বা নারী দ্রুত ওদের উপর ফেলে গেছে, আর তখন রিংকু, যেন এইসব বাজে জিনিশ কী পড়া যায়, এমন ভঙ্গিতে কাগজ ফেলে দিয়েছে। একদিন রিয়া ঐরকম কাগজ হাতে নিয়ে রিংকুকে বলেছিল, কখনো পড়েছ, আমি পড়েছি, এই যে এখানে দ্যাখ ‘যুবক ও বিবাহিত ভাইদের জন্যে বিশেষ আকর্ষণ’ তোমার কাজে লাগতে পারে।’ রিয়ার কথা শুনে সেদিন রিংকু রিয়ার হাতে অর্থবহ চাপ দিয়ে বলেছিল, ‘মেয়ে শয্যায় গেলে দেখা যাবে।’ আজ এই মগবাজার মোড়ের ট্র্যাফিক জ্যামে রিংকু ঐ ‘বিশেষ আকর্ষণ’ পড়ে: যৌবনের শুরুতেই হয়তো অনেক শক্তি অপচয় করেছেন ( রিংকরু মনে পড়ে, কবে থেকে নিয়মিত মাস্টারবেট করতো, দিনে দুতিনবার করতো)। এখন যতটুকু যৌনশক্তির প্রয়োজন আপনার তা নেই। কারণ আপনি নার্ভাস ও দুর্বল হয়ে পড়েছেন। বিয়ে করেছেন অথচ আপনার স্ত্রীকে যৌনতৃপ্তি দিতে পারছেন না। স্ত্রীর কাছে লজ্জা পাচ্ছেন অথবা বিয়ে করতে ভয় পাচ্ছেন। কারণ আপনার স্ত্রীকে যদি তৃপ্তি দিতে না পারেন। হয়তো তাই আপনি চিন্তিত ও হতাশাগ্রস্ত। আর অপেক্ষা না করে চিকিৎসা গ্রহণ করুন। গ্যারানটি দিয়ে আপনার চিকিৎসার দায়িত্ব নেয়া হবে। অধিক সময় স্ত্রী মিলনের জন্য বিজ্ঞানসম্মতভাবে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ঔষধ দেয়া হয় যা নিদির্ষ্ট সময় সেবন করলে ৬০ বছরের বৃদ্ধকেও ২৫ বছরের যুবকের ন্যায় শক্তিশালী করবে। চেহারা হবে লাবণ্যময়, মনে থাকবে আনন্দ, সহবাসে পাবেন পূর্ণ তৃপ্তি। এমনকি দৈনিক ৪/৫ বার স্ত্রীর সাথে ৩০/৪০ মিনিট সময় নিয়ে তৃপ্তি সহকারে সহবাস করতে পারবেন।

রিংকু লিফলেটে লেখা ঠিকানা পড়লো, মালিবাগেই অফিস। কাগজটাকে মুঠোর ভেতরে দুমরালো মুচড়ালো। কাগজের খসখস শব্দের ভেতর আক্রশের শব্দ শোনা যায়। ছোট্ট পিন্ড হয়ে যাওয়া কাগজটা রিংকু রাস্তায় ফেলে দেয়।

৮.
বাবা রিংকুকে বললেন, কালকে বৃহস্পতিবার, সন্ধ্যায় আমি আর তুমি ফরিদপুর যাবো। পীর সাহেব দেখা করতে বলেছেন। ফিরবো, শনিবার রাত্রে, মাগরিব পড়বো পীর সাহেবের সাথে। সরকারী অফিসের নোটিসের ভাষা, কোনোরকম ফাঁক নেই।

৯.

প্যান্টশার্ট পরে, ক্লিন শেভ করে রিংকু তার বাবার সঙ্গে গিয়েছিল ফরিদপুর। ঢাকায় ফিরলো পায়জামা-পাঞ্জাবী পরে। মুখে খোচা খোচা দাড়ি, শেভ করেনি। ডান হাতের বাজুতে তাবিজ লাগানো। রিয়া অবাক হয়ে রিংকুকে দ্যাখে। আমি কি এই মানুষের সাথে প্রেম করেছিলাম, পীর ওকে কী করলো? এক মর্ম-যন্ত্রণায় রিয়া মুঢ় হয়ে যায়, রিংকুকে কী বলবে এখন? রিংকু ঘরে ঢুকে রিয়াকে শুকনো গলায় শুধু ‘কেমন আছো’ বললো। রিংকু আর আগের রিংকু নেই। পীরের বসংবদ মুরিদ হয়ে রিংকুর জীবন বদলে গেছে।

শিলা তার ভাবীকে ঘরের বাইরে থেকে ডেকে জানায, বাবা তাকে ডাকছেন। ‘কেন ডাকছেন, তুমি কিছু জান?’ রিয়ার প্রশ্নের কোনো উত্তর শাহরুখ খান ভক্ত ১৮ বছর বয়সের তরুণী, ননদিনী শিলা জানে না।

‘কেমন আছ মা?’ শ্বশুরের হঠাৎ এই স্নেহ কেন? বিয়ের কয় মাস হয়ে গেল, কোনোদিন এমন নরম গলায় তিনি তো মা বলেননি। রিয়া বৃদ্ধের স্নেহে, স্নেহে পশু পর্যন্ত নরম হয়ে যায়, সহজ হয়ে বলে ‘জ্বী আব্বা ভালো আছি, আপনি ভালো আছেন?’ ‘মা, কাছে বসো’ শ্বশুরের গলা আরো শীলিত। তিনি কি এতদিনের কঠোর ব্যবহারের প্রায়শ্চিত্ত করছেন? কিছুক্ষণ আগে রিংকুকে দেখে রিয়ার চোখ ফেটে যে কান্না আসছিল তা মুহূর্তে উধাও হয়ে যায়। রিয়া বিহ্বল হয়। রিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে শাশুরি আর শিলা। শাশুরি জানেন কেন রিয়াকে ডাকা হয়েছে। রিয়া যদি এখন বিদ্রোহ করে, শাশুরি খুশি হবেন। মোহাম্মদ হাফিজউদ্দিন তার শাদা পাঞ্জাবীর পকেটে হাত রাখেন। একটা রূপার তাবিজ, কালো সুতো দিয়ে বাঁধা, হাতে নিয়ে রিয়ার শাশুরিকে বলেন, ওর বাম হাতে বেঁধে দাও। রিয়ার মাথাতে আসেইনি এরকম কিছু হতে পারে। শিলা বার বার নিজেকে বলছে, ভাবী তুমি বলো, আমি তাবিজ পরি না, আমি তাবিজ পরি না, কিন্তু বলতে পারছে না। রিয়ার শাশুরি তাবিজ পরাতে যাচ্ছেন, শ্বশুরের চোখে খুশি, শিলার চোখে বিতৃষ্ণা, রিয়া অসহায় স্বরে বললো, মা আমি তো তাবিজ পরি না, আমার তো কোনো অসুখ নেই। ‘আমার পীর সাহেব দিছেন, তোমার ভালোর জন্যেই উনি দিছেন, উনি খেয়াল করছেন ধর্মে তোমার মতি নাই, তাবিজ পরবা, পীর সাহেবের পরা তাবিজ’। ভারী গলায়, শব্দগুলি আদেশবাচক, কথা বলে শ্বশুর ঘর থেকে বের হয়ে ড্রয়িং রুমে গেলেন। রাত্রি দশটার খবর শুনবেন।

১০.
রিয়া ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। চোখ কষ্টে, রাগে ফেটে যাচ্ছে। মুখ লাল। বাজু থেকে ক্ষিপ্র হাতে তাবিজ খুলে ছুঁড়ে মারলো। তাবিজ গিয়ে পড়লো মোকসুদুল মোমিনের পাশে, বইটি রাখা ছিল ছোট টেবিলের ’পর। ‘তুমি তাবিজ পরবে না ভালো কথা কিন্তু আল্লার কালাম পড়া তাবিজ এইভাবে’ রিংকুর কথা শেষ হলো না। রিয়া রিংকুর দুই কাঁধ ধরে, ঝাঁকি দিয়ে বলে ‘রিংকু এইসব কী?’ রিয়ার বিস্ফারিত চোখ রিংকুর চোখে, সমস্ত শরীর কাঁপছে। ‘কথা বলছো না কেন?’ এবার আরো জোরে রিংকুকে ঝাঁকি দেয় রিয়া। রিংকু বেশ ভয় পেয়েছে। আজ রিয়া সারা বাড়ি কি তোলপাড় করে ফেলবে? ‘পী র সা হে ব ব ল লে ন’ রিংকুর স্বরে কোনো শক্তি নেই। ‘নিজের কোনো মুরোদ নেই, পীররে দিয়ে বৌরে বশ করতে চাও, লজ্জা করে না?’ কোনো নারী যখন তার পুরুষের মুরোদ নিয়ে কথা বলে তার অর্থ অন্য মানুষ ভিন্নভাবে বুঝতে পারে কিন্তু যে পুরুষকে বলা হয় সেই কেবল জানে কোথায় অভাব। রিংকু ঐ কথা শুনে দাঁত তোলা সাপের মত মাথা নামিয়ে নেয়।

রিংকু দিন দিন দ্রুত বদলে যাচ্ছে। ফরিদপুর থেকে আসার পর পরিচর্যা করে দাড়ি রাখছে। সবার মুখে দাড়ি মানায় না, রিংকুকে দাড়িতে খারাপ লাগছে না। রিয়ার সঙ্গে হিসাব করে কথা বলে, প্রয়োজনের কথা বেশি বলে, আবেগ আর প্রেমের ঘাটতি পড়ছে। বিভিন্নরকম উছিলা দিয়ে আগেই ঘুমিয়ে পড়ে রিংকু। রিয়ার রাতের বেশিরভাগ যায় নিদ্রাহীন, সকালে মাথা ধরে থাকে। শুক্র শনিতে রিংকু বাবার সঙ্গে পাঁচ ওয়াক্ত বসছে জায়নামাজে। অফিসের দিনে বাসায় পড়ছে ফজর আর এশার নামাজ। যেদিন অফিসে বেশি কাজ থাকে, সন্ধ্যায় বাসায় ফিরতে পারে না, বাবার সঙ্গে পড়া হয় না মাগরিব। ফরিদপুর থেকে যেদিন রাতে পিতাপুত্র ফিরলো, ভোরে ফজরের আজানের পর পরই দরজায় টোকা পড়েছিল, বাবা পুত্রকে ডাকছেন, মসজিদে যেতে হবে। অফিসে জোহর আর আসর পড়বার সময় বের করতে পারে না। কাজ ফেলে ধর্মচর্চা করা দেখলে বিদেশী বস মৃদু হেসে, বলা শব্দগুলোয় বেশি চাপ দিয়ে বলে ফেলবে, হাই পায়াস ম্যান, আই থিঙ্ক ইউ শুড গিভ আপ দা জব, ফর ইউ দা মস্ক উইল বি দা বেস্ট প্লেস। কর্ম-সময়ের প্রতি পল হিসাব করে বহুজাতিক পয়সা দেয়, রিংকু সে ব্যবস্থাপনা জানে। রিংকুর পড়ার অভ্যাসও বদলে যাচ্ছে। রিয়া ওকে বেশ ভালো কিছু বই পড়িয়েছে। বিয়ের পরে রিয়া তার প্রিয় কিছু বই নিজেদের বাসা থেকে নিয়ে এসেছিল শ্বশুরবাড়িতে। ‘লাল সালু’ পড়া শেষ হলে রিয়া বলেছির, ‘কী বুঝলে?’ ‘ধর্ম ব্যবসা কিভাবে শুরু করতে হয় ভণ্ড মজিদের ভেতর দিয়ে ওয়ালীউল্লাহ তা সুন্দরভাবে দেখিয়েছেন’ এই পর্যন্ত বলে রিংকু রিয়ার হাতে চাপ দিয়ে বলেছিল, ‘রিয়া তুমি আমার জীবনবোধকে বদলে দিচ্ছ, আগে কী সব হালকা হালকা বই পড়তাম, দিনে একটদুইটা পড়তাম, কী পড়তাম পরদিনই ভুলে যেতাম।’ রিয়া হেসে বলে, ওগুলো অপন্যাস পড়তে, আচ্ছা যে-জীবন বদলে যাচ্ছে তা ভালোর দিকে যাচ্ছে না মন্দের দিকে?’ ‘তুমি দেখছো না কোন দিকে যাচ্ছে’ হেসে বলেছিল রিংকু। সেই রিংকু ফরিদপুর থেকে ফেরার পর আর গল্প-উপন্যাস ধরছেই না। নাড়াচাড়া করছে ‘বেহেসতি জেওর’ আর ‘মোকসুদুল মোমেনিন’। রিয়া বলেছিল,‘এইসব পড় ভালো কথা কিন্তু রিংকু তালেবান হয়ে যেও না, তালেবান হওয়া সহজ, ধার্মিক হওয়া কঠিন’, ‘পড়ে দেখছি, জানতে তো দোষ নেই?’ রিংকু বেশ জোরে উত্তর দিল, উত্তরের ভেতর কোনো সৌজন্য নেই।

দুই মাসের ভেতর আবার রিংকু তার বাবার সঙ্গে ফরিদপুর গেল। পীরের কাছে। যাবার সময় রিংকু বাবার ঘর থেকে আনলো ‘নেয়ামুল কোরআন’ এবং ‘কোরআন ও হাদিসের দৃষ্টিতে বিশ্বনবীর দাম্পত্য জীবন’। সঙ্গে নেবে। রিয়া পীরের ওখানে না যাবার জন্যে রিংকুকে বারবার অনুরোধ করেছিল। রিয়ার কথা শোনেনি। তার শ্বশুর খোঁজখবর রাখছিল রিয়া নামাজকালাম পড়ে কি-না, ধর্মকর্মে মতি আসছে কি-না। রিংকু ফরিদপুর যাবার পরে নামাজ পড়ে আল্লার কাছে রিয়া কেঁদে বলেছে, হে গফুরুর রাহিম তুমি রিংকুকে পীরের হাত থেকে বাঁচাও। রিয়ার নামাজ পড়া শ্বশুর বাড়ির কেউ দেখেনি। ঘরের দরজা বন্ধ ছিল। রিয়ার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ার স্বামী, রিয়া শুনেছিল, পীরের আস্তানায় এখন মাসের পর মাস পড়ে থাকে। বাসা থেকে টাকা নিয়ে যায়। সংসারের কোনো শ্রী নেই। দুটি বাচ্চা নিয়ে সেই মহিলা পড়েছে নিদারুণ কষ্টে।

দুদিন পরে শনিবার রাতে বৃষ্টির ভেতর রিংকু ফরিদপুর থেকে ফিরে আসে। গায়ে আতরের গন্ধ। পীর সাহেব নাকি নিজ হাতে আতর লাগিয়ে দিয়েছে। ‘কেমন ছিলে?’ রিয়ার প্রশ্নে রিংকু সংক্ষেপে, আবেগহীন গলায় উত্তর দেয়, ‘ভালো।’ জিগ্যেশও করে না তুমি কেমন আছ। রিয়া অবাক চোখে রিংকুকে দেখে। এই কী সেই রিংকু যে তাকে জীবনানন্দের ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা’ শুনে টিএসসিতে ওর চুলের কথা বলেছিল! বিয়ের আগে কতদিন, কত সন্ধ্যায় বেলীরোডে নাটক দেখে নাটকের সংলাপ নিয়ে, বিষয় নিয়ে, রাজনৈতিক বক্তব্য নিয়ে কথা বলা রিংকু!

রিয়া জিগ্যেশ করলো, ঘরে ঢোকার সময়, ‘বিড়বিড় করে কী বলছিলে’, ‘ঘরে ঢোকার দোয়া পড়লাম’ রিংকুর জবাব শুনে রিয়া, যেন চমকে উঠেছে, বললো, ‘কী বললে?’ ‘বাইরে থেকে আসলে ঘরে ঢোকার দোয়া পড়তে হয়,’ রিংকুর জবাব শুনে রিয়ার মুখ হা হয়ে যায়। মুখের হা বন্ধ হলে হেসে ফেলে। ‘হাসলে যে’ রিংকু যেন কৈফিয়ৎ চায়। ‘না ভাবছিলাম যে-ভাবে পীরের মুরিদ হচ্ছো, দোয়া পড়ে ঘরে ঢুকছো, আমাকে আজকালই হয়তো বলবে বোরকা পরে বাইরে যেতে হবে, বিছানায় যাবার আগে আমাকে দোয়া দরুদ পরে তোমার সাথে শুতে হবে’ রিয়া কথাগুলি জোরে বলেনি। রিয়া জানে, রাগ আর বিদ্বেষের কথা ধীরে ধীরে শান্ত গলায় বললে ইফেক্ট বেশি হয়। রিংকু গম্ভীর হয়ে বললো, ‘প্রয়োজনে বোরকা পড়তে হবে, দোয়াও পড়তে হবে, আমি যে-ভাবে বলবো সে-ভাবে চলতে হবে।’ রিংকু এরকম বলতে পারে রিয়া স্বপ্নেও ভাবেনি। বিস্মিত চোখে রিয়া রিংকুকে দেখে। ‘কী উত্তর দাও?’ রিংকু এবার তর্জনি রিয়ার নাকের ডগায় ঝাঁকতে ঝাঁকাতে প্রশ্ন করে। শান্ত গলায় রিয়া বলে, ‘এভাবে তো চলবে না, তোমার আসল প্রব্লেমটা কোথায় তা কি জান?’ রিংকু তর্জনি নামায়, ভ্রু কুচকায়, ‘আসল প্রব্লেমটা কোথায়’ রিয়ার এই কথার মধ্যে কীসের ইঙ্গিত আছে, বোঝার চেষ্টা করে, ধরতে পারে না। যেহেতু আছে রাগ নামের এক উত্তেজনার ভেতর, তার উপর আবার ইঙ্গিত বোঝার ব্যর্থতা, রিংকু রিয়ার ডান হাতের কব্জি সজোরে ধরে, দাঁত কামড়ে জিগেশ করে ‘বলো আমার প্রব্লেমটা কী?’ রিয়া রিংকুর চোখে চোখ রেখে বলে : রিংকু তুমি আসলে ধর্মকর্ম করার নাম করে পালাতে চাও, রাতে এই উছিলায় ঐ উছিলায় আগেই ঘুমায়ে পড় কেন, আমি তোমারে জড়ায়ে ধরলে ঘুমের ভান কইরে পড়ে থাক ক্যানো?’ প্রায় এক শ্বাসে বলা কথাগুলি শুনে রিংকু বলে, ঠিক আছে আজ রাতে দেখা যাবে।’ ‘ঠিক আছে পুরুষ দেখা যাবে’, রিয়া মৃদু হেসে উত্তর দেয়।

রাত। ঘরে নীল আলো। মশারির উপর পাতলা একটি চাদর পেড়ে দেয় রিংকু। মিলনের সময় শয়তানের চোখ পড়তে পারে। ওরা শয্যায়। রিংকু বিড়বিড় করে শোয়ার দোয়া পড়লো। রিয়া দেখেও কিছু বললো না। যেন রিংকুর অনেক তাড়া, কোনো আদর নয়, শুুধু একটা চুমু দিয়ে রিয়াকে অনাবৃত করে। স্ত্রী-সহবাসের দোয়া পড়ে মিলিত হলো রিংকু। বিড়বিড় করে দোয়া পড়লো বির্যপাতের সময়। রিয়া নির্বিকার শুয়েছিল। রিংকুর মনে হয় রিয়াকে জিগেশ করে, কেমন হলো। রিয়ার মুখ ভাবলেশহীন। চোখ বোজা। হঠাৎ রিংকু রেগে যায়, দাঁতে দাঁত ঘষে রিয়াকে বলে, তোমার এত খাঁই কেন, গোসল করে ঘুমাও।’ রিয়া কিছুই বলে না। কাঁদছে। ভাবে, কী করে রিংকুর থেকে, এই বাড়ি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

১১.
আমিই রিংকুকে খুন করেছি, মাননীয় আদালত আপনারা যে শাস্তি দেবেন আমি মেনে নেব, আমি কোনো রাগের মাথায় খুন করিনি, আপনারা জানেন আমাদের বিয়ে হয় পনের মাস আগে, বিয়ের তিনচার মাস পর থেকে আমি কোনো শান্তি পাইনি, দাম্পত্য সুখ পাইনি, খুন করবার জন্যে তিন মাস ধরে নিজেকে প্রস্তুত করেছি, আমার এই পরিকল্পনার সাথে আমাদের বাসার কেউ নেই, তবে খুনটা যে-রাত্রিতে আমি করেছি, সে-রাত্রে আমরা মিলিত হয়েছিলাম, ওর মিলনের ইচ্ছাকে আমি ওর জীবনের শেষ ইচ্ছা হিসাবে পূরণ করেছিলাম, ফাঁসীর আসামীর শেষ ইচ্ছা পূরণের কথাটা আমার মাথায় এসেছিল, পনের মাসের মধ্যে রিংকু ৮-বার ফরিদপুর যায়, প্রতিবার এক-একটা তাবিজ আনে, তাবিজ বদলায়, বিয়ের ৯-মাস পর থেকে আমি বোরকা পরি, তাবিজ আর বোরকা না পরলে আমাকে চড়-থাপ্পড় মারতো, উঠতে বসতে আমার কোন আচরণে কোন পাপ হচ্ছে, ধর্ম কোনটাকে অনুমোদন করে, কোনটাকে করে না, তার বিধিনিষেধ শুনতে হতো, আমার শ্বশুর আমার জীবনযাপনের একটা গাইডলাইন আমাকে দিয়ে বলেছিলেন, পীর সাহেব নাকি ঐ গাইডলাইন দিয়েছিলেন, প্রেম করে বিয়ে করেছিলাম জন্যে নিজের মার কাছে, বাবার কাছে, ভাইবোনদের কাছে, বন্ধুদের কাছে মার খাওয়ার কথা কখনো বলিনি, ঐ বাড়িতে আমার ননদিনী শিলা আর শা¦শুরী অনেকবার ঐ পীরের বিরোধীতা করেছে, কোনো কাজ হয়নি, একদিন সন্ধ্যায় পীর সাহেব বাসায় এলেন, আমাকে হুকুম করা হলো, পীর সাহেবের পা ধুইয়ে দিতে হবে, পা মুছে দিতে হবে, এটা উনার নাকি ইচ্ছা, আমি বেঁকে বসি, রিংকু আমার চুল ধরে টেনে টেনে পীর সাহেবের সামনে আনে, আমি পীর সাহেবের পা ধুইয়ে দিইনি, পীর সাহেব কোনো কথা বলেননি, আমাকে পা ধুইয়ে দিতে বলেননি, আমার মনে হয়েছে, পুরো ব্যাপারটা রিংকু আর আমার শ্বশুরের সাজানো, কেননা পীর সাহেব বলছিলেন, আপনারা এইটা কী করছেন, বৌমা কেন আমার পা ধোয়াবে, ওকে নিয়ে যান, তখন রিংকু বলছিল, না হজুর বড় বেয়াদব, পীর সাহেব দ্বিতীয়বার বললেন, বৌ মাকে ঘরে যেতে দিন, আমি সেই রাতে ঘরে যেয়ে ভেবেছিলাম একটি চিঠি লিখে আত্মহত্যা করবো, সাথে সাথে মনে হলো, প্রতিশোধ নিতে হবে, বাথরুমে যেয়ে চোখেমুখে অনেকক্ষণ পানি দিলাম আর নিজেকে বললাম, আমি নিষ্পেষিত হতে হতে শেষ হয়ে যাচ্ছি, মনে হচ্ছিল একটা কিছু আমাকে করতেই হবে, নিজেকে আর কত অপমানিত হতে দেব, আমার যা হয় হবে, রিংকু আমার জীবনকে ধ্বংস করেছে, ওকে, মানে আমার প্রেমকে আমি খুন করবো, মাননীয় আদালত, আপনারা বিচার করবেন আমি আসলে কাকে খুন করেছি, আপনারা যে রায় দেবেন আমি মাথা পেতে নেব।

১২.
মাননীয় প্রধান বিচারক পাশের বিচারককে নিচু গলায় বললেন, কোন তারিখে এই মামলার রায় দেওয়া যাবে? তার চোখ রিয়ার উপর। রিয়ার মুখ শান্ত, চোখের দৃষ্টি নির্বিকার। পাশের বিচারক তার পাশের বিচারকের দিকে তাকালেন। প্রধান বিচারক আবার বললেন, রায় কোন তারিখে দেওয়া যাবে? পাশের বিচারক আবার তার পাশের বিচারকের দিকে তাকালেন।

আষাঢ়, ১৪১৪
======================
গল্প- আলিমের নিভৃতিচর্চা by রাশিদা সুলতানা   গল্প- প্রত্যাবর্তন: আমার ‘ফেরা’ নিয়ে যে কাহিনী না ..মানষ চৌঃ   গল্প- 'বীচিকলায় ঢেকে যায় মুখ ও শিরোনাম' by আনোয়ার ...  গল্প- 'প্রীত পরায়া' by সিউতি সবুর   গল্প- 'চলিতেছে' by মাহবুব মোর্শেদ   গল্প- 'গোপন কথাটি' by উম্মে মুসলিমা   গল্প- 'রূপকথা' by লুনা রুশদী  সঞ্জীব চৌধুরীর কয়েকটি গল্প   গল্প- 'অস্বস্তির সঙ্গে বসবাস' by ফাহমিদুল হক   গল্প- 'মঙ্গামনস্ক শরীরীমুদ্রা' by ইমতিয়ার শামীম   গল্প- 'হাজেরার বাপের দাইক দেনা' by জিয়া হাশান  গল্প- ‘অপঘাতে মৃত্যু’ ও ‘সাদামাটা’ by লীসা গাজী   গল্প- 'দ্বিতীয় জীবন' by ইরাজ আহমেদ  গল্প- 'পুষ্পের মঞ্জিল' by সাগুফতা শারমীন তানিয়া   গল্প- 'একশ ছেচল্লিশ টাকার গল্প' by কৌশিক আহমেদ  গল্প- 'একে আমরা কাকতালীয় বলতে পারি' by মঈনুল আহসান...



bdnews24 এর সৌজন্যে
লেখকঃ জাহিদ হায়দার


এই গল্পটি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.