গল্প- 'কর্কট' by রাশিদা সুলতানা

রের দরজায় পাটিতে বসে মালার মাথাটা কোলের উপর ধরে নুরজাহান উঁকুন আনছিল। ঘুপচিগলির এই ঘরে কেবল দরজার কাছটায় দিনের আলোয় খানিক আলোকিত হয়। টিনের একচালা ঘরের এই রুমের বাকি অংশটুকু সারাক্ষণ অন্ধকারেই থাকে। উঁকুনের কামড়ে ঘুমের মাঝে মেয়েটা সারারাত মাথা চুলকায়। দিনের বেলা একঘণ্টা ঘুমালেও মাথার চুলকানিতে অস্থির হয়ে থাকে । দুপুরের খাবারের পর মেয়েকে পাঁকড়াও করে বসে উঁকুন-নিধন যজ্ঞে। ঘরের ঘুলঘুলিতে চড়ুইপাখি চিড়িৎ চিড়িৎ ডেকে যাচ্ছে। চৌকাঠের অদূরে ড্রেনের কালো ময়লা পানি বাতাসে তিরতির তরঙ্গে বয়ে যায় দুর্গন্ধ ছড়িয়ে। কালো মাছি উড়ছে ভন ভন করে। উঁকুন মারা মাছ ধরার মতোই নেশার ব্যাপার। শরীরে ব্যথা থাকায় এবং চোখে খানিক কম দেখায় দু’তিনটা ছোট ছোট উঁকুন তার হাতছাড়া হয়ে যায়। মেয়ের মাথার সব চুল উলটপালট করে লিকি, ঢেলা বেশ কয়টা ধরা পড়ে। বামদিকের একটা ঘর থেকে ময়না বের হয়ে এসে ড্রেনের উপর বমি করছে। খানিক আগেই তার ঘর থেকে উচ্চ হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। হলুদ আঠালো পদার্থের সাথে একদলা ভাত বেরিয়ে ড্রেনের কালো পানির স্রোতে মিশে যাচ্ছে। মেলামাইনের গ্লাসে পানি নিয়ে কুলি করে। খানিক পরই ময়নার ঘর থেকে ময়না আর এখানকার দালাল সিরাজের উচ্চ হাসির শব্দ শোনা যায়। ময়নার বমি, কুলি করা, উচ্চ হাসি কোনোকিছুই মাজেদার গভীর অভিনিবেশে উঁকুন আনায় বিঘ্ন ঘটাতে পারে না।

নুরজাহান এসে দরজার কাঠে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। ছিপছিপে গড়নের এই নারী ব্যক্তিত্বে, চেহারায় আকর্ষণীয়। সিঁদুর রংয়ের টাঙ্গাইল শাড়ি দিয়ে মুখের, গলার ঘাম মুছতে মুছতে বলে, “বিসমিল্লাহ্ পেট্রোল পাম্প-এর মালিক আমিন সাহেব আইছিল সামেনার ঘরে। তুই তো জানস হ্যায় যে এসপি, ডিসি, জজ, ম্যাজিস্ট্রেট সবারই বন্দু মানুষ। সবাই তার কথা শুনে। সামেনার ঘর থিকা বাইর হইয়া আমার লগে দেখা করছিল। কইছে, ‘দ্যাখো তুমি তো এই পাড়ার ম্যানেজার। তুমি তো জানো হজুর, মৌলভি বহুৎ লোক এই বেশ্যাপাড়া তুইলা দেয়ার লাইগা উইঠা পইড়া লাইগা আছে। তোমরা প্রশাসনরে টাকা পয়সা দাও জানি, কিন্তু তারপরও আমাদের সাপোর্ট ছাড়া টিঁকতে পারবা না। গলির মাথায় কোঁকড়া চুলের একটা মেয়ে দেখলাম, নাম জিগাইলে কইল মালা, ঐ মাইয়টারে দরকার আমার, তুমি তারে তৈরি কইরা নাও।”

শেষ বিকেলের সোনালি আলো নুরজাহানের মাথার উপর দিয়ে ঘরে ঢুকছে। একটা হলুদ বোলতা দরজার কাঠের চারপাশে ভনভন করছে। একটা পা ঘরের বাইরে আরেকটাকে দরজার ভিতরে ছড়িয়ে দিয়ে চৌকাঠের পাশে বসে পড়ে নুরজাহান। “তর তো এত বড় একটা অসুখ ধরা পড়ছে। জরায়ু অপারেশন করতে গিয়া জমাইন্যা টাকা শেষ কইরা ফালাইছস। বহুৎজনের কাছে ধারদেনা, তর জরায়ুতে ক্যান্সার হইছে এই কথা রাষ্ট্র হইয়া গেছে। কেউ জাইনা শুইনা রোগীর লগে শুইতে আইব না। তুই তো দুইতিনমাস আগে কবে জানি কইছিলি মালার মাসিক হইছে। কোনো টেনশন করিস না। মালার বয়সী আরো দুইতিনজনরে ট্রেনিং দিয়া লমু।”

অভিব্যক্তিহীন মাজেদা নিঃশব্দে মালার চুলে হাত বুলায়। শেষ বিকালের সূর্যের একচিলতে আলো ঘরে ঢুকছে। মাজেদা দেখে অযুত নিযুত ধুলিকণা সেই আলোতে উড়ে বেড়াচ্ছে পরিদের মতো ডানা মেলে।

নুরজাহান ভালো করেই জানে সে যা বলবে তা পছন্দ না হলেও মেনে নেবে মাজেদা। কারণ তার অসুখে ডাক্তার অপরেশন অষুধপত্র খাওয়াদাওয়া সমস্তকিছুর আয়োজন নুরজাহানই করেছে, তাছাড়া নুরজাহানের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস কখনোই হয় নাই অসুস্থ এই সুন্দরী মানুষটার। তারপরও আরো বিশদ ব্যাখ্যা দেয়, “কী করবি ম্যায়া লইয়া? পড়ালেখা করায়া ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানাবি? ভদ্রলোকের কাছে বিয়া দিবি? এরপর জীবনভর জামাইর মাইরমুড়ালাথিগুঁতা খাইব? এইখানে তো স্বাধীন জীবন; মাইরধর করার কেউ নাই। বেশ্যার মাইয়ারে কোন ভদ্রলোকে বিয়া করতে আইতো?”

মাজেদা কিছুই বলে না। মাথা নিচু করে বালিশে মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে ঘুমানো মেয়েটার কোঁকড়া চুলে হাত বুলায়। তাকে নিশ্চুপ দেখে নুরজাহান উঠে চলে যায়। মেয়ের কোঁকড়া চুলগুলোকে সরিয়ে মুখটা দ্যাখে, আতঙ্কে নিজের ভিতর কুঁকড়ে যায়, তারপর গভীর অভিনিবেশে দ্যাখে কী অপরূপ ছোট্ট একটা পরি ঘুমাচ্ছে তার কোলের উপর, অস্ফুটে বলে, “সুবহানাল্লাহ্।” সে কখনোই ধার্মিক ছিল না, শুধুমাত্র শবেবরাতে এবং রোজার মাসে নামাজ-রোজা করে, কিন্তু মেয়েটার জন্মের পর যতবার অভিনিবেশে তাকে দেখেছে, পরম মুগ্ধতায় ততবার মনে মনে বলেছে, সুবহানাল্লাহ্। এই মেয়ের বাবা কে তাও সে জানে না। সেসময় বহুলোকের সাথে শুয়েছে। প্রতিরাতে নানাবয়সী কাস্টমার এসেছে।

মালা এখন ক্লাস ফাইভে পড়ে। তার হাতের লেখা অনেক সুন্দর বলে আশপাশের বিভিন্ন বয়সী নারীরা তার হাতে তাদের প্রেমিকদের জন্য চিঠি লিখিয়ে নেয়।

সন্ধ্যায় ঘরের অন্ধকারে মাজেদা নিশ্চল বসে থাকে। অন্যান্য দিন অবেলায় ঘুমাতে থাকলে মেয়েটার ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। আজ আর ভাঙায় না। ঘরের পাশে কড়ইগাছে পাখির কাকলি। কারো ঘরে ট্রানজিস্টারে মমতাজের গান বাজছে। ঘরের সামনে ড্রেনে কালো পানির সাথে মিশে যাছে বমির হলুদ-সাদা ময়লা, ঘরের কোনায় মালার মলিন বইখাতা, আশপাশে সব ঘরে আলো জলে ওঠে। মাজেদা আলো জ্বালায় না। মেয়েকে মশা কামড়াচ্ছে জেনেও না।

***

মালা তার সমবয়সীদের সাথে খেলাধুলা করে দিনের বেশিরভাগ সময় কাটায়। সকালবেলা এনজিও স্কুলে যায়। দুপুরের পর থেকে সারাদিন সমবয়সীদের সাথেই গল্প বা খেলাধুলা করে। শৈশব থেকেই মালা এবং তার বন্ধুরা জানে তাদের অনেকেরই জীবনে জন্মের পর থেকেই বাবার অস্তিত্ব নাই। প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যা হবার আগে মা, নুরজাহান খালা, সুফিয়া খালা এবং আর বাকিসব খালারা সেজেগুঁজে তৈরি হয় কাস্টমার ধরার জন্য। ফলে রাতে মায়ের বুকে ঘুমানোর সুযোগ এখানকার শিশুকিশোরদের হয় না। শুধু যেদিন মায়েরা কাস্টমার না পেয়ে বিফলমনোরথ ফিরে আসে, সেদিনই তারা বিষণ্ন মনে সন্তানদের বুকে জড়িয়ে ঘুমায়। বাকি দিনগুলো কখনও একা, কখনও লাভলি আপার বা অন্য বন্ধুদের সাথে বিছানায় শুয়ে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে। কাস্টমারের খোঁজে বেরিয়ে যাবার আগে মা মালাকে সন্ধ্যার খাবার খাইয়ে দিয়ে যায়। আশৈশব প্রায় প্রতিসন্ধ্যায় মালা দেখেছে আয়নার সামনে বসে মাকে সযত্নে সাজতে। দু’চোখে কাজল দিয়ে বালিশের নিচে থেকে মেরুন, কমলা, লাল বা আর কোনো উজ্জ্বল রঙের শাড়ি পরে আয়নায় মুগ্ধ তাকিয়ে থাকে মা। ধনুকের মতো ভুরুজোড়া কখনো কোঁচকায় আবার প্রসারিত করে, মুচকি হাসে, ফিসফিসিয়ে কিছু বলে… আত্মমগ্ন মাকে সেই সময় মালার পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারী মনে হয়। মা চলে গেলে পাড়ার সামনের মাঠে হয়তো বৌছি, গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্দা খেলে অথবা বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারে।

তার চেয়ে বছর-দেড়েক বড় লাভলি আপা তাকে নানা গল্প শোনায়। একদিন জানায় এই শহরের কোনো এক বড়লোক পয়সাওয়ালার বেটা নাকি নুরজাহান খালার কাছে আসে, ‘মা-মেয়ে’ দু’জনার সাথেই একসাথে শোবে, এমন প্রস্তাব দেয়। বিদেশি সিনেমায় নাকি সে দেখেছে কেউ-কেউ মা-মেয়ের সাথে একইসাথে শোয়। শিউলি আপা আর শিউলি আপার মা ছাড়া এই পাড়ার কোনো মা নাকি মেয়ের সাথে একসাথে শুতে রাজি হয় নাই। ঐ বড়লোকের পোলা নাকি তাদের বহুত গয়নাগাটি, এমনকি শহরে একটা বাড়ি কিনে দিয়েছে। লাভলি আপা মাঝে মাঝে তার সাথে ঘুমায়, পাশের ঘরগুলোতে কী হচ্ছে তার বর্ণনা দেয়, কখনও মালার ছোট হাতদু’টো নিজের বুকের উপর টেনে নেয় এবং তার হাত দিয়ে মালার শরীরের বিভিন্ন জায়গা স্পর্শ করে।

এর মাঝে মা অসুস্থ হয়ে পড়ে, ব্যথায় কোঁকায়, বিকালে আর সাজে না, কাস্টমারের খোঁজে বের হয় না। চোখে-মুখে সারাক্ষণ বিষণ্নতার ছাপ। ব্যথায় কাঁদে কখনও। নুরজাহান খালা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়।

একদিন নুরজাহান খালা লাভলি, মালা, ও তাদের সমবয়সী মেয়েদের ছ’সাতজনকে ডেকে পাঠায়, বলে, “তোরা হগোলতেই আমার মাইয়া। তোগোরে সাজাইয়া গুঁজাইয়া লইলে পরির মতো লাগবো।” কোক, সেভেন-আপ-সহ নানা মুখরোচক খাবার বেড়ে দেয় তাদের সামনে। তারপর তাদের টেলিভিশনের সামনে নিয়ে যায়। “দ্যাখ্, মজার জিনিস! এখন তো বড় হইছস, দুনিয়ার সবকিছু বুইঝা ল।” বলে, নীলছবি চালু করে দেয়। এভাবে দিনে-দিনে মালার কাছে উন্মোচিত হয় নতুন এক পৃথিবী। তাদের সাথে আরেকজন দর্শক থাকে, খালেদ মামা। নুরজাহান খালার ভাতার বলে সবাই তাকে চেনে। সারাদিনই নুরজাহান খালার সাথে আঠার মতো লেগে থাকে। সিনেমা চলার সময় বা শেষে, নানা ছুতায় মালার শরীর স্পর্শ করে সে, নুরজাহান খালার চোখের সামনে। একদিন বিকালে মালাকে শাড়ি পরিয়ে, সাজিয়ে টিভির সামনে বসে নুরজাহান, সেদিন মালাকেই ডাকে শুধু, আর কাউকে না। কোকের সাথে নেশা জাতীয় দ্রব্য মেশানো থাকে বলে দু’চোখে জড়িয়ে আসে মালার। নুরজাহান খালা বেরিয়ে গেলে খালেদ মামা এসে তাকে আলিঙ্গন করে, কোমলভাবে তার শরীর স্পর্শ করে, নেশাগ্রস্ত মালা জিজ্ঞাসা করে, “সবাই না আপনারে নুরজাহান খালার ভাতার বইলা চিনে? আমার লগে এমন করতেছেন, খালা আপনারে খুন করবো না? সবাই তো কয় খালা আপনারে পাগলের মতো ভালবাসে।”

খালেদ হেসে জবাব দেয়, “ভালবাসে বইলাই তো পরির মতো তোরে আমার হাতে তুইলা দিছে ট্রেনিং দেওয়ার লাইগা।” দিনে-দিনে খালেদ তাকে দীক্ষা দেয় কামসূত্রের নানা কলাকৌশলে।

***

মাজেদার শরীরের ব্যথা দিনের পর দিন তীব্র হওয়ায় বাজারে যাওয়া, চুলার কাছে যাওয়া, কোনোকিছুই আর সম্ভব হয় না। নুরজাহান ইদানীং মালাকে অনেক আদর করে। মেয়ের মুখে নুরজাহান খালার প্রশংসা “খালা এটা খাওয়াইছে, ওটা কিনে দিছে, খালা না থাকলে কী হইত। কে তুমার লাইগা রানত, কে যে ডাক্তারের কাছে নিয়া যাইত খোদা জানে।” মালা ইদানীং চোখে কাজল দেয়। সুন্দর সব পোশাক পরে।

রাতে খাওয়া শেষ হলে, “নুরজাহান খালার ঘরে যাই,” বলে চোখে-কাজল-দে’য়া, কানে-ঝুমকা-পরা ছোট্ট পরি উড়ে যায় ঘর থেকে। ঘরের কোনায় ধুলোমলিন বইখাতা পড়ে থাকে। ষাট ওয়াটের বালবের আলোয় মাজেদা দেখে ঘরে প্রচুর ঝুল জমে গেছে। নুরজাহান বলছিল মালা-সহ দশ-বারো বছরের মেয়েদের ট্রেনিং করাবে, খোদা জানে কী ট্রেনিং করাচ্ছে।

ঘরের বাতি নিভিয়ে দেয়। কড়ইগাছে দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙে যাওয়া পাখির পাখসাট। মুণ্ডুহীন ধবধবে সাদাডানাওলা ঘোড়ায় চড়ে মালা উড়ে যাচ্ছে। দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে মালা। অকস্মাৎ ব্যথায় ঘামতে থাকে মাজেদা। মনে হয় করাত দিয়ে কাটছে কেউ তার তলপেট, ঊরু। মাঝরাতে মেয়ে ফিরে আসে। পরদিন দুপুর পর্যন্ত মাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে শিশুর মতো।

এর কিছুদিন পর দুপুরের খাওয়ার পর নুরজাহান মালাকে ডেকে নিয়ে যায়। খানিক পর মাজেদার ঘরে এসে বলে, “মালারে ট্রেনিং দিয়া শিখায়া লইছি। টেনশন করিস না তুই। পাশের ঘরেই থাকবো। আজ রাইতে আমিন সাব আইবো। মালা কইছে, তর ব্যথা বলে বাড়ছিল অনেক। ডাক্তার তো কইছিল ঢাকায় গিয়া কিমোথেরাপি দিতে। একটু গুছায়া উঠতে পারলে তরে ঢাকায় পাঠাইয়া দিমু।”

সন্ধ্যায় নুরজাহান রাতের খাবার নিয়ে আসে। তাকে ঘুমন্ত দেখে খাবার ঢেকে রেখে চলে যায়। সে-রাতে পুরোসময় অন্ধকারে কাটায় সে। যখন নিশ্চিত হয় পাশের ঘরে পুরুষ কণ্ঠস্বর ও মালার কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে, সে উঠে দাঁড়ায়, দুইরুমের মাঝে বেড়ার পার্টিশন দে’য়া এক ফুটো দিয়ে চোখ রাখে পাশের ঘরে; সাদা ফিনফিনে পাঞ্জাবি পরা ক্লিন শেভ্ড্ আমিন সাহেব, গলায় সোনার চওড়া চেইন, আর মালা নগ্ন দেহে বালিশে হেলান দিয়ে, পরিমিত হাসি, মাপা চাহনি, যেন বহুদিনের অভিজ্ঞ যৌনকর্মী, নগ্ন খুদে কোনো দেবী। লোকটাও মালার সহজ আচরণে বিগলিত হয়ে তার চেহারায় এমন এক কাঙালিপনা ঝুলিয়ে রেখেছে, যেন সে তার দাসানুদাস। একসময় মেয়ে জন্তুর মতো চিৎকার করে। আমিন সাহেব মাঝরাতের আগেই মালার দুগালে আদর করে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বের হয়ে যায়। পরিমিত হাসি, পরিমিত চাহনির খুদে নগ্ন দেবী এর মাঝেই ঘুমিয়ে পড়ে দ্রুত।

দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে থাকায় মাজেদার শরীর কাঁপতে থাকে। ব্যথা তীব্র হয়, যেন ধারালো কোনো অস্ত্রে কেউ কোপাচ্ছে তলপেটে। প্রথমে প্রথমে গোঙানি, তারপর চিৎকার করে কাঁদতে থাকে সে। নুরজাহান ছুটে আসে। ময়না, সাবিহা আসে, মাথায় পানি ঢালে কেউ। নুরজাহান দু’টা ঘুমের ঔষুধ খাইয়ে দেয়। পাশের ঘরে মালা তখনও মদের নেশায় গভীর ঘুমে। নুরজাহান শহরের সবচেয়ে বড় “গুলশান-আরা” ক্লিনিকের মালিককে বলে একজন ডাক্তার পাঠাতে। ক্লিনিক মালিকের সাথে দীর্ঘদিনের সখ্য তার। পরদিন ডাক্তার এসে মাজেদাকে দেখে ইনজেকশন দিয়ে চলে যায়। যাবার আগে বলে কেমোথেরাপি ছাড়া বাঁচবে না।

দুপুরে পাশের ঘরে ঘুম ভাঙলে মালা উঠে এসে মায়ের পাশে শোয়। পুরো বিকাল, সন্ধ্যায় মায়ের পাশে ঘুমিয়ে কাটায়। দরজার বাইরে ড্রেনের কাছে ছোট ছোট কচুগাছ মাথা দোলায়। ড্রেনের ওপাশে সুফিয়ার ঘর, তার ঘরের পিছনে বেড়ায় রং-জ্বলে-যাওয়া লাল পেটিকোট ছড়ানো। তার পাশেই কালচে লাল এবং হলুদ দাগওয়ালা মাসিকের ত্যানা ধুয়ে ছড়ানো। দরজা সমীপবর্তী ড্রেনের পানিতে ভেসে যায় ছোট ছোট কালো পোকা, মাছ, নাবিস্কো বিস্কুটের প্যাকেট, পরিত্যক্ত কনডম।

দরজার কাছে পাটিতে মালা গভীর ঘুমে। মেয়ের মুখের দিয়ে চেয়ে মাজেদা মনে মনে বলে, “সুবহানাল্লাহ, খোদা সুবাহানাল্লাহ, যদি ছয় মাস বা এক-দুই বছর পরে মইরা যাই, তুমি দেইখো তোমার দান, তোমার আমানত।” বলতে বলতে ফুঁপিয়ে ওঠে। একটা তেলপোকা দ্রুত চাটাইয়ের উপর দিয়ে মালার পা ঘেঁষে পার হয়ে যায়। একটা ধাড়ি ইঁদুর মেঝেতে পাতা তক্তার উপর রাখা মালার পরিত্যক্ত বইখাতার নিচ থেকে বের হয়ে দরজার আড়ালে অন্ধকারে ঢুকে যায়। বাতাসে পতপত উড়ছে রং-জ্বলে-যাওয়া লাল পেটিকোট। তার পাশে মাসিকের ত্যানাটা আর দেখা যাচ্ছে না। হয়তো বাতাসে ডানা মেলে উড়ে গেছে। সন্ধ্যার দিকে নুরজাহান এসে মেয়েকে ঘুম ভাঙিয়ে রাতের খাবার নিয়ে আসতে বলে। খাওয়াদাওয়া শেষ হলে মাজেদাকে ঘুমের অষুধ, ব্যথার অষুধ খাইয়ে বাতি নিভিয়ে মালাকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। ব্যথার অষুধ খাওয়া সত্ত্বেও ব্যথা কমে নি একটুও। সে যন্ত্রণায় গোঙায়।

সকালে ঘুম ভেঙে মেয়েকে পাশে ঘুমন্ত দ্যাখে, সকালের খাবারের থালা নিয়ে ময়না ঘরে ঢোকে। বিছানার পাশে কনডেন্স্ড্ মিল্কের খালি কৌটাটায় একদলা কফ ফেলে ময়নাকে বলে, “চকির নিচ থিকা চিলুমচিটা একটু বাইর কইরা দে, দাঁত মাজুম।”

“তোমার ঝিরে ঘুম থিকা তুইলা দেই, আমার জরুরি কাম আছে। মালা, ও মালা, তর মায়ের একটু দাঁতটা মাইজা দে, দাঁত মাইজা খাওয়াইয়া দে, তর ব্যারাইম্যা মায় বিছানায় কষ্ট পাইতাছে।” ধাক্কা দিয়ে মালাকে তুলে দিয়ে ময়না বেরিয়ে যায়।

মালা ঘুমকাতুরে চোখ নিয়ে চিলুমচি বের করে এগিয়ে দেয়, মগে পানি নিয়ে মাকে দাঁত মাজতে সাহায্য করে। এত সুন্দর চেহারার মায়ের মুখটা কালো ছোপ-ছোপ দাগে ভরে গেছে। ইদানীং প্রায়ই চোখের কোনে পিচুটি জমে থাকে। শরীর থেকে একটা বোঁটকা গন্ধ আসে, গলার চামড়া বৃদ্ধাদের মতো কুঁচকে গেছে, অথচ একবছর আগেও তার মায়ের শরীর ছিল টানটান; এই পাড়ায় সবচেয়ে শান্ত, ভালো মহিলা বলে পরিচিত ছিল তার। নুরজাহান খালা প্রায়ই বলে “তর মায়েরে এইখানে দালাল, কাস্টমার সবাই সমীহ করত। সবাই খুব নিরিবিলি ও শান্ত মহিলা বইলা চিনত। গালিগালাজ, আলতুফালতু কথাবার্তা কিছুই কইত না সে। তুইও এমনভাবে চলবি কেউ যেন বেশ্যা বইলা কুত্তা-বিলাইর মতো ব্যবহার না করতে পারে।” এত সুন্দর মা তার কত দ্রুত পশুর মতো কুৎসিত হয়ে গেছে।

মাকে খাওয়া দাওয়া করানোর পর চুলে তেল দিয়ে যতœ করে চুলে খোঁপা করে দেয়। খানিক পর নুরজাহান এসে বলে, “মালা, আয় মার্কেটে যামু তরে নিয়া।” তারপর মাজেদার পাশে এসে বসে, “তর শরীর কেমন?”

- আছে আগের মতোই।

- মালারে নিয়া মার্কেটে যামু, তর কিছু লাগবো?

- না লাগবো না। পাটিটা দরজার কাছে নিয়া বিছায়া দাও, আর আমারে ধইরা নিয়া ঐখানে শোয়াইয়া দাও।

দরজার কাছে পাটিতে বিছানা পেতে মালা আর নুরজাহান দু’জনেই তাকে যত্ন করে সেখানে শুইয়ে দিয়ে বেরিয়ে যায়।

সারাদিন এলোমেলো বাতাস সেদিন, দুই হাতে ভর দিয়ে দরজায় হেলান দিয়ে বসে, বাতাসের নাচের ছন্দে কোমর দুলিয়ে কড়ই পাতা উড়ে উড়ে নেমে আসে ড্রেনের পানিতে, মাজেদার চুলে, চোখে, মুখে, শাড়ির আঁচলে। ড্রেনের পানি বাতাসে তরঙ্গায়িত। দরজার চৌকাঠের নিচ থেকে কালো পিঁপড়ার সারি যাচ্ছে বামপাশে ময়নার ঘরের দিকে। মাজেদা ক্লান্ত হয়ে আবারও পাটিতে শুয়ে পড়ে। দুপরে ময়না আসে খাবার নিয়ে।

- নুরজাহানরে দেখছস? নাকি বাইর হইয়া গেছে?

- না এহনও বাইর হয় নাই। ঘরেই আছে।

- মালারে দেখছস?

- হ্যাঁ, নুরজাহান খালার ঘরে। সাজতেছিল, মার্কেটে যাইব বলে। তবে এই বাচ্চা-বাচ্চা ছেরিডিরে খালা নষ্ট করতাছে, ছেরিডির অহনও শরীলই হয় নাই। এগোরে পড়ালেখা বন্ধ কইরা ট্রেনিং দিতাছে।

মাজেদা মন্তব্যহীন তাকিয়ে থাকে, খাটের নিচে চিলুমচি এবং কফ-থুথু ফেলার কনডেন্সড মিল্কের কৌটার দিকে।

বিকেলে ঝড় হয়। সে দরজা বন্ধ করে না, বা কাউকে ডাকেও না বন্ধ করতে। তার শরীরের প্রতিটি সংবেদনে উপভোগ করে বাতাসের ফেনায়িত তরঙ্গ, বৃষ্টির ছাঁট, চুল উড়ছে বৃষ্টিতে, নাক মুখ শরীর ভিজে যাচ্ছে, মালা, বাবা, মা, প্রেম, অতীত ভবিষ্যৎ সব বিস্মৃত হয়ে নিজেকে হালকা ঝরঝরে লাগছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি সে কিশোরীর মতো নেচে উঠবে: “হলুদ গাঁদার ফুল, রাঙা পলাশ ফুল”।

বৃষ্টির পানি যখন বন্যার জলের মতো চৌকাঠের পিঁপড়াদের ভাসিয়ে নিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে পড়ে, মাজেদা দরজায় ভর করে উঠে বসে, তারপর কোনোমতে দুই হাতের উপর ভর করে কোমরটা ধীরে ধীরে সরিয়ে নিয়ে বিছানার কাছে পৌঁছায়, দু’হাতে বিছানা ধরে তাতে ভর করে উঠে বসে। ভিজা শাড়িটা খুলে ফেলে সায়া-ব্লাউজ-পরা অবস্থায় গায়ে কাঁথা টেনে দেয়।

ঝড়-বৃষ্টি থামলে সন্ধ্যায় নুরজাহান এসে ঢোকে। “হায় হায়, তর ঘরে তো বন্যা হইয়া রইছে। ঝড় শুরু হইছে পর চিল্লায়া কাউরে ডাকতে পারলি না। তর মাইয়ারে নিয়া মার্কেটে গেছিলাম। একটু সাইজা গুঁইজা গেছে আর পরির মতো লাগতেছিল। তর পেট থেকে এমন সুন্দর মাইয়া জম্ম দিছস। অরে দুইটা সোনার কানের দুল কিনা দিছি। তর শরীরের অবস্থা যেমন খারাপ হইতেছে। ডাক্তার কইছিল তরে কেমোথেরাপি দেওন লাগবে। হয়তো পুরা সুস্থ হইয়া যাইতে পারস।”

মাজেদা বলে, “আমার অপারেশনের পরে যে ঢাকায় ডাক্তারের কাছে নিয়া গেছিল তখন তো ডাক্তার কইছিল ক্যান্সার ছড়ায়া গেছে।”

- হ্যা কইছিল ক্যান্সার ছড়ায়া গেছে। আবার কেমোথেরাপিও দিতে কইছিল। তুই তো রাজি হইলি না তর ট্যাকা পয়সা ফুরায়া গেছে বইলা।

- এহন কে টাকা দিব?

- টাকার চিন্তা তুই করিস না। আমি দিমু। তর মাইয়াও এহন আয়-রোজগার করতেছে। ওর রোজগার আরও বাড়বো, তুই যদি বাঁইচা থাকস টাকার বস্তায় তুই ঠ্যাংয়ের উপর ঠ্যাং তুইলা থাকবি।

মাজেদা স্থাণু হয়ে বসে থাকে, তারপর বিছানার পাশে কনডেন্স্ড্ মিল্কের কৌটায় ছাইয়ের মধ্যে থুথু ফেলে, কৌটার গা বেয়ে সার বেঁধে পিঁপড়া নামছে।

নুরজাহান বলে যায়, “ঢাকা শহরে আরও নানা জায়গায় শুনছি কী জানি একটা ঔষুধ খাওয়াইলে না কী একটা ইনজেকশন দিলে মাইয়াগো দুধ বড় হয়। পাছার মাংস বাড়ে। তর মাইয়ার তো এহনও শরীলই তৈরি হয় নাই। এমন সুন্দর চেহারার শইলডা নাদুসনুদুস হইলে দুনিয়ার সব বেটারা লাইন দিব। তর টাকার আর অভাব থাকব না। ইণ্ডিয়ায় বলে ক্যান্সারের সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা হয়। তরে ইণ্ডিয়ায় পাঠায়া দিমুনে। পুরা সুস্থ হইয়া যাবি তুই। আগের মতো এই পাড়ার সবচেয়ে সুন্দরী রানি হইয়া বইসা থাকবি।”

মাজেদা জবাব দেয়, “তুমি যে কত কথা জানো। মানুষ কি গরু, ইউরিয়া খাওয়ালে শইল বাড়তে থাকব? তুমি কি আমার ঝিয়েরে ইউরিয়া খাওয়াইতে থাকবা?”

- দ্যাখ, জম্ম তুই দিছস, কিন্তু আমি অরে নিজের মেয়ের মতো আদর করি। জামাকাপড় যেটা চায় কিনা দেই। সোনার গয়না দিছি। মার্কেটে নিয়া গিয়া চাইনিজ খাওইয়া আনছি। কালকে ডাক্তার আইসা তরে বুঝায়া কইয়া যাইব এই দু’দিনে তর মাইয়ার অসুবিধা হইব না।

- ডাক্তার বৈদ্য সবাই তোমার বন্ধু-বান্ধব, তুমি যেমন চাও অরা তেমনেই কথা কইব।

- মাজেদা, বিশ্বাস কর তর মতো বেঈমান আমার বাপের জম্মে দেখি নাই। বেলায় বেলায় রাইন্ধা তরে বিছানায় শোয়ায়া শোয়ায়া খাওয়াইতাছি। তর চিকিৎসা করাইতাছি, কয় পয়সা তর জমাইন্যা ছিল তুই নিজেই তো জানস।

বলে, নুরজাহান ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

মায়ের দিকে মালার নজর দিনে দিনে কমে আসে। নুরজাহান তাকে আগলে রাখে। চমৎকার সব শাড়ি, গয়না, সালোয়ার কামিজে উড়ে বেড়ায়। মাঝে মাঝে মায়ের পাশে এসে শুয়ে বেঘোরে ঘুমায়। মেয়েটা হঠাৎ যেন লম্বা হতে থাকে, তার নিতম্ব, বুক ভারি হতে থাকে। প্রায় প্রতিরাতেই পাশের ঘরে মাতাল মালা এবং তার সঙ্গীর কিংবা সঙ্গীদের হাসির শব্দে রাত্রি খান খান হয়ে যায়। মাজেদার যেদিন শরীর ভালো থাকে সেদিন ঘরের ফুটো দিয়ে দ্যাখে মাতাল মেয়ের অনিন্দ্যসুন্দর দুই চোখ। তার উদ্দাম হাসিতে রাত্রি যেন আরো নিবিড় হয়ে হঠে। সদ্য-বিবাহিত মেয়ের মতো সোনার গয়না, উন্নত বুক, সুগঠিত নিতম্ব, তলোয়ারের মতো ধারালো শরীর। মুখটা এখনো শিশুর। এই সুন্দর শরীরটা অচেনা মায়ের, মুখটা তার মালার। “ছোট ময়না পাখি, ছোট পরি আমার, সুবহানাল্লাহ্।”

তবে মাঝে মাঝে পাশের ঘর থেকে আহত পশুর মতো মালার চিৎকার শোনা যায়। মায়ের হৃৎপিণ্ড তখন দ্রিম দ্রিম কাঁপে। অবসন্ন মা “আমার পরিটারে রক্ষা করো আল্লাহ্” দু’চোখে ভাসিয়ে মেয়ের জন্য প্রার্থনা করে।

মাস কয়েক পরে মায়ের পাশে মেয়ে যখন মৃতবৎ ঘুমাচ্ছে, মা আবিষ্কার করে মেয়ের ক্রমবর্ধিষ্ণু বুক প্রায় তলপেট ছাড়িয়ে গেছে। আতঙ্কিত চোখে মা তাকিয়ে থাকে মেয়ের শরীরের এই অস্বাভাবিক স্ফীতির দিকে।

নুরজাহান এসে মেয়েকে ডেকে ঘুম ভাঙিয়ে নিয়ে যায়। ময়নাকে পাঠিয়ে দেয় তার খাবার ও প্রাতরাশের দায়িত্ব দিয়ে। কড়ই গাছের ডালে ক্রমাগত কাক ডেকে যাচ্ছে। সাফিয়ার ঘর থেকে উচ্চ স্বরে ঝগড়ার শব্দে পুরো পাড়া মাথায় ওঠে। সুন্দর শাড়ি-গয়নায় সাজিয়ে মালাকে নিয়ে নুরজাহান ঘরে ঢোকে। “এসপি ডিসিগো কাছে লইয়া যাইতাছে রফিক, বড় বড় অফিসারেরা বলে অর কথা শুইনা আগ্রহ দেখাইছে।”

নুরজাহান, ময়না, সাফিয়া, হেলেন এবং আরো কিছু মধ্যবয়স্ক ও প্রৌঢ় নারী মাজেদার ঘরে এসে মালার ফিরে আসার অপেক্ষায় বসে থাকে। মালাকে দেখে বড় বড় অফিসাররা কী বলেছে তা জানার আগ্রহ সবার।

সন্ধ্যার দিকে মালা ফিরে এসে মাজেদার পায়ের কাছে বিছানায় বসে। “সবাই আমার লগে খুব ভালো ভালো কথা কইছে। একটা বড় অফিসার তো এত ভালোমানুষ যে আমারে কবিতা শুনাইছে গলা কাঁপায়া কাঁপায়া। হেই মানুষটা এত ভালো আছিল যে আমারে আপনে আপনে কইরা কথা কইছে। আরেকটা কোন বড় অফিসার জানি রফিক মামারে কইছে আমারে সার্কিট হাউজে না কই জানি লইয়া যাইতে।”

দিগি¦জয়ী মেয়ের দিকে সবাই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। মাজেদা মেয়ের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে, “সুবাহানাল্লাহ্।”

মাজেদার ব্যথার চিৎকার দিনে দিনে বাড়তে থাকলে দালাল মজনুকে দিয়ে নুরজাহান তাকে ঢাকায় পিজি হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। ডাক্তার যা করতে বলে, যে অষুধ দিতে বলে মজনু যেন সব আয়োজন করে, এই নির্দেশ দিয়ে দেয়। যাওয়ার আগে নুরজাহানের প্রায় হাতে পায়ে ধরে অনুনয় করে মেয়েকে সাথে নিয়ে হাসপাতালে যেতে। নুরজাহান বকাঝকা করে “তর আল্লাদ দেখলে গা জ্বলে, এহন তর ঝিয়ের ভরা মওসুম, ঝিয়ের কারণেই তর চিকিৎসা হইতাছে। এহন তর লগে গেলে ব্যবসা পুরা বন্ধ হইয়া যাইব না?”

মাজেদা বলে “যদি মইরা যাই ঝিয়ের মুখটাও দেখমু না।”

“তুই মরতি না, এতদিনে তো না খাইয়া মইরা ভূত হইয়া থাকতি, এতদিন যহন মরস নাই, এহনও মরতি না। আমরা সবাই তর লাইগা দোয়া করমু। টাকাপয়সা তো খরচ করতাছি, ইনশাল্লাহ্ তুই সুস্থ হইয়া ফিরা আসবি।”

মাস দেড়েক পর মাজেদাকে বেবিট্যাক্সি থেকে নেমে মজনুর গায়ে ভর দিযে আসতে দেখে সাফিয়ার মেয়ে নীলা নুরজাহানের ঘরে ঢুকে মালাকে আর নুরজাহানকে জানায় “মাজেদা খালা আইছে হাসপাতাল থেকে।” মালা নুরজাহানের কাছে শুনেছে তার মা আসবে দু’এক দিনের মধ্যেই। বাঁক, কুঁজো হয়ে যাওয়া, ন্যাড়া মাথার মাজেদাকে দেখে মালা চিৎকার করে ওঠে, “ও আম্মা, আম্মা গো, তুমার চেহারা এমন হইল ক্যান গো? তুমার চুল কই, মা গো?”

নুরজাহান মায়ের কাছ থেকে মেয়েকে সরিয়ে বুকে চেপে ধরে। তারপর মাজেদার একটা হাত নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে তাকে তার ঘরে পৌঁছে দেয়। একা কোথাও যাওয়া, এমকি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়াও সম্ভব হয় না আর মাজেদার। তার বিছানার পাশেই একটা পাটি, পানির বদনা রেখে যায় নুরজাহান। ছুটা বুয়া এসে তার মলমূত্র পরিষ্কার করে যায়। তার দু’হাতের নানা জায়গায় ফুলে-ফুলে মানচিত্রের মতো ফেটে গেছে। দিনরাত্রের বেশিরভাগ সময় চিৎকার করে মাজেদা। নুরজাহান তাকে ময়লার গাদা আর রান্নাঘরের পাশে একটা ছোট ঘরে পাঠিয়ে দিতে চায়। মালা আর মাকে ছেড়ে খদ্দেরদের সাথে শুতে যেতে রাজি হয় না। মালার জেদের কাছে পরাজিত নুরজাহান, মাজেদাকে তার আগের ঘরেই বহাল রাখে।

নুরজাহান বকাঝঁকা করে, মাঝে মাঝে জোর করে মালাকে তুলে নিয়ে যায়। ইতিমধ্যে মালার কাহিনী দূরদূরান্তের জেলাগুলোতেও পৌঁছে যায়। বিভিন্ন বয়সের অনেক লোকজন অনেক সময় দল বেঁধে আসে মালার সঙ্গ পেতে। অধিকাংশ সময়ই মাতালদের সাথে মালার উচ্চকণ্ঠ হাসি শোনা যায়। খানিক পরই মাতালদের হাসির সঙ্গে মালার জান্তর চিৎকার শোনা যায়। আর মাতালদের হাসি আরও বেড়ে যায় যেন তাতে।

মাতালেরা চলে গেলে মালা টলতে টলতে মায়ের পাশে এসে শুয়ে পড়ে। মা হাত দিয়ে গায়ে স্পর্শ করতেই ছোট শিশুর মতো কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে।

মাজেদার অবস্থার আরও অবনতি হয়। ব্যথায় ছটফট করতে করতে প্রায়ই অচেতন হয়ে যায়। মালা সারাদিনই মায়ের পাশে বসে থাকে। নুরজাহান সন্ধ্যার পর ঘরে এসে মালাকে তৈরি হয়ে নিতে বলতেই মালা বিদ্রোহ করে, “আমি যামুই না আজকা। মার এহন-তহন অবস্থা। আর আমারও সারা শইলে ব্যথা। তোমার দিলে কি একফোঁটা রহমও নাই?”

“রহম না থাকলে কি তর মায়ের পিছে পানির মতো টাকা ঢালছি? কয়জনে এইটা করে খোঁজ নিয়া দ্যাখ। সোনা, ময়না, ঘাড়ত্যাড়ামি করিস না। তর মার শইল এমুন থাকলে আমি আর কোনোদিন শুইতে কমু না তরে। এমপি সাহেবের মেহমান, ঢাকা থিকা আইছে, এমপি সাহেবের সেক্রেটারি, থানার ওসি সবাই কইছে যেন এই মেহমানেগো যত্ন করি। খোদার কসম সোনা, তোর মায়ের এই অবস্থায় আর যাইতে কমু না তরে। আজকে আমার মুখটা রক্ষা কর। এমপি সাব না চাইলে আমরা এইখানে থাকতে পারমু না।”

মালা শক্ত করে মাকে ধরে রাখে। কোনোভাবেই যাবে না। “আমার শইলে, তলপেটে ব্যথা। যামু না আমি।” নুরজাহান বহু অনুনয়বিনয় করে বুঝিয়েসুঝিয়ে মেয়েকে নিয়ে যায় শেষপর্যন্ত।

খানিক পরই শোনা যায় মাতালদের হাসি, বোঝা যায় অনেক মানুষ পাশের ঘরে। একজন গান গায় “তেরি পাতালি কেমেরকা এ জাদু।” অন্যরাও “এ জাদু এ জাদু” বলে ধুয়া দেয়, এবং অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ে। হাসির রোলে মালারও কণ্ঠ শোনা যায়।

নুরজাহান সম্ভবতঃ মদ খাইয়ে ঘরে পাঠিয়েছে। একজন বলে, “এমন মাল তো বাপের জম্মেও দেখি নাই, এমন মালের লাইগা ঢাকা থিকা এত দূরে আইসা ষোলআনা উশুল।” কেউ যে-কোনো একটাকিছু বললেই সবাই হাসিতে খান খান।

মাজেদা এ পাশে যন্ত্রণায় কাতরায়। ওপাশে মালার আর্তনাদ শুরু হয়। মাতালদের হাসি বেড়ে চলে। চিৎকার যত বাড়ে, পাল্লা দিয়ে বাড়ে হাসি। লোকজনের হইহল্লায় মনে হয় অন্ততঃ পনেরো-বিশজন, বা এমনকি চল্লিশ-পঞ্চাশজন, আছে পাশের ঘরে।

মাজেদার মনে হয় মেয়েটা আজকে বাঁচবে না আর। মনে মনে ভাবে কোনোভাবে গড়িয়ে হামা দিয়ে পাশের ঘরে পৌঁছে মানুষগুলোর পায়ে ধরে বলবে মেয়েকে ছেড়ে দিতে। মেয়ের চিৎকারে বোঝা যায় এ তার জীবন বাঁচানোর আকুতি। দুই কনুইয়ে ভর দিয়ে বিছানা থেকে নামতে চেষ্ট করে মাজেদা। ব্যথায় মনে হয় পুরোটা শরীর কেউ ছুরি দিয়ে ফালি ফালি কাটছে। নামতে গিয়ে ধপাস করে মেঝেতে পড়ে যায়। মনে হয় ড্রিল-মেশিন দিয়ে ওরা তার মালার শরীরটা ফুটো করে দিচ্ছে। তীব্র ব্যথায় ককিয়ে ওঠে সে। মাজেদা দুইহাতে ভর দিয়ে শরীরটাকে এগিয়ে নেয় খানিকটা। অবসন্ন হয়ে যায়। চিৎকার, হুল্লোড় সব মিলিয়ে যেতে থাকে হঠাৎ। চেতনা ফেরে যখন, মালার গোঙানি তখনও শোনা যায়; মাতালদের হল্লা শোনা যায় না আর। বাইরে ভোর হচ্ছে, মেয়ে সুস্থ থাকলে তো মায়ের কাছে চলে আসত। দুই কনুইয়ে ভর দিয়ে কোমরটা এগিয়ে নিয়ে যায়। মনে হচ্ছে তলপেট, কোমর-পিঠ সব খুলে পড়ে যাচ্ছে। দুই হাতের উপর ভর করে শরীরটাকে ছেঁচড়ে দরজার চৌকাঠ পার হয়। ড্রেনের পাশ দিয়ে মাটি-কাদায় ঘঁষটে ঘঁষটে এগিয়ে যায় মাজেদা।

নগ্ন নারীমূর্তি, যেন শ্বেতপাথরের ভাস্কর্য। মেঝেতে পড়ে আছে শিশুমুখ ছোট পরি। দু’পায়ে, কোমরে রক্তের দাগ। বিছানায়, মেঝেতে রক্ত। শরীরে তীব্র যন্ত্রণা থাকা সত্ত্বেও কোনোরকমে পৌঁছে যায় সে মেয়ের কাছে। বেঁচে আছে অচেতন, বা মদ খেয়ে গভীর ঘুমে অসাড়। পাশে দু’টি নগ্ন মাতাল ঘুমাচ্ছে। মালাকে ডাকে সে, ধাক্কা দেয়। কোনো সাড়া নেই। তার কণ্ঠস্বরে মাতালদের একজন ঘুম ভেঙে ওঠে। মাজেদার ফুলে যাওয়া শরীর, চেহারা দেখে ভড়কে যায়। মাজেদা অনুরোধ করে, মাইয়াডারে হাসপাতালে নিয়া যাও নইলে কাউরে ডাইকা দাও, হাসপাতালে নিলে মাইয়াডা বাঁচব। মাতাল তার সঙ্গীকে ডেকে তোলে। রক্তাক্ত মালা এবং তার মায়ের বিধ্বস্ত শরীরের দিকে তাকিয়ে নিজেরা চোখের ভাষায় কথা বলে ঘর থেকে উধাও হয়। মাজেদা দুই কনুইয়ে ভর দিয়ে কোমরটাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। লোহার হাত দিয়ে কেউ ছিঁড়ে ফেলছে তার কোমর আর তলপেট। খানিকটা হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে দরজার চৌকাঠে পৌঁছায়, সর্বশক্তি দিয়ে ডাকে, “ময়না, নুরজাহান, আমার মাইয়াডারে হাসপাতালে লইয়া যা।” শরীর অবসন্ন হয়ে আসে। ঢেউয়ের মতো বাতাস ছুটে আসছে। রাতভর ব্যস্ত থাকায় পাড়ার সবাই ভোরের দিকে গভীর ঘুমে অচেতন। ড্রেনের পাশে সবুজ কচুপাতা মাথা দোলাচ্ছে। প্রভাতরবির প্রথম রশ্মিটি দু’টো ঘরের মধ্যে দিয়ে তার মুখের উপর ত্যারছা হয়ে পড়েছে। প্রাণপণ এগুতে গিয়ে তার শরীরের নিম্নাংশ ড্রেনের মধ্যে পড়ে যায়। ড্রেনের মাছি বসে তার নাকে মুখে। অবসন্ন মাজেদার দৃশ্যপট দেকে অপসৃত হয়ে যায় বাতাসে-দোল-খাওয়া সবুজ কচুপাতা, ঢেউয়ের-মতো-ছুটে-আসা বাতাস, সূর্যের উজ্জ্বল আলো, মুখের উপর ভনভনানো মাছি, কোঁকড়া চুলের শিশুমুখ ছোট্ট পরি।

দারফুর, ২০০৮
===============================
রাশিদা সুলতানা 
জন্ম
ব্রাক্ষ্মণবাড়ীয়া ১৯৭৩
প্রকাশিত বই
অপনা মাঁসেঁ হরিণা বৈরী (২০০৪)
আঁধি (২০০৭)
জীবন যাপন দখিন হাওয়া (২০০৮)
পরালালনীল (২০০৯)
=============================
গল্প- আলিমের নিভৃতিচর্চা by রাশিদা সুলতানা   গল্প- প্রত্যাবর্তন: আমার ‘ফেরা’ নিয়ে যে কাহিনী না ..মানষ চৌঃ   গল্প- 'বীচিকলায় ঢেকে যায় মুখ ও শিরোনাম' by আনোয়ার ...  গল্প- 'প্রীত পরায়া' by সিউতি সবুর   গল্প- 'চলিতেছে' by মাহবুব মোর্শেদ   গল্প- 'গোপন কথাটি' by উম্মে মুসলিমা   গল্প- 'রূপকথা' by লুনা রুশদী  সঞ্জীব চৌধুরীর কয়েকটি গল্প   গল্প- 'অস্বস্তির সঙ্গে বসবাস' by ফাহমিদুল হক   গল্প- 'মঙ্গামনস্ক শরীরীমুদ্রা' by ইমতিয়ার শামীম   গল্প- 'হাজেরার বাপের দাইক দেনা' by জিয়া হাশান  গল্প- ‘অপঘাতে মৃত্যু’ ও ‘সাদামাটা’ by লীসা গাজী   গল্প- 'দ্বিতীয় জীবন' by ইরাজ আহমেদ  গল্প- 'পুষ্পের মঞ্জিল' by সাগুফতা শারমীন তানিয়া   গল্প- 'একশ ছেচল্লিশ টাকার গল্প' by কৌশিক আহমেদ  গল্প- 'একে আমরা কাকতালীয় বলতে পারি' by মঈনুল আহসান..   গল্প 'গহ্বর' by জাহিদ হায়দার    গল্প- 'পুরির গল্প' by ইমরুল হাসান  গল্প- 'নওমির এক প্রহর' by সাইমুম পারভেজ  গল্প- 'মরিবার হলো তার সাধ' by আহমাদ মোস্তফা কামাল   গল্প- 'নিষুপ্ত শেকড়' by নিরমিন শিমেল   গল্প- 'লাল ব্যাসার্ধ্ব' by শামীমা বিনতে রহমান  গল্প- 'সেদিন বৃষ্টি ছিল' by মৃদুল আহমেদ   ক. কিছুদিন হয় সেই নগরে কোন বৃষ্টি হচ্ছিল না। কিছুদ.. গল্প- 'তুষার-ধবল' by সায়েমা খাতুন  গল্প- 'কোষা' by পাপড়ি রহমান



bdnews24 এর সৌজন্যে
লেখকঃ রাশিদা সুলতানা


এই গল্পটি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.