গল্প- 'সেদিন বৃষ্টি ছিল' by মৃদুল আহমেদ
সূর্যটাকে আচমকা এক ফুঁ-তে নিভিয়ে দিয়ে রবিশঙ্করের তানপুরার মতো রিমিঝিমিয়ে বৃষ্টি নামল!
রিকশাঅলাও সাথে সাথে রিকশাটা রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে ফেলল। কোনো রকমের ঘোষণা ছাড়াই। বৃষ্টি শুরু হলে রিকশাঅলারা সাধারণত থামে না। চাকা না ঘুরলে পয়সা আসে না, ওরা জানে। হালের বলদের মতো নকল গোয়ার্তুমি দেখিয়ে সমানে প্যাডেল মারে।
কিন্তু এই রিকশঅলা ঝটাং করে রিকশা থামাল। বৃষ্টির প্রথম ছাঁটটা শুরু হবার সাথে সাথেই। যেন ইন্সটল করা সফটওয়্যার, বৃষ্টির টাচ লাগামাত্র রিকশা থেমে যাবে।
মোস্তাফিজ অন্যমনস্ক সুরে বলল, অ্যাই, তোমার পলিথিন নাই?
জবাবে রিকশাঅলা ক্যাবলার মতো হাসল, নিয়া বাইর হই নাই! ক্যাডায় জানে, এইরম আঁতকা বৃষ্টি আইব?
আসলেই, এ সময়ে বৃষ্টির ধরনটা এরকমই। দিব্যি জ্বলজ্বলে একটা দিন, রোদ ঝকঝক করছে, কিন্তু কোত্থেকে হঠাৎ তেড়েফুঁড়ে একটা হাওয়া দিল, বেশ মেঘ করে এল ওপরে, তারপরই ঝিরঝিরিয়ে নামল বৃষ্টি।
ওঃ বৃষ্টি! সে কী আশ্চর্য বৃষ্টি! মুহূর্তের মধ্যেই পুরো জায়গার চেহারাটাকে বদলে দিল। একটা ঝকমকে উজ্জ্বল বিকেল দু-মিনিটের মধ্যেই হয়ে গেল একটা বিষণ্ন প্রায়ান্ধকার সন্ধ্যা।
গলির ভেতর কতগুলো মানুষ হাঁটছিল, দাঁড়িয়ে ছিল। এ-বাড়ির ছাদ থেকে ও-বাড়ির ছাদের মেয়েদের দিকে তাকাচ্ছিল ছেলেরা, মেয়েরাও আড়চোখে সেই দৃষ্টি ফেরত দিচ্ছিল। চা-বিড়ির দোকানের সামনে বেঞ্চে অলস বসে ছিল দুই-চারটা লোক, ক্রিকেট খেলবে বলে ইঁটের ওপর ইঁট সাজিয়ে স্ট্যাম্প বানাচ্ছিল পিচ্চি পোলাপানের দল, কিন্তু বৃষ্টিটা এসেই সবাইকে হটিয়ে দিয়ে চারদিক এখন একেবারে শুনশান।
রিকশার ভেতর বসে বসে বৃষ্টির এই আশ্চর্য ক্ষমতা দেখছিল মোস্তাফিজ।
তার রিকশাঅলা পাশেই একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুঁকছে। একবার দাঁত বের করে হেসে বলল, সার বৃষ্টিতে ভিজতাছেন, নাইমা আসেন!
হ্যাঁ, মোস্তাফিজের ভেজা চলবে না। হাতের ফাইলের ভেতর অফিসের বেশকিছু জরুরি কাগজপত্র আছে। সেগুলো ভিজে গেলে মুশকিল।
মোস্তাফিজ নামল।
গাছ কতক্ষণ মানুষকে আশ্রয় দেয়? রোদ হলে সর্বক্ষণ, কিন্তু বৃষ্টি হলে তার একটা সীমা আছে। একটা সময় পাতা থেকে পাতায় পানি চুঁইয়ে পড়তে থাকে। সেটা হওয়ার আগেই ভালো একটা ছাদের নিচে চলে যাওয়া উচিত।
এদিকওদিক তাকিয়ে মোস্তাফিজ ছাদ খুঁজল। কোথাও কোনো ছাদ কি আছে? ওহে ভাইসব, ওহে এই পথচলতি অচেনা গলির বাসিন্দাগণ, আছে কি কোনো নিবিড় আচ্ছাদন, বৃষ্টির হাত থেকে অফিসের কাগজগুলো বাঁচানো খুব দরকার!
পাওয়া গেল। একটু কোনাকুনি একটা দৌড় দিলে গলির ও মাথায় একটা ছাদ তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। সেই যে এক হাউজিং-এর বিজ্ঞাপনে এক বৌ স্মার্টলি তার জামাইকে বলেছিল না, ‘বাসা-বাড়ির কথা কিছু ভেবেছ? মাথা গোঁজার ঠাঁই তো দরকার!’ ঠিক সেরকমই, মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই তার দরকার। এক্ষুনি, এ মুহূর্তে।
একটা দৌড় তাকে দিতে হবে। আর রিকশাঅলাটা? সে কী করবে?
তার দিকে ফিরে মোস্তাফিজ বলল, আমি ঐ বাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি…।
বলার দরকার ছিল না। একজন বাবুসমাজের মানুষ কখনো কোনো রিকশাঅলার কাছে কৈফিয়ত দেয় না। রিকশা নিয়ে কতটুকু এসেছে সে? পাঁচ টাকা বড়জোর হবে ভাড়া। একটা পাঁচ টাকার নোট কখনো সখনো একটা রিকশাঅলার পকেট থেকেও পড়ে যায়। এমন কিছু ক্ষতি নয়। সে দৌড়ে গিয়ে ঐ ছাদের নিচে দাঁড়ালে রিকশাঅলা ঐ পাঁচটাকা ভাড়া নিয়ে কি শঙ্কিত হয়ে উঠবে? কিছুই না।
কিন্তু মোস্তাফিজ না বলে পারে না। সে মানুষটাই ওরকম নয়। তার কেমন যেন সঙ্কোচ লাগে। ‘আমি ঐ বাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি’ কথাটার মানে হচ্ছে ‘আমি ঐ ছাদের নিচে বৃষ্টি শেষ না হওয়া পর্যন্ত তোমার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। তোমার পাঁচ টাকা আমি মেরে দিয়ে পালিয়ে যাব না! নিশ্চিন্ত থাক!’
এইটুকু না বলে ঐ ছাদটার নিচে গিয়ে ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারত না সে। খুব অস্বস্তি লাগত।
সে এরকমই।
একটু ভদ্রসদ্র গোছের নিরীহ মানুষ।
এই ভদ্রতা নিয়েই একবার একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল।
রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার সময় কারো না কারো সাথে একটু ধাক্কা তো লাগবেই। কেউ তো আবার কারো পাও মাড়িয়ে দেয়, দিয়ে তারপর আবার নিরীহ হেসে বলে, সরি! যার পা মাড়িয়ে দেয়া হয়েছে, সে মিষ্টি একটা ‘সরি’ শুনে ভচকানো জুতা নিয়ে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে চলে যায়।
তৃণার সঙ্গে তার বিয়ের কিছুদিন পর। অতি ভদ্র মোস্তাফিজের এই ‘সরি’ বলার একটা বিশাল বাতিক দাঁড়িয়েছিল সেই সময়। কারো সাথে হালকা একটু ধাক্কা লাগলেই তার মুখ দিয়ে অটো সিস্টেমে ‘সরি’ বের হয়ে আসত।
একদিন তৃণার সাথে রাস্তা দিয়ে কথা বলতে বলতে হাঁটছিল সে, কার সঙ্গে যেন একটু ধাক্কা লাগল হঠাৎ। পাশ ফিরে না দেখেই সে বলল, ‘সরি!’। আশ্চর্য, তৃণা সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ে তার দিকে ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে রইল।
ভদ্রলোক এবং নিরীহ মোস্তাফিজ সেই চাউনি দেখে চমকে গেল। ক্যাবলা হেসে বলল, কী হয়েছে?
তৃণা তাও তাকিয়ে আছে দেখে মোস্তাফিজ ধারণা করল, সে সম্ভবত কোনো মেয়ের সাথে ধাক্কা লাগিয়ে দিয়েছে! সেটাই তৃণার ক্ষেপে যাওয়ার কারণ। কিন্তু সে কি আর ইচ্ছে করে ধাক্কা লাগিয়েছে? সেরকম মানুষই সে নয়। সে পাশ ফিরে তাকিয়েও দেখে নি।
কাঁপা কাঁপা গলায় সে বলেছিল, সরি তৃণা, আমি কি কোনো মেয়ের গায়ে ধাক্কা দিয়েছি?
তাকে, এবং রাস্তায় হাঁটতে থাকা ভিড়ের একরাশ লোককে চমকে দিয়ে তৃণা হো হো করে হেসে উঠেছিল। হাসতে হাসতে বলেছিল, তোমার মতো বেকুব নিরীহ এবং অপদার্থ লোক যদি সেটা করতে পারত, তাহলে খুশিই হতাম! কিন্তু…।
কিন্তু?
তুমি যাকে ধাক্কা দিয়েছ, সে কোনো মানুষ ছিল না!
মানুষ ছিল না? মানে?
মোস্তাফিজের মাথায় আরো গণ্ডগোল লেগে যাচ্ছিল। মানুষ ছিল না মানে কী? তাহলে কি সেখানে কোনো জ্বিন দাঁড়িয়ে ছিল? অথবা এই ব্যস্ত ফুটপাথের ওপর কোনো জাবরকাটা গরু?
তৃণা উত্তর না দিয়ে ক্রমাগত হেসেই যাচ্ছিল। হাসির দমকে কেঁপে কেঁপে উঠছিল তার সারা শরীর। ফুটপাথের গতিসর্বস্ব ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল তারা দুজন। পাশাপাশি। একজন বোকাদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরেকজনের দিকে, সেই আরেকজন এই একজনের দিকে তাকিয়ে হাসিতে কেঁপে উঠছিল।
এক-একটা ছবি বোধহয় মহাকালের চিত্রশালায় স্থান পেয়ে যায়। ভিঞ্চির মোনালিসার মতোই ক্লাসিক সেইসব ছবি কখনো মুছে যায় না। চোখ বুঁজলেই দেখতে পাওয়া যায়। একদম জীবন্ত। পাশাপাশি দুইজন মানুষ। একজনের চোখে বিহ্বলতা, আরেকজনের ঠোঁটে হাসি। পাশেই চলমান ভিড়। সেই ভিড়কে অগ্রাহ্য করে দুটো মানুষ স্থির দাঁড়িয়ে।
মোস্তাফিজ চোখ বুঁজলে আজও সেই ক্লাসিক তৈলচিত্রটা একদম স্পষ্ট দেখতে পায়। তার চিত্রশালায় অবশ্য আরো অনেকগুলো ছবি আছে।
যাই হোক, তৃণা এরপর সেই গল্প অনেককে করেছে। পরিচিত যাকেই সামনে পেয়েছে, বলেছে, জানেন? আমার জামাইটা কীরকম বোকার হদ্দ? শুনুন না, কীরকম বেকুব! রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের গায়ে ধাক্কা দিয়ে না তাকিয়েই বলে, সরি!
বলেই তৃণার সেই কাঁপতে কাঁপতে হাসা। সেই হাসির ছবিও মোস্তাফিজের চিত্রশালায় তেলরঙে আঁকা আছে। মোস্তাফিজের খুব ইচ্ছে ছিল একসময়, ছবি আঁকতে শিখবে। অনেকগুলো ছবি স্মৃতি থেকে কাগজে-তুলিতে নামিয়ে রাখা দরকার। আর্ট কলেজে পড়ত এক বন্ধু, ইশতিয়াক নাম, একবার তার কাছে–
কে?
চমকে উঠে মোস্তাফিজ দেখল, কখন এক লোক বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এসেছে! অন্ধকারে খেয়াল করে নি!
গলাটা বেশ কড়া। এই গলায় শুধু ‘কে’ না বলে ‘কে তুই’ বললেই বেশি মানাত।
সামনে এগিয়ে এসে লোকটি তাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে নরম গলায় বলল, সরি!
তারপর বাড়ির কার্নিশের নিচে দাঁড় করিয়ে রাখা একটা মটরসাইকেল কাপড় দিয়ে মুছতে লাগল। এই ‘সরি’-এর মানে হল, লোকটা তাকে মটরসাইকেল চোর ভেবেছিল।
কী সাঙ্ঘাতিক! অন্ধকারে দাঁড় করিয়ে রাখা মটরসাইকেলটা মোস্তাফিজ দেখেই নি। মোস্তাফিজের প্যান্টে সার্ট ইন করা, গলায় বাড়তি উপকরণ হিসেবে একটা টাইও ঝুলছে। সেটা দেখেই বোঝা গেল, সে ভদ্রলোক? চোর নয়? তাহলে তো মটরসাইকেল চোরদের জানিয়ে দেয়া উচিত, তোমরা টাই পরে চুরি কর হে, ওতে সুবিধা বেশি!
মটরসাইকেল মুছে লোকটি কার্নিশের নিচে এসে দাঁড়াল। আকাশের দিকে একটা অর্থহীন দৃষ্টি দিয়ে বলল, বৃষ্টিটা যে কখন ধরবে!
অর্থাৎ, লোকটি এখন আলাপ জমাতে চাইছে। প্রথম দৃষ্টিতে মোস্তাফিজকে চোর ভেবে ফেলায় সে একান্তই অনুতপ্ত।
মোস্তাফিজের অবশ্য কিছু বলার নেই। সে আবহাওয়াবিদ নয় যে, বৃষ্টি কখন ধরে যাবে, সেটা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারে। কিন্তু আবহাওয়াবিদ না হলেও সে নিতান্তই ভদ্রলোক, কাজেই উসখুস করে উঠে বলল, হ্যাঁ, সেটাই!
দুটোই অনর্থক মন্তব্য। কিন্তু এই অনর্থক মন্তব্য থেকেই বিশাল একটা আলাপ জমে যেতে পারে অনায়াসেই। কেউ একজন যদি আগ বাড়িয়ে বলে, কোথায় যাবেন?
আমি? আর বলবেন না ভাই, ফার্মগেটে রাজধানী হোটেলের সামনে একজনের দাঁড়িয়ে থাকার কথা। ব্যাটা বহুদিনের পুরনো দেনাদার, বহু কষ্টে তাকে ধরা গেছে, ব্যাটা কথা দিয়েছে সাড়ে পাঁচটার সময় দাঁড়িয়ে থাকবে। কিন্তু এতক্ষণে তো বোধহয় ফুটে গেল!
তাই নাকি? দিন ব্যাটার মোবাইলে একটা ফোন! বলুন, বৃষ্টি তো বৃষ্টি, ইস্রাফিলের শিঙ্গা বাজলেও তুমি ঐখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে! আই অ্যাম কামিং!
আরে না ভাই! সেরকম কি আর হয়? দেখুন, আন্ডারগ্রাউন্ড রেল থাকলে কিন্তু এত ঝামেলা হত না! বাইরের দেশগুলো এত উন্নতি করেছে কেন জানেন? জাস্ট বাই দ্যা আইডিয়া অব কমিউনিকেশন!
আরে রাখুন ভাই বাইরের দেশ! পাশের দেশ ইন্ডিয়ার অবস্থাই দেখুন! কলকাতার মতো ছ্যারছেরে মার্কা শহরেই পাতালরেল আছে! আর আমাদের অবস্থা?
এরপরেই আসবে দেশের অর্থনীতির কথা। এরপর দুর্নীতি। তারপরেই সবচেয়ে গরম সাবজেক্ট, রাজনীতি। এভাবেই আলাপ জমে যায়। অফিসের, বাসার ঠিকানা বিনিময় হয়… চলে আসবেন ভাই! …এরপর সত্যি সত্যি চলেও আসা হয়। বন্ধুত্ব হয়। কখনো সখনো আবার একজন আরেকজনের প্রফেশন্যাল লাইনের গুরুত্বপূর্ণ চেইনও হয়ে দাঁড়ায়।
এভাবেই হয়। কিন্তু মোস্তাফিজ এভাবে আলাপ জমাতে পারে না। মোস্তাফিজ মুখচোরা এবং নিরীহ। মানুষকে সে অ্যাকাউন্ট হিসেবে ভাবতে পারে না। কারো সাথে আলাপ হয়ে গেলেও সেই সম্পর্কটাকে ধরে রাখতে পারে না।
যেমন তৃণার সাথে তার সম্পর্কটাও পারে নি।
মটরসাইকেলটা নতুন, এইজন্য বেশ ভয়ে থাকি! …লোকটা হাসল, দুই মাস হয় কিনেছি, এর মধ্যে একবার চুরিও হতে নিয়েছিল!
কী বলবে বুঝতে পারল না মোস্তাফিজ। গালে আঙুল রেখে চোখ বড় বড় করে ‘তাই-ই-ই?’ বলা উচিত?
অন্ধকারে আপনাকে দেখে অন্য কিছু ভেবে বসেছিলাম!
না না, আমি সেরকম কিছু নই! এই দেখুন আমার আইডি কার্ড! আমি নিতান্তই একজন ভদ্রলোক, একটা সফটওয়্যার কোম্পানিতে ছুটকো একটা কাজ করি! কেরানির কাজই বলা যায় সেটাকে। বেচাকেনার হিসাবপত্তর রাখি। আমার মতো লোকের পক্ষে আপনার মটরসাইকেল হাপিস করে দেয়া সম্ভব নয়। সেটা করতে অসততার চেয়েও যেটা বেশি দরকার, সাহস, সেটাই আমার নেই!
অনেক কিছুই বলা যায়। কিন্তু মোস্তাফিজের পক্ষে কিছুই সম্ভব নয়। জবাবে সে শুধু একটু হাসল, তারপর বোকার মতো বলল, হ্যাঁ, আজকাল বড্ড গাড়ি চুরি হচ্ছে!
যেন সে গাড়ির কত খোঁজখবর রাখে। এবং মটরসাইকেলকে গাড়ি বলাটাও বোধহয় গ্রামাটিক্যাল মিসটেক।
আপনি জব করেন?
আমি? অ্যা হ্যাঁ, একটা সফটওয়্যার কোম্পানিতে জব করছি!
নাম?
মোস্তাফিজ!
না না, কোম্পানির নামের কথা জিজ্ঞেস করছি!
ও, কোম্পানির নাম ইউনিসফট!
আরে নামকরা কোম্পানি তো আপনার! অফিসের ডেবিট-ক্রেডিট মেলানোর একটা সফটওয়্যার বিক্রি করেন না আপনারা?
অনেক রকম সফটওয়্যারই বিক্রি করি!
তা তো ঠিকই। কিন্তু আপনাদের ঐ সফটওয়্যারটার কথা আমি জানি, কারণ, বহুদিন থেকেই আমাদের অফিসের জন্য ওটা কেনার কথা! আমার ডিপার্টমেন্টের জিএম অনেকবার তাগাদা দিয়েছেন, কিন্তু যাবো যাচ্ছি করে যাওয়া হচ্ছে না! আপনাকে পেয়ে তো বেশ ভালোই হল!
মোস্তাফিজ মৃদু হেসে বলল, তাই তো দেখছি!
আমি আরিফ, মুহাম্মাদ আরিফুল ইসলাম। সোনালি গ্রুপের মার্কেটিংয়ে আছি! অ্যাসিস্ট্যান্ট মার্কেটিং ম্যানেজার!
আচ্ছা!
মার্কেটিংয়ের লোকই বটে। চৌকস, চোখা কথাবার্তা। মটরসাইকেল চোর মনে করে যেরকম বাঘমার্কা গলায় ‘কে’ বলে উঠতে পারে, আবার মাখনঢালা নরম গলায় ‘সরি’ও বলতে পারে! বৃষ্টির মধ্যে একটা লোক অফিসের কাগজপত্র আর নিজের মাথাটা বাঁচাবার জন্য বাড়ির কার্নিশের নিচে এসে দাঁড়িয়েছে, তার সাথেও দিব্যি বিজনেসের আলাপ সেরে ফেলল!
বুদ্ধিমান এবং কর্মঠ লোক। এরাই পারে। এরাই নতুন মটরসাইকেল চালায়, আর বৃষ্টিভেজা মানুষের সাথেও বিজনেসের আলাপ সেরে ফেলে! সব এদেরই জন্য। বীরভোগ্যা বসুন্ধরা!
মোস্তাফিজকে ছেড়ে চলে যাবার পর গত বছর তৃণার তো আবার বিয়ে হয়েছে। এদেরই মতো কারো সঙ্গে নিশ্চয়। এরকমই উজ্জ্বল, উদ্যমী মানুষ তারা! তৃণার নতুন জামাইকে দেখে নি মোস্তাফিজ। কিন্তু এরকমই ঝকঝকে কোনো মানুষ অবশ্যই, সে জানে। তার মতো বুদ্ধিহীন মানুষে অভক্তি ছিল বলেই তো তৃণার চলে যাওয়া। সেক্ষেত্রে এরকম ঝকমকে বুদ্ধির চটক লাগা মানুষকেই তার বেছে নেয়ার কথা।
সফটওয়্যারটার দাম কত রাখেন আপনারা?
একটু চিন্তা করে মোস্তাফিজ বলল, এক লাখ বিশ।
যে বিক্রি করে দেয়, তার কমিশন কত?
কমিশন?
জ্বি ভাই, কমিশন। আপনি আপনার কোম্পানির একটা প্রোডাক্ট বিক্রি করে দিলে কমিশন পাবেন না?
ও আচ্ছা। হ্যাঁ, কমিশন দেয়া হয়। বেশ বড়সড়ই। এটাতে বোধহয় তিরিশের মতো।
মাথা চুলকে মোস্তাফিজ আবার যোগ করল, কমিশনটা সাধারণত মার্কেটিং ডিভিশনকেই দেয়া হয়!
আপনাকে দেবে না?
আমাকে? আমাকে… হ্যাঁ দেবে!
বাঃ! দারুণ! তাহলে আপনার পনেরো, আমার পনেরো!
আরিফ হা-হা করে হেসে উঠল! মোস্তাফিজও একটু ফ্যাকাশে হাসি হাসল।
মোস্তাফিজের কাঁধে একটা হাত এসে পড়ল। চওড়া কব্জিঅলা একটা হাত। সেই হাতের ভেতর যেন উষ্ণ রক্ত বয়ে যাচ্ছে, কান পাতলে শোনা যায়। সেই হাতটাই যেন বলে উঠল, না কি আপনার আপত্তি আছে?
জবাব না দিয়ে মৃদু একটা ভদ্রতার হাসি হাসল মোস্তাফিজ।
আচ্ছা ঠিক আছে, আপনার বিশ, আমার দশ! তবু একটা বউনি হোক! আমার পরিচিত আরো অনেক অফিসই সফটওয়্যারটা কিনবে, তখন থেকে পনেরো-পনেরো! আরে ভাই, ভালো করে একটু হাসুন! টাকা পাইয়ে দিচ্ছি আপনাকে! আমারও লাভ অবশ্য আছে, আপনাদের কোনো মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ আমাকে ঐ ভাগটা দিত না!
কারো ঘর থেকে কি সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, বন্ধুত্বপূর্ণ কোনো বৌ চলে যেতে পারে? কিন্তু মোস্তাফিজের যায়। মোস্তাফিজ অবাক হয়ে দেখছিল। সে তো এরকম বুদ্ধিমান চটপটে লোক না, যাদেরকে এক কথায় বলা হয় ‘চালু’! হতে পারলে তাকে ছেড়ে তৃণা চলে যেতে পারত না! একটা পারার সাথে আরেকটা না-পারা সম্পৃক্ত। কী গতি লোকটার! বৃষ্টির ছাঁট থেকে বাঁচার জন্য একটু দাঁড়িয়েছিল সে এখানে, এই খানিক সময়ের মধ্যেই লোকটা তার চোখে বিশ হাজার টাকার নেশা লাগিয়ে দিল! টাকা এত সহজে হাতে চলে আসে?
বিশ হাজার টাকা মোস্তাফিজের এক মাসের বেতন।
কোন ব্র্যান্ড খান?
বুঝতে না পেরে আরিফের দিকে বোকার মতো তাকাল মোস্তাফিজ।
সিগারেট, সিগারেটের কথা বলছি! …আরিফ হাসল।
মাথা ঝাঁকিয়ে মোস্তাফিজ বলল, ওঃ! আমি সিগারেট খাই না!
গ্রেড ওয়ান জিপ্পোর ‘টং’ করে আওয়াজ হল। আধো অন্ধকারে জ্বলে উঠল একটা মুখ। এক পলক, তারপরেই আবার নিভে গেল। মোস্তাফিজ মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। তারপর আপনমনেই যেন জিজ্ঞেস করে ফেলল, আপনি বিয়ে করেছেন?
বেশ খানিকক্ষণ থেকেই প্রশ্নটা বারে বারে চোখা ঠোঁট দিয়ে ঘা মারছিল ভেতরে, এবার বেরিয়ে এল।
বিয়ে? …আরিফ একটু অদ্ভুত চোখে তাকাল মোস্তাফিজের দিকে। তারপর একগাল হেসে বলল, গত বছরই বিয়েটা সেরেছি! লাইফের একটা বিশাল কাজ ভাই! সময় থাকতে সেরে রাখা ভালো!
চৌকস! খাসা! মোস্তাফিজ ক্রমশ মুগ্ধ হচ্ছিল। বিয়েটাও তার প্ল্যানের একটা অংশ! এরকমভাবে মোস্তাফিজ কি কোনোদিন ভাবতে পেরেছে? এজন্যেই তৃণা…।
তৃণার কথা বেশিক্ষণ ভাবলেই মোস্তাফিজের ভেতরে এক ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটতে থাকে। এই চারপাশের পৃথিবী ছেড়ে অন্য একটা ছবির পৃথিবীতে মন উড়াল দেয়। সেখানে বেশ কিছু বাছা বাছা ছবি। তেলরঙে, অনেক যত্নে আঁকা। একশোর বছরেও নষ্ট হবে না। …মোস্তাফিজ ক্রমশ তার নিজের চিত্রশালাটার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিল। তেলরঙে আঁকা তৃণার মুখ। বড় যত্নে টাঙানো আছে সেই ছবি। খুব আদর করে আঁকা।
আপনার স্ত্রীর নাম কী?
মোস্তাফিজের স্বরে অপরিসীম সারল্য। দুই চোখে ঘোর। সেই দুই চোখ দেখছে ইজেলে তৃণার মুখ। অথবা দেখছে তৃণার নতুন স্বামীর বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। চটপটে, চৌকস, বিত্তবান, মাথায় সবসময় নতুন নতুন আয়ের চিন্তা। স্বামী তো এরকমই হতে হয়! ঠিক এরকম!
প্রশ্নটা শুনে সিগারেটের আলোটা যেন এক পলক থমকে গেল। আরিফ মুখটা সামনে এগিয়ে নিয়ে এল, ঘোড়েল গলায় বলল, ব্যাপারটা কি ভাই বলুন তো? কোনো বিশাল প্রেম-ট্রেম ছিল নাকি? সোনালি গ্রুপ এসে সাইড মেরে দিয়ে গেছে?
এখন অনায়াসেই একটা মিষ্টি গল্প বানিয়ে বলা যায়… আরে না ভাই, আমার ছোট মামার এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে আপনাদের এই সোনালি গ্রুপেই। কাজের চাপে যেতে পারি নি সেই বিয়েতে, জামাইকেও দেখা হয় নি। ভাবলাম, আপনিই সেই জামাইবাবাজি নাকি…!
কিন্তু মোস্তাফিজ এসব গল্প বানিয়ে বলতে পারে না। পারলে… থাক, পারলে কী হত, সে নিয়ে আর কথা বাড়ানোর দরকার নেই।
আরিফ এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে হো হো করে হেসে উঠল! বলল, আরে ভাই প্রেম-ট্রেম থাকলে বলুন না! আমার এসব নিয়ে কোনো প্রবলেম নেই। বিয়ের আগে দেবদাস-পার্বতীর মতো মন দেয়ানেয়া খেলবে না এমন অরোমান্টিক বৌ আমার পছন্দ না! হলে আমি খুশিই হব!
মোস্তাফিজ আলতো গলায় জিজ্ঞেস করল, কী নাম আপনার স্ত্রীর?
আরিফ চোখ পিটপিট করে বলল, তৃণা! আমার বৌয়ের নাম তৃণা! কী ভাই, মিলল নাম?
বুক ধ্বক করে উঠেছিল মোস্তাফিজের। তাহলে ঠিকই ভেবেছে সে! বীরভোগ্যা বসুন্ধরা! এই অসীম আত্মবিশ্বাসী চতুর লোকটিই তৃণার স্বামী!
কিন্তু কোন নিয়তি তাকে বৃষ্টির মধ্যে ফেলে এই আশ্চর্য ছাদের নিচে এনে দাঁড় করাল? এ তো গল্প-উপন্যাস কিংবা সিনেমায় হয়! ঘুরেফিরে ঠিক এই দিনেই, এই বৃষ্টিঝরা সন্ধ্যায় স্বামীসহ তৃণা তাকে এই বাড়ির সামনে কোণঠাসা করে ফেলল?
এবং তৃণা আসছে… ঐ যে শোনা যাচ্ছে তার গলার আওয়াজ!
কথা বলতে বলতে একটি নারীমূর্তি এই সন্ধ্যার আধো অন্ধকার ঠেলে এগিয়ে এল। তার সঙ্গে আরো কয়েকজন। স্বামী নিয়ে এই বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল বোধহয়। বাড়িটার সামনে এই জায়গাতে কোনো আলো নেই। হয় বালব ফিউজ, নয় তো চোর বালব খুলে নিয়ে গেছে! তাতে অবশ্য ভালোই হয়েছে। নিয়তি মোস্তাফিজকে যে জায়গায় নিয়ে এসেছে, সেখানে ঝকঝকে আলোর মধ্যে দাঁড়াবার মতো সাহস নেই তার!
তৃণা এসে রিনরিনে কণ্ঠে বলল, বৃষ্টি থেমেছে তো, তাই না?
পিছন থেকে একজন পুরুষকণ্ঠ বলল, বৃষ্টি থামার জন্য যে পরিমাণ ব্যস্ত হয়েছিলেন, না থেমে উপায় আছে?
একটা মৃদু হাসির গুঞ্জন উঠল।
তৃণা বলল, আহা, বোঝেন না কেন? আমাকে বাসায় রেখে উনাকে আবার আরেক জায়গায় যেতে হবে! আসব আরেকদিন!
এরপরের বার বেশি সময় নিয়ে!
হ্যাঁ, বেশি সময় নিয়ে!
আরিফ গলা খুলল এবার, তৃণা, পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি, ইনি আমার নতুন বন্ধু মোস্তাফিজ! সামনে এসে ভালো করে উনার চেহারা দেখ! দেখ তো চিনতে পার কিনা!
তৃণা সামনে এগিয়ে এল। মোস্তাফিজকে দেখে ম্লান হাসল একটু, বলল, স্লামালিকুম! ভালো আছেন?
ভালো? …মোস্তাফিজের যেন জ্ঞান ফিরে এল, হ্যাঁ, আমি ভালো আছি, আপনি ভালো?
জবাবে তৃণা মৃদু হাসল। বেশ মিষ্টি তার এই হাসিটা। মোস্তাফিজের ভালো লাগল, বড় সুন্দর একটা মেয়ে! না, তার বিগত স্ত্রী তৃণা এ নয়। এ আরো এক তৃণা। আগের তৃণার চেয়েও আরো সুন্দর। হয়ত বা কে জানে, আগের তৃণার আরো মডিফাইড ভার্সন।
আরিফ হাসতে হাসতে বলল, ভালো করে দেখ দেখি একজন আরেকজনকে, চিনতে পার কিনা! মোস্তাফিজ ভাইয়ের ভয়াবহ কোনো এক প্রেমের সমাধি ঘটেছে এই সোনালি গ্র“পে। সেই থেকে সোনালি গ্র“পের লোক শুনলেই তিনি বৌয়ের নাম জিজ্ঞেস করেন!
নির্দয় রসিকতা। তবে সেটা মোস্তাফিজের কাছে, আরিফের কাছে নয়। কিন্তু আরিফরা রসিকতা করবে, আর মোস্তাফিজদের সেটা মাথা নিচু করে শুনতে হবে, এটাই দুনিয়ার নিয়ম এখন।
তৃণা অবশ্য আরিফের কাঁধে শাসনের একটা ছোট্ট আদুরে চাপড় মারল!
যে বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল আরিফরা, সে বাড়ির গৃহকর্তা এবং তার গিন্নির সাথে আলাপ হল। ফাঁকা শুভেচ্ছা বিনিময়, আর ‘কেমন আছেন’ জাতীয় অর্থহীন প্রশ্ন।
মটরসাইকেলে উঠে এক কিকে স্টার্ট দিয়ে পিছন ফিরে হাসল আরিফ, তাহলে ঐ কথাই রইল! আপনি বিশ, আমি দশ, এরপর থেকে পনেরো-পনেরো! আপনার অফিস আমি চিনি, যোগাযোগ করব! মোস্তাফিজ বললে চিনবে তো?
মোস্তাফিজ নীরবে মাথা নাড়ল।
মটরসাইকেলের ওপর চেপে বসল তৃণা। একটা হাত দিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরল আরিফের। সেই হাতের ভেতর অনেক কথা আছে। সন্ধ্যার ল্যাম্পপোস্টের আলোয় তার প্রসাধন করা মুখটা তখনো ঝকমক করছে। একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে মটরসাইকেলটা চলে গেল।
দ্বিতীয় তৃণার চেহারাটা গলির বাঁকে মিলিয়ে গেল। ঐ তৃণা নয়, এ আরো এক তৃণা। কিন্তু ঘটনা একই।
আগের তৃণাও হয়ত এরকমই কোনো একজনকে বিয়ে করেছে, স্বামীর কোমর জড়িয়ে ধরে মটরসাইকেলে চেপে এলোমেলো বাতাসে চুল ওড়াচ্ছে। মোস্তাফিজের মতো অপদার্থ মানুষের প্রতি তার ভীষণ বিতৃষ্ণা, আরিফের মতো আত্মবিশ্বাসী মানুষই একমাত্র তার তৃষ্ণায় জল ঢালতে পারে।
চোখ কুঁচকে ভাবল মোস্তাফিজ, সেইজন্যই কি সব আরিফরা সব তৃণাদের মটরসাইকেলে তুলে নিয়ে দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে… আর পেট্রোলপোড়া ধোঁয়ার মধ্যে বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে থাকছে মোস্তাফিজরা… অপদার্থ, সাহসহীন মোস্তাফিজ!
সব তৃষ্ণা ঠাণ্ডা জলে মেটে না। তার ওপর বিতৃষ্ণ হয়ে তৃণা যখন সংসার ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তখন তাকে কেন শক্ত দুই হাতে জড়িয়ে ধরে নি মোস্তাফিজ? চুলের মুঠি চেপে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিতে কি সে পারত না? নিছক ভালোমানুষি ছাড়াও স্বামীর কাছে অনেককিছু চাওয়ার থাকে মেয়েদের!
রিকশাঅলাটা গাছতলায় দাঁড়িয়ে আছে। হাতে আবারও একটা বিড়ি। তার একমাত্র বিনোদন।
মোস্তাফিজ যেতেই ‘আসেন সার’ বলে রিকশায় গিয়ে উঠল। ঢুলতে ঢুলতে রিকশা চলেছে, আর মোস্তাফিজ তখন মনে মনে আরেকটা তেলরঙের ছবি আঁকছে। ঝকমকে সুন্দর একটা মুখ, তাতে সন্ধ্যার ম্লান আলো মাখানো। নতুন তৃণার ছবি, যে আগের তৃণার আরো অনেক পরিমার্জিত সংস্করণ। সন্ধ্যার আলোতেও যার রূপ পদ্মফুলের মতো ফুটে থাকে।
পৃথিবীর সব তৃণাদের কেন নিয়ে যায় আরিফেরা? নিয়ে যদি যায়ই, তাহলে আবার কেন মোস্তাফিজদের সাথে নতুন রফা করে পনেরো-পনেরোতে? আর সেই পনেরো-পনেরো কেন তৃণাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়? তাহলে বুদ্ধিহীন, বেকুব, অপদার্থ মোস্তাফিজরা কাকে নিয়ে বাঁচবে?
কল্পনায় তেলরঙে আঁকা মোস্তাফিজের সব ছবিগুলো তার চোখের জলরঙে গুলে একাকার হয়ে যাচ্ছিল…।
রিকশাঅলাও সাথে সাথে রিকশাটা রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে ফেলল। কোনো রকমের ঘোষণা ছাড়াই। বৃষ্টি শুরু হলে রিকশাঅলারা সাধারণত থামে না। চাকা না ঘুরলে পয়সা আসে না, ওরা জানে। হালের বলদের মতো নকল গোয়ার্তুমি দেখিয়ে সমানে প্যাডেল মারে।
কিন্তু এই রিকশঅলা ঝটাং করে রিকশা থামাল। বৃষ্টির প্রথম ছাঁটটা শুরু হবার সাথে সাথেই। যেন ইন্সটল করা সফটওয়্যার, বৃষ্টির টাচ লাগামাত্র রিকশা থেমে যাবে।
মোস্তাফিজ অন্যমনস্ক সুরে বলল, অ্যাই, তোমার পলিথিন নাই?
জবাবে রিকশাঅলা ক্যাবলার মতো হাসল, নিয়া বাইর হই নাই! ক্যাডায় জানে, এইরম আঁতকা বৃষ্টি আইব?
আসলেই, এ সময়ে বৃষ্টির ধরনটা এরকমই। দিব্যি জ্বলজ্বলে একটা দিন, রোদ ঝকঝক করছে, কিন্তু কোত্থেকে হঠাৎ তেড়েফুঁড়ে একটা হাওয়া দিল, বেশ মেঘ করে এল ওপরে, তারপরই ঝিরঝিরিয়ে নামল বৃষ্টি।
ওঃ বৃষ্টি! সে কী আশ্চর্য বৃষ্টি! মুহূর্তের মধ্যেই পুরো জায়গার চেহারাটাকে বদলে দিল। একটা ঝকমকে উজ্জ্বল বিকেল দু-মিনিটের মধ্যেই হয়ে গেল একটা বিষণ্ন প্রায়ান্ধকার সন্ধ্যা।
গলির ভেতর কতগুলো মানুষ হাঁটছিল, দাঁড়িয়ে ছিল। এ-বাড়ির ছাদ থেকে ও-বাড়ির ছাদের মেয়েদের দিকে তাকাচ্ছিল ছেলেরা, মেয়েরাও আড়চোখে সেই দৃষ্টি ফেরত দিচ্ছিল। চা-বিড়ির দোকানের সামনে বেঞ্চে অলস বসে ছিল দুই-চারটা লোক, ক্রিকেট খেলবে বলে ইঁটের ওপর ইঁট সাজিয়ে স্ট্যাম্প বানাচ্ছিল পিচ্চি পোলাপানের দল, কিন্তু বৃষ্টিটা এসেই সবাইকে হটিয়ে দিয়ে চারদিক এখন একেবারে শুনশান।
রিকশার ভেতর বসে বসে বৃষ্টির এই আশ্চর্য ক্ষমতা দেখছিল মোস্তাফিজ।
তার রিকশাঅলা পাশেই একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুঁকছে। একবার দাঁত বের করে হেসে বলল, সার বৃষ্টিতে ভিজতাছেন, নাইমা আসেন!
হ্যাঁ, মোস্তাফিজের ভেজা চলবে না। হাতের ফাইলের ভেতর অফিসের বেশকিছু জরুরি কাগজপত্র আছে। সেগুলো ভিজে গেলে মুশকিল।
মোস্তাফিজ নামল।
গাছ কতক্ষণ মানুষকে আশ্রয় দেয়? রোদ হলে সর্বক্ষণ, কিন্তু বৃষ্টি হলে তার একটা সীমা আছে। একটা সময় পাতা থেকে পাতায় পানি চুঁইয়ে পড়তে থাকে। সেটা হওয়ার আগেই ভালো একটা ছাদের নিচে চলে যাওয়া উচিত।
এদিকওদিক তাকিয়ে মোস্তাফিজ ছাদ খুঁজল। কোথাও কোনো ছাদ কি আছে? ওহে ভাইসব, ওহে এই পথচলতি অচেনা গলির বাসিন্দাগণ, আছে কি কোনো নিবিড় আচ্ছাদন, বৃষ্টির হাত থেকে অফিসের কাগজগুলো বাঁচানো খুব দরকার!
পাওয়া গেল। একটু কোনাকুনি একটা দৌড় দিলে গলির ও মাথায় একটা ছাদ তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। সেই যে এক হাউজিং-এর বিজ্ঞাপনে এক বৌ স্মার্টলি তার জামাইকে বলেছিল না, ‘বাসা-বাড়ির কথা কিছু ভেবেছ? মাথা গোঁজার ঠাঁই তো দরকার!’ ঠিক সেরকমই, মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই তার দরকার। এক্ষুনি, এ মুহূর্তে।
একটা দৌড় তাকে দিতে হবে। আর রিকশাঅলাটা? সে কী করবে?
তার দিকে ফিরে মোস্তাফিজ বলল, আমি ঐ বাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি…।
বলার দরকার ছিল না। একজন বাবুসমাজের মানুষ কখনো কোনো রিকশাঅলার কাছে কৈফিয়ত দেয় না। রিকশা নিয়ে কতটুকু এসেছে সে? পাঁচ টাকা বড়জোর হবে ভাড়া। একটা পাঁচ টাকার নোট কখনো সখনো একটা রিকশাঅলার পকেট থেকেও পড়ে যায়। এমন কিছু ক্ষতি নয়। সে দৌড়ে গিয়ে ঐ ছাদের নিচে দাঁড়ালে রিকশাঅলা ঐ পাঁচটাকা ভাড়া নিয়ে কি শঙ্কিত হয়ে উঠবে? কিছুই না।
কিন্তু মোস্তাফিজ না বলে পারে না। সে মানুষটাই ওরকম নয়। তার কেমন যেন সঙ্কোচ লাগে। ‘আমি ঐ বাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি’ কথাটার মানে হচ্ছে ‘আমি ঐ ছাদের নিচে বৃষ্টি শেষ না হওয়া পর্যন্ত তোমার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। তোমার পাঁচ টাকা আমি মেরে দিয়ে পালিয়ে যাব না! নিশ্চিন্ত থাক!’
এইটুকু না বলে ঐ ছাদটার নিচে গিয়ে ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারত না সে। খুব অস্বস্তি লাগত।
সে এরকমই।
একটু ভদ্রসদ্র গোছের নিরীহ মানুষ।
এই ভদ্রতা নিয়েই একবার একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল।
রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার সময় কারো না কারো সাথে একটু ধাক্কা তো লাগবেই। কেউ তো আবার কারো পাও মাড়িয়ে দেয়, দিয়ে তারপর আবার নিরীহ হেসে বলে, সরি! যার পা মাড়িয়ে দেয়া হয়েছে, সে মিষ্টি একটা ‘সরি’ শুনে ভচকানো জুতা নিয়ে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে চলে যায়।
তৃণার সঙ্গে তার বিয়ের কিছুদিন পর। অতি ভদ্র মোস্তাফিজের এই ‘সরি’ বলার একটা বিশাল বাতিক দাঁড়িয়েছিল সেই সময়। কারো সাথে হালকা একটু ধাক্কা লাগলেই তার মুখ দিয়ে অটো সিস্টেমে ‘সরি’ বের হয়ে আসত।
একদিন তৃণার সাথে রাস্তা দিয়ে কথা বলতে বলতে হাঁটছিল সে, কার সঙ্গে যেন একটু ধাক্কা লাগল হঠাৎ। পাশ ফিরে না দেখেই সে বলল, ‘সরি!’। আশ্চর্য, তৃণা সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ে তার দিকে ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে রইল।
ভদ্রলোক এবং নিরীহ মোস্তাফিজ সেই চাউনি দেখে চমকে গেল। ক্যাবলা হেসে বলল, কী হয়েছে?
তৃণা তাও তাকিয়ে আছে দেখে মোস্তাফিজ ধারণা করল, সে সম্ভবত কোনো মেয়ের সাথে ধাক্কা লাগিয়ে দিয়েছে! সেটাই তৃণার ক্ষেপে যাওয়ার কারণ। কিন্তু সে কি আর ইচ্ছে করে ধাক্কা লাগিয়েছে? সেরকম মানুষই সে নয়। সে পাশ ফিরে তাকিয়েও দেখে নি।
কাঁপা কাঁপা গলায় সে বলেছিল, সরি তৃণা, আমি কি কোনো মেয়ের গায়ে ধাক্কা দিয়েছি?
তাকে, এবং রাস্তায় হাঁটতে থাকা ভিড়ের একরাশ লোককে চমকে দিয়ে তৃণা হো হো করে হেসে উঠেছিল। হাসতে হাসতে বলেছিল, তোমার মতো বেকুব নিরীহ এবং অপদার্থ লোক যদি সেটা করতে পারত, তাহলে খুশিই হতাম! কিন্তু…।
কিন্তু?
তুমি যাকে ধাক্কা দিয়েছ, সে কোনো মানুষ ছিল না!
মানুষ ছিল না? মানে?
মোস্তাফিজের মাথায় আরো গণ্ডগোল লেগে যাচ্ছিল। মানুষ ছিল না মানে কী? তাহলে কি সেখানে কোনো জ্বিন দাঁড়িয়ে ছিল? অথবা এই ব্যস্ত ফুটপাথের ওপর কোনো জাবরকাটা গরু?
তৃণা উত্তর না দিয়ে ক্রমাগত হেসেই যাচ্ছিল। হাসির দমকে কেঁপে কেঁপে উঠছিল তার সারা শরীর। ফুটপাথের গতিসর্বস্ব ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল তারা দুজন। পাশাপাশি। একজন বোকাদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরেকজনের দিকে, সেই আরেকজন এই একজনের দিকে তাকিয়ে হাসিতে কেঁপে উঠছিল।
এক-একটা ছবি বোধহয় মহাকালের চিত্রশালায় স্থান পেয়ে যায়। ভিঞ্চির মোনালিসার মতোই ক্লাসিক সেইসব ছবি কখনো মুছে যায় না। চোখ বুঁজলেই দেখতে পাওয়া যায়। একদম জীবন্ত। পাশাপাশি দুইজন মানুষ। একজনের চোখে বিহ্বলতা, আরেকজনের ঠোঁটে হাসি। পাশেই চলমান ভিড়। সেই ভিড়কে অগ্রাহ্য করে দুটো মানুষ স্থির দাঁড়িয়ে।
মোস্তাফিজ চোখ বুঁজলে আজও সেই ক্লাসিক তৈলচিত্রটা একদম স্পষ্ট দেখতে পায়। তার চিত্রশালায় অবশ্য আরো অনেকগুলো ছবি আছে।
যাই হোক, তৃণা এরপর সেই গল্প অনেককে করেছে। পরিচিত যাকেই সামনে পেয়েছে, বলেছে, জানেন? আমার জামাইটা কীরকম বোকার হদ্দ? শুনুন না, কীরকম বেকুব! রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের গায়ে ধাক্কা দিয়ে না তাকিয়েই বলে, সরি!
বলেই তৃণার সেই কাঁপতে কাঁপতে হাসা। সেই হাসির ছবিও মোস্তাফিজের চিত্রশালায় তেলরঙে আঁকা আছে। মোস্তাফিজের খুব ইচ্ছে ছিল একসময়, ছবি আঁকতে শিখবে। অনেকগুলো ছবি স্মৃতি থেকে কাগজে-তুলিতে নামিয়ে রাখা দরকার। আর্ট কলেজে পড়ত এক বন্ধু, ইশতিয়াক নাম, একবার তার কাছে–
কে?
চমকে উঠে মোস্তাফিজ দেখল, কখন এক লোক বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এসেছে! অন্ধকারে খেয়াল করে নি!
গলাটা বেশ কড়া। এই গলায় শুধু ‘কে’ না বলে ‘কে তুই’ বললেই বেশি মানাত।
সামনে এগিয়ে এসে লোকটি তাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে নরম গলায় বলল, সরি!
তারপর বাড়ির কার্নিশের নিচে দাঁড় করিয়ে রাখা একটা মটরসাইকেল কাপড় দিয়ে মুছতে লাগল। এই ‘সরি’-এর মানে হল, লোকটা তাকে মটরসাইকেল চোর ভেবেছিল।
কী সাঙ্ঘাতিক! অন্ধকারে দাঁড় করিয়ে রাখা মটরসাইকেলটা মোস্তাফিজ দেখেই নি। মোস্তাফিজের প্যান্টে সার্ট ইন করা, গলায় বাড়তি উপকরণ হিসেবে একটা টাইও ঝুলছে। সেটা দেখেই বোঝা গেল, সে ভদ্রলোক? চোর নয়? তাহলে তো মটরসাইকেল চোরদের জানিয়ে দেয়া উচিত, তোমরা টাই পরে চুরি কর হে, ওতে সুবিধা বেশি!
মটরসাইকেল মুছে লোকটি কার্নিশের নিচে এসে দাঁড়াল। আকাশের দিকে একটা অর্থহীন দৃষ্টি দিয়ে বলল, বৃষ্টিটা যে কখন ধরবে!
অর্থাৎ, লোকটি এখন আলাপ জমাতে চাইছে। প্রথম দৃষ্টিতে মোস্তাফিজকে চোর ভেবে ফেলায় সে একান্তই অনুতপ্ত।
মোস্তাফিজের অবশ্য কিছু বলার নেই। সে আবহাওয়াবিদ নয় যে, বৃষ্টি কখন ধরে যাবে, সেটা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারে। কিন্তু আবহাওয়াবিদ না হলেও সে নিতান্তই ভদ্রলোক, কাজেই উসখুস করে উঠে বলল, হ্যাঁ, সেটাই!
দুটোই অনর্থক মন্তব্য। কিন্তু এই অনর্থক মন্তব্য থেকেই বিশাল একটা আলাপ জমে যেতে পারে অনায়াসেই। কেউ একজন যদি আগ বাড়িয়ে বলে, কোথায় যাবেন?
আমি? আর বলবেন না ভাই, ফার্মগেটে রাজধানী হোটেলের সামনে একজনের দাঁড়িয়ে থাকার কথা। ব্যাটা বহুদিনের পুরনো দেনাদার, বহু কষ্টে তাকে ধরা গেছে, ব্যাটা কথা দিয়েছে সাড়ে পাঁচটার সময় দাঁড়িয়ে থাকবে। কিন্তু এতক্ষণে তো বোধহয় ফুটে গেল!
তাই নাকি? দিন ব্যাটার মোবাইলে একটা ফোন! বলুন, বৃষ্টি তো বৃষ্টি, ইস্রাফিলের শিঙ্গা বাজলেও তুমি ঐখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে! আই অ্যাম কামিং!
আরে না ভাই! সেরকম কি আর হয়? দেখুন, আন্ডারগ্রাউন্ড রেল থাকলে কিন্তু এত ঝামেলা হত না! বাইরের দেশগুলো এত উন্নতি করেছে কেন জানেন? জাস্ট বাই দ্যা আইডিয়া অব কমিউনিকেশন!
আরে রাখুন ভাই বাইরের দেশ! পাশের দেশ ইন্ডিয়ার অবস্থাই দেখুন! কলকাতার মতো ছ্যারছেরে মার্কা শহরেই পাতালরেল আছে! আর আমাদের অবস্থা?
এরপরেই আসবে দেশের অর্থনীতির কথা। এরপর দুর্নীতি। তারপরেই সবচেয়ে গরম সাবজেক্ট, রাজনীতি। এভাবেই আলাপ জমে যায়। অফিসের, বাসার ঠিকানা বিনিময় হয়… চলে আসবেন ভাই! …এরপর সত্যি সত্যি চলেও আসা হয়। বন্ধুত্ব হয়। কখনো সখনো আবার একজন আরেকজনের প্রফেশন্যাল লাইনের গুরুত্বপূর্ণ চেইনও হয়ে দাঁড়ায়।
এভাবেই হয়। কিন্তু মোস্তাফিজ এভাবে আলাপ জমাতে পারে না। মোস্তাফিজ মুখচোরা এবং নিরীহ। মানুষকে সে অ্যাকাউন্ট হিসেবে ভাবতে পারে না। কারো সাথে আলাপ হয়ে গেলেও সেই সম্পর্কটাকে ধরে রাখতে পারে না।
যেমন তৃণার সাথে তার সম্পর্কটাও পারে নি।
মটরসাইকেলটা নতুন, এইজন্য বেশ ভয়ে থাকি! …লোকটা হাসল, দুই মাস হয় কিনেছি, এর মধ্যে একবার চুরিও হতে নিয়েছিল!
কী বলবে বুঝতে পারল না মোস্তাফিজ। গালে আঙুল রেখে চোখ বড় বড় করে ‘তাই-ই-ই?’ বলা উচিত?
অন্ধকারে আপনাকে দেখে অন্য কিছু ভেবে বসেছিলাম!
না না, আমি সেরকম কিছু নই! এই দেখুন আমার আইডি কার্ড! আমি নিতান্তই একজন ভদ্রলোক, একটা সফটওয়্যার কোম্পানিতে ছুটকো একটা কাজ করি! কেরানির কাজই বলা যায় সেটাকে। বেচাকেনার হিসাবপত্তর রাখি। আমার মতো লোকের পক্ষে আপনার মটরসাইকেল হাপিস করে দেয়া সম্ভব নয়। সেটা করতে অসততার চেয়েও যেটা বেশি দরকার, সাহস, সেটাই আমার নেই!
অনেক কিছুই বলা যায়। কিন্তু মোস্তাফিজের পক্ষে কিছুই সম্ভব নয়। জবাবে সে শুধু একটু হাসল, তারপর বোকার মতো বলল, হ্যাঁ, আজকাল বড্ড গাড়ি চুরি হচ্ছে!
যেন সে গাড়ির কত খোঁজখবর রাখে। এবং মটরসাইকেলকে গাড়ি বলাটাও বোধহয় গ্রামাটিক্যাল মিসটেক।
আপনি জব করেন?
আমি? অ্যা হ্যাঁ, একটা সফটওয়্যার কোম্পানিতে জব করছি!
নাম?
মোস্তাফিজ!
না না, কোম্পানির নামের কথা জিজ্ঞেস করছি!
ও, কোম্পানির নাম ইউনিসফট!
আরে নামকরা কোম্পানি তো আপনার! অফিসের ডেবিট-ক্রেডিট মেলানোর একটা সফটওয়্যার বিক্রি করেন না আপনারা?
অনেক রকম সফটওয়্যারই বিক্রি করি!
তা তো ঠিকই। কিন্তু আপনাদের ঐ সফটওয়্যারটার কথা আমি জানি, কারণ, বহুদিন থেকেই আমাদের অফিসের জন্য ওটা কেনার কথা! আমার ডিপার্টমেন্টের জিএম অনেকবার তাগাদা দিয়েছেন, কিন্তু যাবো যাচ্ছি করে যাওয়া হচ্ছে না! আপনাকে পেয়ে তো বেশ ভালোই হল!
মোস্তাফিজ মৃদু হেসে বলল, তাই তো দেখছি!
আমি আরিফ, মুহাম্মাদ আরিফুল ইসলাম। সোনালি গ্রুপের মার্কেটিংয়ে আছি! অ্যাসিস্ট্যান্ট মার্কেটিং ম্যানেজার!
আচ্ছা!
মার্কেটিংয়ের লোকই বটে। চৌকস, চোখা কথাবার্তা। মটরসাইকেল চোর মনে করে যেরকম বাঘমার্কা গলায় ‘কে’ বলে উঠতে পারে, আবার মাখনঢালা নরম গলায় ‘সরি’ও বলতে পারে! বৃষ্টির মধ্যে একটা লোক অফিসের কাগজপত্র আর নিজের মাথাটা বাঁচাবার জন্য বাড়ির কার্নিশের নিচে এসে দাঁড়িয়েছে, তার সাথেও দিব্যি বিজনেসের আলাপ সেরে ফেলল!
বুদ্ধিমান এবং কর্মঠ লোক। এরাই পারে। এরাই নতুন মটরসাইকেল চালায়, আর বৃষ্টিভেজা মানুষের সাথেও বিজনেসের আলাপ সেরে ফেলে! সব এদেরই জন্য। বীরভোগ্যা বসুন্ধরা!
মোস্তাফিজকে ছেড়ে চলে যাবার পর গত বছর তৃণার তো আবার বিয়ে হয়েছে। এদেরই মতো কারো সঙ্গে নিশ্চয়। এরকমই উজ্জ্বল, উদ্যমী মানুষ তারা! তৃণার নতুন জামাইকে দেখে নি মোস্তাফিজ। কিন্তু এরকমই ঝকঝকে কোনো মানুষ অবশ্যই, সে জানে। তার মতো বুদ্ধিহীন মানুষে অভক্তি ছিল বলেই তো তৃণার চলে যাওয়া। সেক্ষেত্রে এরকম ঝকমকে বুদ্ধির চটক লাগা মানুষকেই তার বেছে নেয়ার কথা।
সফটওয়্যারটার দাম কত রাখেন আপনারা?
একটু চিন্তা করে মোস্তাফিজ বলল, এক লাখ বিশ।
যে বিক্রি করে দেয়, তার কমিশন কত?
কমিশন?
জ্বি ভাই, কমিশন। আপনি আপনার কোম্পানির একটা প্রোডাক্ট বিক্রি করে দিলে কমিশন পাবেন না?
ও আচ্ছা। হ্যাঁ, কমিশন দেয়া হয়। বেশ বড়সড়ই। এটাতে বোধহয় তিরিশের মতো।
মাথা চুলকে মোস্তাফিজ আবার যোগ করল, কমিশনটা সাধারণত মার্কেটিং ডিভিশনকেই দেয়া হয়!
আপনাকে দেবে না?
আমাকে? আমাকে… হ্যাঁ দেবে!
বাঃ! দারুণ! তাহলে আপনার পনেরো, আমার পনেরো!
আরিফ হা-হা করে হেসে উঠল! মোস্তাফিজও একটু ফ্যাকাশে হাসি হাসল।
মোস্তাফিজের কাঁধে একটা হাত এসে পড়ল। চওড়া কব্জিঅলা একটা হাত। সেই হাতের ভেতর যেন উষ্ণ রক্ত বয়ে যাচ্ছে, কান পাতলে শোনা যায়। সেই হাতটাই যেন বলে উঠল, না কি আপনার আপত্তি আছে?
জবাব না দিয়ে মৃদু একটা ভদ্রতার হাসি হাসল মোস্তাফিজ।
আচ্ছা ঠিক আছে, আপনার বিশ, আমার দশ! তবু একটা বউনি হোক! আমার পরিচিত আরো অনেক অফিসই সফটওয়্যারটা কিনবে, তখন থেকে পনেরো-পনেরো! আরে ভাই, ভালো করে একটু হাসুন! টাকা পাইয়ে দিচ্ছি আপনাকে! আমারও লাভ অবশ্য আছে, আপনাদের কোনো মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ আমাকে ঐ ভাগটা দিত না!
কারো ঘর থেকে কি সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, বন্ধুত্বপূর্ণ কোনো বৌ চলে যেতে পারে? কিন্তু মোস্তাফিজের যায়। মোস্তাফিজ অবাক হয়ে দেখছিল। সে তো এরকম বুদ্ধিমান চটপটে লোক না, যাদেরকে এক কথায় বলা হয় ‘চালু’! হতে পারলে তাকে ছেড়ে তৃণা চলে যেতে পারত না! একটা পারার সাথে আরেকটা না-পারা সম্পৃক্ত। কী গতি লোকটার! বৃষ্টির ছাঁট থেকে বাঁচার জন্য একটু দাঁড়িয়েছিল সে এখানে, এই খানিক সময়ের মধ্যেই লোকটা তার চোখে বিশ হাজার টাকার নেশা লাগিয়ে দিল! টাকা এত সহজে হাতে চলে আসে?
বিশ হাজার টাকা মোস্তাফিজের এক মাসের বেতন।
কোন ব্র্যান্ড খান?
বুঝতে না পেরে আরিফের দিকে বোকার মতো তাকাল মোস্তাফিজ।
সিগারেট, সিগারেটের কথা বলছি! …আরিফ হাসল।
মাথা ঝাঁকিয়ে মোস্তাফিজ বলল, ওঃ! আমি সিগারেট খাই না!
গ্রেড ওয়ান জিপ্পোর ‘টং’ করে আওয়াজ হল। আধো অন্ধকারে জ্বলে উঠল একটা মুখ। এক পলক, তারপরেই আবার নিভে গেল। মোস্তাফিজ মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। তারপর আপনমনেই যেন জিজ্ঞেস করে ফেলল, আপনি বিয়ে করেছেন?
বেশ খানিকক্ষণ থেকেই প্রশ্নটা বারে বারে চোখা ঠোঁট দিয়ে ঘা মারছিল ভেতরে, এবার বেরিয়ে এল।
বিয়ে? …আরিফ একটু অদ্ভুত চোখে তাকাল মোস্তাফিজের দিকে। তারপর একগাল হেসে বলল, গত বছরই বিয়েটা সেরেছি! লাইফের একটা বিশাল কাজ ভাই! সময় থাকতে সেরে রাখা ভালো!
চৌকস! খাসা! মোস্তাফিজ ক্রমশ মুগ্ধ হচ্ছিল। বিয়েটাও তার প্ল্যানের একটা অংশ! এরকমভাবে মোস্তাফিজ কি কোনোদিন ভাবতে পেরেছে? এজন্যেই তৃণা…।
তৃণার কথা বেশিক্ষণ ভাবলেই মোস্তাফিজের ভেতরে এক ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটতে থাকে। এই চারপাশের পৃথিবী ছেড়ে অন্য একটা ছবির পৃথিবীতে মন উড়াল দেয়। সেখানে বেশ কিছু বাছা বাছা ছবি। তেলরঙে, অনেক যত্নে আঁকা। একশোর বছরেও নষ্ট হবে না। …মোস্তাফিজ ক্রমশ তার নিজের চিত্রশালাটার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিল। তেলরঙে আঁকা তৃণার মুখ। বড় যত্নে টাঙানো আছে সেই ছবি। খুব আদর করে আঁকা।
আপনার স্ত্রীর নাম কী?
মোস্তাফিজের স্বরে অপরিসীম সারল্য। দুই চোখে ঘোর। সেই দুই চোখ দেখছে ইজেলে তৃণার মুখ। অথবা দেখছে তৃণার নতুন স্বামীর বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। চটপটে, চৌকস, বিত্তবান, মাথায় সবসময় নতুন নতুন আয়ের চিন্তা। স্বামী তো এরকমই হতে হয়! ঠিক এরকম!
প্রশ্নটা শুনে সিগারেটের আলোটা যেন এক পলক থমকে গেল। আরিফ মুখটা সামনে এগিয়ে নিয়ে এল, ঘোড়েল গলায় বলল, ব্যাপারটা কি ভাই বলুন তো? কোনো বিশাল প্রেম-ট্রেম ছিল নাকি? সোনালি গ্রুপ এসে সাইড মেরে দিয়ে গেছে?
এখন অনায়াসেই একটা মিষ্টি গল্প বানিয়ে বলা যায়… আরে না ভাই, আমার ছোট মামার এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে আপনাদের এই সোনালি গ্রুপেই। কাজের চাপে যেতে পারি নি সেই বিয়েতে, জামাইকেও দেখা হয় নি। ভাবলাম, আপনিই সেই জামাইবাবাজি নাকি…!
কিন্তু মোস্তাফিজ এসব গল্প বানিয়ে বলতে পারে না। পারলে… থাক, পারলে কী হত, সে নিয়ে আর কথা বাড়ানোর দরকার নেই।
আরিফ এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে হো হো করে হেসে উঠল! বলল, আরে ভাই প্রেম-ট্রেম থাকলে বলুন না! আমার এসব নিয়ে কোনো প্রবলেম নেই। বিয়ের আগে দেবদাস-পার্বতীর মতো মন দেয়ানেয়া খেলবে না এমন অরোমান্টিক বৌ আমার পছন্দ না! হলে আমি খুশিই হব!
মোস্তাফিজ আলতো গলায় জিজ্ঞেস করল, কী নাম আপনার স্ত্রীর?
আরিফ চোখ পিটপিট করে বলল, তৃণা! আমার বৌয়ের নাম তৃণা! কী ভাই, মিলল নাম?
বুক ধ্বক করে উঠেছিল মোস্তাফিজের। তাহলে ঠিকই ভেবেছে সে! বীরভোগ্যা বসুন্ধরা! এই অসীম আত্মবিশ্বাসী চতুর লোকটিই তৃণার স্বামী!
কিন্তু কোন নিয়তি তাকে বৃষ্টির মধ্যে ফেলে এই আশ্চর্য ছাদের নিচে এনে দাঁড় করাল? এ তো গল্প-উপন্যাস কিংবা সিনেমায় হয়! ঘুরেফিরে ঠিক এই দিনেই, এই বৃষ্টিঝরা সন্ধ্যায় স্বামীসহ তৃণা তাকে এই বাড়ির সামনে কোণঠাসা করে ফেলল?
এবং তৃণা আসছে… ঐ যে শোনা যাচ্ছে তার গলার আওয়াজ!
কথা বলতে বলতে একটি নারীমূর্তি এই সন্ধ্যার আধো অন্ধকার ঠেলে এগিয়ে এল। তার সঙ্গে আরো কয়েকজন। স্বামী নিয়ে এই বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল বোধহয়। বাড়িটার সামনে এই জায়গাতে কোনো আলো নেই। হয় বালব ফিউজ, নয় তো চোর বালব খুলে নিয়ে গেছে! তাতে অবশ্য ভালোই হয়েছে। নিয়তি মোস্তাফিজকে যে জায়গায় নিয়ে এসেছে, সেখানে ঝকঝকে আলোর মধ্যে দাঁড়াবার মতো সাহস নেই তার!
তৃণা এসে রিনরিনে কণ্ঠে বলল, বৃষ্টি থেমেছে তো, তাই না?
পিছন থেকে একজন পুরুষকণ্ঠ বলল, বৃষ্টি থামার জন্য যে পরিমাণ ব্যস্ত হয়েছিলেন, না থেমে উপায় আছে?
একটা মৃদু হাসির গুঞ্জন উঠল।
তৃণা বলল, আহা, বোঝেন না কেন? আমাকে বাসায় রেখে উনাকে আবার আরেক জায়গায় যেতে হবে! আসব আরেকদিন!
এরপরের বার বেশি সময় নিয়ে!
হ্যাঁ, বেশি সময় নিয়ে!
আরিফ গলা খুলল এবার, তৃণা, পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি, ইনি আমার নতুন বন্ধু মোস্তাফিজ! সামনে এসে ভালো করে উনার চেহারা দেখ! দেখ তো চিনতে পার কিনা!
তৃণা সামনে এগিয়ে এল। মোস্তাফিজকে দেখে ম্লান হাসল একটু, বলল, স্লামালিকুম! ভালো আছেন?
ভালো? …মোস্তাফিজের যেন জ্ঞান ফিরে এল, হ্যাঁ, আমি ভালো আছি, আপনি ভালো?
জবাবে তৃণা মৃদু হাসল। বেশ মিষ্টি তার এই হাসিটা। মোস্তাফিজের ভালো লাগল, বড় সুন্দর একটা মেয়ে! না, তার বিগত স্ত্রী তৃণা এ নয়। এ আরো এক তৃণা। আগের তৃণার চেয়েও আরো সুন্দর। হয়ত বা কে জানে, আগের তৃণার আরো মডিফাইড ভার্সন।
আরিফ হাসতে হাসতে বলল, ভালো করে দেখ দেখি একজন আরেকজনকে, চিনতে পার কিনা! মোস্তাফিজ ভাইয়ের ভয়াবহ কোনো এক প্রেমের সমাধি ঘটেছে এই সোনালি গ্র“পে। সেই থেকে সোনালি গ্র“পের লোক শুনলেই তিনি বৌয়ের নাম জিজ্ঞেস করেন!
নির্দয় রসিকতা। তবে সেটা মোস্তাফিজের কাছে, আরিফের কাছে নয়। কিন্তু আরিফরা রসিকতা করবে, আর মোস্তাফিজদের সেটা মাথা নিচু করে শুনতে হবে, এটাই দুনিয়ার নিয়ম এখন।
তৃণা অবশ্য আরিফের কাঁধে শাসনের একটা ছোট্ট আদুরে চাপড় মারল!
যে বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল আরিফরা, সে বাড়ির গৃহকর্তা এবং তার গিন্নির সাথে আলাপ হল। ফাঁকা শুভেচ্ছা বিনিময়, আর ‘কেমন আছেন’ জাতীয় অর্থহীন প্রশ্ন।
মটরসাইকেলে উঠে এক কিকে স্টার্ট দিয়ে পিছন ফিরে হাসল আরিফ, তাহলে ঐ কথাই রইল! আপনি বিশ, আমি দশ, এরপর থেকে পনেরো-পনেরো! আপনার অফিস আমি চিনি, যোগাযোগ করব! মোস্তাফিজ বললে চিনবে তো?
মোস্তাফিজ নীরবে মাথা নাড়ল।
মটরসাইকেলের ওপর চেপে বসল তৃণা। একটা হাত দিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরল আরিফের। সেই হাতের ভেতর অনেক কথা আছে। সন্ধ্যার ল্যাম্পপোস্টের আলোয় তার প্রসাধন করা মুখটা তখনো ঝকমক করছে। একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে মটরসাইকেলটা চলে গেল।
দ্বিতীয় তৃণার চেহারাটা গলির বাঁকে মিলিয়ে গেল। ঐ তৃণা নয়, এ আরো এক তৃণা। কিন্তু ঘটনা একই।
আগের তৃণাও হয়ত এরকমই কোনো একজনকে বিয়ে করেছে, স্বামীর কোমর জড়িয়ে ধরে মটরসাইকেলে চেপে এলোমেলো বাতাসে চুল ওড়াচ্ছে। মোস্তাফিজের মতো অপদার্থ মানুষের প্রতি তার ভীষণ বিতৃষ্ণা, আরিফের মতো আত্মবিশ্বাসী মানুষই একমাত্র তার তৃষ্ণায় জল ঢালতে পারে।
চোখ কুঁচকে ভাবল মোস্তাফিজ, সেইজন্যই কি সব আরিফরা সব তৃণাদের মটরসাইকেলে তুলে নিয়ে দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে… আর পেট্রোলপোড়া ধোঁয়ার মধ্যে বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে থাকছে মোস্তাফিজরা… অপদার্থ, সাহসহীন মোস্তাফিজ!
সব তৃষ্ণা ঠাণ্ডা জলে মেটে না। তার ওপর বিতৃষ্ণ হয়ে তৃণা যখন সংসার ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তখন তাকে কেন শক্ত দুই হাতে জড়িয়ে ধরে নি মোস্তাফিজ? চুলের মুঠি চেপে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিতে কি সে পারত না? নিছক ভালোমানুষি ছাড়াও স্বামীর কাছে অনেককিছু চাওয়ার থাকে মেয়েদের!
রিকশাঅলাটা গাছতলায় দাঁড়িয়ে আছে। হাতে আবারও একটা বিড়ি। তার একমাত্র বিনোদন।
মোস্তাফিজ যেতেই ‘আসেন সার’ বলে রিকশায় গিয়ে উঠল। ঢুলতে ঢুলতে রিকশা চলেছে, আর মোস্তাফিজ তখন মনে মনে আরেকটা তেলরঙের ছবি আঁকছে। ঝকমকে সুন্দর একটা মুখ, তাতে সন্ধ্যার ম্লান আলো মাখানো। নতুন তৃণার ছবি, যে আগের তৃণার আরো অনেক পরিমার্জিত সংস্করণ। সন্ধ্যার আলোতেও যার রূপ পদ্মফুলের মতো ফুটে থাকে।
পৃথিবীর সব তৃণাদের কেন নিয়ে যায় আরিফেরা? নিয়ে যদি যায়ই, তাহলে আবার কেন মোস্তাফিজদের সাথে নতুন রফা করে পনেরো-পনেরোতে? আর সেই পনেরো-পনেরো কেন তৃণাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়? তাহলে বুদ্ধিহীন, বেকুব, অপদার্থ মোস্তাফিজরা কাকে নিয়ে বাঁচবে?
কল্পনায় তেলরঙে আঁকা মোস্তাফিজের সব ছবিগুলো তার চোখের জলরঙে গুলে একাকার হয়ে যাচ্ছিল…।
============================
গল্প- আলিমের নিভৃতিচর্চা by রাশিদা সুলতানা গল্প- প্রত্যাবর্তন: আমার ‘ফেরা’ নিয়ে যে কাহিনী না ..মানষ চৌঃ গল্প- 'বীচিকলায় ঢেকে যায় মুখ ও শিরোনাম' by আনোয়ার ... গল্প- 'প্রীত পরায়া' by সিউতি সবুর গল্প- 'চলিতেছে' by মাহবুব মোর্শেদ গল্প- 'গোপন কথাটি' by উম্মে মুসলিমা গল্প- 'রূপকথা' by লুনা রুশদী সঞ্জীব চৌধুরীর কয়েকটি গল্প গল্প- 'অস্বস্তির সঙ্গে বসবাস' by ফাহমিদুল হক গল্প- 'মঙ্গামনস্ক শরীরীমুদ্রা' by ইমতিয়ার শামীম গল্প- 'হাজেরার বাপের দাইক দেনা' by জিয়া হাশান গল্প- ‘অপঘাতে মৃত্যু’ ও ‘সাদামাটা’ by লীসা গাজী গল্প- 'দ্বিতীয় জীবন' by ইরাজ আহমেদ গল্প- 'পুষ্পের মঞ্জিল' by সাগুফতা শারমীন তানিয়া গল্প- 'একশ ছেচল্লিশ টাকার গল্প' by কৌশিক আহমেদ গল্প- 'একে আমরা কাকতালীয় বলতে পারি' by মঈনুল আহসান.. গল্প 'গহ্বর' by জাহিদ হায়দার গল্প- 'পুরির গল্প' by ইমরুল হাসান গল্প- 'নওমির এক প্রহর' by সাইমুম পারভেজ গল্প- 'মরিবার হলো তার সাধ' by আহমাদ মোস্তফা কামাল গল্প- 'নিষুপ্ত শেকড়' by নিরমিন শিমেল গল্প- 'লাল ব্যাসার্ধ্ব' by শামীমা বিনতে রহমান
bdnews24 এর সৌজন্যে
লেখকঃ মৃদুল আহমেদ
এই গল্পটি পড়া হয়েছে...
লেখকঃ মৃদুল আহমেদ
এই গল্পটি পড়া হয়েছে...
No comments