গল্প- 'ভ্রম অথবা ভ্রমণ বিষয়ক গল্প' by ইফফাত আরেফীন তন্বী

রিকশার পিছনের পর্দাটা তুলে টুক করে দেখে নেয় সুজলপুরের শেষ ব্রীজটা। ব্রীজের গোড়ায় এক বিশাল পাইন গাছ, পাইন গাছের কথা বিদেশী গল্প উপন্যাসে পড়েছে। ছোটবেলায় ভাবতো পাইন বুঝি কোনো ফল। চীন দেশের ছবিতে আঁকা রূপকথার বইতে একবার দেখেছিলো সাদা রঙের ফল। শাড়িতে গোলাপী পাড়ের মতো শেড দেওয়া সেই ফলে। সেই গাছে গল্পের বাঁদর গুলো ঝুলছিলো।


ওই বয়সে বাঁদরের বাঁদরামীতে যেমন মোহিত হয়েছিলো তেমনি গোলাপীপেড়ে সাদা ফলেও চমৎকৃত হয়েছিলো। ফলের কি নাম লেখা হয়েছিলো ওই বইয়ে? না বোধ হয়। লেখা হয়নি বলেই সে মনে মনে নাম দিয়েছিলো পাইন। অথচ কী আশ্চর্য পাইনের ফলই হয় না! এবং মুহিব জানালো পাইন কাঠই নাকি কেরোসিন কাঠ।

পাইন কাঠই কেরোসিন কাঠ শোনার পর বুকের গভীর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এসেছিলো। দীর্ঘশ্বাস এমন একটি কমন বিষয়! কত কারণেই না বের হয়। দাদি মেঝকার মৃত্যুর কথা মনে হলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, সামু গোপনে বিয়ে করেছিলো তিমিরকে—গোপনে বিয়ে গোপনেই তালাক—কেউ জানে না। সেদিন দুপুরে বারিস্তায় কফি খেতে খেতে বলছিলো, “জানিস জাসিফের একটা হাত আমাকে জড়িয়ে ওর নাক আমার ডান বাহুতে ডোবানো মানে আমি চিৎ হয়ে শুয়ে আর ও কাত হয়ে আমার দিকে ফিরে…।”

তবু কেন যেন তিমিরের কথা ভেবে এত ফাঁকা মনে হলো সব কিছু! ও প্রশ্ন করেছিলো, “কেঁদেছিলি বুঝি খুব সামু?”

সামুর উত্তর ছিলো, “নারে কান্না না কেবল একটা দীর্ঘশ্বাস!”

আচ্ছা পাইন কাঠ কেরোসিন কাঠ এটা জানার দীর্ঘশ্বাসের সাথে মেঝকার জন্য দাদির দীর্ঘম্বাস, তিমিরের জন্য সামুর দীর্ঘশ্বাসের তফাৎটা কী?

পাইন গাছটা ক্রমশ ছোট হয়ে আসে, লোহার কারখানা। ঠিক এই মুহূর্তে এছাড়া আর কোনো ভালো শব্দও মনে পড়ে না ওর। কারখানার নীল সবুজ দরজাটা প্রায়শঃই খোলা থাকে, রাস্তা ও কারখানার ভৌগলিক অবস্থানটা এমনই যে বহু দূর থেকে কোনো রিকশা-আরোহী দেখতে চাইলেই দেখতে পারে ভেতরটা। পেছনে যে পথটা ফেলে এসেছে ও সেটা দূর ছুটিপুরের রাস্তা। এই রিকশা থেকে অনেকটা পথ পিছনে গেলে একটা নদী—শাখা নদী? নাকি প্রশাখা?… চিত্রা কি ভৈরব?… নাকি সেই বনগাঁ থেকে আসা ঢুলু ঢুলু ইছামতি… আসলে প্রকৃত নামটা ওর মাথা থেকে হারিয়ে গেছে যেদিন এই নদীটা ও প্রথম দ্যাখে আর এক আশ্চর্য নাম নদীটার অন্য নাম হয়। তা হোক। নদীর যে নামই হোক নাব্যতা হারালে তাতে কী এসে যায়!

অফিসের সুসজ্জিত কাচের ঘরে ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফ্যালে। কারণ বুঝে গেছে আর কোনোদিনই ঔ পথে যাওয়া হবে না। সব বয়সের একটা ধর্ম আছে; একুশ বছর বয়েসে যে প্রেম হয় সে প্রেমের সাথে জড়িয়ে থাকে সুজলপুর, ছুটিপুর, সুতনুকা নদী, পুরোনো রেলব্রীজ, হলুদ সর্ষে ক্ষেতে বেগুনি চুন্দ্রি জামার প্রজাপতি পাখা মেলে ওড়াওড়ি আর সবার অলক্ষ্যে নদীর নামের প্রজাপতির চোখ বা চুলে ছুঁয়ে দেওয়া বা তার ঠোঁটের হাওয়ায় ওড়ানো ঠোঁট মাখা হাত।

রিকশা থেকে তখনও বেশ দেখা যায় লোহা কারখানার ভেতরটা, কারখানা পার হলেই জামতলা, মিশরীয় পেঁয়াজের দোকান আর দোকানী সেই চশমা পড়া বুড়ো যার চশমার একটা ডাট দড়ির… পাটের দড়িতে কেন যেন একটু লাল সুতো জড়ানো আছে। তার পাশেই আছে চায়ের দোকান, এই দিকে প্রথম রিকশায় ঘণ্টা সাওয়ারী হয়ে আসা—ওই চায়ের লোভেই। তারপর একটু একটু করে পেছন দিকে যাওয়া। ওই পাইন গাছ ব্রীজের ওপারে ছুটিপুর যাবার পথ। আসলে কোনো কোনো গন্তব্য মানুষকে গন্তব্য ছাড়িয়ে আরও দূরে নিয়ে যায়—সে দূর গন্তব্যহীন পথে হাঁটলে আর কোনো গন্তব্য স্থির করা হয় না। জীবনটা গন্তব্যহীন এক বিশেষ লয়ে যেখানে অন্তিম নিয়তির অপো ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।

রিকশাটা অবধারিত ভাবে আজ আর বামে মোড় নিয়ে মিশরীয় পেঁয়াজের গল্প শুনতে শুনতে চা খেতে থামে না। এগুতে থাকে খোলাডাঙা-ধর্মতলার দিকে। হাতের ডান পাশে দূরে ধানক্ষেতের মাঝে খেজুরগাছের দল। অভ্যাসবশত আজও গোনা শুরু করে… উহ্ আজ সংখ্যাটা দাঁড়ায় আটত্রিশ; গতদিন ছিলো একচল্লিশ।

রিভলভিং চেয়ারটা ঘুরিয়ে কাচের ভেতর দিয়ে বাইরে দেখে। নাক বরাবর কাচের বাইরে হলুদ আলামন্ডা নাচতে থাকে, ও ভাবে ইচ্ছে করলেই একদিন রিকশাটা থামিয়ে গুনে আসা যেত খেজুর গাছের দলে কত গুলো গাছ আছে—হয়নি। আর কোনোদিনই এর সঠিক হিসাব জানা যাবে না যেদিন রোদ্দুরনেভা বিকেলে মনুষ্যহীন রাস্তায় একটি আলতো চুমু পড়েছিলো ঠোঁটে সেদিন—তখন যখন ওর ঠোঁটের ভেজা সীমানায় নতুন ভেজা সীমানার স্পর্শ পেয়েছিলো তখন ও ভাবছিলো খেজুর গাছ আজ গোনা হলো না কিন্তু ভাবনার পরের লাইন স্পর্শ করার আগেই দ্রুতগতিতে একটি সাইকেল ওদের পার হতে হতে রাস্তায় শুয়ে থাকা কুকুরের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে ধানেেত সাইকেল আরোহী ছেলেটি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে দেখতে পেয়েছিলো রিকশাটি গতি বাড়িয়ে কখন যেন প্রি চিতায় রূপান্তরিত হয়েছে যা চলে গেছে বহুদূর ছেলেটি ওর ঠোঁটে লেগে থাকা কাদায় এক অদ্ভুত স্বাদ পায় নিমেষেই বুঝতে পারে চিতা বাঘের পেটে একমাথা কোকড়া চুলের আড়ালে সে দেখেছিলো কেবল একটি চোখ আর কপোল—যা ছুয়েছিলো বিকেলের নেভানো আলো কিন্তু এসবের আড়ালে সে যে ঠোঁট জোড়া দেখতে পায়নি এ হলো তারই গলে যাওয়া স্বাদ।

ও এবার হাসলো, ও খুব হাসলো।

ওদের শহরে শনিবাসরীয় শুক্রবাসরীয কবিতার আসরে এক তরুণ আগন্তুক কবির কবিতায় ওই বিকেলটা আবিষ্কার করে ও নতুন কবির সাথে রিকশার চুমুবালকের এক চমৎকার সমন্বয় সাধন করেছিলো… ও ঠিক জানে না এটা কি সমন্বয় নাকি ওই মুহূর্তে তাঁর ছায়ামানব নিজের চুমুদৃশ্য উপভোগের জন্য শরীর থেকে ছিটকে গিয়েছিলো—দৃশ্য ও ক্রিয়ার দ্বৈতসুখ যেখানে তুরীয়ানন্দের আভাস জানায় সেখানে গিয়েই থমকে যায় ও। বুঝতে পারে না কিছুই; ভাবনাগুলোই অগণতান্ত্রিক ঠেকে।

আবার একটা দীর্ঘশ্বাস! সে আছে—লিফটের ছয়-এ এসে পায়ে হেঁটে আরও একতলা মাড়িয়ে যেখানে যেতে হয় সেখানে। সিড়ি ভেঙে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে হয়। প্রায় প্রতিদিনই মেশিনটি ওকে চিনতে চায় না। ওই মেশিনটিকে বাস্তবিক ঢঙ্গী মেয়েগুলোর মতো মনে হয়। প্রথম পরিচয়ের পরে যারা দ্বিতীয়বার অনেক ছেলেকে চিনতে চায় না (আদতে অনেক বেশিই চিনছে) এরপর ছেলেটির আত্মসম্মানে লাগলে একটু ঠোকাঠুকি এ তেমনি আর কি! দু’একবার ম্যানুয়ালি বাটন টেপাটেপির পর মেশিনটি একটু হাস্কি ভয়েজে বলে, “ইউ আর অথোরাইজড।” এরপর নিশ্চিন্ত মনে ও অফিসে ঢোকে। যদিও এই অফিসে নিশ্চিন্ত হবার কিছু নেই কেননা এখানে সর্বদা সকলে ফাকচুয়েট করে। ও ভাবে ও কি ফাকচুয়েট করে না? হঠাৎ মনে পড়ে ‘রতনে রতন চেনে শুয়োরে চেনে কচু।’ বোঝার চেষ্টা করে এরা রতন রতন চিনেছে নাকি শুয়োরে কচু? প্রশ্নটি তাকে সত্যি ভাবিয়ে তোলে। বিষযটি কি তার অস্তিত্বের সাথে জড়িত? হতে পারে… সব কিছুর সাথে হতে পারের মত সম্ভাবনাটা জড়িয়ে রাখাটাই নিরাপদ কারণ হতে পারার সাথে না হতে পারাটাও ঝুলে থাকে, ঠিক সেই ভাবেই কাচের কে রাত নামলে আলোর ভিন্নতা ওকে জিজ্ঞেস করে তোমার গন্তব্য কী? গন্তব্য?… এবার হিসেব কষতে বসে ও সকালবেলা খানিক ফেসবুকিং তারপর গোসল নাস্তা সেরে অফিস অফিস অফিস অফিস বাড়িফেরা, আবার ঘুম, আবার সকাল এখানে কোনো আন্দোলন নেই কেবল মাঝে মাঝে চাকরি ছেড়ে দিতে চাওয়া আর চাকরি থেকে বিচ্যুত হবার মত শঙ্কা ছাড়া। আর নগরকূলবধুরা শরীর নাকি মনের টানে (নাকি সে টান বহুগামিনীর) প্রায়শঃ আর অদৃশ্য প্রেমিকের স্খলন। আবারও এখানে হতে পারে শব্দটা যোগ হয়। হতে পারে স্খলিত সে বা ও নিজেই। তবু ওর গন্তব্য একদিন অদেখা দেখায় পরিণত হবে এরপর সারা পৃথিবী ওর। হতে পারে ওর অপোটাই জীবন কিন্তু প্রায়শ একটি নিশ্চিত ভাবনা ঠিক ভাবনা না এটা যেন ভীষণ বুঝতে পারা। আসলে সে কারো জন্যই অপো করেনা—কোনো আনন্দ কোনো দুঃখ কিংবা কোনো গডো? মৃত্যুও চেয়ে নিশ্চিত গডো আর কী হতে পারে! দর্শন থেকে বেরিয়ে আসে ও, ছোটবেলায় আরবীর হুজুর বলতো শেষ জামানার মানুষ নিজের মৃত্যু কামনা করবে। “শেষ জামানা” এতে একটু খুশীই হয় ও। যাক আদি মধ্য নয় একেবারে অন্তের ও, আর হযতো ও নিজেই একমাত্র যে কিনা কোনো শোক, কোনো দুঃখ বা বেদনার বাইরে থেকে মৃত্যু কামনা করে।

ভীষণ রকম অর্থহীন একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ওর ভেতর থেকে।
==============================
ইফফাত আরেফীন তন্বী
জন্ম
যশোর ২৬/৪/১৯৭৯
tanwi13@yahoo.com


পেশা
পাণ্ডুলিপি রচনা

মূল আগ্রহ পড়া। লেখালেখির প্রতি আগ্রহের জন্য জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্বকে (পাণ্ডুলিপি রচনা) প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিষয় হিসেবে বেছে নেওয়া। কিন্তু মূল প্রস্তুতি শৈশবে মাতামহের অবেক্ষনে ।

লেখালেখির জন্য সর্বত্র উৎসাহ দিতেন বাংলা নাটকের মহাকবি সেলিম আল দীন ও বেগমজাদী মেহেরুন্নেসা সেলিম।

এছাড়া আইকনস নামের একটি মাসিক পত্রিকার সম্পাদক (জীবনযাত্রা বিষয়ক)।
==============================
গল্প- আলিমের নিভৃতিচর্চা by রাশিদা সুলতানা   গল্প- প্রত্যাবর্তন: আমার ‘ফেরা’ নিয়ে যে কাহিনী না ..মানষ চৌঃ   গল্প- 'বীচিকলায় ঢেকে যায় মুখ ও শিরোনাম' by আনোয়ার ...  গল্প- 'প্রীত পরায়া' by সিউতি সবুর   গল্প- 'চলিতেছে' by মাহবুব মোর্শেদ   গল্প- 'গোপন কথাটি' by উম্মে মুসলিমা   গল্প- 'রূপকথা' by লুনা রুশদী  সঞ্জীব চৌধুরীর কয়েকটি গল্প   গল্প- 'অস্বস্তির সঙ্গে বসবাস' by ফাহমিদুল হক   গল্প- 'মঙ্গামনস্ক শরীরীমুদ্রা' by ইমতিয়ার শামীম   গল্প- 'হাজেরার বাপের দাইক দেনা' by জিয়া হাশান  গল্প- ‘অপঘাতে মৃত্যু’ ও ‘সাদামাটা’ by লীসা গাজী   গল্প- 'দ্বিতীয় জীবন' by ইরাজ আহমেদ  গল্প- 'পুষ্পের মঞ্জিল' by সাগুফতা শারমীন তানিয়া   গল্প- 'একশ ছেচল্লিশ টাকার গল্প' by কৌশিক আহমেদ  গল্প- 'একে আমরা কাকতালীয় বলতে পারি' by মঈনুল আহসান..   গল্প 'গহ্বর' by জাহিদ হায়দার    গল্প- 'পুরির গল্প' by ইমরুল হাসান  গল্প- 'নওমির এক প্রহর' by সাইমুম পারভেজ  গল্প- 'মরিবার হলো তার সাধ' by আহমাদ মোস্তফা কামাল   গল্প- 'নিষুপ্ত শেকড়' by নিরমিন শিমেল   গল্প- 'লাল ব্যাসার্ধ্ব' by শামীমা বিনতে রহমান  গল্প- 'সেদিন বৃষ্টি ছিল' by মৃদুল আহমেদ   ক. কিছুদিন হয় সেই নগরে কোন বৃষ্টি হচ্ছিল না। কিছুদ.. গল্প- 'তুষার-ধবল' by সায়েমা খাতুন  গল্প- 'কোষা' by পাপড়ি রহমান  গল্প- 'কর্কট' by রাশিদা সুলতানা   গল্প- 'তিতা মিঞার জঙ্গনামা' by অদিতি ফাল্গুনী  গল্প- 'সম্পর্ক' by তারিক আল বান্না  গল্প- 'অনেক দিন আগের দিনেরা' by রনি আহম্মেদ  গল্প- 'গাদি' by ইফফাত আরেফীন তন্বী   গল্প- 'কামলাঘাটা' by অবনি অনার্য   গল্প- 'কক্ মানে মোরগ: উদ্ভ্রান্ত মোরগজাতি ও তাহাদে.    গল্প- 'ভরযুবতী ও বেড়াল' by সাগুফতা শারমীন তানিয়া  গল্প- 'অমর প্রেম অথবা আমার প্রেম' by ইমরুল হাসান  গল্প- 'সরল রেখা' by শামীমা বিনতে রহমান   গল্প- 'রুখসানার হাসব্যান্ড' by মাহবুব মোর্শেদ




bdnews24 এর সৌজন্যে
লেখকঃ ইফফাত আরেফীন তন্বী

এই গল্পটি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.