গল্প- 'কামলাঘাটা' by অবনি অনার্য

মেডিকেল পূর্বগেটের পুবপাশে, কিংবা রায়েরবাজার বস্তির পাশের খোলা মাঠে, অথবা তারাগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডের পশ্চিম-উত্তর বা উত্তর-পূর্ব পাশে রাস্তার ধারে জড়ো হয়ে আছে জনাদশেক বা পনেরো বা আঠারো নরনারী, যাদের বয়স বিশ-বাইশ-ছত্রিশ-ছাপ্পান্ন বা এইমতো, কিন্তু কার বয়েস কতো এইসব নিয়ে মাথা ঘামাবার প্রয়োজন বৃথা, কেননা কলাকুশলীরা নিজেরাই নিজেদের বয়েস সাধারণ গণিতের হিসেবে গণনা করতে পারে না, বড়জোর তাদের বয়স সম্পর্কে একটা অনুমান করা যেতে পারে তাদের মুখ থেকে শোনা বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনাবলী দিয়ে, তাও আবার পাল্টা-প্রশ্নের উত্তর সাপেক্ষে, এই যেমন ঘটনা তিনি নিজের চোখে দেখেছেন কি-না, নাকি তার বাবা কিংবা দাদা, বা দাদার বাবার অথবা হতে পারে মা কিংবা নানী বা নানীর মা’র মুখে শুনেছেন — এইসব বিচার করে। জয়নালের, কিংবা হতে পারে সে নুরুল বা কামরুল বা জলিল বা বদরুল, তার কিংবা তাদের, গায়ে আজ সবুজ রঙের শার্টটা নেই, আলকাতরা রঙের পলিস্টারের কোর্তাটাও নেই, এমনকি বুকপকেটঅলা নোংরারঙের পাঞ্জাবিটাও নয়। ছাইরঙা ফুলহাতা গেঞ্জি, যা এই ভয়ংকর শীতে সোয়েটারের বিকল্প হিসেবে ব্যবহারে তেমন বাধা নেই, ঝুলে আছে বদরুলের হাতের কব্জি পেরিয়ে খানিকটা। মুহূর্তের মধ্যেই হাত দিয়ে হয়তো তার কানের পাশটা, বগলের পেছনটা বা পিঠের মাঝবরাবর কিংবা রানের কুঁচকি চুলকানোর চেষ্টা করে, অথবা করে না। পায়ের পাশে বা সামনে পড়ে থাকা কোদাল আর বাঁশের ঝুড়িটা অনড় থাকে, অন্তত যতক্ষণ না জয়নালের পায়ের ঠেলায়, কিংবা মৃদু ধাক্কায় সেগুলোর অবস্থানের পরিবর্তন হয়। এতো ঘটনার মধ্য দিয়েও তবু কুয়াশা ঝরছে অনবরত, বা থেকে থেকে, এবং মাথার উন্মুক্ত চুলগুলো কুয়াশায় শাদারঙ ধারণ করলেও কামরুলের মনে পড়ে বগুড়ার কিংবা গাইবান্ধা বা পায়রাবন্দের কোল্ডস্টোরেজের স্মৃতি। শেষদিন মালিকের পক্ষ থেকে বকেয়া পরিশোধের ঘোষণা থাকলেও, এবং সেটা পাবার শতভাগ সম্ভাবনা থাকলেও, জলিলের মনটা বিষাদময় বা অন্য কোনো মনখারাপকরা-অনুভূতিময় হয়ে ওঠে। সকাল ৭টার সার্জারি ক্লাস বা সাড়ে সাতটার বনানীগামী বাস কিংবা সাতটা পয়ত্রিশে হাজিরাখাতায় সই করার লাইন ধরার জন্য তাদের পাশ দিয়ে যে আমি হেঁটে কিংবা রিকশায়, মাঝে মধ্যে টেম্পুতে চড়ে যাই, তাতে ঘটনার এইসব পরম্পরায় কিছুটা এদিক-সেদিক ঘটে, বটে — কিন্তু এতোসব ঘটনার কার্যকারণ নিয়ে তবুও সন্দেহ প্রকাশ করেন জাহাঙ্গীর মাসুদ বাদশা, কিংবা আবুল ফাতেহ হিমু, নাজমুল হক, শাহরিয়ার পারভেজ, এমনকি আফরোজ আল মামুনও। অথচ ডন কিংবা মিথুন, রুমানা কিংবা স্নিগ্ধা, এপি কিংবা দীনা (মানে বোরখাদীনা), অথবা এদের সকলেই কিন্তু এসব ঘটনার একটি কিংবা দুটি কিংবা কয়েকটির কিংবা অনেকগুলোর সাক্ষী। নুরুলের ঠ্যাং তবু ঠকঠকে কাঁপে, শীতে কিবা অন্য কারণে।

নুরুল কিংবা জলিল কিংবা ধরা যাক জয়নালেরই ঠ্যাং কিংবা শরীরের অন্য যেকোনো স্থানের কাঁপুনী কিন্তু কামলাঘাটার মূল মহাজন শামীম কিংবা রাসেল কিংবা রহিমের উপস্থিতির সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেয় না। নুরুল জয়নাল কিংবা মইনুলের ছেলে, বা ভাই¯Íা রফিকুল কিংবা শরীফুল একটা জীর্ণ সাইকেল ধরে দাঁড়িয়ে আছে অদূরেই, কিন্তু তার বাপ কিংবা চাচা কিংবা জ্যাঠার অনুকরণে তাকেও কাঁপুনীতে পেয়েছে, অবশ্য শুধুই ঠ্যাংয়ে। সে তার বাপ-চাচা-জ্যাঠার নিঃশব্দে কাঁপুনী স’য়ে যাওয়ার প্রাগৈতিহাসিক ক্ষমতাকে কোনোমাত্র গুরুত্ব না দিয়ে হঠাৎ করেই ক্যাঁক করে উঠলো — বাবা, কিংবা বড়-আব্বা কিংবা ছোট-আব্বা, মোর ঠ্যাং কাঁপতাছে, অথবা সে এইভাবেও চিল্লায়া উঠতে পারে, বাপ-কাকা-জ্যাডা, আমার ঠ্যাং কিন্তু কইলাম কাঁপতাছে। যেভাবেই কুঁকিয়ে উঠুক-না কেন, তাতে তার বাপ-চাচা-জ্যাঠার কাঁপুনী থামে না, এমনকি কাঁপুনীর মাত্রা বাড়েও না। তবে একটা ব্যাপার ঘটতে দেখা যায়, শামীম কিংবা রহিম কিংবা রাসেল, মানে কামলাঘাটার মহাজনের মোটরসাইকেলের ড্রাইভারের মাথা দেখা যায় এহেন কুয়াশার মধ্যেও। কিন্তু এটা যে রফিকুল বা শরীফুলের চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গেই হয়েছে সেটা নিশ্চয় করে বলা যায় না। সেটা বলা না গেলেও, মহাজনের মোটরসাইকেলের ড্রাইভারের মাথা দেখা যাওয়ার অর্থ যে তার পেছনে স্বয়ং মহাজন আছেন সেটা বলা যায়। এতোটাই নিশ্চয় করে বলা যায় যে, এমনকি প্রত্যাশিত মহাজনের মৃত্যু হলেও ঘটনা ঠিক এভাবেই ঘটবে বা ঘটে। কেননা, মহাজনের উত্তরসূরী তার ছেলে, কিংবা ছোট ভাই বা বড় ভাই, নেহাত আগের ড্রাইভারকে দেখা যাবে পুরনো কিংবা নতুন কোনো ড্রাইভারের পেছনে। তবে তাতে কিন্তু জয়নাল কিংবা নুরুল কিংবা আমিনুলদের দাঁড়িয়ে থাকা, বা কাঁপুনী বা সাইকেল ধরে থাকা তাদের ছেলে কিংবা ভাইস্তা শরীফুল কি রফিকুলের চিৎকারের মাত্রাগত কোনো পরিবর্তন হয় না। কিন্তু মহাজনের আগমণে পরিস্থিতি নগদে পাল্টে যায়। কেননা, একমাত্র এই প্রভুই জানেন আজ কোথায় কী উপায়ে কী মাত্রায় রুটি-রুজির ব্যবস্থা হবে। এখানে রুটি শব্দটির ব্যবহার নিয়ে ফলিত অর্থনীতিবিদদের মধ্যে কানাঘুষা অব্যাহত থাকবে, কেননা রুটি শব্দটি যেহেতু নিদেনপক্ষে আটার সঙ্গে সম্পর্কিত, এবং আটা শব্দটি জয়নাল বা নুরুল বা নাসিমুলদের সঙ্গে দ্ব›দ্বমূলক কোনো সম্পর্কে জড়ায় না, মানে জড়ায়নি এতোকাল, তাই এতোকালই এ-নিয়ে কারোর কোনো আপত্তি ছিলো না, কিন্তু এই দুইহাজারআট সালের ২৫ জুলাই তারিখে বসে নাসিমুল বা করিমুলদের সঙ্গে আটা কিবা রুটি শব্দটির ব্যবহার আদালত অবমাননারও শামিল হতে পারে, বিশেষ দ্রষ্টব্য দিয়ে লেখা উচিত যে জরুরী অবস্থা এখনো জারি আছে।

এই সমাবেশে জোছনা কিংবা শাপলা বা জরিনা থাকলে মহাজন তার দিকে তাকিয়েই মোটরসাইকেল থেকে নেমে পানের পিক ফেলেন, কিংবা সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়েন, না থাকলে অবশ্য তাদের দিকে তাকিয়ে পানের পিক ফেলেন না, এমনকি সিগারেটের ধোঁয়াও ছাড়েন না। এসব গুরুত্বপূর্ণ নারীবাদী ইস্যুতে নুরুল কিংবা জয়নাল কিংবা নাসিরুলের কিছুই এসে যায় না, কেননা তারা নায়কোচিত কোনো সিনেমা বা আর্ট ফিলিমের কেন্দ্রীয় বা পার্শ্বীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ বা উত্তীর্ণ হয় নাই। তারা বরং মহাজনের মুখের দিকে, কিংবা মুখের সামান্য উপর বা নিচ বরাবর, তাকিয়ে থাকে। মহাজনের মুখ থেকে কর্মক্ষেত্রের ঠিকানা, যাবার উপায়, কী ধরনের কাজ, কার সঙ্গে দেখা করতে হবে ইত্যাদি তথ্য একে একে বের হতে থাকে। প্রথম থেকেই মহাজনের বর্ণনা সব শুনলেও তাদের সবার, বা অন্তত কারো কারো, বা অনেকেরই, প্রতীক্ষা থাকে “তো কে কে যাইবা আগায়া আসো” বা “তোমরাগুলা কারা কারা যাইবেন আগায় আইসেন বাহে” প্রশ্নের কিংবা প্রস্তাবনার দিকে। প্রায় প্রতিদিনই, কিংবা অধিকাংশ দিনই, বা নিদেনপক্ষে কোনো কোনো দিন তো বটেই, ওই প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে সবাই, বা অনেকেই, বা কেউ কেউ এতোক্ষণ বর্ণিত পুরো ঘটনা বা ঘটনার অংশবিশেষ ভুলে সামনের দিকে আগায়া আসে, মানে পা নাড়ালেই হলো, অর্থাৎ সামনের দিকে আগানোর উদ্যোগ নিলেই তালিকায় তার নাম উঠে যায়। এরপর তারা হয়তো আরেকবার নিশ্চিত হবার গুরুত্বসহ প্রশ্ন করে জেনে নিতে চায় কর্মক্ষেত্রে গিয়ে যার সঙ্গে দেখা করতে হবে তার নাম। কেননা, এরপরে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রশ্নের উত্তরে মহাজন হয়তো নিজেই নামটা উচ্চারণ করেন, নয়তো ড্রাইভারের দিকে নির্দেশ করে বলেন যে, তারা যেন তার কাছ থেকেই নামটা জেনে নেয়। কিন্তু এরই মধ্যে এমন যদি হয় যে, নুরুল কিংবা আরিফুল বা আশিকুল হয়তো কাজের জায়গার নাম শুনে যেতে অসম্মতি জানায়, মানে নিজের মনে মনে অসম্মতি, মানে মহাজনের সামনে অপ্রকাশিত রেখে, তখন সে কিংবা তারা বাড়িতে বৌ-ঝির অসুস্থতার কথা জানিয়ে আজ বরং কাজে না যাবার সিদ্ধান্ত ক্ষীণকণ্ঠে জানিয়ে দেয় ড্রাইভারের কাছে, কিংবা না জানিয়েই চোরের মতো সরে পড়ে। পরে হয়তো বিলের দিকে যায়, এবং এখন যেহেতু মঙ্গামাস, অর্থাৎ এমনকি আলুর মৌসুমও শেষ, তথা কোল্ডস্টোরেজের কাজও শেষ, উপরন্তু শীতকাল আসন্ন, ফলে কাজ জোটে না, ফলে বিলের ধার থেকে বাস স্টপেজে বা রেল স্টেশনে গিয়ে কুলির কাজ করার চেষ্টা চালায়, কিন্তু ওখানকার স্থানীয় কুলি বা বাটপারদের ধাওয়া খেয়ে হয়তো কোনো ঠেলার হেলপার হবার বাসনা ব্যক্ত করে, কিন্তু যার কাছে এ-বাসনা ব্যক্ত হয়, সে নিজেই হেলপার হবার কারণে তাকে রিকশা চালানোর বুদ্ধি দেয়, কিন্তু ততক্ষণে দুপুর হয়ে গেছে, রিকশা সব ভাড়ায় চলে গেছে, আর তাছাড়া রিকশায় হেলপার নেয়ার সিস্টেম নেই, ফলে অর্ধেক বেলায় কোনো কাজ জুটলেও চাকরিদাতা প্রশ্ন তোলে কার লোক, এবং কারোরই লোক নয় উত্তর পেয়ে দলছুট হবার কারণে বকাবকি করেন, এবং কারো-না-কারোর, অর্থাৎ কোনো-না-কোনো মহাজনের লোক হবার পরামর্শ দেন, এবং কিছু খেয়ে এসেছে নাকি এমন প্রশ্নের উত্তরে না শুনে “খালি পেটে আর কী কাজ করবা” বলে “ঠিক আছে করো, কুড়ি টাকা পাইবা” বলে কাজ দেখিয়ে দেন। ফলে বাকিবেলা না-খেয়ে থাকার নিশ্চয়তা পাওয়া যায়, এবং কাজের ফাঁকেই পরের দিন থেকে মহাজনের পরামর্শ মতো যেকোনো দূরত্বে কাজে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়, এটা মেনে নিয়েই যে, ভবিষ্যতে আরো অসংখ্যবার সিদ্ধান্তটি নিয়ে তাকে ভাবতে হবে, কেননা অতীতেও হয়েছে।

এরই মধ্যে নুরুল মইনুলের কাছে, কিংবা মইনুল নুরুলের কাছে, অথবা আরিফুলের কাছে কিংবা আরিফুল নাসিমুলের কাছে জানতে পেরেছে যে চিটাগাঙের দিকে নোয়াখালি বা মাইজদি বা দত্তেরহাট বা সোনাপুরের দিকে মজুরি পাওয়া যায় দিনে একশো বিশ কি দেড়শো কি দুশো টাকা, এবং অবগত হবার পর পারস্পরিক বোকা বনে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়, এবং তারা মাইগ্রেশনের চিন্তাভাবনা করতে থাকলে আরিফুল কিবা জয়নাল বা তারা সকলেই মহাজনের কথা ভাবতে থাকে, নিজের এবং অনেকের বা সকলের অজান্তেই। ফলত তারা আবার পরেরদিন কামলাঘাটায় সমবেত হবার সিদ্ধান্ত পাকাপাকি করে, এবং আবার হয়তো দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পালিয়ে আসে, এবং আবার আধবেলা না খেয়ে আলোচনাশেষে পরেরদিন কামলাঘাটায় সমবেত হয়, বা অন্তত এবার সত্যি সত্যিই বিদেশে যাবার পরিকল্পনা করে। কিন্তু মহাজন আর নোয়াখালি বা মাইজদি বা দত্তেরহাট বা সোনাপুরের কথা বলে না, বা একদিন হয়তো বলেই ফেলে। এবং এবার হয়তো জয়নাল বা মমিনুল রাজি হয়ে যায়, বা তারা রাজি হয় না, নুরুল কিংবা আরিফুল হয়তো রাজি হয়, এবং ছেলে কিংবা ভাইপোকে সাইকেল নিয়ে চলে যেতে বলে, এবং পাড়ার মেম্বারের দোকান থেকে বাকিতে চাল ইত্যাদি নিয়ে যেতে বলে, এবং সন্ধ্যার পরপরই বাড়িতে ফেরার নিশ্চয়তা দেয়, এবং নিজের পোয়াতি বৌকে গিয়ে সান্ত্বনা দিতে বলে এই ব’লে যে, চিন্তা নাই, অথচ নিজেরাই চিন্তা করতে থাকে অথবা করে না, কেননা এর আগেও পাঁচটা বা চারটা বা তিনটা বাচ্চা হয়েছে ব’লে নিজেরাও নিশ্চিন্তে কোদাল আর ঝুড়ি হাতে নেয়। আবার হয়তো সাইকেল নিয়ে চলে যাওয়া ছেলে বা ভাইপোর রাস্তার দিকে তাকিয়ে আনমনা হয়, বা হয় না, কিন্তু মহাজনের মোটরসাইকেলের ড্রাইভারের তাড়া খেয়ে তাদের জন্য অপেক্ষমান ট্রাকের দিকে অগ্রসর হয়, অথবা রাস্তার ধারে পেশাব করার জন্য এগিয়ে গিয়ে, এবং অনাকাক্সিক্ষত বিলম্ব করে বাড়ির কথা ভাবতে থাকে, অথবা ভাবতে থাকে না, অথবা নতুন দেশের কথা ভাবতে থাকে, কিংবা ওই দেশের যে-ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করতে হবে তার কথা ভাবতে থাকে, বা তার নামটা বারবার মনে করার চেষ্টা করে, এবং পারে না, কিংবা হয়তো পারার সম্ভাবনা দেখা দিলে ট্রাকের স্টার্ট দেবার শব্দ শুনতে পায়, এবং তখন হয়তো সবেমাত্র পেশাব করতে শুরু করেছে এ-অবস্থায় উঠে পড়তে গিয়ে লুঙ্গির প্রান্তভাগ কিংবা হয়তো মধ্যভাগ বা অন্য কোনো ভাগ ভিজে যায়, বা ভেজার উপক্রম হলে সামলে নিয়ে পুরো লুঙ্গিটাই উঠিয়ে ধরে, এবং আবার বসে পেশাব করতে থাকে, কিংবা হয়তো মাঝপথে পেশাব করা বন্ধ রেখেই দৌড়াতে থাকে ট্রাকের দিকে, এবং কোদাল-ঝুড়ি পড়েই থাকে, সেটা খেয়াল করে ফের সেদিকে দৌড়াতে থাকে, এবং সবকিছু ঠিকঠাক নিয়ে ট্রাকের কাছে এসে শুনতে পেলো ট্রাকড্রাইভারের ডায়রিয়ার কারণে আসতে একটু দেরি হবে, কিংবা বিকল্প ড্রাইভারের খোঁজে হয়তো ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন মহাজনের মোটরসাইকেলের ড্রাইভার, কিংবা মহাজন নিজেই। ফলে আধভেজা লুঙ্গি বা পুরোপুরি শুকনো লুঙ্গি নিয়ে, এবং সবুজ রঙের শার্ট বা আলকাতরা রঙের পলিস্টারের কোর্তা বা বুকপকেটঅলা নোংরারঙের পাঞ্জাবিটা অথবা ছাইরঙা ফুলহাতা গেঞ্জি পরেই নুরুল কিংবা জয়নাল কিংবা কামরুল বা জলিল বা বদরুল বসে থাকে রাস্তার পাশে, বা রাস্তার উপরেই, এবং হয়তো কাঁপতে থাকে, শীতে কিবা অন্য কারণে।

একসময় সত্যি সত্যিই চলমান ট্রাকের শব্দ ভেসে আসে, এবং বদরুল বা জয়নাল কিংবা কামরুল অথবা জলিল থেমে থাকা ট্রাকটির দিকে একযোগে বা ভিন্নভিন্নযোগে তাকায়। ট্রাকড্রাইভারের খোঁজে ব্যস্ত কামলাঘাটার মহাজন কিংবা মহাজনের মোটরসাইকেলের ড্রাইভারও হয়তো তাকায়, কিন্তু তাদের একজন বা উভয়েই টের পায় যে, ট্রাকটা আসছে সৈয়দপুর বা দিনাজপুর বা পঞ্চগড়ের দিক থেকে, এবং একটু পরেই বুঝতে পারে যে, ট্রাক আসলে দুটো, এবং ট্রাক দুটো আরো এগিয়ে আসলে দেখা যায় বহনকারী গরুদের কারো মাথা, শিংসহ বা শিংছাড়া বা ভাঙাশিংঅলা, কোনো গরুর পিঠ বা বুক ইত্যাদি। কামলাঘাটার মহাজন কিংবা মহাজনের মোটরসাইকেলের ড্রাইভার বা দুজনেই একসঙ্গে বা ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে ট্রাক থামানোর জন্য হাত নাড়ায়, এবং ট্রাকগুলো প্রথমে জোরে হর্ন বাজিয়ে চলে যাবার ভান করে পরে ধীরে ধীরে গতি কমিয়ে থামায়, এবং একটি বা দুটো ট্রাকেরই ড্রাইভার বা হেলপার নেমে আসে, এবং তার বা তাদের সঙ্গে মহাজন কিংবা মহাজনের মোটরসাইকেলের ড্রাইভারের বা দুজনেরই কথা হয়, এবং সে কিংবা তারা বদরুল বা কামরুল অথবা জলিল কিংবা জয়নালদেরকে পেছনের ট্রাকটিতে চটজলদি উঠে পড়তে বলে, কেননা পেছনের ট্রাকটির অর্ধেকটা বা খানিক বেশি বা কম জুড়ে আছে গরু, কিংবা পেছনের ট্রাকের অর্ধেকটা বা খানিক বেশি বা কম এখনো খালি। ফলে বদরুল বা জয়নাল কিংবা কামরুল অথবা জলিলরা তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে নির্দেশ মোতাবেক, এবং ট্রাকে উঠতে গিয়ে কারো হয়তো কোদাল কিংবা ঝুড়ি বা অন্য কিছু পড়ে গেলে সে বা তারা পেছনের দিকে তাকিয়ে থাকে, কেউ হয়তো এ-সুযোগে বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে, অথচ এরই মধ্যে হয়তোবা ট্রাক মোড় ঘোরার কারণে দিক-পরিবর্তন হয়ে গেছে, অথচ তারা এখনো ট্রাকের পেছনের দিকে তাকিয়ে আছে, ফলে তারা হয়তো আর বাড়ির দিকে তাকিয়ে নেই, কিংবা হয়তো দিকভুল না করে বাড়ির দিকেই তাকিয়ে আছে, হতে পারে সে-বাড়িটা অন্য কারো।

ট্রাক ছুটছে অপার্থিব কোনো যানের মতো, এবং ঠাণ্ডা হাওয়াও বইছে সেইমতো, এবং ফলে বদরুল বা জয়নাল কিংবা কামরুল অথবা জলিলদের হয়তো কাঁপুনী ধরেছে, বা ধরেনি কেননা তাদের সামনেই, যারা পেছন ফিরে বসেছে তাদের পেছনে, বা কারো কারো পাশেই দাঁড়িয়ে আছে কুরবানী কিংবা ওইজাতীয় কোনো উদ্দেশে আমদানীকৃত গরুর দল। বদরুল বা জয়নাল কিংবা কামরুল অথবা জলিলরা গরুগুলোর দিকে তাকিয়ে বা না তাকিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে থাকে, এমনকি কোনো একজন গরু বা দুজন বা কয়েকজন গরুর চনা গড়িয়ে পড়লেও, এবং এর ফলে তাদের দু’একজন বা কয়েকজন বসা থেকে দাঁড়িয়ে থাকেন কিছুক্ষণ, পরে অন্য একটা নিরাপদ জায়গা দেখে ফের বসে পড়েন, এবং আবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে থাকেন গরুগুলোর প্রতি, মতান্তরে তাদের কেউ কেউ খানিক দুঃখও প্রকাশ করেন গরুগুলোর জন্য, কেননা ঠাণ্ডা হাওয়ার প্রায় পুরোটাই গরুগুলোর উপর দিয়ে যাচ্ছে, এবং এভাবে গরুগুলোর প্রতি তারা বেশ সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েন ক্রমশই, একসময় একাত্মই হয়ে পড়েন হয়তোবা। কিন্তু গরুগুলো সব সামনের দিকে তাকিয়ে বা না তাকিয়ে আছে বলে গরুগুলির মুখোমুখি হওয়া সম্ভব হচ্ছে না বদরুল বা জয়নাল কিংবা কামরুল অথবা জলিলের পক্ষে, ফলে তাদের মনক্ষুণ্ন হবার কারণ দেখা দেয়, এবং তাদের দু’একজন বা কয়েকজন বা সবাই আকিজ বা হরিণ বা মুকুটবিড়ি ধরায়, এবং এমন সময় বা খানিক পরে, বা বেশ খানিকটা পরে, সামনের ট্রাকটি পেছনের লালবাতি দেখিয়ে থামবার সংকেত দেয়, এবং দুটো ট্রাকই সাময়িক যাত্রাবিরতি দেয়, এবং সামনের ট্রাকের চালকের শারীরিক অসুবিধার কারণে হেলপারের হাতে ট্রাকচালনার ভার অর্পণ করেছেন বলে পেছনের ট্রাকটিকে সামনে যাবার পরামর্শ দেয়া হলে, এবং সামনের ট্রাকটিকে অতিক্রম করামাত্র ওই ট্রাকের গরুগুলির মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ পেলে বদরুল বা জয়নাল কিংবা কামরুল অথবা জলিলরা সোৎসাহে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে বা কয়েকদৃষ্টিতে গরুগুলির দিকে তাকিয়ে থাকে। এবং তাকিয়েই থাকে। অথবা তাকিয়েই থাকে। অথচ তাকিয়েই থাকে।
===========================
অবনি অনার্য 
কবি

জন্ম : নোয়াখালি, ৩১/৭/১৯৮০
পড়াশোনা: চিকিৎসাশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর।

প্রকাশিত বই
১. লঘুচালে চোরাবালি খেলা; কাব্যগ্রন্থ; ২০০৪; অন্ত্যজ, ঢাকা।
URL: www.geocities.com/sristi_mag/ebook/auboni/index.html

২. উন্মাদ; খালিল জিবরানের দ্য ম্যাডম্যান-এর অনুবাদ; বইমেলা ২০০৬; ইত্যাদি প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা।

৩. জেগে উঠছে ইরান, শিরিন এবাদি’র ইরান অ্যাওয়াকনিং-এর অনুবাদ; বইমেলা ২০০৭; সন্দেশ প্রকাশনী, আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা।

৪. সরস সতী; কাব্যগ্রন্থ; বইমেলা ২০০৮; সন্দেশ প্রকাশনী, বইপাড়া, ১৬ আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা।

৫. চে স্মৃতিকথা; ফিদেল কাস্ত্রোর চে: আ মেমোয়ার-এর অনুবাদ; বইমেলা ২০০৮; সন্দেশ প্রকাশনী, বইপাড়া, ১৬ আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা।

৬. আমার ক্ষোভ আমার অহংকার; ওরিয়ানা ফাল্লাচির দ্য রেইজ অ্যান্ড দ্য প্রাইড-এর অনুবাদ; বইমেলা ২০০৮; সন্দেশ প্রকাশনী, বইপাড়া, ১৬ আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা।

৭. কবিসঙ্গ অনুষঙ্গ; মুক্তগদ্য; জুলাই ২০০৮; যেহেতু বর্ষা, ২৭৫/জি ধানমণ্ডি ২৭, ঢাকা।

৮. WOMB TO-LET; দ্বিভাষিক কাব্যসংকলন; জুলাই ২০০৯; ঢাকা।

৯. আমাদের আর তাহাদের আমেরিকা; একুশে বইমেলা ২০১০; সন্দেশ; বইপাড়া, ১৬ আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা।

১০. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ (প্রা.) লি.; কাব্যগ্রন্থ; একুশে বইমেলা ২০১০; সন্দেশ; বইপাড়া, ১৬ আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা।

সম্পাদিত পত্রিকা
করুল, ২০০৫-
ই-মেইল: aunarjo@gmail.com
==============================
গল্প- আলিমের নিভৃতিচর্চা by রাশিদা সুলতানা   গল্প- প্রত্যাবর্তন: আমার ‘ফেরা’ নিয়ে যে কাহিনী না ..মানষ চৌঃ   গল্প- 'বীচিকলায় ঢেকে যায় মুখ ও শিরোনাম' by আনোয়ার ...  গল্প- 'প্রীত পরায়া' by সিউতি সবুর   গল্প- 'চলিতেছে' by মাহবুব মোর্শেদ   গল্প- 'গোপন কথাটি' by উম্মে মুসলিমা   গল্প- 'রূপকথা' by লুনা রুশদী  সঞ্জীব চৌধুরীর কয়েকটি গল্প   গল্প- 'অস্বস্তির সঙ্গে বসবাস' by ফাহমিদুল হক   গল্প- 'মঙ্গামনস্ক শরীরীমুদ্রা' by ইমতিয়ার শামীম   গল্প- 'হাজেরার বাপের দাইক দেনা' by জিয়া হাশান  গল্প- ‘অপঘাতে মৃত্যু’ ও ‘সাদামাটা’ by লীসা গাজী   গল্প- 'দ্বিতীয় জীবন' by ইরাজ আহমেদ  গল্প- 'পুষ্পের মঞ্জিল' by সাগুফতা শারমীন তানিয়া   গল্প- 'একশ ছেচল্লিশ টাকার গল্প' by কৌশিক আহমেদ  গল্প- 'একে আমরা কাকতালীয় বলতে পারি' by মঈনুল আহসান..   গল্প 'গহ্বর' by জাহিদ হায়দার    গল্প- 'পুরির গল্প' by ইমরুল হাসান  গল্প- 'নওমির এক প্রহর' by সাইমুম পারভেজ  গল্প- 'মরিবার হলো তার সাধ' by আহমাদ মোস্তফা কামাল   গল্প- 'নিষুপ্ত শেকড়' by নিরমিন শিমেল   গল্প- 'লাল ব্যাসার্ধ্ব' by শামীমা বিনতে রহমান  গল্প- 'সেদিন বৃষ্টি ছিল' by মৃদুল আহমেদ   ক. কিছুদিন হয় সেই নগরে কোন বৃষ্টি হচ্ছিল না। কিছুদ.. গল্প- 'তুষার-ধবল' by সায়েমা খাতুন  গল্প- 'কোষা' by পাপড়ি রহমান  গল্প- 'কর্কট' by রাশিদা সুলতানা   গল্প- 'তিতা মিঞার জঙ্গনামা' by অদিতি ফাল্গুনী  গল্প- 'সম্পর্ক' by তারিক আল বান্না  গল্প- 'অনেক দিন আগের দিনেরা' by রনি আহম্মেদ  গল্প- 'গাদি' by ইফফাত আরেফীন তন্বী



bdnews24 এর সৌজন্যে
লেখকঃ অবনি অনার্য


এই গল্পটি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.