অতীতের পুনরাবৃত্তি চাই না by আবুল মোমেন
স্বাধীনতা-পরবর্তী দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে। সে সময় স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর পক্ষেও সম্ভব হয়নি তাঁর দল, প্রশাসনযন্ত্র কিংবা বিরোধী দলের ওপর সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। প্রশাসনে দুর্নীতি ও অনিয়ম ছিল, বিরোধী দলের ছিল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের দাবিতে সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রামের ডাক, আর তাঁর দলের একশ্রেণীর উচ্চাভিলাষী নেতা-কর্মী ব্যক্তিগত সম্পদ ও ক্ষমতার মোহে হয়ে উঠেছিল বেপরোয়া।
বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী নেতা ছিলেন, সম্ভবত প্রথমে ভেবেছিলেন, তিনি মাঠে নেমে হাঁকডাক দিয়ে সব ঠিক করে ফেলতে পারবেন। কিন্তু যে যুদ্ধ সমগ্র দেশ ও দেশবাসীকে নানা মাত্রায় নানাভাবে জড়িয়ে ফেলেছিল, তা মুক্তিযুদ্ধ হলেও তার গতিপথ সবার জন্য একই রকম হওয়ার কথা নয়। তাই অভাবনীয় ধ্বংস ও বিপর্যয়ের অভিজ্ঞতা স্বাভাবিক শৃঙ্খলাবোধ, এমনকি অনেকের ভেতরকার নীতিনৈতিকতার বোধও ভেঙে দিয়েছিল। আমরা দেখলাম, দেশের নামে স্বাধীনতার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগের জন্য প্রস্তুত ছিল যারা, তাদের মধ্যে অনেকেই ক্ষুদ্র স্বার্থ ও বেপরোয়া লোভের ফাঁদে পা দিয়ে স্বাভাবিক ন্যায়বোধ হারিয়ে বসেছিল। দেশে একটা অস্থিরতা এবং তা থেকে অনিশ্চয়তার বাস্তবতা তৈরি হয়েছিল।
আমরা লক্ষ করলে দেখব, উদার দৃঢ়চেতা ও সিংহহূদয়ের বঙ্গবন্ধু ক্রমেই কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠছেন—বিশেষ ক্ষমতা আইন, রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি এবং অবশেষে বাকশাল-ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে এই পরিবর্তন প্রকটভাবে ধরা পড়েছে। তিনি কখনো বিরুদ্ধতাকারী ও বিশৃঙ্খলাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর হচ্ছেন, আবার কখনো তাঁর অসহায়তার প্রকাশও ঘটছে। সিরাজ শিকদারের বন্দিত্ব ও মৃত্যু কিংবা লালঘোড়া দাবড়ানোর হুঁশিয়ারি তাঁর কঠোর অবস্থানকে প্রকাশ করে, আবার যখন নিকটজনদের কাছে আক্ষেপ করে বলেন, ‘সব চাটার দল খেয়ে নিল’, তখন শাসক হিসেবে তাঁর অসহায়তা আর ঢাকা থাকে না।
কঠোরতা বা কর্তৃত্বপরায়ণতার পথে শেষরক্ষা হয় না। ষড়যন্ত্রকারীরা প্রত্যাঘাত করার সুযোগ পেয়ে যায়। তাতে দেশের জন্য কোনো ভালো ফল আসে না। বাংলাদেশ তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।
একদিকে বহু খেসারত, চরম নির্যাতন, দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকার এই অভিজ্ঞতা এবং অন্যদিকে বিপুল জনসমর্থন ও বিশাল জয়, দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী-তরুণসমাজ-আমলাতন্ত্রের সমর্থন সত্ত্বেও আবারও একশ্রেণীর দলীয় নেতা-কর্মীর বাড়াবাড়ির মাধ্যমে দেশে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার আলামত শুরু হয়েছে। তাই বলছিলাম, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের কথা মনে পড়ছে।
আমলাতন্ত্র যথারীতি দুর্নীতিগ্রস্ত আছে, হয়তো ষড়যন্ত্র হলে তাতেও অনেকেই যুক্ত হবে। মূল বিরোধী দল বিশাল পরাজয়ের ধাক্কা সামলে উঠতে না পারলেও সরকারি দলের অস্থির বেপরোয়া অংশ ধীরে ধীরে তাদের হাতে ইস্যু তুলে দিচ্ছে রাজপথে আন্দোলনে নামার জন্য। ফলে সাধারণ মানুষের মনে ২০০৯ যে রঙিন স্বপ্ন ও আশাবাদ নিয়ে শুরু হয়েছিল, দেড় বছরের মাথায় তা অনেকটা ফিকে হয়ে গেছে এবং আশঙ্কার মেঘ ঈশান কোণে জমতে শুরু করেছে। এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে একে বিশ্লেষণ করে বোঝা দরকার।
এ কথা ঠিক, বিএনপি একজন ক্ষমতাপ্রাপ্ত ও ক্রমে ক্ষমতাপাগল হয়ে ওঠা জেনারেলের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য সৃষ্ট দল। এটি একদিকে আওয়ামী লীগবিরোধীদের আর অন্যদিকে জিয়া ও খালেদার ক্যারিশমায় তৈরি রাজনৈতিক মঞ্চ হয়ে ওঠে। এটি আজও ঠিক রাজনৈতিক দল হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে এবারের বিশাল পরাজয়ের ফলে বিএনপির অবস্থা ’৫৪-র নির্বাচনে ভরাডুবির পর তার পূর্বসূরি মুসলিম লীগের যেমনটা হয়েছিল, সে রকমই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কিন্তু আওয়ামী লীগ তাকে লাইফলাইন দিয়ে চলেছে, দলের একশ্রেণীর নেতা-কর্মী মূলত ক্ষমতা-বিত্তের লড়াইয়ে নেমে একের পর এক বেআইনি কাণ্ড বাধিয়ে বসলে এই পরিণতিই স্বাভাবিক। তবে আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্ব ঘটনাগুলোর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে অসচেতন এ কথা বলা যাবে না। প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভানেত্রী, মন্ত্রী ও দলের সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় নেতা ও অনেক মন্ত্রী জোরালো ভাষায় এসব ঘটনার নিন্দা জানাচ্ছেন এবং নিরপেক্ষভাবে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলছেন। এ রকম আশ্বাস ও অঙ্গীকার তাঁরা গোড়া থেকেই দিয়ে এলেও তাতে কাজ হচ্ছে না। বরং দিনে দিনে ঘটনা বাড়ছে এবং ঘটনার বহর ও ভয়াবহতার মাত্রাও বেড়ে চলেছে। বোঝা যায়, নেতৃত্ব সদিচ্ছা প্রকাশ করলেও তা সত্যিই বাস্তবায়নে হাত দেওয়ার ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত। তাঁরা হয়তো ভাবছেন, ধমক-ধামক দিয়ে, কিছু মামলার ভয় দেখিয়ে, দল থেকে বহিষ্কার করে বা জেল খাটিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে। ব্যাপারটা সম্ভবত সে রকম নয়। এর কারণটা প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতার কথায়ই প্রকাশ পেয়েছে। তাঁরা কেউ অভিযোগ করেছেন, কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে আওয়ামী লীগ ও তার বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনে, বিশেষত ছাত্রলীগে, জামায়াত-শিবির-ছাত্রদলসহ অন্যান্য বিরোধী ছোট নেতা ও সাধারণ কর্মীরা ঢুকে পড়েছেন। অভিযোগ হোক, আশঙ্কা হোক, তা সত্য হওয়াই স্বাভাবিক বলে মনে হয়, এমনটা আমরা ঘটতে দেখেছি স্বাধীনতার পরেও। ক্ষমতাবদলের সঙ্গে সঙ্গে দলবদলের ঘটনা তো দেশে আকসার ঘটেই। তা ছাড়া আওয়ামী লীগ তো এবার আদর্শের লড়াইয়ে নেমেছে, যুদ্ধাপরাধী অর্থাৎ জামায়াত ও তার সহযোগীরা সত্যিই এবার কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এদের জন্য তাঁর ব্যাকুলতা এবং সরকারের প্রতি এ কারণে রাগ-ক্ষোভ প্রকাশে কুণ্ঠিত হচ্ছেন না।
আদর্শিক লড়াই সব সময় সর্বাত্মক হয়—তাতে সাধারণত সব পক্ষই সব শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। জামায়াত আপাতদৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ ও অপেক্ষার নীতি নিয়েছে বলে মনে হয়। তবে ধরে নেওয়া যায় যে তারা পাল্টা আঘাতের কিংবা এ অবস্থা বানচাল করার জন্য সব কৌশল অবলম্বন করবেই। বিএনপি দৃশ্যত তাদের সঙ্গে গাঁটছড়া না বাঁধলেও মাঠে তাদেরই এজেন্ডা পূরণে সক্রিয় থাকবে। এর অর্থ হলো নানা অঘটনের মধ্য দিয়ে তারা একদিকে সরকারের প্রতি জনসমর্থন কমাতে চাইবে, অন্যদিকে জনগণের মধ্যে এসব ঘটনার শিকার একটি সংক্ষুব্ধ অংশ তৈরি করে তোলার চেষ্টা করবে।
মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি আদর্শিক লড়াই। কিন্তু বিজয়ের পর থেকে আওয়ামী লীগের একটি অংশ সে কথা ভুলে আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ ও লাভের পেছনে ছুটে সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছিল। এবারের নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গকে সামনে নিয়ে এসে একটি আদর্শিক লড়াইয়ের পটভূমি তৈরি করেছিল। এখানে স্বীকার করতে হবে, এই আদর্শিক অবস্থানের কারণেই কিন্তু দেশের তরুণসমাজ অনেক দিন পরে আওয়ামী লীগের পক্ষে স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করেছিল। যার ফলে মহাজোট বিপুল বিজয় অর্জন করেছিল। ফলে এই বিজয়কে মানতে হলে এখন আওয়ামী লীগকে আদর্শিক লড়াইটি চালিয়ে যেতে হবে। আর তার অর্থ হলো, আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়ে যারা টেন্ডারবাজি, দখলদারিসহ নানা বেপরোয়া বেআইনি কাজে লিপ্ত হচ্ছে, তাদের নিয়ন্ত্রণে সরকার ও দলকে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার ব্যাপারটা কিন্তু সংক্রামক, যদি দেখা যায় পাবনা ও নাটোরের ঘটনায়, ইব্রাহিম ও সানাউল্লাহ হত্যার ঘটনায় সরকারের গৃহীত ব্যবস্থা স্পষ্টভাবে আইনানুগ নয় বা আইন অবাধে নিজস্ব গতিতে চলছে না, কিংবা যদি বোঝা যায় যে মনকে চোখ ঠেরে বুঝ দেওয়ার চেষ্টা চলছে, তাহলে অপরাধীরা আশকারা পায়। তাতে অপরাধ বেড়েই চলবে। এভাবে চললে একসময় সরকারের পক্ষে পরিস্থিতি সামলানো হবে মুশকিল। এমনিতে দারিদ্র্যের চাপ, এমনিতে বঞ্চনার ক্ষত, তার ওপর আছে দ্রব্যমূল্য আর ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের দৌরাত্ম্য—মানুষের ধৈর্য বেশি দিন বাঁধ মানবে বলে মনে হয় না।
আমার বিশ্বাস, এই অনিয়ন্ত্রিত বেপরোয়া বাহিনীকে সামলানো খুব যে কঠিন তা নয়। কেবল সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে সরকার ও দলের নেতৃত্বকে বোঝাতে হবে যে তাঁরা মূলত একটি আদর্শিক লড়াইয়ে আছেন। এটা বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার ব্রত হিসেবেই তাঁরা গ্রহণ করেছেন। এরই অংশ হিসেবে বিচার বিভাগকে প্রশাসন থেকে পৃথক করা, পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল করা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করা, নতুন যুগোপযোগী একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশের অঙ্গীকার, রূপকল্প ২০২১ ঘোষণা ইত্যাদি সরকারের যাত্রাপথ স্পষ্ট করে দেয়। সেই সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিচার বিভাগ থেকেও এসেছে কয়েকটি যুগান্তকারী রায়, এমনকি প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন ভাষণে কখনো শিল্পে দেশীয় ভাষা প্রয়োগের কথা বলে, কখনো শিশুদের ওপর মুখস্থবিদ্যার বোঝা না চাপানোর কথা বলে একটি আধুনিক মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন আমাদের। এটিই যে বাংলাদেশের সঠিক যাত্রাপথ, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এই স্বপ্ন ও সম্ভাবনাকে যেন চাটার দল ও ষড়যন্ত্রীর দল নষ্ট করতে না পারে, সে ব্যাপারে হুঁশিয়ার হতে হবে সরকারকে এবং ক্ষমতাসীন দল ও জোটকে।
এই যে বাংলাদেশের একটি যাত্রাপথ স্পষ্ট হয়ে উঠছে, তাতে সবাইকে শরিক হওয়ার আহ্বান জানাতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, ইচ্ছুক সবাই যেন সক্রিয়ভাবে এই যাত্রায় অংশ নিতে পারে, সেদিকটা খেয়াল রাখতে হবে। এই সূত্রে আবারও যুদ্ধদিনের কথা স্মরণ করিয়ে দেব। একাত্তরের সেই মুক্তিযুদ্ধের দিনে কেবল আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ নয়, সব দেশপ্রেমিকের জন্য দেশের কাজ করার সুযোগ তৈরি হয়েছিল। আর তাই সেদিন মুষ্টিমেয় রাজাকার-আলবদর ব্যতীত দেশের বাকি সব মানুষ কোনো না কোনোভাবে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছিল। সেদিন বাঙালি সব ক্ষুদ্রতা, ব্যক্তিস্বার্থ, হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে মহৎ আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এক ও বড় হয়ে উঠেছিল। ত্যাগ করেছিল নিঃস্বার্থভাবে। তাতেই আমরা স্বাধীনতার মতো এত বড় সাফল্যের অধিকারী হয়েছি।
আজও ঠিক একাত্তরের মতো বিপথগামী জাতি ও ভ্রষ্ট দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে তোলার কঠিন সংগ্রামে আমরা লিপ্ত। এ কাজ মুক্তিযুদ্ধের চেয়েও কঠিন ও বড়।
তাই নেতৃত্বের কাছে অনুরোধ, দেশ গড়ার মহান কর্মযজ্ঞটি স্পষ্ট করুন, সবাইকে এতে শরিক হওয়ার সুযোগ দিন। নিজেরা সংকীর্ণতা ও ক্ষুদ্রতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারলে মাঠপর্যায়েও ক্ষুদ্রতার বিকার ক্রমে বন্ধ হবে। একাত্তরে যদি আমরা পেরে থাকি, একবিংশ শতাব্দীতে কেন পারব না?
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী নেতা ছিলেন, সম্ভবত প্রথমে ভেবেছিলেন, তিনি মাঠে নেমে হাঁকডাক দিয়ে সব ঠিক করে ফেলতে পারবেন। কিন্তু যে যুদ্ধ সমগ্র দেশ ও দেশবাসীকে নানা মাত্রায় নানাভাবে জড়িয়ে ফেলেছিল, তা মুক্তিযুদ্ধ হলেও তার গতিপথ সবার জন্য একই রকম হওয়ার কথা নয়। তাই অভাবনীয় ধ্বংস ও বিপর্যয়ের অভিজ্ঞতা স্বাভাবিক শৃঙ্খলাবোধ, এমনকি অনেকের ভেতরকার নীতিনৈতিকতার বোধও ভেঙে দিয়েছিল। আমরা দেখলাম, দেশের নামে স্বাধীনতার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগের জন্য প্রস্তুত ছিল যারা, তাদের মধ্যে অনেকেই ক্ষুদ্র স্বার্থ ও বেপরোয়া লোভের ফাঁদে পা দিয়ে স্বাভাবিক ন্যায়বোধ হারিয়ে বসেছিল। দেশে একটা অস্থিরতা এবং তা থেকে অনিশ্চয়তার বাস্তবতা তৈরি হয়েছিল।
আমরা লক্ষ করলে দেখব, উদার দৃঢ়চেতা ও সিংহহূদয়ের বঙ্গবন্ধু ক্রমেই কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠছেন—বিশেষ ক্ষমতা আইন, রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি এবং অবশেষে বাকশাল-ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে এই পরিবর্তন প্রকটভাবে ধরা পড়েছে। তিনি কখনো বিরুদ্ধতাকারী ও বিশৃঙ্খলাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর হচ্ছেন, আবার কখনো তাঁর অসহায়তার প্রকাশও ঘটছে। সিরাজ শিকদারের বন্দিত্ব ও মৃত্যু কিংবা লালঘোড়া দাবড়ানোর হুঁশিয়ারি তাঁর কঠোর অবস্থানকে প্রকাশ করে, আবার যখন নিকটজনদের কাছে আক্ষেপ করে বলেন, ‘সব চাটার দল খেয়ে নিল’, তখন শাসক হিসেবে তাঁর অসহায়তা আর ঢাকা থাকে না।
কঠোরতা বা কর্তৃত্বপরায়ণতার পথে শেষরক্ষা হয় না। ষড়যন্ত্রকারীরা প্রত্যাঘাত করার সুযোগ পেয়ে যায়। তাতে দেশের জন্য কোনো ভালো ফল আসে না। বাংলাদেশ তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।
একদিকে বহু খেসারত, চরম নির্যাতন, দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকার এই অভিজ্ঞতা এবং অন্যদিকে বিপুল জনসমর্থন ও বিশাল জয়, দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী-তরুণসমাজ-আমলাতন্ত্রের সমর্থন সত্ত্বেও আবারও একশ্রেণীর দলীয় নেতা-কর্মীর বাড়াবাড়ির মাধ্যমে দেশে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার আলামত শুরু হয়েছে। তাই বলছিলাম, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের কথা মনে পড়ছে।
আমলাতন্ত্র যথারীতি দুর্নীতিগ্রস্ত আছে, হয়তো ষড়যন্ত্র হলে তাতেও অনেকেই যুক্ত হবে। মূল বিরোধী দল বিশাল পরাজয়ের ধাক্কা সামলে উঠতে না পারলেও সরকারি দলের অস্থির বেপরোয়া অংশ ধীরে ধীরে তাদের হাতে ইস্যু তুলে দিচ্ছে রাজপথে আন্দোলনে নামার জন্য। ফলে সাধারণ মানুষের মনে ২০০৯ যে রঙিন স্বপ্ন ও আশাবাদ নিয়ে শুরু হয়েছিল, দেড় বছরের মাথায় তা অনেকটা ফিকে হয়ে গেছে এবং আশঙ্কার মেঘ ঈশান কোণে জমতে শুরু করেছে। এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে একে বিশ্লেষণ করে বোঝা দরকার।
এ কথা ঠিক, বিএনপি একজন ক্ষমতাপ্রাপ্ত ও ক্রমে ক্ষমতাপাগল হয়ে ওঠা জেনারেলের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য সৃষ্ট দল। এটি একদিকে আওয়ামী লীগবিরোধীদের আর অন্যদিকে জিয়া ও খালেদার ক্যারিশমায় তৈরি রাজনৈতিক মঞ্চ হয়ে ওঠে। এটি আজও ঠিক রাজনৈতিক দল হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে এবারের বিশাল পরাজয়ের ফলে বিএনপির অবস্থা ’৫৪-র নির্বাচনে ভরাডুবির পর তার পূর্বসূরি মুসলিম লীগের যেমনটা হয়েছিল, সে রকমই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কিন্তু আওয়ামী লীগ তাকে লাইফলাইন দিয়ে চলেছে, দলের একশ্রেণীর নেতা-কর্মী মূলত ক্ষমতা-বিত্তের লড়াইয়ে নেমে একের পর এক বেআইনি কাণ্ড বাধিয়ে বসলে এই পরিণতিই স্বাভাবিক। তবে আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্ব ঘটনাগুলোর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে অসচেতন এ কথা বলা যাবে না। প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভানেত্রী, মন্ত্রী ও দলের সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় নেতা ও অনেক মন্ত্রী জোরালো ভাষায় এসব ঘটনার নিন্দা জানাচ্ছেন এবং নিরপেক্ষভাবে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলছেন। এ রকম আশ্বাস ও অঙ্গীকার তাঁরা গোড়া থেকেই দিয়ে এলেও তাতে কাজ হচ্ছে না। বরং দিনে দিনে ঘটনা বাড়ছে এবং ঘটনার বহর ও ভয়াবহতার মাত্রাও বেড়ে চলেছে। বোঝা যায়, নেতৃত্ব সদিচ্ছা প্রকাশ করলেও তা সত্যিই বাস্তবায়নে হাত দেওয়ার ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত। তাঁরা হয়তো ভাবছেন, ধমক-ধামক দিয়ে, কিছু মামলার ভয় দেখিয়ে, দল থেকে বহিষ্কার করে বা জেল খাটিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে। ব্যাপারটা সম্ভবত সে রকম নয়। এর কারণটা প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতার কথায়ই প্রকাশ পেয়েছে। তাঁরা কেউ অভিযোগ করেছেন, কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে আওয়ামী লীগ ও তার বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনে, বিশেষত ছাত্রলীগে, জামায়াত-শিবির-ছাত্রদলসহ অন্যান্য বিরোধী ছোট নেতা ও সাধারণ কর্মীরা ঢুকে পড়েছেন। অভিযোগ হোক, আশঙ্কা হোক, তা সত্য হওয়াই স্বাভাবিক বলে মনে হয়, এমনটা আমরা ঘটতে দেখেছি স্বাধীনতার পরেও। ক্ষমতাবদলের সঙ্গে সঙ্গে দলবদলের ঘটনা তো দেশে আকসার ঘটেই। তা ছাড়া আওয়ামী লীগ তো এবার আদর্শের লড়াইয়ে নেমেছে, যুদ্ধাপরাধী অর্থাৎ জামায়াত ও তার সহযোগীরা সত্যিই এবার কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এদের জন্য তাঁর ব্যাকুলতা এবং সরকারের প্রতি এ কারণে রাগ-ক্ষোভ প্রকাশে কুণ্ঠিত হচ্ছেন না।
আদর্শিক লড়াই সব সময় সর্বাত্মক হয়—তাতে সাধারণত সব পক্ষই সব শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। জামায়াত আপাতদৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ ও অপেক্ষার নীতি নিয়েছে বলে মনে হয়। তবে ধরে নেওয়া যায় যে তারা পাল্টা আঘাতের কিংবা এ অবস্থা বানচাল করার জন্য সব কৌশল অবলম্বন করবেই। বিএনপি দৃশ্যত তাদের সঙ্গে গাঁটছড়া না বাঁধলেও মাঠে তাদেরই এজেন্ডা পূরণে সক্রিয় থাকবে। এর অর্থ হলো নানা অঘটনের মধ্য দিয়ে তারা একদিকে সরকারের প্রতি জনসমর্থন কমাতে চাইবে, অন্যদিকে জনগণের মধ্যে এসব ঘটনার শিকার একটি সংক্ষুব্ধ অংশ তৈরি করে তোলার চেষ্টা করবে।
মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি আদর্শিক লড়াই। কিন্তু বিজয়ের পর থেকে আওয়ামী লীগের একটি অংশ সে কথা ভুলে আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ ও লাভের পেছনে ছুটে সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছিল। এবারের নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গকে সামনে নিয়ে এসে একটি আদর্শিক লড়াইয়ের পটভূমি তৈরি করেছিল। এখানে স্বীকার করতে হবে, এই আদর্শিক অবস্থানের কারণেই কিন্তু দেশের তরুণসমাজ অনেক দিন পরে আওয়ামী লীগের পক্ষে স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করেছিল। যার ফলে মহাজোট বিপুল বিজয় অর্জন করেছিল। ফলে এই বিজয়কে মানতে হলে এখন আওয়ামী লীগকে আদর্শিক লড়াইটি চালিয়ে যেতে হবে। আর তার অর্থ হলো, আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়ে যারা টেন্ডারবাজি, দখলদারিসহ নানা বেপরোয়া বেআইনি কাজে লিপ্ত হচ্ছে, তাদের নিয়ন্ত্রণে সরকার ও দলকে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার ব্যাপারটা কিন্তু সংক্রামক, যদি দেখা যায় পাবনা ও নাটোরের ঘটনায়, ইব্রাহিম ও সানাউল্লাহ হত্যার ঘটনায় সরকারের গৃহীত ব্যবস্থা স্পষ্টভাবে আইনানুগ নয় বা আইন অবাধে নিজস্ব গতিতে চলছে না, কিংবা যদি বোঝা যায় যে মনকে চোখ ঠেরে বুঝ দেওয়ার চেষ্টা চলছে, তাহলে অপরাধীরা আশকারা পায়। তাতে অপরাধ বেড়েই চলবে। এভাবে চললে একসময় সরকারের পক্ষে পরিস্থিতি সামলানো হবে মুশকিল। এমনিতে দারিদ্র্যের চাপ, এমনিতে বঞ্চনার ক্ষত, তার ওপর আছে দ্রব্যমূল্য আর ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের দৌরাত্ম্য—মানুষের ধৈর্য বেশি দিন বাঁধ মানবে বলে মনে হয় না।
আমার বিশ্বাস, এই অনিয়ন্ত্রিত বেপরোয়া বাহিনীকে সামলানো খুব যে কঠিন তা নয়। কেবল সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে সরকার ও দলের নেতৃত্বকে বোঝাতে হবে যে তাঁরা মূলত একটি আদর্শিক লড়াইয়ে আছেন। এটা বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার ব্রত হিসেবেই তাঁরা গ্রহণ করেছেন। এরই অংশ হিসেবে বিচার বিভাগকে প্রশাসন থেকে পৃথক করা, পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল করা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করা, নতুন যুগোপযোগী একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশের অঙ্গীকার, রূপকল্প ২০২১ ঘোষণা ইত্যাদি সরকারের যাত্রাপথ স্পষ্ট করে দেয়। সেই সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিচার বিভাগ থেকেও এসেছে কয়েকটি যুগান্তকারী রায়, এমনকি প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন ভাষণে কখনো শিল্পে দেশীয় ভাষা প্রয়োগের কথা বলে, কখনো শিশুদের ওপর মুখস্থবিদ্যার বোঝা না চাপানোর কথা বলে একটি আধুনিক মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন আমাদের। এটিই যে বাংলাদেশের সঠিক যাত্রাপথ, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এই স্বপ্ন ও সম্ভাবনাকে যেন চাটার দল ও ষড়যন্ত্রীর দল নষ্ট করতে না পারে, সে ব্যাপারে হুঁশিয়ার হতে হবে সরকারকে এবং ক্ষমতাসীন দল ও জোটকে।
এই যে বাংলাদেশের একটি যাত্রাপথ স্পষ্ট হয়ে উঠছে, তাতে সবাইকে শরিক হওয়ার আহ্বান জানাতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, ইচ্ছুক সবাই যেন সক্রিয়ভাবে এই যাত্রায় অংশ নিতে পারে, সেদিকটা খেয়াল রাখতে হবে। এই সূত্রে আবারও যুদ্ধদিনের কথা স্মরণ করিয়ে দেব। একাত্তরের সেই মুক্তিযুদ্ধের দিনে কেবল আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ নয়, সব দেশপ্রেমিকের জন্য দেশের কাজ করার সুযোগ তৈরি হয়েছিল। আর তাই সেদিন মুষ্টিমেয় রাজাকার-আলবদর ব্যতীত দেশের বাকি সব মানুষ কোনো না কোনোভাবে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছিল। সেদিন বাঙালি সব ক্ষুদ্রতা, ব্যক্তিস্বার্থ, হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে মহৎ আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এক ও বড় হয়ে উঠেছিল। ত্যাগ করেছিল নিঃস্বার্থভাবে। তাতেই আমরা স্বাধীনতার মতো এত বড় সাফল্যের অধিকারী হয়েছি।
আজও ঠিক একাত্তরের মতো বিপথগামী জাতি ও ভ্রষ্ট দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে তোলার কঠিন সংগ্রামে আমরা লিপ্ত। এ কাজ মুক্তিযুদ্ধের চেয়েও কঠিন ও বড়।
তাই নেতৃত্বের কাছে অনুরোধ, দেশ গড়ার মহান কর্মযজ্ঞটি স্পষ্ট করুন, সবাইকে এতে শরিক হওয়ার সুযোগ দিন। নিজেরা সংকীর্ণতা ও ক্ষুদ্রতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারলে মাঠপর্যায়েও ক্ষুদ্রতার বিকার ক্রমে বন্ধ হবে। একাত্তরে যদি আমরা পেরে থাকি, একবিংশ শতাব্দীতে কেন পারব না?
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments