অবমাননা, দুর্ভোগ আর দায়মুক্তি: সাংবিধানিক গণতন্ত্র হিসেবে ভারতের সামনে প্রশ্ন by কল্পনা কন্নাবিরান
গত
৫ আগস্ট ভারত সরকার সংবিধানে থাকা জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল
করে একে দুটি কেন্দ্র-শাসিত অঞ্চলে পরিণত করেছে। এই নির্দেশ যখন জারি করা
হয় তখন রাজ্যটি ছিল রাষ্ট্রপতির শাসনে, কোনো নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় ছিল
না।
সিনিয়র সংবিধান বিশেষজ্ঞ এ জি নূরানি এই পদক্ষেপকে চরম ও সুস্পষ্টভাবে সংবিধানের পরিপন্থী হিসেবে অভিহিত করে তা বাতিল করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
অন্যান্য আইন বিশেষজ্ঞরাও একই ধরনের অভিমত ব্যক্ত করছেন।
আমাদের সামষ্টিক মননে যেটা উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে তা হলো ক্ষমতাসীন শিবিরে আতঙ্কজনক উল্লাস এবং এই পদক্ষেপের ফলে সংশ্লিষ্ট লোকজনের দুর্ভোগ সম্পর্কে উদাসিন থাকা। তারা বিন্দুমাত্র অপেক্ষা না করেই কাশ্মীরে বিনিয়োগ সম্মেলন আয়োজনের কথা ঘোষণা করেছে, সেখানে করপোরেট হানার কথা জানিয়েছে। প্রতিবেশগত সমৃদ্ধ ওই অঞ্চলের মানুষের কথা বিবেচনায় না এনেই সেখানে অন্যান্য এলাকার মতো পরিবেশ গড়ে তোলা হবে, রাজনৈতিক ধান্দাবাজেরা কাশ্মীরী মেয়েদের শিকার করার জন্য পাগল হয়ে ওঠেছে, মনে হচ্ছে যে হাত বাড়ালেই তারা তা পেয়ে যাবে। বলিউডও সিনেমার মাধ্যমে কাশ্মীর জয় সুসংহত করার জন্য উঠে পড়ে লাগার কথা ঘোষণা করেছে। নির্লজ্জ দায়বদ্ধতার এমন অবস্থা আর কখনো দেখা যায়নি।
সংবিধান অগ্রাহ্য
কাশ্মীরের বাইরে বিজেপি সরকার জোরালোভাবে বলে আসছে যে এসব করা হয়েছে কাশ্মীরের কল্যাণের জন্য। জম্মু ও কাশ্মীরের গভর্নর সাংবিধানিক পদে থেকেও রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তিনি সংবিধান সমুন্নত রাখার তার শপথের কথা ভুলেই গেছেন। সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ সংবিধানকে যেভাবে অগ্রাহ্য করে আসছে, তা ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে।
অবশ্য এটাও ঠিক গত ৭০ বছর ধরে কাশ্মীরের স্বায়ত্বশাসন নস্যাৎ করা হয়েছে। আগের কংগ্রেস করাও মহান কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেনি। কিন্তু বিজেপি সরকার যেভাবে সংবিধান অবমাননার কাজটি করেছে তা নজিরবিহীন।
ঘোষণাটি দেয়ার পর ১৫ দিন অতিবাহিত হলেও কাশ্মীরী জনগণ বাইরের দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। এমনকি তাদের পরিবার সদস্যদের সাথেও কথা বলতে পারেনি। কাশ্মীরের অন্যতম শ্রদ্ধাভাজন সাংবাদিক অনুরাধা ভাসিন সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে মিডিয়ার স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিয়ে উপত্যকার পরিস্থিতির খবর পরিবেশনের স্বাধীনতা চেয়েছেন।
নৃশংস বিধিনিষেধ
যোগাযোগব্যবস্থা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়া, সশস্ত্র বাহিনীর পেলেট বর্ষণ ও অন্যান্য হামলার খবর প্রকাশে বিধিনিষেধ, চিকিৎসার জন্য আসাদের হাসপাতালের রেকর্ড রাখা, সাধারণ নাগরিকদের চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ ইত্যাদি বিষয় সুরাহা করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হলেও কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি। সুপ্রিম কোর্ট ‘স্বাভাবিক’ অবস্থা ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেছে।
উপত্যকায় কোন ধরনের ‘স্বাভাবিক’ অবস্থা ফিরে আসবে? আর স্বাভাবিক অবস্থা ফেরাটা নির্ধারণ করবে কে? কাশ্মীরে যে অবস্থা বিরাজ করছে, তা পুরো ভারতীয় জাতির জন্য লজ্জাজনক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যেখানে দখলদারিত্ব জনসাধরণের মনে গভীর কষ্ট আর যন্ত্রণার সৃষ্টি করছে, যেখানে সেনাবাহিনীর নজরদারি ভয়াবহ মাত্রায় বেড়ে গেছে, সেখানে কোন স্বাভাবিক অবস্থার কথা আমরা বলতে পারি?
কতটা ক্ষতি হয়েছে তা আমরা কিভাবে নিশ্চিত হবো? প্রাণহানির তথ্য আমরা কি স্বাধীন মিডিয়ার কাছ থেকে পাব না সরকারি স্বার্থ পূরণ করে এমন তথ্য থেকেই আমরা সন্তুষ্ট থাকব? আম্বানি আর বলিউডের কাশ্মীরে ফেরাই কি স্বাভাবিক পরিস্থিতির প্রত্যাবর্তন বলে স্বীকৃত হবে?
রাষ্ট্রীয় দায়মুক্তি প্রতিরোধ
আর দায়মু্ক্তি? মাত্র দুই বছরেরও আগে সুপ্রিম কোর্ট নজরদারির বিরুদ্ধে নাগরিক অধিকার, স্বায়ত্বশাসনের অধিকার, মর্যাদার অধিকার, মুক্ত থাকার অধিকারের কথা বলেছে। সংখ্যালঘুদের নিয়ে আদালত এডিএম জবালপুর মামলার রায়ও সমুন্নত রেখেছে।
কিন্তু কাশ্মীরী বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মীরা বারবার বলে আসছেন, কাশ্মীরে এসব অধিকার প্রতিনিয়ত লঙ্ঘিত হচ্ছে। আর এখন যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তাতে আরো খারাপ অবস্থাটিই স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে আমাদের সবার সামনে যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা হলো কাশ্মীরীদের জন্য জায়গা করে দেয়া। নয়তো আমরা ভুলে যাব যে আজকের ভারতে কাশ্মীরেই ন্যায়বিচারের অর্থ নিয়ে কোনো ভাবনাচিন্তার অবকাশ রয়েছে।
>>>লেখক: সমাজতত্ত্ববিদ ও মানবাধিকার কলামনিস্ট
সিনিয়র সংবিধান বিশেষজ্ঞ এ জি নূরানি এই পদক্ষেপকে চরম ও সুস্পষ্টভাবে সংবিধানের পরিপন্থী হিসেবে অভিহিত করে তা বাতিল করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
অন্যান্য আইন বিশেষজ্ঞরাও একই ধরনের অভিমত ব্যক্ত করছেন।
আমাদের সামষ্টিক মননে যেটা উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে তা হলো ক্ষমতাসীন শিবিরে আতঙ্কজনক উল্লাস এবং এই পদক্ষেপের ফলে সংশ্লিষ্ট লোকজনের দুর্ভোগ সম্পর্কে উদাসিন থাকা। তারা বিন্দুমাত্র অপেক্ষা না করেই কাশ্মীরে বিনিয়োগ সম্মেলন আয়োজনের কথা ঘোষণা করেছে, সেখানে করপোরেট হানার কথা জানিয়েছে। প্রতিবেশগত সমৃদ্ধ ওই অঞ্চলের মানুষের কথা বিবেচনায় না এনেই সেখানে অন্যান্য এলাকার মতো পরিবেশ গড়ে তোলা হবে, রাজনৈতিক ধান্দাবাজেরা কাশ্মীরী মেয়েদের শিকার করার জন্য পাগল হয়ে ওঠেছে, মনে হচ্ছে যে হাত বাড়ালেই তারা তা পেয়ে যাবে। বলিউডও সিনেমার মাধ্যমে কাশ্মীর জয় সুসংহত করার জন্য উঠে পড়ে লাগার কথা ঘোষণা করেছে। নির্লজ্জ দায়বদ্ধতার এমন অবস্থা আর কখনো দেখা যায়নি।
সংবিধান অগ্রাহ্য
কাশ্মীরের বাইরে বিজেপি সরকার জোরালোভাবে বলে আসছে যে এসব করা হয়েছে কাশ্মীরের কল্যাণের জন্য। জম্মু ও কাশ্মীরের গভর্নর সাংবিধানিক পদে থেকেও রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তিনি সংবিধান সমুন্নত রাখার তার শপথের কথা ভুলেই গেছেন। সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ সংবিধানকে যেভাবে অগ্রাহ্য করে আসছে, তা ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে।
অবশ্য এটাও ঠিক গত ৭০ বছর ধরে কাশ্মীরের স্বায়ত্বশাসন নস্যাৎ করা হয়েছে। আগের কংগ্রেস করাও মহান কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেনি। কিন্তু বিজেপি সরকার যেভাবে সংবিধান অবমাননার কাজটি করেছে তা নজিরবিহীন।
ঘোষণাটি দেয়ার পর ১৫ দিন অতিবাহিত হলেও কাশ্মীরী জনগণ বাইরের দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। এমনকি তাদের পরিবার সদস্যদের সাথেও কথা বলতে পারেনি। কাশ্মীরের অন্যতম শ্রদ্ধাভাজন সাংবাদিক অনুরাধা ভাসিন সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে মিডিয়ার স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিয়ে উপত্যকার পরিস্থিতির খবর পরিবেশনের স্বাধীনতা চেয়েছেন।
নৃশংস বিধিনিষেধ
যোগাযোগব্যবস্থা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়া, সশস্ত্র বাহিনীর পেলেট বর্ষণ ও অন্যান্য হামলার খবর প্রকাশে বিধিনিষেধ, চিকিৎসার জন্য আসাদের হাসপাতালের রেকর্ড রাখা, সাধারণ নাগরিকদের চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ ইত্যাদি বিষয় সুরাহা করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হলেও কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি। সুপ্রিম কোর্ট ‘স্বাভাবিক’ অবস্থা ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেছে।
উপত্যকায় কোন ধরনের ‘স্বাভাবিক’ অবস্থা ফিরে আসবে? আর স্বাভাবিক অবস্থা ফেরাটা নির্ধারণ করবে কে? কাশ্মীরে যে অবস্থা বিরাজ করছে, তা পুরো ভারতীয় জাতির জন্য লজ্জাজনক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যেখানে দখলদারিত্ব জনসাধরণের মনে গভীর কষ্ট আর যন্ত্রণার সৃষ্টি করছে, যেখানে সেনাবাহিনীর নজরদারি ভয়াবহ মাত্রায় বেড়ে গেছে, সেখানে কোন স্বাভাবিক অবস্থার কথা আমরা বলতে পারি?
কতটা ক্ষতি হয়েছে তা আমরা কিভাবে নিশ্চিত হবো? প্রাণহানির তথ্য আমরা কি স্বাধীন মিডিয়ার কাছ থেকে পাব না সরকারি স্বার্থ পূরণ করে এমন তথ্য থেকেই আমরা সন্তুষ্ট থাকব? আম্বানি আর বলিউডের কাশ্মীরে ফেরাই কি স্বাভাবিক পরিস্থিতির প্রত্যাবর্তন বলে স্বীকৃত হবে?
রাষ্ট্রীয় দায়মুক্তি প্রতিরোধ
আর দায়মু্ক্তি? মাত্র দুই বছরেরও আগে সুপ্রিম কোর্ট নজরদারির বিরুদ্ধে নাগরিক অধিকার, স্বায়ত্বশাসনের অধিকার, মর্যাদার অধিকার, মুক্ত থাকার অধিকারের কথা বলেছে। সংখ্যালঘুদের নিয়ে আদালত এডিএম জবালপুর মামলার রায়ও সমুন্নত রেখেছে।
কিন্তু কাশ্মীরী বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মীরা বারবার বলে আসছেন, কাশ্মীরে এসব অধিকার প্রতিনিয়ত লঙ্ঘিত হচ্ছে। আর এখন যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তাতে আরো খারাপ অবস্থাটিই স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে আমাদের সবার সামনে যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা হলো কাশ্মীরীদের জন্য জায়গা করে দেয়া। নয়তো আমরা ভুলে যাব যে আজকের ভারতে কাশ্মীরেই ন্যায়বিচারের অর্থ নিয়ে কোনো ভাবনাচিন্তার অবকাশ রয়েছে।
>>>লেখক: সমাজতত্ত্ববিদ ও মানবাধিকার কলামনিস্ট
No comments