ডেঙ্গু মোকাবিলায় শুরুতে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের শরণাপন্ন হই -সাক্ষাৎকারে সাদেক হোসেন খোকা
অবিভক্ত
ঢাকার সর্বশেষ মেয়র সাদেক হোসেন খোকা মনে করেন সরকারি সংস্থাগুলোর
সমন্বয়হীনতা এবং যথোপযুক্ত সামাজিক সম্পৃক্ততার অভাবের কারণেই দেশের
বর্তমান ডেঙ্গু পরিস্থিতি এতটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। অতীতে ডেঙ্গু
মোকাবিলায় নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, মেয়র হিসেবে
দায়িত্ব নেয়ার মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা
দিয়েছিল। অনেকটা দিশাহারা পরিস্থিতিতে তখন নগরীর গণ্যমান্য ও জনপ্রিয়
ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা কার্যক্রম শুরু করেছিলাম। সেইসঙ্গে
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে করপোরেশনের
নিবিড় সমন্বয়ের মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু এবারের
ভয়াবহ ডেঙ্গু-পরিস্থিতিতে তেমন কোনো সমন্বয় ও সামাজিক সম্পৃক্ততা লক্ষ্য
করা যাচ্ছে না।
ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য দীর্ঘদিন ধরে নিউ ইয়র্কে অবস্থানরত সাবেক এই মেয়র মানবজমিনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে আরো বলেন, করপোরেশনের অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে ডেঙ্গু মোকাবিলায় যদি আগেভাগেই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া থাকতো তাহলে হয়তো বর্তমানের বিপর্যয়কর পরিস্থিতির কবলে পড়তে হতো না।
তিনি বলেন, ২০০২ সালে আমি মেয়রের দায়িত্বে ঠিকমতো বসতে না বসতেই ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ দেখা দেয়। এ বিষয়ে আমার তেমন কোনো ধারণাই ছিল না।
খোঁজ নিতে গিয়ে দেখলাম যে, স্টোরে মশা মারার কোনো ওষুধই নেই। ওষুধ কিনতে গিয়ে দেখি তহবিলে কোনো টাকা নেই। এমনকি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার মতো টাকাও ছিল না। ওই পরিস্থিতিতে রীতিমতো দিশাহারা হয়ে পড়লাম। তখনই জানতে পারি, মশার প্রজনন প্রতিরোধে জনসচেতনতা সৃষ্টির বিষয়ে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ সাহেবের অতীত অভিজ্ঞতা আছে।
দ্রুত তাঁর শরণাপন্ন হলাম। তাঁর কাছেই জানতে পারি, ডেঙ্গুর ভাইরাসবাহী এডিস মশা পরিষ্কার পানিতে ডিম দেয় এবং এই মশা দিনের আলোতেই মানুষের শরীরে কামড় দেয়। আবু সায়ীদ সাহেবের সঙ্গে কথা বলার পর আমি এ বিষয়ে একের পর এক আরো অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিকে অনুরোধ জানাই আমাদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য। তাতে সাড়া দিয়ে প্রখ্যাত শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ প্রয়াত ডা. এম আর খান, টিআইবির তৎকালীন চেয়ারম্যান প্রফেসর মোজাফফর আহমদ, বুদ্ধিজীবী সৈয়দ আবুল মকসুদ, সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলাম, স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন, লেখক ইমদাদুল হক মিলন, চলচ্চিত্র অভিনেত্রী কবরী, চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন, বিটিভির সাবেক পরিচালক রফিকুল ইসলাম সরকার, সিপিবি নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স, পরিবেশ আন্দোলনের নেতা আবু নাসের এবং সিভিল সোসাইটির আরো অনেকেই দারুণ আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসেন। তাঁদের মিলিত হওয়ার জন্য নগরভবনেই একটি বড় কক্ষ বরাদ্দ করা হয়। তাঁরা নিয়মিত সেখানে বসে পরিস্থিতি পর্যালোচনার পর সেই মোতাবেক করণীয় ঠিক করতেন। তাঁদের দিক-নির্দেশনায়ই সিটি করপোরেশন মশা নিধন ও ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে থাকে।
সাদেক হোসেন খোকা বলেন, সেই বছর এডিস মশার বংশবিস্তার রোধে এসব বিশিষ্ট ব্যক্তি বিভিন্ন গ্রুপে বিভিক্ত হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চলে জনসচেতনতা সৃষ্টির কাজে নেমে পড়েছিলেন। তাতে নগরবাসীর তরফ থেকেও অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া যায়। কারণ তাঁদের সেই তৎপরতা লোক দেখানো বা টিভি ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর উদ্দেশ্য ছিল না। অবশ্য তখন এত বেশি টিভি চ্যানেলও ছিল না। সবাই আন্তরিকতা নিয়ে সত্যিকার জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্যই এগিয়ে এসেছিলেন।
তিনি বলেন, হাতিরঝিল এলাকা ছিল মশার বড় প্রজনন ক্ষেত্র। চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনকে নিয়ে একদিন ওই এলাকায় গেলে তাকে দেখার জন্য হাজার হাজার মানুষ ভেঙ্গে পড়ে। তখন তিনি হ্যান্ডমাইকে বক্তৃতা দিয়ে সেসব মানুষকে মশার প্রজননরোধে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান। দেখা গেল একদিনের মধ্যেই পুরো এলাকা পরিষ্কার হয়ে গেছে। ইলিয়াস কাঞ্চন এমনকি তাঁর সিনেমার শ্যুটিং-শিডিউল পরিবর্তন করেও আমাদের কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছিলেন। ইমদাদুল হক মিলনকে ফোন করে যখন এই কাজে যুক্ত হওয়ার অনুরোধ জানালাম, জবাবে তিনি বললেন, এই প্রথম কোনো মেয়রের ফোন পেলাম। আমি অবশ্যই থাকবো। এরপর তিনি রীতিমতো পূর্ণকালীন আমাদের সঙ্গে থেকে দিনের পর দিন জনসচেতনতা সৃষ্টির কাজে ভূমিকা রেখেছেন।
সাবেক মেয়র বলেন, সেই বছর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীদের ওপর খোঁজ-খবর নিয়ে দেখা গেল, কাঁঠালবাগান, কলাবাগান, ধানমন্ডি ও মোহাম্মদপুর এলাকায় এই রোগের প্রকোপ বেশি। তখন কমিশনার আব্দুল লতিফের তত্ত্বাবধানে এই অঞ্চলে বিশেষ পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করা হয় এবং আমি নিজে তাতে অংশগ্রহণ করি। একদিন সেই অভিযানের অংশ হিসেবে কলাবাগান এলাকায় গেলে স্থানীয় লোকজন আমাকে একটি বাড়ি দেখিয়ে বললো, আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুস সামাদ আজাদ এই বাড়িতে থাকেন। তখন আমি সেই বাড়িতে গিয়ে সামাদ আজাদ সাহেবের সঙ্গে দেখা করি এবং তাঁকেও অনুরোধ জানাই আমাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য। তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেদিন আমাদের সঙ্গে পুরো এলাকা ঘুরে ঘুরে মানুষকে এডিস মশার ব্যাপারে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
খোকা বলেন, তখন সিটি করপোরেশনের ৯০ জন কমিশনারের মধ্যে ৩৩ জন ছিলেন আওয়ামী লীগের। আমি তাদের সবাইকে সমভাবে গুরুত্ব দিয়ে এই কাজে যুক্ত করি এবং তারা প্রত্যেকেই সমান উৎসাহে জনসচেতনতা সৃষ্টির কাজে যুক্ত হন। আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ সাহেব তাঁর বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের কর্মীদেরও এই কাজে যুক্ত করেন। তারা নগরীর বিভিন্ন পার্কে গিয়ে বড় বড় গাছের কোটরে জমে থাকা পানি অপসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
একইসঙ্গে বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে জরুরিভিত্তিতে এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করি। প্রয়াত বরেণ্য সাংবাদিক এবিএম মূসা, মাহফুজ আনাম, রিয়াজউদ্দিন আহমদ, প্রয়াত আমানউল্লাহ কবীর, মতিউর রহমান চৌধুরীসহ সংবাদপত্রসমূহের অধিকাংশ সম্পাদক এবং বিপুলসংখ্যক সিনিয়র সাংবাদিক সাড়া দেন আমার অনুরোধে। তাঁদের সামনে পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেন অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ। পরে তাঁদের অনেকেই ডেঙ্গু সচেতনতা বিষয়ক করপোরেশনের বিজ্ঞাপন বিনামূল্যে ছেপে দেন। এছাড়া জনসচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডের খবর গুরুত্ব দিয়ে নিয়মিত প্রকাশ করেছিল প্রায় সকল সংবাদমাধ্যম।
অন্যদিকে, মেয়র হিসেবে আমি নিজে তৎকালীন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতে থাকি। মান্নান ভূঁইয়া সাহেব আমাকে সর্বাত্মক সহায়তা দিয়েছিলেন দ্রুত মশার ওষুধ যোগাড়ের কাজে। আর স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিয়মিত আমাদের সঙ্গে যোগ দিতেন জনসচেতনতা সৃষ্টির কাজে। তাঁর নির্দেশে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা ও নেতৃস্থানীয় চিকিৎসকরাও যুক্ত হন এই তৎপরতায়। নিজের অতীতের ক্রীড়া সংগঠক এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনের সুবাদে নগরীর বিভিন্ন ক্লাব ও সংগঠনের সঙ্গে যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল সেটাকেও কাজে লাগাই জনসচেতনতা সৃষ্টিতে। তবে পরিস্থিতির আরো অবনতির আশঙ্কা মাথায় রেখে আকাশ থেকে মশার ওষুধ ছিটানো বা এরিয়াল স্প্রে করার জন্য প্রায় ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে প্রয়োজনীয় ইক্যুইপমেন্ট সংযোজন করা হয়। কিন্তু ওই পর্যায়ে উবীনিগ-এর ফরহাদ মযহার সাহেবসহ আরো অনেক পরিবেশবাদী এরিয়াল স্প্রের ব্যাপারে আপত্তি জানান। তখন তাদের আমরা বলি, এখনই এরিয়াল স্প্রে করা হবে না। তবে পরিস্থিতি যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার উপক্রম হয় তখনই শেষ ব্যবস্থা হিসেবে এটা করার প্রস্তুতি নিয়ে রাখছি।
টানা সাড়ে ৯ বছর মেয়রের দায়িত্ব পালনকারী খোকা বলেন, সেই বছর করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের দুই চিকিৎসকের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে একটা সমস্যায় পড়ে যাই। তাদের এই দ্বন্দ্বের জেরে আদালতে একটি মামলা থাকার কারণে প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা পদে কাউকে নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছিল না। ফলে মশকনিধন ও জনসচেতনতা সৃষ্টির সামগ্রিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় ব্যাঘাত ঘটছিল। কারণ, এসব কর্মকাণ্ড স্বাস্থ্য বিভাগের অধীনেই হয়ে থাকে। ওই পরিস্থিতিতে আমি উদ্যোগ নিয়ে সেনাবাহিনীর কর্নেল র্যাঙ্কের একজন চিকিৎসককে ডিসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা পদে নিয়ে আসি। আজও পর্যন্ত সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা পদে সেনাবাহিনীর চিকিৎসকরাই দায়িত্ব পালন করছেন।
সবমিলিয়ে দলমত নির্বিশেষে এক সমন্বিত প্রচেষ্টার বদৌলতেই সেই বছর কার্যকরভাবে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলা সম্ভব হয়েছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য দীর্ঘদিন ধরে নিউ ইয়র্কে অবস্থানরত সাবেক এই মেয়র মানবজমিনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে আরো বলেন, করপোরেশনের অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে ডেঙ্গু মোকাবিলায় যদি আগেভাগেই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া থাকতো তাহলে হয়তো বর্তমানের বিপর্যয়কর পরিস্থিতির কবলে পড়তে হতো না।
তিনি বলেন, ২০০২ সালে আমি মেয়রের দায়িত্বে ঠিকমতো বসতে না বসতেই ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ দেখা দেয়। এ বিষয়ে আমার তেমন কোনো ধারণাই ছিল না।
খোঁজ নিতে গিয়ে দেখলাম যে, স্টোরে মশা মারার কোনো ওষুধই নেই। ওষুধ কিনতে গিয়ে দেখি তহবিলে কোনো টাকা নেই। এমনকি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার মতো টাকাও ছিল না। ওই পরিস্থিতিতে রীতিমতো দিশাহারা হয়ে পড়লাম। তখনই জানতে পারি, মশার প্রজনন প্রতিরোধে জনসচেতনতা সৃষ্টির বিষয়ে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ সাহেবের অতীত অভিজ্ঞতা আছে।
দ্রুত তাঁর শরণাপন্ন হলাম। তাঁর কাছেই জানতে পারি, ডেঙ্গুর ভাইরাসবাহী এডিস মশা পরিষ্কার পানিতে ডিম দেয় এবং এই মশা দিনের আলোতেই মানুষের শরীরে কামড় দেয়। আবু সায়ীদ সাহেবের সঙ্গে কথা বলার পর আমি এ বিষয়ে একের পর এক আরো অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিকে অনুরোধ জানাই আমাদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য। তাতে সাড়া দিয়ে প্রখ্যাত শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ প্রয়াত ডা. এম আর খান, টিআইবির তৎকালীন চেয়ারম্যান প্রফেসর মোজাফফর আহমদ, বুদ্ধিজীবী সৈয়দ আবুল মকসুদ, সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলাম, স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন, লেখক ইমদাদুল হক মিলন, চলচ্চিত্র অভিনেত্রী কবরী, চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন, বিটিভির সাবেক পরিচালক রফিকুল ইসলাম সরকার, সিপিবি নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স, পরিবেশ আন্দোলনের নেতা আবু নাসের এবং সিভিল সোসাইটির আরো অনেকেই দারুণ আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসেন। তাঁদের মিলিত হওয়ার জন্য নগরভবনেই একটি বড় কক্ষ বরাদ্দ করা হয়। তাঁরা নিয়মিত সেখানে বসে পরিস্থিতি পর্যালোচনার পর সেই মোতাবেক করণীয় ঠিক করতেন। তাঁদের দিক-নির্দেশনায়ই সিটি করপোরেশন মশা নিধন ও ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে থাকে।
সাদেক হোসেন খোকা বলেন, সেই বছর এডিস মশার বংশবিস্তার রোধে এসব বিশিষ্ট ব্যক্তি বিভিন্ন গ্রুপে বিভিক্ত হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চলে জনসচেতনতা সৃষ্টির কাজে নেমে পড়েছিলেন। তাতে নগরবাসীর তরফ থেকেও অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া যায়। কারণ তাঁদের সেই তৎপরতা লোক দেখানো বা টিভি ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর উদ্দেশ্য ছিল না। অবশ্য তখন এত বেশি টিভি চ্যানেলও ছিল না। সবাই আন্তরিকতা নিয়ে সত্যিকার জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্যই এগিয়ে এসেছিলেন।
তিনি বলেন, হাতিরঝিল এলাকা ছিল মশার বড় প্রজনন ক্ষেত্র। চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনকে নিয়ে একদিন ওই এলাকায় গেলে তাকে দেখার জন্য হাজার হাজার মানুষ ভেঙ্গে পড়ে। তখন তিনি হ্যান্ডমাইকে বক্তৃতা দিয়ে সেসব মানুষকে মশার প্রজননরোধে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান। দেখা গেল একদিনের মধ্যেই পুরো এলাকা পরিষ্কার হয়ে গেছে। ইলিয়াস কাঞ্চন এমনকি তাঁর সিনেমার শ্যুটিং-শিডিউল পরিবর্তন করেও আমাদের কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছিলেন। ইমদাদুল হক মিলনকে ফোন করে যখন এই কাজে যুক্ত হওয়ার অনুরোধ জানালাম, জবাবে তিনি বললেন, এই প্রথম কোনো মেয়রের ফোন পেলাম। আমি অবশ্যই থাকবো। এরপর তিনি রীতিমতো পূর্ণকালীন আমাদের সঙ্গে থেকে দিনের পর দিন জনসচেতনতা সৃষ্টির কাজে ভূমিকা রেখেছেন।
সাবেক মেয়র বলেন, সেই বছর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীদের ওপর খোঁজ-খবর নিয়ে দেখা গেল, কাঁঠালবাগান, কলাবাগান, ধানমন্ডি ও মোহাম্মদপুর এলাকায় এই রোগের প্রকোপ বেশি। তখন কমিশনার আব্দুল লতিফের তত্ত্বাবধানে এই অঞ্চলে বিশেষ পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করা হয় এবং আমি নিজে তাতে অংশগ্রহণ করি। একদিন সেই অভিযানের অংশ হিসেবে কলাবাগান এলাকায় গেলে স্থানীয় লোকজন আমাকে একটি বাড়ি দেখিয়ে বললো, আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুস সামাদ আজাদ এই বাড়িতে থাকেন। তখন আমি সেই বাড়িতে গিয়ে সামাদ আজাদ সাহেবের সঙ্গে দেখা করি এবং তাঁকেও অনুরোধ জানাই আমাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য। তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেদিন আমাদের সঙ্গে পুরো এলাকা ঘুরে ঘুরে মানুষকে এডিস মশার ব্যাপারে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
খোকা বলেন, তখন সিটি করপোরেশনের ৯০ জন কমিশনারের মধ্যে ৩৩ জন ছিলেন আওয়ামী লীগের। আমি তাদের সবাইকে সমভাবে গুরুত্ব দিয়ে এই কাজে যুক্ত করি এবং তারা প্রত্যেকেই সমান উৎসাহে জনসচেতনতা সৃষ্টির কাজে যুক্ত হন। আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ সাহেব তাঁর বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের কর্মীদেরও এই কাজে যুক্ত করেন। তারা নগরীর বিভিন্ন পার্কে গিয়ে বড় বড় গাছের কোটরে জমে থাকা পানি অপসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
একইসঙ্গে বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে জরুরিভিত্তিতে এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করি। প্রয়াত বরেণ্য সাংবাদিক এবিএম মূসা, মাহফুজ আনাম, রিয়াজউদ্দিন আহমদ, প্রয়াত আমানউল্লাহ কবীর, মতিউর রহমান চৌধুরীসহ সংবাদপত্রসমূহের অধিকাংশ সম্পাদক এবং বিপুলসংখ্যক সিনিয়র সাংবাদিক সাড়া দেন আমার অনুরোধে। তাঁদের সামনে পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেন অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ। পরে তাঁদের অনেকেই ডেঙ্গু সচেতনতা বিষয়ক করপোরেশনের বিজ্ঞাপন বিনামূল্যে ছেপে দেন। এছাড়া জনসচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডের খবর গুরুত্ব দিয়ে নিয়মিত প্রকাশ করেছিল প্রায় সকল সংবাদমাধ্যম।
অন্যদিকে, মেয়র হিসেবে আমি নিজে তৎকালীন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতে থাকি। মান্নান ভূঁইয়া সাহেব আমাকে সর্বাত্মক সহায়তা দিয়েছিলেন দ্রুত মশার ওষুধ যোগাড়ের কাজে। আর স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিয়মিত আমাদের সঙ্গে যোগ দিতেন জনসচেতনতা সৃষ্টির কাজে। তাঁর নির্দেশে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা ও নেতৃস্থানীয় চিকিৎসকরাও যুক্ত হন এই তৎপরতায়। নিজের অতীতের ক্রীড়া সংগঠক এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনের সুবাদে নগরীর বিভিন্ন ক্লাব ও সংগঠনের সঙ্গে যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল সেটাকেও কাজে লাগাই জনসচেতনতা সৃষ্টিতে। তবে পরিস্থিতির আরো অবনতির আশঙ্কা মাথায় রেখে আকাশ থেকে মশার ওষুধ ছিটানো বা এরিয়াল স্প্রে করার জন্য প্রায় ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে প্রয়োজনীয় ইক্যুইপমেন্ট সংযোজন করা হয়। কিন্তু ওই পর্যায়ে উবীনিগ-এর ফরহাদ মযহার সাহেবসহ আরো অনেক পরিবেশবাদী এরিয়াল স্প্রের ব্যাপারে আপত্তি জানান। তখন তাদের আমরা বলি, এখনই এরিয়াল স্প্রে করা হবে না। তবে পরিস্থিতি যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার উপক্রম হয় তখনই শেষ ব্যবস্থা হিসেবে এটা করার প্রস্তুতি নিয়ে রাখছি।
টানা সাড়ে ৯ বছর মেয়রের দায়িত্ব পালনকারী খোকা বলেন, সেই বছর করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের দুই চিকিৎসকের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে একটা সমস্যায় পড়ে যাই। তাদের এই দ্বন্দ্বের জেরে আদালতে একটি মামলা থাকার কারণে প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা পদে কাউকে নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছিল না। ফলে মশকনিধন ও জনসচেতনতা সৃষ্টির সামগ্রিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় ব্যাঘাত ঘটছিল। কারণ, এসব কর্মকাণ্ড স্বাস্থ্য বিভাগের অধীনেই হয়ে থাকে। ওই পরিস্থিতিতে আমি উদ্যোগ নিয়ে সেনাবাহিনীর কর্নেল র্যাঙ্কের একজন চিকিৎসককে ডিসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা পদে নিয়ে আসি। আজও পর্যন্ত সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা পদে সেনাবাহিনীর চিকিৎসকরাই দায়িত্ব পালন করছেন।
সবমিলিয়ে দলমত নির্বিশেষে এক সমন্বিত প্রচেষ্টার বদৌলতেই সেই বছর কার্যকরভাবে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলা সম্ভব হয়েছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।
No comments