বাংলাদেশের চীন-ভারত ভারসাম্য by অস্টিন বডেট্টি
এশিয়ার
টেলিযোগাযোগ শিল্পে চীনের আধিপত্যের বিষয়টি এখন সবার জানা। কিন্তু
বাংলাদেশের অন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে ঘাঁটি গেড়েছে দেশটি। সেটি হলো
জ্বালানি শিল্প। তীব্র জ্বালানি সংকটের কারণে বাংলাদেশ জ্বালানি চাহিদা ও
যোগানের মধ্যে ক্রমবিস্তৃত ব্যবধান কমাতে এই খাতে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ
আকৃষ্ট করার দিকে নজর দিয়েছে। চীনকে এক্ষেত্রে আগ্রহী মনে হয়েছে। চীনের
হুয়াডিয়ান হংকং কোম্পানি লিমিটেড গত বছর বাংলাদেশে একটি বিদ্যুতকেন্দ্র
নির্মাণে সম্মত হয়েছে। এ বছরের শুরুর দিকে বৃটিশ একটি কোম্পানির সঙ্গে
অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পাওয়ারচায়না আরেকটি বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণে সম্মত
হয়েছে। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অধ্যাপক ও ‘বাংলাদেশ: পলিটিকস, ইকোনমিকস
অ্যান্ড সিভিল সোসাইটি’ বইয়ের লেখক ডেভিড লুইস বলেন, ‘বাংলাদেশ এক সময়
জ্বালানি সরবরাহ সমস্যার কারণে ভীষণ সমস্যায় ছিল।
এ কারণেই সরকার এই খাতে বিদেশী বিনিয়োগের সম্ভাবনা যাচাই করার দিকে ঝুঁকেছে।’
বিদ্যুত সংকট মোকাবিলায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশটি দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করে আসছে। ২০১৪ সালে একবার দেশের জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ বা ১০ কোটি মানুষ বিদ্যুতহীন অবস্থায় পড়ে যায়।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রশাসন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কৃষ্ণ কুমার সাহা বলেন, ‘উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের প্রচুর জ্বালানি প্রয়োজন। জ্বালানি সংকটের কারণে দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হতে পারে। যার দরুন দেখা যেতে পারে অস্থিতিশীলতা। এজন্য জ্বালানি সমস্যা দ্রুত সমাধান করতে জ্বালানি শিল্পে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ আনতে চায় বাংলাদেশ।’
এখনও বিপুল সংখ্যক মানুষের গৃহে বিদ্যুত নেই। এই ঘাটতি পূরণে বাংলাদেশের জ্বালানি শিল্পে বিনিয়োগের জন্য ছুটছে বৃটেন, চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিযোগিতায় দৃশ্যত জয়ী হচ্ছে চীন। ২০১৫ সালে বাংলাদেশের জ্বালানি উন্নয়নে ভারতকে টপকে বাংলাদেশের শীর্ষ অংশীদারে পরিণত হয় চীন।
উইলসন সেন্টারে দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক জ্যেষ্ঠ অ্যাসোসিয়েট মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘বর্ধিষ্ণু অর্থনীতি ও বড় জনসংখ্যার দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সবসময়ই জ্বালানি অনিরাপত্তার ঝুঁকিতে থাকবে। এ কারণে জ্বালানি সম্পদের খোঁজে বৈদেশিক বিনিয়োগ অনুসন্ধান সহ সকল বিকল্পই দেশটি খোলা রাখতে চাইবে। অপরদিকে চীনের রয়েছে অঢেল অর্থ আর বিনিয়োগের ইচ্ছা। এ কারণে চীন সবসময়ই এক্ষেত্রে ঢাকার জন্য আকর্ষণীয় অংশীদার।’
তবে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগের কারণে উদ্বেগ দেখা দিতে পারে ভারতে। বাংলাদেশের সঙ্গে ২৫৮২ মাইলের সীমান্ত রয়েছে ভারতের। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সমর্থন দিয়েছিল ভারত। বাংলাদেশের অর্থনীতি ও বিশেষ করে জ্বালানি খাতে চীনের ভূমিকা নিয়ে ভারতের কর্মকর্তারা বেশ সতর্ক। ডেভিড লুইস এক্ষেত্রে বলেন, ‘এই অঞ্চলে দুই বড় শক্তিধর রাষ্ট্র হলো ভারত ও চীন। আর উভয় দেশের সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক রক্ষা করা বাংলাদেশের স্বার্থের পক্ষে। তবে এক্ষেত্রে সম্ভাব্য ঝুঁকি হলো ভারতের সঙ্গে দেশটির জটিল সম্পর্কে অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে, যে সম্পর্ক কিনা এখন বেশ ভাল অবস্থায় আছে। ভারতীয় সম্পৃক্ততার চেয়ে চীনের বিনিয়োগ বাংলাদেশে রাজনৈতিকভাবে কম সংবেদনশীল।’
২০১৫ সালে বাংলাদেশ ও ভারত নিজেদের মধ্যকার ভূখ- সংক্রান্ত বেশিরভাগ জটিলতা নিরসন করেছে। গত বছর ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির প্রস্তাব দেয়। বাংলাদেশ বর্তমানে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের রাজনৈতিক গুরুত্ব ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের অর্থনৈতিক সুবিধা- এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে কাজ করছে।
কুগেলম্যান অবশ্য বলেন, ‘চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করলে বাংলাদেশের দু’টি বড় ঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে। একটি হলো অর্থনৈতিক। বাংলাদেশ হয়তো বিপুল অংকের ঋণের জালে আটকা পড়তে পারে। আরেকটি ঝুঁকি হলো ভূরাজনৈতিক। ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক গত ৫ বছরে বেশ ঘনিষ্ঠ হয়েছে। যদি এটি প্রতীয়মান হয় যে ঢাকা বেইজিং-এর দিকে বেশি ঝুঁকছে, তাহলে নয়াদিল্লির সঙ্গে ঢাকার যে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে, সেখানে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।’
বিদ্যুত কেন্দ্রের মতো বৈদেশিক অবকাঠামো খাতে চীন যে সহযোগিতা করছে, তার অনেকটাই দেশটি করেছে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-এর অধীনে। চীনের এই উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো আফ্রিকা, এশিয়া ও ইউরোপের দেশগুলোকে নিজের অর্থনৈতিক প্রভাব বলয়ের মধ্যে নিয়ে আসা। বাংলাদেশ ও আরও কয়েকটি প্রতিবেশী দেশ এই প্রকল্প থেকে স্বল্পমেয়াদে লাভবান হলেও, প্রায়ই চীনা ঋণের কারণে দীর্ঘমেয়াদী জটিলতাও দেখা গেছে। এই ঋণজালের সবচেয়ে ভয়াবহ উদাহরণ দেখা গেছে শ্রীলঙ্কায়। সেখানে দেশটির সরকার চীনা অর্থায়নে নির্মিত একটি বন্দরের ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে, সেটি চীনের রাষ্ট্র-মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর করেছে।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষ্ণ সাহা বলেন, ‘চীন এই অঞ্চলের সুপার পাওয়ারে পরিণত হয়েছে। চীনের দিকে ঝুঁকে বাংলাদেশ আরও বৈদেশিক বিনিয়োগ ও সস্তা জ্বালানি পেতে পারে। তবে এর ফলে ভারত রেগে যাবে, এমন ঝুঁকিও রয়েছে। বাংলাদেশকে এতটা চীনের কাছাকাছি যেতে দেখে দেশটি খুশি হবে না, এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের ওপর ভারতের অনেক প্রভাব রয়েছে। দেশটি সবসময় চাইবে বাংলাদেশকে চীন থেকে দূরে রাখতে।’
তবে চীন-বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতার সঙ্গে অর্থনৈতিক বিষয়আশয় ও জ্বালানি চাহিদাই বেশি জড়িত। ভারতকে ক্ষুব্ধ করাটা এখানে উদ্দেশ্য নয়। ভারত এখনও বাংলাদেশের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্রদেশের একটি। কুগেলম্যানও বললেন যে, ‘ভারত নিজেও বিষয়টা বোঝে। ঢাকা যদিও চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে, এর পুরোটাই অর্থনৈতিক ও জ্বালানি সংক্রান্ত কারণে। এখানে কৌশলগত কিছু মূখ্য নয়। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক যেমনই হোক না কেন, ভারতের সঙ্গে থাকা সম্পর্ককে সবসময় মূল্য দেবে বাংলাদেশ।’
বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে ভারত সম্পৃক্ততা অব্যাহত রেখেছে। তবে বাংলাদেশের এই খাতে চীনের অন্তর্ভূক্তিকে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি সম্ভাব্য হুমকি হিসেবে দেখছেন ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা।
যদি চীন ও ভারতের কোনো একটি প্রভাব বলয়ে না ঝুঁকেই সম্পর্কে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে বাংলাদেশ, তাহলে বহু বছর ধরে চীন-ভারত-প্রভাবিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফসল ঘরে তুলতে পারবে দেশটি। বাংলাদেশের জ্বালানি খাত নিয়ে এই দুই পরাশক্তি যত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, ততই বাংলাদেশের লাভ।
ডেভিড লুইস বলেন, এসব প্রকল্প থেকে সরাসরি কর্মসংস্থান তৈরি হবে না। কেননা, এখানে চীনা শ্রমিক ও যন্ত্রাংশই ব্যবহৃত হবে। তবে জ্বালানি খাতের উন্নয়ন হলে বাংলাদেশ ভীষণভাবে লাভবান হবে।
গত বছর বাংলাদেশ ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করতে পেরেছে। তবে বর্তমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে হলে ২০৩০ সাল নাগাদ ৩৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করতে হবে বাংলাদেশকে। এক্ষেত্রে হয়তো চীনের ওপরই নির্ভর করতে হবে দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশকে।
কৃষ্ণ সাহা বলেন, ‘চীনা-অর্থায়নে নির্মিতব্য জ্বালানি কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশ বেশ কয়েকভাবে উপকৃত হবে। প্রথমত, এই জ্বালানি সস্তা। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক মঞ্চে ও জাতিসংঘে চীনের সহায়তা নিতে পারবে বাংলাদেশ।’
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি ও জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের স্থায়ী সদস্য হিসেবে চীন যেমন কূটনৈতিক ও আর্থিক সহায়তা দিতে পারবে বাংলাদেশকে, তেমনটা দেশটির খুব অল্প ক’টি মিত্রই পারবে।
(এই নিবন্ধ দ্য ডিপ্লোম্যাট ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে)
এ কারণেই সরকার এই খাতে বিদেশী বিনিয়োগের সম্ভাবনা যাচাই করার দিকে ঝুঁকেছে।’
বিদ্যুত সংকট মোকাবিলায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশটি দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করে আসছে। ২০১৪ সালে একবার দেশের জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ বা ১০ কোটি মানুষ বিদ্যুতহীন অবস্থায় পড়ে যায়।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রশাসন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কৃষ্ণ কুমার সাহা বলেন, ‘উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের প্রচুর জ্বালানি প্রয়োজন। জ্বালানি সংকটের কারণে দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হতে পারে। যার দরুন দেখা যেতে পারে অস্থিতিশীলতা। এজন্য জ্বালানি সমস্যা দ্রুত সমাধান করতে জ্বালানি শিল্পে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ আনতে চায় বাংলাদেশ।’
এখনও বিপুল সংখ্যক মানুষের গৃহে বিদ্যুত নেই। এই ঘাটতি পূরণে বাংলাদেশের জ্বালানি শিল্পে বিনিয়োগের জন্য ছুটছে বৃটেন, চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিযোগিতায় দৃশ্যত জয়ী হচ্ছে চীন। ২০১৫ সালে বাংলাদেশের জ্বালানি উন্নয়নে ভারতকে টপকে বাংলাদেশের শীর্ষ অংশীদারে পরিণত হয় চীন।
উইলসন সেন্টারে দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক জ্যেষ্ঠ অ্যাসোসিয়েট মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘বর্ধিষ্ণু অর্থনীতি ও বড় জনসংখ্যার দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সবসময়ই জ্বালানি অনিরাপত্তার ঝুঁকিতে থাকবে। এ কারণে জ্বালানি সম্পদের খোঁজে বৈদেশিক বিনিয়োগ অনুসন্ধান সহ সকল বিকল্পই দেশটি খোলা রাখতে চাইবে। অপরদিকে চীনের রয়েছে অঢেল অর্থ আর বিনিয়োগের ইচ্ছা। এ কারণে চীন সবসময়ই এক্ষেত্রে ঢাকার জন্য আকর্ষণীয় অংশীদার।’
তবে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগের কারণে উদ্বেগ দেখা দিতে পারে ভারতে। বাংলাদেশের সঙ্গে ২৫৮২ মাইলের সীমান্ত রয়েছে ভারতের। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সমর্থন দিয়েছিল ভারত। বাংলাদেশের অর্থনীতি ও বিশেষ করে জ্বালানি খাতে চীনের ভূমিকা নিয়ে ভারতের কর্মকর্তারা বেশ সতর্ক। ডেভিড লুইস এক্ষেত্রে বলেন, ‘এই অঞ্চলে দুই বড় শক্তিধর রাষ্ট্র হলো ভারত ও চীন। আর উভয় দেশের সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক রক্ষা করা বাংলাদেশের স্বার্থের পক্ষে। তবে এক্ষেত্রে সম্ভাব্য ঝুঁকি হলো ভারতের সঙ্গে দেশটির জটিল সম্পর্কে অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে, যে সম্পর্ক কিনা এখন বেশ ভাল অবস্থায় আছে। ভারতীয় সম্পৃক্ততার চেয়ে চীনের বিনিয়োগ বাংলাদেশে রাজনৈতিকভাবে কম সংবেদনশীল।’
২০১৫ সালে বাংলাদেশ ও ভারত নিজেদের মধ্যকার ভূখ- সংক্রান্ত বেশিরভাগ জটিলতা নিরসন করেছে। গত বছর ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির প্রস্তাব দেয়। বাংলাদেশ বর্তমানে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের রাজনৈতিক গুরুত্ব ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের অর্থনৈতিক সুবিধা- এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে কাজ করছে।
কুগেলম্যান অবশ্য বলেন, ‘চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করলে বাংলাদেশের দু’টি বড় ঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে। একটি হলো অর্থনৈতিক। বাংলাদেশ হয়তো বিপুল অংকের ঋণের জালে আটকা পড়তে পারে। আরেকটি ঝুঁকি হলো ভূরাজনৈতিক। ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক গত ৫ বছরে বেশ ঘনিষ্ঠ হয়েছে। যদি এটি প্রতীয়মান হয় যে ঢাকা বেইজিং-এর দিকে বেশি ঝুঁকছে, তাহলে নয়াদিল্লির সঙ্গে ঢাকার যে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে, সেখানে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।’
বিদ্যুত কেন্দ্রের মতো বৈদেশিক অবকাঠামো খাতে চীন যে সহযোগিতা করছে, তার অনেকটাই দেশটি করেছে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-এর অধীনে। চীনের এই উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো আফ্রিকা, এশিয়া ও ইউরোপের দেশগুলোকে নিজের অর্থনৈতিক প্রভাব বলয়ের মধ্যে নিয়ে আসা। বাংলাদেশ ও আরও কয়েকটি প্রতিবেশী দেশ এই প্রকল্প থেকে স্বল্পমেয়াদে লাভবান হলেও, প্রায়ই চীনা ঋণের কারণে দীর্ঘমেয়াদী জটিলতাও দেখা গেছে। এই ঋণজালের সবচেয়ে ভয়াবহ উদাহরণ দেখা গেছে শ্রীলঙ্কায়। সেখানে দেশটির সরকার চীনা অর্থায়নে নির্মিত একটি বন্দরের ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে, সেটি চীনের রাষ্ট্র-মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর করেছে।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষ্ণ সাহা বলেন, ‘চীন এই অঞ্চলের সুপার পাওয়ারে পরিণত হয়েছে। চীনের দিকে ঝুঁকে বাংলাদেশ আরও বৈদেশিক বিনিয়োগ ও সস্তা জ্বালানি পেতে পারে। তবে এর ফলে ভারত রেগে যাবে, এমন ঝুঁকিও রয়েছে। বাংলাদেশকে এতটা চীনের কাছাকাছি যেতে দেখে দেশটি খুশি হবে না, এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের ওপর ভারতের অনেক প্রভাব রয়েছে। দেশটি সবসময় চাইবে বাংলাদেশকে চীন থেকে দূরে রাখতে।’
তবে চীন-বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতার সঙ্গে অর্থনৈতিক বিষয়আশয় ও জ্বালানি চাহিদাই বেশি জড়িত। ভারতকে ক্ষুব্ধ করাটা এখানে উদ্দেশ্য নয়। ভারত এখনও বাংলাদেশের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্রদেশের একটি। কুগেলম্যানও বললেন যে, ‘ভারত নিজেও বিষয়টা বোঝে। ঢাকা যদিও চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে, এর পুরোটাই অর্থনৈতিক ও জ্বালানি সংক্রান্ত কারণে। এখানে কৌশলগত কিছু মূখ্য নয়। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক যেমনই হোক না কেন, ভারতের সঙ্গে থাকা সম্পর্ককে সবসময় মূল্য দেবে বাংলাদেশ।’
বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে ভারত সম্পৃক্ততা অব্যাহত রেখেছে। তবে বাংলাদেশের এই খাতে চীনের অন্তর্ভূক্তিকে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি সম্ভাব্য হুমকি হিসেবে দেখছেন ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা।
যদি চীন ও ভারতের কোনো একটি প্রভাব বলয়ে না ঝুঁকেই সম্পর্কে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে বাংলাদেশ, তাহলে বহু বছর ধরে চীন-ভারত-প্রভাবিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফসল ঘরে তুলতে পারবে দেশটি। বাংলাদেশের জ্বালানি খাত নিয়ে এই দুই পরাশক্তি যত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, ততই বাংলাদেশের লাভ।
ডেভিড লুইস বলেন, এসব প্রকল্প থেকে সরাসরি কর্মসংস্থান তৈরি হবে না। কেননা, এখানে চীনা শ্রমিক ও যন্ত্রাংশই ব্যবহৃত হবে। তবে জ্বালানি খাতের উন্নয়ন হলে বাংলাদেশ ভীষণভাবে লাভবান হবে।
গত বছর বাংলাদেশ ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করতে পেরেছে। তবে বর্তমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে হলে ২০৩০ সাল নাগাদ ৩৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করতে হবে বাংলাদেশকে। এক্ষেত্রে হয়তো চীনের ওপরই নির্ভর করতে হবে দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশকে।
কৃষ্ণ সাহা বলেন, ‘চীনা-অর্থায়নে নির্মিতব্য জ্বালানি কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশ বেশ কয়েকভাবে উপকৃত হবে। প্রথমত, এই জ্বালানি সস্তা। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক মঞ্চে ও জাতিসংঘে চীনের সহায়তা নিতে পারবে বাংলাদেশ।’
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি ও জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের স্থায়ী সদস্য হিসেবে চীন যেমন কূটনৈতিক ও আর্থিক সহায়তা দিতে পারবে বাংলাদেশকে, তেমনটা দেশটির খুব অল্প ক’টি মিত্রই পারবে।
(এই নিবন্ধ দ্য ডিপ্লোম্যাট ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে)
No comments