সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধে অর্থমন্ত্রীর বাজেটাস্ত্র
থমাস জেফারসন। আমেরিকার ফাউন্ডিং ফাদার। আমেরিকার ‘ডিকারেশন অব ইনডিপেন্ডেন্স’-এর প্রধান প্রণেতা। আমেরিকার তৃতীয় প্রেসিডেন্ট। ছিলেন দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট জন অ্যাডামসের আমলের (১৮৯৭-১৮০১) নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট। গণতন্ত্র, রিপাবলিকানিজম ও ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রবল সমর্থক এই ব্যক্তিত্ব আমেরিকান উপনিবেশবাদীদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন গ্রেট ব্রিটেন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন জাতি গঠনে। তিনি রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় পর্যায়ের অনেক আনুষ্ঠানিক দলিল ও সিদ্ধান্তের অনুঘটক হিসেবে কাজ করে গেছেন। তার অনন্য একটি সুপরিচিতি আছে। তিনি সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও ছিলেন সংবাদপত্রের বিকাশ ও স্বাধীনতার পক্ষের ব্যতিক্রমী মানুষ। আমরা যারা সংবাদপত্র জগতের মানুষ, তারা প্রায়ই তাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি তার একটি বিখ্যাত বক্তব্যের জন্য। তার উক্তিটি সাক্ষ্য বহন করে তিনি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বিকাশকে কতটুকু গুরুত্ব দিতেন। জেফারসন ১৭৮৬ থেকে ১৭৮৮ সালে এডওয়ার্ড ক্যারিংটনকে একজন প্রতিনিধি হিসেবে কন্টিনেন্টাল কংগ্রেসে পাঠিয়েছিলেন। তখন জেফারসন প্যারিস থেকে ক্যারিংটনকে যে চিঠি লিখেছিলেন, এর উপসংহার টেনে লিখেছিলন : আমাকে যদি Ôa government without newspapersÕ’ অথবা ‘Ônewspapers without a governmentÕ’Ñ এ দুয়ের মধ্যে যেকোনো একটিকে বেছে নিতে বলা হয়, তবে আমি এক মুহূর্তও না ভেবে দ্বিধাহীনভবে দ্বিতীয়টিকেই বেছে নিতাম। তিনি এমনটি উচ্চারণ করেছিলেন, সেই ১৭৮৭ সালের দিকে। কারণ, তার উপলব্ধিতে ছিল : জনগণই হচ্ছে শাসকদের সেন্সর। সংবাদপত্রে সরকারের ভুলত্রুটি সবচেয়ে ভালোভাবে ধরা পড়ে। আর সরকার চাইলে সে ভুল সহজেই শোধরাতে পারে। সে যা-ই হোক, আমাদের এই সময়ের সরকারগুলো এই সত্য উপলব্ধিতে অপারগ। তাই এরা সংবাদপত্রকে পরম শত্রু ভাবে এবং কিভাবে সংবাদপত্রের হাত-পা যথাসম্ভব আঁটসাঁট করে বাঁধা যায়, সে চিন্তাই তাদের মাথায় ঘোরে সারাক্ষণ। ফলে এটি স্পষ্ট, আমাদের সরকারপ্রধানকে যদি ‘অ্যা গভর্নমেন্ট উইদাউট নিউজপেপারস’ অথবা ‘নিউজপেপারস উইদাউট অ্যা গভর্নমেন্ট’Ñ এ দুয়ের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে বলা হয়, তবে নিশ্চিতভাবেই ‘অ্যা গভর্নমেন্ট উইদাউট নিউজপেপারস’ অপশনটিই বেছে নেবে। নিকট অতীতের দিকে তাকালে, এমনটিরই প্রমাণ মেলে। সম্প্রতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের যে বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে সংবাদপত্র শিল্পের ওপর নানা কায়দায় যেভাবে ভ্যাট-শুল্ক-কর বসানো হয়েছে, তার প্রেক্ষাপটেই এই কথাগুলো বলা। দোরগোড়ায় কড়ানাড়া আগামী অর্থবছরের বাজেটে সংবাদপত্রের বিভিন্ন উপকরণ ও আয়ের ওপর বাড়তি শুল্কÑ করÑ ভ্যাট চাপানো হয়েছে। সংবাদপত্রের আয়ের অন্যতম খাত বিজ্ঞাপনের ওপর ৪ শতাংশ হারের অগ্রিম কর আগে থেকেই ছিল। বিজ্ঞাপনের ওপর নতুন করে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপসহ ছাপাখানায় ব্যবহারের কালি, প্লেট ও নিউজপ্রিন্ট আমদানিসহ সব কিছুতেই ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এতে সংবাদপত্র শিল্প টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে পড়বে। ২০১৩ সালে সংবাদপত্র কর্মীদের জন্য অষ্টম ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
তখন সংবাদপত্র শিল্পকে বাড়তি অর্থনৈতিক চাপের মুখে পড়তে হয়। তা ছাড়া তখন কাগজসহ অন্যান্য উপকরণেরও দাম বাড়ে। বাড়ে বিদ্যুতের দামও। ফলে সংবাদপত্রের ব্যয় অনেক বেড়েছে। এর ফলে অনেক সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষ সময়মতো সাংবাদিক ও অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ঠিকমতো পরিশোধ করতে পারছে না। কোথাও কোথাও ব্যাপক হারে সাংবাদিক ও কর্মী ছাঁটাইয়ের মতো দুঃখজনক ঘটনা ঘটতে আমরা দেখছি। এদিকে নবম ওয়েজবোর্ড দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে। তখন আরেক দফা বাড়বে সংবাদপত্রে সাংবাদিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার খরচ। এমনটি যে শুধু বাংলাদেশেই ঘটছে, তা নয়। দুনিয়াজুড়ে সংবাদপত্র শিল্প রীতিমতো হুমকির মধ্যে রয়েছে। বিভিন্ন দেশের বড় বড় পত্রিকাগুলো সংস্করণ কমিয়ে দিচ্ছে। সার্কুলেশন কমিয়ে দিচ্ছে। কর্মী ছাঁটাই করছে। খরচ কমানোর সম্ভাব্য উপায় উদ্ভাবন করে নানা ধরনের পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করছে। সংবাদপত্রে বিনিয়োগ থামিয়ে দিয়ে কোনোমতে চালু রাখার চেষ্টা করছে। বিখ্যাত ক’টি আন্তর্জাতিক ইংরেজি দৈনিক সম্পূর্ণ দৈনিকের রূপ পাল্টে রূপান্তরিত হচ্ছে ট্যাবলয়েডে। আমাদের দেশের অবস্থা এ থেকে আলাদা কিছু নয়। এমনি অবস্থায় নতুন বাজেটে অবিবেচকের মতো নতুন করে ভ্যাট-শুল্ক-কর আরো বাড়িয়ে দেয়া সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণ বৈ কী হতে পারে? শুধু বিমাতাসুলভ আচরণ বললে যথেষ্ট বলা হয় না, বরং বলা উচিত এখানে সরকারের ভূমিকা সংবাদপত্র হন্তারকের। এমনি অবস্থায় আমাদের দেশের সরকার যখন সংবাদপত্রের ওপর ভ্যাট-শুল্কের খড়গ হাতে নিয়ে মাঠে নেমেছে, তখন অনেক দেশ ভাবছে কী করে সংবাদশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে যুক্তরাষ্ট্র, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলোর সরকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তা দিচ্ছে তাদের নিজ নিজ দেশের বেসরকারি সংবাদপত্রগুলোকে। শুধু সাংবাদিকদের কর্মসংস্থান কিংবা সংবাদপত্র টিকিয়ে রাখা কিংবা সংবাদপত্রের কাছ থেকে সমর্থন পওয়ার জন্য এসব দেশের সরকার এই সহায়তা দিচ্ছে তা নয়, বরং জনগণের তথ্য ও বিনোদন পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে তথ্যভিত্তিক সমাজ গড়ার অংশ হিসেবে এসব উদ্যোগ নিচ্ছে এই দেশগুলো। সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদন মতেÑ যুক্তরাষ্ট্রের রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারগুলো কর ছাড় দিয়ে সংবাদপত্রের করহার বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িংয়ের সমান করা হয়েছে। সংবাদপত্র বিক্রির আয়ের পাশাপাশি বিজ্ঞাপনের আয়ের ওপরও ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রচার সংখ্যা বাড়ানো ও ব্যবস্থাপনা খরচকেও কর ও ভ্যাট থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এভাবে প্রতি বছর ৯০ কোটি ডলারেরও বেশি রাজস্ব ছাড় দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড ও রয়টার্স ইন্সটিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব জার্নালিজম প্রণীত এক যৌথ প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদন থেকে আরো জানা যায়, সংবাদপত্রসহ গণমাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সহায়তার ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে আছে ফিনল্যান্ড। দেশটি সংবাদপত্র বিক্রির আয় ছাড়াও বিজ্ঞাপন, নিউজপ্রিন্ট, ছাপাখানা ও ছাপাখানায় ব্যবহারের সব ধরনের উপকরণকে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দিচ্ছে। এ ছাড়া সংখ্যালঘু বা আঞ্চলিক ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলোকে সে দেশে ভর্তুকি দেয়া হয়। ফ্রান্স নিবন্ধিত সংবাদপত্রগুলোর ওপর ছাড়হারে ভ্যাট আরোপ করে। তা ছাড়া সংবাদপত্রে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের কর অব্যাহতিও দিচ্ছে। অপর দিকে, আমাদের সরকার নিয়মিতভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কী করে সংবাদপত্রের বিকাশকে স্তব্ধ করে দেয়া যায়। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করার মতো নতুন নতুন আইন প্রণয়ন, সরকারবিরোধী পত্র-পত্রিকা ও সাংবাদিক হয়রানি তো আছেই। এর ওপর আবার আরোপ করা হচ্ছে ভ্যাট-শুল্ক-করের খড়গ। একটি মিডিয়া গ্রুপের হিসাব রক্ষণ বিভাগের দেয়া হিসাব মতে, নিউজপ্রিন্ট আমদানি খাতে প্রতি মাসে গড়ে তাদের শুল্ক-কর বাবদ এখন খরচ হয় এক কেটি টাকা। আর বিজ্ঞাপনেরর ওপর ভ্যাট বসলে তাদের প্রতি মাসে গুনতে হবে কমপক্ষে আরো ৬০ লাখ টাকা। নানা ধরনের প্রিন্টিং কেমিক্যালের ওপর প্রস্তাবিত শুল্ক-কর হিসাব করে দেখা গেছে, এতে পত্রিকার প্রকাশনা খরচ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে পড়বে।
এতদিন সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপনদাতারাই ভ্যাট পরিশোধ করত। সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষকে বিজ্ঞাপন খাতের অর্থ দেয়ার আগে ভ্যাটের টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হতো। কিন্তু আগামী অর্থবছর থেকে বিজ্ঞাপন খাতের এই হিসাব পাল্টে যাবে। আমাদের দেশে সাধারণত সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন ছাপা হওয়ার দুই মাস, ছয় মাস বা তারও বেশি সময় পর এর অর্থ পত্রিকাগুলো পেয়ে থাকে। অনেক সময় বিজ্ঞাপন ছাপানোর পরও কোটি কোটি টাকা বকেয়া পড়ে যায়। কারণ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিজ্ঞাপন ছাপা হয় মৌখিক আদেশে। এসব কারণে বাংলাদেশের অনেক পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাওয়ার নজির আছে। আগামী অর্থবছর থেকে বিজ্ঞাপন ছাপানোর পর চুক্তি অনুসারে অর্থ আদায় হোক বা না হোক, কাগজ-কলমে ওই সংবাদপত্রগুলোকে বিজ্ঞাপন ছাপাতে যে অর্থ দিতে চেয়েছে, তা আয় হিসেবে দেখাতে হবে। এরপর বিজ্ঞাপন ছাপানোর জন্য যে অর্থ সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষের পাওয়ার কথা, তা আদায় হোক বা না হোক, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সে অর্থের ১৫ শতাংশ হারের রাজস্ব এনবিআরে জমা দিতে হবে। অন্য দিকে, সংবাদপত্রের কোন পাতায় কতটুকু বিজ্ঞাপন ছাপালে কী পরিমাণ অর্থ সংবাদপত্র পাবে, তার দরও নির্ধারণ করা আছে। আগামী অর্থবছর থেকে বিজ্ঞপন খাতে ধার্য করা রাজস্ব ধরেই যিনি বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন, তিনি মূল্য পরিশোধ করবেন। সংবাদপত্র কর্র্তৃপক্ষকে বিজ্ঞাপন খাতে পরিশোধিত অর্থ থেকেই ভ্যাট দিতে হবে। সংবাদপত্র বিজ্ঞাপনের মূল্য কমাতে পারলেও বাড়ানোর স্বাধীনতা পায় না। ফলে বিজ্ঞাপন খাতে সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষের প্রকৃত আয় কমে যাবে। ভুললে চলবে না, সংবাদপত্র আর দশটি পণ্যের মতো সাধারণ কোনো পণ্য নয়। সমাজ ও জাতিকে তথ্যসমৃদ্ধ করে শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে নেয়ার পাশাপাশি জনগণের তথ্য জানার অধিকার কার্যত নিশ্চিত করে সংবাদপত্র। তাই প্রতিটি দেশে সংবাদপত্র একটি আলাদা মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। সেজন্য সংবাদপত্র শিল্পকে শুল্ক-কর-ভ্যাট ছাড় দেয়ার একটি রেওয়াজ রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের সরকারগুলো সংবাদপত্র শিল্পে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহারের পণ্যগুলোর ওপর শুল্ক-কর আর ভ্যাটের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে এই শিল্পকে কার্যত সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথটুকু বন্ধ করে রাখে। কারণ, আমাদের দেশের সরকারগুলোর দুর্বলতার শেষ নেই। সংবাদপত্রগুলো সরকারের কোন দুর্বলতা কোন মাত্রায় কখন বের করে দেয়, সেই চিন্তায় সরকারি দলের নেতানেত্রীরা ভয়ে কণ্ঠিত থাকেন। এবারের বাজেটে সরকার অন্যান্য শিল্পের কাঁচামালের মতো সংবাদপত্র শিল্পের প্রধান প্রধান কাঁচামালের ওপর বাড়তি শুল্ক-কর-ভ্যাট বসিয়ে কার্যত সংবাদপত্রের বিকাশকেই স্তব্ধ করার প্রয়াস চালিয়েছে। পাশের দেশ ভারতেও নিউজপ্রিন্ট আমদানির ওপর কোনো আমদানি শুল্ক নেই। অথচ ভারতের তুলনায় সব দিক থেকে অনেক পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশে নিউজপ্রিন্টের ওপর আমদানি শুল্ক কার্যকর রয়েছে। তা ছাড়া আমাদের দেশের সংবাদপত্রের পাঠক সংখ্যার তুলনায় ভারতের পাঠক সংখ্যা বহু গুণ বেশি। শত বাধার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলা বাংলাদেশের সংবাদপত্র শিল্পের ওপর এবারের বাজেটে বাড়তি কর-ভ্যাট-শুল্ক চাপানোর বিষয়টি বিভিন্ন মহলের প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক গোলাম রহমান বলেছেন, বাংলাদেশে সংবাদপত্র শিল্প এমনিতেই খুব দুর্বল। ১৬ কোটি মানুষের দেশে মাত্র ২০ থেকে ২৫ লাখ সংবাদপত্র বিক্রি হচ্ছে। সংবাদপত্রের বহুল প্রচারের জন্য এ শিল্প ও এর উপকরণগুলোকে পুরোপুরি ভ্যাট, শুল্ক ও কর থেকে অব্যাহতি দেয়া প্রয়োজন। তা না করে উল্টো অগ্রিম কর, ভ্যাাট ও শুল্ক বসানো হচ্ছে, যা খুবই হতাশাজনক। বাড়তি শুল্ক-কর-ভ্যাট আরোপের ফলে সংবাদপত্রের উৎপাদন খরচ বাড়বে, সংবাদপত্রের দাম বাড়বে। তখন সার্কুলেশন কমে যাবে। অনেক ছোট ও মাঝারি পত্রিকা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কর্মী ছাঁটাই চলতে পারে মূলধারার পত্রিকাগুলোতেও। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত উপায় হিসেবে দুনিয়ার সব দেশেই সংবাদপত্র শিল্প অন্যান্য শিল্পের তুলনায় বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত হাসান একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত ‘সংবাদপত্রের কণ্ঠ রোধ করার ভ্যাট’ শীর্ষক এক লেখায় উল্লেখ করেন : ‘সংবাদপত্র মত প্রকাশের একটি বড় জায়গা, এটি যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে সমাজে মানুষ কী চিন্তা করছে, তার প্রকাশ ঘটবে না। এটি সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ভালো নয়। সরকার মূলত সংবাদপত্রের টুঁটি চেপে ধরতে চায়। এর জন্য সংবাদপত্র শিল্পের ওপর নানাভাবে ভ্যাট বসিয়েছে। সরকারের এমন ধরনের সিদ্ধান্ত অত্যন্ত নিন্দনীয়। সরকারের উচিত দ্রুত এ খাতের ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার করা।
সরকার তার বিরুদ্ধে সমালোচনা দেখতে চায় না। এটি সাধারণভাবে সব সরকারেরই চরিত্র। এ কারণে নানাভাবে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করতে চায় বাংলাদেশের সরকারগুলো। সম্প্রতি সংবাদপত্রে সরকারি বিজ্ঞাপন কমেছে। ই-টেন্ডার হওয়ার কারণে সংবাদপত্রে এখন ক্ষুদ্র আকারের বিজ্ঞাপন দিলেই হয়। ফলে সরকারি দরপত্রের যে বড় বড় বিজ্ঞাপন দেয়া হতো সেটি বন্ধ হয়ে গেছে। আবার সরকারি বিজ্ঞাপন রেট আর বেসরকারি বিজ্ঞাপন রেটের পার্থক্যও অনেক।’ এ দিকে এ প্রসঙ্গে প্রেস কাবের সাবেক সভাপতি ও নিউজ টুডের সম্পাদক বিশিষ্ট্য সাংবাদিক রিয়াজ উদ্দিন আহমদ গণমাধ্যমে বলেছেন, বাজেটে ভ্যাট ও করের যে প্রস্তাব, তা সংবাদপত্রের আর্থিক অবস্থা আরো খারাপ করবে। অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না, যদি কিছু পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। অনেক সাংবাদিক কর্মচারী বেকার হয়ে যেতে পারেন। সংবাদপত্রকে অন্য পণ্যের সাথে তুলনা করে ভ্যাট আরোপ করা হবে অনৈতিক। সংবাদপত্রকে চাপের মুখে রাখার অর্থ হলো, সমাজকে বিকশিত হতে না দেয়া। গণতন্ত্রকে বিকশিত হতে না দেয়া। এ কথাটি সরকারকে বুঝতে হবে। সমালোচকেরা বলেন, সরকার যা করছে তা বুঝেশুনেই করছে। আওয়ামী লীগের কোনো সরকারই গণতন্ত্রের বিকাশ চায় না, তা ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। যদি আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের বিকাশ চাইত তবে, এক দলীয় বাকশালী ব্যবস্থা কায়েমের পদক্ষেপ নিতো না। ৫ জানুয়ারির মতো একটি অগ্রহণযোগ্য ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে পাঁচ বছর ক্ষমতায় টিকে থাকার ঘো ধরতে পারত না। একইভাবে আওয়ামী লীগ সরকার কোনো কালেই সংবাদপত্রবান্ধব হতে পারেনি। পারলে সত্তরের দশকে সব ক’টি পত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে মাত্র চারটি দৈনিক সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রকাশের পদক্ষেপ নিত না। আর আওয়ামী লীগ সরকার সংবাদপত্রবান্ধব হলে সর্বশেষ বাজেটে এ শিল্পের ওপর বাড়তি ভ্যাট-শুল্ক-করের বোঝা তুলে দিত না। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের দমন পীড়নে নতুন নতুন আইনি হাতিয়ার নিয়ে হাজির হতো না। এ ক্ষেত্রে সাংবাদিক ও মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণকারী আইসিটি আইন ও এর কুখ্যাত ৫৭ ধারা প্রবলভাবে সমালোচিত হলেও, এর ব্যাপক প্রয়োগ চলছে বর্তমান সরকারের আমলে। অতি সম্প্রতি তা যেন আরো জোরদার করে তোলা হয়েছে। আসলে এ সরকরের আমলে বিরোধী দলমতের মানুষকে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য চলছে কথায় কথায় মামলা। সাংবাদিক, শিক্ষক, রাজনীতিক, বিশ্লেষক ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে চলছে মামলা দায়েরের প্রতিযোগিতা। কখনো আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার, কখনো মানহানির, আবার কখনো রাষ্ট্রদোহের মামলা চলছে কথায় কথায়। এভাবে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা হচ্ছে আইনের মারপ্যাঁচে। আর এবার বাজেটাস্ত্র প্রয়োগ করে চলছে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধের চূড়ান্তপ্রক্রিয়া। সমালোচকেরা বলেনÑ আসলে আওয়ামী লীগ কোনো কালেই সংবাদপত্রবান্ধব হতে পারল না।
No comments