৯০০ কোটি টাকার ঋণ অনিয়ম
দুর্নীতি এবং ঋণ অনিয়ম রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের শাখায় শাখায় ছড়িয়ে পড়েছে। সারা দেশে ব্যাংকটির ১৯টি শাখা থেকে ২৬টি প্রতিষ্ঠান ঋণের নামে প্রায় ৯০০ কোটি টাকার অনিয়ম করেছে। কিছু ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজশের প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিপুল পরিমাণ এ অর্থ আদায় না হওয়ায় বর্তমানে মন্দ খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে- যা আদায়ের কোনো সম্ভাবনা নেই। ২০১৫ সালে অগ্রণী ব্যাংকের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালিত বিশদ পরিদর্শনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সংশ্লিষ্ট বিশিষ্টজনরা বলছেন, প্রয়োজনে আইন পরিবর্তন করে গুরুতর অপরাধীদের চাকরিচ্যুত করা উচিত। রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকের এমডি-চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়ার পর থেকে এমন বেহাল দশার সৃষ্টি হয়েছে। তাদের মতে, ব্যাংকটিতে বেশ কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা আগেও ছিল। এখনও আছে। কিন্তু এদেরকে যতদিন না সরাবে ততদিন ব্যাংকের অবস্থা আরও নাজুক হবে। জানতে চাইলে অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার যুগান্তরকে বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় দেয়া ঋণ ফেরত আসবে না। কারণ এ ধরনের ঋণ বিতরণে কোনো নিয়ম মানা হয় না। তিনি বলেন, ব্যাংকটিতে সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে। মনিটরিং জোরদার করতে হবে। অগ্রণী ব্যাংক এবং সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকারি ব্যাংকে অপরাধ যত গুরুতরই হোক শাস্তি কেবল সাময়িক বরখাস্ত। বিষয়টি যে অপরাধ করে এবং করায় উভয়ের জানা। সে কারণে অপরাধের প্রবণতা কিছুতেই কমছে না। যেমন অগ্রণী ব্যাংকের সিলেট বোয়ালজুর বাজার শাখায় প্রায় ৪৬ লাখ টাকা চুরির ঘটনায় বাবুল রঞ্জন পুরাকায়স্থকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। আর বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ শাখার প্রায় ৩৭ লাখ টাকা আত্মসাতের ঘটনায় ব্যাংকের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার মিসেস সাফিয়া বেগম এবং ঋণ বিতরণে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (লোন অফিসার) সৈয়দ শিওন সাইফকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এভাবে শত শত কোটি টাকার ঋণ অনিয়মে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত বহু অপরাধী সহজে পার পেয়ে যাচ্ছেন। জানতে চাইলে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এসব অনিয়ম পুরনো। তাছাড়া এক দিনে তা সংঘটিত হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ভাবে অনিয়মগুলো হয়েছে। অডিটে যেসব অনিয়ম বেরিয়ে আসছে তা সমাধানের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। আগামীতে ব্যাংকটির অবস্থা আরও ভাল হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশদ পরিদর্শন প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সেন্ট্রাল অ্যাকাউন্টস ডিভিশনে পেনশনের টাকা নিয়ে অনিয়ম করা হয়েছে। ৩০২ কোটি টাকা বিল হিসেবে উপস্থাপনে ব্যর্থ হয়েছে ব্যাংকটি। এছাড়া একই ডিভিশন থেকে ব্যাংকের ২৫৩ কোটি টাকা শেয়ারবাজারের অতালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করায় পুরো অর্থই ক্ষতির সম্মুখীন। এর বাইরে ব্যাংকের বি-ওয়াপদা কর্পোরেট শাখায় সাড়ে ৩৭ কোটি টাকার ঋণ অনিয়ম করা হয়েছে। আলভি স্পিনিং মিলসের কাছে ব্যাংকের পাওনা এসব টাকা আদায় অনিশ্চিত এবং ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। অথচ পাওনা আদায়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। একই শাখায় আরও প্রায় ৪ কোটি টাকার ঋণ অনিয়ম করা হয়েছে। মেসার্স ডোমার স্পেশালাইজড কোল্ড স্টোরেজের অনুকূলে দেয়া এসব ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ,
সীমাতিরিক্ত ও ক্ষতিমানে শ্রেণীকৃত। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ঋণ আদায় ও দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যাংক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তবে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলছে, টাকা আদায়ে চেষ্টা অব্যাহত আছে। ইতিমধ্যে ৬৫ লাখ টাকা আদায় করা সম্ভব হয়েছে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, অগ্রণী ব্যাংকের রমনা কর্পোরেট শাখার ৩ গ্রাহক প্রতিষ্ঠান ঋণের নামে নিয়ে গেছে প্রায় ৫২ কোটি টাকা। এগুলো হল- আহমেদ স্পিনিং মিলসের অনুকূলে ৩০ কোটি টাকা, রবি ফ্যাশনের অনুকূলে প্রায় ৬ কোটি এবং মেসার্স হেলেনা এন্টারপ্রাইজের অনুকূলে ১৬ কোটি টাকা। একইভাবে আমিন কোর্ট কর্পোরেট শাখার ৪ গ্রাহক প্রতিষ্ঠান ঋণের নামে নিয়েছে প্রায় সাড়ে ৫৪ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানগুলো হল- মেসার্স প্যান্ডোরা ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের অনুকূলে ৬ কোটি টাকা, মেসার্স বেস্ট ট্রেড লিংকের অনুকূলে সাড়ে ২৪ কোটি, মেসার্স রেদোয়ান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের অনুকূলে ১৪ কোটি, ইউনি এ্যালায়েন্স জুট ইন্ডাস্ট্রিজের অনুকূলে ১০ কোটি টাকা। এসব ঋণের পুরোটাই এখন আদায় অনিশ্চিত হয়ে মন্দ খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্রেডিট ডিভিশন-১ এর গ্রাহক প্রতিষ্ঠান মেসার্স লীনা পেপার মিলসের অনুকূলে প্রায় সাড়ে ৪৪ কোটি টাকা, ঢাকার চক বাজার শাখার গ্রাহক প্রতিষ্ঠান মেসার্স শহীদ স্টোরের অনুকূলে ১ কোটি টাকা, গ্রিনরোড কর্পোরেট শাখার গ্রাহক প্রতিষ্ঠান মৌরিশাস ইন্টারকন্টিনেন্টালের অনুকূলে ৩৪ কোটি টাকা, কক্সবাজার শাখার গ্রাহক প্রতিষ্ঠান মেসার্স কর্ণফুলী সি ফুডসে অনুকূলে সাড়ে ৪ কোটি, পুরানা পল্টন কর্পোরেট শাখার গ্রাহক প্রতিষ্ঠান মেসার্স গ্লোবাল জুট ইন্ডাস্ট্রিজের অনুকূলে প্রায় ১২ কোটি, শান্তিনগর শাখার গ্রাহক মোসাম্মৎ তাহমিনা ইসলামের অনুকূলে প্রায় সাড়ে ৮ কোটি, সদরঘাট কর্পোরেট শাখার গ্রাহক প্রতিষ্ঠান মেসার্স জুয়েল ক্লথ স্টোরের অনুকূলে দেড় কোটি, বরগুনা শাখার গ্রাহক প্রতিষ্ঠান এমআর ট্রেডিং কোংয়ের অনুকূলে প্রায় ৬৫ কোটি, ঢাকার ওয়াসা কর্পোরেট শাখার গ্রাহক প্রতিষ্ঠান এ্যাপোলো ফার্মাসিউটিক্যালস ল্যাব. লিমিটেডের অনুকূলে প্রায় ৩ কোটি, ঢাকার শ্যামলী শাখার গ্রাহক প্রতিষ্ঠান মেসার্স ডিজিটাল ব্রিকস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের অনুকূলে প্রায় ৬ কোটি টাকার ঋণ অনিয়ম করা হয়েছে। এছাড়া পুরাতন গাড়ি ঠিক করার নামে প্রায় ২০ লাখ টাকার নয়ছয় করা হয়। যেখানে সরকার নির্ধারিত হার উপেক্ষিত হয়েছে। একইভাবে কম্বল ক্রয়ের নামে অনিয়ম করা হয়েছে প্রায় দেড় কোটি টাকার। পাশাপাশি ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গৃহনির্মাণ ঋণ দিয়েও আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে ব্যাংকটি।
No comments